ইসলামের রোকন সমূহ
।
ইসলাম
ইসলাম আল্লাহ তা’য়ালার মনোনীত ‘দ্বীন’ বা জীবন ব্যবস্থা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ কিভাবে জীবন যাপন করবে ইসলামে তার পথ নির্দেশ রয়েছে। অন্য কথায়, মানুষ যে উপায় অবলম্বন করে আল্লাহকে জানতে ও চিনতে পারে তাইকে ইসলাম বলা হয়।
ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ। তাই মানুষের মধ্যে যারা এ ইসলামকে কবুল করে বা আল্লাহ র কাছে সম্পূর্ণরূপে নিজেদের আত্মসমর্পণ করে তাদের বলা হয় ‘মুসলিম’। কেবল মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেই কেউ মুসলমান হয় না, বরং কাফের মুশরিকের ঘরে জন্ম নিয়েও যদি কেউ ঈমান আনে এবং ইসলামের সব বিধি বিধান মেনে চলে তবে সেও মুসলিম। মানুষের মধ্যে মুসলিমরা শ্রেষ্ঠ জাতি কুরআনের ভাষার “তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে যেন তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দাও আর অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো।” অন্য স্থানে বলা হয়েছে “তোমাদের মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে যেন তোমরা মানুষের কাছে সত্যের সাক্ষ্য হতে পার।”
সারকথা, কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী আল্লাহ’র দেয়া বিধি-নিষেধ মেনে জীবন পরিচালনার নামই হল ‘ইসলাম’।
ইসলাম ধর্মের মূল স্তম্ভ:
আব্দুল্লাহবিনউমার (রা:) হতেবর্ণিত।তিনিবলেন:, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
:بني الاسلام علي خمس:
شهادة ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله واقام الصلوة و ايتاء الزكاة وحج البيت و صوم رمضان
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। লা ‘ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ তথা এ কথার স্বাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সা: আল্লাহর রাসুল, নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্জ আদায় করা এবং রামাযান মাসে রোযা রাখা। সহীহবুখারী: অধ্যায়:২, হাদীস:৭
।
১. কালিমা
কালিমা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সম্বলিত কয়েকটি আরবি পংক্তির নাম। এর মাধ্যমেই ইসলামের প্রথম স্তম্ভ পূর্ণতা পায়। ইসলামে কালিমার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক । কালিমার মূল অবকাঠামো হচ্ছে বিশ্বাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যায় যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক উপাস্য নেই সে জান্নাতে যাবে।
এক. কালিমা তাইয়্যেবা
আরবি :
لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ مُحَمَّدٌ رَسُوُل اللّهِ
বাংলা উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
বাংলা অর্থ : আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।
দুই. কালিমা শাহাদৎ
আরবি :
اشْهَدُ انْ لّآ اِلهَ اِلَّا اللّهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه، وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدً اعَبْدُهوَرَسُولُه
বাংলা উচ্চারণ : আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।
বাংলা অর্থ : আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি এক। তাঁহার কোন অংশীদার নেই, এবং আমি আরও সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, নিশ্চয়ই হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহ্র প্রেরিত বান্দা ও রাসূল।
তিন. কালিমা তামজীদ
আরবি :
سُبْحَان لِلّه وَ الْحَمْدُ لِلّهِ وَ لآ اِلهَ اِلّا اللّهُ، وَ اللّهُ اَكْبَرُ وَلا حَوْلَ وَلاَ قُوَّة ِلَّا بِاللّهِ الْعَلِىّ الْعَظِيْم
বাংলা উচ্চারণ : সুব্হানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আক্বার ওয়ালা হাওলা ক্বুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল্ আলিইল্ আযীম্।
বাংলা অর্থ : মহিমা ও সকল প্রসংশা আল্লাহ্র জন্য, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান, সর্বশক্তিমান ও সর্বক্ষমতাবান। আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ নয়। তিনিই মহান।
চার. কালিমা তাওহীদ
আরবি :
لا الهَ اِلَّا اللّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيْكَ لَهْ، لَهُ الْمُلْكُ وَ لَهُ الْحَمْدُ يُحْى وَ يُمِيْتُ وَ هُوَحَىُّ لَّا يَمُوْتُ اَبَدًا اَبَدًا ط ذُو الْجَلَالِ وَ الْاِكْرَامِ ط بِيَدِهِ الْخَيْرُ ط وَهُوَ عَلى كُلِّ شَئ ٍ قَدِيْرٌ ط
বাংলা উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্ দাহু লা-সারিকা লা-হু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহা ই ওয়া উ মিতু বি ইয়া সি হিল খাইরু ওয়া-হু-ওয়া আ-লা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
বাংলা অর্থ : আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই তিনি এক তার কোন অংশীদার নেই। সমস্ত সৃষ্টি জগৎ এবং সকল প্রশংসা তাঁরই। তিনি জীবন হান করেন আবার তিনিই মৃত্যুর কারণ তার হাতেই সব ভাল কিছু এবং তিনিই সৃষ্টির সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
পাঁচ. কালিমায়ে রদ্দে কুফর
আরবি :
اللهم انی اعوذبک من ان یشرک بک شیئا واستغفرک ما اعلم به ومالا اعلم به تبت عنه وتبرأت من الکفر والشرک والمعاصی کلها واسلمت وامنت واقول ان لا اله الا الله محمد رسول الله صلی الله علیه وسلم.
