আহলে বাইত

 

আহলে বাইত কি ?

আহলে বাইতের মর্যাদা

গাদিরে খুমের ঘটনা

আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা

আহলে বাইত কি ?

‘আহল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ- সদস্য, অধিকারী ইত্যাদি। ‘বাইত’ শব্দের অর্থ- ঘর, গৃহ ও পরিবার। সুতরাং আহলে বাইত শব্দের অর্থ- পরিবারের সদস্য। পারিভাষিক অর্থে- নবী সাঃ এর কন্যা হযরত ফাতেমা যাহরা রাঃ, জামাতা হযরত আলী রাঃ, দুই দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন রাঃকে রাসূল সাঃ এর আহলে বাইত বলা হয়।

আহলে বাইতের মর্যাদা

রাসূল পাক সাঃ এর পরিবারের মধ্যে ইমাম আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী মুরতাজা রাঃ, হযরত মা ফাতিমা যাহরা রাঃ, ইমাম হযরত হাসান রাঃ ও ইমাম হযরত হোসাইন রাঃ আহলে বাইতের সদস্য। রাসূল পাক সাঃ তাঁদেরকে আহলে বাইত হিসাবে ঘোষণা করেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই রাসূল পাক সাঃ এর বংশধারা এবং ইসলামের মূলধারা প্রবাহিত। তাঁদের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে রাসূল পাক সাঃ এর শাফায়াত এবং মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য। অন্যদিকে সূফীবাদ হলো আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা। সূফীবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করা। আল্লাহ পাক যাঁকে ভালবাসেন এবং যাঁর আত্মাকে পবিত্র করে দিয়েছেন তিনিই প্রকৃত সূফী। আর আত্মাকে পবিত্র করার মাধ্যম হলেন আল্লাহর প্রিয় হাবীব পাক সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতের অনুসরণ। তাই মাশায়েখে কেরামগণ সর্ব্বদা আল্লাহর রাসূল সাঃ ও তাঁহার আহলে বাইতের অনুসরণ করেন। আল্লাহর দিক হতে তাঁদেরকে বিশেষ ইস্তেকামত বা স্থিরতা দান করা হয়। তাই সূফী সাধক শামসুল উলামা হযরত মাওলানা শাহ সূফী উল্লাহ রাঃ বলেছেন :

“আগর কেসিকো তাসলিম ও রেযা কা সহীহ মাকাম দেখনা মাকাসুদ হো

তো ও ময়দানে কারবালা কে র্যারাত কা সায়ের করে।”

অর্থাৎ : যদি কাহারও তসলিম ও রেযার সঠিক অবস্থান দেখা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে যেন কারবালার ময়দানের ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র বস্তু সমূহ পর্য্যবেক্ষণ করে।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন,

ইন্নমা ইউরীদুল্লাহু লিইউযহিবা আনকুমুর রিজসা আহলাল বায়তি ওয়া ইউতাহহিরাকুম তাতহীরা

অর্থ : “ হে নবীর আহলে বাইত! আল্লাহ কেবল চান আপনাদের হতে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূর করতে এবং সম্পূর্ণরূপে পূত পবিত্র রাখতে”     (সূরা আহযাব, আয়াত : ৩৩)

এই জন্যই এমন ধরণের গুণের অধিকারী অলি আল্লাহ ও সুফিয়ায়ে কেরামগণ আল্লাহর রেযামন্দী ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন। অসংখ্য বিপদ-আপদের সম্মুখীন হয়েও তাঁরা আল্লাহর রেযামন্দীর জন্য ব্যাকুল ছিলেন এবং অহরহ আল্লাহর জন্যই সমর্পিত চিত্ত থাকতেন। কারণ, তাঁদের দর্শনই হল “যেখানেই থাক না কেন আল্লাহর সঙ্গে থাক।”

যারা নবী করিম সাঃ এর আহলে বাইতের অনুসারী না হয়ে তাঁদের কষ্ট প্রদান ও ধ্বংস কবার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, সেই এজেদি মুসলমানদের কর্ম্মধারা ও বংশধর আজও বিভিন্ন দেশে ছড়ায়ে ছিটায়ে আছে। তারা নানা বেশে ইসলামের নামে নিরীহ মুমিন মুসলমান ও সর্ব্ব সাধারণকে ধোঁকা দিয়া তাদেরকে নিজেদের দলভুক্ত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

