পর্ব-১

অলি আউলিয়াগণের জীবন থেকে শিক্ষা

.

হযরত হাসান বসরী রাঃ

হযরত ফুযাইল ইবনে আয়ায রাঃ

হযরত ইবরাহিম ইবনে আদহাম রাঃ

হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ

হযরত খাজায়ে খাজেগান মঈন উদ্দীন হাসান চিশত সানজরী রহ.

কুতুবুল আকতাব খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ

হযরত শায়খ ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ

সুলতানুল আউলিয়া মাহবুবে এলাহী হযরত শায়খ নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ

হযরত হাসান বসরী রাঃ

হযরত হাসান বসরী রাঃ হযরত ওমর ফারুক রাঃ এর খেলাফতকালে হিজরি ১১ সনে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় বসরায় অতিবাহিত হয়েছিল বলে তাঁকে বসরী বলা হয়। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ আলেম এবং অতিশয় পরহেজগার ও খোদাভীরু। তাঁর পিতার নাম ছিল মুসা রাঈ, তিনি বসরা এবং ওয়াসেতের মধ্যবর্তী সায়লাসান নামক স্থানে বসবাস করতেন এবং যায়েদ ইবনে ছাবেত আনসারী রাঃ এর আযাদকৃত গোলাম ছিলেন। তিনি হিজরি ১২ সনে সিদ্দিকে আকবর হযরত আবু বকর রাঃ এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর মাতা ছিলেন উম্মুল মোমেনীন হযরত উম্মে সালামা রাঃ এর বাদী। শৈশবে হযরত হাসান বসরীর মাতা যখন কাজে রত থাকতেন এবং ক্ষুধার জ্বালায় তিনি কাঁদতে আরম্ভ করতেন তখন হযরত উম্মে সালামা রাঃ তাঁকে নিজের স্তন চুষিয়ে সান্ত্বনা দিতেন। হযরত উম্মে সালামার স্তন হতে যে পরিমাণ দুধের ফোঁটা তাঁর মুখে আসত, সে পরিমাণ বরকত আল্লাহ তায়ালা তাঁর মধ্যে প্রকাশ করতেন। বলা বাহুল্য, এটা হুজুর সাঃ এর সোহবতের ফল।
হযরত হাসান রাঃ এর জন্মের পর হযরত ওমর রাঃ এর কাছে হাজির করা হলে তিনি বললেন, এ বালকের নাম হাসান রাখ, কেননা তাঁর মুখমণ্ডল অপূর্ব সুন্দর। সে জন্যই তাঁর নাম রাখা হয় হাসান। হযরত উম্মে সালামাও শৈশবে তাঁকে অতি যতেœর সাথে প্রতিপালন করেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করেন, ইয়া আল্লাহ ! তাঁকে তুমি ইমাম করিও, যাতে সারা জগতের মানুষ তাঁর একতেদা অনুসরণ করে।
হযরত হাসান রাঃ ১৩০ জন সাহাবীর সঙ্গ লাভ করেন। হযরত আলী রাঃ তাঁকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। হাসান তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন এবং তাঁর পবিত্র হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তিনি হযরত ইমাম হাসান রাঃ হতেও হাদিস, তাফসীর শিক্ষা গ্রহণ করেন।
হযরত হাসান বসরীর আধ্যাত্মিক জীবনের প্রারম্ভ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি মণি মানিক্যের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা উপলক্ষে একবার তিনি রোম শহরে গমন করেন। জনৈক রোমীয় উজিরের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। এক দিন তিনি উজিরের অনুরোধে ঘোড়ায় চড়ে তার সাথে শহরের বাইরে কোন এক স্থানে গমন করেন। সেখানে মণি-মানিক্য খচিত, সুসজ্জিত ও সুবৃহৎ একটি রেশমী তাঁবু দেখতে পান। একদল সুসজ্জিত সৈন্য উক্ত তাঁবু প্রদক্ষিণ করে তাঁদের ভাষায় কিছু বলতে বলতে চলে গেল। এর পরক্ষণেই আনুমানিক চারশ’ দার্শনিক পণ্ডিত এসে পূর্ববৎ তাঁবু প্রদক্ষিণ করলেন এবং নিজেদের ভাষায় কি যেন বলতে বলতে চলে গেলেন। তার পরপরই আবার প্রায় দুই শতাধিক সুন্দরী যুবতী প্রত্যেকে বহু মূল্যবান মণি-মানিক্যের থালা মাথায় করে তাঁবু প্রদক্ষিণ করল এবং কিছু একটা বলতে বলতে চলে গেল। তৎপর বুযুর্গানে দ্বীন তাঁবুতে এসে প্রবেশ করলেন এবং কিছু বলাবলি করতে করতে বের হয়ে চলে গেলেন। সর্বশেষে স্বয়ং রোম সম্রাট এবং তাঁর উজির তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং অল্পক্ষণ পরেই বের হয়ে আসলেন। হযরত হাসান রাঃ বলেন, এরূপ দৃশ্য দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। আমি উজিরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি? উজির বলতে আরম্ভ করলেন, বাদশাহর পরম সুন্দর এক পুত্র ছিল, তিনি ছিলেন সুবিজ্ঞ আলেম এবং অসীম সাহসী বীরপুরুষ। বাদশাহ তাঁর প্রতি নিরতিশয় স্নেহবান ছিলেন। হঠাৎ তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেক বিশেষজ্ঞ বিকিৎসকও চিকিৎসা করে তাঁকে আরোগ্য করেেত ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান। এ তাঁবুতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। সম্রাট বছরে একবার মহাড়ম্বরে তাঁর কবর জিয়ারত করতে আসেন। আজ ছিল সে দিন।
উজির আরো বললেন, প্রথমে যে সৈন্য বাহিনী এসে তাঁবু প্রদক্ষিণ করেছে, তারা বলেছে, হে রাজকুমার, আপনার যে অবস্থা ঘটেছে, আমাদের রণকৌশল ও বহুবলে যদি তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হত তবে আমরা প্রাণপণ যুদ্ধ করে আপনাকে তা থেকে মুক্ত করতাম। কিন্তু এমনটি যিনি ঘটিয়েছেন তাঁর কাজে বাধা দেয়ার শক্তি আমাদের নেই। এমনি করে মহিয়ান প্রভুর শক্তির কাছে সবাই নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করল। একইভাবে সবশেষে উজিরসহ সম্রাট বলে গেলেন, হে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র, এ ক্ষেত্রে তোমার পিতার হাতে কোন শক্তি নেই। তোমার সৈন্যদল, দার্শনিক পণ্ডিত, বুযুর্গানে দ্বীন, সুন্দরী ললনাসহ ধন-রত্ম সব কিছুই উপস্থিত করেছি, নিজেও উজির-নাজিরসহ উপস্থিত হয়েছি। যদি এসব অবলম্বনে তোমার মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হত, তবে আমি তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টার কোন ত্র“টি করতাম না। কিন্তু এ ঘটনা যিনি ঘটিয়েছেন- তোমার পিতা তো এক্ষেত্রে নগণ্য। এমনকি এ পৃথিবীতে যা কিছু সবই সেই মহাশক্তিমান আল্লাহর সামনে অক্ষম ও দুর্বল। এই বলে সম্রাট অশ্র“ভেজা চোখে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসেন।
বন্ধু উজিরের মুখে ঘটনার ব্যাখ্যা শুনে ভাবাবেগে হযরত হাসান বসরী রাঃ জেগে উঠেন। তারপর ব্যবসা ছেড়ে বসরায় ফিরে আসেন। মনে মনে শপথ করলেন, জীবনে আর কখনো এ নশ্বর পৃথিবীর মোহে আবিষ্ট হবেন না। তারপর তিনি হযরত আলী রাঃ এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। আর তাঁর থেকে শিক্ষা দীক্ষা নিতে থাকেন। হযরত আলী রাঃও তাঁকে খুব ভালবাসতেন। তাছাড়া তিনি একশ’ ত্রিশজন সাহাবীরও সঙ্গ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। শুরু হল হযরত হাসান বসরী রাঃ এর ইবাদত ও রিয়াজতের পালা। সেকালে তিনি এমন কঠোর সাধনায় মগ্ন হলেন, যা আর কারো সাধ্য ছিল না। তিনি টানা সত্তর বছর অজু অবস্থায় ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁর অজু কেবল অজুর স্থানে এসে ভঙ্গ হত। সঙ্গে সঙ্গে আবার অজু করে নিতেন। তিনি পৃথিবীর সব লোকের সঙ্গ ত্যাগ করে নির্জনতা অবলম্বন করেন। কঠোর ইবাদত ও রিয়াজতের মাধ্যমে যুগের অলি-দরবেশগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হয়ে গেলেন।
