আল-কুরআনের নির্দেশনা

ইসলামে তাসাউফ তথা শরীয়তের পাশাপাশি তরীকত হাকীকত ও মারেফাত অর্জন এবং সে জন্য পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ একটি অত্যাবশকীয় বিষয় যা কোরআন হাদীছ ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা সাব্যস্ত।

এ প্রসঙ্গে প্রথমে আমি মহান কোরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক বলেন –

لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم يتلوا عليهم أيته يزكيهم و يعلمهم الكتب والحكمة و ان كانوا من قبل لفى ضلل مبين-

(লাকাদ মান্নাল্লাহু আলাল মু’মিনীনা ইঁজ বা’আছা ফীহিম রাছুলাম মিন আনফুছিহিম ইয়াতলু আলাইহিম আ-ইয়াতিহী ওয়া ইয়ূজাক্কিহিম ওয়া ইয়ূ আল্লীমুহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাহ ওয়া ইন কানু মিন কাবলু লাফী দ্বালা-লিম মুবীন)।

অর্থাৎ, মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাকের বড়ই ইহসান যে তাদের মধ্যে হতে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহ পাকের আয়াতগুলো তেলায়াত করে শুনাবেন, তাদেরকে তাজকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন এবং কিতাব ও হিকমত (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান শিক্ষা দিবেন। যদিও তারা পূর্বে হেদায়েত প্রাপ্ত ছিল না। (সূরা আল এমরান, আয়াত-১৬৪)

অনুরূপভাবে, সুরা বাকারা’র ১২৯ ও ১৫১ নং আয়াত শরীফে উপরোক্ত আয়াত শরীফের সমার্থবোধক আয়াতে কারীমার উল্লেখ আছে। মূলতঃ উল্লেখিত আয়াত শরীফে বিশেষভাবে চারটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে: তন্মধ্যে আয়াত শরীফ তেলাওয়াত করে শুনানো এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া, এ তিনটি বিষয় হচ্ছে এলমে জাহির বা ইলমে ফিকাহ এবং ইলমে মারেফতের অন্তর্ভুক্ত। যা এবাদাতে জাহের বা দ্বীনের যাবতীয় বাহ্যিক হুকুম আহকাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন যাপনে হালাল কামাই করার জন্য প্রয়োজন। আর চতুর্থ হচ্ছে তাজকিয়ায়ে “ক্বলব”, অর্থাৎ, অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা। মুফাসসিরীনে কিরামগণ “ইউযাক্কীহিম”-এর ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ তাফসীরের কিতাব, যেমন তাফসীরে জালালাইন-কামালাইন, বায়হাকী, ইবনে কাছীর, রুহুল বয়ান, তাফসীরে মাযহারী, মা’রেফুল কোরআন-সহ আরও অনেক তাফসীরে তাজকিয়ায়ে ক্বলব বা অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধ করাকে ফরজ বলেছেন এবং তজ্জন্যে এলমে তাসাউফ অর্জন করাও ফরজ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাসসিরে ফকিহুল উম্মত হযরত মাওলানা শায়খ ছানাউল্লাহ পানি পথি (রহ:) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে মাযহারী’-তে উল্লেখ করেন, যে সকল লোক ইলমে লা-দুন্নী বা ইলমে তাছাউফ হাছিল করেন তাঁদেরকে সূফি বলে। তিনি ইলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ আইন বলেছেন। কেননা, ইলমে তাছাউফ মনকে বা অন্তঃকরণকে গায়রুল্লাহ হতে ফিরিয়ে আল্লাহ পাকের দিকে রুজু করে দেয়। সর্বদা আল্লাহ পাকের হুজুরী পয়দা করে দেয় এবং ক্বলব্ বা মন থেকে বদ খাছলত-সমূহ দূর করে নেক খাছলত-সমূহ পয়দা করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেয়।

মূলতঃ শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফত, এ সবের প্রত্যেকটি-ই কোরআন সুন্নাহসম্মত এবং তা মানা ও বিশ্বাস করে কার্যে পরিণত করা কোরআন-সুন্নাহ’র-ই নির্দেশের অর্ন্তভুক্ত।

আল্লাহপাক তাঁর কালাম পাকে এরশাদ করেন –

لكل جعلنا منكم شرعة و منهاجا “লি-কুল্লিন-জ্বায়াল না মিনকুম শির’আতাউ ওয়া মিনহাজ”।

অর্থাৎ, আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি জীবন বিধান বা শরীয়ত, অপরটি তরীকত-সম্পর্কিত বিশেষ পথ নির্ধারণ করে দিয়েছি। (সূরা মাইয়িদা, আয়াত ৪৮)

আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে আরও এরশাদ করেন –

و ان لواستقاموا على الطريقة- (ওয়া আল লাওয়িস্তেকামু আলাত তারীকাতে- সূরা জ্বিন আয়াত ১৬)