বাংলা উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাহ ইন্নী আউযুবিকা মিন্ আন্ উশ্রিকা বিকা শাইআওঁ ওয়া আনা আ’লামু বিহী, ওয়া আস্তাগ্ফিরুকা লিমা আ’লামু বিহী, ওয়ামা লা-আ’লামু বিহী, তুব্তু আন্হু ওয়া তাবাররা’তু মিনাল কুফরি ওয়াশ্ শিরকি ওয়াল মায়াছী কুল্লিহা, ওয়া আসলামতু ওয়া আমান্তু ওয়া আক্বুলু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি।
বাংলা অর্থ : হে আল্লাহ্! আমি তমার নিকট আকাঙ্ক্ষা করছি যে আমি যেন কাউকে তমার সাথে শরিক না করি। আমি আমার জ্ঞাত ও অজ্ঞাত পাপ হতে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তা হতে তোবা করছি। কুফরী, শিরক ও অন্যান্য সব পাপ হতে দূরে থাকছি। এবং স্বীকার করছি যে, “আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।”
আরও দুইটি কালিমা
ঈমানে মুজমাল: “আ-মানতু বিল্লাহি কামা হুয়া বিআসমায়িহি ওয়া সিফাতিহি ওয়াকাবিলতু জামিয়া’ আহকা- মিহি ওয়া আরকানিহী’
অর্থ: আমি আল্লাহ তায়ালার প্রতি তাঁর সমুদয় নামের সহিত ও তাঁহার যাবতীয় গুণাবলীর সহিত ঈমান আনলাম। আর তাঁর যাবতীয় আদেশ ও বিধি-বিধান মেনে নিলাম।
ঈমান মুফাছছাল: “আ-মানতু বিল্লাহি ওয়ামালা- ইকাতিহী ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসুলিহি ওয়াল ইয়াওমিল আ-খিরি ওয়াল ক্বাদরি খায়রিহী ওয়া শাররিহী মিনাল্লা- হি তায়ালা ওয়াল বা’ছি বা’দাল মাওত।”
অর্থ : আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহর উপর, তাঁর ফিরিশতাগণের উপর, তাঁর আসমানী কিতাব সমূহের উপর, তাঁর রাসুলগণের উপর, পরকালের উপর এবং তাকদীরের ভাল- মন্দের উপর, যা আল্লাহ পাকের নিকট হতে হয়ে থাকে এবং মৃত্যুর পর পূনরায় জীবিত হওয়ার
।
২. সালাত (নামাজ)
সালাতের গুরুত্ব প্রসঙ্গে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ তাৎপর্য্যপূর্ণ অনেক নির্দেশনা দিয়াছেন। সালাত ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ৮২ জায়গায় সালাত কায়েমের প্রতি তাগিদ দিয়াছেন। মুসলমানের জন্য ঈমানের পরেই সালাতের স্থান।
সালাত আরবী শব্দ, ফার্সী ভাষায় ইহাকে বলা হয় নামাজ। সালাত শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে : যেমন- প্রার্থনা, স্মরণ, আশীর্বাদ, অনুগ্রহ, সুখের উপায়, মঙ্গলকারী বস্তু, উপাসনা, আরাধনা ইত্যাদি। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ মাতলাউল উলুম গ্রন্থে লিখিয়াছেন, “নামাজ একটি সর্ব্বাঙ্গীন কল্যাণকর ইবাদতের নাম। নামাজ ‘নিয়ামতে সদরে কোবরা’ তথা শাহী মালখানার চাবি। নামাজের বহির্ভাগে রহিয়াছে নবুয়াতী ফয়েজ। আর নামাজের অভ্যন্তর বেলায়েতে পরিপূর্ণ। নামাজের মধ্যে একাধারে ইবাদত, আনুকূল্য, নৈকট্য, সৌন্দর্য এবং ভ্রমণাদি রহিয়াছে। ইহাতে সাধকের সফর কার্য্যাদি বিভিন্ন অবস্থা, দোয়া, আত্ম সম্বোধন, আত্মমুখী হওয়া এবং অন্যের দিকে মনোনিবেশ না করা, কাশফের প্রদীপ দ্বারা সফর তথা মি’রাজের বিভিন্ন স্তর ও স্থান সমূহকে আলোকোজ্জ্বল করা।”
শরীয়তের পরিভাষায় যে আরাধনা-উপাসনায় নিয়ম অনুযায়ী পাক পবিত্র হইয়া আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে কিয়াম-রুকু, সেজদা ইত্যাদি করা হয় তাকে নামাজ বলে। রাসূলুল্লাহ্ সাঃ সর্ব্ব সাধারণকে এই নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়াছেন। সামাজিক ঐক্য-শৃঙ্খলা ও কল্যাণের জন্য দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত। ইহা ছাড়া পবিত্র কুরআনে সার্বক্ষণিক নামাজের প্রতিও নির্দেশনা রহিয়াছে। বলা হইয়াছে, “তাহারা স্বতন্ত্র যাহারা তাহাদের নামাজে সার্বক্ষণিক কায়েম থাকে।” (সূরা মাআরিজ- ২৩) এই সার্বক্ষণিক নামাজের প্রতি গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে মারেফাতপন্থীগণ তরীকতের দিকে অগ্রসর হন। আল্লাহর প্রেমে নিবিষ্ট চিত্তে ধ্যান-খেয়াল ও স্মরণই প্রকৃত নামাজ। আন্তরিক ভাবে যদি নামাজ সম্পন্ন করা না যায়, তবে অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গাদির নামাজ বিনষ্ট হওয়ার ধ্র“ব সম্ভাবনা থাকে। তাইতো রাসূলুল্লাহ সাঃ বলিয়াছেন, “আন্তরিকতাহীন নামাজÑনামাজ নহে।” যে নামাজে আন্তরিকতা নাই, হৃদয়ের উপস্থিতি নাই, সেই নামাজ কখনো পরিপূর্ণতা লাভ করে না।
পবিত্র কুরআনের সূরা তাহা’য় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ,
“ওয়া আকিমুুস সালাতা লিজিকরী।” অর্থাৎ আমার স্মরণার্থেই নামাজকে সুপ্রতিষ্ঠিত কর।
নামাজের মাধ্যমে হৃদয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করিতে হইবে যেন সর্ব্ব ক্ষণ সর্ব্ব মুহূর্তে আল্লাহ পাকের নাম হৃদয়ে জাগ্রত থাকে। আল্লাহ পাকের স্মরণে তাঁহারই প্রেমাগ্নিতে মনের কলুষতা পুড়াইয়া ছাই করিয়া নিজেকে আত্মাহুতি দেওয়ার নামই সত্যিকার নামাজ। শরীয়তের দৃষ্টিতে নামাজ দৈনিক পাঁচবার, আর তাহা সমাধা করিবার স্থান মসজিদ। কিন্তু তরীকতের দৃষ্টিতে নামাজ সর্ব্ব ক্ষণের জন্য এবং জীবন ব্যাপী তাহা অবিরত থাকিবে। সেই নামাজ সমাধা করিবার স্থান ক্বালব নামক মসজিদ। ক্বালব বা আত্মা মৃত্যু ও নিদ্রা হইতে মুক্ত। তাইতো সূফী সাধকগণ বলিয়া থাকেন, একটি শ্বাস পরিমাণ সময়ও আল্লাহ হইতে ভুলিয়া থাকা কাফের হওয়ার সমতুল্য। এই রূপ একনিবিষ্ট ও সর্ব্বান্তকরণে নামাজেই আল্লাহর সহিত মিরাজ হওয়া সম্ভব। এই কারণেই রাসূলুল্লাহ সাঃ বলিয়াছেন, “আস সালাতু মিরাজুল মুমিনীন।”
শরীয়তের নামাজের পাশাপাশি মারেফাতের নামাজের অনুশীলন অত্যাবশ্যক। সামাজিক শৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক উন্নয়ন সাধন ব্যতীত নামাজের শর্ত আদায় হইবে না। নামাজের শর্ত আদায় প্রসঙ্গে হযরত দাতা গঞ্জেবখশ্ রাঃ তাঁহার গ্রন্থে লিখিয়াছেন- “নামাজের দৈহিক পবিত্রতা হইল বাহ্যিক নাপাকী হইতে পবিত্র হওয়া এবং বাতেনী ও অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা হইল নফসের কামনায় গোলামী এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের মহব্বত ত্যাগ করা। নামাজে কিবলার দিকে মুখ করা জাহেরী এবং আরশে এলাহীর দিকে মনোনিবেশ করা বাতেনী পবিত্রতা। দাঁড়াইয়া নামাজ পড়িবার সামর্থ্য থাকিলে তাহা জাহেরী এবং আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়া বাতেনী শর্ত।”