একদিন এক লোক অন্যজনকে বলল, হযরত হাসান বসরী রাঃ কেমন করে আমাদের সবার উপরের স্থান দখল করে নিলেন? উত্তরে লোকটি বলল, সবাই তাঁর জ্ঞানের মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অপর কারো মুখাপেক্ষী নন। আর ধর্মের বিষয়বস্তুতে সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। আর এ কারণেই তিনি শীর্ষস্থানীয় হয়েছেন।
হযরত হাসান বসরী রাঃ প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে ওয়াজ করতেন। সেই মজলিশে হযরত রাবেয়া বসরী রাঃ উপস্থিত না থাকলে তিনি ওয়াজ করা থেকে বিরত থাকতেন। লোকে তাঁকে জিজ্ঞেস করত, এত মর্যাদাবান বুযুর্গানে দ্বীন মজলিশে উপস্থিত একজন বৃদ্ধা আসেননি, এতে ওয়াজ না করার কারণ কি? তিনি উত্তরে বলতেন, যে শরবত আমি হাতিকে পান করাতে তৈরি করেছি, তা পিপীলিকার মুখে কি করে দেই।
অন্যদিকে হযরত রাবেয়া বসরী রাঃকে যখন লোকজন জিজ্ঞাসা করত, আপনি একজন নারী হয়ে কি করে পুরুষের মাহফিলে যোগ দে? তখন তিনি হাদিসের ভাষায় উত্তর করতেন- তালেবুল মাওলা মুজাক্কার তালেবুল উকবা মুয়ান্নাস তালেবুদ দুনিয়া মুখান্নাস। অর্থাৎ- আল্লাহর অনুসন্ধানী পুরুষ, আখেরাতের অনুসন্ধানী নারী আর জাগতিক অনুসন্ধানী নপুংসক। আমি হচ্ছি আল্লাহর অনুসন্ধানী তাই আমি পুরুষ। আর তোমরা আখেরাতের সন্ধানী- তাই তোমারা নারী। তোমরা কেন ভিন পুরুষের মাহফিলে এসেছো?
ফলে হযরত রাবেয়া বসরী রাঃ এর উপস্থিতিতে হযরত হাসান বসরী রাঃ ওয়াজ করতে করতে তাঁকে লক্ষ্য করে বলতেন, হে রাবেয়া ! আমার অন্তরের এ উদ্দীপনা তোমার উদ্দীপনাপূর্ণ রূহের ফয়েজ থেকে উদ্ভূত।
আর একদিন লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, মুসলমানী কি এবং মুসলমান কে? তিনি বললেন, মুসলমানী রয়েছে কিতাবে, আর মুসলমান রয়েছে কবরে। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ধর্মের মূল পদার্থ কি? তিনি উত্তরে বললেন, পরহেজগারী অর্থাৎ- খোদাভীতি। তারা বলল, কোন বস্তু পরহেজগারী ধ্বংস করে? তিনি বললেন, লোভ। আবার প্রশ্ন করা হল, হুজুর ! আদন কি? তিনি বললেন, তা স্বর্ণ নির্মিত একটি অট্টালিকা- যাতে পয়গম্বর, শহীদ, সিদ্দিক এবং ন্যায় পরায়ন বাদশাহগণ ব্যতীত আর কেউ প্রবেশাধিকার পাবে না। তাঁকে পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, রুগ্ন চিকিৎসক অপরের চিকিৎসা কেমন করে করবে? তিনি বললেন, আগে সে নিজের চিকিৎসা করিয়ে নিবে, অতঃপর অপরের চিকিৎসা করবে।
হযরত হাসান বসরী রাঃ নিজকে সকলের চাইতে হেয় এবং সকলকে নিজের চাইতে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন। একদা তিনি দজলা নদীর তীরে ভ্রমণ করছিলেন, জনৈক হাবশীকে দেখলেন, একজন স্ত্রীলোকসহ বসে আছে এবং হস্তস্থিত বোতল হতে কিছু পান করছে, সে কি আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ? তা কেমন করে হতে পারে? মনে মনে তিনি এরূপ জল্পনা কল্পনা করতেছেন, ঠিক এমন সময় তথায় একটি যাত্রী বোঝাই নৌকা এসে পড়ল এবং ঘূর্ণিপাকে পড়ে তলায়ে গেল। নৌকায় সাত জন আরোহী ছিল। হাবশী লোকটি তৎক্ষণাৎ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং বীরত্বের সাথে ছয় জনকে উদ্ধার করে আনল। এরপর হাসান বসরীর দিকে লক্ষ্য করে বলল, নিমজ্জমান সাতজন লোকের মধ্যে ছয়জনকে আমি উদ্ধার করেছি বাকি একজনকে তুমি উদ্ধার কর। উনি যে আমার মা। বোতলের মধ্য হতে যা পান করছি তা ছিল পবিত্র পানীয়, মদ্য নয়। তুমি অন্ধ, না জ্ঞানচক্ষু বিশিষ্ট তা পরীক্ষা করার জন্যই আমি এ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলাম। দেখলাম বাস্তবিকই তুমি অন্ধ। এটা শুনে হাসান রাঃ লজ্জিত হয়ে হাবশীর নিকট ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন, হে হাবশী ভাই ! এতগুলো মানুষকে যখন তুমি নদীর অতল গর্ভ হতে উদ্ধার করেছ, তখন আমাকেও অহংকারের অতল গর্ভ হতে উদ্ধার কর। হাবশী দোয়া করলেন, আল্লাহ পাক তোমায় দিব্যচক্ষু দান করুন। এরপর হতে হযরত হাসান রাঃ নিজেকে আর কারও চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন না।
একদিন একটি কুকুর দেখে হযরত হাসান রাঃ বললেন, হায় খোদা ! পরলোকে আমাকে এই কুকুরের সাথে বিচার করো। একথা শুনে পার্শ্বস্থ এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, আপনি উত্তম না এই কুকুরটি? হযরত হাসান রাঃ বললেন, কিয়ামতের ময়দানে যদি আমি আযাব হতে মুক্তি লাভ করি তবে আমাকে উত্তম বলতে পার, অন্যথায় আমার মত হাসানের চেয়ে কুকুরটিই উত্তম।
একদিন হযরত হাসান রাঃ জানতে পারলেন, জনৈক ব্যক্তি তাঁর অগোচরে নিন্দা করেছে। তিনি একথালা পরিপক্ক খেজুর নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলেন এবং অতি বিনয়ের সাথে বললেন, আপনার কিছু সওয়াব আপনি আমার আমলনামায় স্থানান্তরিত করে দিয়েছেন। আমি তার বিনিময়ে আপনাকে এই যৎসামান্য উপহার দিলাম। এর চাইতেও যদি ভাল পুরস্কার দেওয়ার মত ক্ষমতা আমার থাকত তাও দিতে আমি কুণ্ঠিত হতাম না।
এ মহান অলি হযরত হাসান বসরী রাঃ হযরত ওমর ফারুক রাঃ এর খেলাফতকালে হিজরি ২১ সনে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর জীবনে অধিকাংশ সময় বসরায় অতিবাহিত হয়েছিল বলে তাঁকে বসরী বলা হয়। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ আলেম এবং অতিশয় পরহেজগার ও খোদাভীরু। তাঁর পিতার নাম ছিল মূসা রাঈ। তিনি বসরা এবং ওয়াসেত এর মধ্যবর্তী সায়লাসান নামক স্থানে বসবাস করতেন এবং যায়েদ ইবনে সাবেত আনসারী রাঃ এর আযাদকৃত গোলাম ছিলেন। তিনি হিজরি ১২ সনে সিদ্দিকে আকবর হযরত আবু বকর রাঃ এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর মাতা ছিলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাঃ এর বাদী।
হযরত হাসান বসরী রাঃ ৫ রজব ১১০ হিজরি শুক্রবার মোতাবেক ১০ আগষ্ট ৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় ইন্তেকাল করেন।