এই ভ্রান্ত আকীদার আলেমরা আল্লাহ পাকের পেয়ারা হাবীব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ এর রওজা মোবারক জেয়ারত, তাঁর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ, মিলাদ শরীফ ও কিয়াম করাকে বেদাত ও বেশরা বলে থাকে। তারা সাধারণ মানুষকে আশুরা পালন করা ও তাজিয়া মিছিল করা হতে বিরত রাখায় চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাঁরা কোন ধরনের মুসলমান ও রাসূল পাক সাঃ এর আশেক তা অনেকেই বুঝতে পারে না। তাদের পিছনে অনেকেই অর্থ যোগান দেয়, তাদের অর্থনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েকটি টিভি চ্যানেল। যার কারণে তাদের প্রচার প্রচারণাও বেশি হয়। কিন্তু যারা প্রকৃত পক্ষে আহলে বাইতের অনুসারী তাদের প্রচার প্রচারণা তেমন হয় না। তাদের নেই কোন টিভি চ্যানেল। তাই এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া অতি জরুরী।

আমি এ প্রসঙ্গে নাহাজুল বালাগা’র উল্লেখ আছে, আমরা (আহলে বাইত) মাঝখানের বালিশের ন্যায়। যে পেছনে পড়ে রয়েছে তাকে তা পেতে হলে আগায়ে আসতে হবে এবং যে অতিক্রম করে গিয়েছে তাকে এর নিকটে ফিরে আসতে হবে।

সূফীবাদের অনুসারীগণ রাসূল পাক সাঃ এবং তাঁর আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়ার কারণে তারা শিয়া-সূন্নীর মতপার্থক্য করতেন না। বরং তাঁরা বলতেন যারা রাসূল পাক সাঃ এর আহলে বাইতকে ভালবাসে তারাই প্রকৃত ইসলামের অনুসারী। তাই আওলাদে রাসূল সাঃ হযরত সুরেশ্বরী রাঃ দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দরবার শরীফে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য্যরে সহিত নিয়মিত আশুরা উদযাপন করতেন। মহররম আসলেই তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ দেখলে মনে হত তিনি যেন শিয়া হয়ে গিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যে মাঝে মধ্যেই বলতেন, রাসূল সাঃ এর আহলে বাইতকে ভালবাসলেই যদি শিয়া হয়ে যায়, তবে আমি শ্রেষ্ঠ শিয়া।

এই ভাবে তিনি রাসূল সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতকে ভালবাসতেন ও অনুসরণ করতেন এবং ভক্ত-মুরিদগণকেও এই নির্দেশ দিতেন। তিনি বলতেন আহলে বাইতের পথ মোটেও সহজ নহে। হযরত ইমাম হাসান রাঃ ও ইমাম হোসাইন রাঃ এই পথেই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই এই পথে চলতে হলে নানা বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখিন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই সম্পর্কে ইমাম হযরত আলী রাঃও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। নাহাজুল বালাগা’য় উল্লেখ করা হয়েছে, আহলে বাইতদের যারা ভালবাসে তাদেরকে দুঃখ দুর্দশা-লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-উৎপীড়ন-যন্ত্রণা পোহাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘হে রাসূল বলুন, তোমাদের কাছে রিসালাতের বিনিময়ে আমার নিকটাত্মীয়গণের প্রতি সৌহার্দ্য, ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই চাই না।” (সূরা শুরা, আয়াত : ২৩)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, আমি নবী সাঃ কে জিজ্ঞাসা করি যে, আপনার বংশধর কারা? যাঁদের ওপর মুসলমানদের ভালবাসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তখন তিনি বললেন, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন। তাছাড়া, এ আয়াত নাজিল হবার পর সাহাবাগণ নবী সাঃকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, কারা আপনার নিকটাত্মীয়, যাঁরা আপনার দুয়ারী জিন্দেগীর বিশাল ব্যাপক কর্মকা-ের বিনিময় স্বরূপ? উত্তরে হাবীবে খোদা সাঃ বলেন, আলীয়্যুন ওয়া ফাতেমা ওয়া আবনাহুমা, অর্থাৎ আলী, ফাতেমা ও তাঁদের সন্তানগণ।

সূফীবাদের অনুসারীগণ দুনিয়াদারীর মায়া ও লোভ লালসা ত্যাগ করে আল্লাহর ধ্যানে তাঁর জিকির ও তসবিহ পাঠের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করতে পছন্দ করে। তারা যখনই সময় পান তখন নবীর প্রতি দরূদ-সালাম পেশ করে থাকেন। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নির্দেশ দান করেছেন,

অবশ্যই আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাদের নিয়ে নবীর প্রতি দরূদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করতে থাক এবং উত্তম উপায়ে সালাম পেশ কর। (সূরা আহযাব, আয়াত : ৫৬)

