তরিকা সমূহের বর্ণনা

 

তরিকা কি?

বহুল পরিচিত সাত তরিকার বিবরণ

কাদেরিয়া তরিকা

চিশতিয়া তরিকা

নকশবন্দিয়া তরিকা

মোজাদ্দেদিয়া তরিকা

সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকা

ওয়াইসিয়া তরিকা

মাসুমিয়া তরিকা

তরিকা কি?

তরিকা শব্দটি আরবী তারিক শব্দ হইতে পরিগৃহীত হইয়াছে, ইহার বাংলা অর্থ হইল পথ, রাস্তা ইত্যাদি। কিন্তু অবশ্যই বুঝিতে হইবে যে, এই পথ কোন সাধারণ পথ নয় বরং মহান আল্লাহ্র নৈকট্য হাসিল করার নিমিত্তে যে পথ অতিক্রম করা হইয়া থাকে মূলত সেই পথকেই তরিকা বলা হইয়া থাকে। ইসলামী আধ্যাত্মিক পরিভাষায় তরিকা হইল বেলায়েতের জ্ঞান অর্জন করিতে আল্লাহর অলিগণের প্রবর্ত্তিত বিভিন্ন সাধন পদ্ধতি আর সে পথটির সিলসিলা হইতেছে নিম্নরূপ:
পবিত্র কোরআনের দিক নির্দেশনা এবং রাসূল সা. ও তাঁহার পবিত্র আহ্লে বাইত আ.-এর দিক নির্দেশনার আনুগত্য করাই হইতেছে- মহান আল্লাহ্র নৈকট্য হাসিল অর্থাৎ পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর পথ।
পবিত্র কোরআনে বলা হইয়াছে:
“লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহ্ উসওয়াতুন হাসানাহ্…” ।
অর্থ: আল্লাহ্র রাসূলের মধ্যেই রহিয়াছে তোমাদের জন্য সকল সুন্দরের আদর্শ।
রাসূল সা. কর্তৃক মদিনা মোনওয়ারাহ্তে তৌহিদ বা এলাহিয়্যাতের শিক্ষা তথা মারেফাত অর্জনের যে শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহার পথ চলা শুরু হইয়াছিল পবিত্র কোরআন ও রাসূল সা.-কে আনুগত্যের মাধ্যমে।
হযরত আলী রা. যেহেতু রাসূল সা.-এর একনিষ্ঠ বিশ্বস্ত এবং গোপন ভেদের আমিন ছিলেন তাই তাঁহার পরে তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এই শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। তিনি স্বীয় জীবদ্দশায় বহু শিষ্য তৈরী করিয়াছিলেন এবং রাসূল সা.-এর পরে তাঁহার সকল শিষ্যই হযরত আলী রা.-এর শিষ্যে পরিণত হইয়াছিলেন।
হযরত  মুহাম্মদ  মুস্তাফা  সা.-কে  সূফীগণ প্রথম ও শ্রেষ্ঠ পীর বলিয়া অভিহিত করেন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মূল উৎস বলিয়া মনে করেন। সেই জন্য হযরত রাসূলে করীম সা. হইতেই সমস্ত তরিকার উদ্ভব।
হযরত নবী করীম সা. তাঁহার বিশেষ কিছু সাহাবীকে মিনহাজ বা তাসাওউফ বা তত্ত্ব দর্শন শিক্ষা দান করিয়াছেন। তাঁহাদের উল্লেখ যোগ্য হইলেন- হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা., হযরত ওমর ফারুক রা., হযরত আলী রা., হযরত সালমান ফারসী রা., হযরত আবু জর গিফারী রা., হযরত আবু হোরায়রা রা., হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা., হযরত মিকদাদ রা., হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা., হযরত মাআ’জ রা. প্রমুখ।
হযরত আবু বকর রা.-এর মাধ্যমে বর্ত্তমানেও দুইটি তরিকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই তরিকা দুইটি হইল: নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়া। হযরত ওমর রা.-এর মাধ্যমে প্রচারিত তরিকার বর্ত্তমানে কোন অস্তিত্ব নাই। হযরত সালমান ফারসী রা. ইয়ামেন অঞ্চলে তরিকত প্রচার করিতেন। নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার শাজারা মোবারকেও তাঁহার নাম রহিয়াছে। হযরত আলী রা.-এর মাধ্যমে প্রচারিত তরিকার উপর ভিত্তি করিয়াই কাদেরিয়া ও চিশতিয়া তরিকা সহ বিভিন্ন তরিকা ও উপ-তরিকা বর্ত্তমানে বিদ্যমান রহিয়াছে। তাঁহার প্রচারিত তরিকা প্রধানতঃ তাঁহার পুত্রদ্বয় হযরত ইমাম হাসান রা. ও হযরত ইমাম হোসাইন রা. এবং বিশিষ্ট তাবেঈন হযরত হাসান বসরী রহ.-এর মাধ্যমে প্রচারিত হইয়াছে। অন্যদের মাধ্যমে প্রচারিত কোন তরিকার সন্ধান বর্ত্তমানে তেমন পাওয়া যায় না। অবশ্য বিশিষ্ট তাবেঈন হযরত ওয়াইস করনী রহ.-এর মাধ্যমে প্রচারিত ওয়াইসিয়া তরিকা বর্ত্তমানে বিদ্যমান রহিয়াছে।
বিভিন্ন তরিকার নিয়ম-কানুন, আধ্যাত্মিক সুলুক ও তালিম সু-সংগঠিত ও সু-সংবদ্ধ হয় খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে। ইহার পূর্ব্বে সূফীগণের আধ্যাত্মিক অনুশীলন মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছিল। এই সময় (১০ম শতাব্দীতে) আধ্যাত্মিক সাধনার সু-বিখ্যাত কুতুব ও প্রৌজ্জ্বল পীর-মোর্শেদগণ বিভিন্ন তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সকল সূফী-পীর স্বীয় তরিকার ইমাম ও কুতুব হিসাবে পরিগণিত।
কাল-কালান্তরে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা., হযরত আলী রা.ও হযরত ওয়াইস করনী রহ.-এর তরিকার উপর ভিত্তি করিয়াই উল্লেখ যোগ্য সূফী-সাধকগণের মাধ্যমে অনেক তরিকা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তাঁহাদের সাধন পদ্ধতির পার্থক্যের কারণেই তরিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে। তরিকা সমূহের সংখ্যা নির্দিষ্ট করিয়া বলা দুষ্কর। কাহারো মতে, তিন সহস্র বা ততোধিক। এই সকল তরিকার মধ্যে বহু সংখ্যক তরিকা অবলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। প্রায় চারশত তরিকার সন্ধান পাওয়া যায়।