হযরত ফুযাইল ইবনে আয়ায রাঃ

হযরত ফুযাইল ইবনে আয়ায রাঃ ছিলেন তাব এ তাবেঈন ভুক্ত এবং তৎকালীন উন্নত পর্যায়ের সুফিয়া এবং বুযুর্গ আউলিয়া কেরামগের অন্যতম, তরিকতের ক্রিয়াকলাপ এবং হাকিকত ও মারেফাতের অগাধ জ্ঞানী এবং কামেল, তওবাকারীগের অগ্রণী, দয়া-দাক্ষিণ্যের দীপ্তিমান ভাস্কর। তিনি খোদাতত্ত্ব জ্ঞান এবং আউলিয়াকেরাম কর্তৃক প্রসংশিত ছিলেন। তাঁর সম্যক অবস্থা সততা ও খাঁটিতে পরিপূর্ণ।
প্রথম জীবনে তিনি ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন। মারব এবং বাওয়ার্দ নামক মরু প্রান্তরে তাঁবুতে অবস্থান করতেন। টাট বা চটের পোশাক পরিধান ওপশমী টুপী ব্যবহার করতেন। তিনি লম্বা এক ছড়া তসবীহ গলায় ঝুলাইয়া খোদাগত প্রাণ দরবেশের বেশে থাকিতেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথী অনেক ছিল। কিন্তু সকলেই ছিল ডাকাত। সেই ডাকাতদল ডাকাতি করে লুণ্ঠিত দ্রব্য তাঁর নিকট নিয়ে আসত। তিনি তাদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিতেন। আর তার মধ্যে যা কিছু নিজের পছন্দ তা নিজের জন্য রাখতেন। কিন্তু কখনো জামাতে নামাজ পড়া ত্যাগ করতেন না। তাঁর দলের মধ্যে যে কেহ জামাতে নামাজ না পড়লে তাকে দল থেকে বের করে দিতেন।
একবার এক দল বণিক মরুভূমির সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। বণিকের দল এ পথের ডাকাত দলের কুখ্যাতি পূর্ব হতে অবহিত ছিল। তাদের মধ্যে একজনের কাছে অনেক নগদ টাকা ছিল। সে টাকাগুলো কোন স্থানে লুকায়ে রাখতে মনস্থ করল যেন কাফেলার মালপত্র লুণ্ঠিত হলেও এই টাকা রক্ষা পায়। মরুভূমির মধ্যে ছুটাছুটি করতে করতে একস্থানে দেখতে পাইল, একটি তাঁবুর ভিতরে টাট পরিহিত একজন ফকির তসবীহ হাতে জায়নামাযে বসা আছেন। সে মনে মনে ভাবল, খুব ভাল হয়েছে এই বুযুর্গ লোকের সাক্ষাৎ পেলাম, টাকাগুলো তার কাছে গচ্ছিত তার কাছে গচ্ছিত রাখব। তাঁর কাছে গিয়ে লোকটি নিজের অবস্থা বর্ণনা করল। তিনি ইঙ্গিতে বললেন, তাঁবুর ভিতরে যেখানে ইচ্ছা তোমার নিজের হাতে রেখে যাও। বণিক টাকাগুলো নির্দিষ্ট স্থানে রেখে কাফেলার দিকে ফিরে এসে দেখল যে, ডাকাতেরা কাফেলা লুণ্ঠন করে চলে গেছে। সে ব্যক্তি কাফেলায় নিজের মালপত্র যা অবশিষ্ট পাইল তা নিয়ে তাঁবুর দিকে গেল। তাঁবুর সম্মুখে গিয়ে দেখল, ডাকাতেরা লুণ্ঠিত মাল বণ্টন করছে এবং বণ্টনকারী স্বয়ং সেই ফকির সাহেব। সে মনে মনে ভাবল, আহা ! আমি আমার টাকাগুলি নিজের হাতে এনে ডাকাতের হাতে তুলে দিলাম। হযরত ফুযাইল রাঃ বণিককে দূর হতে দেখে নিজের কাছে ডাকলেন। লোকটি ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গেল। হযরত ফুযাইল রাঃ জিজ্ঞাসা করলেন, কার কাছে এসেছ? সে বলল, আমার আমানত ফেরত নিতে এসেছি। তিনি বললেন তুমি যেখানে রেখেছ সেখান থেকে নিয়ে যাও। সে যথাস্থানে গিয়ে নিজের টাকা উঠায়ে নিল এবং কাফেলার দিকে চলে গেল। হযরত ফুযাইলের বন্ধুরা বলল, এই কাফেলা লুণ্ঠন করে আমরা নগদ টাকা কিছুই পাইনি। আপনি এই লোকটিকে টাকাগুলো ফেরত দিলেন কেন? হযরত ফুযাইল বললেন, এই লোকটি আমার প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করেছে। আমিও আল্লাহ তায়ালার প্রতি সর্বদা ভাল ধারণা পোষণ করছি। আমি তার ভাল ধারণাকে সত্যে পরিণত করলাম। এর ফলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি আমার ধারণাকে সত্যে পরিণত করে দিতে পারেন।
অতঃপর আর একদিন সেই ডাকাতের দল অন্য একটি কাফেলা আক্রমণ করে তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে আনল এবং ভাগ বণ্টন শেষ করে তারা খাইতে বসল। এমন সময় কাফেলার একজন লোক এসে তাদের জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কি সর্দার নেই? একজন উত্তর করল, আছে। বণিক বলল, তিনি এখন কোথায়? ডাকাত বলল, তিনি নফল নামাজ পড়ছেন। বণিক বললেন, তিনি খেতে আসেন না কেন? ডাকাত বলল, তিনি দিনে রোজা রাখেন। বণিক বলল, এখন তো রোজার মাস নয়। উত্তর আসল, তিনি নফল রোজা  রাখেন। বণিক বিস্মিত হল এবং হযরত ফুযাইল রাঃ এর কাছে গিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারলাম না, রোজা-নামাজের চুরি ও ডাকাতির সঙ্গে কি সম্পর্ক। ফুযাইল বললেন, তুমি কুরআন শরীফ পড়নি। সে বলল, পড়েছি। ফুযাইল বললেন, তুমি কি কুরআনের এই আয়াতটি পড়নি? – অন্য একদল তাদের গুনাহের কাজসমূহ স্বীকার করল, তারা নেক আমলকে গুনাহের সাথে মিশায়ে ফেলেছে। বণিক তা শুনে অবাক হয়ে গেল।
হযরত ফুযাইল রাঃ এর স্বভাবের মধ্যে মানবতা এবং ভদ্রতা এই পরিমাণ ছিল যে, কোন কাফেলার সঙ্গে স্ত্রীলোক থাকলে সে কাফেলার নিকটেও যেতেন না। আর যার কাছে অল্প মাল থাকত তাকে লুণ্ঠন করত না। যাদের লুণ্ঠন করতেন তাদের একেবারেই নিঃসম্বল করে ছাড়তেন না। নেকীর প্রতি তাঁর খুব ঝোঁক ছিল। প্রথম জীবনে তিনি জনৈক স্ত্রীলোকের প্রেমে আসক্ত ছিলেন। ডাকাতি করে নিজের অংশে যা পেতেন সবই তার কাছে পাঠায়ে দিতেন। কখনও কখনও নিজেও তার কাছে চলে যেতেন এবং এশক ও মহব্বত প্রকাশ করে খুব রোদন করতেন।
একদিন মারব হতে একজন বণিক ফুযাইলের তাঁবুর পার্শ্বস্থ পথে রওয়ানা হল। লোকে বলল, রক্ষী সঙ্গে নাও, কেননা বিখ্যাত ডাকাত ফুযাইলের আড্ডা এই পথে। সে বলল, আমি শুনতে পেরেছি ফুযাইল খোদাভীরু। সে জনৈক ক্বারী সাহেবকে নিজের উটের উপর চড়ায়ে নিল। তিনি উটের পিঠে বসে দিবা-রাত্র কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। অনন্তর কাফেলা হযরত ফুযাইল রাঃ এর ঘাঁটির কাছে পৌঁছালো। ঘটনাক্রমে ক্বারী সাহেব তখন এই আয়াতটি পাঠ করছিলেন, এখনও কি ঈমানদারদের জন্য সেই সময়টুকু নিকটবর্তী হয়নি যে, তাদের অন্তর খোদাকে স্মরণ করে ভীত হয়?” এই আয়াতটি শুনে হযরত ফুযাইল রাঃ এর অন্তর এমনভাবে প্রভাবিত হয় যে, আয়াতটি তীরের মত এসে তাঁর অন্তরে বিঁধিল এবং তা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিল। তৎক্ষণাৎ তিনি মনে মনে বললেন, হায় ! আর কতদিন আমি এভাবে লুট-তরাজ করতে থাকব? এখন সেই সময় এসে পড়েছে। হে পরওয়ারদেগার ! এখন আপনার পথে চলার সময় এসে পড়েছে। এই বলে তিনি ফরিয়াদ করতে লাগলেন। সময় এসে পড়েছে। তিনি তওবা করলেন এবং আল্লাহর দিকে রুজু করলেন এবং অনুতপ্ত, লজ্জিত ও পেরেশান হয়ে এক নির্জন স্থানে চলে গেলেন। ঘটনাক্রমে সেখানে কোন এক কাফেলা বিশ্রাম করতেছিল। তারা বলাবলি করছিল, এপথে আমাদের যাওয়া ঠিক হবে না। এ পথে ফুযাইলের ঘাঁটি রয়েছে। হযরত ফুযাইল রাঃ তাদের কথা শুনে বললেন, হে বণিকদল ! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, ফুযাইল তওবা করেছে, এখন সেই তোমাদেরকে দেখে পলায়ন করতেছে। একথা বলতে বলতে এবং রোদন করতে করতে তিনি পথ চলতে লাগিলেন। যাদের উপর উৎপীড়ন করে মনে কষ্ট দিয়েছিলেন, কাকুতি মিনতি করে মাফ চাহিয়া তাদের কারও কারও মন সন্তুষ্ট করে দিতেন আর যাদের লুণ্ঠন করেছিলেন তাদের কারও কারও হক ফিরায়ে দিতেন এবং কারও কারও হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতেন। তাঁর অনুতপ্ত অবস্থা দেখে সকলে মাফ করে দিল। কিন্তু বাওয়ার্দের প্রান্তরের নিকটবর্তী জনৈক ইহুদি কোন মতেই রাজি হল না এবং তার বন্ধুদের বলল, আজ মোহাম্মদীদিগকে ঘৃণা ও লাঞ্ছিত করার দিন আমাদের এসেছে। অতঃপর হযরত ফুযাইল রাঃ কে বললেন, আমি তোমাকে এক শর্তে মাফ করে দিতে পারি, যদি এই বালির টিলাটাকে এখান থেকে স্থানান্তরিত করে দিতে পার। টিলাটা ছিল খুব বড়। হযরত ফুযাইল রাঃ দিবারাত্র পরিশ্রম করে উক্ত টিলা হতে টুকরীতে করে বালি বহন করে নিতে লাগলেন। তাঁর প্রতি আল্লাহ তায়ালার দয়া হল, পরবর্তী রাত্রে এমন জোরে ধূলি ঝঞ্ঝা প্রবাহিত হল যে, সেই বালুকা ¯তূপ হতে বালু উড়ালে নিয়ে সমান করে রাখল। ইহুদি যখন দেখল যে, তার শর্ত পূরণ হয়েছে, তখন হযরত ফুযাইল রাঃ কে বললেন, আমি কসম করেছি আমার লুণ্ঠিত অর্থ ফেরত না পেলে আমি মাফ করব না।
এখন তুমি এক কাজ কর, আমার বালিশের নীচে স্বর্ণের একটি থলি রয়েছে তা উঠায়ে আমার হাতে দাও। তা হলে আমার কসম ঠিক থাকবে এবং আমি তোমাকে মাফ করে দিব। হযরত ফুযাইল রাঃ ইহুদির বালিশের নিছ থেকে স্বর্ণের থলি উঠায়ে এনে তার হাতে দিল। ইহুদি বলল, আগে আমাকে ইসলাম ধর্শে দীক্ষিত কর তৎপর তোমাকে মাফ করে দিব। হযরত ফুযাইল রাঃ তাকে কলেমায়ে শাহাদাৎ পড়ালেন। ইহুদি মুসলমান হয়ে গেল এবং তাঁকে মাফ করে দিল।
