চাঁদের হিসাব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম

বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় সরকারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহ স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখার নীতি অনুসরণ করে। কিন্তু এদেশের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক দরবার এবং কিছু প্রগতিশীল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখার পরিবর্তে বিশ্বে প্রথম চাঁদ দেখে হিজরি সন গণনার পক্ষপাতি। তাই তারা সরকারের ঘোষণার সাথে একাত্ম না হয়ে বহিঃবিশ্ব থেকে চাঁদ দেখার সংবাদ সংগ্রহের মাধ্যমে ইসলামী পর্বসমূহ উদযাপন করে থাকে।
দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ প্রায় ১৩০ বছর পূর্ব থেকে স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখে গণনা শুরু করার পরিবর্তে চাঁদের অবস্থান ও আকৃতির উপর নির্ভর করে হিসাব গণনা এবং সে অনুসারে ইবাদত-বন্দেগী পালন করতেন। তাঁর অনুসৃত রীতি দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে দীর্ঘ দিন পালিত হয়ে আসছে। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর কনিষ্ঠ পৌত্র আলহাজ্জ্ব খাজা শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন আহমদীনূরী মা.জি.আ. দেশের সমমনা আলেম-উলামা ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে আন্তর্জাতিক চাঁদ দেখা কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কেননা দেশের জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখার মাধ্যমে হিসাব গণনা করায় তা সঠিক হয় না। নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ডে চাঁদ দেখা কুরআন-হাদিসের বাণীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না, বরং বিশ্বের যে কোন দেশে দেখা গেলে তা সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য, এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সঠিক পদ্ধতিতে হিসাব রাখবেন এবং বিশ্বের যে কোন দেশে চাঁদ দেখা যাক না কেন সে সংবাদ সংগ্রহের মাধ্যমে সকলকে জানাবেন এবং ইবাদত-বন্দেগী পালন করবেন। তাই আমাদের ফোরামের নামকরণ করেন ‘আন্তর্জাতিক চাঁদ দেখা কমিটি’।
এই প্রেক্ষাপটে সমমনা আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ এবং দেশের বরেণ্য ব্যক্তিগণকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক চাঁদ দেখা কমিটি। এই কমিটির উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবে ২০০০ সালের ২৪ শে নভেম্বর একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়। উক্ত সেমিনারে মুফতি ড. মাওলানা এ.কে.এম. মাহবুবুর রহমান “কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকাহের দৃষ্টিতে সমগ্র বিশ্বে একই দিনে চাঁদ দেখা ও ইসলামী পর্ব সমূহ উদযাপন” বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। উক্ত সেমিনারে দেশের প্রখ্যাত আলেম, জ্ঞানী-গুণীজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ একমত হন যে, সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মাঝে মাত্র তিন ঘণ্টা ব্যবধানের কারণে এক দিন বা দুই দিন পরে রোজা রাখা ও ঈদ করা এবং টেলিভিশনে প্রচারিত হজ্বে¡র দৃশ্য স্বচোক্ষে দেখা সত্ত্বেও পরবর্তী দিনে কুরবানী ঈদ পালন না করা বাঞ্ছনীয় নয়।
তাই আন্তর্জাতিক চাঁদ দেখা কমিটি সূচনা লগ্ন থেকে বিশ্বে প্রথম চাঁদ দেখার সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ এবং সে মোতাবেক চাঁদ কেন্দ্রিক ইবাদত উদযাপন করার জন্য দেশবাসীকে নির্দেশনা দিয়ে আসছে। দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, চট্টগ্রাম মির্জাখিল দরবার শরীফ, মদিনা জামাত, সাভার, নূরপুর ও গাজীপুর খানকা, সাদ্রা দরবার শরীফের ভক্ত-অনুসারী এবং চাঁদপুর সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় এক কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান একই দিনে, বারে ও তারিখে চাঁদ কেন্দ্রিক ইবাদত করে আসছে।

চাঁদের সঠিক হিসাব প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান চিরস্মরণীয়