বাতেনী নামাজ আল্লাহর পথে ক্রমোন্নতির মাধ্যম, আর জাহেরী নামাজ শরীয়তের বিধান। তাই তরীকত পন্থীগণ বাতেনী নামাজে মনোযোগী হইলেও শরীয়ত ত্যাগ করেন না। মহান আল্লাহর অলি শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ নিয়মিত পাঞ্জেগানা নামাজ আদায়ে অতি সতর্ক ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ভক্ত-মুরিদ ও অনুসারীগণের প্রতি পাঞ্জেগানার নামাজে ব্রতী হওয়ার নির্দেশ দান করিয়াছেন। তিনি দরবার শরীফে থাকিলে অধিকাংশ সময় মসজিদে জামাতের সহিত নামাজ আদায় করিতেন। তবে তিনি ওয়াক্তি ও জুমার নামাজের সুন্নত ও নফল নামাজ ঘরে আদায় করিতেন।
হযরত নূরশাহ রাঃ দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফ মসজিদে জামাতের সহিত ওয়াক্তি ফরজ নামাজ কিংবা জুমার ফরজ নামাজ আদায় করিয়া রওজা শরীফ বা ঘরে সুন্নত ও নফল নামাজ পড়িতেন। আমি পিতা কেবলার সহিত এই নিয়মে অনেক বার জুমার নামাজ আদায় করিয়াছি।
বর্তমানে সুরেশ্বর দরবার শরীফে নামাজের যথাযথ পরিবেশ সমৃদ্ধ মসজিদ থাকা সত্ত্বেও অনেকে স্বীয় ভক্ত-মুরিদানকে মসজিদে গিয়া জামাতের সহিত নামাজ আদায় করিতে বারণ করিয়া থাকে। বরং তাহারা ভিন্ন স্থানে জামাতের আয়োজন করিয়া থাকে। যাহা ইসলামী শরীয়ত এবং হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ও হযরত নূরশাহ রাঃ এর নীতি পরিপন্থী। কারণ, ইসলামে নামাজ আদায়, জামাতে নামাজ আদায় ও মসজিদে জামাতের সহিত নামাজ আদায়ের গুরুত্ব ভিন্ন ভিন্ন।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ স্বরচিত কিতাব সমূহে জাহেরী এবং বাতেনী উভয় প্রকার নামাজের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করিয়াছেন। তিনি পবিত্র ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে একনিবিষ্ট হৃদয়ে নামাজের শর্ত আদায়ের প্রতি তাগিদ দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন,
“নামাজের শর্ত আদি করিলে আদায়
বেগর মানসে বল নামাজ কোথায় ॥
নামাজে মানস যদি হবে দরকার
তবে সে নামাজ বটে খোদা সিদ্ধ সার ॥”
একাগ্র চিত্তে সার্বক্ষণিক নামাজ আদায়ের জন্য পীরের হাতে বায়াত গ্রহণ অত্যাবশ্যক, একই সঙ্গে জাহেরী ভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরিপূর্ণ রূপে আদায়ের জন্য পীরের দীক্ষা গ্রহণ করাও প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে লিখিয়াছেন,
“নামাজেতে খাড়া যদি খোদা করে মনে
পবনের আগে মন চলে যাবে বনে ॥
শয়তান হইতে পানা ধরিবে খোদার
পাইতে খোদার পানা পীর দরকার ॥
নতুবা শয়তান পীর হয় তা সবার
দমে দমে দাগা দেয় হেন দাগাদার ॥”
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ নামাজের বাহ্যিক দিক হইতে অভ্যন্তরীণ দিকে অধিক মনোযোগী হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, শুধু মুখে আউজুবিল্লাহ পড়িলেই শয়তান দূর হয় না। ইহার জন্য প্রয়োজন মনের কল্পনা বাসনা দূর করিয়া আল্লাহর সহিত একাত্ম হওয়া। তাহা হইলে নামাজের ফল পাওয়া যাইবে। যেমন নামাজ পড়িয়াছেন হযরত আলী রাঃ। নামাজের মধ্যে তাঁহার পা চিরিয়া বিদ্ধ তীর বাহির করা সত্ত্বেও তিনি সে সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণ বে-খবর।
এই প্রসঙ্গে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ, ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে লিখিয়াছেন-
“অতএব আলেমের কাহেলী কীর্তন
পড়ই নামাজ খালি কি করিবে মন ॥
মন যদি বনে যায় তাতে দোষ নাই
কেবল নামাজে খালি কেরাতই চাই ॥
বলে আয় আলী যবে পড়িত নামাজ
আসিত বেহুদা বাত তাঁর মন মাঝ ॥
তবে হায় ছোট বড় করহ বিচার
পড়হ আউজ তবে কেন বারে বার ॥
তবে কি আউজ তব বেহুদা কীর্তন
হায় আলী আউজে কি ছিলেন বারণ ॥
নহে নহে তিনির যে আছিল কল্পনা
যেই কালে মন পুরে ছিল না বাসনা ॥
যে কালে বিষাক্ত তীর বিন্ধিল পদেতে
কোন হেতু হইল না তীর নিকালিতে ॥
নামাজেই হেতু হল তীর খুলিবার
ফকিরী ধর্মের পরে প্রণয় তাঁহার ॥”
এই প্রসঙ্গে একই গ্রন্থে তিনি আরো লিখিয়াছেন,
“ইবলিসে দাগা হতে হয়ে গেল দূর
তেইসে খোদার পানা আউজ প্রচুর ॥
পানা পেতে মানা কোথা প্রভুর বচন
পানাহীন পড়া শুধু একথা কেমন ॥
ভ্রমেতে মানির পরে দৃষ্টি করে নাই
মৌখিক পাঁচালী শুধু কি হবে ভালাই ॥
তবে কি করিল সাঁই কোরানেতে ভুল
নামাজে কাহিলী যত তাই ফাওয়াইলুল ॥
নামাজেতে মন সিদ্ধ হইবে না যার
তাহার কারণে করে দোজখ প্রচার ॥
করার না হলে মন হবে না নামাজ
দেখহে নামাজীগণ কোরানের মাঝ ॥
প্রকাশ্য নামাজ যবে করিবে আদায়
খাড়া বসে শুয়ে কর জেকের খোদায় ॥
এহা তক কর সবে জেকের খোদার
শান্তশীল হয়ে যাবে মন একাকার ॥
এখন কায়েম কর নামাজ সকালে
ওক্ত মুকাররার এই বিহান বিকালে ॥
পাঞ্জেগানা কহে এই নামাজের তরে
এরূপ নামাজ পড়া হুকুম সবারে ॥
এছাই খোদার বাক্য আকিমুচ্ছালাত
বার বার কোরানেতে কহে এই বাত ॥”
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ নামাজের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অধিক মনোনিবেশ করিবার জন্য স্বরচিত ‘মাতলাউল উলুম’ কিতাবে লিখিয়াছেন,
“নামাজে আপন অন্তর ও নফসের প্রতি মনোযোগী হওয়ার সঙ্গে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হওয়া এবং ইহাতে কাবা, জমিন এমনকি নবী-অলিগণের প্রতিও মনোনিবিষ্ট হওয়ার প্রশিক্ষণ রহিয়াছে। নামাজের মধ্যে যে সকল জিনিষের নাম মুখে উচ্চারণ করিতে হয়, তাহাদের অর্থ-মর্মের প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হয় ও মনোযোগ দিতে হয়। এমনকি এই সবের সহিত উভয় জগতের মধ্যে যে সব বস্তু রহিয়াছে সব কিছুর নাম জপ করিতে হয় এবং ঐ গুলির প্রতি খেয়াল এবং ধ্যান রাখিতে হয়। এই সকল বিষয়ে দৃষ্টি না থাকিলে তাকে নামাজ বলা যাইবে না, বরং তাহা খেল-তামাসার শামিল।