নব দীক্ষিত মুসলমানটি হযরত ফুযাইল রাঃ কে বলল, আপনি জানেন কি, আমি কেন মুসলমান হলাম? তিনি বললেন, না। সে বলল, এই পর্যন্ত আমি সঠিকভাবে জানতে পারিনি যে, সত্য ধর্ম কোনটি। আজ তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।আমি তাওরাত কিতাবে পড়েছি, যথার্থ তওবাকারী মাটির ঢিলা স্পর্শ করলে তা স্বর্ণ হয়ে যায়। আমার বালিশের নিচের থলির মধ্যে ছিল মাটি, আমার ইচ্ছা হল আমি আপনার তওবার যথার্থতা পরীক্ষা করব। আপনার তওবা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। থলির সব মাটি স্বর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং আপনাদের ইসলাম ধর্ম সত্য।
কথিত আছে, পথ চলাকালে এক ব্যক্তির সাথে হযরত ফুযাইল রাঃ এর সাক্ষাঃ হল। তিনি তাকে বললেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে কিছু নসিহত কর এবং আমাকে বাদশাহের কাছে নিয়ে চল। আমি শরিয়তের খেলাফ বহু কাজ করেছি। বাদশাহ আমার উপর শরিয়তের হুকুম জারি করবেন। লোকটি তাঁকে বাদশাহের কাছে নিয়ে গেল। বাদশাহ তাঁর ললাটের দিকে দৃষ্টি করেই নেককারের লক্ষণ দেখতে পেলেন। সুতরাং তাঁকে সসম্মানে নিজ গৃহে পৌঁছাইয়া দিতে আদেশ করলেন। ঘরের দরজায় পৌঁছিয়া তিনি দরজা খুলার জন্যা ঘরের লোকদের ডাকলেন। আওয়াজ শুনেই ঘরের লোকেরা বলল, মনে হয়, তিনি কোন আঘাত পেয়েছেন, কাজেই গলার স্বর বসে গেছে। হযরত ফুযাইল রাঃ তা শুনে বললেন, হ্যাঁ, তোমরা সত্যই বলেছ, আমি শক্ত আঘাত পেয়েছি। তারা জিজ্ঞাসা করল, কিসে আঘত পেয়েছেন? তিনি বললেন, প্রাণের ভিতর। অতঃপর ঘরে প্রবেশ করে বিবিকে বললেন, আমি কাবা শরীফ যাইতে ইচ্ছা করেছি। তুমি ইচ্ছা করলে আমি তোমাকে মুক্তি দিতে পারি। বিবি বললেন, আমি তো কখনও আপনার সঙ্গ ত্যাগ করব না। আপনি যেখানেই থাকবেন আমি আপনার সঙ্গে থেকে আপনার খেদমত করব। অনন্তর হযরত ফুযাইল রাঃ বিবিকে সঙ্গে নিয়েই মক্কা শরীফ গেলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্য পথ সুগম করে দিলেন। তিনি মক্কা শরীফের বাসিন্দা হয়ে সেখানকার বহু আউলিয়ায়ে কেরামের খেদমত করলেন। অবশেষে হযরত ইমাম আবু হানিফা রাঃ এর খেদমতে দীর্ঘকাল অবস্থান করে দ্বীনী এলম শিক্ষা করলেন এবং রিয়াযত ও রেওয়ায়েতে (হাদিস শাস্ত্রের) কামালিয়াত হাসিল করলেন। কালক্রমে তিনি বিখ্যাত ওয়ায়েজ হলেন। মক্কাবাসীরা তাঁর মজলিসে সমবেত হয়ে তাঁর ওয়াজ শুনত। এমন কি, শেষ পর্যন্ত তাঁর অবস্থা এরূপ দাঁড়াল যে, বাওয়ার্দ হতে তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা দলে দলে তাঁর সাক্ষাৎ লাভের জন্য আসতে লাগল। কিন্তু তিনি কাকেও সাক্ষৎ দিলেন না। তারা পীড়াপীড়ি আরম্ভ করলে তিনি গৃহের ছাদের উপর উঠে তাদের লক্ষ্য করে বললেন, হে লোকগণ ! তোমরা আল্লাহকে ভুলে দুনিয়ার মোহে মুগ্ধ হয়ে গেছ, আল্লাহ তোমাদের আকল দান করুন এবং তাঁর কোন কাজে তোমাদের লিপ্ত করুন। একথা শুনে তারা ব্যর্থ মনে দেশে ফিরে গেল। হযরত ফুযাইল রাঃ ছাদের উপর থেকে রোদন করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য নিজের দরজা খুললেন না। (আনওয়ারুল আযকিয়া)
খলিফা হারুনূর রশিদের উজির ইবনে ফযল বারী বারামাকী বলেন, হজ্জ্বের সফরে খলিফা আমাকে বললেন, এখানে কি কোন আল্লাহওয়ালা লোক আছেন যাঁর সাক্ষাৎ লাভ করে খিছু নসিহত হাসিল করতে পারি। অতঃপর আমি খলিফাকে ফুযাইলের বাড়ি নিয়ে গেলাম, তিনি তখন ঘরের ভিতরে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করছিলেন। আমরা যখন তাঁর দ্বারে পৌঁছিলাম ঠিক তখন এই আয়াতটি তেলাওয়াত করছিলেন- “যারা পাপ কাজে লিপ্ত তারা কি ধারণা করে যে, আমি তাদেরকে ইমানদার ও নেককারদের মত গণ্য করব? হারুরূর রীশদ বললেন, কোন উপদেশ কামনা করলে আমার  জন্য এই আয়াতই যথেষ্ট। তৎপর আমরা দরজায় করাঘাত করলাম। হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, কে? আমি বললাম, আমিরুল মুমিনীন। তিনি বললেন, আমার কাছে আমিরুল মুমিনীনের কি প্রয়োজন? আর আমারই বা তাঁর কাছে কি প্রয়োজন? আমাকে দুনিয়ার দিকে আকর্ষণ করবেন না। আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ ! নবী করিম সাঃ হাদিস শরীফে বলেছেন, বান্দার পক্ষে নিজের নফসকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে হীন ও অপদস্থ করা জায়েজ নহে। ফুযাইল বললেন, আপনার কথা সত্য, কিন্তু রেযাওয়ালা লোকদের রেযাই স্থায়ী ইজ্জত। এতে আপনি আমার হীনতা দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আমি আল্লাহ পাকের নির্দেশের উপর সন্তুষ্ট থাকার কারণে একে নিজের ইজ্জত মনে করছি, ফজল বারমাকী বললেন, শাসকদের সম্মান করা ওয়াজিব। তিনি বললেন, আামাকে বিরক্ত করবেন না। ফযল বারমাকী বললেন, আমাদের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিন, অন্যথায় আমরা বলপূর্বক প্রবেশ করব। তিনি বললেন,  আমি অনুমতি দিচ্ছি না, তবে বলপূর্বক প্রবেশ করতে চাইলে আপনাদের ইচ্ছা। হারুনূর রশিদ ভিতরে প্রবেশ করলে হযরত ফুযাইল রাঃ বাতি নিভায়ে দিলেন, যেন হারুনূর রশিদের চেহারার প্রতি দৃষ্টি না পড়ে। হারুনূর রশিদ অন্ধকারে হাতড়ায়ে হযরত ফুযাইলের হাতের সঙ্গে হাত মিলালেন। হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, আহা ! এমন নরম হাত ! এটা দোযখের আগুন হতে রক্ষা পেলেই ভাল। একথা বলেই তিনি নামাজে দাঁড়ালেন।
তাঁর কথা শুনে খলিফা হারুনূর রশিদ রোদন করতে লাগলেন এবং বললেন, আরও কিছু উপদেশ দিন। হযরত ফুযাইল রাঃ নামাজের সালাম ফিরায়ে বলতে লাগলেন, আপনার পূর্ব পুরুষ হযরত আব্বাস রাঃ নবী করিম সাঃ এর চাচা ছিলেন। একদা তিনি নবী করিম সাঃ কে বললেন, আপনি আমাকে কোন কাওমের সর্দার করে দিন। হুযুর সাঃ বললেন, আপনি আমাকে কোন কাওমের সর্দার করে দিন। হুযুর সাঃ বললেন, চাচা ! আমি আপনাকে আপনার নফসের সর্দার করে দিলাম। কেননা আপনি এক মুহূর্তকাল আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে মশগুল থাকা, মানুষ সহস্র বৎসর আপনার আনুগত্য করা এবং আপনি তাদের উপর কর্তৃত্ব করার চেয়ে উত্তম, “কেননা পৃথিবীতে কর্তৃত্ব করা পরকালে লজ্জিত হওয়ার কারণ হবে।” খলিফা হারুনূর রশিদ বললেন, আরো কিছু উপদেশ দান করুন। হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খেলাফতের আসনে বসেই সালেম ইবনে আবদুল্লাহ, রাজ্বা ইবনে হাইয়্যান এবং মুহাম্মদ ইবনে কা’আবকে ডেকে বললেন, খেলাফতের দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে নিয়ে আমি বড়ই বিপদে পড়েছি। এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ আমাকে বলে দিন। তাঁরা বললেন, আপনি যদি কাল কেয়ামতের দিন আযাব হতে অব্যাহতি পেতে চান, তবে আপনার প্রজাবৃন্দের মধ্যে বৃদ্ধদের বাপের তুল্য, যুবকদের ভাইয়ের মত, শিশুদের নিজ সন্তানের মত এবং নারীদের নিজের মা ও বোনের মত মনে করবেন। তাদের সাথে সেরূপ ব্যবহার করবেন যেরূপ আপনার পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নী ও সন্তান-সন্ততির সাথে করে থাকেন। খলিফা হারুনূর রশিদ বললেন, আরো কিছু নসিহত করুন। এই গোটা মুসলিম বিশ্বকে আপনার ঘর এবং সমগ্র রাজ্যের প্রজাবৃন্দকে আপনার পরিজন মনে করবেন। খলিফা বললেন, আরো কিছু বলুন। তিনি বললেন, মুরুব্বীস্থানীয় লোকদের প্রতি মেহেরবাণীর দৃষ্টি, ভ্রাতৃস্থানীয়দের প্রতি দয়ার দৃষ্টি এবং সন্তানস্থানীয়দের প্রতি স্নেহের দৃষ্টি রাখবেন। আমি আপনার এই সুন্দর ও সুদর্শন চেহারার জন্য আশঙ্কা করছি- এমন না হয় যে, তা দোযখের আগুনে দগ্ধিভূত হয়ে বীভৎস ও কদাকার হয়ে যায়।