বহুল পরিচিত সাত তরিকার বিবরণ

ভারত বর্ষে তিন শতাধিক তরিকার মধ্যে বহুল পরিচিত তরিকা গুলি হইল- কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, ওয়াইসিয়া, মাসুমিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া। নিম্নে এই সাত তরিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলিয়া ধরা হইল:

কাদেরিয়া তরিকা

কুতুবে রব্বানী গাউসে সামদানী বড়পীর হযরত সৈয়্যেদ মহিউদ্দীন আবু মুহাম্মদ আবদুল কাদির জিলানী রহ. এই তরিকার প্রবর্ত্তক। হযরত বড়পীর রহ.-এর নামানুসারে তাঁহার উদ্ভাবিত ও প্রচারিত তরিকার নামÑ কাদেরিয়া তরিকা। রাসূলুল্লাহ সা. হইতে শুরু করিয়া তরিকাতে খেলাফত প্রাপ্ত চতুর্দশ পুরুষ হইলেন গাউসুল আজম হযরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রহ.।
কালেমা তাইয়্যেবা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” যথা: লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, হা, আলিফ, লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, লাম, হা নোক্তা বিহীন এই বারোটি বর্ণের তালিম কাদেরিয়া তরিকার খাস তালিম। এই নোক্তা বিহীন বারোটি হরফের মধ্যে দুনিয়ার সমস্ত রহস্য লুকায়িত রহিয়াছে। এই বারোটি হরফই বিশ্ব জগতের মূল কারণ ও উৎস। তৌহিদের প্রকৃত রূপও এই কালেমা। নোক্তা শূন্য বর্ণ দিয়ে কেন কালেমার সৃষ্টি, তাহা গভীর রহস্যে নিমজ্জিত। এই কালেমাকে জানিলে, চিনিলে ও সঠিক ভাবে গবেষণা করিয়া পড়িলে তাহার নিকট সকল রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হইয়া যায়। এই কালেমা বিশ্ব মহীরুহের মূল ও নূরে মুহাম্মদীর মূল উৎস। এই তালিম না পাওয়া পর্য্যন্ত কেহ কাদেরিয়া তরিকার সূফী-সাধক ও পীর হওয়ার যোগ্য হন না। যিনি এই কালেমার রহস্য জানেন- তিনি আরেফ বিল্লাহ ও অলিয়ে কামেল-এর মর্যাদায় আসীন হন। এই রূপ জ্ঞানী সম্পর্কেই বলা হইয়াছ:

