প্রথম পর্ব
নবী রাসূলগণের জীবন থেকে শিক্ষা
.
।
নবী রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালবেসে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে যুগে যুগে নবী- রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবীরা ছিলেন সত্য ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। ছিলেন উন্নত চরিত্র ও নিষ্পাপ জীবনের অধিকারী। ছিলেন আদর্শ মানুষ। তাঁরা অহীর মাধ্যমে আল্লাহর বাণী লাভ করতেন। তাঁরা কখনো আল্লাহর হুকুম অমান্য করতেন না।
আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর দাসত্ব করার জন্যে। তাঁর হুকুম পালন করার জন্যে। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করার জন্যে। সেই সাথে পৃথিবীটাকে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করার জন্যে। এই হল মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ নবীদের পাঠিয়েছেন মানুষকে তাঁদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানিয়ে দিতে এবং কথাটা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে।
মহান আল্লাহ যাদের নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন, তাঁরা সারা জীবন মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন। মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন। নফসের তাড়না এবং শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলতে তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছেন।
নবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন, মানুষ যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তাঁর সন্তুষ্টির পথে জীবন যাপন করে, তবে মৃত্যুর পর যে চিরন্তন জীবন আছে, সেখানে তাঁরা মহা সুখে জান্নাত লাভ করবে। কিন্তু যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন ধারণ করবে না। মৃত্যুর পরের জীবনে তাঁদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি আর শাস্তি।
নবী শব্দের অর্থ হল ‘সংবাদ বাহক’। রাসুল শব্দের অর্থ ‘বাণী বাহক’। নবী- রাসুলগণ আল্লাহর বাণী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সঠিক পথের সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বলেই তাঁদেরকে নবী ও রাসুল বলা হয়। সকল রাসুলই নবী ছিলেন। তবে সকল নবী রাসুল ছিলেন না। অনেক নবীর কাছে আল্লাহ তায়ালা শুধু অহী পাঠিয়েছেন। আবার অনেক নবীর কাছে অহী এবং কিতাবও পাঠিয়েছেন।
প্রথম নবী ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম আ.। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসালাম। তাঁর পরে পৃথিবীতে আল্লাহ আর কোন নবী আসবেন না। পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা ঠিক কত জন নবী পঠিয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা এক লক্ষ বিশ হাজার নবী পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে তিনশত পনের জন ছিলেন রাসুল। তবে তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা মহান আল্লাহই ভাল জানেন।
আল্লাহ কুরআন মজিদে পঁচিশজন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সকলেই রাসুল ছিলেন। কুরআনে উল্লেখিত নবী-রাসুলগণ হলেনঃ ১. হযরত আদম আ., ২. হযরত নূহ আ., ৩. হযরত ইদ্রিস আ., ৪. হযরত হুদ আ., ৫. হযরত সালেহ আ., ৬. হযরত ইব্রাহীম আ., ৭. হযরত লুত আ., ৮. হযরত ইসমাঈল আ., ৯. হযরত ইসহাক আ., ১০. হযরত ইয়াকুব আ., ১১. হযরত ইউসুফ আ., ১২. হযরত শুয়াইব আ., ১৩. হযরত আইউব আ., ১৪. হযরত যুল কিফল আ., ১৫. হযরত মূসা আ., ১৬. হযরত হারূন আ., ১৭. হযরত দাউদ আ., ১৮. হযরত সুলাইমান আ., ১৯. হযরত ইলিয়াস আ., ২০. হযরত আল ইয়াসা আ., ২১. হযরত ইউনুস আ., ২২. হযরত জাকারিয়া আ., ২৩. হযরত ইয়াহিয়া আ., ২৪. হযরত ঈসা আ., ২৫. হযরত মুহাম্মদ সা.
অন্য নবী রাসুলগণের নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। তবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি সকল জাতির কাছেই নবী পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি মানব বসতিতেই নবী পাঠিয়েছেন। (সুরা ফাতির – আয়াত ২৪, সুরা আর রায়াদ – আয়াত ৭)
নবী-রাসুলগনের প্রতি অবশ্যই ঈমান আনতে হবে। কুরআনে যে পঁচিশজনের নাম উল্লেখ আছে, তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি পৃথকভাবে ঈমান আনতে হবে। তাঁদের কারো প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না। আর যেসব নবী রাসুলের নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি, তাঁদের প্রতি সামগ্রিকভাবে ঈমান আনতে হবে।
সকল নবী একই দ্বীনের বাহক ছিলেন। তাঁরা সকলেই আল্লাহর প্রেরিত ছিলেন। তাঁরা মানুষকে-
১. আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছেন।
২. আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন।
৩. এক আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব করতে বলেছেন।
৪. আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন।
৫. আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী সমাজ জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন। সুবিচার করতে বলেছেন।
৬. ঈমানের ভিত্তিতে ভ্রাতৃত্ব গড়তে ও হানাহানি পরিহার করতে বলেছেন।
৭. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে আত্নরক্ষা করতে বলেছেন।
৮. জাহান্নাম থেকে বাঁচতে এবং জান্নাতের পথে চলতে বলেছেন।
নবীগণ মানুষকে কল্যাণের পথে ডেকেছেন। কিন্তু মানুষ দুনিয়ার অন্ধ মোহে লিপ্ত হয়ে নবীদের বিরোধিতা করেছে। তাঁদের অনেক দুঃখ কষ্ট দিয়েছে। অত্যাচার নির্যাতন করেছে। অনেক নবীকে লোকেরা নিজের মাতভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। আল্লাহর এই মহান নবীগণকে মানুষ হত্যা করার কূট কৌশল করেছে। অগণিত নবীকে তাঁরা হত্যা করেছে। কাউকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছে। কাউকে তারা হত্যা করার জন্যে তাড়া করেছে। কাউকে হত্যা করার জন্যে বাড়ী ঘেরাও করেছে।
এত চরম বিরোধিতা স্বত্তেও নবীগণ সত্য পথের দিকে দাওয়াত দান থেকে কখনই বিরত থাকেন নি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তাঁরা প্রত্যেকেই মানুষকে সত্য পথে আসার আহবাণ জানিয়ে গেছেন। তাঁরা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সমাজ গড়ার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না। সুতরাং আল্লাহ তাঁর অনুসারীদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবার। হযরত মুহাম্মদ সা. এর উম্মতের জ্ঞানী লোকেরা নবীর সত্যিকার উত্তরাধিকারী। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব করার, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর বিধান মাফিক পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ার ও পরিচালিত করার দায়িত্ব পালন করবে।
এখন আমাদের কাছে এ কথা স্পস্ট হল যে, পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ দুটি। একটি হল নবীদের দেখানো পথ। এটিই বিশ্ব জগতের স্রস্টা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ। এ পথের প্রতিদান হল জান্নাত বা বেহেশত।
অপরটি হল আল্লাহদ্রোহীতার পথ। এটি আল্লাহকে অমান্য করার পথ। আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথ। নবীদের অমান্য করার পথ। শয়তানের পথ। আত্নার দাসত্বের পথ। এ পথের পরিনাম হল জাহান্নাম, চির শাস্তি, চির লাঞ্ছনা, চির অকল্যাণ আর ধ্বংস।
আমাদেরকে চলতে হবে আল্লাহর পথে। চলতে হবে নবীদের পথে। নবীদের দেখানো পথই হল আল্লাহর সন্তুস্টির পথ। নবীদের পথই দুনিয়ার কল্যাণের পথ। নবীদের পথই জান্নাতের পথ। নবীদের পথ শান্তির পথ। নবীদের দেখানো পথ সুন্দর পৃথিবী গড়ার পথ। নবীদের দেখানো পথ আদর্শ মানুষ হবার পথ। নবীদের পথ উন্নতির পথ, শ্রেষ্ঠত্বের পথ। তাই তাঁদের আদর্শকে জানা, তাঁদের ভালোবাসা এবং তাঁদের আদর্শের অনুসরণ করাই সঠিক পথ।
।
প্রথম নবী হযরত আদম আ.
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর আল্রাহ তায়ালা পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আর সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষ সৃষ্টি করে তাঁকেই পৃথিবীতে তাঁর নতুন প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবেন। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ফেরেশতাদের জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘হে ফেরেশতারা, পৃথিবী নামের নতুন যে গ্রহটি আছে, সেখানে আমি এক নতুন প্রজন্মকে প্রতিনিধি নিয়োগ করবো।’’
ঘোষণাটি শুনে ফেরেশতারা বলল, ‘‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে সেখানকার ব্যবস্থাপনায় বিপর্যায় সৃষ্টি করবে, আর করবে হানাহানি রক্তপাত? আপনার প্রশংশা আর গুণগান করার জন্যেতো আমরাই নিযুক্ত রয়েছি।’’ (সুরা ২ আল বাকারা-আয়াত ৩০)
আল্লাহ তাঁদের বলে দিলেনঃ ‘‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’’ (সুরা ৬ আনয়ামঃ আয়াত ২, সুরা মুমিনুনঃ আয়াত ১২, সুরা সাজদাঃ আয়াত ৭)
সৃষ্টি করলেন আদমকে
তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন প্রথম মানুষ। সৃষ্টি করলেন তাঁকে মাটি দিয়ে। (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩০) মাটির দেহ তৈরি হয়ে যাবার পর তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন জীবন। তিনি হয়ে গেলেন এক জ্যান্ত মানুষ। আল্লাহ তাঁর নাম দিলেন ‘আদম’। তিনি আদমকে শুধু জ্যান্ত মানুষই বানান্ নি। বরং ‘‘খালাকাল ইনসান, আল্লামাহুল বাইয়ান’’-তাঁকে মানুষ বানালেন এবং কথা বলা শিখালেন।
আদম পৃথিবীর সব মানুষের পিতা।
জ্ঞানী আদম
তারপর মহান আল্লাহ ‘আদমকে সব কিছুর নাম শিখালেন’। (সুরা আল বাকারাঃ আয়াত ৩১)
নাম শিখানোর মানে কী? নাম শিখানোর মানে পরিচয় শিখানো। গুণবৈশিষ্ট এবং ব্যবহার বিধি জানানো। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আদমকে সব কিছুর পরিচয় জানিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন ব্যাবহার করার নিয়ম কানুন। প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করার জন্যে এ শিক্ষা লাভ করার প্রয়োজন ছিল অনিবার্য। এবার ফেরেশতাদের ডেকে বললেনঃ
‘‘তোমরা যে ধারণা করছিলে, তা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে বল দেখি এই জিনিসগুলির নাম।’’ (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩১)
তাঁদের সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান দেয়া হয় নি। তাঁরা বিনীত হয়ে বললো –‘‘ প্রভূ, ত্রুটিমুক্ত পবিত্র তোমার স্বত্বা। আমরা তো কিছুই জানি না। কেবলমাত্র তুমি যতটুকু শিখিয়েছ, ততটুকুই আমরা জানি। সমস্ত জ্ঞান ও বিজ্ঞতার মালিক তো তুমিই।’’ (সুরা আল বাকারাঃ আয়াত ৩২)
এবার তিনি আদমকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘আদম, তুমি ওদেরকে এ জিনিসগুলির পরিচয় বলে দাও।’’ আদম আ. সবগুলি জিনিসের পরিচয় তাঁদেরকে বলে দিলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৩)
হযরত আদম আ. এর প্রতি সেদাবনত হওয়ার হুকুম
এই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফেরেশতারা যা সন্দেহ করেছিলো, তারই জবাব দেয়া হয়েছে। তাঁদের বুঝিয়ে দেয়া হল, মানুষকে কেবল ক্ষমতা আর স্বাধীনতাই দেয়া হবে না, বরং তাঁদের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্যে জ্ঞানও দেয়া হবে।
এবার আল্লাহ্ ফেরেশতাদের হুকুম দিলেনঃ ‘‘আদমের সামনে নত হও। ’’
আল্লাহর নির্দেশে সবাই আদমের সামনে অবনতো হলো। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৪)
কিন্তু ইবলিস অবনতো হতে অস্বীকার করলো। সে অহংকার করে বললোঃ ‘‘আমি আদমের চাইতে উত্তম। কারণ তুমি আমাকে আগুণ দিয়ে সৃষ্টি করেছ। আর আদমকে তো মাটি দিয়ে তৈরি করেছ। ’’
এভাবে ইবলিস তিনটি অমার্জনীয় অপরাধ করলো। সে-
১. আল্লাহর হুকুম অমান্য করলো,
২. অহংকার করলো এবং
৩. নিজেই নিজেকে উত্তম বলে ঘোষণা করলো।
এই তিনটির চাইতে নিকৃষ্ট অসৎ গুণ আর হয় না। সুতরাং আল্লাহ্ তাঁকে ‘‘অভিশপ্ত শয়তান’’ বলে আখ্যা দিলেন। বললেনঃ ‘ তুই এখান থেকে নেমে যা। এখানে থেকে অহংকার করার কোন অধিকার তোর নেই। যা, তুই বেরিয়ে যা। এখন থেকে তুই অপমানিত ও লাঞ্ছিতদেরই একজন।’’ (আল আরাফঃ আয়াত ১৩)
এবার সে সমস্ত কল্যাণ ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হল। আর ‘ইবলিস’ মানেই নিরাশ। কিন্তু সে অহংকার ত্যাগ করলো না। সে ভাবল, আদমের কারণেই তো আমি বঞ্চিত আর অভিশপ্ত হয়েছি। সুতরাং আদম ও আদমের সন্তানদের ক্ষতি করার জন্য আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। সে আল্লাহকে বললোঃ ‘আমাকে পূনরুথ্যান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।’’ এই ‘অবকাশ দিন বলতে শয়তান আল্লাহর কাছে দুটি সুযোগ চাইলোঃ
১. কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ এবং
২. আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার সুযোগ।
‘‘আল্লাহ্ বললেন- যা তোকে সুযোগ দিলাম।’’ (আল আরাফঃ আয়াত ১৫, সুরা আল হিজরঃ আয়াত ৩৭) শয়তান বলল-
‘‘আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে এখন থেকে আমি তোমার সরল সঠিক পথের বাঁকে বাঁকে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পিছে, ডানে বামে, সব দিক থেকে আমি তাঁদের ঘিরে ফেলব। ফলে তাঁদের মধ্যে থেকে খুব কম লোককেই তুমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ পাবে।’’ (সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ১৬-১৭)
আল্লাহ বললেন, আমার বান্দাদের উপর তোর কোন প্রভাব প্রতিপত্তি চলবে না। তুই জোর করে তাঁদের সঠিক পথ থেকে ফেরাতে পারবি না। তুইতো পারবি কেবল চালবাজি করতে। মিথ্যা আশার লোভ দেখাতে। পাপের কাজকে চাকচিক্যময় করে দেখাতে। আর ভ্রান্ত পথের আকর্ষণ সৃষ্টি করতে। এই সুযোগই তো কেবল তোকে দেয়া হয়েছে। লোকদের জোর করে হেদায়েতের পথ থেকে গোমরাহির পথে টেনে নেবার ক্ষমতা তোকে দেয়া হয় নি। তবে যে সব মানুষ তোর প্রলোভনে পড়বে, আমি তাঁদেরকে আর তোকে দিয়ে জাহান্নাম ভর্তি করবো। (ইসরাঃ আয়াত ৬২-৬৫, সুরা হিজরঃ আয়াত ৪২)
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি, যে সব মানুষ আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে, শয়তান তাঁদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। সে ক্ষমতা শয়তানের নেই। শয়তান কেবল তাদেরই বিপথগামী করতে পারবে, যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে না। কিংবা তাঁর হুকুম পালনে গাফলতি করে।
আদম ও হাওয়া জান্নাতে
তারপর মহান আল্লাহ্ শয়তানকে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়ে দিলেন। আর আদমকে থাকতে দিলেন জান্নাতে। প্রথমত আদম ছিলেন একা। তারপর আল্লাহ্ আদমের (পাঁজরের হাড়) থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন। (আন নিসাঃ আয়াত ১)
এবার তিনি আদমের কাছে কিছু নির্দেশ পাঠালেন। বললেন, ‘‘হে আদম, তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনেই জান্নাতে থাকো। যা খুশি ইচ্ছামত খাও। তবে শুনো ঐ যে গাছটি, সেটির কাছেও যেও না। সেটির ফল খেও না। খেলে জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে।’’ (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৫)
বাবা আদম আর মা হাওয়া দারুন সুখে জান্নাতে থাকতে লাগলেন। কী চমৎকার জায়গা জান্নাত। সুখ আর আনন্দের অন্ত নেই এখানে। কিন্তু আদম হাওয়ার এই আনন্দ, এই সুখ শয়তানের সহ্য হয় না। সে ভাবলো, আদমের কারণেই তো আমার এই লাঞ্ছনা। যে করেই হোক, আমি যেমন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে লাঞ্ছিত হয়েছি। এরকমভাবে আদমকে দিয়েও আল্লাহর হুকুম অমান্য করাতে হবে। তখন সেও হবে আমার মত লাঞ্ছিত ও অপদস্থ।
শয়তান প্রতারণা করলো
আদম ও হাওয়া তখন পর্যন্ত শয়তানের ধোকা প্রতারণা সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা লাভ করেন নি। এই সুযোগে শয়তান খুব ভালো মানুষের বেশে এসে তাঁদের ধোঁকা দিল। সে বললোঃ তোমাদের প্রভূ তোমাদের এই গাছের নিচে যেতে নিষেধ করেছেন কেন জান? আসলে এই গাছের ফল খেলে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়। ফেরেশতা হওয়া যায়। তাছাড়া চিরদিন বেঁচে থাকা যায়। তোমরা যেন আবার ফেরেশতা না হয়ে বস, যেন চিরকাল বেঁচে না থাকো, সে জন্যই তোমাদের প্রভূ এ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন। সে কসম করে বললোঃ ‘আমি তোমাদের ভালো চাই’। এভাবে সে দুজনকেই তার প্রতারণার জালে বন্দী করে ফেললো।(আল আরাফঃ আয়াত ২০-২২)
তাঁরা দুজনেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে বসলেন। আল্লাহর নিষেধের কথা ভুলে গেলেন তাঁরা। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তাঁরা অমান্য করে বসলেন মহান আল্লাহর নির্দেশ।
সাথে সাথে তাঁদের জান্নাতি পোশাক খশে পড়লো। তাঁরা গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জা আবৃত করতে থাকেন। এ সময় আল্লাহ্ পাক তাঁদের ডেকে বললেন- আমি কি তোমাদের নিষেধ করিনি এ গাছটির কাছে যেতে? আমি কি তোমাদের বলিনি শয়তান তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।? (আল আরাফঃ আয়াত ২২)
আদম ও হাওয়ার অনুতাপ
আদম ও হাওয়া দুজনেই তাঁদের ভুল বুঝতে পারলেন। চরম অনুতপ্ত হলেন তাঁরা। অপরাধবোধ তাঁদের ভীষণ ব্যাকুল করে তুললো। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তাঁরা। অনুতপ্ত মনে কাতর কণ্ঠে তাঁরা ফরিয়াদ করলেন প্রভূর দরবারেঃ
‘‘ওগো প্রভূ, আমরা তো নিজেদের উপর অবিচার করে বসেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো, আমাদের প্রতি রহম না করো, তবে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।’’ (সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ২৬)
আল্লাহ ক্ষমা করে দিলেন তাঁদের
তাঁদের এই আন্তরিক অনুশোচনা ও তওবা আল্লাহ কবুল করলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৭)
ফলে আদম ও হাওয়া শয়তানের প্রতারণার জালে আবদ্ধ হয়ে যে অপরাধ করে ফেলেছিলেন, মহান আল্লাহ্ তা মাফ করে দিলেন। তাঁরা পূনরায় আগের মত নিষ্পাপ হয়ে গেলেন।
এখানে লক্ষ্যনীয় যে, প্রথমে ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করে অভিশপ্ত হয়েছে। পরবর্তীতে আদম আ. এবং তাঁর স্ত্রীও আল্লাহর হুকুম অমান্য করলেন। কিন্তু তাঁরা রয়ে গেলেন নিষ্পাপ ও আল্লাহর প্রিয়,– এর কারন হল, শয়তান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছে-
১. বুঝে শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে।
২. সে নিজেকে বড় মনে করেছে।
৩. সে নিজেকে উত্তম মনে করেছে।
৪. সে অহংকার করেছে।
৫. সে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছে।
৬. এই অপরাধের জন্যে সে মোটেও অনুতপ্ত হয় নি এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নি।
অন্যদিকে আদম আ. ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া-
১. ইচ্ছাকৃতভাবে বুঝে শুনে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেন নি।
২. তাঁরা বিদ্রোহও করেন নি।
৩. তাঁরা অহংকারও করেন নি।
৪. তাঁরা সচেতনভাবে মূলত আল্লাহর একান্তই আনুগত্য ছিলেন।
৫. তাঁরা অপরাধ করেছেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে।
৬. তাঁরা ভুল বুঝবার সাথে সাথে অনুতপ্ত হন। আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
খেলাফতের দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে পদার্পণ
এভাবেই আদম আ. আল্লাহর দাস ও খলিফা হবার মর্যাদা রক্ষা করেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাই আল্লাহ্ তাঁর মূল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছা করলেন। অর্থাৎ তিনি আদম আ. কে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে দিলেন। এ জন্যইতো তিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন জান্নাতে রেখে একটা পরীক্ষা নিলেন মাত্র। এ পরীক্ষার মাধ্যমে আসলে এক বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন আদম আ.। প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবার কালে, মহান আল্লাহ্ তাঁকে বলে দিলেন, যাও পৃথিবীতে অবতরণ করো। তোমার শত্রু শয়তানও সেখানে যাবে। সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমরা বসবাস করবে। সেখানে তোমাদের জীবন সামগ্রীরও ব্যবস্থা আছে। সেখানেই তোমাদের বাঁচতে হবে। সেখানেই তোমাদের মরতে হবে। আবার সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হবে, পুনরুত্থিত করা হবে। (আল আরাফঃ আয়াত ২৪-২৫)
এ প্রসঙ্গে তিনি হযরত আদম আ. কে আরও বলে দিলেন, আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে জীবন পদ্ধতি যাবে। যে আমার দেয়া জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তাঁর কোন ভয় থাকবে না। থাকবে না, কোন দুঃখ, কোন বেদনা। অর্থাৎ সে অনায়াসে আবার জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং চিরকাল সুখে থাকবে। (আল বাকারাঃ আয়াত ২৮)
আল্লাহ আরো বলে দিলেন, তবে যারা আমার জীবন পদ্ধতি অমান্য করবে আর মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিবে আমার আয়াতকে, চিরদিন তাঁদের আগুনে ফেলে রাখবো। তাঁরা তাঁদের চির শত্রু অভিশপ্ত শয়তানের সাথে অনন্ত জীবন জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। (আল বাকারাঃ আয়াত ২৯)
এভাবে হযরত আদম আ. –কে আল্লাহ্ তাঁর খলীফা ও নবী বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে থাকেন। আদম আ. তাঁর সন্তানদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে শিখান। শয়তানের ধোঁকা প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাঁর শয়তানের বিরদ্ধে সংগ্রাম করেই জীবন কাটান।
আদম আ. ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। তিনিই ছিলেন প্রথম নবী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ভদ্র ও রূচিবান। ছিলেন উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। ছিলেন অত্যন্ত সংযমশীল, আল্লহভীরু ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমপির্ত। এইসব মহান গুণাবলীর অধিকারী একজন সভ্য মানুষের মাধ্যমেই পৃথিবীতে শুরু হয় মানুষের শুভযাত্রা। আমরা এবং আমাদের আগের ও পরের সমস্ত মানুষই হযরত আদম আ. এর সন্তান। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
‘হে মানুষ, তোমাদের প্রভূকে ভয় করো। তিনিইতো তোমাদেরকে একটি মাত্র প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর থেকেই তাঁর জুড়ি তৈরি করেছেন। আর তাঁদের দুজন থেকেই বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ আর নারী। (আন নিসাঃ আয়াত ১)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মাজীদে –
১. আদম আ. এর নাম উচ্চারিত হয়েছে পঁচিশবার।
২. আট স্থানে মানুষকে আদমের সন্তান বলা হয়েছে।
৩. ইবলিস শব্দটি উল্লেখ রয়েছে এগারো বার।
৪. ৮৮ বার শয়তান শব্দের উল্লেখ হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ বার এক বচনে আর আঠারো বার বহুবচনে। আল্লাহদ্রোহী মানব নেতাদেরকেও কুরআনে শয়তান বলা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলা হয়েছে।
৫. হযরত আদম আ. এর ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছেঃ সুরা আল বাকারা, আল আরাফ, বনি ইসরাইল, আল কাহাফ, তোয়াহা, আল হিজর, সোয়াদ।
হযরত আদম আ. এর জীবন এই শিক্ষা নিতে পারি-
আল্লাহর হুকুম মানতে হবে,
শয়তানের পথ ছাড়তে হবে,
জান্নাতে যেতে হবে,
শয়তানের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
।
হযরত ইদ্রিস আ.
আল কুরআনে যে পঁচিশ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে, তাঁদেরই একজন ইদ্রিস আ.। মহান আল্লাহ্ তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আল কুরআনে আল্লাহ পাক ইদ্রিস আ. সম্পর্কে বলেনঃ
‘‘এই মহাগ্রন্থে ইদ্রিসের কথা স্মরণ করো। তিনি ছিলেন একজন বড় সত্যপন্থী মানুষ ও নবী। আমি তাঁকে অনেক বড় উচ্চস্থানে উঠিয়েছি।’’ (সুরা মরিয়মঃ আয়াত ৫৬-৫৭)
স্বয়ং আল্লাহ্ পাকই তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আর মহান আল্লাহ্ যাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তাঁর চেয়ে বড় ভাগ্যবান আর কে?
তিনি কোন সময়কার নবী?
ইদ্রিস আ. প্রাগৈতিহাসিক যুগের নবী। তাই তিনি কোন সময়কার নবী, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে অনেক মুফাসসির বলেছেন, কুরআনের বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তিনি নূহ আ. এর পূর্বেকার নবী ছিলেন এবং আদম আ. এর সন্তান বা নিকট বংশধরদের একজন ছিলেন। ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন, আদম আ. এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। ইদ্রিস আ. তাঁর জীবনের তিন শত আট বছর পেয়েছিলেন।
তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন?
তিনি কোন সময়কার নবী ছিলেন, কুরআনে যেমন সে কথা বলা হয় নি, ঠিক তেমনি তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন সে কথাও কুরআনে বলা হয় নি। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, তিনি বেবিলনের লোক। আবার কেউ কেউ বলেছেন- তিনি মিশরের লোক। আসলে দুটি কথাই ঠিক। তিনি বেবিলনে জন্ম গ্রহণ করেন। এখানে নবুয়ত লাভ করেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকেন। এখানে কিছু লোক ঈমান আনে, আর বাকী লোকেরা ঈমান আনতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, বরং তাঁরা হযরত ইদ্রিস ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা আরম্ভ করে। ফলে ইদ্রিস আ. তাঁর সংগী সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন। এখানে এসে তিনি নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানকার মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে থাকেন।
ইদ্রিস আ. এর নবুয়ত
হযরত আদম ও হযরত শীষ আ. এর পরে আল্লাহ্ তায়ালা হযরত ইদ্রিসকে নবুয়ত প্রদান করেন। তিনি বড় জ্ঞানী লোক ছিলেন। তাঁকে প্রাচীনতম বিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় তিনিই সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার করেন।
ইসরাইলী বর্ণনায় ইদ্রিস আ. কে ‘হনোক’ বলা হয়েছে। তালমূদে বলা হয়েছে- ‘হনোক’ তিন শত তিপ্পান্ন বছর পর্যন্ত মানব সন্তানদের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর শাসন ছিল ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ শাসন। তাঁর শাসনামলে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হতে থাকে।
হযরত ইদ্রিস আ. একসময় খারাপ লোকদের থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করছিলেন। এরি মধ্যে তাঁর কাছে আল্লাহর ফেরেশতা এসে তাঁকে ডেকে বললেন, ‘হে ইদ্রিস, ওঠো একাকি থাকার জীবন ত্যাগ করো। মানুষের মাঝে চলা ফেরা করো এবং তাঁদের সঠিক পথ দেখাও।’ এ নির্দেশ পেয়ে হযরত ইদ্রিস বের হয়ে আসেন এবং মানুষকে ডেকে উপদেশ দিতে শুরু করেন।
বেবিলনের লোকেরা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য কিছু লোক হযরত ইদ্রিসের দাওয়াত কবুল করে আল্লাহর পথে চলতে আরম্ভ করেন। কিন্তু অধিকাংশ লোক আল্লাহর পথে আসতে অস্বীকার করে। তাঁরা হযরত ইদ্রিস ও তাঁর সাথীদের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করে। তিনি যখন দেখলেন এদের আর সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন এবং নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন। হযরত ইদ্রিস এখানকার লোকদেরকে সৎ পথে চলার উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। লোকেরা তাঁর প্রচেষ্টায় ব্যাপকভাবে আল্লাহর পথে আসতে থাকে। ফলে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে শান্তি আর সুখের ফোয়ারা। হযরত ইদ্রিস আ. মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার কাজে এবং মানুষকে আল্লাহর আইন অনুযায়ী চালাবার কাজে যত বিরোধিতার এবং দুঃখ মুসিবতেরই সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে তিনি চরম ধৈর্য ও সবর অবলম্বন করেন। তাইতো মহান আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রশংসা করে পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘‘আর ইসমাঈল, ইদ্রিস, যুলকিফল এরা প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল। আমি তাঁদের প্রবেশ করিয়েছি আমার রহমতের মাঝে। তাঁরা ছিল সৎ এবং সংশোধনকামী।’’ (সুরা ২১ আল আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৫)
হযরত ইদ্রিস আ. এর উপদেশ
ইসরাইলী সূত্র এবং কিংবদন্তী আকারে হযরত ইদ্রিস আ. এর বেশ কিছু উপদেশ এবং জ্ঞানের কথা প্রচলিত আছে। এখানে তাঁর কিছু উপদেশ ও জ্ঞানের কথা তুলে ধরা হল-
১. আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে যদি সংযোগ থাকে ধৈর্য ও সবরের, তবে বিজয় তাঁর সুনিশ্চিত।
২. ভাগ্যবান সে, যে আত্মসমালোচনা করে। আল্লাহ্ প্রভূর দরবারে প্রত্যেক ব্যক্তির সুপারিশ হল তাঁর নেক আমল।
৩. সঠিকভাবে কর্তব্য পালনের মধ্যেই আনন্দ। শরিয়া দ্বীনের পূর্ণতা দান করে। আর যে ব্যক্তি দ্বীনের দিক থেকে পূর্ণ, সেই ব্যক্তি শক্তিশালী।
হযরত ইদ্রিস আ. মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালন করতে বলতেন। তাঁরই ইবাদত ও দাসত্ব করতে বলতেন। তিনি মানুষকে উপদেশ দিতেন- পরকালে নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে, দুনিয়াতে নেক আমল করতে এবং এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে। তিনি নির্দেশ দিতেন সালাত কায়েম করতে, সিয়াম পালন করতে, যাকাত পরিশোধ করতে এবং পবিত্রতা অবলম্বন করতে।
কথিত আছে, হযরত ইদ্রিস আ. এর সময়কালে বিরাশিটি ভাষা চালু ছিল। তিনি সবগুলি ভাষা জানতেন এবং সবগুলি ভাষাতেই কথা বলতে পারতেন। তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকদেরকে তাঁদের নিজেদের ভাষায় উপদেশ দিতেন। আল কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আমি যখনই কোন রাসুল পাঠিয়েছি, সে নিজ কওমের ভাষায় তাঁদের দাওয়াত দিয়েছে।’’ (সুরা ইব্রাহীমঃ আয়াত ৪)
জানা যায় হযরত ইদ্রিস আ.- ই সর্বপ্রথম নগর সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর সময় ১৮৮ টি নগর গড়ে উঠেছিলো।
তাঁর মর্যাদা
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যখন মি’রাজে গিয়েছিলেন, তখন চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিস আ. এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হযরত ইদ্রিস তাঁকে দেখে বলে ওঠেনঃ ‘শুভেচ্ছা স্বাগতম, হে আমার মহান ভাই।’
কুরআন মাজীদে হযরত ইদ্রিস আ. এর নাম দুইবার উল্লেখ হয়েছে। একবার সুরা মরিয়মে আর একবার সুরা আম্বিয়াতে। উভয় স্থানেই আল্লাহ্ তায়ালা ইদ্রিস আ. এর উচ্চ গুণাবলীর ও মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন।
।
হযরত নূহ আ.