আর যাহার অবস্থা এরূপ নহে, তাহার নামাজ অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি ব্যতীত কিছুই নহে। কারণ, দণ্ডায়মান অবস্থায় নামাজির শির উর্ধ্বালোকে এবং নূরানী দৃষ্টি জমিনে ঝলসাতে থাকে। ইহাকে সালাতের দর্পণ বলা হয়। এই দর্পণে পূর্ণ সফর প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হয়। ইহা মহাসফর। এই সফরে একবার নিমজ্জিত হইলে কিয়ামত পর্য্যন্ত তাহা হইতে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নহে। এই কিয়ামই হইল মহান অলিগণের আধ্যাত্মিক অবস্থা। তাঁহারা এক কিয়াম বা আধ্যাত্মিক হালে পুরা জীবন কাটাইয়া দেন। এই এক কিয়ামেই তাঁহাদের নামাজ সম্পন্ন হইয়া যায় এবং তাঁহাদের আহওয়াল তথা ভাবান্তর সমূহের মাধ্যমে রুকু সিজদা প্রকাশ পায়। যেমন- বৃক্ষাদির সিজদা ; তাহাদের ভাবের মাধ্যমে সিজদা সম্পন্ন হয়। রুকু, তথা উপর দিক হইতে মাথা নিচু করা সফর হইতে স্ব- স্থানে প্রত্যাবর্তন করা বুঝায়। অর্থাৎ, ইহা এই সফরে পৌঁছাইবার মঞ্জিল।
এখানেই এই সফরের ফলাফল এবং উপকারিতা অর্জন হয় এবং ‘আহওয়াল’ তথা ভাবগত সফরে মস্তক অবনত অবস্থায় যে নিয়ামত এবং বরকত রহিয়াছে, তাহাও এখানে সংগ্রহ করিতে হয়। যেমন, গাড়ী অথবা জাহাজ থামাইয়া যার যার দেনা পাওনা দিয়া অবসর হইয়া যাওয়া। কিন্তু ঐ সময় কুতুবী দর্পণে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিতে হয়। এইজন্য আপন পায়ের উভয় বুড়ো আঙ্গুলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিতে হয়। আর ঐ উভয় আঙ্গুলকে দেহের মধ্যে কুতুব বলা হয়।
এখানে কুতুবী দর্পণে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিলে আহওয়ালে কুতুবিয়া তথা কুতুবগণের ভাব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এই কারণে গাউস-কুতুবগণের দৃষ্টি সদা জমিনে নিবদ্ধ থাকে, যেন পৃথিবী ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পায়। উক্ত কারণেই চারজন কুতুব পৃথিবীর চার পাশে সদা দণ্ডায়মান থাকেন। এই চার কুতুবের ফয়েজ দেহের চার কুতুবের উপর প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ, হাত ও পায়ের চার বুড়ো আঙ্গুলের উপর থাকে, যাহাকে আরবীতে ‘এবহাম’ বলে। এই কারণে নামাজে আঙ্গুল জমিনে যুক্ত থাকে এবং খেয়াল রাখিতে হইবে যেন তাহা জমিন হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে না পারে।
মোটকথা, রুকুর ভেতরে নামাজী মুসাফির-গন্তব্যে যাত্রার পর পূর্ণ নিয়ামত গৃহে পৌঁছাইয়া আত্মিক সফরে রত হয়। অর্থাৎ, যে সফরে নফসের মি’রাজ এবং কাশফ যাহা প্রভু সত্তার বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। এইখানে “নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবলিল ওয়ারীদ” অর্থাৎ, আমরা তাহার শাহরগ হইতেও নিকটে, এই ঘোষণার মর্মার্থ পুরাপুরি প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ, এই স্তরে নৈকট্য সূত্রে একাত্মতা ঘটে এবং “ওয়া হুওয়া মাআকুম আইনামা কুনতুম” অর্থ- থাকেন তিনিও তোমাদের সহিত যথায় রহিয়াছ তোমরা। অর্থাৎ, তিনি শাহরগ হইতে নিকটতম। তাই উহাই নৈকট্য অর্জনের স্থান, যাহা ক্বালবে মুদাব্বির তথা চক্রাকার অন্তরের একেবারে মাথায় অবস্থিত।
অতএব নামাজে নিজেকে নিকট করা ভূমি সত্তার সঙ্গে স্বয়ং সম্পৃক্ত হওয়া। যার প্রকাশ ‘মোকামে মাহমুদা’, যাহা দু’ভ্রুর মধ্যস্থল তথা মূল কপাল এবং তাহা আল্লাহ দর্শনের দর্পণ। নাকের মাথা হইল রহস্যময় গোপন নালা এবং সত্যতার দর্পণ। এই জন্য সিজদায় দৃষ্টি নাকে নিবদ্ধ রাখিতে হয়। আর দুইটি সিজদা দুইটি বেলায়েতের ফলশ্র“তি। যেহেতু দ্বিতীয় বেলায়েত প্রথম বেলায়েত হইতে উত্তম। সেহেতু প্রথম সিজদা হইতে দ্বিতীয় সিজদা উত্তম। অর্থাৎ, প্রথম সিজদায় নিকটে এবং দ্বিতীয় সিজদায় নিকটতম হওয়া যায়। দূরত্ব হইতে নৈকট্য আর নৈকট্য হইতে দূরত্বের প্রয়োজন রহিয়াছে। এজন্যই নৈকট্য লাভের পর সফরে দূরত্ব ঘটায় আর এই উভয়ের মধ্যে যে মঞ্জিল রহিয়াছে তাহা একটিই। তাই রুকু একটি হইয়াছে।
একটি নৈকট্য ও সাথীত্ব লাভের শুকরিয়া স্বরূপ আর অপরটি হইলো আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই জন্য সিজদা দুইটি হইয়াছে। অতঃপর সিজদার শেষে বৈঠক উভয় দিকের মোসাহেদার ইঙ্গিত, যাহা বক্ষমধ্যে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, বক্ষমধ্যে সমগ্র জগতের জ্ঞান রহস্য বিদ্যমান। এইজন্য তাহাকে জগৎ পাত্র বলা হয়। সর্ব্ব শেষে সালামের মাধ্যমে অবসর হওয়ার অর্থ হইল অন্যের সহিত সম্পৃক্ত হওয়া। এই অবস্থায় কথা বোধগম্য হয়। অর্থাৎ, ইতিপূর্ব্বে মিরাজের পথে ছিল, এখন তাহা হইতে অবতরণ হইল। এই সালাম কোন ফেরেশতাকে এবং কোন লোককেও দেওয়া যাইতে পারে। দুই রাকাত নামাজের অর্থ হইল দুই বার নিয়ামতের ভিতর প্রবেশ করিয়া তৎসহ বাহির হইয়া আসা, আর চার রাকাত নামাজের দুই রাকাত হইলো আল্লাহর ইবাদত আর বাকি দুই রাকাত হইলো শুকরিয়া।”
নামাজের পূর্ণতা অর্জন হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সহিত মি’রাজের মাধ্যমে। মুমিনের মি’রাজ কিভাবে হইতে পারে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে তাহা বর্ণনা করিয়াছেন এইভাবে-
“মোমিনের মেয়ারাজ জান ও নামাজ
পীরের কলবে ভেদ রহিবে না বাজ ॥
নামাজেতে ফল পাই এই মানসেতে
লইবে নামাজ নূর পীর নিকটেতে ॥
তবেই পাইবে ফল খুলিবে নয়ান
কোরানের ফয়েজ পাওয়া এমনি সন্ধান ॥”
অতএব সুরেশ্বর দরবার শরীফের সকল ভক্ত-মুরিদান ও আশেকানের উচিত, হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর নির্দেশাবলী যথাযথ ভাবে অনুসরণ করা। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ব্যক্তি জীবনে নিয়মিত পাঞ্জেগানার নামাজ আদায় করিয়াছেন এবং তাঁহার অনুসারীগণকে তাহা পালন করিতে বলিয়াছেন। সুতরাং নিয়মিত নামাজ আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া প্রত্যেক ভক্ত অনুসারীর একান্ত কর্তব্য।
