মনীষীগণের উদ্ধৃতি
আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য ইলমে তাসাউফ যে ফরজ, এ প্রসঙ্গে আফজালুল মুফাসসিরীন আল্লামা হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহ:) তাঁর ‘তাফসীরে রুহুল বয়ানে’ উল্লেখ করেন যে, দ্বিতীয় প্রকার ইলম হচ্ছে ইলমে তাছাউফ যা ক্বলব বা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য ফরজ।
এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ হওয়া সম্পর্কে ‘জামিউল উসুল’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, এলমে তাছাউফ বদ খাছলত-সমূহ হতে নাজাত বা মুক্তি পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। পক্ষান্তরে, আল্লাহ-প্রাপ্তি, রিপু বিনাশ ও সংযম শিক্ষার একমাত্র পথও। এই জন্য ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরজে আইন।
সূফীকুল শিরোমনি আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী (রহ:) বলেন –
‘ইলমে জাহের হাম চুঁ মসকা, ইলমে বাতেন হাম চুঁ শীর
কায় বুয়াদে বে শীরে মসকা, কায় বুয়াদে বেপীরে পীর’।
অর্থাৎ, ইলমে জাহের জানো দুধের মেছাল (উপমা), আর বাতেন জানো মাখনের মেছাল, দুধ ছাড়া মাখন কীভাবে হয় আর পীরের আনুগত্য ছাড়া পীর কীভাবে হয়। (মসনবী শরীফ)
পীর মাশায়েখগণের মধ্যে বাইয়া’ত করার যে প্রথা প্রচলিত তার সারমর্ম হলো জাহেরী ও বাতেনী আমলের ওপর দৃঢ়তা অবলম্বন করা এবং গুরুত্ব প্রদান করার অঙ্গীকার করা। তাঁদের পরিভাষায় একে বাইয়া’তে তরীকত, অর্থাৎ, তরীকতের কাজ বা আমল করার অঙ্গীকার করা। কেউ কেউ এ বাইয়া’তকে অস্বীকার করে থাকেন। কারণ হিসেবে বলেন যে হুজুর পাক (দ:) হতে তা বর্ণিত নেই। তখন শুধু কাফেরদেরকে ইসলামের বাইয়া’ত করার দরকার ছিল। কিন্তু উল্লেখিত হাদীছ শরীফে এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান। তাই অনেক ইমাম মুজতাহিদ আলেমগণ বলেছেন- من ليس له شيخ فشيخه الشيطان ‘মান লায়ছা লাহু শায়খুন ফা-শায়েখুহুশ শয়তানুন’ ( জুনায়েদ বাগদাদী রহ:)। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কোনো হাক্কানী পীর বা শায়েখের বাইয়া’ত গ্রহণ করেনি, তার শায়খ বা ওস্তাদ হয় শয়তান। শয়তান-ই তাকে গোমরাহ বা বিভ্রান্ত করে দেয়। কাজেই গোমরাহী থেকে বাঁচা যেহেতু ফরজ, সেহেতু পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ। আর ঠিক এ কথাটি বলেছেন আমাদের হানাফী মজহাবের ইমাম, ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ:)। তিনি বলেন, “লাওলা ছানাতানি লাহালাকান নোমান”। অর্থাৎ, “আমি নোমান বিন ছাবিত যদি দু’টি বছর না পেতাম তবে হালাক হয়ে যেতাম”। অর্থাৎ, যদি আমি আমার পীর সাহেব ইমাম জাফর সাদেক (রা:)-এর কাছে বাইয়া’ত হয়ে দু’টি বছর অতিবাহিত না করতাম, তবে আত্মশুদ্ধি লাভ না করার কারণে গোমরাহ ও হালাক (ধ্বংস) হয়ে যেতাম।
আর বিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও আলেমকুল শিরোমণি বিশিষ্ট সুফি সাধক হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহ:) বলেন –
“মাওলানা রুম হারগেজ কামেল নাশুদ; তা গোলামে শামছে তিবরীজ নাশুদ”
অর্থাৎ, আমি মাওলানা রুমী ততোক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ-ওয়ালা হতে পারিনি যতোক্ষণ পর্যন্ত আমার পীর হযরত শামছে তাবরীজ (রহ:)-এর কাছে বাইয়া’ত হয়ে এলমে তাছাউফ আমল করে এখলাছ হাছিল না করেছি। অর্থাৎ, এলমে তাছাউফ আমলের মাধ্যমে এখলাছ অর্জন করার পরই আমি হাকীকি মু’মিন হতে পেরেছিলাম (মসনবী)।
তাই কাদেরীয়া তরীকার ইমাম হযরত গাউছুল আযম মাহবুবে ছোবহানী কুতুবে রব্বানী গাউছে সামদানী শায়খ মহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জীলানী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কেতাব “সিররুল আসরার”-এর ৫ম অধ্যায়ে তওবার বয়ানে লিখেছেন, ক্বলব বা অন্তরকে জীবিত বা যাবতীয় কু-রিপু হতে পবিত্র করার জন্য আহলে তালকীন তথা পীরে কামেল গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। কারণ তাওহীদের রত্ন (বীজ) কোনো যোগ্য মুর্শিদের অন্তর থেকে গ্রহণ করতে হবে।