অনেক অনেক বছর হলো আদম আ. বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। তাঁর স্ত্রী হাওয়াও আর বেঁচে নেই। তাঁদের মৃত্যুর পর শত শত বছরের ব্যবধানে অনেক বেড়ে গিয়েছিল তাঁদের বংশধারা। এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য নারী পুরুষ আদম সন্তান। ইরাকসহ বর্তমান আরব দেশগুলিই ছিল তাঁদের বসবাসের এলাকা।
আদম আ. এর মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন তাঁর সন্তানেরা ইসলামের পথেই চলে। চলে আল্লাহর পথে। মেনে চলে আল্লাহর বিধান। অনুসরণ করে আল্লাহর নবী আদমের পদাংক। তাঁদের মাঝে জন্ম নেয় অনেক আলেম। তাঁরাও তাঁদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করার চেষ্টা সাধনা করে যান। এরি মধ্যে হযরত ইদ্রিস আ. ও অতীত হয়ে যান। কিন্তু কালক্রমে আদম সন্তানরা আদম আ. এর শিক্ষা ভুলে যান। ভুলে যান ইদ্রিস আ. এর উপদেশ। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায় তাঁরা। ইসলামের পথ থেকে তাঁরা সড়ে পড়ে দূরে।
ফলে তাঁরা শয়তানের অনুসারী হয়ে যায়। পরিনত হয় আত্নার দাসে। তাঁরা অহংকারি হয়ে পড়ে। দুনিয়ার জীবনটাকেই বড় করে দেখতে শুরু করে। এখানকার লাভ ক্ষতিকেই তাঁরা আসল লাভ ক্ষতি মনে করে। শুধু তাই নয়। বরং সব চাইতে বড় অপরাধটিও তাঁরা করে বসে। সেটা হল শিরক। তাঁরা শিরকে নিমজ্জিত হয়। মনগড়া দেবদেবীদের তাঁরা আল্লাহর অংশীদার আর প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয়। পূজা করার জন্যে তাঁরা মূর্তি তৈরি করে নেয়।
তাঁদের বড় মূর্তিটির নাম ছিলপ ‘অদ্দ’। এ ছিল পুরুষ দেবতা। একটি মূর্তির নাম ছিল ‘সূয়া’। এটি ছিল দেবী। একটির নাম ছিল ‘ইয়াগুস’। এটির আকৃতি ছিল সিংহের মত। একটি মূর্তি ছিল ঘোড়ার আকৃতির। এটির নাম ছিল ‘ইয়াউক’। আরো একটি বড় মূর্তি ছিলো। ঈগল আকৃতির এই মূর্তিটির নাম ছিল ‘নসর’।১ (সুরা নূহ আয়াত ২৩)
এইসব মূর্তির তাঁরা পূজা করতো। এসব অসহায় দেবদেবীকে তাঁরা আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছিলো। তাঁরা অন্ধকারে ডুবেগিয়েছিল। তাঁদেরই এক উঁচু ঘরে জন্ম নেয় এক শিশু। সে বড়ো হয়ে ওঠে তাঁদেরই মাঝে। কৈশোর, তারুণ্য পার হয়ে যৌবনে এসে উপনীত হয়। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, যোগ্যতা, দক্ষতা দেখে সবাই ভাবে, ভবিষ্যতে সেই হবে উন্নত মানুষ। সে কখনো মিথ্যা বলে না। অন্যায় অপরাধে জড়িত হয় না। কারো প্রতি অবিচার করে না। উন্নত পবিত্র চরিত্রের সে অধিকারী।
আল্লাহ্ নূহকে নবী মনোনীত করেন। তাঁর কাছে অহী পাঠানঃ ‘‘কঠিন শাস্তি আশার আগেই তুমি তোমার জাতির লোকদেরকে সাবধান করে দাও।’’ (সূরা নূহঃ আয়াত ১)
আল্লাহ্ নূহের কাছে তাঁর দ্বীন নাজিল করেন। দ্বীন মানে জীবন যাপনের ব্যবস্থা। আল্লাহর দ্বীনের নাম ‘ইসলাম’। আল্লাহর দ্বীন অনুযায়ী জীবন যাপন না করলে যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, নিজ জাতিকে সে ব্যাপারে সতর্ক্ করার জন্যে আল্লাহ্ নূহ –কে নির্দেশ প্রদান করেন।
নূহ তাঁর জাতির লোকদের বললেন- ‘‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো। তাঁর হুকুম মেনে চলো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কেবল তাকেই ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমার আনুগত্য করো। যদি তাই না করো, আমার ভয় হচ্ছে, তবে তোমাদের উপর একদিন কঠিন শাস্তি এসে পড়বে। আমি কিন্তু তোমাদের স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি।’’
নূহ তাঁদের আর বলেনঃ ‘‘আমি তোমাদের যেভাবে চলতে বলছি, তোমরা যদি সেভাবে চলো, তবে আল্লাহ্ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন। আর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন। নইলে কিন্তু আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে।’’ (সূরা নুহঃ আয়াত ২৪-২৫)
নূহের এই কল্যাণময় হিতাকাঙ্ক্ষী আহবানের জবাবে তাঁর জাতির নেতারা বললোঃ তুমি কেমন করে হলে আল্লাহর রাসুল? তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ।৩ (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)
সাধারণ মানুষের উপর কিন্তু নূহের ছিলো দারুন প্রভাব। তাঁরা জাতির স্বার্থপর নেতাদের চাইতে নূহ-কেই বেসি ভালোবাসতো। নেতারা যখন দেখলো জনগণ তো নূহের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। তাঁর সাথী হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সমস্ত কায়েমি স্বার্থ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন তাঁরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। তাঁরা জনগণকে বলে, ‘‘দেখ নূহের কাণ্ড, সে তো তোমাদের মতই একজন মানুষ মাত্র। কিন্তু সে নিজেকে আল্লাহর রাসুল বলে দাবী করছে। আসলে ওসব কিছু নয়। সে এভাবে দেশের প্রধান নেতা এবং কর্তা হতে চায়। কোন মানুষ যে আল্লাহর রাসুল হতে পারে, এমন কথা তো বাপদাদার কালেও শুনিনি। আল্লাহ্ যদি আমাদের মাঝে কোন রাসুল পাঠাতেনই তবে নিশ্চয়ই কোন ফেরেশতা পাঠাতেন। তোমরা ওর কথায় কান দিও না। ওকে আসলে জীনে পেয়েছে।’’ ৪ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৩-২৫)
এভাবে বৈষয়িক স্বার্থের ধারক এই নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে দিলো। তাঁরা নূহের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলো। নূহ দিন রাত তাঁদের সত্য পথে আসার জন্যে ডাকতে থাকেন বুঝাতে থাকেন। নূহ তাঁদের আল্লাহর পথে আনবার জন্যে যে কী আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, তা আমরা নূহ আ. এর কথা থেকেই জানতে পারি। তিনি মহান আল্লাহর কাছে তাঁর কাজের রিপোর্ট দিতে গিয়ে বলেন,
‘‘হে আমার প্রভূ, আমি আমার জাতির লোকদের দিনরাত ডেকেছি তোমার দিকে। কিন্তু আমার আহবানে তাঁদের এড়িয়ে চলার মাত্রা বেড়েই চলেছে। আমি যখনই তাঁদের ডেকেছি তোমার ক্ষমার দিকে, তাঁরা তাঁদের কানে আঙুল ঢেসে দিয়েছে। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। এসব অসদাচরণে তাঁরা অনেক বাড়াবাড়ি করে চলেছে। তাঁরা সীমাহীন অহংকারে ডুবে পড়েছে। পরে আমি তাঁদের উঁচু গলায় ডেকেছি। প্রকাশে দাওয়াত দিয়েছি। গোপনে গোপনেও বুঝিয়েছি। আমি তাঁদের বলেছি, তোমরা তোমাদের মালিকের কাছে ক্ষমা চাও। তিনি বড় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে পানি বর্ষণ করবেন। ধনমাল আর সন্তান দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের জন্যে বাগবাগিচা সৃষ্টি করে দিবেন। নদী-নালা প্রবাহিত করে দিবেন।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ৫-১২)
নূহ তাঁদের বুঝালেন, কেন তোমরা আল্লাহর পথে আসবে না? তিনি তাঁদের বললেন, “দেখ না, আল্লাহ্ কিভাবে স্তরে স্তরে সাতটি আকাশ বানিয়েছেন? চাঁদকে বানিয়েছেন আলো আর সূর্যকে প্রদীপ? আল্লাহই তো তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনি এই মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন। তারপর তোমাদের বের করবেন এই মাটি থেকেই। আল্লাহই তো পৃথিবীটাকে তোমাদের জন্যে সমতল করে বিছিয়ে দিয়েছেন, যাতে করে তোমরা উন্মুক্ত পথ ঘাট দিয়ে চলাচল করতে পার।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ১৫-২০) এত করে বুঝাবার পরেও তাঁরা নূহের কথা শুনল না। তাঁরা নিজেদের গোঁড়ামি আর অহংকারে অটল রইল। তাঁরা নূহকে বলল, আমরা কেমন করে তোমার প্রতি ঈমান আনি? তোমার অনুসারী যে কয়জন হয়েছে, ওরা তো সব ছোট লোক। আমরা তোমাদেরকে আমাদের চাইতে বেশী মর্যাদাবান মনে করি না। বরং আমরা তোমাদের মিথ্যাবাদীই মনে করি। (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)
তারা আর বললোঃ “আমরা তো তোমাকে দেখছি স্পষ্ট মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল আরাফঃ আয়াত ৬০)
নূহ তাদের আবারো বুঝালেন, “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি মোটেও বিপথে চলছি না। আমি তো বিশ্বজগতের মালিকের বাণী বাহক। আমি তো কেবল আমার প্রভূর বাণীই তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আমি তো কেবল তোমাদেরই কল্যাণই চাই। আমি আল্লাহর পক্ষ এমন সব জিনিস জানি, যা তোমরা জানো না। হে আমার দেশবাসী, তোমরা একটু ভেবে দেখো, আমি যদি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর থাকি আর তিনি যদি আমাকে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহও দান করে থাকেন, কিন্তু তোমরা যদি তা না দেখতে পেলে, তবে আমার কি করবার আছে? তোমরা মেনে নিতে না চাইলে আমি তো আর তোমাদের উপর তা চাপিয়ে দিতে পারি না। হে আমার ভাইয়েরা, আমি যে দিন রাত তোমাদের আল্লাহর পথে ডাকছি, তার বিনিময়ে তো আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাই না। আমি তো কেবল আল্লাহর কাছে এর বিনিময় চাই। এতেও কি তোমরা বুঝতে পারছো না যে, তোমাদের ডাকার এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই?” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬১-৬২, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৮-২৯)
এভাবে আল্লাহর মহান ধৈর্যশীল নবী হযরত নূহ আ. কয়েক শত বছর পর্যন্ত তাদের আল্লাহর পথে ডাকেন। তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা করেন। ধ্বংস ও শাস্তির হাত থেকে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তাঁর এই মহৎ কাজের জবাব দেয় তিরস্কার, বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তাদের সমস্ত বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় হাজার বছর ধরে তিনি পরম ধৈর্যের সাথে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যান। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তাদের বুঝাবার চেষ্টা করেন।
কিন্তু তাঁর হাজারো মর্মস্পর্শী আবেদন নিবেদনের পর তারা তাঁর কথা শুনলো না। আল্লাহর দ্বীন কবুল করলো না তারা। স্বার্থপর নেতারা জনগণকে বলে দিলোঃ “তোমরা কিছুতেই নূহের কথায় ফেসে যাবে না। তাঁর কথায় কোন অবস্থাতেই তোমরা দেব দেবীদের ত্যাগ করবে না। ত্যাগ করবে না ‘অদ্দ’ আর ‘শুয়া’ কে। ইয়াগুস, ইয়াউক আর নসরকেও পরিত্যাগ করতে পারবে না। এভাবে তারা অধিকাংশ জনগণকে সম্পূর্ণ বিপথগামী করে দিলো।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৩-২৪)
শুধু কি তাই? বরং তারা এর চাইতেও বড় ষড়যন্ত্র করলো। তারা আল্লাহর নবী নূহ আ. –কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো। কুরআনের ভাষায়- ‘ওয়া মাকারু মাকরান কুব্বারা’ – তারা এক বিরাট ষড়যন্ত্র পাকালো। (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২২) তারা নূহ আ. কে অহংকারী ভাষায় শাসিয়ে দিলো, “নূহ, তুমি যদি বিরত না হও, তবে বলে দিচ্ছি, তুমি হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৬)
শুধু তাই নয়, তারা নূহ আ. কে ধমকের সুরে আরো বললো, “তুমি তো এতদিন আমাদের সাথে বড় বেশী বিবাদ করেছ। শুনো, তুমি যে আমাদের ধমক দিচ্ছিলে, তোমার কথা না শুনলে আমাদের উপর বিরাট শাস্তি নেমে আসবে, কোথায় সেই শাস্তি? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তবে শাস্তিটা নিয়ে এসে দেখাও।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩২)
নূহ আ. বললেন, দেখো তোমাদের শাস্তি দেয়া তো আমার কাজ নয়। সেটা আল্লাহর কাজ। তিনি চাইলে তোমাদের শাস্তি দিবেন। আর তিনি শাস্তি দিতে চাইলে সেটা তোমরা কিছুতেই আটকাতে পারবে না। শুধু তাই নয়, তখন যদি আমিও তোমাদের কোন উপকার করতে চাই, করতে পারবো না। আল্লাহর ফায়সালা পরিবর্তন করার সাধ্য কারো নেই।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৩-৩৪)
এবার মহান আল্লাহ্ অহীর মাধ্যমে তাঁর প্রিয় দাস নূহকে জানিয়ে দিলেন, “হে নূহ, তোমার জাতির যে কয়জন লোক ঈমান এনেছে, তাদের পর এখন আর কেউ ঈমান আনবে না। সুতরাং তুমি তাদের কার্যকলাপে দুঃখিত হইও না।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৬)
আল্লাহর বিচক্ষণ বান্দা ও নবী হযরত নূহ আ. এটাকে তাঁর অবাধ্য ও চরম অধপতিত জাতির উপর অচিরেই আল্লাহর আজাব আসবার সবুজ সংকেত মনে করলেন। তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, “আমার প্রভূ, তুমি এই কাফিরদের একজনকেও বাঁচিয়ে রেখো না। তুমি যদি তাদের ছেড়ে দাও, তাহলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিপথগামী করে ছাড়বে। আর তাদের ঔরসের প্রজন্মও দূরাচারী আর কাফিরই হবে। হে প্রভূ, তুমি আমাকে আর আমার বাবা মাকে মাফ করে দাও। আর সেসব নারী পুরুষকেও মাফ করে দাও, যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৬-২৮)
নূহ আরও বললেন, “প্রভূ, এই লোকগুলির মোকাবেলায় তুমি আমাকে সাহায্য করো। ওরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। আমাকে অস্বীকার করছে। এখন আমার আর তাদের মাঝে তুমি চুড়ান্ত ফায়সালা করে দাও। তবে আমাকে আর আমার সাথী মুমিনদের তোমার পাকড়াও থেকে বাঁচাও। (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৬, সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৭-১১৮)
আল্লাহ্ নূহের জাতির এই দুষ্ট লোকগুলিকে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটাই আল্লাহর নিয়ম। কোন জাতি বিপথগামী হলে, আল্লাহ্ তাদের সত্য পথ দেখানোর জন্যে নবী বা সংশোধনকারী পাঠান। নবীরা তাদের সত্য পথে আনার জন্যে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালান। অসৎ লোকদের সাংঘাতিক বিরোধিতার মূখেও তাঁরা জনগণকে সংশোধন করার চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যান। কিন্তু তাদের সকল চেষ্টার পরও যখন আল্লাহ্ বাস্তবে দেখে নেন যে, এই লোকগুলি আর সত্য পথে আসবে না। তখন তিনি তাদের ধ্বংস করে দেন। নূহ আ. এর জাতির বাস্তব অবস্থাও তাই ছিলো। আল্লাহর নবী নূহ আ. হাজার বছর ধরে তাদের আল্লাহর পথে আনার চেষ্টা করেন। দিনরাত তিনি তাদের বুঝান। গোপনে গোপনে বুঝান। জনসভা, আলোচনা সভা করে বুঝান। তারা শুনতে চায় না, তবু তিনি জোর গলায় তাদের ডেকে ডেকে বুঝান। তাঁকে দেখলে তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিত। তিনি কথা বলতে গেলে তারা কানে আঙ্গুল চেপে ধরত। হাজারো রকমের তিরস্কার তারা তাঁকে নিয়ে করতো। বলত এতো ম্যাজেসিয়ান। কিন্তু তিনি তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা সাধনা চালিয়েই যান। কিছু যুবক অবশ্য ঈমান আনে। কিন্তু জাতির সর্দার নেতারা পরবর্তী সময়ে জনগণের আল্লাহর পথে আসার সকল পথ বন্ধ করে দেয়। তখন তারা সবাই আল্লাহর চরম বিরোধী হয়ে যায়। তাদের সত্য পথে আসার আর কোন সম্ভাবনাই আর বাকী থাকে না। এমনকি তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করার পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে। অবশেষে আল্লাহ তাদের পৃথিবী থেকে ধ্বংস করার ফায়সালা করেন। তিনি নূহ আ.-কে নির্দেশ দেন, “নূহ, আমার তদারকীতে তুমি একটি নৌযান তৈরি করো।”১২ (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৭)
আল্লাহ্ নূহ আ.-কে আর বলে দিলেন, “চুলা ফেটে যখন পানি উঠবে, তখন তুমি নৌযানের মধ্যে সব রকমের জীবজন্তু এক জোড়া এক জোড়া করে উঠাবে। তবে তাদের উঠাবে না যাদের ব্যাপারে আমি ফায়সালা দিয়ে দিয়েছি, যে তারা ডুবে মরবে।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৭)
হযরত নূহ আ. আল্লাহর নির্দেশে তৈরি করতে লাগলেন এক বিশাল নৌযান। তাঁর বিরুদ্ধচারীরা যখন সেখান দিয়ে যাতায়াত করতো, তারা নৌযান তৈরি নিয়েও নূহের প্রতি বিদ্রুপ করতো। তারা তাঁকে তিরস্কার করতো।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৮) আসলে তাদের আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি ঈমানই ছিলো না। তারপর একদিন নৌযান তৈরি শেষ হলো। নূহ আ. আল্লাহর নির্দেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর একদিন হঠাৎ দেখা গেলো চুলা ফেটে মাটির নিচ থেকে অনর্গল পানি বেরুতে লাগলো। নূহ আ. বুঝতে পারলেন আল্লাহর নির্দেশ এসে গেছে। তিনি ঈমানদারদের ডেকে বললেন, তোমরা জলদি করে নৌযানে ওঠে পড়ো। তিনি দ্রুত সমস্ত ঈমানদার লোকদের নৌযানে তুলে দিলেন। সব রকমের জীব জন্তু একেক জোড়া তুলে নিলেন। দুজন ছাড়া তাঁর পরিবারের সকলকে তুলে নিলেন। এদের একজন নূহ আ. এর স্ত্রী। যিনি বাপদাদার জাহেলি ধর্ম অনুসারীদের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে আল্লাহও তাঁকে প্লাবনের পানিতে ডুবিয়ে মারলেন। আরেকজন হলো স্বয়ং নূহ আ. এর হতভাগ্য পুত্র। সেও ঈমান আনে নি। নির্দেশমতো সবাই যখন নৌযানে উঠে গেল, তখন দেখতে দেখতে ঘটে গেল এক অবাক কাণ্ড। চারিদিকে যমিন ফেটে সৃষ্টি হলো অসংখ্য ঝর্ণাধারা। প্লাবনের বেগে মাটির নিচে থেকে উঠতে শুরু করলো পানি আর পানি। সাথে সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। নিচে থেকেও উঠছে পানি। উপর থেকেও পড়ছে পানি। চারিদিকে পানি আর পানি। পানির উপরে ভাসতে শুরু করলো নৌযান। নূহ আ. দোয়া করলেনঃ “আল্লাহর নামে শুরু হচ্ছে এর চলা আর আল্লাহর নামেই থামবে এ নৌযান। আমার প্রভূ অবশ্যি অতিশয় ক্ষমাশীল দয়াময়।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৪১)
অদূরেই নূহের কাফির পুত্রটি দাঁড়িয়ে ছিলো। নূহ দেখলেন, পাহারের মতো উঁচু হয়ে এক বিরাট ঢেউ এগিয়ে আসছে। তিনি চিৎকার করে ছেলেকে ডেকে বললেন, এখনো সময় আছে ঈমান এনে আমাদের সাথী হয়ে যা। কাফিরদের সাথী হসনে। এক্ষুনি ডুবে মরবি।” অসৎ ছেলেটি বললোঃ “আমি পাহাড়ে উঠে যাবো, পানি আমাকে কিছুই করতে পারবেনা।” নূহ আ. বললেন- একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া আজ কেঊ রক্ষা পাবে না।” এরি মধ্যে এক বিরাট ঢেঊ এসে ছেলেকে তলিয়ে নিয়ে গেলো। (সূরা হুদঃ আয়াত ৪২-৪৩)
ঈমানের পথে না এলে নবীর ছেলে হলেও আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। নবীর স্ত্রী হলেও মুক্তি পাওয়া যায়না। দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির একমাত্র পথ হলও ঈমানের পথ, নবী দেখানো পথ। এরপর পানিতে সমস্ত কিছু ভেসে গেলো। বড় বড় পাহাড় পানির মধ্যে তলিয়ে গেলো। দিন যায়, রাত আসে। মাস যায়, মাস আসে। আকাশ আর পাতালের পানিতে পৃথিবী তলিয়েই চলেছে। নূহ আ. এর নৌযানের মানুষ আর প্রাণীগুলো ছাড়া সমস্ত জীবজন্তু মরে শেষ। একটি মানুষও আর বেঁচে নেই। সব দুষ্ট লোক আর আল্লাহর নবীর শত্রুরা ধ্বংস হয়ে শেষ হয়ে গেল। আল্লাহ্ তায়ালা এভাবে তাঁর প্রিয় নবী নুহ আ. ও তাঁর সাথীদেরকে রক্ষা করলেন যালিমদের অত্যাচার ষড়যন্ত্র থেকে। তাই তিনি নূহ আ.- কে নির্দেশ দিলেন এই ভাষায় শোকর আদায় করতেঃ
“শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি যালিমদের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৮)
সেই সাথে আল্লাহ্ নূহ আ.-কে এই দোয়া করতেও নির্দেশ দিলেনঃ
“প্রভূ, আমাকে বরকতপূর্ণ স্থানে অবতরণ করাও, আর তুমিইতো সর্বোত্তম স্থানে অবতরণ করিয়ে থাকো।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৯)
অবশেষে আল্লাহ একদিন হুকুম দিলেনঃ “হে পৃথিবী সমস্ত পানি গিলে ফেলো, হে আকাশ বর্ষণ বন্ধ করো।’’ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪)
মহান আল্লাহর নির্দেশে আকাশ পানি বর্ষণ বন্ধ করলো। পৃথিবী তাকে ডুবিয়ে রাখা সমস্ত পানি চুষে খেয়ে ফেললো। তারপর নূহ আ. এর নৌযানটি জুদি (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪) পাহাড়ের চুড়ায় এসে ঠেকলো। আর্মেনিয়া থেকে কুর্দিস্তান পর্যন্ত রয়েছে এক দীর্ঘ পর্বতমালা। এই পর্বতমালারই একটি নাম হলো জুদি পর্বত। এটি কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইবনে উমর দ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মুসলমানরা হযরত উমর রা. এর খিলাফত আমলে যখন ইরাক ও আল জাজিরা বিজয় করেন, তখন মুসলিম সৈনিকদের অনেকেই জুদি পাহাড়ের উপর নূহ আ. এর নৌযান দেখতে পান।
নৌযান জুদি পর্বতে ঠেকার পর আল্লাহ্ নির্দেশ দিলেনঃ “হে নূহ, নেমে পড়ো। নেমে আসো পৃথিবীতে। এখন থেকে তোমার প্রতি আর তোমার সংগী সাথীদের প্রতি আমার নিকট হইতে রইলো শান্তি আর প্রাচুর্য।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৮)
তাঁরা নেমে আসেন পৃথিবীতে। সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন আল্লাহর অনুগত দাস হিসেবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মাজীদে –
১. নূহ আ. এর নাম উচ্চারিত হয়েছে তিতাল্লিশ বার।
২. যে সব সুরায় নূহের কথা ও কাহিনী উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলোঃ আলে ইমরান, আনয়াম, নিসা,আরাফ, তাওবা, ইউনুস, হুদ, ইবরাহীম, বনি ইসরাইল, মরিয়ম, আম্বিয়া, হজ্জ, মুমিনুন, ফুরকান, শুয়ারা, আন কাবুত, আহযাব, সাফফাত, সোয়াদ, মুমিন, শুরা, কাফ, যারিয়াত, নাজম, কামার, তাহরীম, নূহ।
৩. নূহ আ. এর কাহিনী বিস্তারিত জানা যাবে সূরা আরাফ, হুদ, মুমিনুন, শোয়ারা এবং নূহে।
।
হযরত হুদ আ.