নামাজ আদায়ে
নূরেহকের প্রয়োজনীয়তা
দয়ালপাক হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ‘নূরেহক’ তালাশ করিবার বিষয়ে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করিয়াছেন। সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগীর মূলেই রহিয়াছে ‘নূরেহক’। নূরেহক সন্ধান করা ফরজ। তাই নামাজ পড়িবার জন্য তিনি একাগ্র চিত্তে পীর-মোর্শেদ কেবলার নিকট হইতে নূর চাহিয়া নেওয়ার কথা বলিয়াছেন।
এই প্রসঙ্গে তিনি পবিত্র ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে উল্লেখ করিয়াছেন-
“নামাজ পড়িতে যদি চাহে কোন জন
পীর হতে নূর তার চাহি যে লওন ॥
তবেই লগিবে মন পাবে তার ফল
কবুল করিবে সাঁই এইত আমল ॥”
তিনি পবিত্র ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে আরও উল্লেখ করিয়াছেন-
“কিসের নামাজ রোজা কিসের কোরান
নূরেহক বিনা তাহা সকল বেজান ॥
যাহার কলবে নূর হয়েছে রৌশন
কোরান জেকের জান তাহার কারণ ॥
মূল শূন্য বিনা নূরে কি হইবে লাভ
মৌখিক কীর্তন রিয়া সকল খারাপ ॥
“তত্ত্ব করা নূরেহক ফরজ একীন
কহিয়াছে খোদা কুনু মায়াচ্ছাদেকীন ॥
পীর ধর যথা পার, কহিয়াছে সাই
পীরের উছিলা বিনা হবে না ভালাই ॥”
নূরে হকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি আরও বলিয়াছেন-
“নূরেহক বিনা গতি নাহি ত্রিভুবনে
সে নূর সঙ্গের সাথী মরনে জীয়নে ॥”
নামাজের ফয়েজ
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ভক্ত-অনুসারীগণের প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পাশাপাশি নামাজের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি পাওয়ার উপায় সম্পর্কে বর্ণনা করিয়াছেন। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ, নামাজের হাকীকত ও ফজিলত অর্জন করিবার পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি ‘নামাজের ফয়েজ’ অধ্যায়ে বর্ণনা করিয়াছেন।
“নামাজেতে ফল পাই এই মানসেতে
লইবে নামাজ নূর পীর নিকটেতে ॥
তবেই পাইবে ফল খুলিবে নয়ন
কোরানের ফয়েজ পাওয়া এমনি সন্ধান ॥
খাড়া হও নামাজেতে করহ বন্দেগী
হইবে না হইবে না কখন রান্দেগী ॥
যতক্ষণ আছ তুমি নামাজে খোদার
আসিবে না আসিবে না কুঘটনা আর ॥
কেরাত পড়িবে যদি তাবত কোরান
হইবে না হইবে না কভু পেরেশান ॥
রুকু দিয়া দিন ভর যদি তুমি রবে
কখন না কখন না মছিবত হবে ॥
ছজুদাতে যেয়ে যদি রাখিবেন মাথা
হইবে না হইবে না কখনই ব্যথ্যা ॥
একেলা জমাত পড় ঘরেতে বসিয়া
নিজ ইমামের তব মোক্তাদি হইয়া ॥
একেলা জমাত করে পড়িবে কোরান
একেলার জন্য শত করিও বিছান ॥
একেক বিছানে কর শতেক কাতার
একেক কাতারে লোক সহস্র হাজার ॥
সহস্র জবান হবে একের জবান
একেক জবানে হবে সহস্র সন্ধান ॥
একেক সন্ধানে যদি পড়িবে নামাজ
এক এক নামাজে হবে শত মেরাজ ॥”
নামাজীদের প্রতি
হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ বলিয়াছেন, নামাজের পূর্ণাঙ্গ হাকীকত লাভের প্রথম শর্ত হইল পীরের হাতে বায়াত গ্রহণ করা। কামেল পীরের দীক্ষা ব্যতীত একাগ্র চিত্তে নামাজে মনোনিবেশ করা ও নামাজের ফয়েজ অর্জন করা সম্ভব নহে। যদি নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর দীদার লাভ বা আত্ম তৃপ্তি লাভ করা সম্ভব না হয়, তবে ঐ নামাজ শুধু শারিরীক শ্রম ব্যতীত কিছুই হইবে না। এই কারণেই যুগে যুগে সাহাবায়ে কেরাম, মহান অলি-আউলিয়াগণ ও সত্য পথের সন্ধানীগণ হাকিকী পীরের নিকট বায়াত গ্রহণ করিয়াছেন। কেবল আউজুবিল্লাহ পড়িয়া বিতাড়িত শয়তান হইতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাহিয়া দীর্ঘ সূরা-কেরাত পড়িলেই প্রকৃত নামাজ হয় না।
তাই হযরত সুরেশ্বরী রাঃ নামাজীদের প্রতি যথার্থ উপায়ে নামাজ আদায়ের পন্থা সম্পর্কে স্বরচিত ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে লিখিয়াছেন-
“আউজ পড়া হয় শয়তান কারণ
দাগা দিয়া নষ্ট যেন নাহি করে মন ॥
আল্লাজি ইউওয়াছবিছু পড়ে ছুরে নাছ
পাগলের সাঁকো লারা কহিছে খান্নাছ ॥
ওরেরে মুসল্লীগণ মৌখিক নামাজী
পাগলের সাঁকো লারা মনে পড়ে আজি ॥
ভাল কথা দাগা দিতে ভুলেছিনু আগে
স্মরণ দিয়াছ তাহা বোলাইয়া রাগে ॥
হেলাইব সাঁকো আজি মনের মতন
কেনরে আউজ তুমি পড়িলা এখন ॥
কেমন আউজ তব দেখিব এবার
এহেন মন্ত্রেতে এবে কি হয় আমার ॥
তোমার মন্ত্রেতে আমি নাহি যাব দূর
করিব মন্ত্রিকে আমি আজি সাঙ্গচুর ॥
চিরস্থায়ী আছে যার সঙ্গে অদ্ভূত
কোথায় তাহার মন্ত্রে পালাইবে ভূত ॥
সামান্য মন্ত্রেতে যদি জ্বীন ধরা যায়
তবে কেন ভূত ভয় চলনা রাহায় ॥
ভূতে দূতে কখন কি হইবে সমান
তাতেই দেখিয়া ভূত উড়িবে পরাণ ॥
আচানক ভূত দেখে তারা মারা যায়
কেমনে খান্নাছ তবে দৌড়াইবে হায় ॥
একেক খান্নাছ ভয়ে শত ভূত ধায়
কেমনে খান্নাছ তবে দৌড়াইবে তায় ॥
তোমার আউজে যদি খান্নাছ ডরিত
নামাজেতে ওছওয়াছ কভু না হইত ॥
এবাদতে দাগাদারী করে যেই জন
সামান্য চক্ষেতে যদি হ’ত নিরক্ষণ ॥
ভুরূকুটি দিতে তার হুশ হারাইত
কেমনে নামাজীগণ কেরাত পড়িত ॥
মুসল্লী কেরাতে শুধু গলা করে সার
নহে কি কেরাতে ভূত ডরিত না আর ॥
ভূতান্তি রোগীতে যদি শুনিত কেরাত
শুনিয়া শতেক ভূত যাইত তফাত ॥
পালাইবে দূরে থাক নিজে থাকা দায়
এবাদতে ভূত দৌড়া হইবে কোথায় ॥
এবাদতে দাগা দেয় নহে ছোট ভূত
দেখে তায় নামাজীর পরে যেত মুত ॥
শরীর কম্পিত কেন একেলা ঘরেতে
যখন নিরালা হয় নামাজ পড়িতে ॥
একেলা নামাজ পড় অরণ্য ভিতর
দেখিব মনেতে তব আসে কি না ডর ॥
অতএব মোজাদ্দেদ কহে সুবচন
মহাসুখী ইবলিসেরে দেখে কোন জন ॥
বলে আয় বেকারেতে কেন আছ ভাই
কহে সেই আলেমানে দিয়াছে রেহাই ॥
আলেমান বদ যারা আমার সঙ্গতি
তাহারাই আজ বটে মম কাজে গতি ॥
তবে নাকি কহিয়াছে প্রভু করতার
মনুষ্য ও জ্বীন হতে তারা দাগাদার ॥
অতএব আলেমের কাহেলী কীর্তন
পড়হ নামাজ খালি কি করিবে মন ॥
মন যদি বনে যায় তাতে দোষ নাই
কেবল নামাজে খালি কেরাতই চাই ॥ ”