অর্থাৎ, তারা যদি তরীকতে (সঠিক পথে) কায়েম থাকতো।

অতএব, তরীকত শব্দটি কোরআন শরীফে রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, উক্ত শিক্ষা বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এমন কোনো কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া, যিনি ফয়েজ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এখন প্রশ্ন হলো, এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয়, আর তা লাভ করার মাধ্যম বাইয়া’ত হয়, তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কী করে?
বস্তুতঃ পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হতে হবে। এটা মহান আল্লাহ পাকের কালামে অসংখ্য আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত। যদি এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহাজ্ঞানী ব্যক্তিবর্গগণ নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য না মানেন, তবে কার কী বলার আছে। তাদেরকে যতোই বোঝানো হউক না কেন, কিছুতেই তারা বোঝার চেষ্টা করবে না; বা বুঝতে সক্ষম হয় না। তাদের ক্বালবে সীলমোহর মারা আছে।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে এরশাদ করেন –

ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻛُﻮﻧُﻮﺍ ﻣَﻊَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ

(ইয়া আইয়্যুহাল্লাজীনা আ-মানুত্তাক্কুলা ওয়া কুনু মা’আছ্ছাদিকীন)।

অর্থাৎ, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় করো, আর ছাদেকীনদের সঙ্গী হও” (সূরা তওবা, আয়াত-১১৯)। এ আয়াত পাকে আল্লাহ পাক মূলতঃ পীর-মাশায়েখগণের সঙ্গী বা সোহবত এখতিয়ার করার কথা বলেছেন। কারণ হক্কানী মুর্শিদগণ-ই হাকীকি ছাদেকীন।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তা’আলা কোরআন শরীফের প্রথম সূরাতেই শিখিয়ে দিচ্ছেন –

ﺍﻫْﺪِﻧَﺎ ﺍﻟﺼِّﺮَﺍﻁَ ﺍﻟْﻤُﺴْﺘَﻘِﻴﻢَ ﺻِﺮَﺍﻁَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻤْﺖَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ

অর্থাৎ, আমাদের সরল সঠিক পথ [সীরাতে মুস্তাকিম] দেখাও। তাঁদের পথ যাঁদেরকে তুমি নিয়া’মত দান করেছো। {সূরা ফাতিহা, ৬-৭}

সূরায়ে ফাতিহায় মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেছেন, সেটাকে সাব্যস্ত করেছেন সীরাতে মুস্তাকিম।

আর তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা হলেন –

ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻢَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻴِّﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺼِّﺪِّﻳﻘِﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺸُّﻬَﺪَﺍﺀِ ﻭَﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ

অর্থাৎ, যাদের ওপর আল্লাহ তা’আলা নিয়ামত দিয়েছেন, তাঁরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও নেককার বান্দাগণ। {সূরা নিসা, ৬৯}

এ দু’আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে, নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, আর নেককারগণ তথা আল্লাহ’র অলীগণ।যাঁদের শানে আল্লাহ্‌ নিজেই ঘোষণা দেন –

ألاَ اِنَّ اَولِياَء اللهِ لاَ خَوفٌ عَلَيهِم وَلَاهُم يَحزَنُون-

অর্থাৎ, সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহ’র অলী বা বন্ধুগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁদের কোনো চিন্তা-পেরেশানী নেই। (সূরা ইউনূস, ৬২)

আর ওই সকল প্রিয় বান্দাদের পথ-ই সরল সঠিক তথা সীরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ, তাঁদের অনুসরণ করলেই সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলা হয়ে যাবে। যেহেতু আমরা নবী দেখিনি, দেখিনি সিদ্দীকগণও, দেখিনি শহীদদের। তাই আমাদের সাধারণ মানুষদের কুরআন সুন্নাহ থেকে বের করে সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলার চেয়ে একজন পূর্ণ শরীয়ত-তরীকতপন্থী হক্কানী বুযুর্গের অনুসরণ করার দ্বারা সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলাটা হবে সবচেয়ে সহজ। আর একজন শরীয়ত সম্পর্কে প্রাজ্ঞ আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করার নাম-ই হল পীর-মুরিদী বা তাসাউফ অর্জন ও বাইয়া’ত গ্রহণ।

আল্লাহ পাক তাঁর পাক কালামে আরো এরশাদ করেন —

يا ايها الذين امنوا وابتغوا اليه الوسيلةَ وَ جَاهِدُوا فِى سَبِيلِهَ لَعَلَّكُم تُفلِحُون-