নূহ আ. এর সময় আল্লাহ্ তাঁর দ্বীনের শত্রুদের প্লাবন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কেবল হযরত নুহ আ. আর তাঁর ঈমানদার সাথিদের। এই বেঁচে থাকা মুমিনরা আর তাদের বংশধরেরা অনেকদিন আল্লাহর বিধান আর নবীর আদর্শ মাফিক জীবন যাপন করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পর লোকেরা আবার ভুল পথে চলতে শুরু করে। তাঁরা নবীর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। এক আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। এমনি করে তাঁরা ডুবে পড়লো শিরক আর মূর্খতার অন্ধকারে।
আদ জাতি
সেকালে আরবের সবচে’ শক্তিশালী জাতি ছিলো আ’দ জাতি। ইয়েমেন, হাজরামাউত ও আহকাফ অঞ্চল নিয়ে এরা এক বিরাট রাজ্য গড়ে তুলেছিলো। তাদের ছিলো অগাধ দৈহিক শক্তি আর ছিলো বিরাট রাজশক্তি। তাঁরা গড়ে তুলেছিলো বড় বড় শহর, বিরাট বিরাট গম্বুজধারী অট্টালিকা আর বিলাস সামগ্রী। নূহ আ. এর পর আল্লাহ্ তায়ালা আ’দ জাতিকে ক্ষমতা প্রদান করেন। তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানান। নিজের অপার অনুগ্রহে তাদের চরম উন্নতি দান করেন। ফলে গোটা আরবের উপর চলতে থাকে তাদের দাপট। কিন্তু এ উন্নতির ফলে তাঁরা গর্ব ও অহংকারে নিমজ্জিত হয়। নূহ আ. এর দেখানো পথ থেকে তাঁরা দূরে সরে যায়। মহান আল্লাহকে ভুলে গিয়ে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। নূহ আ. এর তুফানের পর তারাই সর্বপ্রথম মূর্তি পূজা শুরু করে। তাদের নেতাগণ ছিলও যালিম, স্বৈরাচারী। জনগণকে তাঁরা নিজেদের হুকুমের দাস বানিয়ে নিয়েছিলো। তাঁরা এতই অহংকারী হয়ে উঠেছিলো যে, কাউকেই পরোয়া করতো না। তাঁরা ঘোষণা করলো, “আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে?” (সূরা ৪১ হামিম আস সিজদাঃ আয়াত ১৫)
তাঁরা ভুলে গেলো যে, আল্লাহই সর্বশক্তিমান। আল্লাহই তাদের এতো উন্নতি দান করেছেন।
মুক্তির বার্তা নিয়ে এলেন হুদ
আদ জাতীকে সুপথ দেখাবার জন্যে আল্লাহ্ তাদের মাঝে একজন নবী পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেন। এ জাতির সবচে’ ভালো লোক হুদকে আল্লাহ্ তাদের নবী মনোনীত করেন। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ “আমি আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হুদকে রাসুল বানিয়ে পাঠালাম। হুদ আল্লাহর বাণী পেয়ে তাঁর জাতির লোকদের ডেকে বললোঃ “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কি তোমাদের পাপ কাজের অশুভ পরিণতির ভয় করো না?” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৫)
আল্লাহর নবী হুদ আ. তাদের বুঝালেন- “ভাইয়েরা আমার, তোমরা তোমাদের দয়াময় প্রভূর কাছে ক্ষমা চাও। তাঁর দিকে ফিরে এসো। তাহলে তিনি তোমাদের বৃষ্টি বর্ষীয়ে পানি দিবেন। তোমাদের বর্তমান শক্তিকে আরো শক্তিশালী করবেন। দেখো। তোমরা অপরাধীদের মতো তাঁকে উপেক্ষা করো না।” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫২)
দরদভরা হৃদয় নিয়ে হযরত হুদ তাদের আরও বললেনঃ “তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? দেখো, আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমি যে তোমাদের বুঝাবার এতো চেষ্টা করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাইনা। এতে কি তোমরা বুঝতে পারছো না, এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই? আমিতো কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই। আমাকে প্রতিদান দিবেন তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।” (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১২৪-১২৭)
হুদ আ. তাঁদের আরো বুঝালেনঃ “তোমাদের এ কি হলো? প্রতিটি স্থানেই কেন তোমরা অর্থহীন মূর্তি বানাচ্ছো? কেনই বা এতো অট্টালিকা গড়ে তুলছো? এগুলো কি তোমাদের চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে ভাবছো? তোমরা যখন কাউকেও পাকড়াও করো, তখন কেন নির্বিচারে অত্যাচারীর ভূমিকা পালন করো? এবার এসো আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। সেই মহান প্রভূকে ভয় করো যিনি তোমাদের সবকিছুই দিয়েছেন। তোমরাতো জানোই তিনি তোমাদের দিয়েছেন অগণিত পশু, অসংখ্য সন্তান-সন্তুতি। দিয়েছেন কতোনা বাগ-বাগিচা, নদ-নদী, ঝর্ণাধারা। তোমাদের ব্যাপারে এক গুরতর দিনের শাস্তির আশংকা আমি করছি।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১২৮-১৩৫)
এভাবে হুদ আ. তাঁর জাতির লোকদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন। তাঁদের তিনি মহান প্রভূ আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। পরকালের খারাপ পরিণতির কথা তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁদের ক্ষমা চাইতে বলেন। আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে বলেন। আল্লাহর হুকুম পালন করতে এবং নবীর পথে চলতে বলেন। তিনি তাঁদের বলেনঃ এটাই পার্থিব কল্যাণ আর পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ।
আদ জাতি নবীর প্রতিপক্ষ হলো
এতো আন্তরিক আহবান আর কল্যাণময় উপদেশ সত্ত্বেও আদ জাতি নবীর কথা শুনলো না। আল্লাহর পথে এলো না। দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে পারলো না। উল্টো তাঁরা নবীর সাথে বিতর্ক শুরু করলো। তারা নবীকে বললোঃ “আমরা মনে করি তুমি বোকা। তোমার কোন বুদ্ধি নেই। তাছাড়া আমাদের ধারণা, তুমি এসব মিথ্যা কথা বলছো।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৬)
তাঁরা আল্লাহর রাসুলকে আরো বললোঃ “তোমার উপদেশ আমরা মানি না। তোমার এসব উপদেশ সেকেলে লোকদের অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে আমাদের উপর কোন শাস্তিই আসবে না।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১৩৬-১৩৮)
তাঁদের প্রতিবাদের জবাবে আল্লাহর নবী বললেনঃ “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি কোন বোকা নির্বোধ ব্যক্তি নই। বরং আমি বিশ্ব জগতের মালিক মহান আল্লাহর রাসুল। আমিতো কেবল তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছি। আর আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত কল্যাণকামী। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৭-৬৮)
হযরত হুদ তাঁদের আর বললেনঃ “তোমাদের সতর্ক করার জন্যে তোমাদের জাতিরই এক ব্যক্তির কাছে তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে ‘উপদেশ বার্তা’ এসেছে বলে কি তোমরা বিস্মিত হচ্ছো? স্মরণ করো নূহের জাতির পর আল্লাহ্ তো তোমাদেরকেই পৃথিবীর প্রতিনিধি বানিয়েছেন। তোমাদের জনবল ও দেহবলের অধিকারী করেছেন। সুতরাং আল্লাহর দানশীলতাকে স্মরণ রেখো। আশা করা যায়, তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৯)
পার্থিব কায়েমি স্বার্থ আর শয়তানের ধোঁকা আদ জাতির নেতাদের প্রতারিত করলো। তাঁরা আল্লাহর নবীকে বললোঃ “হে হুদ, তুমি কি এ জন্যে নবী হয়ে এসেছো যে, আমরা কেবল এক খোদার ইবাদত করবো আর আমাদের বাপদাদারা যে সব মা’বুদের (দেব দেবীর) পূজা করতো, তাঁদের ত্যাগ করবো? তুমি তো আমাদের কাছে কোন দলিল প্রমাণ নিয়ে আসোনি। আমরা কখনো তোমার কথায় আমাদের খোদাগুলোকে ত্যাগ করবো না। আমরা বলছি, আমাদের খোদাদের কোন একটির গজব তোমার উপর আপতিত হয়েছে।” ২ (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭০, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৩-৫৪)
এবার আল্লাহর নবী হুদ আ. তাঁদের বললেনঃ “তোমাদের উপর তোমাদের মালিক আল্লাহর অভিশাপ আর গজব এসে পড়েছে। তোমরা কি আমার সাথে সেই সব মনগড়া খোদাদের ব্যাপারে বিতর্ক করছো, যেগুলোর নাম তৈরি করেছো তোমরা নিজেরা আর তোমাদের বাপ দাদারা? অথচ সেগুলোর পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রমাণ নেই। তোমরা যদি আমার কথা না শোনো, তবে অপেক্ষা করতে থাকো। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭১)
হযরত হুদ আ. এর দীর্ঘ দাওয়াতের ফলে জনগণের মধ্যে একটা নাড়া পড়েছিল। তাঁরা শিরক করছিলো ঠিকই কিন্তু আল্লাহকে তাঁরা জানতো। আর হুদ আ. যেহেতু তাঁদের আল্লাহর দিকেই ডাকছিলেন, সুতরাং তাঁর দাওয়াতের একটা বিরাট প্রভাব জনগণের উপর পড়ছিল। তাই জনগণ হযরত হুদের প্রতি ঈমান এনে ফেলতে পারে এই ভয়ে পাপিষ্ঠ নেতারা ময়দানে নেমে এলো। জনসভা করে তাঁরা হযরত হুদ আ. এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করতে লাগলো। তাঁরা জনগণকে বললোঃ “এ ব্যক্তি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। তোমরা যা খাও, সেও তাই খায়। তোমরা যা পান করো, সেও তাই পান করে। কেমন করে সে নবী হতে পারে? তবে তাঁর কথা মেনে নিলে তোমাদের দারুন ক্ষতি হবে। হুদ যে তোমাদের বলছে, তোমরা যখন মরে গিয়ে মাটির সাথে হাড়-গোড়ে পরিণত হবে, তখন তোমাদের আবার কবর থেকে বের করে আনা হবে। তাঁর এই অঙ্গীকার অসম্ভব। আমাদের এই পৃথিবীর জীবনটাই তো একমাত্র জীবন। আমাদের মরন বাচন সব এখানেই শেষ। আসলে আমাদের আর কখনো উঠানো হবে না। আল্লাহর নাম নিয়ে হুদ মূলতঃ মিথ্যে বলছে। আমরা তাঁর কথা মানি না। ”৩ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৩-৩৮)
কিছু লোক ঈমান আনলো
বিবেকবান লোকদের মনে সত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলেও যালিম অত্যাচারী শাসকদের ভয়ে তাঁরা সত্য গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেনি। কেবল কিছু সংখ্যক সাহসী যুবক যুবতীই আল্লাহর পথে এগিয়ে এলো। তাঁরা নবীর সাথি হলো। জীবন বাজী রেখে তাঁরা আল্লাহর পথে কাজ করতে থাকলো। এখন জাতি সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক পক্ষে রয়েছেন আল্লাহর নবী আর তাঁর সাথী একদল যুবক যুবতী। গোটা জাতির তুলনায় এদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। প্রতিপক্ষে ছিল শাসক গোষ্ঠী আর ঐ সব লোক, বাতিল সমাজের সাথে জড়িয়ে ছিলো যাদের স্বার্থ।
সময় ঘনিয়ে এলো
আল্লাহর নবী হুদ আ. অবশেষে তাঁদের চরম বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মোকাবেলায় বলে দিলেনঃ “আমি তোমাদের সামনে সাক্ষী হিসেবে স্বয়ং আল্লাহকেই পেশ করছি। আর তোমরা সাক্ষী থাকো, আল্লাহর ক্ষমতায় তোমরা যাদের অংশীদার বানাচ্ছো আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে যা করার করো। আমার ভরসা তো মহান আল্লাহর উপর। তিনি আমারো মালিক, তোমাদেরও মালিক। সমস্ত জীবের ভাগ্য নিয়ন্তা তো তিনিই। তিনি যা করেন, তাই সঠিক। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৪-৫৬)
হযরত হুদ তাঁদের আর বলে দিলেন, “তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও, নাও। কিন্তু জেনে রেখো, আল্লাহ্ আমাকে যে বার্তা নিয়ে পাঠিয়েছেন তা আমি তোমাদের কাছে পুরোপুরি পৌঁছে দিয়েছি। এখন আমার প্রভূ তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে বসাবেন এবং তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৭)
অতঃপর সবধরনের চেষ্টা শেষ করার পর হযরত হুদ আ. যখন দেখলেন এদের সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নাই, তখন মনে বড় কষ্ট নিয়ে তিনি দোয়া করলেন, “আমার প্রভূ, এরা তো মিথ্যা বলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন তুমিই আমাকে সাহায্য করো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৯)
জবাব এলো, “ অচিরেই এরা নিজেদের কৃতকর্মের (নিষ্ফল) অনুশোচনা করবে। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪০)
ধ্বংস হলো আ’দ জাতি
আল্লাহর নবী হুদ আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে সংকেত পেলেন যে, তিনি এখন এ জাতিকে ধ্বংস করে দিবেন। বড় মনোবেদনার সাথে তিনি তাঁদের জানিয়ে দিলেন, “আল্লাহর রোষ এবং আযাব তোমাদের জন্যে অবধারিত হয়ে পড়েছে। ” জাতির শাসকরা অহংকার করে বললো, “আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে? ” তাঁরা হযরত হুদকে আরো বললো- “তুমি যে আমাদের শাস্তি দেয়ার অংগীকার করছো, তুমি সত্যবাদী হলে সেই শাস্তি দিয়ে দেখাও। ”
অবশেষে তাঁদের উপর আল্লাহর আযাব এসে পড়লো। উপত্যকার দিক থেকে আযাব তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছিলো। তাঁরা বললো- এতো মেঘ, অনেক বৃষ্টি হবে। হুদ বললেন, “এই সেই অংগীকার, যার জন্যে তোমরা তাড়াহুড়ো করছিলে। এটা প্রচণ্ড ঝড়। এতে রয়েছে চরম যন্ত্রণাদায়ক আযাব। এটা প্রতিটা বস্তুকে ধ্বংস করে রেখে যাবে। ” (সূরা ৪৬ আহকাফঃ আয়াত ২৪)
অল্প পরেই ধেয়ে এলো মেঘ। ধ্বংস করে দিয়ে গেলো সব কিছু। ধ্বংস হয়ে গেলো আল্লাহদ্রোহী শক্তি। আল কুরআনে তাঁদের ধংশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
“আর আ’দ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ঠাণ্ডা ঝড় বায়ু দিয়ে। সে বায়ু তিনি তাঁদের উপর দিয়ে চালিয়ে দেন একাধারে সাত রাত আট দিন। অতঃপর সেখানে তাঁরা চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকলো যেন উপড়ানো খেজুর গাছের কাণ্ড। কোন পাপীই তা থেকে রক্ষা পায়নি। ” (সূরা ৬৯ আল হাক্কাহঃ আয়াত ৬-৮)
“এক বিকট ধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। আর আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম খড় কুটোর মতো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪১)
এভাবে ধ্বংস হয়ে গেলো তৎকালীন বিশ্বের মহা শক্তিশালী আ’দ জাতি। আল্লাহ্ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন, ধ্বংস করে দিলেন তাঁদের দেশ ও সুরম্য শহর। ধূলিস্যাত হয়ে গেলো তাঁদের অহংকার। বিরান হয়ে গেলো তাঁদের জনবসতি। তাঁদের শহর ‘আহকাফ’ এখন এক বিরাট মরুভূমি। এখনো সেই ভূতুরে মরুভূমি অতিক্রম করতে লোকেরা ভয় পায়। শোনা যায়, সেই মরুভূমিতে যা কিছু পড়ে সবই তলিয়ে যায়।
প্রাচীনকালে এতই নাম করা ছিলও যে, এখনো লোকেরা তাঁদের নাম অনুযায়ী যে কোন প্রাচীন জাতিকে ‘আদি জাতি’, ‘আদি বাসী’ বলে থাকে। প্রাচীন ভাষাকে ‘আদি ভাষা’ বলে থাকে। এতো প্রতাপশালী একটি জাতিকেও মহান আল্লাহ্ ধ্বংস করে দিলেন তাঁর আয়াতকে অস্বীকার করা ও তাঁর নবীকে অমান্য করার ফলে। তাঁদের ধ্বংসের ইতিহাসের মধ্যে পৃথিবীর সকল জাতির জন্যেই রয়েছে উপদেশ।
হযরত হুদ ও তাঁর সাথিরা বেঁচে গেলেন
কিন্তু এই সর্বগ্রাসী ধ্বংস থেকে আল্লাহ্ হুদ আ. ও তাঁর সাথিদের (ঈমানদার) বাঁচিয়ে দিলেন। মহান আল্লাহ্ বলেন, “ যখন আমার হুকুম এসে গেলো, তখন আমি নিজ রহমতে হুদ ও তাঁর সাথে ঈমান গ্রহণকারীদের রক্ষা করলাম আর এক কঠিন আযাব থেকে তাঁদের বাঁচালাম। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৮)
আযাব আসার পূর্বক্ষণে আল্লাহ্ পাকের নির্দেশে হুদ আ. তাঁর সাথিদের নিয়ে নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেন। এভাবেই আল্লাহ্ তাঁদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। মহান আল্লাহ্ আ’দ জাতির যে সব পাপিষ্ঠদের ধ্বংস করে দিয়েছেন, তাঁরা ছিলো প্রথম আ’দ। ” (সূরা ৫৩ আন নাজমঃ আয়াত ৫০)। আর হযরত হুদ আ. এর সাথে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন দ্বিতীয় আ’দ। পরবর্তীকালে এই দ্বিতীয় আদ’ই আবার বড় আকার ধারণ করে।
হুদ আ. যে সব বিষয়ে আহ্বান করেছিলেন
হুদ আ. তাঁর জাতিকে কি দাওয়াত দিয়েছেন? আসুন কুরআন মাজীদ দেখি। কুরআন বলে হযরত হুদ আ. তাঁর জাতিকে বলেছিলেনঃ
১. হে আমার জাতি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর হুকুম পালন করো।
২. আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই।
৩. নিজেদের অপরাধের জন্যে তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।
৪. তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে এসো।
৫. আমি তো কেবল আমার প্রভূর বার্তা তোমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছি।
৬. আমি কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই।
৭. আমি বোকা নই আমি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের রাসুল।
৮. কল্যাণ চাও তো মহান আল্লাহর দান সমূহকে স্মরণ করো।
৯. আমার প্রভূ সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
১০. সমস্ত প্রানীর ভাগ্য আল্লাহর হাতে।
১১. আমি আমার মালিক ও তোমাদের মালিক আল্লাহর উপর ভরসা রাখি।
১২. তোমরা বিবেক খাটিয়ে চলো।
১৩. তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহ্ অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থানে বসাবেন।
১৪. আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় তোমরা যাদের শরীক করছো, আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি।
১৫. আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো।
১৬. আমি তোমাদের উপর এক কঠিন দিনের শাস্তির ভয় করছি।
১৭. মহান আল্লাহই সমস্ত জ্ঞানের উৎস।
১৮. এ কাজের বিনিময়ে আমি তোমাদের কছে কোন প্রতিদান চাই না। আমাকে প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব মহান আল্লাহর। (হুদ আলাইহিস সালামের এই আহবানগুলি কুরআন থেকে নেয়া হয়েছে)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মাজীদে হযরত হুদ আ. এর নাম উল্লেখ আছে সাত বার। আ’দ জাতির নাম উল্লেখ হয়েছে চব্বিশ বার। হুদ আ. এর নাম উল্লেখ হয়েছে সূরা আ’রাফ আয়াত ৬৫ ; হুদ আয়াত ৫০,৫৩,৫৮,৬০, ৮৯ এবং সূরা শোয়ারা; আয়াত ১২৪। হযরত হুদ হযরত হুদ আ. ও আ’দ জাতির কথা উল্লেখ যে সব সুরায় – সূরা আরাফ, সূরা তাওবা, সূরা হুদ, সূরা ইবরাহীম, সূরা হাজ্জ, সূরা শোয়ারা, সূরা ফুরকান, সূরা আনকাবুত, সূরা সোয়াদ, সূরা মুমিনুন, সূরা হামিম আস সিজদা, সূরা আহকাফ, সূরা কাফ, সূরা যারিয়াত, সূরা আন নাজম, সূরা আল কামার, সূরা আলহাক্কাহ এবং সূরা আল ফজরে।
।
হযরত সালেহ আ.
হযরত হুদ আ. এর সাথে আ’দ জাতির যে লোকগুলো বেঁচে গিয়েছিলেন, সামুদ জাতি তাঁদেরই উত্তর পুরুষ। পরবর্তী কালে এ বংশের কোন প্রভাবশালী নেতার নামে এরা সামুদ জাতি নামে পরিচিত হয়। প্রথমে ‘আদ’দের’ ধ্বংসের পর উত্তর দিকে সরে এসে এরা নিজেদের আবাস ও বসতি গড়ে তোলে। সেকালে এদের আবাস এলাকার নাম ছিল ‘হিজর’। এ কারণে কুরআনে এদেরকে ‘আসহাবুল হিজর’ বা হিজরবাসী নামেও অভিহিত করা হয়েছে। (সূরা ১৫ আল হিজর” আয়াত ৮০-৮৪)। তাঁদের সেই ঐতিহাসিক এলাকার বর্তমান নাম হলো ‘ফাজ্জুন্নাকাহ’ এবং ‘মাদায়েনে সালেহ’। এ স্থানটির অবস্থান হিজাজ ও সিরিয়ার গোটা মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে।
বৈষয়িক উন্নতি ও নৈতিক অধঃপতন
সামুদ জাতির বৈষয়িক ও নৈতিক অবস্থা ছিল আ’দ জাতিরই অনুরূপ। সামুদ জাতি সমতল ভুমি আর পাহাড়ের গাত্র খোদাই করে গড়ে তোলে ভুরি ভুরি সুরম্য অট্টালিকা। এগুলোর প্রযুক্তিগত কারুকাজ ছিল খুবই উন্নত। তাছাড়া এগুলো ছিল অত্যন্ত বিলাসবহুল। ছিল ঝর্নাধারা, বাগবাগিচা, থরে থরে খেজুরের বাগান। এতো সব প্রাসাদ, মনোরম উদ্যান আর স্মৃতিসৌধ তাঁরা কেন গড়ে তুলেছিল? কুরআন বলছে ‘ফারেহীন’ অর্থাৎ তাঁরা এগুলো গড়ে তুলেছিল গর্ব- অহংকার, ক্ষমতা, অর্থ আর প্রযুক্তিগত উন্নতি দেখানোর জন্যে। (সূরা ৪০ আল মুমিনুনঃ আয়াত ৮৩)
কুরআন আরো বলছে, তাঁরা সাধারণ মানুষের উপর যুলুম ও শোষণ করে তাঁদের দুর্বল করে রেখেছিল। মূর্তি পূজাকে তাঁরা তাঁদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছিল। আর মূর্তিগুলোর উপর পৌরোহিত্য করতো এসব নেতারা। দেব দেবীর মূর্তির নামেই জনগণকে করা হত শোষণ। মনগড়া পূজা অর্চনা করার মধ্যেই ছিল তাঁদের যাবতীয় সুবিধা। ধর্মের মুখোশ পরেই তাঁরা আল্লাহদ্রোহীতার নেতৃত্ব দেয়। সমাজপতিরা ছিলো যালিম, প্রতারক আর শোষক। এই ঘুনে ধরা নোংরা নৈতিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের শিল্প, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নতির বাহার। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তাঁদের ভেতরের কলুষতা।
আলোর মশাল নিয়ে এলেন হযরত সালেহ আ.
এই অধঃপতিত জাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্যে মহান আল্লাহ্ সামুদ জাতির সবচাইতে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি সালেহ কে তাঁদের নবী নিযুক্ত করলেন। আল্লাহর বাণী আর হিদায়েতের আলো নিয়ে হযরত সালেহ আ. জনগণ এবং জাতির নেতৃবৃন্দের নিকট উপস্থিত হলেন । অত্যন্ত দরদ ভরা হৃদয় নিয়ে তিনি তাঁদের আহবান জানালেন কল্যাণ ও মুক্তির দিকে। আহবান জানালেন তাঁদের মালিক ও প্রভু মহান আল্লাহর দিকে। বললেন- “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। নেই কোন হুকুমকর্তা। তিনিই তো যমীন থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এখানেই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তোমাদের অপরাধের জন্যে তাঁর কাছে ক্ষমা চাও আর তাঁর দিকে ফিরে এসো। তিনি অবশ্যই তোমাদের ডকে সাড়া দিবেন।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬১)
তাঁদের ভাই সালেহ তাঁদের আর উপদেশ দিলেন, “তোমরা কি ভয় করবেনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। তোমাদের বুঝাবার জন্যে আমি যে এতো কষ্ট করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর দায়িত্বে। তোমাদের এই সব উদ্যান, ঝর্নাধারা, ক্ষেত-খামার, বাগান ভরা রসাল খেজুর আর অহংকার প্রদর্শনের জন্যে পাহাড় গাত্রে নির্মিত বালাখানাসমূহের মধ্যে কি তোমাদের চিরদিন নিরাপদে থাকতে দেয়া হবে? সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। এই সীমালংঘনকারী নেতাদের হুকুম মেনো না। তাঁরা তো পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কোন সংস্কার সংশোধনের কাজ তাঁরা করছে না।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৪২-১৫২)
এসব মর্মস্পর্শী উপদেশের জবাবে জাতির নেতারা বললো, “হে সালেহ, এতোদিন তোমাকে নিয়ে আমাদের কতই না আশা ভরশা ছিল। আর এখন কিনা তুমি আমাদেরকে আমাদের দেব দেবীদের পূজা উপাসনা থেকে বিরত রাখতে চাও। তোমার কথায় আমাদের সন্দেহ- সংশয় রয়েছে।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬২)
সালেহ বললেন, “ভাইয়েরা আমার, তোমরা একটু ভেবে দেখো। আমি যদি আমার প্রভূর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক উজ্জ্বল প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি আর তাঁর বিশেষ অনুগ্রহেও ধন্য হয়ে থাকি, তবে কে আমাকে তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা করবে যদি তাঁর নির্দেশের খেলাফ করি? (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৩)
তাঁদের কল্যাণের পথে আনার জন্যে হযরত সালেহ তাঁদের এতো করে বুঝালেন। কিন্তু তাঁরা বুঝলো না। তারা শলা পরামর্শ করলো, “আমাদের সবার মাঝে সে একজন মাত্র লোক। আমরা সবাই তাঁর অনুসরণ করবো? তাহলে আমরা তো ভ্রান্তি আর অগ্নিতে নিমজ্জিত হবো। আমাদের সবার মাঝে কেবল তাঁরই উপর উপদেশ অবতীর্ণ হলো? আসলে সে মিথ্যাবাদী।”
সাধারণ জনগণের মন হযরত সালেহ আ. এর উপদেশে বিগলিত হচ্ছিলো। কিন্তু এইভাবে তারা জনগণকে ডেকে এনে আবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলো।
নিদর্শন দেখাবার দাবী
জাতির নেতারা এবার হযরত সালেহ আ. এর প্রতি এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। তারা বললো, “তোমার উপর কেউ যাদু করেছে। নইলে তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ। হ্যাঁ তবে তুমি যদি সত্য নবী হয়ে থাকো, তাহলে কোন নিদর্শন দেখাও।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৩- ১৫৪)
এ কথা বলে তারা একটি বড় পাথর খণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করে বললো- এই পাথরের ভেতর থেকে যদি গাভীন উটনী বের করে আনতে পারো, তবে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো এবং তোমার আনুগত্য করবো। তারা মনে করেছিলো, তাঁদের এ দাবী পূরণ করা হযরত সালেহ আ. এর জন্যে অসম্ভব। তারপর হযরত সালেহ তাঁদেরকে নিদর্শন দেখানোর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তাঁর বুক ভরা আশা ছিলো, নিদর্শন দেখালে হয়তো তারা ঈমান আনবে।
আল্লাহ বললেন, “হে সালেহ, আমি উটনী পাঠাচ্ছি ঠিকই। তবে এই উটনী হবে তাঁদের জন্যে চুড়ান্ত পরীক্ষা স্বরূপ। তুমি স্থির থাকো আর তাঁদেরকে বলে দাওঃ “কূপের পানি পান করার জন্যে তাঁদের মাঝে পালা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ একদিন পুরো পানি পান করবে সেই উটনী আর একদিন পান করবে তারা সবাই আর তাদের পশুরা।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৫)
আল্লাহর নিদর্শনের উটনী
অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে সমস্ত মানুষের সামনে পাথর থেকে উটনী বেরিয়ে এলো। হযরত সালেহ এবার উটনীর ব্যাপারে মহান আল্লাহর ফরমান তাঁদের জানিয়ে দিলেন। একটি ছোট্ট ভাষণ তিনি তাঁদের সামনে পেশ করলেন, “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, সত্যিই আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। দেখো তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে পড়েছে। এটি আল্লাহর উটনী। এটি তোমাদের জন্যে চুড়ান্ত নিদর্শন। সতরাং একে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দাও। আল্লাহর যমীনে সে মুক্তভাবে চরে বেড়াবে। কেউ তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার চেষ্টা করো না। তাহলে চরম পীড়াদায়ক শাস্তি তোমাদের গ্রাস করে নেবে। তোমরা সে সময়টার কথা স্মরণ করো, যখন মহান আল্লাহ আ’দ জাতির উপর তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করেন এবং এমনভাবে এ ভূখণ্ডে তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেন যে, তোমরা মুক্ত ময়দানে প্রসাদ নির্মাণ করছো আর পাহাড় কেটে বিলাস গৃহ করছো। সুতরাং মহান আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের মতো সীমালঙ্ঘন করো না।” (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৩-৭৪)
জাতি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল
মহান নবী হযরত সালেহ আ. এর আহবানে সত্য উপলব্ধি করতে পেরে জাতির কিছু লোক ঈমান আনলো। আল্লাহর পথে এলো। নবীর সাথী হলো। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু জাতির নেতারা এবং তাঁদের অধিকাংশ অনুসারী ঈমান গ্রহণ করলো না। এই হঠকারী নেতারা ঐ নির্যাতিত মুমিনদের লক্ষ্য করে বললো – ‘তোমরা কি সত্যি জানো যে, সালেহ তাঁর প্রভুর রাসুল?’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫)
মুমিনরা বললেন –‘আমরা অবশ্যই জানতে পেরেছি এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫) অহংকারী নেতারা বললো- ‘তোমরা যে বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তা মানি না।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৬)
তারা হত্যা করলো উটনীকে
আল্লাহর উটনী স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে লাগলো। একদিনের সমস্ত পানিই উটনী পান করতো। তাঁদের ক্ষেত-খামারে সে অবাধে বিচরণ করতো। এভাবে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হয়। ঈমান না আনলেও এই অলৌকিক উটের ব্যাপারে তাঁদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিলো। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও উটনীকে তারা অনেকদিন বরদাশত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলো না। তারা শলা পরামর্শ করলো এবং সিদ্ধান্ত নিল উটনীকে হত্যা করবে। কিন্তু কে নেবে উটনীকে হত্যা করার দায়িত্ব? এক চরম হতভাগা এগিয়ে এলো। জাতির নেতারা তাঁর উপরে এ দায়িত্ব সপে দিলো। এক চরম ভয়াবহ পরিণতির ভয় তারা করলো না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর উটনীকে তারা হত্যা করলো। এভাবে দ্রুত এগিয়ে এলো তারা নিজেদের করুণ পরিণতির দিকে।
আর মাত্র তিন দিন
উটনী হত্যার খবর পেয়ে, হযরত সালেহ কম্পিত হলেন। কিন্তু আফসোস, তাঁর জাতি বুঝল না। তাঁর আর কিছুই করার নেই। তিনি দৌড়ে এলেন। তারা বললো, সালেহ, তুমি তো অংগীকার করেছিলে একে হত্যা করলে আমাদের উপর বিরাট বিপদ নেমে আসবে। কোথায় তোমার সেই বিপদ? যদি সত্যি তুমি রাসুল হয়ে থাকো, তবে এনে দেখাও সেই বিপদ। আল্লাহর নবী সালেহ এবার তাঁদের জানিয়ে দিলেন, ‘এখন তোমাদের শেষ পরিণতির সময় আর মাত্র তিনদিন বাকী আছে। নিজেদের সুরম্য প্রাসাদগুলোতে বসে এই তিনদিন ভালো করে ভোগ বিলাস করে নাও। এ এক অনিবার্য অংগীকার।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৫)
এবার নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র
উটনীকে হত্যা করার পর এবার সামুদ জাতির নেতারা স্বয়ং হযরত সালেহ আ.-কেই সপরিবারে হত্যা করার ফায়সালা করলো। তারা ভাবলো, সালেহই তো আমাদের পথের আসল কাঁটা। সে-ই তো আমাদের ভোগ বিলাসে বাধা দিচ্ছে। আমাদের জীবন পদ্ধতি বদলে দিতে চাচ্ছে। আমাদের ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চাইছে। আমাদের সমালোচনা করছে। জনগণকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। তাঁর কারণেই তো এখন আমাদের উপর বিপদ আসার আশংকা দেখা দিয়েছে। সুতরাং তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলেই সব চুকে যায়। সামুদ জাতির নয়টি সম্প্রদায়ের নেতারা বসে শেষ পর্যন্ত ঐ তিন দিনের মধ্যেই নবীকে হত্যা করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরো সিদ্ধান্ত নেয়, হত্যার পরে সালেহর অভিভাবক হিসেবে যিনি তাঁর রক্তমূল্যের দাবীদার হবেন, তাঁকে বলবো, আমরা এ হত্যাকান্ডে জড়িত নই। এ ঘটনা কুরআন মজিদে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, “শহরে ছিলো নয়জন দলপতি। তারা দেশকে অন্যায় অনাচারে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। কোন প্রকার ভালো কাজ তারা করতো না। তারা একে অপরকে বললো- আল্লাহর কসম খেয়ে অংগীকার করো, রাতেই আমরা সালেহ আর তাঁর পরিবারবর্গের উপর আক্রমন চালাবো। তারপর তাঁর অভিভাবককে বলবো, তোমার বংশ ধ্বংস হবার সময় আমরা ওখানে উপস্থিতই ছিলাম না। আমরা সত্য সত্য বলছি।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৪৮-৪৯)
ওদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, “তারা একটা ষড়যন্ত্র পাকালো আর আমরাও একটা পরিকল্পনা বানালাম। যা তারা টেরই পেলো না।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫০)
ধ্বংস হলো সামুদ জাতি
আল্লাহ্ বলেন, “এখন চেয়ে দেখো, তাঁদের ষড়যন্ত্রের পরিণতি কি হলো? আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম, সেই সাথে তাঁদের জাতিকেও। ” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫১)
আল্লাহ্ সামুদ জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের গর্ব অহংকার ও ভোগ বিলাস সব তলিয়ে গেলো। মুফাসসিরগণ তাঁদের ধ্বংসের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন- হযরত সালেহ যে তাঁদের তিন দিনের সময় বেধে দিলেন, তাতে তাঁদের অন্তরে ভয় ঢুকে গেলো। প্রথম দিন তাঁদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন তাঁদের চেহারা লালবর্ণ হয়ে যায়, আর তৃতীয় দিনে তাঁদের চেহারা হয়ে যায় কালো। অতঃপর তিনদিন শেষ হবার পরপরই রাত্রিবেলা হঠাৎ এক বিকট ধ্বনি এবং সাথে সাথে ভুমিকম্প শুরু হয়ে যায়। বজ্রধ্বনি আর ভুকম্পনে তারা সম্পূর্ণ বিনাস হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ্ বলেন, “হঠাৎ বজ্রধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। যখন ভোর হলো, তখন দেখা গেলো, তারা নিজেদের ঘর দোরে মরে উপর হয়ে পড়ে রইলো, যেন এসব ঘরে তারা কোন দিনই বসবাস করেনি।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৭-৬৮)
তাঁদের উন্নত প্রযুক্তির সুরম্য অট্টালিকা সমূহের ধ্বংসাবশেষ আজো তাঁদের অঞ্চলে শিক্ষণীয় হয়ে পড়ে আছে।
বেঁচে গেলেন হযরত সালেহ আ. এবং তাঁর সাথীরা
তারা হযরত সালেহ আ. কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো যে রাতে, সে রাতেই মহান আল্লাহ্ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন। সে ধ্বংস থেকে আল্লাহ্ পাক হযরত সালেহ এবং তাঁর সাথীদের রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের নিরাপদে বাঁচিয়ে রাখলেন। মহান আল্লাহ্ বলেন, “অতঃপর যখন ওদের ধ্বংশ হবার নির্দিষ্ট সময়টি আসলো, তখন সালেহ এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল, তাঁদেরকে বিশেষ রহমতের দ্বারা রক্ষা করলাম। সেদিনকার লাঞ্ছনা থেকে নিরাপদ রাখলাম। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু দুর্দান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং মহাপরাক্রমশীল।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৬)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আল কুরআনে হযরত সালেহ আ. এর নাম উল্লেখ আছে ৯ বার। যেসব সুরায় উল্লেখ আছে সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ, আয়াত ৭৩, ৭৫, ৭৭, সূরা হুদ, আয়াত ৬১, ৬২, ৬৬, ৮৯, সূরা শোয়ারা, আয়াত ১৪২, সূরা নামল, আয়াত ৪৫।
আল কুরআনে সামুদ জাতির নাম উল্লেখ আছে ২৬ স্থানে। সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ, আয়াত ৭৩, তাওবা, ৭০, হুদ ৬১, ৬৮, ৬৮, ৯৫, ইবরাহীম ৯, ইস্রা ৫৯, হজ্জ ৪২, ফুরকান ৩৮, শোয়ারা ১৪১, নামল ৪৫, আন কবুত ৩৮, সোয়াদ ১৩, মুমিন ৩১, হামিমুস সাজদা ১৩-১৭, কাফ ১৩, যারিয়াত ৪৩, আন নাজম ৫১, আল কামার ২৩, আল হাক্কাহ ৪, ৫, বুরুজ ১৮, আল ফজর, আশ সামস ১১।
।
হযরত ইবরাহীম আ.