مَن قَالَ لا الَهَ الا اللهُ مُخلِصاً دَخَلَ الجَنَّةَ

উচ্চারণ: মান কলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিছান দাখালাল জান্নাতা।
অর্থ:      “যে তাহকিক (গবেষণা) করিয়া জীবনে একটি বারের জন্যও কালেমা পাঠ করিয়াছে, তাহার জন্য দোজখের আগুন হারাম।”
এই কালেমা শরীফ প্রথমত: দুই ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগ ফানা ও এক ভাগ বাকা। ফানাকে নুজুল (অবরোহ) ও বাকাকে উরুজ (আরোহ)ও বলা হয়। কি ভাবে এই কালেমার শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে, কালেমা সাবেত করিতে হইবে- তাহা সূফী-সাধক ও পীর-মোর্শেদগণ ব্যতীত সাধারণ শুষ্ক আলেমগণ (আরবী ভাষায় বিদ্বান) বলিতে পারেন না।
হযরত নবী করিম সা. এই কালেমার বিশেষ তালিম হযরত আলী রা.কে প্রদান করিয়াছিলেন। তিনি এই তালিম তাঁহার খলিফা হযরত হাসান বসরী রহ.-কে দান করেন। তাঁহার নিকট হইতে গাউসুল আজম হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ.-এর নিকট আসে। এই কালেমার রহস্য তাঁহার নিকট আসিবার পূর্ব্ব পর্য্যন্ত ইহার তালিম সিনা-ব-সিনা আসিত। কিন্তু তিনি এই তালিমকে সু-বিন্যস্ত করিয়া লিখিত আকারে গুপ্ত ভাবে বিশেষ মুরিদানকে দান করেন। এতদ ব্যতীত এই তরিকার অন্যান্য পদ্ধতিও তিনি সু-সংবদ্ধ করেন।
তরিকার নিয়মানুসারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে অজিফা পাঠ, বিশেষ দরূদ শরীফ, নফী-এসবাতের জিকির ও মোশাহাদা করিতে হয়। মুরিদের মনের অবস্থা ও পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকতা ভঙ্গ করিয়া জিক্রে জলী বা জিক্রে খফী উভয় প্রকার জিকির করিবার নিয়ম এই তরিকায় রহিয়াছে। কাদেরিয়া তরিকা ভুক্ত অনেক উপ-তরিকা রহিয়াছে। তন্মধ্যে প্রধান ও আদি নয়টি উপ-তরিকা রহিয়াছে, যথা: হাবিবিয়া, তারফুরিয়া, কারখিয়া, সকতিয়া, জুনায়দিয়া, গাজর দিদিনিয়া, তুরতুসিয়া, কারতুসিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া। এই তরিকা ভুক্ত জুনায়েদিয়া উপ-তরিকা মতে সামারও প্রচলন রহিয়াছে।
আওলাদে রাসূল সা. হযরত বাবা ফতেহ আলী ওয়াইসী পাক রহ.-এর প্রিয়তম মুরিদ-খলিফা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী  রহ. কাদেরিয়া তরিকা সম্পর্কে স্ব-রচিত ‘র্সিরেহক্ক জামেনূর’ কিতাবে একটি ভিন্ন অধ্যায় রচনা করিয়াছেন। নিম্নে উহার অংশ বিশেষ তুলিয়া ধরা হইল:
“কাদেরিয়া তরিকার সাধনা কোন লতিফার সহিত সম্পৃক্ত নহে। বরং খোদা প্রেমিকের যেই স্থানে আল্লাহ শব্দের প্রভাব পড়িবে, সেখানেই জিকির জারী হয়। সেইখান হইতে তাহা সমস্ত শরীরে শিহরিত হয়। অতঃপর সেখানে বিশেষ অবস্থা ও নূর সমূহ বিচ্ছুরিত হইবার পর তাজাল্লী বা আলোক প্রভার বিকিরণ এবং ঊর্ধ্ব জগতের ভ্রমণ সংঘটিত হয়। ফলে এমন আবেগের উত্থান এবং অবস্থার পর্য্যায়ক্রমিক উন্নতি সাধিত হয়, যাহা বলা বা লেখা যায় না।
মোর্শেদের তাওয়াজ্জুহ্ ব্যতীত সালেকের এই পথে সফল হওয়া খুবই কঠিন। যখনই এই সকল বিশেষ অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়, তখনই মোর্শেদ তাহাকে নিজের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে উন্নততর মনজিলে পেঁৗঁছার পথ নির্দেশ করেন। প্রকৃত মকসুদে পৌঁছাইবার পথ বাতলাইয়া দেন। সালেক চলার পথে যখনই ধীরে ধীরে নূরানী জগতে অগ্রসর হয় এবং বিশাল বিশাল ভয়ানক সমুদ্র অতিক্রম করিবার পর জাতী তথা মূল নূরের প্রভাবে ফানার মাকামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তখনই মূল সত্তার দরিয়ায় ডুবিয়া যায়। সমুদ্রের মতো যাহার কিনারায় মূলের মূল, শাখার শাখা বিভিন্ন পর্য্যায়ে ওয়াহ্দাতুল ওজুদ বা অস্তিত্বের একত্বের অলি-গলিতে ঘুরিতে থাকে। ইহারই মধ্যে শাহে লা-তায়াইউন বা অসীম অমূর্ত বা নির্বস্তুক জগতের আবির্ভাব ঘটে, যাহার কূল-কিনারা নাই।”