হাদীস শরীফে যে এলেম অর্জন করা ফরজ বলা হয়েছে তা দ্বারা এলমে মারেফাত ও কোরবতকেই বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও অন্যান্য সর্বজনমান্য ও সর্বজনস্বীকৃত ইমাম-মুজতাহিদ ও আওলিয়া ই-কিরামগণ (রহ:) পীর-মাশায়েখের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতওয়া দিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহ:) তাঁর “এহইয়াউ উলুমুদ্দীন ও কিমিয়া সায়াদাত” কিতাবে, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি আজমেরী (রহ:)-এর মালফুজাত “আনিসুল আরওয়াহ” কিতাবে, ইমামুশ শরীয়াত ওয়াত তরীকত শায়খ আবুল কাশেম কুশাইরী (রহ:) “রিছালায়ে কুশাইরিয়া” কিতাবে, হযরত মাওলানা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (রহ:) “মালাবুদ্দা মিনহু ও এরশাদুত্তালেবীন” কিতাবে, শাহ আব্দুল আজিজ মহাদ্দিস দেহলভী (রহ:) “তাফসীরে আজিজ” শীর্ষক কিতাবে, আল্লামা শামী (রহ:) “রদ্দুল মোখতার” কিতাবে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ:) তাঁর “তাফসীরে কবীর” কিতাবে, কাইয়্যুমে আউয়াল আফজালুল আউলিয়া হযরত ইমাম মোজাদ্দেদে আলফে ছানী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত আল-“মাকতুবাত শরীফে”, হযরত ইমাম আহমদ রেফায়ী (রহ:) তাঁর “বুনইয়ানুল মুআইয়্যাদ” কিতাবে, হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহ:) “তাফসীরে রুহুল বয়ানে” সরাসরি পীর গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতুয়া দিয়েছেন।
এলমে তাছাউফ ছাড়া ইলমে শরীয়তের ওপর যথাযথ আমল করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সুতরাং এলমে মারেফত চর্চা করা সকলের জন্যই ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। আর এই এলেমে তাছাউফ পারদর্শী মুর্শিদে কামেল-এর সোহবত ও তা’লীম ব্যতিরেকে অর্জন করা কখনও সম্ভব নয়।
পীর-মুর্শিদগণই হচ্ছেন হাকীকি আলেম। কেননা, পীর-মুর্শিদগণই এলমে শরীয়ত ও মারেফত, এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। আর উক্ত উভয় প্রকারের এলমের অধিকারীগণই হচ্ছেন হাদীছ শরীফের ঘোষণা অনুযায়ী- العلماء ورثة الانبياء প্রকৃত আলেম বা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া। যেমন এ প্রসঙ্গে ইমামে রব্বানী মাহবুবে সুবহানী কাইয়ূমে আওয়াল সুলতানুল মাশায়েখ হযরত মোজাদ্দেদ আলফে ছানি (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কিতাব ’মকতুবাত শরীফে’ উল্লেখ করেন, আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিছ। এ হাদীস শরীফে বর্ণিত আলেম তারাই যাঁরা নবীগণের রেখে যাওয়া এলমে শরীয়ত ও এলমে মারিফত এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। অর্থাৎ, তিনি-ই প্রকৃত ওয়ারিছ বা স্বত্বাধিকারী। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র এক প্রকারের এলমের অধিকারী, সে নবীগণের প্রকৃত ওয়ারিশ নয়। কেননা, পরিত্যক্ত সম্পত্তির সকল ক্ষেত্রে অংশিদারী হওয়াকেই ওয়ারিছ বলে। আর যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোনো নির্দিষ্ট অংশের অধিকারী হয়, তাকে ’গরীম’ বলে। অর্থাৎ, সে ওয়ারিছ নয়, গরীমের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, যারা পীর-মাশায়েখ নয়, অর্থাৎ, শুধু এলমে শরীয়তের অধিকারী ও এলমে তাছাউফ-শূন্য, তারা প্রকৃত আলেম নয়।
অতএব, হক্কানী পীর-মাশায়েখগণই হচ্ছেন প্রকৃত বা খাঁটি আলেমে দ্বীন। ক্বলব জারি করতে হলে তাঁদের কাছে যেতে হবে। যে ব্যক্তি কোনো পীর-মাশায়েখের কাছে বাইয়া’ত হয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ করে খিলাফত প্রাপ্ত হয়নি, তার কাছে বাইয়া’ত হওয়া অনুচিত।