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ বলিয়াছেন, সাধারণতঃ শয়তানের প্রতারণা হইতে মুক্তি লাভ করিতে আউজু বিল্লাহ পাঠ করা হইয়া থাকে। আমরা সূরা নাছ পাঠ করিয়া থাকি শয়তানের প্রবঞ্চনা হইতে রক্ষা পাইতে। তখন শয়তান বলিয়া থাকে, প্রবঞ্চনা দিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম মনে করাইয়া ভালই করিয়াছ। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ বলিয়াছেন, ইহা যেন পাগলের সাঁকো নাড়ানোর নামান্তর। তখন শয়তান আরো বেশি প্রবঞ্চনা দিতে প্রস্তুতি নেয়। সে কটাক্ষ করিয়া বলে, দেখিব তোমার আউজু বিল্লাহর শক্তি কেমন? দেখি ইহা আমার কি করিতে পারে ?
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ আরো বলিয়াছেন, যাহার অন্তরে শয়তান ঘর বাধিয়াছে মৌখিক মন্ত্রে তাহার কিছু যায় আসে না। হযরত দাতা গঞ্জেবখশ রাঃও স্বরচিত ‘কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থে এমনটিই বলিয়াছেন। বাস্তবতাও ইহাই। কারণ, সাধারণ মুসল্লীরা নামাজে সূরা ফাতিহা শুরু করিবার পূর্ব্বেই আউজু বিল্লাহ পাঠ করিয়া থাকে। তথাপি তাহাদের মন ছুটাছুটি করিয়া থাকে। এমন নামাজী প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে যাহা বলা হইয়াছে তারই কাব্যিক ভাবানুবাদ হযরত সুরেশ্বরী রাঃ স্বরচিত ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন এই ভাবে :
“ফাওয়াইলুল বলে সাঁই কোরানেতে কয়
বেনূর মুসল্লী যাবে নরকে নিশ্চয় ॥
কেননা কাহিনী জন্মে সে নূর বিহনে
উৎপত্তি হবে ছুস্তি অন্ধকার মনে ॥”
তিনি আরো লিখিয়াছেন :
“নামাজেতে মন সিদ্ধ হইবে না যার
তাহার কারণে করে দোজখ প্রচার ॥
করার না হলে মন হবে না নামাজ
দেখহে নামাজীগণ কোরানের মাঝ ॥”
‘নূরে হক গঞ্জেনূর’ কিতাবে তিনি লিখিয়াছেন :
“প্রকাশ্য নামাজ যবে করিবে আদায়
খাড়া বসে শুয়ে কর জেকের খোদায় ॥
এহা তক কর সবে জেকের খোদার
শান্তশীল হয়ে যাবে মন একাকার ॥
এখন কায়েম কর নামাজ সকালে
ওক্ত মুর্কারার এই বিহান বিকালে ॥
পাঞ্জেগানা কহে এই নামাজের তরে
এরূপ নামাজ পড়া হুকুম সবারে ॥
এছাই খোদার বাক্য আকিমুচ্ছালাত
বার বার কোরানেতে কহে এই বাত ॥”
সুতরাং মৌখিক আউজ পাঠ বা আনুষ্ঠানিক ভাবে না পড়িয়া আন্তরিকতার সহিত বিসমিল্লাহ সহ সূরা কেরাত পাঠ করিতে হইবে। আর যেই অন্তর মাঝে শয়তান বাসা বাধিয়াছে, তাহা ভাঙ্গিতে খাঁটি মোর্শেদের নিকট তালিম নিতে হইবে। মোর্শেদী তালিম ব্যতীত তাহা ভাঙ্গা সম্ভব নহে। তাই পবিত্র কুরআনেও বলা হইয়াছে, “তোমরা মাধ্যম সন্ধান কর।” অর্থাৎ শয়তানী প্রবঞ্চনা হইতে মুক্ত থাকিয়া সঠিক ভাবে আল্লাহর নিকট পৌঁছাইতে মোর্শেদে বরহক্কের বিকল্প নাই।
।
২. রোজা
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ সকলকে বলিতেন, “আল্লাহ পাকের নির্দেশিত ফরজ পালনে সকলকে সজাগ থাকিতে হইবে। তাই হযরত সুরেশ্বরী রাঃ মাহে রমজানের ফরজ রোজা নিজে যেমন পালন করিতেন, তেমনি ভক্ত-মুরিদান সহ সকলকে এই ফরজ রোজা রাখিতে গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। তিনি কেবল রমজানের ফরজ রোজাই রাখিতেন না, উপরন্তু বছরের অধিকাংশ সময়ই রোজা রাখিতেন। তবে যে কোন রোজাই চন্দ্রের হিসাবের সহিত সম্পৃক্ত হওয়ায় তিনি চন্দ্রের সঠিক হিসাব রাখিবার প্রতি সকলকে নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন।
চান্দ্র মাসের ভুল হিসাবের কারণে রোজা কম-বেশি হইবে, কিংবা যথার্থ দিবসে পালিত না হওয়ায় তাহা হইবে উপবাস মাত্র। চন্দ্রের নির্ভুল হিসাব সম্পর্কে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর নির্দেশনা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচিত হইয়াছে। তিনি উল্লেখ করিয়াছেন, রোজা রাখা প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য। কেননা রমজানের ৩০টি রোজার মাধ্যমে মানুষের ভিতর হইতে ৩০টি বুরাই দূর হইয়া তৎপরিবর্তে ৩০টি নূর হাসিল হয়।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ শরীয়ত, হাকীকত, তরীকত, মারেফাতের প্রচার ও শিক্ষার মাধ্যমে যুগান্তকারী অধ্যায় সৃষ্টি করিয়াছেন। যে কারণে তাঁহাকে জামানার মোজাদ্দেদ বলিয়া সকলেই আখ্যায়িত ও শ্রদ্ধা-ভক্তি করিয়াছেন। বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণে তাঁহার আধ্যাত্মিক যশঃ ও সুখ্যাতি বিদ্যুৎ বেগে সর্ব্বত্র ছড়াইয়া পড়িল। দলে দলে লোক আসিয়া তাঁহার জ্যোতির্ময়ী রূপ দর্শন করিয়া অভিভূত হইয়া পড়িতেন। আল্লাহ পাকের প্রেমে দিশাহারা ও পাগলপারা হইয়া তাঁহার পবিত্র চরণে আত্ম সমর্পণ করিলেন। অতঃপর তাঁহার পবিত্র হস্তে বায়াত গ্রহণ করতঃ নিজেদের জীবন স্বার্থক করিলেন। তাই আশেকানে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ও আশেকানে হযরত নূরীশাহ রাঃ এর ঈমানী দায়িত্ব হইল নামাজ আদায় ও কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে রমজানের ফরজ রোজা ও অন্যান্য নফল রোজা তাঁহার নির্দেশনা মতে আদাব ও ভক্তি সহ পালন করা।
।
৪. যাকাত
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মৌলিক ফরয ইবাদতের মধ্যে অন্যতম এবং ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক। ধনবান সম্পশালী মুসলমানদের বৎসর শেষে সম্পদের একটি নির্ধারিত অংশ আল্লাহর নির্দেশিত খাতে ব্যয় করার নামই যাকাত। ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে ঈমান, নামাজ, রোজা ধনী গরিব সকল মুসলমানদের জন্য সমান ফরয। কিন্তু যাকাত ও হজ্ব অর্থ সম্পদে সামর্থবান মুসলমান পুরুষ ও নারীর ওপর ফরয। যাকাত কুরআনের শব্দ। অর্থ- পবিত্রতা, প্রবৃদ্ধি এবং আধিক্য। পরিভাষায়- আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ কুরআনে বর্ণিত আট প্রকারের কোন এক প্রকার লোক অথবা প্রত্যেককে দান করে মালিক বানিয়ে দেয়াকে যাকাত বলে।