(ইয়া আইয়্যূলহাল্লাজীনা আ-মানুত্তা কুল্লাহা অবতাগু ইলাইহিল অছিলাতা অ জ্বা-হিদু ফি ছাবিলিহী লা’আল্লাকুম তুফলিহুন)। অর্থাৎ, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহপাককে ভয় করো, আর তাঁর সন্তষ্টি লাভের জন্য উছিলা গ্রহণ করো (সুরা মায়িদা, আয়াত-৩৫)।

মুফাসসিরীনগণ বলেন, উল্লেখিত আয়াত শরীফে বর্ণিত উছিলা দ্বারা তরীকতের মাশায়েখগণকে বোঝানো হয়েছে। যেমন তাফসীরে রুহুল বয়ানে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে -‘আল ওয়াসলু লা ইয়াহছিলু ইল্লা বিল উছিলাতে ওয়াহিয়া ওলামায়ে মুহাক্কেকীনা ওয়া মাশায়েখুত তরিকত’, অর্থাৎ, উক্ত আয়াতে উছিলা ছাড়া উদ্দেশ্যকে (আল্লাহ্‌কে) লাভ করা যাবেনা, আর সে উছিলা হলো মুহাক্কীক আলেম বা যিনি তরীকতের শায়খ বা পীর। যদিও অনেকে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান সদকা, জিহাদ ইত্যাদিকে উছিলা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাকিকতে পীর-মাশায়েখগণই হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম উছিলা। কারণ পীর-মাশায়েখগণের কাছে বাইয়া’ত হওয়া ছাড়া তাজকিয়া নাফস বা আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয় না। আর আত্মশুদ্ধি ব্যতিরেকে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ, তাবলীগ কোনো কিছুই আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয় না বা নাজাতের উছিলা হয় না।

তাই দেখা যাবে অনেক লোক নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান ছদকা, জিহাদ, তাবলীগ ইত্যাদি করেও জাহান্নামে যাবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেন,فويل للمصلين (ফাওয়াইলুল্লিলমুছাল্লিন); অর্থাৎ, মুসুল্লীদের জন্য জাহান্নাম (সূরা মাউন, আয়াত-৭)। কোন মুসুল্লী জাহান্নামে যাবে – যে মুছল্লী তাজকিয়ায়ে নাফসের মাধ্যমে অন্তর থেকে রিয়া দূর করে “ইখলাছ” হাছেল করেনি, তাই সে মানুষকে দেখানোর জন্য নামাজ আদায় করছে। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করেনি। আল্লাহ বলেন, “আল্লাজিনা হুম ইউরা-উন”। অর্থাৎ, তারা ওই নামাজি যারা রিয়ার সহকারে নামাজ আদায় করেছে (সূরা-মাউন, আয়াত-৬)।
কামেল পীর-মুর্শিদের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন –

من يهد الله فهو المهتد و منيضلل فلن تجد له وليا مرشدا-

(মাই ইয়াহদিল্লাহু ফাহুয়াল মুহতাদে ওয়ামাই ইয়ুদ্বলিল ফালান তাজিদালাহু ওলিইয়্যাম মুর্শেদা)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক তাকে হেদায়ত দেন, আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ় থাকে সে কখনও অলিয়ে কামেল মুর্শিদ খুঁজে পাবে না (সূরা-কাহাফ, আয়াত-১৭)। উক্ত আয়াত শরীফের দ্বারা মূলতঃ এটাই বোঝানো হয়েছে যে ব্যক্তি কোনো কামেল-মোকাম্মেল পীর সাহেবের কাছে বাইয়া’ত হয়নি, সে ব্যক্তি গোমরাহ।

আল্লাহ্‌ পাক আরও মুর্শিদের আনুগত্যের বিষয়ে এরশাদ করেন –

أَطِيعُوا الله وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِى الآَمرِ مِنكُم-

অর্থাৎ, আনুগত্য করো আল্লাহ’র, আনুগত্য করো রাসূলের এবং যারা তোমাদের মধ্যে হুকুমদাতা। (সূরা নিসা, আয়াত নং ৫৯)

উক্ত আয়াতে কারীমায় ‘ তোমাদের মধ্যে যারা হুকুমদাতা (উলিল আমর)’ দ্বারা শরীয়ত ও তরীকতের আলেমকে বোঝানো হয়েছে। এটাই বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মত।

আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন- يوم ندعوا كل اناس بامامهم অর্থাৎ, সেই দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমামের (শায়খের) নামে আহ্বান করবো। (সূরা বনি ইসরাঈল)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে “আ’রায়েসুল বয়ান”-এ উল্লেখ রয়েছে, “ওয়া ইয়াদ’উল মুরীদিনা বে আসমায়ে মাশায়েখেহীম”। অর্থাৎ, হাশরের দিন প্রত্যেক মুরীদকে ডাকা হবে যার যার শায়খ বা পীরের নামে। তাই পীরের দলভুক্ত হয়ে আল্লাহ’র দরবারে হাজিরা দিতে হবে।