অনেক সুন্দর চেহারা সেদিন দোযখের আগুনে বীভৎস ও কদাকার হয়ে যাবে এবং বহু আমীর ব্যক্তি সেদিন দোযখে কয়েদী হয়ে থাকবে। খলিফা হারুনূর রশিদ বললেন, আরও কিছু বলুন এবং হায় ! হায় !! করে কাঁদতে লাগলেন। হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন, আখেরাতে আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে জবাব দেয়ার জন্য ভালভাবে প্রস্তুত হন এবং সতর্ক থাকুন। কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক আপনাকে প্রত্যেকটি মুসলমান প্রজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন এবং প্রত্যেক লোকের প্রতি সুবিচার করেছেন কিনা তার হিসাব নিবেন। যদি কোন রাত্রে কোন একজন বৃদ্ধা রমণীও নিজের ঘরে অনাহারে শুয়ে থাকে, কাল কেয়ামতের ময়দানে সে আপনার আঁচল ধরে টানবে এবং খোদার দরবারে আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করবে। একথা শুনে খলিফা হারুনূর রশিদ আরো অস্থির হয়ে রোদন করতে লাগলেন। ফজল বারমাকী বললেন, “হে ফুযাইল ! ক্ষান্ত হোন। আপনি তো আমিরুল মুমিনীনকে মেরে ফেলবেন।” হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, “হে হামান? চুপ থাক, তুমি এবং তোমার দলের লোকেরাই তো আমিরুল মুমিনীনকে হত্যা করেছ, আমি নই। এতে খলিফা হারুনের রোদনের মাত্রা আরো বেড়ে গেল এবং ফজলকে বললেন, তোমাকে তিনি হামান এই জন্য বলেছেন যে, আমাকে তিনি ফেরাউনের স্থানে মনে করছেন। অতঃপর খলিফা হারুনূর রশিদ প্রশ্ন করলেন, আপনার কোন ঋণ আছে কি? হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, হ্যাঁ, আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে ঋণী। তাঁর ইবাদত করাই আমার উপর ঋণ। যদি তিনি আমাকে ধরপাকড় করেন, তবে তো আমার জন্য খুবই আক্ষেপের বিষয়। হারুনূর রশিদ বললেন, লোকের কাছে আপনার দেয় কোন ঋণ আছে কি না তাই আমি জিজ্ঞাসা করছি। হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, আল্লাহ পাকের শোকর তিনি আমাকে অনেক নেয়ামত দান করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। অতঃপর হারুনূর রশিদ এক হাজার দিনারের একটি থলে তাঁর সামনে রেখে বললেন, এই মাল হালাল। এটা আমি মায়ের ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছি। হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, আহা ! আমার এত নসিহত আপনার উপর কোন ক্রিয়া করল না। আপনি এখনই যুলুম ও অবিচার আরম্ভ করে দিলেন। আশ্চর্যের বিষয় আমি আপনাকে মুক্তির দিকে আহ্বাণ করছি, আপনাকে দুনিয়া হতে নিঃসম্পর্ক করার চেষ্টা করছি, আর আপনি আমাকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করছেন এবং আমার উপর বোঝা চাপাচ্ছেন। আমি বলছি আপনার কাছে যা আছে তা প্রকৃত প্রাপক এবং যোগ্য লোকদের দান করুন, অথচ যাকে দান করা উচিত নয়, তাকে দান করতেছেন। এই বলে তিনি খলিফা হারুনূর রশিদের নিকট হতে উঠে দরজা বন্দ করে দিলেন। তিনি বাইরে এসে বললেন, আহা ! কেমন খাঁটি মানুষ। বাস্তবিক পক্ষে ফুযাইলই সত্যিকারের মানুষ।
হযরত ফুযাইল রাঃ বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে চেনার মত চিনতে পেরেছে, সে সর্বশক্তি নিয়োগে তাঁর ইবাদত করে থাকে।” কেননা, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে চিনতে পেরেছে সে তাঁর নেয়ামত মেহেরবাণী এবং রহমত দ্বারাই তাঁকে চিনেছে। তাঁর প্রকৃত পরিচয় পাওয়া মাত্র সে তাঁকে প্রকৃত বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং বন্ধুর মনোতুষ্টি সাধনের নিমিত্ত সর্বশক্তি নিয়োগে তাঁর ইবাদত করে। কেননা বন্ধুর আদেশ পালন করা কঠিন হয় না। অতএব, যার হৃদয়ে আল্লাহর বন্ধুত্ব জ্ঞান অধিক হয়ে থাকে আল্লাহর ইবাদতের লোভও তার জন্য অধিক হয়ে থাকে।
খোদাতত্ত্ব জ্ঞানের আধিক্যের কারণেই খোদার বন্ধুত্ব ভাব অধিক হয়ে থাকে। হযরত আয়েশা রাঃ বলেন, এক রাতে নবী করিম সাঃ আমার বিছানা হতে উঠে কোথাও চলে গেলেন। আমি মনে করলাম তিনি হয়ত অন্য বিবির ঘরে পদার্পন করেছেন। অগত্যা আমি উঠে তাঁর সন্ধানে চলিলাম এবং দেখলাম, তিনি সোজা মসজিদে গিয়ে নামাজে দাঁড়ালেন এবং রোদন করতে লাগলেন। কিয়ৎক্ষণ পর হযরত বিলাল রাঃ তাহাজ্জুদের নামাজের আজান দিলেন। হুজুর নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষ করে হুজরায় ফিরে আসলেন। লক্ষ্য করে দেখলাম দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ায়ে নামাজ পড়ার কারণে তাঁর পা মোবারক ফুলে গেছে, আঙ্গুলগুলোর মাথা ফেটে তা হতে পানি নির্গত হচ্ছে। আমি কেঁদে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ ! আল্লাহ পাক তো আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন, তবে আপনি এত কষ্ট কেন করছেন? এত কষ্ট এবং কান্নাকাটি তো সেই ব্যক্তি করবে যার পরিণাম ভাল হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। হুজুর সাঃ বললেন, হে আয়েশা ! আমার প্রতি আল্লাহ পাকের মেহেরবাণী অসীম। আমি কি শোকর আদায়কারী বান্দা হব না। আল্লাহ পাক যখন অনুগ্রহপূর্বক ক্ষমার সুসংবাদ দান করেছেন, তখন আমার কি উচিত নয় যে, যথাসাধ্য শোকরগুজারী দ্বারা সেই নেয়ামতের সম্বর্ধনা করি?
হযরত ফুযাইল রাঃ আরো বলেছেন, দুনিয়া একটা পাগলা গারদ। মানুষ এর মধ্যে পাগলের দল। পাগলা গারদে পাগলের হাতে-পায়ে বেড়ি থাকে। আমাদের নফসের কুপ্রবৃত্তিসমূহ আমাদের জন্য বেড়ি এবং আমাদের পাপ কার্যসমূহ আমাদের শিকল
একদিন হযরত ফুযাইল রাঃ নিজের শিশু পুত্রকে কোলে নিয়ে চুম্বন করছিলেন। যেমন স্বভাবতঃ পিতামাতা স্নেহাধিখ্য বশতঃ শিশু সন্তানকে চুম্বন করে স্নেহ প্রকাশ করে থাকে। বালক বলল, আব্বা ! আপনি কি আমাকে ভালবাসেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বালক বলল, আপনি কি আল্লাহ তায়ালাকেও ভালবাসেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বালক বলল, আব্বা ! একটি হৃদয়ে তো দুইজনের প্রতি ভালবাসা স্থান পইিতে পারে না। ফুযাইল রাঃ বুঝিলেন, এটা প্রকৃতপক্ষে বালকের কথা নয়। বন্ধুই তা বালকের মুখ দ্বারা বলাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তিনি শিশু পুত্রকে কোল হতে নামায়ে মাটিতে রাখলেন এবং আল্লাহ পাকের ইবাদতে মশগুল হলেন। কথিত আছে, একবার হজ্বের দিন আরাফাতের ময়দানে দাঁড়ায়ে হযরত ফুযাইল রাঃ লোকের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করতেছিলেন এবং তাদের কান্নাকাটি শুনতেছিলেন। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ……… এত অধিক সংখ্যক মানুষ যদি কোন কৃপণ লোকের নিকট কান্নাকাটি করে টাকা পয়সা প্রার্থনা করত, তবে সে কখনও প্রার্থিদের নিরাশ করত না। হে রাহমান, হে রাহীম ! আপনার পক্ষে তাদের দান করা যখন খুবই সহজ এবং আপনি সমস্ত দাতাদের দাতা, অতএব, আশা করি, আপনি সকলকে মাফ করে দিবেন।
রেওয়ায়েত আছে, আরাফাতের রাতে লোকে হযরত ফুযাইল রাঃ কে প্রশ্ন করল, আপনি এখানে সমবেত লোকদের সম্পর্কে কি মনে করেন? তিনি বললেন, ফুযাইল যদি তাদের মধ্যে না থাকত তবে আল্লাহ তায়ালা সকলকে মাফ করে দিতেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, এর কারণ কি যে, আমরা খোদাভীরু লোকদের দেখতে পাই না? তিনি বললেন, তোমরা যদি খোদা ভীরু হতে তবে খোদাভীরু লোক তোমাদের কাছে অদৃশ্য হত না। কেননা খোদাভীরুকে খোদাভীরু ছাড়া এবং বিলাপকারীকে বিলাপকারী ব্যতিত অপর কেহ দেখতে পায় না। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, মানুষ খোদার প্রেমে কখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়? তিনি বললেন, যখন আল্লাহ তায়ালা হতে কোন দান প্রাপ্ত হওয়া এবং এবং বঞ্চিত হওয়াকে সে সমান জ্ঞান করে। কোন অবস্থায় আল্লাহর প্রতি কোন অভিযোগ করা না হয়। লোকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “লাব্বাইক” (আমি হাজির) বলতে ইচ্ছুক ব্যক্তি শুধু এই ভয়ে বলতে পারছে না যে, পাছে সে লাব্বাইক বললে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে “লা-লাব্বাইক” (তুমি হাজির নও) বলা হয়। এমন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কি বলেন? হযরত ফুযাইল রাঃ বললেন, আমি আশা করি যে ব্যক্তির অবস্থা এরূপ হয় এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এরূপ মনে করে, কোন লাব্বাইক উচ্চারণকারীই তার চেয়ে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে না।
হযরত আহমদ ইবনে হাম্বল রাঃ বলেন, আমি হযরত ফুযাইল রাঃ কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি দুনিয়ার সর্দারীর প্রত্যাশী হয়েছে সে লোকচক্ষে এবং আল্লাহ পাকের দৃষ্টিতে হেয় হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি ফুযাইলকে বললাম, আমাকে কিছু নসিহত করুন। তিনি বললেন, ‘তাবে’ অর্থাৎ- অন্যের অনুসরণকারী হোন। ‘মতবু’ অর্থাৎ- অন্যের অনুসরণীয় হবেন না। এটা আল্লাহ পাকের পছন্দনীয় নয়।
লোক তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, ধর্মের মূল কি? তিনি বললেন, ‘আকল’ অর্থাৎ জ্ঞান। আবার জিজ্ঞাসা করল, ধৈর্যের মূল কি? তিনি উত্তর করলেন, ‘হেলম’ অর্থাৎ- সহিষ্ণুতা। আবার জিজ্ঞাসা করল, সহিষ্ণুতার মূল কি? তিনি বললেন, সবর।
হযরত বিশরে হাফী রাঃ বলেন, আমি হযরত ফুযাইল রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যুহদ’ (সংসার বিরাগ) উত্তম না ‘রেযা’ (আল্লাহ তায়ালার বিধানে সন্তুষ্ট থাকা)? তিনি বললেন, রেযাই উত্তম। কেননা, যে ব্যক্তি খোদার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট থাকে সে কখনও প্রাপ্ত মর্যাদার চেয়ে অধিক মর্যাদা কামনা করেনা।