ইসলামে নামাজের পরেই যাকাতের স্থান। পবিত্র কুরআনে সালাত কায়েমের সাথেই যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাকাত আদায় করার মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয় আর যাকাত অনাদায়ে সম্পদ অপবিত্র থাকে এবং যাকাত আদায় করার মাধ্যমে সম্পদে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। যাকাত দরিদ্র, অভাবী, নিরন্ন ও অক্ষম জনগোষ্টীর অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
যাকাত কার ওপর ফরয ?
ইসলামী শরীয়তে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ একবছর কারো নিকট আবর্তিত হলে শতকরা ২.৫০% সম্পদের মূল্যমান আল্লাহ তা’আলার নির্দেশিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই যাকাত বলা হয়। সুতরাং যার কাছে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত একবছর গচ্ছিত থাকবে তার ওপর যাকাত আদায় করা ফরয।
যাদের ওপর যাকাত ওয়াজিব :
যাদের ওপর যাকাত ওয়াজিব তারা তিন প্রকার:
১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া।
২. যাদের সম্পদের ওপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে ফসলের ক্ষেত্রে এক বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরি নয় বরং ফসলের যাকাতের সম্পর্ক ফসল পাকার সাথে।
৩. ফলের যাকাত ওয়াজিব হয় যখন তা পরিপক্কতা লাভ করে এবং খাওয়ার উপযোগী হয়।
যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত :
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির মধ্যে একটি। যাকাত ছাড়া দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করে না। যাকাত অস্বীকার করা কুফরী। যাকাত ফরয হয় দ্বিতীয় হিজরীতে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে যাকাতের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বহু আয়াত নাজিল করেছেন। ইরশাদ হয়েছেÑ তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকু কর রুকুকারীদের সাথে। (সূরা বাকারা : ৪৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- আর ধনীদের সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার। (মায়ারিজের ২৪-২৫)
এই পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামায এবং রোজার সম্পর্ক মানুষের দৈহিক পরিশ্রম ও মনের সাথে, পক্ষান্তরে যাকাত ও হজ্বের সম্পর্ক শরীর ও অর্থের সাথে। বিশেষভাবে যাকাত ধনী বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ওপরই ফরয হয়ে থাকে। হাদীস শরীফে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘তাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে গ্রহণ করা হবে। আর তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র বা অভাবী তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।’ (বুখারী ১৪০১)
ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য রেখেই যাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত- রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়Ñ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল আর তারা নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে।’ (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবু সায়ীদ রা. বর্ণনা করেন- ‘একদা রাসূল সা. আমাদেরকে নসিহত করার সময় তিন বার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমযানের রোযা রাখবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য অবশ্যই জান্নাতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ কর’।’ (নাসায়ী)
যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ :
আল্লাহ তা’আলা কুরআনে যাকাতের অর্থ ব্যয়ে আটটি খাত উল্লেখ করেছেন। ১.ফকির, ২.মিসকিন, ৩.যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী, ৪.যাদের চিত্ত অকর্ষণ প্রয়োজন, ৫.দাসত্ব থেকে মুক্তি জন্য, ৬.ঋণগ্রস্থদের ঋণ থেকে মুক্তির জন্য, ৭.আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করে তাদের
জন্য, ৮.মুসাফিরদের জন্য এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। (সুরা তাওবা-৬০)
১. ফকির: যারা নিজে সাধারণভাবে জীবন যাপন করতে পারে না। অনেক দুঃখ-কষ্টে জীবনযাপন করে- তাদেরকে যাকাত দেয়া। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তাদের থেকে যাকাত নেয়া হবে, আর গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’
২. মিসকিন: সহায়-সম্বলহীন, হৃতসর্বস্ব ব্যক্তি যার নিকট কিছুই নেই- এমন লোকদের যাকাত দেয়া ।
৩. যাকাত আদায়ে কর্মচারী: যারা যাকাতের টাকা বা সম্পদ উসুল করার কাজে নিয়োজিত তাদের বেতন-ভাতার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা।
৪. কৃতদাসকে মুক্তকরার জন্য: কৃতদাস বা কৃতদাসীকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা।
৫. মুআল্লাফাতে কুলুব: নওমুসলিম, অমুসলিম বা কাফের সম্প্রদায়ের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা। যাতে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তাদের অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি মুহাব্বাত ভালবাসা তৈরী হয়। একমাত্র এই উদ্দেশ্য ছাড়া অমুসলিমদের মধ্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না।
৬. ঋণগ্রস্থ বক্তি : ঋণগ্রস্থ কোন ব্যক্তিকে ঋণ থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা।
৭. আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করে: ফি সাবিলিল্লাহ বলতে যারা আল্লাহর পথে বিভিন্নভাবে জিহাদরত তাদের সার্বিক সাহায্যার্থে যাকাতের অর্থ প্রদান করা।
৮. মুসাফিরদের জন্য: কোন মুসাফির ব্যক্তি পথিমধ্যে অর্থাভাবে বিপদগ্রস্থ বা অসহায় হয়ে পড়েছে। বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছার মত কোন সম্বল তার সঙ্গে নেই। এমতাবস্থায় যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা বা লোকটির জন্য যাকাতের অর্থ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ।
যাকাত আল্লাহ কেন ফরজ করলেন ?