চিশতিয়া তরিকা

চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ইমাম সুলতানুল হিন্দ খাজায়ে খাজেগান গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈন উদ্দীন হাসান চিশতী সানজরী রহ.। কাদেরিয়া ও চিশতিয়া এই উভয় তরিকারই উদ্ভব ঘটিয়াছে হযরত আলী রা. হইতে। চিশতিয়া তরিকার শাজারা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সা. হইতে শুরু করিয়া হযরত আলী রা. হইতে হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী  রহ. খেলাফত প্রাপ্তির সপ্তদশ খলিফা।
হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ. শরিয়তের সকল বিধি নিষেধ পালনের প্রতি সর্বদা সজাগ থাকিতেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ভাবেই শরিয়তের কোন ব্যত্যয় তিনি সহ্য করিতেন না। তিনি ভক্ত-অনুসারীদিগকে শরিয়তে পাবন্দ থাকিবার জন্য কঠোর নির্দেশ দিতেন। এমন কি চিশতিয়া তরিকার অনুসারীগণ যেন কখনও শরিয়তের বরখেলাপ না করিতে পারে, সেই জন্য আহলে চিশতের পরিপালনীয় একটি অজিফা রচনা করিয়া হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.কে প্রদান করিয়াছিলেন; যাহা হযরত কাকী রহ.-এর স্ব-রচিত ‘দলিলুল
আরেফীন’ গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে বিধৃত হইয়াছে।
আহলে চিশতের জন্য প্রদত্ত এই অজিফা দান কালে তিনি বলেন, “বুজুর্গানে দ্বীন হইতে আমি যে অজিফা লাভ করিয়াছি, তাহা পালনে সুদৃঢ় রহিয়াছি। মনে রাখিও, রাসূল সা. বলিয়াছেন: “তারিকুল বিরদি মালউন অর্থাৎ অজিফা ত্যাগকারী অভিশপ্ত।”
একই ভাবে তিনি তাহাদিগকে সূফী দর্শনের গূঢ় রহস্য পূর্ণ বিষয় গুলি সম্পর্কেও দীক্ষা প্রদান করিতেন। চিশতিয়া তরিকায় নিজকে জানিবার বা দেহ তত্ত্বের তালিম গ্রহণের বিশেষ গুরুত্ব রহিয়াছে। এই তালিমের চূড়ান্ত পর্য্যায়ে উন্নীত না হওয়া পর্য্যন্ত কেহ এই তরিকায় কামালিয়ত অর্জন করিতে পারে না বা তাহার পক্ষে সূফী-দরবেশ পর্য্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। দেহ তত্ত্বের প্রধান সাধনা হইল আনাসির-এ-খামসা বা পঞ্চভূত (পঞ্চ উপাদান)। এই সাধনার গুরু হযরত মুহাম্মদ সা.। তাঁহার নিকট হইতে হযরত আলী রা., হযরত আলী রা. হইতে হযরত হাসান বসরী রহ. এই তালিম লাভ করেন। সিনা-ব-সিনা চলিয়া আসা এই তালিম হযরত ওসমান হারুনী রহ.ও লাভ করেন। এই তালিম গুলি লিপিবদ্ধ ছিল না। হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ. তালিম গুলি সু-শৃঙ্খল ভাবে সাজাইয়া গুছাইয়া লিপিবদ্ধ করেন।
চিশতিয়া তরিকা মতে আব, আতশ, খাক, বাদ ও নূর যথাক্রমে পানি, আগুন, মাটি, বায়ু এবং নূরকে আনাসির-এ-খামসা বা পঞ্চ উপাদান নামে অভিহিত করা হয়। সমুদয় সৃষ্টি জগতের মূল উৎস এই পঞ্চ উপাদান। সমুদয় জড় বস্তু ও প্রাণী দেহে ‘আনাসিরে আরবায়া’ বা চার উপাদান যেমন পানি, আগুন, মাটি ও বায়ুর সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। আর চার উপাদানের মূলে রহিয়াছে নূর বা এক জ্যোতির্ম্ময় সত্তা। প্রত্যেক উপাদানে রহিয়াছে পাঁচটি গুণ বা সিফাত।
উহা আবার তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা:
১. আহাদিয়াত    :    এই স্তরে মহিমান্বিত আল্লাহ আপনাতেই বিদ্যমান এবং অতি সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম দরিয়া রূপে রহিয়াছেন। এই পর্য্যায়ে তিনি একক ও অদ্বৈত।
২. ওয়াহিদাত    :    এই স্তরে তিনি তাঁহার ইরাদা বা আকাক্সক্ষা বা এশক (প্রেম) হইতে নূরে মুহাম্মদী সা. সৃষ্টি করেন।
৩. ওয়াহেদিয়াত    :    এই স্তরে নূরে মুহাম্মদী সা. হইতে তিনি নিজেকে বিশ্ব চরাচর সৃষ্টির সঙ্গে ‘আহমদ’ রূপে প্রকাশ করেন। এই কারণেই কুরআনের পূর্ব্বে সকল ধর্ম্ম গ্রন্থে হযরত মুহাম্মদ সা.কে ‘আহমদ’ উল্লেখ করা হইয়াছে।
হযরত সুরেশ্বরী রহ. তাঁহার রচিত আধ্যাত্মিক ঊর্দু গ্রন্থ “সিররেহক্ক জামেনূর”-লেখকের  ভূমিকায় লিখেছেন “আহাদ” এবং “আহমাদ” এর মধ্যে “মীম” এর পার্থক্য কেবল হামদ্ ও নাতের জন্য।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য পংক্তিতে সেই সুরই ধ্বনিত হইয়াছে এই ভাবে

আহমদের ঐ মীমের পর্দা উঠিয়ে দেখ মন
আহাদ সেথায় বিরাজ করে হেরে গুণীজন ॥

যে চিনতে পারে রয় না ঘরে হয় সে উদাসী
সে সকল ত্যাজি ভজে শুধু নবীজীর চরণ ॥

এই তালিমকে ‘মান আরাফা নাফসাহু’ এর তালিমও বলা হয়। এই তালিম রপ্ত না করা পর্য্যন্ত কেহই প্রকৃত সূফী বা চিশতিয়া তরিকার পীর হইবার যোগ্য নহেন।
চিশতিয়া তরিকায় সামা প্রচলিত রহিয়াছে। মাঝে মাঝে এই তরিকা পন্থীগণ সামার অনুষ্ঠান করেন। ইহাতে তাহারা জজবার হালতে পৌঁছেন। সামার দ্বারা আল্লাহর প্রেম বর্ধিত হয়। তাই চিশতিয়া তরিকার মাশায়েখগণ সামাকে ‘রুহানী গেজা বা আত্মার খোরাক’ বলেন।
একই ভাবে চিশতিয়া তরিকায়ও কালেমা তাইয়্যেবা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” যথা : লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, হা, আলিফ, লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, লাম, হা নোক্তা বিহীন এই বারোটি বর্ণের খাস তালিমের বিধান রহিয়াছে।
এই তরিকার প্রধান দুইটি উপ তরিকা হইল: প্রধান খলিফা সুলতানুল মাশায়েখ হযরত নিজাম  উদ্দিন  রা.-এর  নামানুসারে  ‘নিজামিয়া’  ও  অন্যতম  খলিফা  হযরত মখদুম আলী কালিয়ারী রা.-এর নামানুসারে ‘সাবেরিয়া’ পৃথিবীতে অদ্যাবধি রহিয়াছে।