হযরত ইবরাহিম ইবনে আদহাম রাঃ

হযরত ইবরাহিম ইবনে আদহাম তৎকালের শ্রেষ্ঠ খোদাভীরু এবং সিদ্দিক ছিলেন। দুনিয়াতেও তিনি প্রতাপশালী বাদশাহ ছিলেন। সংসার ত্যাগী হয়ে খোদাতত্ত্ব জ্ঞানে শীর্ষস্থান লাভ করেছিলেন। বিশেষ ও সাধারণ সর্বশ্রেণীর লোকের কাছে তিনি সম্মানিত ও প্রিয় ছিলেন। তিনি বহু বুযুর্গানে দ্বীনের সাংসর্গ লাভ করেছিলেন। হযরত ইমাম আবু হানিফা রাঃ এর সোহবতে থেকেও তিনি দ্বীনী এলেম হাসিল করেছিলেন। শায়খুল এরাক হযরত জুনাইদ বাগদাদী রাঃ বলেন, বাতেনী এলমের আলেমদের সমস্ত এলমের চাবি ইবরাহীম ইবনে আদহাম।
একবার ইবরাহীম ইবনে আদহাম হযরত আবু হানিফার সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। ইমাম সাহেবের মজলিশে লোকেরা তাঁর প্রতি ঈষৎ অবহেলার দৃষ্টিতে তাকালে ইমাম সাহেব বললেন, সাইয়েদুনা ইবরাহী (অর্থাৎ আমাদের সরদার ইবরাহীম আদহাম) আসুন। ইমাম সাহেবের সহচরেরা তাঁর প্রতি ইমাম সাহেবের এরূপ সম্মানজনক সম্ভাষণ শুনে বললেন, “ইনি এই সরদারী কেমন করে প্রাপ্ত হলেন?” হযরত আবু হানিফা রাঃ বললেন, “আমি জানি তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহ পাকের ইবাদতে মশগুল থাকেন। আমরা তো সময় সময় অন্যের কাজেও মশগুল হয়ে থাকি। অতএব দেখে নেও তিনি কিরূপ স্তরের লোক।
প্রথম জীবনে হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম ছিলেন বলখের প্রতাপশালী বাদশাহ। এক বিশাল রাজ্য ছিল তাঁর শাসনাধীন। তিনি যখন ভ্রমণে বের হতেন, তখন ৪০ জন করে স্বর্ণের ঢাল ও রৌপ্যের গুর্জধারী সৈন্য তাঁর অগ্রে ও পশ্চাতে দেহরক্ষীরূপে মোতায়েত থাকত।
একদা শাহী মহলে গভীর রাতে তিনি সুকোমল শয্যাযুক্ত পালঙ্কে শায়িত ছিলেন, এমন সময় ছাদের উপর লোক চলার শব্দ টের পেলেন। তিনি উচ্চ শব্দে জিজ্ঞাসা করলেন, ছাদের উপর কে? উত্তর আসল, তোমারই একজন বন্ধু। আমার একটি উট হারায়েছে, তা তালাশ করছি। তিনি বললেন, তুমি তো দেখছি বেশ বোকা, রাজ প্রাসাদের ছাদের উপর উট আসবে কেমন করে? ছাদের উপরের লোকটি বললেন, হে গাফেল ! তুমি মখমলের পোশাস পরে স্বর্ণের সিংহাসনে বসে আল্লাহ তায়ালাকে অন্বেষণ করছো। এটা ছাদের উপর উট অন্বেষণ করার চেয়ে অধিক আশ্চর্যের বিষয় নয় কি? একথা বলেই ছাদের উপরের লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁর এই কথায় হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহামের অন্থরে একপ্রকার ভীতির সঞ্চার হল এবং তাঁর হৃদয়ে আগুন জ্বলে উঠল। তিনি খুব চিন্তিত, পেরেশান এবং ব্যাকুল হয়ে পড়লেন।
পরদিন যখন তিনি রাজ দরবারে সিংহাসনে সমাসীন, মন্ত্রীমণ্ডলী ও ওমরাগণ প্রত্যেকের নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট এবং চাকর-নওকরেরা সাবিদ্ধভাবে দণ্ডায়মান। অর্থাৎ সাধারণ রাজদরবার চলতেছিল, এমন সময় হঠাৎ একজন তেজস্বী পুরুষ খুব শান-শওকতের সাথে দরবারে প্রবেশ করলেন। তাঁর গাম্ভীর্য দর্শনে প্রভাবান্বিত হয়ে দ্বাররক্ষী ও চাকর নওকরেরা তাঁকে বাধা দেবার সাহস পেল না। এমন কি, একথাও জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেল না যে,আপনি কে? সকলে নির্বাক ও হতভম্ব হয়ে রইল। আগন্তুক লোকটি সিংহাসনের নিকটবর্তী হলে ইবরাহীম আদহাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি চাও? লোকটি উত্তর করল, ভয় করবেন না, আমি এই পান্থশালায় অবস্থান করতে চাই না। বাদশাহ বললেন, এটা পান্থশালা নয়, এটা আমার রজমহল। আগন্তুক বললেন, আচ্ছা বলুন তো আপনার পূর্বে এই মহলে কে কে বাস করত? বাদশাহ বললেন, আমার পিতা। আগন্তুক আবার প্রশ্ন করলেন, আপনার পিতার পূর্বে এই রাজপ্রাসাদ কার অধিকারে ছিল? বাদশাহ বললেন, আমার পিতামহের। এইরূপে আগন্তুক আরও কয়েকবার জিজ্ঞাসা করল এবং বাদশাহ অমুক অমুক বলে উত্তর দিলেন। তখন আগন্তুক বললেন, আচ্ছা, এখন আপনিই বলুন,  যেখানে একজন আসছে আর একজন যাচ্ছে। এটা পান্থশালা ছাড়া আর কি হতে পারে? একথা বলেই তিনি বের হয়ে গেলেন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম একাকী তাঁর পিছে পিছে দৌড়াতে লাগলেন এবং কিছুদূর গিয়ে তাঁকে পেলেন। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি খিজির। একথা শুনেই ইবরাহীম ইবনে আদহামের প্রাণে একপ্রকার আগুন জ্বলে উঠল। হযরত খিজির আঃ অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
হযরত খিজির আঃ এর কথা শুনে ইবরাহীম ইবনে আদহামের উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে গেল। তিনি আদেশ করলেন, ঘোড়া প্রস্তুত করা। আমি জঙ্গলে ভ্রমণ করব। দেখি আরও কি প্রকাশ পায়। এরপর তিনি লোক-লস্কর নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাত্রা করলেন এভং লক্ষ্যহীনভাবে যে দিকে সে দিকেই চলতে লাগলেন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তিনি সঙ্গীয় লোকজন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। অকস্মাৎ গায়ে হতে আওয়াজ আসল, এখনও জাগ্রত হও, এমন কি মৃত্যু তোমাকে জাগ্রত করার পূর্বে জাগ্রত হও। শব্দগুলো তিন চারবার শুনতে পেলেন। হযরত ইবরাহীম আদহাম তা শুনে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। ইতিমধ্যে দেখতে পেলেন একটি হরিণ সম্মুখে দণ্ডায়মান, তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে শিকার করতে উদ্যত হলেন। হরিণটি বলল, তুমি আমাকে শিকার করতে পারবে না। আমিই তোমাকে শিকার করার জন্য প্রেরিত হয়েছি। হে ইবরাহীম এ কাজের জন্যই কি তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? তোমার কি আর কোন কর্তব্য নেই? হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম পুনঃ পুনঃ সাবধান বাণী শুনে ব্যাপার কিছুটা বুঝতে পারলেন। হরিণের দিক হতে দৃষ্টি ফিরায়ে নিজের ঘোড়ার দিকে তাকালেন। ঘোড়ার জীন হতেও হরিণের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। তখন তাঁর হৃদয়ে একপ্রকার ভয়ের সঞ্চার হল এবং অন্তরচক্ষু খুব পরিষ্কার হয়ে গেল। তাঁকে সংসারের মায়াজাল হতে মুক্ত করে নিজের দিকে আকর্ষণ করাই যখন আল্লাহ পাকের ইচ্ছা রয়েছে, তখন নিজের লেবাসের প্রতি দৃষ্টি করা মাত্র তিনি কোর্তার বোতাম হতেও হরিণের কথাগুলোর অবিকল প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। এখানে এসে তাঁর অন্তরদৃষ্চিট সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হয়ে গেল। ফলে ফেরেশতা জগতের দ্বার তাঁর সম্মুখে মুক্ত হয়ে পড়ল। সেই জগতের ব্যাপার সমূহ তাঁর হৃদয়ে অবতীর্ণ হতে লাগল এবং ইয়াক্কীনের স্তরে গিয়ে পৌঁছাল। তখন তিন ভাবাবেগে কান্নায় ফেটে পড়লেন। অশ্র“র বন্যা প্রবাহিত হল, চোখের পানিতে পরিধেয় বস্ত্র, এমন কি ঘোড়া পর্যন্ত ভিজে গেল। তিনি খাঁটি মনে তওবা করলেন। সংসারের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা ও বীতশ্রদ্ধা জেগে উঠল। তিনি সদর রাস্তা ত্যাগ করে গভীর জঙ্গলের দিকে চলতে লাগলেন। কিছুদূর অগ্রসর হতেই চটের খশখশে লেবাস পরা এক রাখালের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হল, শাহী লেবাস তাকে দিয়ে তিনি তার চটের লেবাস পরিধান করলেন। বাদশাহ ইবরাহীম ইবনে আদহাম বাদশাহীর বিনিময়ে ফকিরী গ্রহণ পূর্বক খালি পায়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে লাগলেন। তখন থেকে নিজের গতকালের গুনাহ স্মরণ করে তওবা করতে লাগলেন এবং আল্লাহ তায়ালার দরবারে রোদন  করতে লাগলেন। এই রূপে ঘুরতে ঘুরতে ‘মারভ’ নগরে পৌঁছিলেন।
মারফের এক পুলের উপর দিয়ে কোন একজন অন্ধ লোককে যেতে দেখে তিনি আশক্ষ করলেন, লোকটি হয়ত পুল হতে পড়ে যাবে। তিনি আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করলেন, …… অর্থাৎ, ইয়া আল্লাহ তাকে রক্ষা রকুন। তৎক্ষণাৎ সেই অন্ধ লোকটি শূন্যে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়াল এবং ইবরাহীম আদহামকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে নিল। এই ব্যাপার দেখে তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। ভাবতে লাগলেন, সোবহানাল্লাহ ! তিনি কত বড় বুযুর্গ লোক। অতঃপর তথা হতে যাত্র করে নিশাপুরে পৌঁছলেন। সেখানে একটি প্রসিদ্ধ গুহা ছিল। নয় বৎসর, পর্যন্ত তিনি উক্ত গুহার মধ্যে অবস্থান করলেন এবং ‘মুজাহাদাহ’ ও সাধনায় প্রবৃত্ত থেকে আখেরাতে প্রচুর সম্বল সংগ্রহ করলেন। উক্ত গুহায় তিনি একাকী বাস করতেন, বৃহস্পতিবার তিনি গুহা হতে বের হয়ে জঙ্গল থেকে লাকড়ী সংগ্রহ করে নানতেন এভং শুক্রবার দিন সকাল বেলা তা বাজারে নিয়ে বিক্রয় করতেন। অতঃপর জুমআর নামাজ আদায় কের রুটি খরিদ করতেন এভং তার অর্ধাংশ ফকিরকে দান করি বাকী অর্ধাংশ নিয়ে গুহায় ফিরে যেতেন আর তা দ্বারা পরবর্তী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গুহায় অবস্থান করতেন এবং ইবাদতে মশগুল থাকতেন।
কথিত আছে, এক কনকনে শীতের রাত্রে তিনি বরফ গলা পানিতে গোসল করে ভোর পর্যন্ত ইবাদতে মশগুল থাকলেন। ভোর বেলায় তাঁর খুব শীত বোধ হল। শীতের প্রকোপে তিনি এত অবশ হয়ে পড়লেন যে, ভাবতে লাগলেন, আর জীবন রক্ষা পাবে না। মনে মনে কল্পনা করলেন, সামান্য কিছু আগুন পেলে কতই না ভাল হত। এই কল্পনা আসামাত্র তিনি অনুভব করলেন, কেহ যেন একখানা চর্মের চাদর তাঁর দেহের উপর জড়ায়ে দিয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে শরীর গসম হয়ে উল। তিনি ঘুমায়ে পড়লে। একটু পরে জেগে দেখতে পেলেন, তা চর্ম-চাদর নয় বরং একটি বিকটাকার অজগর। এই অজগরই তাঁকে শরীরকে গরম করে রেখেছে। তা দেখে তাঁর অন্তর ভয়ে কেঁপে উঠল। তিনি খোদার দ্বারে প্রার্থনা করলেন, “ইয়া আল্লাহ ! আপনি তো একে অনুগ্রহের আকারে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু আমি একে গজবের আকারে দেখছি। এই দৃশ্য বরদাশত করার শক্তি আমার নেই।” তৎক্ষণাৎ অজগরটি তাঁর দেহ ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