আল্লাহর পক্ষ থেকে যাকাত ফরজ করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, দারিদ্র বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়ন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, দারিদ্রের করণে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমিই তাদের ও তোমাদের রিযিক দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে তাদের হত্যা করা মহাপাপ। (বনী ইসরাঈল- ৩১)
দারিদ্রের করণে মানুষ নিজ সন্তানকেও হত্যা করতে পারে, তাই দরিদ্রমুক্ত করার জন্যই আল্লাহ তা’আলা যাকাত ফরজ করেছেন। আর রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, দরিদ্র মানুষকে কুফরীর দিকে ঠেলে দেয়। সুতরাং দরিদ্র হচ্ছে মানুষের ঈমান ও চরিত্র এবং সমাজের শান্তি স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি এবং অভিশাপ। দরিদ্র জনগোষ্টীর একটা অংশকে তাদের দারিদ্রতার সুযোগে এক শ্রেণীর লোক সমাজের নানা অন্যায়, অনাচার ও অবৈধ কাজে ব্যবহার করছে।
ইসলামের যাকাত বিধান ধনী গরীবে মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা। যাকাত আদায়ে ধনী গরীবের মাঝে ভালবাসা তৈরী হয়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সমাজ থেকে দারিদ্রতা দূর হয়।
।
৫. হজ্জ্ব
ইসলামের বর্ননা অনুসারে হজ্জ একটি আবশ্যকীয় বা ফরজ উপাসনা। এটি ইসলামের ৫ম স্তম্ভ। হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ- “ইচ্ছা” বা “সংকল্প” করা। আচার ও আদব-কায়দার বিবেচনায় হজ্জ হলো বৎসরের নির্দ্দিষ্ট দিনে নির্দ্দিষ্ট পোশাকে কয়েকটি স্থানে অবস্থান বা ওকুফ, ক্বাবা শরীফের তাওয়াফ, পশু কোরবানী, নির্দ্দিষ্ট স্থানে পরপর ৩দিন কংকর নিক্ষেপ এবং সাফা-মারওয়া টিলাদ্বয়ের মধ্যে হাঁটা। হজ্বের ঐতিহাসিক পটভূমি কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ্জ আদায় করেন ইসলামের নবী আদম ; তারপর নূহ সহ অন্য ইসলামের অন্যান্য নবী-রাসূল এ দায়িত্ব পালন করেন। ইব্রাহিম (আ:) এর সময় থেকে হজ্জ ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত করা হয়। হিজরি সনের ১২তম মাস হলো জিলহজ্জ মাস। ইসলামের বর্ননা অনুসারে এই সময়ই স্রষ্টা ইব্রাহিম কে হজ্জ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় আছেঃ এ আদেশের পর ইব্রাহিম আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন,
লোক সব, তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ্জ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো”। এই বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে যে ইব্রাহিম এর ঘোষণা স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়।[৪]
হজ্জ-এর বিভিন্ন আচার-কায়দা ইব্রাহিম এর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিভিন্ন ইসলামিক বর্ননায় উল্লেখ আছে ইব্রাহিম স্রষ্টার নির্দেশে তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরাকে নির্জন
মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। সেখানে, ক্বাবা শরীফের অদূরে, বিবি হাজেরা নবজাত শিশু ইসমাইল কে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলেন। সাহায্যের জন্য কাউকে না পেয়ে তিনি পানির খোঁজে সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করেই হজ্জের সময় মুসলিমদের জন্য সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে হাঁটার নিয়ম রয়েছে।
ইসলামিক বর্ননায় উল্লেখ আছে স্রষ্টা বেহেশত বা স্বর্গ থেকে আদম ও হাওয়া কে যখন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, এতে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে উভয়ে আরাফাত ময়দানে এসে মিলিত হন। এই ঘটনার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজ্বের একটি অংশ হিসেবে মুসলিমরা আরাফাতের ময়দানে এসে উপস্খিত হয়ে স্রষ্টার কাছে কান্নাকাটি করে ইবাদতে মগ্ন হন।
আবু হোরায়রা বর্ণিত এক হাদিসে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্জ করে এবং অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ্জ থেকে এমতাবস্খায় ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়েছে।
অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সেও তদ্রূপই হয়ে যায়।” [৩] আরেকটি হাদিসে তিনি বলেছেনঃ “শয়তান আরাফার দিন হতে অধিক লজ্জিত ও অপদস্থ আর কোনো দিন হয় না, কেননা ওই দিন আল্লাহতায়ালা স্বীয় বান্দার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করেন ও অসংখ্য কবিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” তিনি
আরো বলেছেনঃ “একটি বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ্জ সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর চেয়ে উত্তম। বেহেস্ত ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু তার প্রতিদান হতে পারে না।”
ইসলামি শরিয়তে হজ ফরজ হওয়ার জন্য সাতটি পূর্বশর্ত রয়েছে।
যেমন-
(১) মুসলমান হওয়া
(২) জ্ঞানবান হওয়া
(৩) বালিগ হওয়া
(৪) আজাদ বা স্বাধীন হওয়া
(৫) আর্থিক দিক থেকে হজ পালনে সক্ষম হওয়া
(৬) হজ ফরজ হওয়ার ইলম থাকা (৭) হজের সময় হওয়া (শামী-২)।
একইভাবে হজ আদায় ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলি ৫টি
(১) শারীরিক সুস্থতা
(২) রাস্তাঘাট নিরাপদ হওয়া
(৩) কারাবন্দী না হওয়া
(৪) মহিলার ক্ষেত্রে স্বামী কিংবা অন্য কোনো (বিবাহ নিষিদ্ধ পুরুষ) ‘মাহরিম’ সাথে থাকা এবং
(৫) মহিলাদের ইদ্দত পালনের অবস্থা হতে মুক্ত হওয়া