নকশবন্দিয়া তরিকা

নকশবন্দিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত শেখ খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ আল- বোখারী রহ.। এই তরিকা মূলতঃ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. কর্তৃক উদ্ভাবিত। রাসূলুল্লাহ সা. গোপন ভাবে হযরত আবু বকর রা.কে ইলমে মারেফাতের যে খেলাফত দান করিয়াছিলেন, তাহা অদ্যাবধি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন তরিকা, উপ-তরিকার মাধ্যমে জারী রহিয়াছে। নক্শবন্দিয়া তরিকা উহার একটি উল্লেখ যোগ্য তরিকা। রাসূলুল্লাহ সা.-এর গোপন তালিম হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর মাধ্যমে পীর বা খলিফা পরম্পরায় সিনা-ব-সিনায় ইমামে তরিকত শামসুল আরেফিন হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রহ. পর্য্যন্ত খেলাফত প্রাপ্তির ষোড়শ স্তর পৌঁছিয়াছে।
নকশবন্দিয়া তরিকার গুরুত্বপূর্ণ তালিম হইল ছয় লতিফা এবং চার উপাদান তথা আব, আতশ, খাক, বাদ অর্থাৎ পানি, আগুন, মাটি ও বাতাস প্রভৃতির উপর মোরাকাবা করা। ছয় লতিফা: ক্বাল্ব, রূহ, ছের, খফী, আখফা, নফস প্রভৃতির উপর সাধনার প্রতিক্রিয়া পরিচালিত হয়। ইহা ব্যতীত পঞ্চ হাযরা তথা সায়ের ইলাল্লাহ, সায়ের ফিল্লাহ, সায়ের আনিল্লাহ, আলম-এ-মিসাল, আলম-এ-শাহাদাত প্রভৃতির উপর মোরাকাবা করিবার নিয়ম-পদ্ধতি এই তরিকায় বিদ্যমান রহিয়াছে। নকশবন্দিয়ার তালিম রাসূলুল্লাহ সা. হইতে সিনা-ব-সিনায় হযরত বাহাউদ্দীন নক্শবন্দিয়া রহ.-এর নিকট পৌঁছিলেও পূর্ব্বে তাহা লিপিবদ্ধ আকারে ছিল না। হযরত বাহাউদ্দীন নক্শবন্দ রহ. তাহা সু-শৃঙ্খল ভাবে লিপিবদ্ধ করেন।
নক্শবন্দিয়া সাধকগণ আহাদিয়াত, ওয়াহিদাত ও ওয়াহেদিয়াতের স্তরে পরিভ্রমণ করেন। ওয়াহিদাত ও ওয়াহেদিয়াত স্তর দুইটি উপনীত হইতেছে সায়ের ইলাল্লাহ’তে। আলমে আমর ও আলমে খালক একই স্তরে অবস্থিত। আহাদিয়াতের স্তর কেবলই সায়ের ফিল্লায় অবস্থিত।
নকশবন্দিয়া তরিকা মতে ৮টি বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয় যথা:
১.    হুঁশদম: শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি খেয়াল রাখা।
২.    নেগাহ্ বর কদম: পীরের পদাঙ্কানুসরণ করা।
৩.    সফর দার ওয়াতন: দেহ রাজ্যে পরিভ্রমণ করা।
৪.    খিলওয়াত দার আঞ্জুমান: চুপি চুপি বাক্যালাপ।
৫.    ইয়াদ কার্দান: সার্ব্বক্ষণিক জিকিরে মশগুল থাকা।
৬.    বাজগশত: আল্লাহর প্রতি ধাবিত হওয়া।
৭.    নেগাহ দাশ্ত: আল্লাহতে অন্তর্দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা।
৮.    ইয়াদ দাশ্ত বা খোদগোজাশ্ত: নিজকে নিঃশেষ করিয়া আল্লাহতে চির জাগ্রত রাখা। এই তরিকা মতে নিচু স্বরে জিকির স্বীকৃত। এই তরিকার কোন কোন উপ-তরিকায় সামা জাতীয় গজলের প্রচলনও রহিয়াছে।
উল্লেখ্য, নকশবন্দিয়া তরিকার শাজারা মোবারকে ১৬তম পুরুষ ইমামুত তরিকত হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রহ.। কিন্তু ভারতবর্ষে সর্ব্ব প্রথম এই পবিত্র তরিকা প্রচার-প্রসার শুরু করেন হযরত খাজা রাজি উদ্দীন মুহাম্মদ বাকি বিল্লাহ রহ.। তিনি এই তরিকার ২২তম পুরুষ। তিনি স্বীয় পীর-মোর্শেদ হযরত মাওলানা খাজাগী আমাকনগী রহ.-এর নির্দেশে এই তরিকার প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যেই ভারতবর্ষে আগমন করিয়াছিলেন। তখন তাঁহার সফর সঙ্গী ছিলেন তাঁহার স্ত্রী ও মহীয়সী মাতা।
হযরত বাকি বিল্লাহ রহ.-এর পবিত্র মাজার শরীফ নতুন দিল্লী রেল ষ্টেশনের নিকটে নবী করীম সড়কের একটি টিলার উপর অবস্থিত। আল্লাহ পাক তাঁহার মাজার শরীফ জেয়ারতের সৌভাগ্য আমাকে দান করিয়াছেন।