উক্ত নয় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে তাঁর আধ্যাত্মিক মর্যাদা জনগণের মধ্যে ছড়ায়ে পড়ল। লোকজনের সমাগম আরম্ভ হয়ে গেল। তা দেখে তিনি গুহা ত্যাগ করে মক্কা শরীফে চলে গেলেন। তৎকালে শায়খ আবু সাঈদ আবুল খায়ের রাঃ নামক জনৈক বুযুর্গ সেই গুহা দেখতে গিয়ে বলে উঠলেন, সোবহানাল্লাহ ! একজন আল্লাহওয়ালা মহা মানবের অবস্থানের ফলে এই গুহাটি যেমন আরামদায়ক সুগন্ধে পরিপূর্ণ হয়েছে।, তা যদি মেশকে পরিপূর্ণ থাকত তবু এত সুগন্ধ দান করত না।
কথিত আছে, ইবরাহীম আদহাম রাঃ যখন জঙ্গলে ঘুরছিলেন তখন একদিন একজন বুযুর্গ লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে আল্লাহ পাকের ‘ইসমে আযম’ (শ্রেষ্ঠতম নাম) শিখায়ে দেন। তিনি ঐ নামে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করতে আরম্ভ করেন। অকস্মাৎ তিনি একদিন হযরত খিজির আঃ কে দেখতে পান। তিনি বললেন, হে ইবরাহীম ! যিনি আপনাকে আল্লাহ তায়ালার ইসমে আযম শিখায়েছেন, তিনি আমার ভাই ইলিয়াস, অতঃপর তার ও খিজির আঃ এর মধ্যে বহু বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হল। তিনি হযরত খিজির আঃ এর মুরিদ হলেন। এর বদৌলতেই হযরত ইবরাহীম আদহাম এমন উচ্চ মর্যাদা লাভ করেন।
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম বলেন, আমি জঙ্গলে ভ্রমণ করতে করতে যাতুল এরাক নামক স্থানে পৌছে দেখলাম, ৭০ জন গুদড়ী পরিহিত দরবেশ একস্থানে নিহত অবস্থায় লোককে দেখলাম, তাঁর দেহে এখনও কিছুমাত্র প্রাণ বাকী রয়েছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে যুবক? তোমাদের এমন অবস্থার কারণ কি? তিনি বললেন, হে আদহাম ! শুধু পানি এবং ইবাদতখানাকে আঁকড়ায়ে ধর। আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে থেক না- তাঁর রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। খুব কাছে এসো না, কেননা, ব্যথা ও দুঃখে জর্জরিত হয়ে যাবে। আল্লাহ না করুন, কোন ব্যক্তি যেন শান্তির বিছানায় শায়িত থেকে এমন বেআদবী না করে। অর্থাৎ, শান্তিতে থেকে গুনাহের কাজ করে। এমন বন্ধুকে সর্বদা ভয় করে চলবে যিনি হাঝীদিগকে রূমদেশীয় কাফেরদের মত হত্যা করেন এবং হাজীদের সঙ্গে জেহাদ করেন। দেখ, আমরা সকলেই সূফী ছিলাম। আমরা সকলেই একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে অরণ্য ভ্রমণে যাত্র করেছিলাম। আমরা এরূপ প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমরা কখনও পরস্পর অন্য কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলব না, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারও দিকে মনোযোগ দিব না। আমরা যখন জঙ্গল অতিক্রম করে এহরাম বেঁধে স্থান মীকাতে পৌঁছলাম, তখন হযরত খিজির আঃ আমাদের সম্মুখে এসে পড়লেন। আমরা তাঁকে দেখে সালাম করলাম এবং আনন্দিত হলাম। আমরা মনে মনে বললাম ‘আলহামদুলিল্লাহ’ (যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য।) আমাদের চেষ্টা আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয়েছে এবং প্রার্থী প্রার্থিত বস্তু পর্যন্ত পৌঁছেছে। অর্থাৎ অন্বেষণকারী অন্বেষিত বস্তু প্রাপ্ত হয়েছে। ফলে এমন মহামানব আমাদের এস্তেকবালের জন্য এসেছে। তৎক্ষণাৎ আমাদের আত্মা সময়হকে লক্ষ্য করে গায়েবী সম্বোধ্ন হল, হে মিথ্যাবাদীর দল ! হে মিথ্যা দাবীদারগণ ! তোমরা কি আমার সঙ্গে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলে?  এখনই আমরাকে ভুলে গেল? আমাকে ছেঢ়ে অন্যের বন্ধুত্ব জুড়ে দিলে? আচ্ছা, কোন পরোয়া নেই এই অপরাধে এখনই আমি তোমাদের প্রাণ হরণ করে নিব এবং তোমাদের রক্ত প্রবাহিত করে দিব।  আমার রাজ্যে সর্বপ্রকার রক্তপাতই হয়ে থাকে। আগুনের পাতিলে লোবানের পরিবর্তে প্রাণসমূহ জ্বালান হয়। হে আদহাম যদি তোমরার খেয়াল আমাদের মত হয়ে থাকে, তবে তুমিও আমাদের সঙ্গে বধ্যভূমিতে চলে আস, অন্যথায় আমাদের নিকট থেকে দূরে সবে পড়। কেননা, আমরা নিহত বন্ধু, হযরত তুমি তোমার খেয়াল ঠিক রাখতে পারবে না, শেষে আমাদের দশা প্রাপ্ত হবে। এই যে, নিহত যুবকদের দেখছ তারা সকলেই এই একই অপরাধে দণ্ডিত। হে ইবরাহীম ! সাবধান হও, তোমার খেয়ালও যদি আমাদের মত হয়ে থাকে, তবে আমারেদ দিকে পা বাড়াইও অন্যথায় এখনও তোমার কিছুই হয়নি দূরে থাক। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ তা শুনে অবাক হয়ে পড়লেন। তিনি উক্ত মুমূর্ষু লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা বল তো তুমি কেমন করে রক্ষা পেলে? সে উত্তর করল, তাঁরা সকালে কামেল ছিলেন, আর আমি এখনও অপূর্ণ, এখনস কামেল হবার জন্য চেষ্টা করছি, যেন তাঁদের সঙ্গী হতে পারি, এতটুকু বলে তিনি প্রাণত্যাগ করলেন।
কথিত আছে, হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম একাধারে চল্লিশ বছর বাল প্রতি কদমেকদমে নামাজ পড়তে পড়তে এবং কান্নাকাটি করতে করতে মক্কা শরীফ পর্যন্ত পৌঁছলেন। হরম শরীফে অবস্থানকারী বুযুর্গ লোকগণ তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য বের হলেন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম তা জানতে পেরে সহযাত্রীগণ হতে পৃথক হয়ে একাকী সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়ে গেলেন যেন কেহ তাঁকে চিনতে না পারে। এস্তেকবালের জন্য আগত বুযুর্গ লোকদরে খাদেমগণ তাঁদের সম্মুখে চলতেছিল। তন্মেধ্যে একজন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহামকে দেখে প্রশ্ন করলেন, তারা এই বেদ্বীন লোকটির কাছে কি প্রত্যাশা করেন।
খাদেমগণ একথা শুনে তাঁর পায়ে ধরে ধাক্কা মারতে মারতে বলল, বেটা ! তুই এমন বুযুর্গ এবং আল্লাহওয়ালা মহাপুরুষকে বেদ্বীন বললি, তুই যিন্দীক তুই বেদ্বীন। ইবরাহীম বললেন, ভাই ! আমিও তো তাই বললাম যে, আমিই যিন্দীক (বেদ্বীন)। তারা তাঁকে ছেড়ে যখন সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে গেল তখন তিনি নিজের নফসকে সম্বোধন করে বললেন, হে নফস ! এই ভেবে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলি যে, মক্কার বুযুর্গগণ আমার এস্তেকবােেলর জন্য এসেছেন এবং মনে মনে তা আশাও পোষণ করছিলি, এখত তার উপযুক্ত শাস্তি পেলো তো? আমারও আশা ছিল শীঘ্রই তোর এই অপরাধের জন্য লাঞ্ছনা ও শাস্তি হোক। আলহামদুলিল্লাহ ! আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। ইতিমধ্যে আগন্তুকরা চিনে ফেলল যে, তিনিই হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ। সকলে তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং তাঁকে সসম্মানে মক্কায় নিয়ে গেলেন।
অতঃপর তিনি মক্কা শরীফে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন। মক্কাবারীরা অনেকে তাঁর মুরিদ হলেন। তিনি সর্বদা নিজে পরিশ্রম করে জঙ্গল হতে কাঠ কুড়ায়ে এনে বাজারে বিক্রি করতেন এবং তা দিয়ে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করতেন। কখনও ছাগ-মেষ চরায়ে এবং কখনও বা শাক-সবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
কথিত আছে, বলখ ত্যাগকালে তাঁর একটি শিশুপুত্র ছিল। সে বয়স্ক হয়ে স্বীয় মাতাকে জিজ্ঞাসা করল, মা, আব্বা কোথায়? মা তার পিতার গৃহত্যাগের ঘটনা আদ্যোপান্ত খুলে বললেন এবং এও বললেন যে, লোকমুখে শুনা যায়, তিনি বর্তমানে মক্কা শরীফে অবস্থান করছেন। পুত্র বলল, আপনার অনুমতি পেলে আমি মক্কায় গিয়ে খানায়ে কাবা জিয়ারত করব এবং আব্বাজানের অনুসন্ধান করে তার খেদমত করতে থাকব। অতঃপর পুত্র বলখ শহরে ঘোষণা করে দিলেন, কারো হজ্বের আকাক্সক্ষা থাকলে আমার সঙ্গী হতে পারে। আমি তার খাওয়া ও যানবাহনের যাবতীয় খরচ বহন করব। এই ঘোষণার ফলে চার হাজার হজ্বযাত্রী সমবেত হল। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহামের পুত্র আপন মাতাসহ উক্ত চার হাজার লোকের খাওয়া এবং যানবাহনের খরচ দিয়ে মক্কা শরীফে নিয়ে গেলেন। মক্কা শরীফে পৌঁছে হরম শরীফে আসতেই গুদড়ী পরিহিত একদল দরবেশের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হল। তিনি তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি ইবরাহীম ইবনে আদহাম কে চিনেন? তাঁরা বললেন, তিনিই তো আমাদের পীর-মোর্শেদ। পুত্র জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি এখন কোথায় আছেন? তাঁরা উত্তর করলেন, তিনি এখন জঙ্গলে কাঠ কুড়াতে গেছেন, কাঠ এনে বাজারে বিক্রি করে তদ্বারা আমাদের জন্য রুটি খরিদ করে আনবেন। এ কথা শুনে পিতার অন্বেষণে জঙ্গলের দিকে চললেন। কিছু দূর অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলেন এক বৃদ্ধ কাঠের বোঁঝা কাঁধে করে আসছেন। পিতার এই অবস্থা দর্শনে পুত্র বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং তাঁর চক্ষু বয়ে অশ্র“ গড়ায়ে পড়তে লাগল। কিন্তু নিজেকে দমন করে রাখলেন। তিনি বৃদ্ধের পাছে পাছে চলতে লাগলেন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম বাজারে এসে উচ্চস্বরে বললেন, হালাল অর্থের বিনিময়ে হালাল মালের খরিদ্দার কেহ আছে কি? তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি এসে তাঁর লাকড়ীগুলো খরিদ করল এবং তাঁকে রুটি দিয়ে দিল। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রুটি নিয়ে মুরিদদের কাছে আসলেন। তাদের সামনে রুটি রেখে তিনি নামাজে দাঁড়ালেন। মুরিদগণ রুটি আহার করতে লাগল।