এ আয়াত নাজিলের পর সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাঃ এর কাছে গিয়ে বললেন, হুজুর কিভাবে আপনাকে সালাম দিতে হয় জানি: কিন্তু কিভাবে আপনার প্রতি দরূদ পেশ করতে হয় এবং উত্তম উপায়ে সালাম পেশ করতে হয়, তা জানি না। তখন তিনি তাঁদেরকে দরূদ পেশ করা শেখালেন। যার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

অন্য একটি হাদিসে রাসূলে করিম সাঃ বলেছেন, আমার ওপর অসম্পূর্ণ দরূদ পড়ো না। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল : হে নবী সাঃ অসম্পূর্ণ দরূদ কেমন?

তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ বলেই থেমে যাও। তোমাদের উচিত এরূপ বলা : আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলা আলে মুহাম্মদ।

সূফীবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভ করা। সোপান ছাড়া যেমন উপরে উঠা যায় না, তেমনিভাবে রাসূলপাক সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতের শাফায়াত ছাড়া আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই সূফীগণ রাসূলপাক সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতকে আল্লাহকে পাওয়ার সোপান বলেই গণ্য করে থাকেন।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, সেদিনের কথা স্মরণ কর, যেদিন আমি সবাইকে তাদের নেতাদের সঙ্গে আহ্বান জানাবো, অতঃপর যাদের ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে, তখন তারা (সন্তুষ্ট মনে) তাদের আমলনামা পড়তে থাকবে এবং তাদের প্রতি তিলমাত্র জুলুম করা হবে না।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৭১)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এই আয়াত প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ কেয়ামতের দিন শ্রেষ্ঠ নেতা হযরত আলী রাঃ ও অন্ধকারে আলোকবর্তিতাস্বরূপ হযরত হাসান ও পুণ্যবানের প্রতীক হযরত হোসাইন রাঃকে ডাকবেন। আর তাঁদের বলা হবে যে, তোমরা তোমাদের বন্ধুজনসহ পুলসিরাত পার হয়ে যাও এবং নির্দ্বিধায় জান্নাতে প্রবেশ কর। অতঃপর মিথ্যাচারীদের নেতাকে ডাকা হবে। তন্মধ্যে ইয়াজিদও থাকবে। তাকে বলা হবে, তুমি তোমার বন্ধুদের হাত ধরে নির্দ্বিধায় জাহান্নামে প্রবেশ কর। (ইমামাতুল কুরআন, পৃঃ ৩৩৯)

এ প্রসঙ্গে নবী করীম সাঃ বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী জিনিস রেখে যাচ্ছি- আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত, এ দু’টি জিনিস একে অন্যের সাথে পৃথক হবে না; যতক্ষণ না তাঁরা আমার সাথে পুলসিরাতে মিলিত হয়।(মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, ৫ম খন্ড ও তিরমিজী শরীফ)

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, তোমাদের কাছে আমার আহলে বাইত-এর উদাহরণ নূহের নৌকার সমতুল্য। যারা এ নৌকায় আরোহণ করবে, তারাই মুক্তি পাবে এবং যারা আহলে বাইত হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তারা ডুবে যাবে, অর্থাৎ ধ্বংস হয়ে যাবে।    (তিরমিজী, মুসতাদরাকে হাকিম, ৩য় খন্ড)

এ প্রসঙ্গে হুজুর সাঃ আরো বলেছেন, যে কেউ আমার মত বাঁচতে ও মৃত্যুবরণ করতে চায় এবং মরণের পর বেহেশতে বসবাস করতে চায়, তাঁর উচিত আলীকে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে গ্রহণ করা এবং আমার পর আমার আহলে বাইতকে অনুসরণ করা। কারণ তাঁরা আমার আহলে বাইত এবং আমাকে যা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাঁদেরও তাই দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাঁদেরও সে জ্ঞান ও বুদ্ধি দান করা হয়েছে, যা আমাকে দান করা হয়েছে। আমার সে সকল অনুসারীদের জন্য দুঃখ, যারা আমার আহলে বাইত ও তাঁদের মর্যাদা অস্বীকার করবে, তারা আমার সাথে সম্পর্ক ও সম্বন্ধ অস্বীকার করে। আল্লাহ যেন তাদের আমার শাফায়েত হতে লাভবান না করেন।(মুসনাদে হাম্বল, ৫ম খন্ড)

এ প্রসঙ্গে নবীজী সাঃ আরো বলেছেন, তাঁদের (আহলে বাইত) আগে যেও না, তাতে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে অথবা তাঁদের থেকে পেছনে পড় না, তাতেও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তাঁদের শিক্ষা দিও না, কারণ তাঁরা তোমার চেয়ে বেশি জানেন।