মোজাদ্দেদিয়া তরিকা

মোজাদ্দেদিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী ইমামে রব্বানী কাইয়ুমে জামান শায়েখ আহমদ সেরহিন্দী রহ.। এই তরিকা মূলতঃ নক্শবন্দিয়া তরিকা হইতে উদ্ভূত। তাই উভয় তরিকার সাধন-ভজন প্রায় একই রকম। উভয় তরিকাই রাসূলুল্লাহ সা. হইতে হযরত আবু বকর রা. ও হযরত সালমান ফারসী রা.-এর মাধ্যমে আগত। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রহ. খেলাফত প্রাপ্তির ২৩তম খলিফা।
মোজাদ্দেদিয়া তরিকা মতে ছয় লতিফা, চতুর্ভুজ এবং পাঁচ হাজার মোরাকাবা বা অনুশীলন অত্যাবশ্যক। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রহ. পঞ্চ হাযরাকে নূতন নিয়মে সাজান। নক্শবন্দিয়া তরিকা মতে সায়ের ইলাল্লাহ, সায়ের ফিল্লাহ এবং আনিল্লাহর স্থলে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রহ. কিছুটা পরিবর্ত্তন ও পরিবর্ধন করেন। তিনি সায়ের ইলাল্লাহকে বেলায়েতে সোগরা বা ক্ষুদ্রতম বেলায়েত এবং সায়ের ফিল্লাহকে বেলায়েতে কুবরা বা বৃহত্তম বেলায়েত নামকরণ করিয়াছেন। আহাদিয়াতের স্তরকে তিনি পূর্ব্বেকার স্তর হইতে ২০/২২টি ঊর্ধ্বস্থিত স্তর বলিয়া অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন। বেলায়েতে উলিয়া বা ঊর্ধ্বাস্থিত বেলায়েতকে তিনি নবুয়তের পর্য্যায় ভুক্ত বলিয়া অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন। সালেক এই ২০/২২টি মাকামের মধ্য দিয়া আহাদিয়াতের স্তর অতিক্রম করিয়া বাকাবিল্লাহ বা কাইয়ুমিয়াত লাভ করেন।

সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকা

কাদেরিয়া ও চিশতিয়া তরিকার সংমিশ্রণে সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকা। এই তরিকার প্রবর্তন করেন হযরত আবু নজিব জিয়া উদ্দিন সোহরাওয়ার্দী রহ.। তৎপর এই তরিকার উন্নয়ন সাধন করেন তাঁহার জগৎ বিখ্যাত মুরিদ-খলিফা হযরত শিহাব উদ্দীন আবু আমর উমর বিন আবদুল্লাহ আল-সোহরাওয়ার্দী রহ.। তিনি ওয়াহদাতুল অজুদ (হামা উস্ত) বা সর্ব্বেশ্বরবাদ তত্ত্বজ্ঞানীদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। তাঁহার মতে ইলাহিয়াত বা ঐশী সত্তার বিকাশ ও স্ফূরণ হয় আদমিয়াত বা মানবত্বে। তিনি ইত্তেহাদের ভিত্তি মূলে হযরত আদম আ.কে সর্ব্ব প্রথম আল্লাহর শারীরিক বিকাশ বলিয়া মনে করেন। মানবীয় দৈহিক সত্তায় ঐশী সত্তার প্রকাশই এক চিরন্তন রহস্য। আল্লাহর সকল সিফাত বা গুণ মানুষের মধ্যেই বিকশিত হয়। এই জন্যই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে সৃষ্টি জগতের উপর কর্ত্তৃত্ব করিতেছে। মানুষ ব্যতীত কেহই আল্লাহর রহস্য উদঘাটন করিতে পারে না।
হযরত শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহ.-এর মতে এই তরিকার ভিত্তিই হইল:
১. জওক (আধ্যাত্মিক স্বাদ গ্রহণ)
২. ওয়াজদ (উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা)
এই তরিকায় আল্লাহর অলিগণ কখনও জাহির, কখনও বাতেনে থাকেন। হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী রহ. এই তরিকার জাহেরী ও বাতেনী উভয় অবস্থার ইমাম ও কুতুব ছিলেন।
সকল অলি-আউলিয়া কম-বেশী আহমদী নূরের বর্ণনা উপস্থাপন করিয়াছেন। তবে সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকায় ইহার অনেক বর্ণনা খোলাখুলি ভাবে রহিয়াছে। এই তরিকার জ্ঞান সম্পন্ন অলি-আউলিয়ার কিছু কিছু রীতিনীতি, কাজ-কর্ম্ম শরিয়তের বা সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির গণ্ডিভুক্ত না-ও হইতে পারে। ইহা বেলায়েতের প্রভাব মুক্ত এবং শরিয়তের আদেশ-নিষেধ সাময়িক ভাবে রহিত হওয়ার অবস্থা। ইহাকে খিজিরী বেলায়েত বলে।
হযরত শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী স্বীয় তরিকার বিস্তারিত দর্শন বিষয়ক একাধিক কিতাব রচনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে ‘হেকমতে আশরাক’ গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ। তাঁহার তরিকার বিস্তারিত মূলনীতি ও দর্শন এই কিতাবে রহিয়াছে। গ্রন্থটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে যুক্তিবাদ ও দর্শন বিষয়ে আলোচনা করা হইয়াছে। দ্বিতীয় খণ্ডে আনোয়ারে এলাহীর বর্ণনা রহিয়াছে। ইহাতে তাজাল্লিয়াতে রব্বানীর বিশেষ বর্ণনা রহিয়াছে। ইহা পাঁচ ভাগে বিভক্ত :
১. নূর ও হাকিকত সম্বন্ধে আলোচনা।
২. নূর বিষয়ক শৃঙ্খলা।
৩. নূরুল আনোয়ার, আনোয়ারে কাহিরা, আনোয়ারে মুর্জারাদা সম্পর্কে
আলোচনা।
৪. বরজখের প্রকার ভেদ ও নমুনা।
৫. নবুয়াত, মনামত, মা’আদ (প্রত্যাবর্তন) বিষয়ক আলোচনা।
উক্ত পাঁচ বিভাগে রমুজ ও ইশারার সংক্ষিপ্ত আলোচনা রহিয়াছে। নূর ও জুলমাত সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রহিয়াছে। তিনি নূর বলিতে রূহ, জুলমাত বলিতে শরীর এবং আনোয়ার আক্লকে বুদ্ধিবৃত্তি বলিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন। আক্ল দ্বারা উকুলে আফলাক- ইহার দ্বারা আনোয়ারে কাহিরা এবং আনোয়ারে মুর্জারাদার সংক্ষিপ্ত আলোচনা পরিবেশিত হইয়াছে। আলমে বরজখ দ্বারা আলমে আজসাম বুঝাইয়াছেন। এই ভাবে: জাতে এলাহী, সিফাতে আফয়াল, লজ্জত (স্বাদ), মারেফাত, হেকমতে ইলমে কালাম, দর্শন ও তাসাউস ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিয়াছেন।
কুরআন-হাদিসের সূক্ষ্ম রহস্য পূর্ণ আয়াত ও হাদিস শরীফের উপর প্রতিষ্ঠিত দর্শন ও তরিকা প্রচারের সময়ে ইমাম হযরত শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহ. বিভিন্ন উলামা ও মাশায়েখের বিরোধিতা ও নির্যাতনের শিকার হইয়াছিলেন। সর্ব্ব শেষে ১২৩৪ খ্রীষ্টাব্দেতিনি শাহাদত বরণ করেন।
ইরান, ইরাক সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই তরিকার অনুসারী রহিয়াছেন।