বাইয়াত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা
 
“বাইয়া’ত” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, “বাইয়ু’ন” শব্দ থেকে।“বাইয়ু’ন” শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “ক্রয়-বিক্রয়”। এখানে এই “ক্রয়-বিক্রয়” মানে হচ্ছে আমার আমিত্বকে আল্লাহর রাহে রাসূল (দ:) বা নায়েবে রাসূলের কাছে কোরবান করে দিলাম, বিলীন করে দিলাম, বিক্রি করে দিলাম। আমার আমিত্ব, আমার যতো অহংকার আছে, অহমিকা আছে, আমি আমি যতো ভাব আছে, সমস্ত কিছু আল্লাহর রাসূল (দ:) বা নায়েবে রাসূলের কাছে আল্লাহর রাহে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করে দেয়া, কোরবান করে দেয়া, বিক্রি করে দেয়া, এবং পক্ষান্তরে, রাসূল (স:)-এর কাছ থেকে কোরআন সুন্নাহ-ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা খরিদ করে, সমস্ত উপাসনার মালিক আল্লাহ, এবাদতের মালিক আল্লাহ, কুল মখলুকাতের মালিক আল্লাহ, এই দৃঢ় ঈমানে ঈমানদার হয়ে যাওয়া, এটাকেই বলা হয় বাইয়াত বা “ক্রয়-বিক্রয়”।

আল্লাহ্‌ রাব্বুল ইজ্জত এরশাদ করেন –

آَ نَّ اللهَ اَشتَرَى مِنَ المُؤمِنِينَ اَنفُسَهُم وَ اَموَالَهُم بِاَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِى سَبِيلِ اللهِ فَيَقتُلُونَ وَ يُقتَلُونَ وَعدَا عَلَيهِ حَقَّا فِى التَّورة وَالاِنجِيلِ وَالقُرأنِ وَ مَن اَوفى بِعَهدِهِ مِنَ اللهِ فَاستَبشِرُوا بِبَيعِكُمُ الَّذِى بَايَعتُمْ بِهِ وَ ذًالِكَ هُوَ الْفًوْزُ الْعَظِيمُ-

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মু’মিনদের থেকে তাদের জান ও মাল এর বিনিময়ে যে, অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, কখনও হত্যা করে এবং কখনও নিহত হয়। তাওরাত ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আল্লাহর চাইতে নিজের ওয়াদা অধিক পালনকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আনন্দ করো তোমাদের সে সওদার জন্য যা তোমরা তাঁর সাথে করেছ। আর তা হলো মহা সাফল্য। (তাওবা:১১১)

لَقَد رَضِىَ الله عَنِ المُؤمِنِينَ اِذ يُبَايِعُونَكَ تَحتَ الشَّجَرَةِ-

অর্থাৎ, হে রাসূল! আল্লাহ মু’মিনদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার কাছে বাইয়া’ত হচ্ছিল। (সূরা ফাতহা : ১৮)

* যে ব্যক্তি তার ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) পূর্ণ করবে এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করবে, সে আল্লাহ পাকের প্রিয়জন হবে। আর নিশ্চিতভাবে আল্লাহ পাক মুত্তাকীদের ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান: ৭৬)

o ﺇِﻥَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻧَﻚَ ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻥَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻳَﺪُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﻮْﻕَ ﺃَﻳْﺪِﻳﻬِﻢْ

অর্থাৎ, হে রাসূল! যেসব লোক আপনার কাছে বাইয়া’ত হচ্ছিল, তারা আসলে আল্লাহর কাছেই বাইয়া’ত হচ্ছিল। তাদের হাতের ওপর আল্লাহর (কুদরতের) হাত ছিল। (সূরা ফাতহা-১০)

يَاايٌهَا النَّبِىٌّ اِذا جَاءَكَ المُؤمِنتِ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌْﻧَﻚَ-

অর্থাৎ, হে রাসূল (দ:)! যে সকল মু’মিন মহিলারা আপনার কাছে বাইয়াত হওয়ার জন্য আসে (মুরিদ হওয়ার জন্য আসে), তাঁদেরকে আপনি বাইয়া’ত দান করুন। (সূরা মুমতাহানা: ১২)

অতএব, আত্মশুদ্ধি ও এলমে তাছাউফ অর্জন করা যেহেতু ফরজে আইন, আর কামেল পীর-মাশায়েখ ছাড়া এলমে তাছাউফ বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়, সেহেতু একজন কামেল পীর-মুর্শিদ অন্বেষণ করে বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ। এটাই গ্রহণযোগ্য, বিশুদ্ধ ও দলীলভিত্তিক ফতওয়া। এর বিপরীত মত পোষণকারীরা বাতিল ও গোমরাহ।