জন্ম ও কৈশোর
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। নমরূদীয় ইরাকের ঊর নগরীতে জন্ম হয় এক শিশুর। একদিন সেই শিশুটিই হন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ। ওর বাবা আজর ছিলেন বড় একজন ধর্মীয় পুরোহিত। তিনি নিজের হাতে মূর্তি তৈরি করতেন। আর ঐ মূর্তিগুলোকেই সারা দেশের মানুষ দেবতা বলে মানতো। ওদের পূজা উপাসনা করতো। ছেলে জন্ম হওয়ায় বাবা আজর দারূন খুশি। ভাবেন, আমার পরে আমার এই ছেলেই হবে ধর্মীয় পুরোহিত। নিজ হাতে সে দেবতা বানাবে। সে রক্ষা করবে আমার ধর্মীয় ঐতিহ্য। মনের খুশিতে আজর তাঁর পুত্রের নাম রাখেন ইব্রাহিম। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন। তিনি ইব্রাহিমকে দিয়ে মূর্তি ভাংগার পরিকল্পনা করেন। আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইব্রাহিম বড় হতে থাকে। ইব্রাহিমকে তিনি নিজ ভান্ডার থেকে দান করেন অগাধ জ্ঞান, বুদ্ধি আর দূরদৃষ্টি। কিশোর বয়স থেকেই ইব্রাহিম সব কিছু যুক্তি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে থাকেন।
চিন্তা করেন ইব্রাহিম
ইব্রাহিম ভাবেন, নিজেদের হাতে মূর্তি বানিয়ে সেগুলোকে খোদা মানা তো বিরাট বোকামি। যারা কারো উপকার করতে পারে না, কারো অপকারও করতে পারে না, তারা খোদা হয় কেমন করে? কেউ যদি ঐ দেবতাগুলির ক্ষতি করতে চায়, তা থেকেও দেবতাগুলি আত্মরক্ষা করতে পারে না। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর পিতা ও সমাজের লোকেরা বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছে। তিনি তাঁর বাবাকে বলেন, “বাবা, আপনি কি মূর্তিকে খোদা মানেন? আমিতো দেখছি, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা পরিষ্কার ভুলের মধ্যে আছেন।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৭৪)
ইব্রাহিম দেখলেন, তাঁর জাতির লোকেরা চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্রেরও পূজা করছে। তারা মনে করলো, এগুলো তো শক্তিশালী দেবতা। কিন্তু এরা যে খোদা হতে পারে না, তা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। রাত্রি বেলা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ইব্রাহিম বলেন- তোমরা বলছো এ আমার প্রভু, অতঃপর নক্ষত্র যখন ডুবে গেলো, তখন তিনি বলে দিলেন, অস্তমিত হওয়া জিনিসকে আমি পছন্দ করি না। এরপর উজ্জ্বল চাঁদ উদয় হলো। তিনি বললেন- তবে এই হবে প্রভু, কিন্তু যখন চাঁদও ডুবে গেলো, তিনি তখন বললেন- এতো খোদা হতে পারে না। আসল প্রভু মহাবিশ্বের মালিক নিজেই যদি আমাকে পথ না দেখান, তবে আমিতো বিপথগামীদের দলভুক্ত হয়ে পড়বো।
অতঃপর সকাল হলে পুবাকাশে ঝলমল করে সূর্য উঠলো। তবে তো এই হবে খোদা। কারণ এতো সবার বড়। তারপর সন্ধ্যায় যখন সূর্য ডুবে গেলো, তখন তিনি তাঁর কওমকে সম্বোধন করে বললেন- তোমরা যাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার অংশীদার ভাবছো, আমি তাঁদের সকলের থেকে মুখ ফেরালাম। আমি সেই মহান প্রভুর নিকট আত্মসমর্পণ করছি, যিনি আসমান আর জমিনকে সৃষ্টি করেছেন। আমি তাঁর সাথে কাউকেও অংশীদার বানাবো না।
শুরু হলো বিবাদ
এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর জাতির লোকেরা তাঁর সাথে বিবাদে লিপ্ত হলো। তিনি তাঁদের বললেন- “তোমরা কি মহান আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে বিতর্ক করছো? তিনি তো সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা যাদেরকে আল্লাহর আংশীদার মানো, আমি ওদের ভয় করি না। আমি জানি ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
ইব্রাহিম তাঁর বাবাকে বললেন- “বাবা আপনি কেন সেই সব জিনিসের ইবাদত করেন? যেগুলো কানে শুনে না, চোখে দেখে না এবং আপনার কোন উপকার করতে পারে না। বাবা আমি সত্য জ্ঞান লাভ করেছি, যা আপনি লাভ করেননি। আমার দেখানো পথে চলুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো। বাবা, কেন আপনি শয়তানের দাসত্ব করছেন? শয়তান তো দয়াময় আল্লাহর অবাধ্য।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪২-৪৪)
জবাবে ইব্রাহিমের পিতা বললেন- “ইব্রাহিম, তুই কি আমার খোদাদের থেকে দূরে সরে গেলি? শোন, এই পথ থেকে ফেরত না এলে, আমি তোকে পাথর মেরে হত্যা করবো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৬)
মূর্তি ভাংগার পালা
কোন কিছুতেই যখন জাতির লোকেরা সত্য গ্রহণে প্রস্তুত হলো না, তখন ইব্রাহিম একদিন ঘোষণা করলেন, তোমাদের অনুপস্থিতিতে একদিন তোমাদের এই মিথ্যা খোদাদের বিরুদ্ধে একটা চাল চালবো। ইব্রাহিমের কোথায় তারা তেমন একটা গুরুত্ব দিলো না। একদিন সব লোক এক ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে চলে গেলো। ইব্রাহিমকেও তারা উৎসবে যেতে বলে। কিন্তু অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তিনি গেলেন না। নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি পীড়িত। আমি যাবো না। সুতরাং তাঁকে রেখেই তারা চলে গেলো। শহর পুরুষ শূন্য হয়ে পড়লো। এই সুযোগে ইব্রাহিম ওদের ঠাকুর ঘরে এলেন। দেখলেন, সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ওদের মূর্তি দেবতাগুলো। ওদের সামনে রয়েছে দামি দামি খাবার জিনিস। ইব্রাহিম ওদের বললেন- “তোমাদের কি হয়েছে? এসব স্বাদের জিনিস খাওনা কেন? কি হলো, কথা বলছো না কেন? তারপর তিনি মূর্তিগুলোকে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেললেন। কিন্তু ঠাকুর দেবতাটিকে ভাংলেন না। ওকে ওর জায়গায়ই রেখে দিলেন।
উৎসব শেষে লোকেরা ফিরে এলো। দেবতাদের অবস্থা দেখে সবার মাথায় হাত। তারা বলাবলি করতে লাগলো- কোন যালিম আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যবহার করলো? কেউ কেউ বললো – আমরা যুবক ইব্রাহিমকে এদের ব্যাপারে সমালোচনা করতে শুনেছি।
নেতারা গোস্বায় ফেটে পড়লো। বললো, অপরাধীকে ধরে নিয়ে এসো সবার সামনে। ইব্রাহিমকে আনা হলো। তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যবহার কি তুমি করেছো?” ইব্রাহিম ভাবলেন, ওদের খোদাদের অক্ষমতা প্রমাণ করার এটাই বড় সুযোগ। তিনি বললেন, নয়তো ওদেরকেই জিজ্ঞেস করুন, কে মেরেছে ওদের? ঐ বড়টাকেই জিজ্ঞেস করুন, সে-ই ভেঙ্গেছে নাকি?
ইব্রাহিমের কথা শুনে তারা লজ্জিত হলো। মনে মনে ভাবলো, আসলে আমরাই তো অন্যায়কারী। তারপর মাথানত করে তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, দেবতাগুলো যে কথা বলতে পারে না, তাতো তুমি ভালো করেই জানো।’
ইব্রাহিম সবাইকে সম্বোধন করে বললেন – “তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব জিনিসের পূজা উপাসনা করো, যেগুলো তোমাদের ভালোও করতে পারে না, আবার মন্দও করতে পারে না? দুঃখ তোমাদের জন্যে, কেন তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এগুলোর ইবাদত করো? তোমাদের কি একটুও বিবেক বুদ্ধি নেই?” এবার তারা ইব্রাহিমকে ঘিরে ফেললো। চারদিকে হৈ হট্টগোল শুরু করে দিলো। ইব্রাহিম জোর গলায় বললেন – ‘তোমরা কি তোমাদের নিজেদের হাতে বানানো মূর্তির ইবাদত করবে? অথচ তোমাদেরকে তো সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্।’
রাজ দরবারে আনা হলো
তারা ইব্রাহিমকে নিয়ে খুব চিন্তায় পড়লো। কী করবে তাঁকে নিয়ে? সে তো দেবতাদের আর কোন মান-ইজ্জতই বাকী রাখলো না। তারা বিভিন্ন রকম শলা পরামর্শ করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিমের বিষয়টি তারা রাজ দরবারে তুললো। তাঁদের রাজা ছিলো নমরূদ। নমরূদকে তারা বুঝালো, ইব্রাহিমের ব্যাপারে বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সে আমাদের ধর্মও বিনাশ করবে, আপনার রাজত্বও বিনাশ করবে।
রাজা বললেন- ইব্রাহিমকে আমার কাছে নিয়ে এসো। অতঃপর ইব্রাহিমকে নমরূদের সামনে হাজির করা হলো। নমরূদ তাঁর সাথে কথা বললেন। ইব্রাহিম তাঁকে আল্লাহর দিকে আহবান জানান। কিন্তু নমরূদ ইব্রাহিমের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করলো। বললো- তোমার প্রভু কে?
ইব্রাহিম- আমার প্রভু তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দান করেন।
নমরূদ- আমিও মানুষকে মারতে পারি, আবার জীবিত রাখতে পারি। (নমরূদ মৃত্যুদন্ড দেওয়া দুজন কয়েদীকে এনে একজনকে হত্যা করলো, আর একজনকে ছেড়ে দিলো।)
ইব্রাহিম- ‘আমার আল্লাহ্ সূর্যকে পূর্বদিক থেকে উঠান, তুমি যদি সত্যি সত্যি প্রভু হয়ে থাকো, তবে সূর্যকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও তো দেখি।’ (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ২৫৮)
একথা শুনে রাজা হতভম্ব, হতবাক ও নিরুত্তর হয়ে গেলো। আল্লাহ্ তো যালিমদের পথ দেখান না। এভাবে ইব্রাহিমের যুক্তির কাছে রাজা প্রজা সবাই পরাস্থ হলো। ইব্রাহিম যুক্তির মাধ্যমে মূর্তিকে খোদা মানার অসারতা প্রমাণ করে দিলেন। চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রকে খোদা মানা ভুল প্রমাণ করে দিলেন। রাজা বাদশাহকে প্রভু মানার ভ্রান্তি স্পষ্ট করে দিলেন। তাঁদের ধর্ম ও সব দেবতাই যে মিথ্যা, সেকথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিলেন। সাথে তিনি তাঁদেরকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানালেন। আল্লাহর পয়গাম তিনি তাঁদের কাছে পৌঁছে দেন।
অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ
কিন্তু তারা কিছুতেই ঈমান আনলো না। বরং নৈতিকভাবে ইব্রাহিমের কাছে পরাজিত হয়ে তারা তাঁর উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। অন্ধ বর্বরতায় মেতে উঠলো তারা। সিদ্ধান্ত নিলো ইব্রাহিমকে হত্যা করার। কিন্তু কিভাবে হত্যা করবে তাঁকে? তারা ফায়সালা করলো বিরাট অগ্নীকুন্ড বানাবে। তারপর তাতে পুড়িয়ে মারবে ইব্রাহিমকে। যে কথা সে কাজ। এক বিরাট অগ্নীকুন্ড বানালো তারা। এটা ছিলো ইব্রাহিমের জন্যে এক বড় পরীক্ষা। তিনি দেখতে চাইলেন ইব্রাহিম কি জীবন বাঁচানোর জন্যে ঈমান ত্যাগ করে, নাকি ঈমান বাঁচানোর জন্যে জীবন কুরবানী করে? কিন্তু ইব্রাহিম তো অগ্নী পরীক্ষার বিজয়ী বীর। তিনি তো জীবন বাঁচানোর জন্যে কিছুতেই আল্লাহকে এবং আল্লাহর দ্বীনকে ত্যাগ করতে পারেন না। তিনি আল্লাহ্ এবং আল্লাহর দ্বীনকে জীবনের চাইতে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসেন। কাফিররা তাঁকে অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ করার জন্যে নিয়ে এলো। তিনি তাঁদের কাছে নতো হননি। জীবন ভিক্ষা চাননি। জীবন বাঁচানোর জন্যে নিজের দ্বীন এবং ঈমান ত্যাগ করেননি। তাঁর তেজোদীপ্ত ঈমান তাঁকে বলে দিলো- ইব্রাহিম, জীবন মৃত্যুর মালিক তো তোমার মহান প্রভু আল্লাহ্। তাঁর ঈমান তাঁকে বলে দেয়, আল্লাহ্ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে না চান, তবে গোটা পৃথিবী এক হয়েও তা থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
নিশ্চিত মনে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি অগ্নীকুন্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষেপ করলো নিজেদের তৈরি করা নরকে। আল্লাহ্ ইব্রাহিমের প্রতি পরম খুশি হয়ে আগুণকে বলে দিলেন- “হে আগুণ, ইব্রাহিমের প্রতি সুশীতল এবং শান্তিময় হয়ে যাও।”
আগুনের কি সাধ্য আছে সৃষ্টিকর্তার হুকুম অমান্য করার?
সুতরাং অগ্নীকুন্ডে ইব্রাহিম সম্পূর্ণ নিরাপদ থেকে গেলেন। আগুণ তাঁর কোনই ক্ষতি করলো না। বরং আল্লাহর হুকুমে সে ইব্রাহিমের সেবায় নিয়োজিত হলো। ইব্রাহিমের জাতি আবার তাঁর কাছে পরাজিত হলো। ইব্রাহিম আবার তাঁদের কাছে প্রমাণ করে দিলেন, তাঁদের দেবতারা নিজেদের রক্ষা করতেই অক্ষম। আর তিনি যে মহান প্রভুর প্রতি তাঁদের ডাকছেন, তিনি যে কোন ক্ষতি থেকে বান্দাদের রক্ষা করতে সক্ষম। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনিই একমাত্র সত্তা যার হুকুম পালন করা উচিত। যার ইবাদত উপাসনা করা উচিত।
হিজরত করেন হযরত ইব্রাহিম আ.
অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পেয়ে ইব্রাহিম আল্লাহর পথে আসার জন্যে তাঁদেরকে অনেক বুঝান। কিন্তু তারা কিছুতেই নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভুল পথ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। বরং ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে। ইব্রাহিম দেখলেন, এ মানুষগুলোর আর হিদায়াতের পথে আসার সম্ভাবনা নেই। তখন তিনি আল্লাহর হুকুমে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে রওয়ানা করলেন। সাথে ছিলেন স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লূত। জাতির লোকদের মধ্যে কেবল ভাতিজা লুতই ঈমান এনেছিলেন। প্রিয় জন্মভূমি থেকে হিজরত করেন ইব্রাহিম। এবার তিনি উন্মুক্ত বিশ্বে দাওয়াতী কাজ বিস্তার করা শুরু করেন। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে ডাকতে তিনি সিরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে চলে যান ফিলিস্তিন এলাকায়। আল্লাহর বার্তা বইয়ে নিয়ে যান তিনি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। দীর্ঘ পথের ভ্রমন, মানুষের বিরোধিতা, অত্যাচার নির্যাতন আর হাজারো রকমের কষ্ট তাঁকে ক্লান্ত করতে পারেনি। তিনি মানুষকে দাওয়াত দিয়েই চলেছেন।
এবার তিনি ফিলিস্তিন থেকে যাত্রা শুরু করেন মিশরের দিকে। কেবল মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর জন্যেই এ মহামানব ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। পাড়ি দেন মরু-প্রান্তর, সমুদ্র পাথার। এসব কিছুই করেন তিনি তাঁর মহান প্রভু দয়াময় আল্লাহকে খুশি করার জন্যে। তাইতো জন্মভূমি ত্যাগের সময় প্রশান্ত দীল ইব্রাহিম বলেছিলেন-
“আমি আমার প্রভুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ৯৯)
মিশরে এসে তিনি এখানকার মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকেন আল্লাহর দিকে। সাথে তাঁর স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লুত। মিশরে এসে দেখেন এখানকার বাদশাহ বড়ই স্বৈরাচারী-যালিম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদশাহ হযরত ইব্রাহিম আর তাঁর স্ত্রীর আল্লাহ ভক্তিতে মুগ্ধ হন এবং ইব্রাহিম ও সারাহর সেবা করার জন্যে নিজ কন্যা হাজেরাকে ইব্রাহিমের নিকট বিয়ে দেন। ইব্রাহিমকে অনেক ধন-দৌলত প্রদান করেন।
আবার ফিলিস্তিনে
মিশর থেকে ইব্রাহিম আ. আবার ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এবার ফিলিস্তিনকেই তিনি তাঁর দাওয়াতী কাজের মূল কেন্দ্র বানান। ভাতিজা লুতকে জর্ডান এলাকায় নিজের প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। আল্লাহ তায়ালা তাকেও নবুয়ত দান করেন।
ইব্রাহিমের মনে বড় দুঃখ, তিনি বৃদ্ধ বয়সে এসে উপনীত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর কোন সন্তানাদী নেই। স্ত্রী সারাহ ছিলেন একজন বন্ধ্যা মহিলা। তাঁর কোন সন্তানাদী হতো না। ইব্রাহিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, “হে প্রভু, আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো।”(সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০০)
পরম দয়াময় আল্লাহ্ তাঁর দোয়া কবুল করেন। স্ত্রী হাজেরার ঘরে তাঁর এক সুন্দর ফুটফুটে ছেলের জন্ম হয়। তিনি পুত্রের নাম রাখেন ইসমাঈল। বৃদ্ধ বয়সে শিশু পুত্রের হাসিতে তাঁর মন ভরে উঠে। কিন্তু এই পুত্রের ভালবাসা নিয়েও আল্লাহ্ তাঁকে পরীক্ষায় ফেলেন। আল্লাহ্ তাঁকে বাজিয়ে দেখতে চান, তিনি পুত্রের ভালবাসার চেয়ে আল্লাহর হুকুম পালন করাকে বড় জানেন কী-না?
এবার আল্লাহ্ ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে মক্কার জনমানব ও ফল পানি শস্যহীন মরুভূমিতে রেখে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইব্রাহিম যে, আল্লাহকে সবার চেয়ে বেশী ভালবাসেন। তিনি যে জানেন, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা যায় না। তাইতো তিনি হাজেরা আর শিশু পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হন। আল্লাহর ইঙ্গিতে তিনি তাঁদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আবার ফিলিস্তিন অভিমুখে রওয়ানা করেন। হাজেরাকে বলে যান, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাদেরকে এখানে রেখে গেলাম। হাজেরাকে কিছু খাদ্য ও এক মশক পানি দিয়ে আসেন। প্রশান্ত সমুদ্রের মতো প্রশস্ত হৃদয় আর হিমালয়ের মতো অটল ধৈর্যশীল ইব্রাহিম আল্লাহ্ প্রদত্ত পরীক্ষায় বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে।
আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ইব্রাহিম ঘুরে বেড়ান ফিলিস্তিন, জর্ডান আর হিজাযের বিভিন্ন এলাকায়। একাজ করাই তাঁর মূল দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের ফাকা ফাকে তিনি মক্কায় যান। স্ত্রী পুত্রকে দেখে আসেন। হাটি হাটি পা পা করে ছেলে বড় হয়ে ওঠে। সাথে সাথে ছেলের প্রতি ইব্রাহিমের মহব্বতও উপচে উঠে। ফলে আল্লাহ্ ইব্রাহিমকে আবার পরীক্ষা নিতে চান।
পুত্র কুরবানীর হুকুম
ইসমাঈলের এখন বুঝ বুদ্ধি হয়েছে। ইব্রাহিমের সাথে এখন পুত্র ইসমাঈল ঘরে বাইরে যাতায়াত করেন। পিতা যদি বৃদ্ধ বয়সে উদীয়মান কিশোর পুত্রকে নিজের সাহায্যকারী হিসেবে পান, তবে তাঁর প্রতি যে পিতার মহব্বত কতটা বেড়ে যায়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ঠিক এমনই এক সময়ে আল্লাহ্ পাক ইব্রাহিমকে স্বপ্নে ইসমাঈলকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করেন। বলে দেন, ‘ইব্রাহিম, তোমার প্রিয়তম পুত্রকে কুরবানী করো।’ আল্লাহর হুকুম লংঘন করা যায় না। তাঁর হুকুম পালন করা অবধারিত।
পুত্রের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন ইব্রাহিমকে আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তিনি পুত্রকে ডেকে নিয়ে জানালেন- ‘পুত্র আমার, আল্লাহ্ আমাকে স্বপ্নে হুকুম করেছেন তোমাকে কুরবানী করার জন্যে। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? ’
‘যেমন বাপ, তেমন ছেলে।’ উর্দু ভাষায় বলা হয় ‘বাপকা বেটা’। আর আরবী ভাষায় বলা হয় ‘হওয়া ইবনু আবিহী’। কথাটি যেন ইসমাঈলের জন্যেই প্রযোজ্য। আল্লাহর হুকুমের কাছে তিনি পিতার মতই নুইয়ে দিলেন মাথা। বললেন- ‘আব্বু, আল্লাহর হুকুম কার্যকর করুন। ইনশা’য়াল্লাহ আপনি আমাকে অটল ধৈর্যশীল পাবেন।’ দয়া ও করুণার সাগর মহান আল্লাহ্ তো তাঁদের পিতা পুত্র দু’জনের কথা শুনছিলেন। এসময় তাঁদের প্রতি যে তাঁর মহব্বত ও রহমতের স্রোতধারা কিভাবে বইয়ে আসছিলো তা একমাত্র তিনিই জানেন। প্রভু রহমান এ সময়টির কথা নিজ ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেন, “ওরা দু’জনেই যখন আমার হুকুমের কাছে মাথা নত করে দিলো আর ইব্রাহিম পুত্রকে (জবাই করার জন্য) উপুড় করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাঁকে ডাক দিয়ে বললাম, ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিণত করে দেখালে পুণ্যবানদের এভাবেই আমি প্রতিফল দান করি। এটা ছিলো একটা বিরাট পরীক্ষা। অতঃপর একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি তাঁর পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর পরবর্তী লোকদের মাঝে একথা স্থায়ী করে দিলাম যে, ইব্রাহিমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০৩-১০৯)
বাপ ছেলে দুজনই আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন। ইব্রাহিম পুত্রকে কুরবানী করার জন্যে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। চোখ বন্ধ করে পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। ঠিক এমনই সময় তাঁর প্রিয়তম প্রভু ডাক দিয়ে বললেন- ইব্রাহিম থামো, তুমি আমার হুকুম পালন করেছো বলে প্রমাণ দিয়েছ। ইব্রাহিম চোখ খুলে দেখলেন সামনে একটি দুম্বা দাড়িয়ে আছে। আল্লাহ্ বলে দিলেন পুত্রের পরিবর্তে এবার এই দুম্বাটিকে কুরবানী করে দাও। আর তোমার এই কুরবানী হবে বিরাট এক ঐতিহাসিক কুরবানী।
এবার ইব্রাহিম দুম্বাটিকে যবেহ করে দিলেন। প্রিয় পুত্রকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আল্লাহ্ ইব্রাহিমের ঐ বিরাট কুরবানীকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মুসলিমদের মাঝে প্রতি বছর কুরবানী করার নিয়ম চালু করে দিলেন। আজো আমরা ইব্রাহিম আ. এর সেই মহান কুরবানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ঐ তারিখে পশু কুরবানী করি। এভাবেই আল্লাহ্ ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ।
এই চরম পরীক্ষাটিতেও ইব্রাহিম যখন উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ্ একদিকে তাঁকে নিজের খলিল বা বন্ধু বানিয়ে নিলেন। আল কুরআনে তাঁর নেতৃত্বের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, “স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন ইব্রাহিমকে তাঁর প্রভু বেশ কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন আর সব ক’টিতেই সে উত্তীর্ণ হলো, তখন তিনি তাঁকে বললেন- আমি তোমাকে সব মানুষের নেতা বানাতে চাই। ইব্রাহিম জানতে চাইলো- এই প্রতিশ্রুতি কি আমার সন্তানদের ব্যাপারেও প্রযোজ্য হবে? তিনি বললেন- আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে না। (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৪)
এটাই আল্লাহর নীতি। তিনি কাউকেও বড় কোন দায়িত্ব ও নেতৃত্ব দিতে চাইলে তাঁকে ভালোভাবে বাজিয়ে নেন। সব পরীক্ষায় বিজয়ী হওয়ার পরে তিনি ইব্রাহিমকে শুধু নেতৃত্বই দেননি, সেই সাথে বৃদ্ধ বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহর ঘরেও একটি পুত্র সন্তান দান করেন। তাঁর নাম ইসহাক। শুধু তাই নয় মহান আল্লাহ্ তাঁর দুই ছেলেকেই নবী মনোনীত করেন।
আল্লাহর কুদরত দর্শন
ইব্রাহিম আ. এর প্রতি আল্লাহর এতো বড় অনুগ্রহের কারন হলো, আল্লাহর প্রতি তাঁর পরম আস্থা ও প্রত্যয়। মহান আল্লাহ্ তাঁকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সে কারনেই তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয় আল্লাহর প্রতি মজবুত ও অটল প্রত্যয়। আল্লাহর প্রতি নিজের পরম আস্থাকে আরো মজবুত করে নেবার জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে একটা আবদার করেন। সে আবদারটি কুরআনের বর্ণনায় এ রকম, “সে ঘটনাটি স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম বলেছিল, আমার প্রভু, তুমি কেমন করে মৃত্যুকে জীবিত করো আমাকে একটু চোখের সামনে দেখিয়ে দাও। তিনি বললেন- তুমি কি তা বিশ্বাস করো না? ইব্রাহিম বললো- অবশ্যই বিশ্বাস করি, তবে আমার মনের সান্ত্বনার জন্যে নিজের চোখে দেখতে চাই। তিনি বললেন- তবে তুমি চারটি পাখি ধরো। সেগুলোকে নিজের কাছে ভালোভাবে পোষ মানিয়ে নাও। তারপর সেগুলিকে (যবাই করে) সেগুলোর একেকটি অংশ একেক পাহাড়ে রেখে এসো। অতঃপর তুমি ওদের ডাকো। দেখবে ওরা তোমার কাছে দৌড়ে আসবে। জেনে রাখো, আল্লাহ্ বড় ক্ষমতাশীল মহাবিজ্ঞানী।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ২৬০)
ইব্রাহিম আ. পাখিগুলোকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন পাহাড়ে রেখে এসে ওদেরকে ডাক দেন। সাথে সাথে ওরা জীবিত হয়ে ইব্রাহিমের কাছে উড়ে আসে। আল্লাহ্ তাঁকে চাক্ষুস দেখিয়ে দিলেন, তিনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করতে পারেন। এভাবেই আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন সব মানুষকে জীবিত করবেন এবং সবাই হাশরের ময়দানে দৌড়ে এসে একত্রিত হবে। বিষয়টি ইব্রাহিম স্বচক্ষে দেখে পরম প্রত্যয় ও প্রশান্তি লাভ করেন।
কা’বা ঘর নির্মাণ
এবার আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় ইব্রাহিমকে আরেকটি বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তাঁকে কা’বা ঘর নির্মাণের নির্দেশ প্রদান করেন। কোন জায়গাটিতে কা’বা ঘর নির্মাণ করতে হবে, তাও তিনি বলে দেন। সেই জায়গাটি তো এখন আমাদের সকলেরই জানা। কা’বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম আ. পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে। এটিতো সেই জায়গা যেখানে তিনি রেখে এসেছিলেন শিশু পুত্র ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে। এটি তো সেই স্থান, যার পাশে মিনাতেই কুরবানী করতে গিয়েছিলেন প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে। আল্লাহর নির্দেশে পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে নিপুন কারিগরের মতো কা’বার ভিত উঠালেন। তারপর নির্মাণ সম্পন্ন করলেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘরের। এ সময় দু’জনেই দয়াময় রহমানের দরবারে দোয়া করলেন, “আমাদের প্রভু, তুমি আমাদের এই কাজ কবুল করো। তুমিতো সবই শোন এবং সবই জানো। প্রভু, আমাদেরকে তোমার অনুগত রাখো। আমাদের বংশ থেকে তোমার অনুগত একটি উম্মত সৃষ্টি করে দাও। তোমার হুকুম পালন করার নিয়ম আমাদের জানিয়ে দাও। আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তুমি তো মহাক্ষমাশীল দয়াবান। আমাদের প্রভু, এদের মধ্য থেকেই এদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিয়ো।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৮-১২৯)
মহান আল্লাহ্ ইব্রাহিমের তৈরি ঘরকে নিজের ঘর বলে ঘোষণা দিলেন। এ ঘরকে তিনি চিরদিন বাঁচিয়ে রাখলেন। তিনি ইব্রাহিমকে বলে দিলেন, “এই ঘরে হজ্জ পালন করার জন্যে মানুষকে সাধারণভাবে অনুমতি দিয়ে দাও। মানুষ বহু দূর দুরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে উটে চড়ে তোমার কাছে আসবে। —এই প্রাচীনতম ঘরের তাওয়াফ করবে।” (সূরা আল হাজ্জ আয়াত ২৭-২৯)
এভাবে মহান আল্লাহ্ ইব্রাহিম আ. এর কীর্তিসমূহকে চির স্মরণীয় করে রাখলেন। তাঁর নির্মাণ করা ঘরকে কেন্দ্র করে হজ্জ, তাওয়াফ ও কুরবানীর নিয়ম চিরস্থায়ী করে দিলেন। এই মহান ঘর ও ঘরের কাছে রেখে যাওয়া নিজ পরিবারের জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, “প্রভু, এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানাও। আমার প্রভু, আমার সন্তানদের একটি অংশকে তোমার এই মহাসম্মানিত ঘরের কাছে এনে পুনর্বাসিত করেছি। এটাতো পানি ও তরুলতাশুন্য এক মরু প্রান্তর। প্রভু, ওদের এখানে রেখেছি যেন, এরা সালাত কায়েম করে। সুতরাং তুমি ওদের প্রতি মানুষের মনকে অনুরক্ত বানিয়ে দাও। শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দুটি সন্তান ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। প্রভু, আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে সালাত কায়েমকারী বানাও।” (সূরা ১৪ ইব্রাহিমঃ আয়াত ৩৫-৪০)
কুরআনে হযরত ইব্রাহিম আ. এর প্রশংসনীয় গুণাবলী
মহান আল্লাহ্ তাঁর কিতাব আল কুরআনে ইব্রাহিম আ. এর গুণবৈশিষ্টের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এখানে আমরা কয়েকটি উল্লেখ করলাম-
১. “পৃথিবীর কাজের জন্যে আমি ইব্রাহিমকে বাছাই করেছিলাম।”
২. “তাঁর প্রভু যখন বললেন- ‘আত্মসমর্পণ করো’। সে বললো- ‘সারা জাহানের প্রভুর নিকট আমি আত্মসমর্পণ করলাম।’’
৩. “সে বললো- পুত্র আমার, মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পিত থাকো।”
৪. “তোমরা খাঁটিভাবে ইবরাহীমের পথ অনুসরণ করো।”
৫. “আল্লাহ্ ইব্রাহিমকে তাঁর বন্ধু বানিয়েছেন।”
৬. “আমি ইব্রাহিমকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়েছি।”
৭. “সে বললো- আমি আসমান ও যমীনের স্রষ্টার দিকে মুখ ফিরালাম।”
৮. “ইব্রাহিম ছিলো বড়ই ধৈর্যশীল কোমল হৃদয় ও আমার প্রতি অনুরক্ত।”
৯. “ইব্রাহিম নিজেই ছিলো একটি উম্মাহ। সে একমুখী হয়ে আল্লাহর অনুগত ছিল।”
১০. “আল্লাহর অনুগ্রহরাজির প্রতি সে ছিলো শোকরগুজার। তিনি তাঁকে পছন্দ করেছেন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।”
১১. “ইব্রাহিম ছিলো এক অতি সত্যবাদী মানুষ এবং নবী। ”
১২. “ইব্রাহিমকে আমি সতর্কবুদ্ধি ও জ্ঞান দান করেছি।”
১৩.“আমি বললাম- হে আগুণ, তুমি ইব্রাহিমের প্রতি সুশীতল, শান্তিময় ও নিরাপদ হয়ে যাও।”
১৪. “আমি ডেকে বললাম- হে ইব্রাহিম, তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিণত করেছো।”
১৫. “তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে ইব্রাহিমের মধ্যে।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মজিদে ইব্রাহিমের নাম উচ্চারিত হয়েছে ৬৯ বার। যেসব সুরাতে ইব্রাহিম আ. সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে- সূরা আল বাকারা, আন নিসা, আন-আম, তাওবা, হুদ, ইব্রাহিম, হিজর, আন নাহল, মরিয়ম, আম্বিয়া, আল হাজ্জ, শোয়ারা, আন কাবুত, সাফফাত, যুখরুফ, যারিয়াত, মুমতাহিনা।
।
হযরত লুত আ.
পরিচয়
হযরত লুত আ. আল্লাহর এক সম্মানিত নবী। তিনি সেই সব নবীদের একজন, যাদের জাতি ঈমান আনেনি। হযরত লুতের জাতি যে কেবল ঈমান আনেনি, তা নয়, বরং তাঁর জাতির লোকেরা ছিলো সেকালের সবচেয়ে পাপিষ্ঠ লোক। হযরত লুত আ. সেইসব নবীদেরও একজন, যাদের জাতিকে আল্লাহ্ ইসলামের বিরোধিতা করার কারণে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। হযরত নূহ, হযরত সালেহ ও হযরত হুদ আ. এর জাতির মতোই লুত আ. এর জাতিকেও আল্লাহ্ পাক ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
হযরত লুত আ. ছিলেন মহান নবী হযরত ইব্রাহিম আ. এর ভাতিজা। হযরত ইব্রাহিম আ. যখন নিজ দেশ ইরাকে ইসলাম প্রচার করছিলেন, তখন সেখানে মাত্র দু’জন লোক ঈমান এনেছিলেন। এদের একজন ছিলেন হযরত ইব্রাহিম আ. এর স্ত্রী সারাহ আর অন্নজন ছিলেন তাঁর ভাতিজা হযরত লুত আ.। তিনি যখন ইরাক থেকে হিজরত করতে বাধ্য হন, তখন কেবল এ দু’জনই তাঁর হিজরতের সাথী হন।
হিজরত ও নবুয়ত লাভ
রাজা নমরূদের অত্যাচারে যখন নিজ দেশে ইসলাম প্রচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন লুত চাচা ইব্রাহিম আ. এর সাথে দেশ ত্যাগ করেন। চাচার সাথে দ্বীন প্রচারের কাজে তিনি ফিলিস্তিন, সিরিয়া হয়ে আফ্রিকার মিশরে পাড়ি জমান। মহান নবী হযরত ইব্রাহিমের ইসলাম প্রচারের সাথী হিসেবে লুত অগাধ জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ফলে আল্লাহ্ তায়ালা তাকেও নবুয়্যত দান করেন এবং জর্ডান এলাকায় একটি পাপিষ্ঠ জাতির কাছে ইসলাম প্রচারের গুরু দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।
কোন সে জাতি?