যুগে যুগে বহু সাধারণ মানুষ এবং আধ্যাত্মিক পুরুষগণ ব্যক্তি জীবনে চাঁদের সঠিক হিসাব অনুসরণের পাশাপাশি তা সমাজে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলিয়ে কামেল শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী ও জ্যেষ্ঠ পুত্র হাদিয়ে জামান হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ ওরফে আবদুল হাই রাঃ আজীবন চাঁদের সঠিক হিসাব পালন ও প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের ন্যায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় তাঁরা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ প্রদর্শন করতে সক্ষম হননি। বর্তমানে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলেই এ আন্দোলন জোরদার করা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমান সময়ের এ আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক প্রফেসর মরহুম আ.ন.ম. আবদুল মান্নান খান। তিনি এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। অন্য যারা এখনও এ আন্দোলন সংগ্রাম করছেন তাঁদের সকলের নাম দিতে গেলে বৃহৎ পরিসরের প্রয়োজন হবে। কারো নাম বাদ পড়লে তিনি মনে কষ্ট পেতে পারেন। তাই অন্য কারো নাম উল্লেখ না করে শুধু যারা চাঁদের সঠিক হিসাব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেছেন তাদের নাম উল্লেখ করা হল :

ক্রমিক

লেখকের নাম                    

   গ্রন্থ 

প্রকাশ কাল
১. ড. মুফতি মাওলানা আবদুল্লাহ আল মারুফ আল হেলাল ১৯৮৮
২. হাফেজ এ. আই. এম. লোকমান চান্দ্রমাস ও ইসলামী উম্মাহ ১৯৯২
৩. আলহাজ্ব জাকারিয়া আল মাদানী, সাদ্রা দরবার শরীফ রোজা/ঈদ সমস্যা ও সমাধান ১৯৯৩
৪. মোঃ শফিউল্লাহ নিজামী বিশ্বনবীর ফরমান, রোজা/ঈদ একই দিন ১৯৯৬
৫. মুফতি মাওলানা নেছার আহমদ খান ইসলামে শরীয়তের ফতোয়া ১৯৯৬
৬. মুফতি মাওলানা ড. এ.কে.এম. মাহবুবুর রহমান কুরআন সুন্নাহ ও মনীষীগণের দৃষ্টিতে পবিত্র শবে বারাআত শবে কদর ও রমযানুল মোবারক ১৯৯৭
৭. প্রকৌশলী আজিজুল হক চাঁদ দেখা ও বিজ্ঞান ২০০০
৮. মুফতি আবু বকর মোহাম্মদ ইসমাঈল চৌধুরী নতুন চাঁদ দেখা ২০০১
৯. মোঃ ফখরুল ইসলাম একই দিনে রোজা/ঈদ ২০০৩
১০. মোঃ সিরাজুল ইসলাম তালুকদার বর্ষ বিভ্রাটে মুসলিম ২০০৪
১১. অধ্যক্ষ মাওলানা কামাল উদ্দিন খান চাঁদ দেখা ও হানাফী মাজহাব ২০০৫
১২. চান্দ্র মাস এবং Lunar Month ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ এনামুল হক ২০০৬
১৩. মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম হানাফী মাজহাবের বিধান ২০০৬
১৪. ইমাম উদ্দিন আবদুল ওয়াহাব পৃথিবীতে একই দিনে করি ঈদ ২০০৭
১৫. মেজর মীর হোসেন চৌধুরী (অবঃ) হিজরি ক্যালেন্ডার বনাম হেলাল কমিটি ২০০৮
১৬. ইউসুফ ইয়াসিন সিয়াম, কদর, ঈদ ইত্যাদি ২০০৮
১৭. মোঃ আব্দুর রশিদ মত বিরোধ নিরসন ২০০৮
১৮. প্রভাষক মুফতি এনামুল হক আল মাদানী সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ঈদ ২০০৮
১৯. কামাল আহমদ নতুন চাঁদের বিধান ২০০৮
২০. ডা. জুন্নুন চৌধুরী, এম.বি. (নিউইয়র্ক) হিজরি সনের হিসাব ২০০৯
২১. পীরজাদা মুহাম্মদ নাছির বিল্লাহ রব্বানী ইসলামী শরীয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত সর্বপ্রথম চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা কর্তব্য ২০০৯
২২. শাইখুল হাদিস জসীম উদ্দীন রহমানী সাওম ও ঈদ ২০১৩
২৩. আলহাজ্ব আব্দুল মাওফিক চৌধুরী, পীর সাহেব মৌলভীবাজার ইসলামীক বর্ষ পুঞ্জিকা ২০১৩
২৪. আলহাজ্জ্ব খাজা শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন আহমদীনূরী, দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফ, নড়িয়া, শরীয়তপুর নতুন চাঁদ উদয়ে রোজা ও ঈদ উদযাপন ২০১৩