ওয়াইসিয়া তরিকা

মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জ্বত তাঁহার কিছু কিছু বান্দাকে পয়গম্বর আ. অথবা অলি আল্লাহর পবিত্র  আত্মা  হইতে  সরাসরি ফয়েজ দান করিয়া এবং তাঁহাদেরকে বেলায়েতের মর্য্যাদায় উন্নীত করিয়া যোগ্যতা সম্পন্ন করেন। ইহাই ‘ওয়াইসি তরিকার’ মূল বৈশিষ্ট্য।
ওয়াইসিয়া তরিকা সম্পর্কে শামসুল উলামা আল্লামা হযরত জানশরীফ শাহ্     সুরেশ্বরী রহ. স্ব-রচিত ছফিনায়ে ছফর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন:

ওয়াইছিয়া গুণ এই ফয়েজ রৌশন।
জ্বলিবে যাহার ঘরে দেখিবে আপন ॥
চুমুক হাওয়ানী কহে এই গুণ তরে।
মোর্শেদ রাশেদ নৈলে পাইবারে নারে ॥

উল্লেখিত কাব্য পংক্তিমালায় ওয়াইসিয়া তরিকার গুণাগুণ তুলিয়া ধরা হইয়াছে। বলা হইয়াছে  যে,  মোর্শেদ  দয়া  করিয়া  ফয়েজে  ওয়াইসিয়া  দান করিলে সালেক নিজের মধ্যেই
আলো দেখিতে পাইবেন।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীন হযরত ওয়ায়েস আল-করনী রহ. এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা-ইমাম। তিনি জাগতিক ভাবে কখনও রাসূল সা.-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন নাই, করিতে পারেন নাই। জাগতিক সাক্ষাৎ ব্যতীতই অলৌকিক ভাবে রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট হইতে বাতেনী ভাবে তাওয়াজ্জুহ ও ইলমে লাদুন্নী লাভ করিয়াছিলেন। নবী করিম সা. এর অপরিসীম রূহানী ফয়েজ লাভ করিয়া ধন্য হইয়াছিলেন। পরবর্ত্তীতে রাসূল সা. তাঁহাকে খেরকায়ে খেলাফত প্রদান করেন। তিনি হযরত আলী রা.-এর একজন বিশিষ্ট সহচর ছিলেন। তিনি রূহানী জগতের উচ্চতম মাকামে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালার মর্জিতে এবং রাসূল সা.-এর অনুমোদনে কোন কোন আউলিয়া কেরাম প্রকাশ্য পীর-মোর্শেদ ব্যতীতই স্থান-কালের গণ্ডিকে রূহানী শক্তির মাধ্যমে অতিক্রম করিয়া ওয়াইসিয়া তরিকায় বায়াত গ্রহণ করিয়া থাকেন। তরিকায় উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পরবর্ত্তীতে খেলাফতও লাভ করিয়া থাকেন।
যেমন  হযরত  খাজা  আবুল  হাসান  খেরকানী  রহ. স্বীয়  মোর্শেদ হযরত সুলতানুল আরেফীন বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর ইন্তেকালের ত্রিশ বৎসর পর খেরকানে জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লাহ তায়ালার পরম রহমত ও কুদরতে হযরত খেরকানী রহ. ওয়াইসিয়া সিলসিলায় হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর নিকট বায়াত নেন। অতঃপর নেয়ামত ও ফয়েজ-রহমত লাভ করিয়া অলি আল্লাহগণের সুলতান হইয়াছিলেন। জন্মের পর তিনি তাঁহার মোর্শেদ হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর রূহানিয়াতের মধ্যে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। অন্যদিকে, হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রহ.ও তাঁহার পবিত্র জীবদ্দশায় খেরকানে গমন করিয়া তাঁহার এই রূহানী মুরিদ ও তাঁহার নেয়ামত প্রদান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন।”
আবার কোন কোন অলি-আল্লাহ তাঁহার ওয়াইসিয়া সিলসিলা ভুক্ত রূহানী মুরিদকে কখনও কখনও বাহ্যিক ভাবে তাসাওউফের  তালিম গ্রহণ করিতে প্রকাশ্য পীর-মোর্শেদের নিকট বায়াত গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। এই রূপ অবস্থায় মুরিদের জন্য ঐ নির্দেশ পালন করা একান্ত আবশ্যক হইয়া পড়ে। আবার অনেক অতি উঁচু মানের অলি আল্লাহ স্বীয় রূহানী মুরিদকে অন্য কাহারও নিকট সমর্পণ না করিয়া নিজের একান্ত রূহানী আশ্রয়ে প্রতিপালন করিয়া থাকেন।
‘তাজকেরাতুল আউলিয়ায়ে হিন্দ ও পাকিস্তান’ নামক গ্রন্থে লেখক উল্লেখ করিয়াছেন, “হযরত খাজা বাবা গরীব নেওয়াজ রহ.-এর নিকট হইতে কয়েকজন আল্লাহর অলি প্রকাশ্য পীর ব্যতীতই রূহানী তালিম ও বেলায়েত লাভ করিয়াছেন। এইখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য যে, পীরের হাতে বায়াত না হইয়াও রূহানী নেয়ামত পাওয়া সম্ভব নহে বলিয়া যে চিরন্তন সত্য তাসাওউফ দর্শনে প্রতিষ্ঠিত আছে, ওয়াইসিয়া সিলসিলা তাঁহার বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম নহে, বরং আরও নিগূঢ়তম অর্থে উচ্চ অবস্থানে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত।”
বাংলার আধ্যাত্মিক জগতে ওয়াইসিয়া সিলসিলা ভুক্ত উচ্চ স্তরের আল্লাহর অলিগণের উল্লেখ যোগ্য হইলেন ঃ রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ. এবং তাঁহার প্রাণপ্রিয় মুরিদ-খলিফা শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. ও তাঁহার ৩৪ জন পীর ভাই। অবশ্য এই তরিকার খেলাফত ও বেলায়েত অর্জনের সৌভাগ্য খুব কম অলিই পাইয়া থাকেন।