এ প্রসঙ্গে নবীজী সাঃ আরো বলেছেন, মুহাম্মাদের সন্তান (আ’লে মুহাম্মাদ)-এর স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া এবং তাঁদের প্রতি ভালবাসা হচ্ছে পুলসিরাত পার হবার উপায় এবং তাঁদের আনুগত্য হচ্ছে আল্লাহর ক্রোধ হতে রক্ষা কবচ।

এ প্রসঙ্গে নবীজী সাঃ আরো বলেছেন, যদি কেউ রুকন বা মুকামের মাঝে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে এবং তাঁর সমস্ত জীবন প্রার্থনা (নামাজ), রোযা এবং উপাসনা করে কাটায়, কিন্তু মুহাম্মদের সন্তান [আ’লে মুহাম্মদ সাঃ]-এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তবে সে নিশ্চিত দোযখে যাবে।

হযরত রাসূলে মকবুল সাঃ আরো এরশাদ করেন যে, হযরত আলী আঃ-এর মহব্বত ও অনুসরণ ব্যতীত কেউই জান্নাতে যেতে পারবে না। পুল সিরাত অতিক্রম করতে হলে হযরত আলী আঃ-এর অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হবে। (ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাত, পৃঃ ১১৬)

এ প্রসঙ্গে হযরত আহমদ বর্ণনা করেছেন : ‘রাসূলে করিম সাঃ ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের হাত ধরে বলেছেন, আমাকে ও এই দু’জন এবং এদের পিতামাতাকে ভালোবাসবে সে কিয়ামতের দিনে আমার সঙ্গে বেহেশতে থাকবে।

আজও প্রকৃত অলি-আউলিয়া, পীর-মাশায়েখগণ ইমাম হাসান রাঃ, ইমাম হোসাইন রাঃ তথা আহলে বাইতের নিশান বক্ষে ধারণ করিয়া মানুষকে প্রকৃত ইসলামের প্রতি আহ্বান করিতেছেন। যাঁহাদের কোন লোভ-লালসা পরাভূত করিতে পারে না। যেমনটি পারে নাই ইমাম হাসান রাঃ, ইমাম হোসাইন রাঃ কে।