কোন সে জাতি? যার কাছে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয় হযরত লুত আ. এর উপর? কুরআনে এদেরকে ‘কওমে লুত বা লুতের জাতি’ বলা হয়েছে। এ জাতি যে অঞ্চলে বাস করতো, বর্তমানে সে অঞ্চলের নাম ট্রান্স জর্ডান। এ জায়গাটি ইরাক ও ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি অবস্থিত। সেকালে এ জাতির প্রধান শহরের নাম ছিলো সাদুম। এছাড়াও তাঁদের আরো অনেকগুলো শহর ছিলো। চরম পাপাচারের কারণে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁদেরকে ধ্বংস করে দেন। তাঁদের শহরগুলোকে তলিয়ে দেন। বর্তমানে যাকে লুত সাগর বা Dead Sea (মৃত সাগর) বলা হয়, তাঁদের শহরগুলো তলিয়ে এতেই মিশে গিয়েছিলো। লুত সাগরের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে আজো তাঁদের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। হযরত ইব্রাহিম আ. এর প্রতিনিধি হিসেবে এ এলাকাতেই হযরত লুত আ. ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
লুত জাতির পাপাচার
লুত আ. এর জাতির মতো পাপিষ্ঠ জাতি খুব কমই ছিলো। তাঁদের চরিত্র এতো খারাপ ছিলো, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তারা ছিলো সমকামী। তারা প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ এবং জনসমাবেশে কুকর্মে লিপ্ত হতো। ডাকাতি-রাহাজানি ছিলো, তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।
তাঁদের এলাকায় কোন ভালো মানুষ এসে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতো না। কোনো ব্যবসায়ী বণিক তাঁদের এলাকায় গেলে সব কিছু খুইয়ে আসতে হতো। তাঁদের মধ্যে সামান্যতম লজ্জা শরম পর্যন্ত ছিলো না। তাঁদের মাঝে একজন সৎ লোকও ছিলো না, যে পাপ কাজে বাধা দেবে। এমন একটি প্রাণিও ছিলো না, যে পাপকে ঘৃণা করতো। এমন একজন লোকও ছিলো না, যে কোন অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতো।
হযরত লুত আ. এর আহবান
এই পাপিষ্ঠ লোকদের সত্য পথ দেখানোর জন্যেই মহান আল্লাহ্ হযরত লুত আ. কে পাঠালেন। তিনি এসে তাঁদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকলেন। মহান আল্লাহকে ভয় করতে বললেন, কুরআনের ভাষায়, “লুতের জাতি রাসুলদেরকে অস্বীকার করেছিলো। লুত তাঁদের বলেছিল, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও।”
আল্লাহর পরম ধৈর্যশীল নবী তাঁদের আরো বললেন, “তোমরা এমন পাপাচার করছো, যা তোমাদের আগে কোন জাতি করেনি। তোমরা একটি সীমালংঘনকারী জাতি।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৮০)
তিনি তাঁদের বলেছিলেন, “কেন তোমরা নরদের সাথে নোংরা কাজ করো? কেন ডাকাতি-রাহাজানি করো? আর জনসমাবেশে কুকাজে লিপ্ত হও।”
এভাবে লুত আ. দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের অনেক উপদেশ দিলেন, আল্লাহর পথে আসতে বললেন। পাপাচার থেকে বিরত হতে বললেন। কুকর্মের প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু তাঁদের একটি লোকও উপদেশ গ্রহণ করলো না।
হযরত লুত আ. এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
ওরা হযরত লুতের উপদেশ তো গ্রহণ করলোই না, সৎ পথে তো এলোই না, বরং হযরত লুতের সংশোধন কাজের বিরুদ্ধে গড়ে তুললো বিরাট প্রতিরোধ। কেউ তাঁদের ভালো হবার কথা বলুক এটা তারা সহ্য করতে পারতো না। পাপ কাজ ত্যাগ করার কথা তারা শুনতে পারতো না। ফলে হযরত লুত আ. এর বিরামহীন সংশোধন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তারা ক্ষেপে উঠলো। হযরত লুত যে তাঁদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখিয়েছেন এর জবাবে তারা প্রথমে হযরত লুতকে বললো- আমরা তো তোমাকে আর তোমার খোদাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কই তোমার খোদার আযাব? তুমি যদি সত্যি খোদার নবী হতে তবে তো আল্লাহর আযাব এনে দেখাতে পারতে। তারা আল্লাহর নবী হযরত লুতকে শাসিয়ে বললো, “লুত, যদি তুমি তোমার সংশোধন কাজ থেকে বিরত না হও, তবে তোমাকে অবশ্যই আমাদের দেশ থেকে বের করে দেব।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ৬৭)
কিন্তু আল্লাহর কোন নবী তো আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে বিরত থাকতে পারেন না। মানুষকে সৎ পথে ডাকার ও সংশোধন করার কাজ থেকে বিরত হতে পারেন না। হযরত লুত তাঁর মিশন চালিয়ে যেতে থাকলেন। অবশেষে তারা আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে চরম সিদ্ধান্ত নিলো। নেতারা জনগণকে বললো, “এই লুত আর তাঁর পরিবার পরিজনকে দেশ থেকে বের করে দাও। ওরা বড় পবিত্র লোক।”
এলো ধ্বংসের ফেরেশতারা
আল্লাহর নবী হযরত লুত আ. এর পুত পবিত্রতা নিয়ে ওরা যখন তিরস্কার করতে থাকলো, আর তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করতে থাকলো, তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ ঐ জাতিটিকে পৃথিবীর বুক থেকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে ফেরেশতা পাঠিয়ে দিলেন। ফেরেশতারা প্রথমে হযরত ইব্রাহিমের কাছে এলো। তাঁর স্ত্রী সারাহর ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান হবার সুসংবাদ দিলো। বিদায় নেয়ার সময় ইব্রাহিম তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, “হে দুতেরা, আপনারা কি কোন অভিযানে এসেছেন?
-হ্যাঁ, আমরা ঐ অঞ্চলকে (সাদুম) ধ্বংস করে দিতে এসেছি। আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁদেরকে পাথর মেরে ধ্বংস করে দিতে। আপনার মহান প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে পাথরে চিহ্ন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
ইব্রাহিম বললেন- সেখানে তো লুত আছে, তাঁর কি উপায় হবে?
ফেরেশতারা বললেন- আমরা জানি সেখানে কারা আছে? লুত আর তাঁর পরিজনকে নিরাপদ রাখা হবে। অতঃপর ফেরেশতারা সে এলাকায় চলে এলেন সুশ্রী মানুষের বেশ ধরে। এসে হযরত লুতের ঘরে উঠলেন। লুত তাঁদের চিনতে পারেননি। বললেন- আপনাদের তো চিনতে পারছি না।
তারা বললো- আমরা আপনার কাছে এসেছি। এই লোকেরা যেই বিষয়ে সন্দেহ করছে আমরা সে বিষয়ে ফায়সালা করতে এসেছি। এতোক্ষণে হযরত লুতের বাড়িতে নতুন মেহমানদের আসার খবর পেয়ে গেছে শহরের সব মন্দ লোকেরা। বদমাশ লোকগুলো দৌড়ে এলো মেহমানদের সাথে খারাপ কাজ করার মতলবে। লুত তাঁদের বাধা দিলেন। আফসোস করে বললেন- তোমাদের মাঝে কি একজন ভালো মানুষও নেই?
ফেরেশতারা হযরত লুতকে কানে কানে বলে দিলেন, আমরা আল্লাহর দূত ফেরেশতা। এরা আমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। রাতের একটি অংশ পার হয়ে গেলে আপনি আপনার পরিবার- পরিজনকে নিয়ে এই এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবেন। ওদের ধ্বংসের নির্ধারিত সময়টি হলো ভোর। ভোর তো ঘনিয়ে এলো। ভোর হবার আগেই আল্লাহর নির্দেশে হযরত লুত এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন। এদিকে ফেরেশতারা গোটা এলাকার জমিনকে সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দিলেন। অবিরাম পাথর নিক্ষেপ করে সব কিছু ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের একটি লোককেও বাঁচিয়ে রাখা হলো না। বিরাণ করে দেয়া হলো সবকিছু। সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে গেলো পাপিষ্ঠ জাতি। মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমি তাঁদের প্রচন্ড বর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিলাম। সতর্ক করার পরও যারা সংশোধন হয় না, তাঁদের উপর এমন নিকৃষ্ট বর্ষণই করা হয়ে থাকে।”
নবীর দুর্ভাগা স্ত্রী
যারা ধ্বংস হয়েছে, তাঁদের সাথে হযরত লুত আ. এর স্ত্রীও ছিলেন। ইনি নবীর স্ত্রী হয়েও কুফরির পক্ষ ত্যাগ করেননি। নবীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেননি। ফলে আল্লাহ্ তায়ালা কাফিরদের সাথে তাকেও ধ্বংস করে দেন। হযরত লুত যখন রাতে ঐ এলাকা ত্যাগ করেন, তখন তাঁর এই স্ত্রী তাঁর সাথে যাননি। কাফিরদের সাথে থেকে যান এবং আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যান। আল্লাহ্ বলেন, “আমি লুত আর তাঁর পরিবার-পরিজনকে সেই ধ্বংস থেকে বাঁচালাম। তবে তাঁর বৃদ্ধা (স্ত্রী) কাফিরদের সাথে রয়ে গেলো। আর আমি তাঁদের সম্পূর্ণ ধংস করে দিলাম। ”
আল কুরআনের অন্য এক স্থানে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্ কাফিরদের উপমা বানিয়েছেন নূহ আর লুতের স্ত্রীকে। তারা দু’জন আমার দুই নেক বান্দার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। কিন্তু তারা তাঁদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। স্বামী নবী হয়েও আল্লাহর আযাব থেকে তাঁদের বাচাবার ব্যাপারে উপকারে আসলো না। তাঁদের নির্দেশ দেয়া হলো- দোযখীদের সাথে প্রবেশ করো দোযখে।” (সূরা ৬৬ আত তাহরিম। আয়াত ১০)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ তায়ালা আল কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন- “আমি ইসমাঈল, ইউশা, ইউনুস এবং লুতকে গোটা জগতবাসীর উপর মর্যাদা দান করেছি।’ সত্যিই মহান আল্লাহ্ তাঁর এই নবীকে বিরাট মর্যাদা দিয়েছেন। কুরআন মজিদে লুত নামটি ২৭ বার উচ্চারিত হয়েছে। যেসব সুরায় উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো বলে দিচ্ছি- আনআম-৮৬, আ’রাফ-৮০, হুদ-৭০,৭৪,৭৭,৮১, হিজর- ৫৯,৬১, আম্বিয়া- ৭১,৭৪, হাজ্জ-৪৩, শোয়ারা- ১৬০,১৬১,১৬৭, আন নামল-৫৪,৫৬, আনকাবুত- ২৬,২৭,৩২,৩, সাফফাত- ১৩৩, সয়াদ-১৩, কাফ-১৩, আল কামার- ৩৩,৩৪, আত তাহরিম-১০।
।
হযরত ইসমাঈল আ.
“এ কিতাবে ইসমাঈলকেও স্মরণ করো। সে ছিলো প্রতিশ্রুতি পালনকারী। ছিল একজন রাসূল ও নবী। সে তাঁর লোকজনকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিতো। আর সে ছিলো তাঁর প্রভুর অবারিত সন্তোষ প্রাপ্ত।” – (আল কুরআন ১৯- ৫৪,৫৫)
আল্লাহর অবারিত সন্তোষ প্রাপ্ত এই মানুষটি হলেন মুসলিম জাতির পিতা আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম আ. এর পুত্র। তাঁর মায়ের নাম হাজেরা। ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। পরে মক্কায় মায়ের কোলে লালিত- পালিত হন। একটু বড় হলে আল্লাহ্ তাঁর পিতাকে নির্দেশ দেন তাঁকে কুরবানী করবার জন্যে। পিতার মতই তিনি আল্লাহর হুকুমের কাছে মাথা নত করে দেন। এরপর তিনি পিতা ইব্রাহিম আ. এর সাথে কা’বা ঘর নির্মাণ করেন। আল্লাহ্ তাঁকে নবুয়ত দান করেন।
মায়ের সাথে মক্কায় এলেন
ইব্রাহিম আ. এর ছিলেন দু’জন স্ত্রী। বড়জন সারাহ আর ছোটজন হাজেরা। সারাহ বুড়ি হয়ে গেছেন, এখনো তাঁর কোন ছেলেমেয়ে হয়নি। কিন্তু আল্লাহ্ হাজেরাকে চাঁদের মতো ফুটফুটে একটি ছেলে দান করেন। হযরত ইব্রাহিম আ. ছেলের নাম রাখেন ইসমাঈল।
কিন্তু আল্লাহ্ ইব্রাহিমকে নিজের বন্ধু বানাবার জন্যে কতো যে পরীক্ষা করেছেন, তাঁর ইয়ত্তা নেই। শিশুপুত্রের ব্যাপারে তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। বললেন- শিশু ইসমাঈল ও তাঁর মাকে মক্কার মরু প্রান্তরে রেখে এসো। ইব্রাহিমের কাছে আল্লাহর হুকুম শিরোধার্য। তিনি তাঁদের নিয়ে ফিলিস্তিন থেকে রওয়ানা করলেন মক্কার দিকে। সহীহ বুখারীতে এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে বড় একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে,
ইব্রাহিম হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন। পথে হজেরা শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে একদিন তিনি তাদের নিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হলেন। এখন যেখানে কা’বা ঘর ও যমযমের কূপ এখানেই একটি গাছের নিচে তাঁদের রাখেন। তখন মক্কায় কোন মানুষ ছিলো না। পানিও ছিলো না। ইব্রাহিম তাঁদের এক থলে খেজুর আর এক মশক পানি দিয়ে ফিরে চললেন ফিলিস্তিনের দিকে। হাজেরা তাঁর পিছে পিছে দৌড়ে এলেন। বললেন- আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদের এখানে রেখে যাচ্ছেন? ইব্রাহিম জবাব দিলেন- হ্যাঁ। একথা শুনে হাজেরা বললেন- ‘ঠিক আছে, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ একথা বলে তিনি ফিরে এলেন যথাস্থানে। এদিকে ইব্রাহিম যে প্রিয়তম পুত্র স্ত্রীকে রেখে ফিরে চলেছেন, তাঁর বুক তো ফেটে যাচ্ছিলো। তাঁর হৃদয়ের কান্না তখন আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ দেখেননি। কিন্তু এ যে আল্লাহর হুকুম। আর তাঁর হুকুম পালন করাতো অপরিহার্য। আল্লাহর হুকুমে ইব্রাহিম এতো বড় বিরহের কাজও করতে পারেন। বুকের মধ্যে মনকে চেপে ধরে নীরবে তিনি ফিরে চলেছেন। পিছনে ফিরে তাকাননি। তাকালে ওদের চেহারা তাঁকে আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা দিতে পারে। তাঁর হৃদয় যেন সমুদ্রের মতো উদার আর হিমালয়ের মতো অবিচল। সামনে অগ্রসর হয়ে চলেছেন তিনি। কিছুদূর এসে একটি টিলার উপরে উঠে ফিরে দাঁড়ালেন। এখান থেকে আর ওদের দেখা যায় না। এখানে দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম দয়াময় প্রভু মহান আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে দোয়া করলেন, “আমার প্রভু, এই দানা-পানিহীন মরুভূমিতে তোমারই সম্মানিত ঘরের পাশে আমার সন্তানের বসতি স্থাপন করে গেলাম। প্রভু, ওদের এখানে রেখে গেলাম যাতে ওরা সালাত কায়েম করে। তাই তুমি মানুষের মনকে ওদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিও আর ফলফলারি দ্বারা ওদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দিও, যেন ওরা তোমার শুকরগুজার হয়ে থাকে।” (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৭)
অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছার উপর মনকে অটল রেখে ধীরে ধীরে ইব্রাহিম চলে এলেন ফিলিস্তিনের দিকে। এ দিকে হাজেরা থলের খেজুর আর মশকের পানি খেয়ে দিন কাটাতে থাকেন। শিশু ইসমাঈল মায়ের বুকের দুধ পান করেন। কিন্তু অচিরেই মশকের পানি শেষ হয়ে গেলো। পিপাসায় তাঁর ছাতি ফেটে যায়। বুকে দুধ আসে না। বাচ্চাও ক্ষুদায় পিপাসায় ধড়পড় করছে। মৃত্যু যেন হাতছানি দিয়ে তাঁদের ডাকছে। চোখের সামনে অনাহারে শিশুপুত্রের করুন মৃত্যু কোন মা কি সহ্য করতে পারে? পুত্রকে বাঁচানোর জন্যে তিনি পানির খোজে দৌড়ালেন। সামনেই একটি পাহাড়। এই পাহাড়ের নাম সাফা পাহাড়। তিনি দৌড়ে সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে গেলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন কোন মানুষ দেখতে পান কি-না? উদ্দেশ্য হলো মানুষ দেখতে পেলে কিছু পানি চেয়ে নেবেন। কিন্তু না কোথাও কোন মানুষ দেখা যায় না।
এবার দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে পড়লেন। সামনে মাঠের ওপাশেই আর একটি পাহাড়। এর নাম মারওয়া পাহাড়। হাজেরা দৌড়ে এসে মারওয়া পাহাড়ের উপরে উঠলেন। দুই পাহাড়ের মাঝে সাত চক্কর দৌড়াদৌড়ী করলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোন মানুষের সন্ধান পেলেন না। ছেলে মৃত প্রায় আর নিজের জীবন ওষ্ঠাগত। হাজেরা চোখের সামনে বাচার আর কোন উপায় দেখেন না। এখন তিনি সম্পূর্ণ অসহায়।
আল্লাহর উপহার যমযমের কূপ
কিন্তু আল্লাহ্ যে অসহায়ের সহায়। হাজেরা যখন মারওয়া পাহাড়ের ওপর তখন নীচে একটি শব্দ শুনে সেখান থেকে ইসমাঈল আ. এর নিকট ফিরে এলেন। তিনি দেখতে পেলেন, শায়িত শিশু ইসমাঈলের পদাঘাতে সেই স্থানে একটি পানির ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এটাই পরবর্তীকালে যমযম কূপ নামে খ্যাত হয়। এর চতুর্দিকে প্রস্তর দ্বারা বাঁধ নির্মাণ করে বিবি হাজেরা আ. সর্বপ্রথম পানি ধরে রাখেন। পৌত্তলিক যুগে জুরহুমীগণ শত্রুতাবশত কুপটি বন্ধ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে মহানবী সা. এর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব কূপটি পুনরায় আবিষ্কার করে খনন করে এর চতুর্দিকে পাকা প্রাচীর নির্মাণ করে দেন। সে থেকে আজ অবধি মহান স্রষ্টা আল্লাহর অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে সেখান থেকে অনবরত প্রয়োজনীয় পানি বের হয়ে আসছে।
হাজেরা দৌড়ে এসে কূপের চারপাশে বাধ দিলেন। অঞ্জলি ভরে পানি পান করলেন। মশকে পানি ভরে নিলেন। বুকে দুধ এলো। ইসমাঈলকে প্রাণ ভরে দুধ পান করালেন।
ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন
আল্লাহর অসীম সাহায্য পেয়ে হাজেরা আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। দিন যায় রাত আসে। ইসমাঈল ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠেন। এদিকে পানির সন্ধান পেয়ে মক্কার আকাশে পাখি এলো। পানির সন্ধান পেয়ে ইয়েমেন দেশের জুরহুম গোত্রের একদল লোক মক্কায় বসবাস করার জন্যে হাজেরার অনুমতি চাইলো। তিনি তাঁদের অনুমতি দিলেন। ফলে মক্কায় জনবসতি গড়ে উঠলো। পানির ছোঁয়াচ পেয়ে মরুভূমিতে ফল ফলারি উৎপন্ন হতে থাকলো। আল্লাহ্ ইসমাঈল ও তাঁর মায়ের সব অসুবিধা দূর করে দিলেন। এখানে যে জনবসতি গড়ে উঠেছে তাঁর কৃতিত্ব কিন্তু ইসমাঈলের মায়ের হাতেই থাকলো। ইব্রাহিম আ. প্রায়ই প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজেরাকে দেখার জন্যে মক্কায় আসেন। ইসমাঈলের হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি দেখে ইব্রাহিমের মন ভরে যায়। ফুটফুটে টুকটুকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আনন্দে আল্লাহর শোকর আদায় করেন। যখন আসে পাশের মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার জন্যে বের হন, ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে যান। এভাবে কিছু দিন মক্কায় থেকে আবার চলে যান ফিলিস্তিনে। আবার ফিরে আসেন মক্কায়। ইসমাঈল দিন দিন বেড়ে ওঠেন। পিতা তাঁকে মনের মতো সুন্দর করে গড়ে তোলেন। যেমন বাপ, তেমনি আল্লাহর অনুগত হয়ে গড়ে উঠে ইসমাঈল। ফলে পিতার মহব্বত বেড়ে যায় পুত্রের প্রতি। আল্লাহর প্রতি তাঁদের পিতা পুত্রের ভালোবাসাকে আল্লাহ্ পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন।
যবাই হবার হুকুম পেলেন
ইব্রাহিম একদিন স্বপ্ন দেখেন তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন। নবীদের স্বপ্নও একপ্রকার অহী বা আল্লাহর আদেশ। আল্লাহর হুকুম শিরোধার্য। কিন্তু ইসমাঈল কি এ হুকুম মেনে নেবে? আসলে আল্লাহ্ তো সে পরীক্ষাই নিতে চান। আল্লাহতো দেখতে চান ইসমাঈল আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা পেতে দেয় কিনা? নিজের জীবনের চাইতেও আল্লাহর হুকুম পালন করাকে বড় কর্তব্য মনে করে কিনা? আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সে নিজের জীবনকে কুরবানী করতে প্রস্তুত আছে কিনা?
কিন্তু ইসমাঈলতো তাঁর পিতার মতই আল্লাহর অনুগত। আল্লাহর সন্তুষ্টির চাইতে বড় কোন কাম্য তাঁর নেই। পিতা ইব্রাহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরবানী করার হুকুম জানিয়ে দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহর অতি সম্মানিত দাস ইসমাঈল বলে উঠেন, “আব্বা, আপনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করুন। ইনশা’য়াল্লাহ আপনি আমাকে অটল অবিচল ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী পাবেন।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০২)
ইতিহাস ও তাফসীর ভিত্তিক রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, শয়তান কুরবানীর মহান একাজে বিভিন্নভাবে বাঁধার সৃষ্টি করে । সে প্রথমে মা হাজেরা ও ইসমাঈল আ. কে উল্টো বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁরা শয়তানের প্ররোচনায় কোন পাত্তা দিলেন না। মরদুদ শয়তান হযরত হাজেরা আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. কে ধোঁকা দেয়া থেকে নিরাশ হয়ে মিনা যাওয়ার পথে ‘জামরায়ে আকাবাহ’, ‘জামারায়ে উসত্বা’ এবং ‘জামরায়ে উলা’ এই তিন জায়গায় তিনবার হযরত ইবরাহীম আ. কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে এবং হযরত ইবরাহীম আ. প্রত্যেকবারই তাকে সাতটি করে কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতি স্বরূপ মিনায় ঐ তিনটি স্থানে কংকর নিক্ষেপ করার বিধান হাজীদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন এই মহান কুরবানীর ইবাদত পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানগাহে পৌঁছলেন এবং ইবরাহীম আ. কুরবানী করার জন্য ইসমাঈল আ. কে শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাঈল আ. পিতা ইবরাহীম আ. কে বললেন আব্বাজান! আমার হাত পা খুব শক্ত করে বেঁধে নিন যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা না পড়ে। অন্যথায় এতে আমার ছওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হবেন। আপনার ছুরিটি ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। কারণ, মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার। আপনি আমার আম্মাজানের নিকট আমার শেষ বিদায়ের সালাম টুকু অনুগ্রহ পূর্বক পৌঁছে দিবেন। যদি আমার জামা তার নিকট নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন।
একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কি যে হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইবরাহীম আ. দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, ওগো আমার প্রাণ প্রিয় বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ। অতঃপর তিনি পুত্রকে আদর করে চুম্বন করলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে তাকে বেঁধে নিলেন।
অতঃপর তাঁকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে, বার বার ছুরি চালানো সত্বেও গলা কাটছে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা স্বীয় কুদরতে পিতলের একটা টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন।
তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজী! আমাকে উপুড় করে শুইয়ে নিন। কারণ, আমার মুখমন্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃস্নেহ উথলে উঠে। ফলে গলা কাটা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ছুরি দেখে আমি ঘাবড়ে যাই। সে মতে হযরত ইবরাহীম আ. তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন এবং পুনরায় সজোরে প্রাণপণে ছুরি চালালেন।
কিন্তু তখন ও গলা কাটতেছেনা। হযরত ইবরাহীম আ. চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। হযরত ইবরাহীম আ. এর এ প্রাণন্তর প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন এবং হযরত ইসমাঈলের বিনা যবেহেই তার কুরবানী কবুল করে নিলেন। এ ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম আ. এর উপর ওহী নাযিল হলো। তাফসীরে রুহুল মাআ’নী। সূত্র হযরত কাতাদাহ রা. হতে বর্নিত, তাফসিরে ইবনে কাসীর মসনদে আহমদ থেকে নকল করা হয়েছে। সূত্র হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত।هُ “অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের কে সোপর্দ করলো এরং ইবরাহীম আ. পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে), তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি সপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট কঠিন পরীক্ষা। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিলেন এখন পুত্রকে ছেড়ে দিন এবং আপনার নিকট যে দুম্বাটি দাঁড়ানো রয়েছে, পুত্রের পরিবর্তে সেটাকে যবেহ করুন। তখন ইবরাহীম আ. পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, একটি হৃষ্ট পুষ্ট দুম্বা দাঁড়ানো আছে। আল্লাহর শোকর আদায় করে তিনি সেই দুম্বাটিকে যবেহ করলেন।
বাপ বেটা দুইজনই আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করলেন। আর আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করার চাইতে বড় বিজয় কি হতে পারে? মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমরা একটি মহান কুরবানীর বিনিময়ে ইসমাঈলকে ছাড়িয়ে নিলাম।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০৭)
এটা একটা বিরাট কুরবানী, বিরাট আত্মত্যাগ। সে জন্যই আল্লাহ্ তায়ালা এই বিরাট কুরবনীকে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখার জন্যে সেই তারিখে যেনো মুমিনেরা আল্লাহর হুকুমে নিজেদের আত্মত্যাগের প্রমান স্বরূপ পশু কুরবানী করে, এ নিয়ম চালু রেখেছেন। বিগত প্রায় চার হাজার বছর থেকে মানুষ ইসমাঈল ও তাঁর পিতার সেই বিরাট কুরবানীকে স্মরণ করে। প্রতি বছর ঐ তারিখে মুসলিমরা আল্লাহর উদ্দেশে পশু কুরবানী করে। যারা মক্কায় হজ্জ পালন করতে যায়, ঐ তারিখে সেখানে কুরবানী করা তাঁদের জন্যে অবশ্য করনীয় কাজ। যারা আল্লাহর হুকুমের সামনে বিনীত হয়ে মাথা নত করে দেন, আল্লাহ্ তাঁদের এভাবেই পুরস্কৃত করেন। পরীক্ষায় পাশের পর আল্লাহ্ ইসমাঈলকে নবুয়্যত দান করেন।
এর আগে ইসমাঈলের মা পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন মহান আল্লাহ্ সেই ঘটনাটিকেও চির স্মরণীয় করে রাখলেন। যারাই মক্কায় হজ্জ করতে যাবে, তাঁদের জন্যে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করার নিয়ম আল্লাহ্ চালু করে দিলেন। মা হাজেরার সেই কষ্টকে আল্লাহ্ স্মরণীয় করে রাখলেন কেন?
কারন তিনি যে আল্লাহর ইচ্ছায় মক্কার জনমানবহীন মরুভূমিতে বসবাস করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ইব্রাহিম যখন বললেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁকে এই মরুভূমিতে রেখে যাচ্ছেন, তখন তিনি একমাত্র আল্লাহর উপরে ভরসা করে সেখানে থেকে গেলেন। তাঁর এই যে বিরাট আল্লাহ্নির্ভরতা, এরি বিনিময়ে আল্লাহ্ পাক তাঁকে চির স্মরণীয় ও সম্মানিত করে রাখলেন।
বিয়ে করলেন পিতা হলেন
দিন যায় রাত আসে। বছর ঘুরে আসে নতুন বছর। ইসমাঈল বড় হয়ে উঠেন। পাশেই বসবাস করছে জুরহুম গোত্রের লোকেরা। ইসমাঈল তাঁর সুন্দর ও চমৎকার মানবীয় গুনাবলীর জন্যে তাঁদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেন। ইসমাঈল যৌবনপ্রাপ্ত হলে তারা তাঁদের এক মেয়েকে ইসমাঈলের কাছে বিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুকাল পরেই তাঁর মা হাজেরা ইহলোক ত্যাগ করেন। আল্লাহ্ পাক ইসমাঈলের মাকে নিজ রহমতের ছায়াতলে স্থান দিন। এরই মাঝে ইব্রাহিম এলেন প্রিয় পুত্র ও স্ত্রীকে দেখার জন্যে। ইসমাঈল এসময় মক্কার বাইরে ছিলেন। ইব্রাহিম এসে পুত্রকে বাড়িতে পেলেন না। স্ত্রী হাজেরাও মৃত। ঘরে শুধু পুত্রবধু। কিন্তু পুত্রবধু একজন সত্যিকার মুমিন মহিলার মতো আচরণ করেননি। একজন নবীর স্ত্রী আর একজন নবীর পুত্র বধু হিসেবে তো তাঁর আদর্শ মুসলিম মহিলা হওয়া উচিত ছিলো। ফলে পিতার নির্দেশে ইসমাঈল এ মহিলাকে তালাক দেন এবং আরেকজন সত্যিকার মুমিন মহিলাকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাঁর কয়েকটি ছেলেমেয়ে জন্ম হয়। তাঁরাও আদর্শ মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠেন।
কা’বা নির্মাণে অংশ নিলেন
একদিন পিতা ইব্রাহিম ইসমাঈলকে ডেকে বললেন- ‘আল্লাহ্ আমাকে একটি কাজের হুকুম দিয়েছেন। তুমি কি আমাকে সে কাজে সাহায্য করবে? ইসমাঈল বললেন- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবো।’ ইব্রাহিম সামনের উঁচু টিলাটি দেখিয়ে বললেন- ‘মহান আল্লাহ্ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাবার নির্দেশ দিয়েছেন।’
অতঃপর বার বেটা দু’জন মিলে আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করলেন। ইসমাঈল পাথর যোগান দেন আর ইব্রাহিম গাঁথুনি গেঁথে দেয়াল নির্মাণ করেন, ছাদ নির্মাণ করেন। গাঁথুনি যখন উপরে উঠছিলো, তখন ইসমাঈল একটি বড় পাথর এনে দিলেন। ইব্রাহিম সে পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। পাথরটির এমন গুণ ছিল যে প্রয়োজনমত উঁচু হয়ে যেত। যেন জীবন্ত পাথরের ন্যায়। আজও সে পাথরটি কা’বা ঘরের সামনে বিদ্যমান আছে। আপনি যখন হজ্জ বা উমরা করতে যাবেন সে পাথরটি দেখতে পাবেন। ওখানে দু’রাকাত নামাজ পড়তে হয়। সে পাথরটির নাম মাকামে ইব্রাহিম। বাপ ছেলে মিলে যখন বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) নির্মাণ শেষ করলেন, তখন দু’জনে প্রভু দয়াময় মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, তিনি যেন তাঁদের এই খিদমত কবুল করে নেন। মহান আল্লাহ্ তাঁদের এই বিরাট খিদমত কবুল করে নেন। তাঁদের নির্মাণ করা ঐ ঘরকে চিরদিনের জন্যে হজ্জ ও তাওয়াফের কেন্দ্রে পরিণত করে দেন। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আল্লাহর এই ঘরকে তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় ছুটে যায়। আপনি সেই ঘরের তাওয়াফ করার নিয়ত করে রাখুন। হয়তো আল্লাহ্ একদিন সুযোগ করে দিবেন। অতঃপর ঐ ঘরকে কেন্দ্র করে মক্কা একটি স্থায়ী শহরে পরিণত হয়। সারা পৃথিবী থেকে আল্লাহ্ ভক্ত লোকেরা ছুটে আসে সেখানে। আল্লাহর ঘর ধরে তারা রোনাজারি করে।
ইসলামী সমাজ গড়লেন
ইসমাঈলের পিতা ইব্রাহিম আ. মহান আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে দোয়া করেছিলেন- ‘আমাকে নেক্কার সন্তান দান করো।’ সত্যিই আল্লাহ্ তাঁকে নেক পুত্র দান করেন। ইব্রাহিম আরো দোয়া করেছিলেন- ‘প্রভু, আমাকে সালাত কায়েমকারী বানাও, আমার সন্তানদেরকেও।’
ইসমাঈলকে আল্লাহ্ তায়ালা শুধু নেক্কারই বানাননি, শুধু সালাত কায়েমকারীই বানাননি, সেই সাথে একজন আদর্শ নবীও বানিয়েছিলেন। তাইতো মহান আল্লাহ্ বলেন, “ইসমাঈল, আলয়াসা, ইউনুস, লুত এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদা দান করেছি।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৮৬)
ইসমাঈল মক্কা ও হিজাযের লোকদেরকে আল্লাহর পথে ডাকেন। তাঁদের তিনি আল্লাহকে জানার, বুঝার ও আল্লাহর পথে চলার তা’লিম দেন। তিনি তাঁদের সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেন। তাই আল্লাহ্ তাঁর প্রশংসা করে বলেন, “ইসমাঈল, ইদ্রিস, যুলকিফল এরা সবাই ছিল সবর অবলম্বনকারী। আমি তাঁদেরকে আমার রহমতের ছায়াতলে স্থান দিয়েছি। তারা ছিলো যোগ্য লোক এবং সততার প্রতীক।” (সূরা ২১ আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৫)
তাঁর বারোজন পুত্র ছিলো এবং তারা সকলেই ছিলেন ইসলামী সমাজের কাণ্ডারি।
তাঁরই বংশে জন্ম নিলেন মুহাম্মদ সা.