ওয়াইসী শব্দের বিশ্লেষণ

তরিকত পন্থীগণ কম-বেশি ‘ওয়াইসী’ শব্দটির সহিত পরিচিত। হযরত ওয়ায়েস করনী রহ.-এর নামের সহিত ‘ওয়াইসী’ শব্দটি সম্পৃক্ত হইলেও সাধারণ মানুষ এই বিষয়টি তেমন অবগত নহেন। তবে ভারতবর্ষে ‘ওয়াইসী’ শব্দটির ব্যাপকতা লাভ করিয়াছে রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ. এবং তাঁহার সুযোগ্য মুরিদ-খলিফাগণের তরিকত প্রচারের মাধ্যমে। শব্দটি আমাদের নিকট পরিচিত হইলেও ইহার বিশ্লেষণ  আমরা অনেকেই জানি না। এইখানে ‘ওয়াইসী’ শব্দের একটি বিশ্লেষণ তুলিয়া ধরা হইল:
“আল্লাহ তায়ালা জাল্লা শানুহু তাঁহার কিছু কিছু বান্দাকে প্রচুর যোগ্যতা সম্পন্ন করেন। কখনও কখনও পয়গাম্বর আলাইহিস সালাম অথবা অলি আল্লাহগণের পবিত্র রূহ বা আত্মা হইতে এই সকল বান্দার উপর সরাসরি ফয়েজ বা স্নেহ প্রবাহ পৌঁছানো হয় এবং তাঁহাদেরকে বেলায়েতের মর্তবা পর্য্যন্ত পৌঁছাইয়া দেওয়া হয়। ইহাকেই ‘ওয়াইসী’ বলে। যেমন হযরত ওয়ায়েস করনী রহ. সাইয়্যেদুল বশর হযরত মুহাম্মদ সা.-এর বাহ্যিক ও সরাসরি পবিত্র সোহবত বা সাহচর্য্য ব্যতীত বাতেনী ভাবে তাঁহার নিকট হইতে ফয়েজ বা স্নেহ প্রবাহ অর্জন করিয়াছিলেন” ।

মাসুমিয়া তরিকা

মাসুমিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা এবং ইমাম হযরত খাজা মুহাম্মদ মাসুম আল-কাইয়্যুম রহ.। যাঁহার উপাধি ছিল ‘আল-উরওয়াতুল উসকা’। মাসুমিয়া তরিকা মূলতঃ নক্শবন্দিয়া-মোজাদ্দেদিয়া তরিকা হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। পাক-ভারত উপ-মহাদেশে এই তরিকা হযরত খাজা মুহাম্মদ মাসুম রহ. কর্ত্তৃক উদ্ভাবিত- যাহা অদ্যাবধি বিশ্বের বহু স্থানে বিভিন্ন তরিকার মাধ্যমে চালু রহিয়াছে। তিনি ছিলেন মোজাদ্দেদিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম হযরত ইমামে রব্বানী মোজাদ্দেদ আলফেসানী শায়খ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী রহ.-এর তৃতীয় সাহেবজাদা এবং মুরিদ-খলিফা। তিনি তাঁহার সময় ‘কুতুবুল এরশাদ’ ছিলেন। তাঁহার মোবারক হস্তের উপর হাত রাখিয়া নয় লক্ষ লোক বায়াত গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার প্রায় সাত হাজার খলিফা ছিলেন। তাঁহার সালেকানদের ক্বালবে ফানায়ে ক্বালবের নমুনা এক সপ্তাহের মধ্যেই অর্জন হইত- যাহা বিরল ঘটনা।