গাদিরে খুমের ঘটনা

মহানবী সাঃ তাঁহার শেষ জীবনে হজ্জ্ব অনুষ্ঠান পালনের পর নূতন পুরাতন মুসলমানদের উদ্দেশে ভাষণ দান করিয়াছিলেন। তাহারা হিজাজের বিভিন্ন স্থান হইতে হজ্জ্ব¡ব্রত পালনের জন্য আসিয়াছিলেন। তিনি মক্কা হইতে ফিরিবার পথে মক্কা-মদিনার মধ্যবর্ত্তী স্থান জুহফা এলাকার ‘গাদিরে খুম’ নামক এক জনবসতিহীন প্রান্তরের নিকটে আসিয়া এক মূল্যবান ভাষণ দান করেন। স্থানটি ছিল একটা ক্রসরোড এবং হিজাজের লোকেরা এখান হইতে স্ব-স্ব পথে বিভক্ত হইয়া যাইত।
হিজাজের লোকেরা পরস্পর পৃথক হইবার পূর্ব্বে রাসূল সাঃ মুসলমানদের থামিবার জন্য আদেশ করিলেন। যাহারা সম্মুখে ছিল, তাহারা ফিরিয়া আসিল এবং যাহারা পশ্চাতে ছিল, তাহারা আগাইয়া আসিল। আবহাওয়া ছিল খুব গরম ও রৌদ্রোত্তপ্ত। কোথায়ও ছায়া ছিল না। মহানবী সাঃ জানাইলেন, সকলে আল্লাহর নূতন এক আদেশ শুনিবার জন্য প্রস্তুত হও।
উটের পিঠের কিছু জিনের সাহায্যে মিম্বর তৈয়ারী করা হইল। মহানবী সাঃ ঐ মিম্বরে আরোহণ করিয়া সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন :
“আমি অচিরে আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিব। আমি তোমাদের ফেলিয়া চলিয়া যাইব। আমার দায়িত্ব আছে এবং তোমাদেরও দায়িত্ব আছে। তোমরা আমার সম্পর্কে কি সাক্ষ্য দিবে?”
সমবেতরা উত্তর করিল, “আমরা সাক্ষ্য প্রদান করিতেছি, আপনি আপনার নবুয়াতের দায়িত্ব পালন করিয়াছেন এবং আপনি আপনার সর্ব্বোত্তম পদ্ধতিতে আমাদের পথপ্রদর্শন করিয়াছেন। আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন।”
মহানবী সাঃ বলিলেন,
“তোমরা কি এক আল্লাহর ইবাদত করিবার, আমার নবুয়াতের এবং শেষ বিচার দিনের যখন মৃতকে আবার জীবিত করা হইবে, তাহার সাক্ষ্য দিতেছো ?”
প্রত্যেকে উত্তর করিল, “হ্যাঁ, আমরা এমনই সাক্ষ্য দিতেছি।”
তিনি বলিলেন, “আল্লাহ আমার সাক্ষী হউন…।”
অতঃপর তিনি বলিলেন, “হে লোক সকল! তোমরা কি আমার কথা শুনিতে পাও?” তাহারা বলিল, “হ্যাঁ।” তখন সকলে চুপ হইয়া গেল এবং বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসিতেছিল না। তারপর মহানবী সাঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, এখন বল; “আমি আমার পরে যে দুইটি মূল্যবান জিনিষ রাখিয়া যাইতেছি, তাহাদের সম্পর্কে তোমরা কি করিবে?”
জনতার মধ্য হইতে একজন উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “সেই দুইটি বস্তু কি?”
মহানবী সাঃ বলিলেন, “প্রথম হইল- পবিত্র কুরআন। তোমরা কুরআন হইতে নিজেদের দূরে সরাইয়া নিও না। তাহা হইলে তোমরা বিপথগামী হইয়া যাইবে। দ্বিতীয় মূল্যবান বস্তু, যাহা আমি রাখিয়া যাইতেছি তাহা হইল- আমার আহলে বাইত। মহান আল্লাহ আমাকে জানাইয়াছেন, এই দুইটি বস্তু কখনো পৃথক হইবে না। তাহারা জান্নাতে আমার সহিত মিলিত হইবে এবং এই দুই বস্তু হইতে দূরে থাকিলে তোমরা ধ্বংস হইয়া যাইবে।”
মহানবী সাঃ তাঁহার চারপাশে তাকাইলেন যেন তিনি কাউকে খুঁজিতেছিলেন। অতঃপর তিনি আলী রাঃকে দেখিতে পাইলেন। ঝুঁকিয়া পড়িয়া আলী রাঃ এর হাত ধরিয়া তিনি তাঁহাকে উপরে তুলিয়া নিলেন। এই সময়ে উভয়ের বগলের শুভ্রতা দেখা যাইতেছিল। সমবেত জনতা তাঁহাকে দেখিল এবং চিনিতে পারিল।
এই সময়ে মহানবী সাঃ এর কণ্ঠস্বর উচ্চতর এবং স্পষ্ট হইল। তিনি ঘোষণা করিলেন, “মুমিনদের উপর তাহাদের নিজেদের হইতেও অধিকতর কর্ত্তৃত্ববান কে?”
জনতা উত্তর দিল, “আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূল এই বিষয়ে ভাল জানেন।” তিনি বলিলেন, “আল্লাহ আমার প্রভু (মাওলা) এবং আমি সকল মুসলমানের নেতা (মাওলা) এবং আমি তাহাদের মধ্যে উত্তম।” তারপর পুনরায় বলিলেন, “আমি যাহার নেতা (মাওলা) আলীও তাহার নেতা (মাওলা)।” এই কথা তিনি তিন বার বলিয়াছিলেন। কিছু কিছু বর্ণনায় এই কথা তিনি চার বার বলিয়াছিলেন বলিয়াও উল্লেখ রহিয়াছে।

আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা

এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হইয়াছে,
“কুল লা-আসআলুকুম আলাইহি আজরান ইল্লাল মাওয়াদ্দাতা ফিল কুরবা।”
অর্থ- “হে রাসূল বলুন, তোমাদের নিকট রিসালাতের বিনিময়ে আমার নিকটাত্মীয়গণের প্রতি সৌহার্দ্য, ভালবাসা ব্যতীত আর কিছুই চাহি না।” (সূরা শুরা, আয়াত : ২৩)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলিলেন, আমি নবী সাঃকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, আপনার বংশধর কাহারা? যাঁহাদের ওপর মুসলমানদের ভালবাসা বাধ্যতা মূলক করা হইয়াছে। তখন তিনি বলিলেন, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উচিত রাসূল সাঃ এর আহলে বাইতকে ভালবাসা, তাঁহাদের অনুসরণ করা। অন্যথায় রাসূল সাঃ এর শাফায়াত লাভ ভাগ্যে জুটিবে না।