মহান আল্লাহ্ ইসমাঈল আ. কে আরো একটি বড় মর্যাদা দান করেছেন। সেটা হলো, তাঁরই বংশে পাঠিয়েছেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃকে। কা’বা নির্মাণের পর ইসমাঈল পিতা ইব্রাহিমের সংগে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, “প্রভু, আমাদের বংশ থেকে তাঁদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিও, যিনি ওদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শোনাবেন, কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিবেন আর তাঁদের জীবনকে পরিশুদ্ধ পরিচ্ছন্ন করবেন। ” (সূরা বাকারা, আয়াত ১২৯)
আল্লাহ্ ইসমাঈল ও তাঁর পিতার দোয়া কবুল করেন। ইসমাঈলের বংশেই মুহাম্মদ সা. এর আবির্ভাব ঘটান। মুহাম্মদ সা. এসে পৃথিবীতে আবার ইব্রাহিম ও ইসমাঈল আ. এর মতই কা’বা কেন্দ্রিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কা’বা এবং কা’বা কেন্দ্রিক হজ্জ, কুরবানী, তাওয়াফ, সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি মাকামে ইব্রাহিমে সালাত আদায় ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ্ পাক ইব্রাহিম আ., ইসমাঈল আ. ও তাঁর সম্মানিত মা হাজেরা আলাইহিস সালামকে চিরদিন পৃথিবীতে স্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করলেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর অনুগত দাসদের এভাবেই পুরস্কৃত করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় নবী ইসমাঈল আ.-কে বিরাট সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। কুরআন মজিদে মোট বারোটি স্থানে আল্লাহ্ পাক ইসমাঈলের নাম উল্লেখ করেন। কয়েকটি আয়াত তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইসমাঈল আ. সম্পর্কে আরো বলেন-
“স্মরণ করো, ইসমাঈল, আলয়াসা, যুলকিফলকে। এরা সবাই ছিলো উত্তম আদর্শ।” (সূরা ৩৮ সোয়াদ, আয়াত ৪৮)
“হে মুহাম্মদ, তোমার কাছে আমি অহী পাঠাচ্ছি, যেমন পাঠিয়েছিলাম নূহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে, যেমন পাঠিয়েছিলাম ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের কাছে।” (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ১৩৬)
“হে মুহাম্মদ, বলো- আমরা আল্লাহকে মানি আর ইসমাঈল ও ইব্রাহিমের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাও মানি।” (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ১৩৬)
যেসব সুরায় ইসমাঈল আ. এর কথা উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো- সূরা আল বাকারাঃ ১২৫-১৪০, আলে ইমরানঃ ৮৪, আন নিসাঃ ১৬৩, আল আনআমঃ ৮৬, ইব্রাহিমঃ ৩৯, মরিয়মঃ ৫৪, আল আম্বিয়াঃ ৮৫, সোয়াদঃ ৪৮।
।
হযরত ইসহাক আ.
মহান আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম আ. এর দুই পুত্র ছিলেন। দুজনকেই আল্লাহ নবুয়্ত দান করেন এবং আরো দান করেন উচ্চ মর্যাদা। তাঁদের একজন ইসমাঈল আ. এবং অপরজন ইসহাক আ.। হযরত ইব্রাহিমের ছিলেন দুই জন স্ত্রী। একজন সারাহ আর অপরজন হাজেরা। সারাহ প্রথম স্ত্রী। তাঁকে সাথে নিয়েই হযরত ইবরাহীম তাঁর মাতৃভূমি ইরাক থেকে হিজরত করেন। অনেক দেশ ঘুরে মিশরে যান। সেখানে বিয়ে করেন দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরাকে। সেখান থেকে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এখানে আসার পর হাজেরার ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেন। সে পুত্রই ছিলেন কুরবানীর নবী হযরত ইসমাঈল আ.। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইবরাহীম শিশুপুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মাকে মক্কায় নিয়ে রেখে আসেন। সারাহ ফিলিস্তিনেই থেকে যান। হযরত ইবরাহীমও ফিলিস্তিনেই থাকতেন। আবার মক্কায় গিয়ে স্ত্রী ও পুত্র ইসমাঈলকে দেখাশুনা করে আসতেন।
সারাহর দুঃখ
কিন্তু সারার বড় দুঃখ। তিনি একজন বৃদ্ধা মহিলা। তাঁর সন্তানাদি হয় না। অথচ সব নারীই মা হতে চায়। সন্তানের মুখ দেখতে চায়। সন্তানকে বুকভরা আদর আর স্নেহ মমতা দিয়ে জড়িয়ে রাখতে চায়। মা ডাক না শুনলে কোন নারীরই বুক ভরে না। সন্তান ছাড়া নারীর কোল থাকে শুন্য। বুকভরা আশা নিয়ে সারাহ সবসময় দয়াময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন সন্তান চেয়ে। কিন্তু আজো তাঁর সন্তান হয়নি। তিনি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছেন। বয়েস হয়ে গেছে নব্বই। স্বামীও এখন শতায়ু বৃদ্ধ। সন্তান লাভের আর কি আশা? এ ঘরে সন্তান লাভের ব্যাপারে এখন দুজনই নিরাশ। কিন্তু হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেলো।
সুসংবাদ পেলেন সারাহ
হঠাৎ একদিন হযরত ইব্রাহিমের বাড়িতে এলো কয়েকজন তাগড়া যুবক। অতি সুন্দর সুশ্রী হৃষ্টপুষ্ট ওরা। যেনো শক্তিশালী যোদ্ধা এবং বিরাট কোন সম্রাটের সৈনিক। তাঁদের আকস্মিক আগমনে ইব্রাহিম ভয় পেয়ে গেলেন। তবে তারা এসেই হযরত ইব্রাহিমকে সালাম দেন এবং তিনিও সালামের জবাব দিয়ে তাঁদেরকে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করেন।
মেহমান এলে হযরত ইব্রাহিম অত্যন্ত খুশি হতেন। কারণ তিনি ছিলেন বড় মেহমান নেওয়াজ। ওদের বসতে দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাজা গরুর গোশত ভুনা করে নিয়ে আসলেন। সারাও পিছে পিছে এসে পর্দার আড়ালে দাঁড়ালেন। ইব্রাহিম সারার ভুনা করা মজাদার গোশত তাঁদের পরিবেশন করতে থাকলেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড। ওরা হাত গুটিয়ে রাখলো। খাবার স্পর্শ করছেনা। ইব্রাহিম ভাবলেন- নিশ্চয়ই এরা শত্রু হতে পারে। বললেন- আপনারা কারা? আপনাদের তো চিনতে পারছিনা? আপনাদেরকে আমার ভয় হচ্ছে।
এবার তারা মুখ খুললো। বললো- আপনি ভয় পাবেন না। আমরা আল্লাহর দূত ফেরেশতা। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে আপনার জন্যে সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। সারার ঘরে আপনার একটি বিজ্ঞ পুত্র সন্তান জন্ম হবে। একথা শুনে সারাহ বিস্মিত হয়ে সামনে এগিয়ে এলেন। কপালে হাত মেরে বললেন- এতো এক বিস্ময়ের খবর, আমি হয়ে গেছি বুড়ি থুরথুড়ি। তাঁর উপরে জনমের বন্ধ্যা। শুধু কি তাই? আমার স্বামীও শতায়ু বৃদ্ধ। কেমন করে হবে আমার ছেলে?
ফেরেশতারা বললেন- “এতো আল্লাহর সিদ্ধান্ত। আপনি কি আল্লাহর ফায়সালার ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করছেন? এ সুসংবাদ নির্ঘাত সত্য। এর কোন নড়চড় হবে না। আপনার গর্ভে ইসহাক জন্ম নেবেই। শুধু তাই নয়, ইসহাক একজন নবী হবে আর তাঁর ঘরেও জন্ম নেবে আরেক নবী ইয়াকুব। এ হচ্ছে আল্লাহর রহমত। পথভ্রান্তরা ছাড়া কি কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়? আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাকৌশলী, সপ্রসংশিত, অতিশয় মর্যাদাবান। তিনি যা চান তাই হয়। হে ঘরবাসী, আল্লাহর রহমত আর বরকতের ধারা বর্ষিত হোক আপনাদের প্রতি।” (সূরা ১১ হুদ-৭২,৭৩)
জন্ম নিলেন ইসহাক
আল্লাহর হুকুমের নড়চড় নেই। হযরত ইব্রাহিম আর সারার ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম গ্রহণ করলেন ইসহাক। চাঁদের মতো ফুটফুটে ছেলে। বুড়ো বয়সে ছেলে হলে আদরের সীমা থাকে না। বাবা মার আদরে লালিত পালিত হয়ে বড় হতে থাকলেন ইসহাক। যেমন বাপ তেমন ছেলে। মহান আল্লাহ ইসহাককে দান করেছেন দারুন মেধা, জ্ঞান এবং বুঝ-বুদ্ধি।
নবুয়্ত লাভ
বড় হলে ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা নবুয়ত দান করেন। একজন প্রশংসিত নবী হিসেবে কুরআন মজিদে বার বার তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে। ফিলিস্তিন অঞ্চলে তিনি তাঁর পিতা হযরত ইব্রাহিম আ. এর প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। হযরত ইব্রাহিম যে বিরাট অঞ্চলে ইসলাম কায়েম করে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তারা দুই ভাই ইসমাঈল ও ইসহাক তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হিজায অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন বড় ভাই ইসমাঈল আ.। আর ফিলিস্তিন অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেন ছোট ভাই ইসহাক আ.।
হযরত ইসহাক আ. এর বংশ
হযরত ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা এক ঐতিহাসিক গোত্রের পূর্বপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র ইয়াকুবকে আল্লাহ তায়ালা নবী মনোনীত করেন। ইয়াকুবের আরেক নাম ছিলো ইসরাইল। তাঁর সন্তানরা বনী ইসরাইল (ইসরাইলের বংশধর) হিসেবে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছে। মূলত এ বংশের ধারাবাহিকতা হযরত ইসহাক আ. থেকেই আরম্ভ হয়। এ বংশে আল্লাহ অসংখ্য নবী প্রেরণ করেছেন। ইসলামের সঠিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত অবস্থায় এ বংশের লোকেরা আজো পৃথিবীতে বর্তমান আছে।
হযরত ইসহাক আ. এর প্রশংসনীয় গুণাবলী
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মজিদে তাঁর দাস ও নবী হযরত ইসহাক আ. এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
১, “আমার দাস ইব্রাহিম, ইসহাক আর ইয়াকুবের কথা স্মরণ করো। তারা ছিলো বড় কর্মঠ আর দুরদৃষ্টি সম্পন্ন। একটি খাঁটি গুণের কারণে আমি তাঁদের মর্যাদাবান করেছিলাম। আর তা হলো পরকালের চিন্তা। তারা আমার কাছে বাছাই করা আদর্শ মানুষ।” (সূরা সোয়াদ, আয়াত ১০২)
২. “অতপর আমি ইব্রাহিমকে ইসহাকের সুসংবাদ দিলাম। বললাম- সে হবে একজন নবী ও উন্নত আমলের সুযোগ্য লোক।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১২)
৩. “আর আমি তাঁকে দান করেছি ইসহাককে। তাছাড়াও ইয়াকুবকে। তারা প্রত্যেকেই ছিলো সৎ সুযোগ্য। আমি তাঁদের নেতা বানিয়েছি। তারা আমার নির্দেশ মতো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতো। আমি তাঁদের কাছে অহী করেছিলাম কল্যাণমূলক কাজ করার, সালাত কায়েম করার ও যাকাত পরিশোধ করার। তারা ছিলো আমার একান্ত অনুগত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৭৩)
৪. “অতপর আমি তাঁকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দান করলাম। আর তাঁদের প্রত্যেককেই বানালাম নবী। নিজ রহমতে তাঁদের ধন্য করলাম আর মানুষের মাঝে তাঁদেরকে সত্যিকার সুনাম ও সুখ্যাতি দান করলাম।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৯-৫০)
৫. “হে মুহাম্মদ, আমি তোমার প্রতি তেমনই অহী নাযিল করেছি, যেমন করেছিলাম নুহ এবং তাঁর মধ্যবর্তী নবীদের উপর। যেমন আমি অহী পাঠিয়েছি ইব্রাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক—এর প্রতি— এরা সবাই ছিলো সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রাসুল।” (সূরা নিসা, আয়াত ১৬৩-১৬৫)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মজিদে হযরত ইসহাকের নাম উল্লেখ হয়েছে ১৭ বার। যেসব সুরাতে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো, সূরা আল বাকারাঃ ১৩৩,১৩৬,১৪০। আলে ইমরানঃ ৮৪। নিসাঃ ১৬৩। আল আনআমঃ ৮৪। হুদঃ ৭১। ইউসুফঃ ৬,৩৮। ইব্রাহিমঃ ৩৯। মরিয়মঃ ৪৯। আল আম্বিয়াঃ ৭২। আন কাবুতঃ ২৭। আস সাফফাতঃ ১১২,১১৩। সোয়াদঃ ৪৫।
।
হযরত ইয়াকুব আ.
নাম ও বংশ পরিচয়
মহাকালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ ইয়াকুব আ.। পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক বংশের তিনি আদি পুরুষ। সেকালে ইবরানী ভাষা নামে একটি ভাষা চালু ছিলো। বহ নবীর মুখের ভাষা ছিলো এই ইবরানী ভাষা। এ ভাষায় আল্লাহ তায়ালা কিতাবও নাযিল করেছেন। হযরত ইয়াকুব আ. এর ভাষাও ছিলো এই ইবরানী ভাষা। এ ভাষায় তাঁর নাম ছিলো ইসরাইল। এর অর্থ কি? ইসরাইল মানে আল্লাহর দাস। অন্য সকল নবীর মতো তিনিও আল্লাহর দাসই ছিলেন। তবে সেই সাথে তাঁর নামটিও ছিলো ‘আল্লাহর দাস’। এর আরবী অনুবাদ হল ‘আব্দুল্লাহ’। হযরত ইয়াকুব আ. ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাবান একজন নবী। পূর্বপুরুষের দিক থেকে তিনি এক সম্মানিত নবীর পুত্র আরেক সম্মানিত নবীর নাতি। অর্থাৎ তিনি ছিলেন হযরত ইব্রাহিমের নাতি আর হযরত ইসহাকের পুত্র। অন্যদিকে তাঁর বংশেও জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য নবী। তিনি ইসরাইল নামে পরিচিত হবার কারণে তাঁর বংশধরদের বলা হয় ‘বনী ইসরাইল’ বা ইসরাইলের বংশধর।
কোন কোন সুত্র থেকে জানা যায় তাঁর বংশধরদের মধ্যে চার হাজার নবী জন্মগ্রহণ করেন। হযরত ইউসুফ, মুসা, হারুন, দাউদ, সুলাইমান, যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ বিখ্যাত নবী রাসুলগণ ছিলেন তাঁরই বংশধর।
জন্ম ও শৈশব
হযরত ইব্রাহিম আ. তাঁর প্রথম স্ত্রী সারাকে নিয়ে ফিলিস্তিনের কেনান শহরে বসবাস করতেন। এখানে সারার ঘরে জন্ম নেন হযরত ইসহাক আ.। আর এ শহরেই জন্ম হয় ইসহাকের পুত্র হযরত ইয়াকুব আ. এর। নবীর পুত্র শৈশব থেকেই জ্ঞানে গুণে নবীর মতো হয়ে গড়ে উঠতে থাকেন। তাঁর উন্নত জ্ঞান বুদ্ধি সুন্দর স্বভাব চরিত্র আর অমায়িক ব্যবহার দেখে ছোট বেলা থেকেই বুঝা যাচ্ছিলো, তিনি হবেন একজন মহামানব ।
যৌবনকালে খালার বাড়ি
ইয়াকুব যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন একদিন তাঁর মা রিফকাহ তাঁকে তাঁর খালার বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললেন- তুই সেখানে গিয়ে থাকগে। যুবক ইয়াকুব মায়ের নির্দেশে খালার বাড়ি চলে এলেন। ব্যবিলন নামে একটি শহর ছিল ইরাকে। এখন এই শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই ব্যবিলনের ‘ফুদ্দানে আরাম’ নামক স্থানেই ছিলো ইয়াকুবের খালার বাড়ি। এখানে এসে ইয়াকুব শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা আর মেধা বৃদ্ধির বিরাট সুযোগ পেলেন।
বিয়ে করলেন ইয়াকুব আ.
খালার বাড়িতে ইয়াকুব সতের বা বিশ বছর অবস্থান করেন। এখানেই তিনি বিয়ে শাদি করেন। তিনি চারটি বিয়ে করেন। বড় স্ত্রীর নাম ছিলো লিয়া, দ্বিতীয় স্ত্রী রাহিল, তৃতীয় স্ত্রী যুলফা আর চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন বলুহা। তাঁর কোন স্ত্রীর ঘরে কয়টি ছেলে হয়েছিলো, ইতিহাসে তাও উল্লেখ আছে। তাঁর পুত্রদের নাম- লিয়ার ঘরে জন্ম হয় ছয়টি পুত্রের। ওদের নাম হলো- রুবিল, শামউন, লাভি, ইয়াহুযা, ইসাখার ও যাবলুন।
রাহিলের ঘরে জন্ম নেন দুইজন পুত্র সন্তান। তারা হলেন- ইউসুফ ও বনী ইয়ামীন।
যুলফার ঘরে জন্ম হয় দুই ছেলে জাদ ও আশির।
বলুহার ঘরেও দুইটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। তারা হলেন- দান ও নাফতালি।
সব মিলে হলো- বারোটি পুত্র । এই বারো পুত্র থেকেই জন্ম নেয় বনী ইসরাইলের বারোটি শাখা গোত্র। এদের মধ্যে লাভির বংশে জন্ম নেন হযরত মুসা ও হারুন আ.। ইয়াহুযা ছিলেন ধর্মীয় দিক থেকে খুবই প্রভাবশালী। পরবর্তীকালে তাঁর নাম অনুসারেই আসল ধর্ম বিকৃত হয়ে জন্ম নেয় ইয়াহুদি ধর্মের। একপুত্র ইউসুফ আ. তো পরে মিশরে গিয়ে সেখানকার শাসক হন।
ফিরে এলেন কেনানে
অনেক দিন হয়ে গেলো খালার বাড়ি। এবার ডাক পড়েছে নিজের বাড়ি ফিরে আসার। বিনিয়ামিন ছাড়া তাঁর এগারটি পুত্রের জন্ম খালার বাড়িতেই হয়। বিবি বাচ্চা সবাইকে নিয়ে ইয়াকুব রওয়ানা করলেন ফিলিস্তিনের দিকে। অনেক দিন দূরে থাকার পর এবার এসে পৌঁছে গেলেন নিজ মাতৃভূমি কেনানে। কেনানে আসার পর ছোট ছেলে বিনইয়ামিনের জন্ম হয়। এতোগুলো নাতি পেয়ে দাদা দাদি দারুন খুশি। বাড়ি ফিরে ইয়াকুব আল্লাহর পথে নিজের জানমাল পুরোপুরি নিয়োজিত করেন।
নবী হলেন ইয়াকুব আ.
ইয়াকুব ছিলেন আল্লাহর জন্যে নিবেদিতপ্রাণ। আল্লাহও তাঁকে নিজের জন্যে বাছাই করে নেন। দান করেন নবুয়ত। ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে হযরত ইব্রাহিম আ. পুত্র ইসহাকের উপরে দায়িত্ব দিয়ে যান। ইসহাক আ. বৃদ্ধ বয়েসে উপনীত হবার পরে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই পুত্র ইয়াকুব তাঁর প্রতিনিধি মনোনীত হন। কিছুকাল পর হযরত ইয়াকুব আ. এর পিতা হযরত ইসহাক আ. ইহলোক ত্যাগ করেন। হযরত ইয়াকুব গোটা ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দ্বীনের পতাকা উড্ডীন করেন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে বয়ে নিয়ে যান আল্লাহর বাণী। মানুষকে সমবেত করেন আল্লাহর দ্বীনের পতাকাতলে।
ধৈর্য জ্ঞান ও আল্লাহ নির্ভরতার প্রতীক
হযরত ইয়াকুব আ. ছিলেন পরম ধৈর্যশীল ও ধৈর্যের পাহাড়। তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইউসুফকে তাঁর ভাইয়েরা যখন অন্ধকূপে ফেলে বাড়ি এসে তাঁর কাছে বলেছিলো, ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। তখন এই চরম দুঃখ ও বেদনার সংবাদ শুনে তিনি কেবল এতোটুকুই বলেছিলেন, “বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্যে একটি অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে দিয়েছে। আমি ধৈর্য ধরবো, উত্তম ধৈর্য। তোমরা যে কথা সাজিয়েছ, তাঁর জন্যে কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১৮)
ছোট ছেলে বিন ইয়ামিনকে যখন তাঁর ভাইয়েরা চুরির ঘটনার জন্যে মিশরে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিলো, তখনো তিনি একই ভাষায় বলেছিলেন, “আমি উত্তমভাবেই ধৈর্য ধারণ করলাম। মহান আল্লাহ হয়তো ওদের সবাইকেই আমার কাছে এনে দিবেন।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮৩)
“আমি আমার দুঃখ বেদনার ফরিয়াদ কেবল আল্লাহর কাছেই করবো। আল্লাহর ব্যাপারে আমি যততুকু জানি তোমরা তা জান না। হে আমার ছেলেরা, তোমরা যাও, ইউসুফ ও তাঁর ভাইকে (বনিয়ামিন) খুঁজে দেখো। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮৬-৮৭)
হযরত ইয়াকুবের ঐ দুষ্ট প্রকৃতির দশটি ছেলে যখন মিশর শাসকের পরিচয় পেলো, তখন তারা দেখলো, এতো তাঁদেরই সেই ভাই ইউসুফ, যাকে তারা অন্ধকূপে ফেলে দিয়েছিলো। ইউসুফ তাঁদের ক্ষমা করে দিলেন। ইউসুফের জন্যে চিন্তা করতে করতে হযরত ইয়াকুবের দুটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ইউসুফ তাঁর ভাইদের কাছে নিজের জামা দিয়ে বললেন- এটি নিয়ে আমার আব্বার মুখমণ্ডলে রাখো, তাতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। তারা যখন ইউসুফের সুসংবাদ আর তাঁর জামা নিয়ে কেনানের উদ্দেশে রওয়ানা করলো, তখন হযরত ইয়াকুব বাড়ির লোকদের বললেন, “আমি ইউসুফের সুবাস পাচ্ছি।”(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৪)
অতপর সুসংবাদ বহনকারীরা যখন ইউসুফের জামাটি এনে তাঁর মুখমণ্ডলে রাখলো, সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি লাভ করলেন। তখন তিনি তাঁর ঘরের লোকদের বললেন, “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব কথা জানি, যা তোমরা জান না।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৬)
বৃদ্ধ বয়েসে মিশর এলেন
কি সৌভাগ্য হযরত ইয়াকুব আ. এর। মহান আল্লাহ তাঁর হারানো ছেলে ইউসুফকে মিশরের শাসক বানিয়েছেন। ইউসুফ তাঁর ভাইদের বলে পাঠিয়েছেন পরিবারের সবাইকে মিশর নিয়ে আসতে। হযরত ইয়াকুবের সেই অপরাধী ছেলেগুলো বাড়ি এসে বলল, “আব্বাজান, আপনি আমাদের অপরাধ মাফির জন্যে দোয়া করুন। সত্যিই আমরা অপরাধী ছিলাম।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৭)
হযরত ইয়াকুব বললেন, “আমি আমার প্রভুর দরবারে তোমাদের ক্ষমা করে দেবার জন্যে আবেদন জানাবো। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৮)
অতঃপর হযরত ইয়াকুব সপরিবারে মিশর চলে এলেন। এ সময় তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। মিসর পৌঁছার সময় নিকটবর্তী হ’লে ইউসুফ (আঃ) ও নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য বিশাল আয়োজন করেন। অতঃপর পিতা-মাতা ও ভাইদের নিয়ে তিনি শাহী মহলে প্রবেশ করেন। অতঃপর তিনি পিতা-মাতাকে তাঁর সিংহাসনে বসালেন। এর পরবর্তী ঘটনা হ’ল শৈশবে দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনন্য দৃশ্য। এ বিষয়ে বর্ণিত কুরআনী ভাষ্য নিম্নরূপ:
‘অতঃপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছল, তখন ইউসুফ পিতা-মাতাকে নিজের কাছে নিল এবং বলল, আল্লাহ চাহেন তো নিঃশংকচিত্তে মিসরে প্রবেশ করুন’। ‘অতঃপর সে তাঁর পিতা-মাতাকে সিংহাসনে বসালো এবং তারা সবাই তার সম্মুখে সিজদাবনত হ’ল। সে বলল, হে পিতা! এটিই হচ্ছে আমার ইতিপূর্বে দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা। আমার পালনকর্তা একে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন। তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা চান, সুক্ষ্ম কৌশলে তা সম্পন্ন করেন। নিশ্চয়ই তিনি বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (ইউসুফ ১২/৯৯-১০০)।
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর পিতা-পুত্রের মিলনের সময় ইউসুফের কথাগুলি লক্ষণীয়। তিনি এখানে ভাইদের দ্বারা অন্ধকূপে নিক্ষেপের কথা এবং পরবর্তীতে যোলায়খার চক্রান্তে কারাগারে নিক্ষেপের কথা চেপে গিয়ে কেবল কারামুক্তি থেকে বক্তব্য শুরু করেছেন। তারপর পিতাকে গ্রাম থেকে শহরে এনে মিলনের কথা ও উন্নত জীবনে পদার্পণের কথা বলেছেন। অতঃপর ভাইদের হিংসা ও চক্রান্তের দোষটি শয়তানের উপরে চাপিয়ে দিয়ে ভাইদেরকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁর ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখা এগারটি তারা এবং সূর্য আর চাঁদ তাঁকে সেজদা করছে তাঁর পিতা-মাতা ও ভাইদের সেজদা করার মাধ্যমে সত্য হল।
তাই তিনি বললেন, “আব্বাজান, আমি যা স্বপ্ন দেখেছিলাম, এ হলো সেই স্বপ্নের মর্ম। আমার প্রভু, আমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি আমার প্রতি বিরাট অনুগ্রহ দেখিয়ে আমাকে কারাগার থেকে বের করে এনেছেন। আপনাদের মরু অঞ্চল থেকে বের করে এনে আমার সাথে মিলিত করেছেন। অথচ শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। আমার প্রভু অতি সূক্ষ্ম কৌশলে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও সুকৌশলী।”(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০০)
মিশরে হিজরত করে আসার পর হযরত ইয়াকুব আ. আরো সতের বছর বেঁচে ছিলেন। এ হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিলো একশো ত্রিশ বছর। একশো সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি মিশরে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছেলেদেরকে অসিয়ত করে যান, তাঁকে যেন ফিলিস্তিনে নিয়ে তাঁর পিতা মাতার পাশে সমাহিত করা হয়।
পুত্রদের প্রতি উপদেশ
হযরত ইয়াকুব জনগণ ও তাঁর পুত্রদের যে উপদেশ দিয়েছিলেন, কুরআনের দুটি স্থানে তাঁর কিছু অংশ বর্ণিত হয়েছে। যখন তাঁর দশ ছেলে ছোট ছেলে বিনইয়ামিনকে সাথে নিয়ে খাদ্য শস্য আনার জন্যে মিশর যাত্রা করেছিলে, তখন তিনি তাঁদের উপদেশ দিলেন-
“হে আমার ছেলেরা, তোমরা মিশরের রাজধানীতে একটি প্রবেশ পথে ঢুকো না। বিভিন্ন গেইট দিয়ে প্রবেশ করো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারব না। সমস্ত কৃতিত্ব তো আল্লাহর হাতে। আমি তাঁরই উপর ভরসা করছি। সকল ভরসাকারীকে তাঁরই উপরে ভরসা করতে হবে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৬৭)
সূরা বাকারায় হযরত ইয়াকুবের উপদেশগুলো এভাবে উল্লেখ হয়েছে, “ইয়াকুব তাঁর সন্তানদের এই উপদেশ দিয়েছিলোঃ হে আমার সন্তানেরা, আল্লাহ তোমাদের জন্যে মনোনীত করেছেন ‘আদ দীন’ (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম) সুতরাং তোমরা মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) থাকো। সে মৃত্যুকালে তাঁর সন্তানদের জিজ্ঞেস করেছিলো- আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদত ও দাসত্ব করবে? জবাবে তারা বলেছিল, আমরা সেই এক আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব করবো। যাকে আপনি ও আপনার পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম, ইসমাঈল এবং ইসহাক ইলাহ হিসেবে মেনেছেন। আমরা তাঁরই অনুগত হয়ে থাকবো।” (সূরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ১৩২-১৩৩)
হযরত ইয়াকুব আ. এর এই উপদেশটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি থেকে আমরা জানতে পারি-
১. ইসলামই হলো আল্লাহর মনোনীত দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা।
২. আল্লাহর মনোনীত দীনের অনুসারীরা মুসলিম।
৩. সকল নবী একই দীনের বাহক ও প্রচারক ছিলেন।
৪. আমৃত্যু আল্লাহর অনুগত বাধ্যগত হয়ে থাকাই প্রকৃত মুমিনের কাজ।
৫. মুসলিম হওয়া মানে আল্লাহর দাসত্ব করা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মজিদে মহান আল্লাহ তাঁর দাস ও নবী হযরত ইয়াকুবের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। আল কুরআনে ১৬ বার তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে। যেসব আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সেগুলো–সূরা আল বাকারা- ১৩২, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০, সূরা আলে ইমরান- ৮৪, সূরা আন নিসা- ১৬৩, সূরা আল আনয়াম- ৮৪, সূরা হুদ- ৭১, সূরা ইউসুফ- ৬, ৩৮, ৬৮, সূরা মরিয়ম- ৬, ৪৯, সূরা আল আম্বিয়া- ৭২, সূরা আল আনকাবুত- ২৭, সূরা সোয়াদ- ৪৫।
মহান আল্লাহ হযরত ইয়াকুব আ. সম্পর্কে বলেন, “সে (ইয়াকুব) ছিলো আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান। কিন্তু অধিকাংশ লোক প্রকৃত সত্য জানেনা।” (সূরা ইউসুফঃ আয়াত ৬৮)
।
হযরত ইউসুফ আ.
আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত ইউসুফ আ. একরাতে একটি অপূব স্বপ্ন দেখেন এবং পিতা হযরত ইয়াকুব আ. এর নিকট এভাবে বণনা করেন, আব্বু, আজ রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি, এগারটি তারা এবং সূর্য আর চাঁদ আমাকে সাজদা করছে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ০৪)
পিতা বললেন,“পুত্র আমার, এ স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের বলো না। ওরা জানতে পারলে তোমার ক্ষতি করার চিন্তা করবে। আর শয়তান তো মানুষের ঘোরতর শত্রু আছেই।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ০৫)
ছোট্ট কচি ইউসুফ যেদিন এ স্বপ্ন দেখেন, সেদিনই তাঁর বিজ্ঞ পিতা বুঝতে পারেন, মহান আল্লাহ তাঁর এই পুত্রটিকে নবুয়ত দান করবেন। তাই তো তিনি সতর্ক করে দিলেন। সেই সাথে আরো বললেন, “তোমাকে তোমার প্রভু তাঁর কাজের জন্যে নির্বাচিত করবেন, কথার মর্ম বুঝতে শেখাবেন আর তোমার প্রতি ও ইয়াকুবের পরিবারের প্রতি ঠিক তেমনি করে তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করবেন, যেমনটি করেছিলেন তোমার পিতামহ ইসহাক ও ইব্রাহিমের প্রতি।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৫-৬)
বংশ পরিচয়
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন- “করিম ইবনে করিম ইবনে করিম-ইউসুফ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইবনে ইসহাক ইবনে ইব্রাহিম।” ‘করিম’ মানে সম্মানিত। অর্থাৎ সম্মানিত নবী হযরত ইউসুফ মহাসম্মানিত নবী ইব্রাহিম আ. এর প্রপুত্র সম্মানিত নবী ইসহাকের পৌত্র আর সম্মানিত নবী ইয়াকুবের পুত্র।
হযরত ইউসুফ আ. যেমনি ছিলেন মহান নবীদের সন্তান, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্র ও পবিত্র জীবনের অধিকারী এক মহান নবী। আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন, “ইন্নাহু কা-না মিন ইবাদিনাল মুখলাসিন- সে ছিলো আমার একান্ত বাছাই করা দাসদের একজন।” হযরত ইউসুফের জন্ম হয় নানার বাড়িতে। জন্মের পর পিতার সাথে নিজের বাড়ি ফিলিস্তিনের হেবরন শহরে চলে আসেন। তাঁর মায়ের নাম ছিলো রাহিল। হযরত ইউসুফের পিতা ইয়াকুব আ. চার বিয়ে করেছিলেন। চার ঘরে তাঁর ছিলেন মোট বারো ভাই। তবে হযরত ইউসুফের সহোদর ভাই ছিলেন মাত্র একজন, বিনয়ামিন। বারো ভাইদের মধ্যে বিনয়ামিন ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। ইউসুফ ছিলেন সোনার ছেলে। যেমন বাপ তেমনি ছিলেন পুত্র ইউসুফ। নবীর ছেলে ঠিক নবীর মতো জ্ঞান বুদ্ধি আর চমৎকার আচার আচরণ। ইবাদত বন্দেগীতে অগ্রগামী। আল্লাহ ভীরু, আল্লাহ পরায়ন। বাপ দেখলেন আল্লাহর কাছে এই ছেলেই হবে তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। বাবা তাঁকে খুব বেশি আদর যত্ম করতেন।
দশ ভাইয়ের ষড়যন্ত্র
ইউসুফ আর বিনয়ামিনকে পিতা নিজেই দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া অত্যন্ত সুস্বভাবের অধিকারী হবার কারণে তিনি তাঁদের নিজের কাছে কাছে রাখতেন। অপরদিকে তাঁর অন্য দশটি ছেলে ছিলো দুষ্ট প্রকৃতির। তাঁরা বাপের মতো হয়ে গড়ে উঠেনি। তাছাড়া অন্যায় স্বভাব চরিত্রের কারণে তাঁরা পিতার বিশ্বাসভাজনও হতে পারেনি। তাঁরা একজোট হয়ে একদিন ষড়যন্ত্র পাকালো। তাঁরা বলাবলি করলো, “ইউসুফ আর তাঁর ভাই বিনয়ামিন আমাদের চেয়ে বাবার কাছে অধিক প্রিয়। অথচ আমরা দশজন একটি শক্তিশালী দল। বাবা খুব ভুল করছেন। চলো আমরা ইউসুফকে মেরে ফেলি বা কোথাও নিয়ে ফেলে আসি। তখন বাবার দৃষ্টি আমাদের দিকে ফিরে আসবে। এই অপরাধটা করার পর তোমরা আবার ভালো হয়ে যেও।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮-৯)
যে কথা সে কাজ। তাঁরা তাঁদের পিতার কাছে এসে বললো- বাবা, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের উপর আস্থা রাখেন না কেন? আমরা তো সব সময় তাঁর ভালোই চাই। আগামীকাল ওকে আমাদের সাথে দিন। আমাদের সাথে গিয়ে ফলমূল খাবে আর দৌড়াদৌড়ি করে মন চাংগা করবে। আমরা তাঁর পূর্ণ হিফাজত করবো।
বাবা বললেন- তোমরা তাঁকে নিয়ে গেলে আমি চিন্তাগ্রস্ত থাকবো। আমার শংকা হয়, তোমরা ওর প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়বে আর এ ফাকে ওকে বাঘ খেয়ে ফেলবে।
দশ ভাই বললো- আমরা এতগুলো লোক থাকতে ওকে বাঘে খাবে? তবে তো আমরা বড় অকর্মণ্য বলে প্রমাণিত হবো। তারপর তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বাবাকে এটা ওটা বুঝিয়ে ওরা পরদিন ইউসুফকে বনের দিকে নিয়ে গেলো। আল্লাহভক্ত এই ছেলেটিকে ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দারুণ চিন্তার মধ্যে সময় কাটাতে থাকেন ইয়াকুব আ.।
কূপে ফেলে দিলো ইউসুফ আ. কে
সে এলাকা দিয়ে ছিলো একটি আন্তর্জাতিক পথ। এ পথে মিশর থেকে সিরিয়া আর সিরিয়া থেকে মিশরে বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করতো। ব্যবসায়ীদের পানি পানের সুবিধার্থে লোকেরা পথিমধ্যে এখানে সেখানে পানির কূপ খনন করে রাখতো। ব্যবসায়ীরা কূপের কাছে বিশ্রাম নিতে আর বালতি ফেলে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে পান করতো।
ইউসুফের দুরাচার নিষ্ঠুর ভাইয়েরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে এমনই একটি কূপে ফেলে দিলো। আল্লাহ ছাড়া সেখানে ইউসুফকে সাহায্য করবার আর কেউই ছিল না। ইউসুফ সকল ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করলেন। তাঁর মহান প্রভু আল্লাহ অহীর মাধ্যমে তাঁকে শান্তনা দিলেন এবং ভবিষ্যতের সুসংবাদ জানিয়ে দিলেন।
পিতার নিকট বানোয়াট কাহিনী
এবার দশ ভাই ফন্দি আঁটলো পিতার নিকট এসে কি বলবে? যারা মিথ্যা বলতে পারে, তাঁদের জন্যে কোন একটা ফন্দি এঁটে নেয়া তো কঠিন নয়। ইউসুফকে কূপে ফেলে দেয়ার সময় তাঁরা তাঁর জামাটা রেখে দিয়েছিলো। একটা পশু যবাই করে এবার ইউসুফের জামায় সেটার রক্ত মেখে নিলো। সন্ধ্যার পর ভান করে কাঁদতে কাঁদতে দশ ভাই বাড়ি ফিরে এলো। ইউসুফের রক্তমাখা জামা বাপের সামনে রেখে দিয়ে বললো- “বাবা, আমরা দশভাই দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম। এদিকে ইউসুফকে বসিয়ে রেখেছিলাম আমাদের জিনিসপত্রের কাছে। হঠাৎ এক নেকড়ে এসে ওকে খেয়ে ফেলে। আমরা সত্য কথা বলছি বাবা, জানি, আমরা যতই সত্য বলি না কেন আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১৭)
তাঁদের পিতা মহান নবী হযরত ইয়াকুব এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরও কেবল আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ধৈর্য ধারণ করলেন।
রাখে আল্লাহ মারে কে?
আল্লাহ যাকে বাচান তাঁকে মারার শক্তি কার আছে? আল্লাহ কূপের মধ্যে ইউসুফের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেন। ইউসুফ সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। ইতোমধ্যে সেখানে একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে অবতরণ করলো। তাঁরা তাঁদের একজনকে কূপ থেকে পানি উঠাতে পাঠালো। সে যখন পানির জন্যে বালতি ফেললো, ইউসুফ তাঁর বালতি ধরে উঠে এলেন। লোকটি চিৎকার করে উঠলো- কি চমৎকার, এ যে এক বালক। তাঁরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে পণ্যদ্রব্য হিসেবে বিক্রি করে দিলো। বিক্রি করলো মাত্র সামান্য কয়েক দিরহামে।
মিশরে ইউসুফ আ.
মিশরের ‘আযিয মিশর’ উপাধিধারী এক বড় মন্ত্রী ইউসুফকে বিনিকদের কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি ইউসুফকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘একটি ছেলে কিনে এনেছি। ওকে যত্ন করে রেখো। ও আমাদের উপকারে আসতে পারে, আর নয়তো তাঁকে আমরাই পুত্র বানিয়ে নেবো।’
এবার দেখুন আল্লাহর ক্ষমতা। তিনি কিভাবে ইউসুফকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলেন সেকালের শক্তিশালী রাজ্য মিশরের ক্ষমতাবানদের ঘরে। আল্লাহ বলেন, “এভাবে আমি ইউসুফের জন্যে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হবার পথ বের করে দিলাম। সেই সাথে আমি তাঁকে সবকিছুর মর্ম বুঝার শিক্ষাও দান করলাম।”
এ ঘরে ইউসুফ রাজপুত্রের সমাদরে বড় হতে থাকলেন। এখানেই তিনি যখন পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে নবুয়ত দান করেন। তাঁকে নবুয়্যত দান করে আল্লাহ বলেন – “আমি নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। ” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ২২)
জেলে যাবো তবু পাপ করব না
তখনকার মিশরের লোকদের নৈতিক চরিত্র ছিলো খুবই খারাপ। তাঁদের নারী পুরুষ সবাই নির্লজ্জের মতো পাপ কাজ করে বেড়াতো। কেউ পাপ কাজ করলে অন্যেরা সেটাকে খারাপ মনে করতনা । ইউসুফ যেমন ছিলেন জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিমান, ঠিক তেমনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর, সুশ্রী এক বলিষ্ঠ যুবক। সেই ‘আযিয মিশরের’ স্ত্রী এবং অন্যান্য শহুরে মহিলারা ইউসুফকে চারিদিক থেকে পাপ কাজে নামাবার জন্যে ফুসলাতে থাকে। আযীয মিশরের স্ত্রী জুলেখা একপক্ষীয়ভাবে ইউসুফের সাথে পাপ কাজে লিপ্ত হবার জন্যে পাগল হয়ে যায়। একদিন সে ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইউসুফকে বলে- ‘আসো’
ইউসুফ বলেন- “এমন কর্ম থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমার প্রভু আমাকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। যারা পাপ কাজ করে তাঁরা কখনো সাফল্য অর্জন করে না।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ২৩)
একথা বলে ইউসুফ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে দরজার দিকে দৌড়ালেন। মহিলাটিও তাঁকে ধরার জন্যে তাঁর পেছনে পেছনে দৌঁড়ালো। মহিলাটি পেছন থেকে ইউসুফের জামা টেনে ধরে। ইউসুফ দৌঁড়াতে থাকেন। ফলে টানাটানিতে তাঁর জামা ছিড়ে যায়। ইউসুফ দরজা পর্যন্ত চলে আসেন এবং দরজা অলৌকিকভাবে দরজা খুলে যায়। দরজা খুলতেই তাঁরা দু’জনে মহিলার স্বামী আযীয মিশরকে দরজার সামনে দাঁড়ানো দেখতে পায়। পাপিষ্ঠ মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে ইউসুফের প্রতি ইংগিত করে তাঁর স্বামীকে বলে উঠে- ‘যে আপনার স্ত্রীর সাথে বদ কাজ করতে চাইছে, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করুন অথবা কঠিন শাস্তি দিন।’
ইউসুফ বললেন- আমি নই, তিনিই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। দুই ধরনের কথার প্রেক্ষিতে আযিয মিশর বেকায়দায় পড়ে যান। এমতাবস্থায় মহিলার ঘরেরই একজন সাক্ষী দিয়ে বললো- ‘দেখুন, ইউসুফের জামা যদি সামনের দিক থেকে ছেড়া হয়ে থাকে, তাহলে ইউসুফ মিথ্যাবাদী এবং আপনার স্ত্রী সত্যবাদী। আর ইউসুফের জামা যদি পেছনের দিক থেকে ছেড়া থাকে, তাহলে ইউসুফ সত্যবাদী এবং আপনার স্ত্রী মিথ্যাবাদী।’ তাঁর স্বামী যখন দেখলেন, ইউসুফের জামা পেছন দিক থেকে ছেড়া, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন- “এটা তোমারই চক্রান্ত। নারীদের ছলনা চক্রান্ত খুবই শক্তিশালী। হে ইউসুফ, তুমি বিষয়টা উপেক্ষা করো। হে আমার স্ত্রী, তুমি ক্ষমা চাও, কারণ তুমিই দোষী।”
আযীয মিশরের স্ত্রীর এই আচরণের খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। কানাঘুষা চলতে থাকে উপরের তলার মহিলাদের মধ্যে। তাঁদের কথা হলো- সম্পক করবি তো কর উপরের তলার কোন পুরুষের সাথে, ক্রীতদাসের করতে গেলি ক্যান?
তাঁদের এসব কথাবার্তার খবর এসে পৌঁছে যায় আযীয মিশরের স্ত্রী জুলেখার কানেও। তাঁর কথা হলো- ওরা আমার কাংখিত যুবকটি সম্পর্কে না জেনেই ওরা আমাকে দোষারোপ করছে।
ফলে জুলেখা তাঁদের ভুল ধারণা দূর করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে উপর তলার মহিলাদের জন্যে আয়োজন করে এক ভোজ সভার। তাঁদেরকে নিমন্ত্রণ জানায় নির্দিষ্ট দিন। খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখে। কেটে কেটে খাবার জন্যে তাঁদের প্রত্যেকের জন্যে সরবরাহ করে একটি করে ছুরি। সবাই ছুরি দিয়ে ফল কেটে কেটে খাচ্ছে, এমনি সময় জুলেখা ইউসুফকে তাঁদের সামনে আসতে আদেশ করে। ইউসুফ ডাইনিং হলে ঢুকতেই সবগুলো নারী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইউসুফের দিকে। তাঁরা আত্মভোলা হয়ে কেটে ফেলে নিজেদের হাত। তাঁরা স্বগত স্বত্বস্ফূত বলে উঠে- ‘আল্লাহর কসম, এতো মানুষ নয়, সাক্ষাত এক সম্মানিত ফেরেশতা।’ এবার জুলেখা বলে উঠে, দেখো, তোমরা না জেনে এমন একজন যুবকের ব্যাপারেই আমাকে তিরস্কার করছিলে। আমি অবশ্যি তাঁকে নিবেদন করেছি। কিন্তু সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন থেকে সে যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে অবশ্যি আমি তাঁকে হীন ও লাঞ্ছিত করে কারাগারে নিক্ষেপ করবো। আল্লাহর একান্ত অনুগত দাস ইউসুফ তো কিছুতেই পাপ কাজে নিমজ্জিত হতে পারেন না। এখন তাঁদের সবার জালাতনে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। উপর তলার সব মহিলার দৃষ্টি এখন ইউসুফের দিকে। ইউসুফ আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, “ওগো আমার প্রভু, এরা আমাকে যে কাজের দিকে ডাকছে তাঁর চাইতে কারাগারই আমার কাছে অধিকতর প্রিয়। আমার প্রভু, এদের চক্রান্ত থেকে তুমি যদি আমাকে না বাঁচাও, তাহলে তো আমি এদের ফাঁদে আঁটকে যাবো।’’ (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৩৩)
কারাগারে ইউসুফ আ.
আল্লাহ ইউসুফের ফরিয়াদ কবুল করলেন। নারীদের চক্রান্ত থেকে তাঁকে রক্ষা করলেন। যাদের নারীরা ইউসুফের জন্যে উন্মাদ হয়ে পড়েছিলো, তাঁরা একটি মেয়াদের জন্যে ইউসুফকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলো। অথচ তাঁরা জানতো ইউসুফ সম্পূর্ণ নির্দোষ। এভাবে ইউসুফ নৈতিক পরীক্ষায় মহাবীরের বেশে বিজয়ী হলেন। আর মিশরের অভিজাত মহল তাঁর চারিত্রিক আদর্শের কাছে চরমভাবে পরাজিত হলো।
দুই কয়েদীর স্বপ্ন এবং ইউসুফের দাওয়াতী কাজ
ইউসুফ জেলে এসে কৌশলের সাথে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, উন্নত চরিত্র আর দাওয়াতী কাজে আকৃষ্ট হয়ে কয়েদীরা তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ে। এক রাতে দু’জন কয়েদী স্বপ্ন দেখলো। তাঁরা ভাবলো, ইউসুফ ছাড়া আর কেউ তাঁদের স্বপ্নের মর্মার্থ বলে দিতে পারবে না। ছুটে এলো তাঁরা ইউসুফের কাছে।
একজন বললো- ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমি মদ তৈরি করছি’।
অপরজন বললো- ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমার মাথায় রুটি রাখা আছে আর পাখি তা থেকে খাচ্ছে।’
এরা দু’জন ছিলো মিশর রাজের কর্মচারী। একজন ছিলো রাজার মদ প্রস্তুতকারক, আর অপরজন ছিলো রাজার রুটি প্রস্তুতকারক।
ইউসুফ ওদের স্বপ্নের কথা শুনে বললেন- তোমাদের খাবার আসার আগেই আমি তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেবো। এই ফাঁকে তোমরা আমার কিছু কথা শুনো। আমি মহান প্রভু আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে তোমাদের বলছি, “আল্লাহর সাথে কাউকেও শরীক করা উচিত নয়। এটা আমাদের এবং গোটা মানবজাতির উপর আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ, তিনি আমাদেরকে তাঁর ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করার জন্যে সৃষ্টি করেননি। কিন্তু অধিকাংশ লোক তাঁর শোকর আদায় করে না।”
“হে আমার কারাসাথীরা, চিন্তা করে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু খোদা ভালো, নাকি একজন সর্বশক্তিমান আল্লাহ ভালো? তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যার ইবাদত করছো, তাঁরা তো মাত্র কতগুলো নাম। এ নামগুলো তো তোমরাই রেখেছো।”
“আসলে সকল ক্ষমতার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহ। কৃতিত্ব শুধুমাত্র তাঁর। তিনি হুকুম দিয়েছেন তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবেনা। এটাই হলো সঠিক সরল জীবন পদ্ধতি। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৩৮-৪০)
এবার তিনি তাঁদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিলেন। বললেন, “তোমাদের প্রথমজন তাঁর মনিবকে মদ পান করাবার চাকুরিতে ফিরে যাবে। আর দ্বিতীয়জনকে শুলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে এবং পাখি তাঁর মাথা ঠুকে ঠুকে মগজ খাবে। এই হলো তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৪১)
সত্যি তাই হলো। একজন মুক্তি পেলো এবং নিজের পূর্বের চাকুরিতে ফিরে গেলো। অপরজনকে শুলে করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং পাখি তাঁর মাথায় বসে মগজ খুঁটে খুঁটে খায়।
স্বপ্ন দেখেন রাজা
কারাগারে হযরত ইউসুফের আরো কয়েকটি বছর কেটে যায়। তিনি সেখানেই দ্বীনের কাজ করতে থাকেন। এরি মধ্যে মিশরের রাজা এক স্বপ্ন দেখেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন, “সাতটি মতা তাজা গাভীকে সাতটি শুকনো হালকা পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে। আরো দেখেন সাতটি সবুজ শস্যের ছড়া আর সাতটি শুকনো ছড়া।”
রাজা তাঁর পরিষদবর্গকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে বললেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এর ব্যাখ্যা করতে পারল না। এ সময় হঠাৎ ইউসুফের সেই কারা সাথিটির মনে পড়লো ইউসুফের কথা। সে বললো- আমাকে ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দিন, আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা এনে দিচ্ছি। তাই করা হলো। সে ছুটে এলো কারাগারে। ইউসুফের কাছে এসে বললো, “হে মহাসত্যবাদী ইউসুফ, আমাদের রাজা এই স্বপ্নে দেখেছেন। আপনি এর ব্যাখ্যা বলে দিন।” ইউসুফ রাজার স্বপ্নের মর্ম বলে দিলেন। তিনি বললেন- “তোমরা সাত বছর লাগাতার চাষাবাদ করবে। এ সময় যে ফসল কাটবে, তা থেকে আহারের পরিমাণ ছড়া (শীষ) থেকে বের করবে, বাকিটা ছড়া সমেত রেখে দেবে। তারপর তোমাদের দেশে আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। এ সময় খুব কমই ফসলাদি হবে। এ সময় আগের সাত বছরের সংরক্ষিত ফসল খাবে। অতঃপর একটি বছর আসবে, তখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং প্রচুর ফসল উঠবে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৪৭-৪৯)
লোকটি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে গিয়ে রাজাকে বললো। এ ব্যাখ্যা রাজার মনের মতো হলো। তিনি ব্যাখ্যাটি দারুন পছন্দ করলেন আর কারাগারে লোক পাঠিয়ে দিলেন ইউসুফকে নিয়ে আসার জন্যে। রাজার দূত যখন ইউসুফকে কারাগার থেকে বের করে নিতে এলো, ইউসুফ তাঁকে বললেন, ফিরে যাও। রাজাকে গিয়ে বলো, আগে সেই মহিলাদের বিচার করতে, যারা চক্রান্ত করে আমাকে কারাগারে পাঠিয়েছে।
রাজা সেই মহিলাদের ডেকে পাঠালেন এবং তাঁদের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন। তাঁরা বললো- “আল্লাহর কসম, ইউসুফ কোন অন্যায় করেনি, কোন পাপ করেনি। আমরাই তাঁকে ফাসাতে চেষ্টা করেছিলাম। সে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, নির্দোষ এবং সে অত্যন্ত সৎ ও সত্যবাদী।”
এ সত্য উদঘাটিত হবার পর ইউসুফ বললেন- আমি তো চেয়েছিলাম, এ সত্য প্রকাশিত হোক আর আযীয জানতে পারুক, আমি বিশ্বাস ঘাতকতা করিনি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
ইউসুফ আ. এর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ
রাজা নির্দেশ দিলেন যাও, এবার ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাঁকে একান্তভাবে নিজের জন্যে নিয়োগ করবো। ইউসুফ জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। রাজা যখন তাঁর সাথে কথা বললেন, তিনি তাঁর অগাধ জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা আর বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্র দেখে অভিভূত হলেন। তিনি বললেন- আপনি এখন আমাদের এখানে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। আপনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। ইউসুফ বললেন- আপনি দেশের অর্থ ভাণ্ডারের দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত করুন। আমি তা যথাযথ সংরক্ষণ করবো। এ ব্যাপারে আমি জ্ঞান রাখি। রাজা তাই করলেন। আর এভাবেই মহান আল্লাহ ইউসুফের জন্যে রাষ্ট্রীয় কৃতিত্বের পথ পরিষ্কার করে দিলেন। তিনি সৎলোকদের প্রতিদান কখনো বিনষ্ট করেন না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পৃথিবীতেও তাঁদের পুরস্কৃত করেন আর পরকালের প্রতিদান তো রয়েছেই। শেষ পর্যন্ত রাজা ইউসুফের সততা, দক্ষতা ও আন্তরিক নিষ্ঠার জন্যে গোটা দেশের শাসনভারই ছেড়ে দেন ইউসুফের উপর এবং নিজে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা এলো মিশরে
হযরত ইউসুফ আ. অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবার পর সাত বছর খুব ফসল হয়। তিনি সুন্দরভাবে ফসল সংরক্ষণ করেন। এরপর আসে পরবর্তী দুর্ভিক্ষের সাত বছর। এ সময় সংরক্ষিত ফসল ভাণ্ডার দিয়ে দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করেন। ফিলিস্তিনের দিকেও দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। মিশরে খাদ্য মজুদ থাকার খবর শুনে বিভিন্ন দেশের লোকেরা খাদ্য শস্যের জন্যে ছুটে আসে মিশরে। ইউসুফের ভাইয়েরাও খাদ্য কেনার জন্যে ছুটে আসে মিশরে। হ্যাঁ, ইউসুফের সেই দশভাই মিশরে এলো। তাঁরা অর্থকড়ি নিয়ে এসেছে খাদ্য শস্য কেনার জন্যে।
তাঁরা এসে অর্থমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলো। ফলে তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ইউসুফের কাছে। তাঁরা ইউসুফকে মোটেও চিনতে পারেনি। কিন্তু ইউসুফ তাঁদের চিনে ফেললেন। তাঁদের সাথে কথাবার্তা বললেন। খোঁজ খবর নিলেন। বললেন, একটি ভাইকে আবার বাড়িতে রেখে এলেন কেন? আবার আসার সময় তাকেও নিয়ে আসবেন। ছোট্টভাইটিকে অর্থাৎ বিনয়ামিনকে দেখার জন্যে ইউসুফের মন ছটফট করছিলো। তিনি তাঁদের বিদায় দেয়ার সময় বলে দিলেন, দেখুন আমি খুবই অতিথি পরায়ন। দেখছেন না আমি কি রকম পাত্র ভরে দিচ্ছি? আপনাদের ছোট ভাইটিকেও নিয়ে আসবেন। ওকে নিয়ে না এলে আপনাদের আর এখানে আসার দরকার নেই। আর আপনাদের খাদ্য শস্য দেয়া হবে না। ইউসুফ এদিকে তাঁর কর্মচারীদের গোপনে বলে দিলেন, ওরা খাদ্য শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে সেগুলো চুপিসারে, তাঁদের শস্যের বস্তায় ঢুকিয়ে ফিরিয়ে দাও। বাড়ি ফিরে এসে তাঁরা তাঁদের পিতাকে বললো- আব্বা, বিনয়ামিনকে নিয়ে না গেলে এরপর আমাদের আর খাদ্যশস্য দেবে না। এবার ওকে আমাদের সাথে দিন। আমরা অবশ্যি তাঁর হিফাজত করবো। বস্তা খোলার পর খাদ্যশস্যের সাথে অর্থকড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে দেখে তাঁরা খুশিতে বাগবাগ হয়ে উঠলো। তাঁরা বলল- আব্বাজান, আমাদের আর কি চাই। এই দেখুন, আমাদের অর্থকড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা আবার যাবো। আমাদের ভাইয়ের হিফাজত করবো। তাঁদের পিতা হযরত ইয়াকুব বললেন- তোমাদের তো বিশ্বাস করা যায় না। আল্লাহই সত্যিকার হিফাজতকারী। আমি ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে তোমাদের সাথে দেব না, যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে ওকে ফিরিয়ে আনার শপথ না করবে। সুতরাং তাঁরা বিনয়ামিনকে ফিরিয়ে আনবে বলে আল্লাহর নামে শপথ করলো। এবার হযরত ইয়াকুব ওকে তাঁদের সাথে দিলেন। আর তাঁদের বলে দিলেন, তাঁরা যেন বিভিন্ন পথে মিশরে প্রবেশ করেন। একত্রে একই পথে যেন না ঢুকে। এরপর তাঁরা মিশরে এলো। ইউসুফের কার্যালয়ে প্রবেশ করলো। ইউসুফ বিনয়ামিনকে একান্তে ডেকে নিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। ওহ, তখন দুই সহোদর ভাইয়ের কী যে আনন্দ, কিন্তু দশভাইকে তাঁরা এটা বুঝতে দেননি। তাঁদের মালপত্র প্রস্তুত করে দেয়া হলো। এ সময় ইউসুফ নিজ ভাইয়ের মালের সাথে একটি সোনার পেয়ালা ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁরা মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলো। কিছুদূর যেতে না যেতেই পিছে থেকে ডাক পড়লো। তাঁদের বলা হলো, তোমরা চোর।
তাঁরা জিজ্ঞেস করলো- কেন, আপনাদের কি হারিয়েছে?
কর্মচারীরা বললো- বাদশাহর পানপাত্র হারিয়েছে। তাঁরা বললো- আল্লাহর কসম আমরা অনাসৃষ্টি করতে আসিনি। আর আমরা চোরও নই।
‘তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমাণ হলে চোরের কি শাস্তি হবে?’
‘যার কাছে পেয়ালা পাওয়া যাবে, আপনারা তাঁকে রেখে দিবেন। আমাদের ওখানে যালিমদের শাস্তির বিধান এটাই।’
এবার তল্লাশি শুরু হলো। প্রথমেই দশভাইয়ের মাল তল্লাশি করা হলো। সবশেষে বিনয়ামিনের মালপত্র থেকে উদ্ধার করা হয় পেয়ালা।
দশভাই বললো- ‘এ যদি চুরি করে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। ইতিপূর্বে তাঁর সহোদর ইউসুফও চুরি করেছিলো।’ ইউসুফ তাঁদের অপবাদ নীরবে হজম করেন। সত্য তাঁদের কাছে এখনো প্রকাশ করলেন না। মনে মনে বললেন- তোমরা বড় বদ। আল্লাহ প্রকৃত সত্য অবগত আছেন। তাঁরা আবদার করলো, বিনয়ামিন ধরা পড়লেও তাঁর পরিবর্তে তাঁদের কোন একজনকে রেখে দিতে। ইউসুফ তা অন্যায় বলে অস্বীকার করলেন। ফলে তাঁরা নিরাশ হয়ে বাইরে গিয়ে ভাবতে থাকে এখন কী করবে?
তাঁদের মধ্যে যে ভাইটি সবচে বড়, সে বললো- তোমাদের কি মনে নেই তোমরা তোমাদের পিতার সাথে কি অংগীকার করে এসেছো? তোমরা বিনয়ামিনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে আল্লাহর নামে অংগীকার করে আসোনি? ইতোপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারেও তোমরা বাড়াবাড়ি করেছো, তাও তোমাদের মনে আছে। এখন আমি এখানেই থেকে যাবো। আল্লাহর কোন ফায়সালা না হলে অথবা বাবা অনুমতি না দিলে আমি এখান থেকে ফিরে যাব না। তোমরা বাবার কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলোগে।
ওরা বাড়ি ফিরে এসে যখন তাঁদের পিতা হযরত ইয়াকুবের কাছে ঘটনা বললো, তখন তিনি বললেন- আমি সবর করবো। মহান আল্লাহ ওদের দুই ভাইকেই আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারেন। তিনি তো সবকিছু জানেন।
এদিকে দুঃখ বেদনায় হযরত ইয়াকুব জর্জরিত হয়ে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে যায়। তিনি ছেলেদের বলেন- যাও, ইউসুফ আর তাঁর ভাইকে অনুসন্ধান করো। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।
ইউসুফ আ. এর সন্ধান লাভ
তাঁরা আবার ফিরে এলো মিশরে। ইউসুফের সাথে দেখা করে বললো- “হে আযীয, আমরা এবং আমাদের পরিবার পরিজন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। সামান্য পুঁজি নিয়ে এসেছি। আপনি দয়া করে পুরো মাত্রায় খাদ্যশস্য দিন। আমাদের দান করুন। আল্লাহ দানকারীদের অবশ্যি প্রতিদান দিয়ে থাকেন।”
ওদের বক্তব্য শুনে ইউসুফ বললেন- “তোমাদের কি মনে নেই তোমরা যখন অজ্ঞ ছিলে তখন ইউসুফ আর তাঁর ভাইয়ের সাথে কি ব্যবহারটা করেছিলে?”
একথা শুনে তাঁরা আঁতকে উঠলো। বললো- “হায়, তুমিই কি ইউসুফ?”
“হ্যাঁ, আমিই ইউসুফ আর এই বিনয়ামিন আমার ভাই। মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। যারাই আল্লাহকে ভয় করবে আর সবর অবলম্বন করবে, আল্লাহ সেই সৎ লোকদের কর্মফল নষ্ট করবেন না।”
ওরা দশভাই বললো- আল্লাহর কসম, আল্লাহ তোমাকে আমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। সত্যিই আমরা বড় অপরাধ করেছি।
ইউসুফ বললো- “আজ আর তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সব দয়ালুর বড় দয়ালু।”
এরপর ইউসুফ তাঁর গায়ের জামা তাঁদের দিয়ে বললেন- এ জামাটি নিয়ে বাড়ি চলে যাও। এটি আমার আব্বাজানের মুখমণ্ডলে রেখো। এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর আমাদের আব্বা আম্মাসহ তোমাদের সমস্ত পরিবার পরিজনকে মিশরে নিয়ে এসো। দশভাই এবার মনের সুখে ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা করলো। এদিকে এরা যাত্রা করেছে আর ওদিকে হযরত ইয়াকুব বাড়ির লোকদের বললেন- আমি ইউসুফের সুবাস পাচ্ছি, তোমরা আমাকে বুড়ো বয়েসের বুদ্ধিভ্রষ্ট বলো না।
ইতোমধ্যে ওরা ইউসুফের সুসংবাদ নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো। ঐ জামাটি হযরত ইয়াকুবের মুখমণ্ডলে স্পর্শ করার সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। আনন্দে খুশিতে হযরত ইয়াকুব আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। ওরা দশভাই বাবার কাছে ক্ষমা চাইলো। বাবাকে ওদের জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বললো। তিনি তাঁদের জন্যে দোয়া করলেন।
হযরত ইয়াকুব আ. এর পরিবারের হিজরত
হযরত ইয়াকুব সবাইকে হিজরতের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন। সহসাই বিরাট পরিবার পরিজনের বহর নিয়ে তাঁরা মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। জানা যায় এ এসময় হযরত ইয়াকুবের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিলো ৬৭ জন। তাঁরা যেদিন মিশরের রাজধানীর কাছে পৌঁছলেন, সেদিন মিশরে ছিলো একটি উৎসবের দিন। উৎসব উপলক্ষে বিপুল সংখ্যক লোক এক জায়গায় একত্রিত হয়। হযরত ইউসুফ সেনাবাহিনী ও জনগণের বিরাট এক শোভাযাত্রাসহ তাঁর পিতা মাতাকে অভ্যর্থনা জানান। ইউসুফের বাবা মা ও পরিবারবর্গের মিশরে আগমনের খবর শুনে জনগনের মাঝে খুশির জোয়ার বয়ে আসে। স্বয়ং মিশরের রাজা ইউসুফকে নির্দেশ দেন, তাঁদের বড় আকারে সংবর্ধনা জানাবার। বাবা মা ও আপনজনদের মিশর আগমনে আজ ইউসুফের মনে যে কী খুশি আর কত যে আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
সত্য হলো হযরত ইউসুফ আ. এর স্বপ্ন
মিসর পৌঁছার সময় নিকটবর্তী হ’লে ইউসুফ (আঃ) ও নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য বিশাল আয়োজন করেন। অতঃপর পিতা-মাতা ও ভাইদের নিয়ে তিনি শাহী মহলে প্রবেশ করেন। অতঃপর তিনি পিতা-মাতাকে তাঁর সিংহাসনে বসালেন। এর পরবর্তী ঘটনা হ’ল শৈশবে দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনন্য দৃশ্য। এ বিষয়ে বর্ণিত কুরআনী ভাষ্য নিম্নরূপ:
‘অতঃপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছল, তখন ইউসুফ পিতা-মাতাকে নিজের কাছে নিল এবং বলল, আল্লাহ চাহেন তো নিঃশংকচিত্তে মিসরে প্রবেশ করুন’। ‘অতঃপর সে তাঁর পিতা-মাতাকে সিংহাসনে বসালো এবং তারা সবাই তার সম্মুখে সিজদাবনত হ’ল। সে বলল, হে পিতা! এটিই হচ্ছে আমার ইতিপূর্বে দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা। আমার পালনকর্তা একে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন। তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা চান, সুক্ষ্ম কৌশলে তা সম্পন্ন করেন। নিশ্চয়ই তিনি বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (ইউসুফ ১২/৯৯-১০০)।
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর পিতা-পুত্রের মিলনের সময় ইউসুফের কথাগুলি লক্ষণীয়। তিনি এখানে ভাইদের দ্বারা অন্ধকূপে নিক্ষেপের কথা এবং পরবর্তীতে যোলায়খার চক্রান্তে কারাগারে নিক্ষেপের কথা চেপে গিয়ে কেবল কারামুক্তি থেকে বক্তব্য শুরু করেছেন। তারপর পিতাকে গ্রাম থেকে শহরে এনে মিলনের কথা ও উন্নত জীবনে পদার্পণের কথা বলেছেন। অতঃপর ভাইদের হিংসা ও চক্রান্তের দোষটি শয়তানের উপরে চাপিয়ে দিয়ে ভাইদেরকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁর ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখা এগারটি তারা এবং সূর্য আর চাঁদ তাঁকে সেজদা করছে তাঁর পিতা-মাতা ও ভাইদের সেজদা করার মাধ্যমে সত্য হল।
তাই তিনি বললেন, “আব্বাজান, আমি যা স্বপ্ন দেখেছিলাম, এ হলো সেই স্বপ্নের মর্ম। আমার প্রভু, আমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি আমার প্রতি বিরাট অনুগ্রহ দেখিয়ে আমাকে কারাগার থেকে বের করে এনেছেন। আপনাদের মরু অঞ্চল থেকে বের করে এনে আমার সাথে মিলিত করেছেন। অথচ শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। আমার প্রভু অতি সূক্ষ্ম কৌশলে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও সুকৌশলী।”(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০০)
সবকিছুতে আল্লাহর অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি উচ্চাঙ্গের বর্ণনা এবং এতে মহানুভব ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
আল্লাহর শোকর আদায়
ইউসুফকে মহান আল্লাহ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন। কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন। নবুয়ত দান করেছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছেন। বিপুল জনপ্রিয়তা দান করেছেন। অবশেষে বাবা মা আর সকল আত্মীয় স্বজনকেও এনে তাঁর সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর কত যে অনুগ্রহ তাঁর উপর। তিনি অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে শোকর আদায় করেন তাঁর মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে, “আমার প্রভু, তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো। কথার মর্ম বুঝতে শিখিয়েছ। হে আসমান যমীনের স্রষ্টা, দুনিয়া এবং আখিরাতে তুমিই আমার অভিভাবক। তোমার অনুগত অবস্থায় আমাকে মৃত্যু দিও আর নেক্কার লোকদের সাথে মিলিত করো।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০১)
হযরত ইউসুফ আ. এর সময়ে মিশর
বিভিন্ন ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে জানা যায়, হযরত ইউসুফ যখন মিশর যান, তখন মিশরে পঞ্চদশতম রাজ পরিবারের শাসন চলছিলো। এ বংশের রাজাদের বলা হতো ‘রাখাল রাজা’ (Hyksos Kings)। এরা মিশরীয় ছিলো না। তাঁরা ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে গিয়ে মিশরের রাজত্ব দখল করে। এ বংশের রাজাদের ‘আমালিক’ রাজাও বলা হয়। এরা বিদেশী হবার কারনে তাঁরা হযরত ইউসুফকে সাদরে গ্রহন করেছিলো। ইয়াকুব আ. এঁর বংশধর বনী ইসরাইলকে দেশের সব চাইতে উর্বর এলাকায় বসতি স্থাপন করতে দিয়েছিলো। হযরত ইয়াকুবের বংশধরদের বনী ইসরাইল বলা হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, রাখাল রাজাদের ‘আপোসিস’ নামক রাজাই ছিলেন হযরত ইউসুফের সময়কার রাজা।
এ রাজা হযরত ইউসুফকে অত্যন্ত সম্মান দান করেন। প্রথমে ইউসুফকে তিনি অর্থমন্ত্রী বানান। পড়ে দেশ শাসনের বিরাট দায়িত্ব ভার ইউসুফের উপর অর্পণ করেন। হযরত ইউসুফ যে বিরাট যোগ্যতা ও অগাধ জ্ঞানের ভিত্তিতে দেশ শাসন করেন রাজা তাতে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত ইয়াকুবের বংশধরেরা অর্থাৎ বনী ইসরাইলের লোকেরা ব্যাপকভাবে ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করে। বিভিন্ন স্তরে তাঁরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআনের একটি সুরাই রয়েছে হযরত ইউসুফের নামে। সুরাটির নাম ‘ইউসুফ’। এটি আল কুরআনের দ্বাদশ সূরা। মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। গোটা সুরায় হযরত ইউসুফের কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে। কুরআন মজিদে এ কাহিনীকে ‘আহাসানুল কাসাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মানে ‘সর্বোত্তম কল্যাণকর কাহিনী’। সত্যিই হযরত ইউসুফের জীবনীতে রয়েছে তরুন ও যুবকদের জন্যে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়। রয়েছে আদর্শ জীবন গড়ার উপাদান। আল কুরআনে হযরত ইউসুফের নাম ২৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে। এঁর মধ্যে ২৫ বারই উল্লেখ হয়েছে সূরা ইউসুফে। তাছাড়া সূরা আনয়ামের ৮৪ ও সূরা আল মুমিনের ৩৪ নম্বর আয়াতে একবার একবার করে উল্লেখ হয়েছে।
হযরত ইউসুফ আ. এর চারিত্রিক আদর্শ
হযরত ইউসুফ আ. এর কাহিনীতে রয়েছে আমাদের জন্যে অনেক শিক্ষা। তাঁর জীবনাদর্শ থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো-
১. তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব ছিলেন আল্লাহর নবী। ফলে ইউসুফ ছোট বেলা থেকেই নবীর অনুসারী হন। নবীর পথে চলেন।
২. তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞান পিপাসু। ফলে আল্লাহ তাঁকে অনেক জ্ঞান দান করেন। কথার মর্ম উপলব্ধি করার যোগ্যতা দেন।
৩. তিনি সব সময় পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। ফলে পিতা মাতাও তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
৪. তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বাসী। যে কেউ তাঁর উপর আস্থা রাখতে পারতো।
৫. তিনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের অধিকারী।
৬. তিনি গোপনে এবং সুযোগ পেয়েও পাপ কাজ করেননি।
৭. তিনি সব সময় আল্লাহকে ভয় করতেন।
৮. তিনি কারা নির্যাতন সয়েছেন, কিন্তু কোন প্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ করতে রাজি হন নি।
৯. তিনি ছিলেন অত্যন্ত আমানতদার। কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি।
১০. তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। কখনো ধৈর্যহারা হননি।
১১. তিনি সুযোগ পেলেই মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন। দাওয়াত দিতেন।
১২. সকল বিষয়ে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করতেন। আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতেন। তাঁর কাছেই ফরিয়াদ করতেন।
১৩. তিনি তাঁর জ্ঞান ও প্রতিভার মাধ্যমে মানুষের উপকার করতেন। তাঁদের সমস্যার সনাধান বলে দিতেন
১৪. যেসব নারী তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলো, সামাজিকভাবে তিনি তাঁদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন।
১৫. তিনি সামাজিকভাবে নিজের নির্দোষ, নিষ্পাপ ও বিশ্বস্ত হবার কথা প্রমান করে দেন।
১৬. তিনি সুযোগ পেয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহন করেন।
১৭. তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে তাঁর উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন।
১৮. ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ভাইদের অপরাধের প্রতিশোধ নেননি।
১৯. সুযোগ পেয়েও প্রতিশোধ গ্রহন না করে ভাইদের ক্ষমা করে দেন।
২০. তিনি পিতামাতা ও ভাইদেরকে সম্মানের সাথে পুনর্বাসিত করেন।
২১. তিনি সকল সৌভাজ্ঞের জন্যে কেবল মহান আল্লাহর শোকর আদায় করেন। তাঁরই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকেন।
২২. তিনি আল্লাহর একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত দাসের মতো অবস্থায় মৃত্যু কামনা করেন।
২৩. পরকালে তিনি নেক লোকদের সাথী হবার জন্যে মহান আল্লাহর কাছে আকুতি জানান।
আসুন, আমরা হযরত ইউসুফ আ. এর এসব মহান আদর্শের অনুসরণ করি। নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি।
।
হযরত শুয়াইব আ.
মহান আল্লাহ আল কুরআনে যেসব সম্মানিত নবীর নাম উল্লেখ করেছেন হযরত শুয়াইব আ. তাঁদেরই একজন। অন্য সকল নবীর মতো তিনিও এই মহা সত্যের প্রতিই মানুষকে আহবান করেছিলেন, “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা কেবল এক আল্লাহর দাসত্ব, আনুগত্য এবং হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই।”
হযরত শুয়াইব আ. এর কওম
কুরআন মজিদে শুয়াইব আ. কে মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন- এই দুটি নাম মূলত একটি গোত্রের দুটি নাম। আবার কেউ কেউ বলেছেন- এ দুটি আসলে দুটি গোত্রেরই নাম। হযরত শুয়াইব আ. এই দুটি কওমের কাছেই নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরগনের মতে, এই দুটি গোত্র ইবরাহীম আ. এর বংশধর। তাঁদের বসবাসও ছিলো পাশাপাশি। কুরআনে বলা হয়েছে এ দুটি জাতি উম্মুক্ত রাজপথে অবস্থান করতো। মাদইয়ানবাসীদের বসবাস ছিলো উত্তর হিজায থেকে ফিলিস্তিনের দক্ষিনাঞ্চল জুড়ে এবং সেখান থেকে সিনাই উপত্যকার শেষ পর্যন্ত আকাবা উপসাগর এবং লোহিত সাগরের তীর জুড়ে। মাদইয়ান ছিলো তাঁদের প্রধান শহর।
বর্তমান তাবুক অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিলো আইকাহ। তাবুকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আইকাবাসীরা বসবাস করতো। মাদইয়ান এবং আইকাবাসীদের মধ্যে বৈবাহিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এ ছাড়া উভয় জাতি একই ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম এবং অন্যায় ও অপরাধে লিপ্ত ছিলো। সে কারণে আল্লাহ তাঁদের উভয় জাতির হেদায়েতের জন্যে একজন ব্যক্তিকেই নবী নিযুক্ত করেন।
হযরত শুয়াইবের জন্ম হয় মাদইয়ান গোত্রে। কুরআন মজিদে মাদইয়ানবাসীদের হযরত শুয়াইবের জাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাঁদেরকে ‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা’ বলে সম্বোধন করতেন।
হযরত শুয়াইব আ. এর সময়কাল
হযরত শুয়াইব আ. যে ঠিক কোন সময়কার নবী ছিলেন, সে কথাটি একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, শুয়াইব আ. হযরত মুসা আ. এর পূর্বেকার নবী ছিলেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত মুসা আ., হযরত শুয়াইব আ. এর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন।
মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের দুরাচার
মাদইয়ান ও আইকাবাসী তাঁদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম আ. এর প্রচারিত দ্বীন ইসলামেরই উত্তরাধিকারী ছিলো। কিন্তু কয়েকশ বছরের ব্যবধানে তাঁরা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলে এবং বাস্তবে ইসলামের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে পড়ে। বিশ্বাস ও চরিত্রের দিক থেকে তাঁরা যেসব অপরাধে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো সেগুলো হলো-
১. তারা আল্লাহর দিনকে বিকৃত করে ফেলেছিলো।
২. তারা আল্লাহর সাথে শিরক করতো। মূর্তি পূজা করতো।
৩. তারা জীবন যাপনের সঠিক পথ থেকে দূরে সরে পড়েছিলো।
৪. তারা মাপে কম দিতো। লেনদেনে হেরফের করতো। মানুষকে ঠকাতো। প্রতারণা করতো।
৫. ডাকাতি ও হাইজ্যাকি ছিলো তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।
৬. এছাড়াও অন্যান্য পাপাচার এবং ধ্বংসাত্মক কাজে তারা লিপ্ত ছিলো।
হযরত শুয়াইব আ. এর সংস্কার আন্দোলন
এই দুটি অধঃপতিত কওমকে সংশোধন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মাদইয়ানের মহান চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী শুয়াইবকে নবী নিযুক্ত করেন। শুয়াইব ছিলেন অত্যন্ত সুভাষী ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি মর্মস্পর্শী দাওয়াত এবং আহ্বানের মাধ্যমে আল্লাহর দিনের প্রচার ও জাতিকে সংশোধনের সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর কর্মধারা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র আল কুরআনে বলেন, “আর আমি মাদইয়ানবাসীদের কাছে তাঁদের ভাই শুয়াইবকে পাঠিয়েছি। সে তাঁদের বলেছিল- হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অপর কোন ইলাহ নাই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। তাই তোমরা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও। মানুষকে তাঁদের দ্রব্য সামগ্রীতে ঠকিও না। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। এতেই তোমাদের জন্যে রয়েছে কল্যাণ। প্রতি পথে ডাকাত হয়ে বসো না। সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না। যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রেখো না এবং সহজ সরল পথকে বাঁকা করার চেষ্টা করো না। চোখ খুলে দেখো অতীতে যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তাঁদের পরিণতি কী হয়েছে? ” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৫-৮৬)
মাদইয়ানবাসীদের মতো আইকাবাসীদেরও সংশোধন করার জন্যে হযরত শুয়াইব আ. আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন, “আইকাবাসীরা রাসুলদের অস্বীকার করে। শুয়াইব যখন তাঁদেরকে বললো- তোমরা কি ভয় করো না? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল, সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো। এই উপদেশ দানের কাজে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। আমাকে পারিশ্রমিক দেয়ার দায়িত্ব তো মহান আল্লাহর। ওজন পূর্ণ করে দাও, মানুষকে তাঁদের মাল কম দিও না, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। সেই মহান স্রষ্টাকে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৭৬-১৮৪)
এভাবে মর্মস্পর্শী ভাষায় হযরত শুয়াইব আ. এই দুইটি জাতিকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর সাথে বিতর্ক ও দ্বন্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হয়। তারা বললো- “হে শুয়াইব তোমার সালাত কি তোমাকে এই শিক্ষাই দেয় যে, আমরা সেই সব মাবুদদের পরিত্যাগ করবো, আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের ইবাদত করতো? আর আমাদের অর্থ সম্পদ ইচ্ছামত ব্যয় করার অধিকার আমাদের থাকবে না? তুমি একজন মহৎ হৃদয়ের বড় সদাচারী ব্যক্তিই রয়ে গেলে।” (সূরা হুদ, আয়াত ৮৭)
তারা আর বললো- “তুমি একজন যাদুগ্রস্থ মানুষ, তুমি তো আমাদের মতই একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কিছুই নও। আমরা তোমাকে পরিষ্কার মিথ্যাবাদী মনে করি। তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে এক টুকরা আকাশ ভেঙ্গে আমাদের উপর ফেলো দেখি।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৮৫-১৮৭)
শুয়াইব বললো- “আমি তো কেবল তোমাদের সংশোধন চাই। আমার সাধ্য অনুযায়ী সংশোধনের এই চেষ্টা আমি করে যাবো। আমার বিরুদ্ধে তোমাদের হঠকারীতা যেন সেই পর্যায়ে না যায়, যার ফলে নূহ, হুদ, ও সালেহ এর জাতির উপর আল্লাহর আযাব এসেছিলো। আর লুত জাতির ধ্বংসের ইতিহাস তো তোমাদের থেকে বেশী আগের নয়। তোমরা আল্লাহর কাছে মাফ চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো। তিনি বড় দয়ালু, বড় বন্ধু সুলভ।” (সূরা হুদ ৮৮-৯০)
এসব কথার জবাবে তারা বলছিলো – “শুয়াইব, তোমার অনেক কথাই আমাদের বুঝে আসে না। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক না থাকলে তোমাকে আমরা পাথর মেরে হত্যা করতাম। আমাদের চাইতে তোমার ক্ষমতা বেশী নয়।”
তাঁদের এসব কথা শুনে শুয়াইব বললেন, “আমার সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক কি আল্লাহর চাইতেও সম্মানিত? তোমরা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের কথা বলছো, অথচ আল্লাহর ব্যাপারে মোটেই তোয়াক্কা করছ না? তোমরা অবশ্যই আল্লাহর বেষ্টনীতে আছো।” তিনি আরো বললেন, “আমার কাজ আমি অবশ্যই করে যাবো, তোমরা অচিরেই জানতে পারবে, কার উপর অপমানকর আযাব আসে আর মিথ্যাবাদীই বা কে? তোমরা অপেক্ষা করো, আমিও অপেক্ষা করছি।”
চরম বিরোধিতার মুখেও একদল যুবক হযরত শুয়াইবের প্রতি ঈমান আনে। চরম নির্যাতনের মুখেও তারা আল্লাহর নবীর সাথে দ্বীনের পথে চলতে থাকে। কিন্তু বিরোধীরা কিছুতেই এদের সহ্য করতে পারে না। তারা অবশেষে হুংকার ছেড়ে ঘোষণা দিলো – “হে শুয়াইব, আমরা তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে দেশ থেকে বের করে দেবো। অথবা তোমাদেরকে আমাদের প্রচলিত ধর্মে ফিরে আসতে হবে।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৮)
তারা জনসভা করে জনগণের মাঝে ঘোষণা করে দিলো – তোমরা যদি শুয়াইবের দলে যোগ দাও তাহলে তোমাদের ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবে না। এ সব হুংকারের জবাবে হযরত শুয়াইব মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন, “ওগো আমাদের প্রভু, আমাদের মাঝে আর আমাদের জাতির মাঝে সঠিক ফায়সালা করে দাও। তুমি তো সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৯)
মাদইয়ান ও আইকাবাসীর ধ্বংস
হযরত শুয়াইবের অনেক চেষ্টা সাধনার পরেও যখন এই দুইটি জাতি আল্লাহর পথে আসল না এবং নবী ও তাঁর সাথীদের উৎখাত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো, তখন আল্লাহ তায়ালা এই উভয় জাতিকে ধংস করে দিলেন। মাদইয়ানবাসীদের ধংস করলেন প্রচণ্ড বজ্রধ্বনি দিয়ে। এমনভাবে তাঁদের বিরান করে দিলেন, যেনো ওখানে কোন দিনই কোন লোক বসবাস করেনি। অপরদিকে আইকাবাসীদের ধ্বংস করে দিলেন ছাতার মতো মেঘমালা পাঠিয়ে। মেঘ থেকে আযাব বর্ষিত হলো আর আইকাবাসীরা সম্পূর্ণভাবে ধংস হয়ে গেলো। কিন্তু মহান আল্লাহ হযরত শুয়াইব এবং তাঁর সাথীদেরকে এসব ধ্বংসের আযাব থেকে রক্ষা করলেন। তাঁদের বাঁচিয়ে রাখলেন এবং এই মুমিনদের ঘরেই জন্ম নিলো পরবর্তী প্রজন্ম।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মজিদে সূরা আরাফ ও সূরা হুদে মাদইয়ানবাসীদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সূরা শোয়ারায় বর্ণিত হয়েছে আইকাবাসীদের ঘটনা। কুরআন মজিদে হযরত শুয়াইবের নাম উল্লেখ হয়েছে ১১ বার। সে আয়াতগুলো হলো – সূরা আরাফঃ ৮৫, ৮৮, ৯০, ৯২। সূরা হুদঃ ৮৫, ৮৭, ৯১, ৯৪। আন কাবুতঃ ৩৬। শোয়ারাঃ ১৭৭।
।
হযরত আইয়ুব আ.
হযরত আইয়ুব আ. এর বংশ পরিচয়
আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত আইয়ুব আ. এর কথা পবিত্র কুরআন শরীফের চারটি স্থানে উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলো সূরা আন নিসার ১৬৩ নম্বর আয়াত, সূরা আল আনয়ামের ৮৪ নম্বর আয়াত, সূরা আল আম্বিয়ার ৬৩-৬৪ নম্বর আয়াত এবং সূরা সোয়াদের ৪১-৪৪ নম্বর আয়াত। হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন নবী। কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন মিশরীয়। তবে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতকে অনেকে সঠিক বলেছেন। তাঁর মতে, হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় হলো হযরত ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাক, হযরত ইসহাকের পুত্র ঈশু, ঈশুর পুত্র আমুশ, আমুশের পুত্র আইয়ুব। হযরত আইয়ুব আ. খ্রিষ্টপূর্ব নবম বা দশম শতকের লোক ছিলেন।
ধনী হযরত আইয়ুব আ.
হযরত আইয়ুব আ. বিশাল ধনী ছিলেন । তাঁর অগাধ ধন সম্পদ ছিল। তিনি ছিলেন অনেক অনেক ভূমি ও বাগ বাগিচার মালিক। তাঁর ছিল অগাধ অর্থকড়ি। ছিল অনেক সন্তান সন্তুতি। ছিল সুস্বাস্থ্য। কিন্তু এতো বড় ধনী হলে কি হবে, এ জন্যে তাঁর ছিল না কোন গর্ব, ছিল না কোন অহংকার। তিনি এগুলোকে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে করতেন। আল্লাহ তাঁকে এত ধনসম্পদ দিয়েছেন বলে তিনি সব সময় আল্লাহর শোকর আদায় করতেন, আল্লাহর কৃতজ্ঞ হয়ে থাকতেন।
কঠিন পরীক্ষা
কিন্তু আল্লাহর নিয়ম হলো, তিনি মানুষকে দিয়েও পরীক্ষা করেন, নিয়েও পরীক্ষা করেন। আর যেসব মানুষ আল্লাহর বেশী প্রিয়, তিনি তাঁদের অনেক বড় পরীক্ষা নেন। হযরত আইয়ুব আ. ছিলেন আল্লাহর একজন অতিপ্রিয় দাস ও নবী। তিনি যেমন তাকে ভালবাসতেন, তেমন কঠিন পরীক্ষাও তাঁর উপর চাপিয়ে দেন। হযরত আইয়ুব আ. চারটি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন –
১. তাঁর সমস্ত ধন সম্পদ জমাজমি নষ্ট হয়ে যায়।
২. তাঁর সারা শরীরে কঠিন যন্ত্রনাদায়ক এক রোগ দেখা দেয়। বছরের পর বছর কাটে কিন্তু তাঁর রোগ ভালো হয়না।
৩. তাঁর স্ত্রী ছাড়া সকল আপনজন তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যান। তিনি সম্পূর্ণ নিঃসহায় হয়ে পড়েন।
৪. এ অবস্থায় আল্লাহর প্রতি বিমুখ হওয়ার জন্যে শয়তান তাঁকে অনবরত প্ররোচনা দিতে থাকে।
এতো বড় পরীক্ষায় পড়েও হযরত আইয়ুব আ. সবর অবলম্বন করেন, ধৈর্য ধারণ করেন। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করেন। তিনি সুসময়ে যেমন তাঁর প্রভুর কৃতজ্ঞ ছিলেন, দুঃসময়েও ঠিক তেমনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত দুঃখ কষ্টের জন্যে কেবল মহান আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করতেন। কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চাইতেন। তিনি বলতেন, “প্রভু, আমি বড় কষ্টে আছি। আর তুমি তো সব দয়ালুর বড় দয়ালু। প্রভু, শয়তান আমাকে বড় কষ্ট ও যন্ত্রণা দিচ্ছে, তুমিতো আমার অবস্থা দেখছো।”
হযরত প্রায় সতের আঠারো বছর এই কঠিন রোগ ও অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। তিনি তাঁকে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে বলেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪২)। হযরত আইয়ুব তাই করলেন। কী আশ্চর্য, পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার সাথে সাথেই সেখান থেকে স্বচ্ছ পানির একটা ঝর্নাধারা প্রবাহিত হলো। আল্লাহ তাঁকে এ পানি পান করতে এবং এ পানি দিয়ে গোসল করতে বলেন। তিনি তাই করলেন। এর ফলে আল্লাহর দয়ায় তাঁর রোগ ভালো হয়ে গেলো।
বিবি রাহমা
রাহমা নামে হযরত আইয়ুবের একজন স্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহভীরু, সতী এবং স্বামী পরায়না। দীর্ঘ রোগের কারণে আপনজন সবাই হযরত আইয়ুবকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাঁর স্ত্রী রাহমা তাঁকে ছেড়ে যাননি। বছরের পর বছর ধরে তিনি স্বামীর সেবা যত্ন করেন। অসাধারণ ধৈর্যগুণ থাকলেই কোন নারী এতো বছর ধরে কঠিন রোগেও স্বামীর সেবা করে যেতে পারেন। শয়তান হযরত আইয়ুবকে সরাসরি কোন ধোঁকা দিতে না পেরে রাহমার কাছে এলো। সে রাহমাকে এই বলে প্ররোচনা দিতে থাকে, তুমি আর কতকাল সহ্য করবে? দিনের পর দিন শয়তান তাঁকে এভাবে অসঅসা দিতে থাকে। তাঁকে প্ররোচিত করতে থাকে। অবশেষে একদিন এসে তিনি স্বামীকে বললেন – এভাবে আর কতকাল পরীক্ষা চলবে? আর কতকাল বিপদ মুসিবত সইয়ে যাবো?
একথায় হযরত আইয়ুব অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ণ হলেন। তিনি স্ত্রীকে বললেন – যতদিন দুঃখ কষ্টের মধ্যে আছো, তাঁর চেয়ে বেশী দিন কি সুখের মধ্যে কাটাওনি? যতোদিন আমি সুখে ছিলাম ততোদিন দুঃখ ভোগের আগে এ অবস্থা দূর করে দেয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে আবদার করতে আমার লজ্জা হয়। হযরত আইয়ুব স্ত্রী রাহমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর মুখে যখন অধৈর্যের কথা শুনলেন এটাকে তিনি আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা মনে করলেন এবং অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। রাগের মাথায় তিনি কসম খেয়ে বললেন, এ অধৈর্যের জন্যে আমি তোমাকে একশত বেত্রাঘাত করবো। রাগ স্তিমিত হলে তিনি পেরেশান হয়ে উঠলেন, যদি কসম বাস্তবায়ন করি তাহলে তো একজন নিরপরাধকে শাস্তি দেয়া হয়। আর যদি কসম বাস্তবায়ন না করি তাহলে তো গুনাহগার হতে হয়। এর সমাধান চেয়ে তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন। তিনি যতগুলো বেত্রাঘাত করার অংগীকার করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ততগুলো শলা দিয়ে একটি আটি বানাতে বললেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)
আর সেই আটি দিয়ে বিবি রাহমাকে একটি মৃদু আঘাত করতে বললেন। ব্যাস, তিনি তাই করলেন। তাঁর অংগীকার পূর্ণ হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ তাঁদের দুজনের চিন্তা দূর করে দিলেন এবং তাঁদেরকে নিজের রহমত দ্বারা সিক্ত করলেন।
ফিরে এলো সুখের দিন
এবার হযরত আইয়ুব আ. এর সুখের দিন ফিরে এলো। আল্লাহ তাঁকে রোগ ভালো করে দিলেন। আবার প্রচুর ধন সম্পদ দান করলেন। তাঁর সন্তান ও আত্মীয় স্বজনরা ফিরে এলো তাঁর কাছে। তিনি সুস্থ শরীরে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে লাগলেন। বহু দুঃখ কষ্টের পর বিবি রাহমার জীবনে আবার সুখের দিন ফিরে এলো।
আল কুরআনে তাঁর প্রশংসা
মহান আল্লাহ কুরআন মজিদে হযরত আইয়ুব আ. এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন-
১. আমি আইয়ুবকে পেয়েছি পরম ধৈর্যশীল। সে ছিলো আমার এক উত্তম গোলাম, ছিলো আল্লাহমুখী। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)
২. আইয়ুবের ব্যাপারটি ছিলো বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)
৩. আইয়ুবের ঘটনা ইবাদতকারীদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৪)
৪. হে মুহাম্মাদ, আমি তোমার কাছে অহী পাঠাচ্ছি ঠিক সেভাবে, যেভাবে পাঠিয়েছিলাম নুহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে- ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন এবং সুলাইমানের কাছে। (সূরা আন নিসা, আয়াত ১৬৩)
শিক্ষণীয় বিষয়
বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে যে হযরত আইয়ুবের জীবন চরিত থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে, তাতো মহান আল্লাহ পাকই পবিত্র কুরআনে বলেছেন। সত্যি তাই। আসুন দেখি, আমরা তাঁর জীবন চরিত থেকে আমরা কি কি শিক্ষা পাই।
১. প্রাচুর্যের সময় আত্মহারা হয়ে আল্লাহকে ভুলে যেতে নেই।
২. ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি, মান ইজ্জত এই সবকে আল্লাহর দান মনে করা উচিত এবং এগুলোর জন্যে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত।
৩, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট ও বিপদে মুসিবতে ধৈর্যহারা হতে নেই। বরং ধৈর্যের সাথে আল্লাহর উপর আশা ভরসা করে থাকা উচিত।
৪, বিপদ মুসিবত, দুঃখ কষ্ট রোগ শোক ও অসহায় অবস্থায় শয়তান মুমিনদের সাথে প্রতারণা করার সুযোগ নেয়। তাই এসব অবস্থায় শয়তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে থাকতে হবে।
৫, সুখের সময় আল্লাহর শোকর আদায় করা এবং দুঃখের সময় সবর অবলম্বন করা নবীদের আদর্শ।
৬, রাগ বশত কোন ভুল করে ফেললে সেজন্যে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
৭, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট, বিপদ মুসিবতে একজন মুমিন স্ত্রীর কোনো অবস্থাতেই স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়। বরং পরম ধৈর্য ও সবরের সাথে স্বামীর সেবা করা উচিত।