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ মুরিদগণকে নসিহত করতেন, দেখ, নিজেদের দাড়ি-গোঁফ বিহীন বালকদের প্রতি দৃষ্টি করা থেকে রাক্ষা করিও, বিশেষতঃ বর্তমান সময়ে স্ত্রীলোক এবং বালকদের সংখ্যা অধিক হয়ে গেছে। মুরিদেরা সকলে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী নিজদের সংযত করে রেখেছিল। হাজীরা যখন তওয়াফ আরম্ভ করে দিল, তখন তিনিও মুরিদদের নিয়ে তওয়াফ করতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে তওয়াফ করতে করতে তাঁর পুত্র তাঁর সম্মুখে এসে পড়ল। তিনি এক দৃষ্টিতে অপলক নেত্রে পুত্রের প্রতি তাকায়ে রইলেন। তা দেখে মুরিদগণ বিস্মিত হয়ে গেল। তওয়াফ শেষে মুরিদরা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, হযরত ! আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, আপনি আমাদের তো নিষেধ করেছেন যে, দাড়ি ও গোঁফবিহীন বালক এবং স্ত্রীলোকের প্রতি দৃষ্টি করো না। অথচ আজ আপনি একটি দাড়ি-গোঁফবিহীন সুদর্শন বালকের দিকে অনেকক্ষণ তাকায়ে থাকলেন। এতে কি রহস্য রয়েছে, আমাদের খুলে বলুন। তিনি বললেন, আমি বলখ ত্যাগ করার সময় একটি দুগ্ধপোষ্য পুত্র সন্তান রেখে এসেছিলাম। এই সুদর্শন বালকটিকে দেখে আমার মনে হচ্ছে যে, এই বালকটিই আমার সেই পুত্র। পরবর্তী দিন তাঁর একজন মুরিদ বলখের কাফেলার সন্ধানে বের হয়ে দেখল একটি রেশম নির্মিত তাঁবুর মধ্যে সুরসীর উপর বসে সেই সুদর্শন বালকটি কুরআন শরীফ তেলওয়াত করছে। আর তাঁর গণ্ডদ্বয় বেয়ে অবিরত ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। উক্ত মুরিদ অনুমতিক্রমে ভিতরে প্রবেশপূর্বক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? তিনি উত্তরে বললেন, বলখ হতে। মুরিদ আবার জিজ্ঞাসা করল, আপনি কার পুত্র? তিনি উত্তরে বললেন, আমি গতকাল ভিন্ন আর কখনও আমার পিতাকে দেখিনি। কাজেই সঠিক বলতে পারি না যে, তিনিই আমার পিতা না অন্য কেহ? এবং এই ভয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না যে, আমি জিজ্ঞাসা করলে পাছে তিনি আবার পলায়ন না করেন। কেননা, তিনি আমাদের সকলের ছেড়ে পালায়ে এখানে এসেছেন। আর আমার পিতার নাম ইবরাহীম ইবনে  আদহাম। মুরিদটি তখন বললেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন আমি আপনাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাব।
এই সময় হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ রোকনে ইয়ামানী নামক স্থানে নিজের মুরিদদের নিয়ে বসেছিলেন। দূর থেকে তিনি দৃষ্টি করে দেখতে পেলেন, তাঁর মুরিদ তাঁর পুত্র ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন। নিকটে আসলে তাঁর স্ত্রী দৃষ্টি তাঁর উপর পতিত হল। তৎক্ষণাৎ স্ত্রী অস্থির হয়ে বিলাপ সহকারে রোদন করতে লাগলেন এবং বললেন, দেখ ইনি তোমার পিতা। উপস্থিত মুরিদগণও এই করুণ অবস্থা দর্শন করে অশ্রু সংবরণ করতে পারল না। আশপাশে যত লোক ছিল কেহ অশ্রু সংবরণ করতে পারল না। তাঁর পুত্র বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। সংজ্ঞা প্রাপ্ত হলে পিতাকে সালাম করলেন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম সালামের জবাব দিয়ে পুত্রকে বুকে টেনে নিলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন ধর্মে আছ? তিনি উত্তর করলেন, হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর ধর্মে আছি। ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কুরআন শরীফের জ্ঞান লাভ করেছ কি? পুত্র উত্তর করলেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি দ্বীনী এলম কিছু শিক্ষা করেছ কি? এবারেও পুত্র হ্যাঁ বললেন। ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। অতঃপর হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম সেই স্থান ত্যাগ করার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু পুত্র তাঁকে ছাড়লেন না। বেগম সাহেবাও ক্রন্দন করতে লাগলেন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ আকাশের দিকে মুখ উঠায়ে বলতে লাগলেন, ইয়া আল্লাহ ! আপনি আমাকে সাহায্য করুন। তৎক্ষণাৎ তাঁর পুত্র তাঁর কোলেই প্রাণত্যাগ করলেন। মুরিদগণ বিস্মিত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হযরত ! একি হল? তিনি বললেন, পুত্রকে আলিঙ্গন করা মাত্র আমার অন্তরে তাঁর প্রতি মহব্বতের উদয় হল। তৎক্ষণাৎ পরওয়ার দেগারের তরফ থেকে আওয়াজ আসল, ইবরাহীম ! তুমি আমার বন্ধুত্বের দাবি করে থাক, এখন দেখছি আমার ভালবাসার সাথে তুমি অন্যকেও হৃদয়ে স্থান দিয়েছ। তুমি মুরিদদের নসিহত করে থাক, সন্তান ও স্ত্রীর প্রেমে মুজও না। আর তুমিই এখন নিজের স্ত্রী পুত্রের ভালবাসায় মজে যাচ্ছ। এই গায়েবী আওয়াজ পেয়ে আমি আল্লাহ পাকের কাছে আরজ পেশ করলাম, ইয়া আল্লাহ ! যদি পুত্রের মহব্বত আমাকে আপনার মহব্বত থেকে বঞ্চিত রাখে, তবে আপনি হয় আমার প্রাণ হরণ করুন অথবা তাঁদের প্রাণ গ্রহণ করুন, আল্লাহ তায়ালা আমার দোয়া পুত্র সম্বন্ধেই কবুল করলেন।
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বলেন, কাবা গৃহে একাকী তাওয়াফ এবং মুনাজাত করার সুযোগ আমি বহুদিন থেকে তালাশ করছিলাম। কিন্তু তেমন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। ঘটনাক্রমে একরাত্রিতে অধিক বৃষ্টি হওয়ার ফলে আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় তাওয়াফকারী ছিল না। সেই সুযোগে আমি খানায়ে কাবার দেয়ালে হাত রেখে নিজের গুনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করলাম। গায়েব হতে আওয়াজ হল, ইবরাহীম ! তোমার মত সমস্ত মাখলুক আমার কাছে এই প্রার্থনাই করে থাকে। আমি যদি সকলকে এখানেই মাফ করে দেই তবে আমার ক্ষমা ও দয়াগুণের উত্তাল তরঙ্গায়িত দরিয়া কি কাজে লাগবে? হযরত ইবরাহীম রাঃ বলেন, তা শুনে আমি বললাম, ইয়া আল্লাহ ! আপনি কেবলমাত্র আমারই গুনাহ মাফ করে দিন। আবার আওয়ায আসল, ইবরাহীম ! তোমার উচিত সারা দুনয়ার মানুষের জন্য আমার দরবারে দোয়া করা এবং তোমার নিজের বিষয় মোটেই উল্লেখ না করা। আর দুনিয়ার সকলেই তোমারর জন্য আমার কাছে প্রার্থনা করুক তাই তোমার জন্য মঙ্গল।
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ মুনাজাতে বলতেন, এলাহী ! আপনি আমার প্রতি দয়া করে আমাকে মর্যাদা দান করেছেন, তৎতুলনায় আটি বেহেশত নিতান্ত নগণ্য। আর আপনি যে মহব্বত আমাকে দান করেছেন এবং আমার অন্তরে আপনার জিকিরের প্রতি যে অনুরাগ দান করেছেন এবং আপনার মহিমা ও মাহাত্ম্য চিন্তনের সময় আমাকে যে প্রশস্ততা দান করেছেন এই সমুদয়ের তুলনায় আটটি বেহেশত তো কিছুই নয়। তিনি মুনাজাতে এও বলতেন, এলাহী ! আমাকে নাফরমানী লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা অবস্থা থেকে মুক্ত করে ইবাদত বন্দেগীর ইজ্জত দান করুন। তিনি মুনাজাতে আরও বলতেন, এলাহী ! যে ব্যক্তি আপনার পরিচয় লাভ করেছে সেও জানে না যে, যে ব্যক্তি আপনাকে মোটেও চিনে না তার কি অবস্থা হবে?
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বলেন, আমি ইবাদত ও জিকির-ফিকিরে ১৫ বছর কঠিন পরিশ্রম ও সাধনার পর একদিন গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেলাম, তুমি আরাম ও শান্তির ফাঁদে আটকা পড়ে আছ, আল্লাহ তায়ালার খাঁটি বান্দা হয়ে যাও। অর্থাৎ তাঁর আদেশ ও নিষেধসমূহ যথাবিহীতরূপে পালন করার জন্য সচেষ্ট ও যতœবান হও।
একদিন কতিপয় লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি বাদশাহী ত্যাগ করলেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, একদিন আমি সিংহাসনে সমাসীন ছিলাম। খাদেম আমার সামনে একখানা আয়না এনে রাখল, আমি তাতে দৃষ্টি করতেই দেখতে পেলাম আমার স্থান কবরে। আমি তথায় নিতান্ত একাকী, সঙ্গী বা দুঃখের সাথী কেউ নেই। তা সত্ত্বেও দেখলাম, অতি দূর দারাযের দীর্ঘ পথ আমাকে অতিক্রম করে যেতে হবে, তদুপরি আরও দেখলাম, এই দীর্ঘ সফরের জন্য আমার কাছে কোনই পাথেয় নেই- একান্ত নিঃসম্বল আমি, আরও দেখতে পেলাম, হাকিম ও মুন্সেফ বিচারাসনে সমাসীন, কিন্তু আমার কাছে নিজের নির্দোষিতার কোনই দলিল প্রমাণ নেই। এসমস্ত অবস্থা দর্শনে আমার হৃদয় থেকে বাদশাহীর মোহ দূর হয়ে গেল।
লোকে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আপনি খোরাসান থেকে পলায়ন করে আসলেন কেন? তিনি বললেন, সেখানে বার বার লোক এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করত আপনি কাল কেমন ছিলেন এবং আজ কেমন আছেন? লোকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি স্ত্রী গ্রহণ করেন না কেন? তিনি বললেন, কোন স্ত্রীলোক এমন স্বামী গ্রহণ করতে রাজী হতে পারে, যার কারণে তাকে খালি পায়ে ও অনাহারে থাকতে হবে? আমার দ্বারা সম্ভব হলে তো আমি আমার নিজেকেই তালাক দিতে প্রস্তুত। অতএব বলুন তো আমি একজন নারীকে আমার প্রতারণা ও ধোঁকার বাধনে কেমন করে বেধে রাখতে পারি?
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ একজন দরবেশকে অন্য দরবেশের গীবত করতে শুনলেন। তিনি উক্ত দরবেশকে তিরস্কার করে বললেন, আমার মনে হয় তুমি দরবেশী বিনা মূল্যে খরিদ করেছ। সেই দরবেশ বললেন, দরবেশীও কি খরিদ করার বস্তু? তিনি বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। দেখনা আমিই তো বলখের রাজ সিংহাসনের বিনিময়ে দরবেশী খরিদ করেছি এবং এখন পর্যন্ত লাভেই আছি। কেননা ইহা বাদশাহীর চেয়ে অধিক মূল্যবান বস্তু।
একদিন তিনি কোন এক দরবেশকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার স্ত্রী আছে কি? দরবেশ উত্তর করলেন, না। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, পুত্র? দরবেশ বললেন, তাহাও না। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, খুব ভাল আছ। তিনি বললেন, যে দরবেশ স্ত্রী গ্রহণ করেছে, সে যেন নৌকায় আরোহণ করেছে। যদি সেই স্ত্রীর গর্ভে কোন পুত্র জন্মগ্রহণ করে তবে যেন তার নৌকা ডুবে গেল।
কথিত আছে, একদা কোন এক ব্যক্তি এক হাজার দেরহাম পূর্ণ একটি থলি এনে হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে বললেন, আপনি এই এক হাজার দেরহাম গ্রহণ করুন। তিনি বললেন, আমি দরিদ্র লোকের কোন দান গ্রহণ করি না। আগন্তুক বললেন, আমি যথেষ্ট ধন সম্পদের মালিক। আমি দরিদ্র নই। হযরত ইবরাহী আদহাম রাঃ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার যে ধন-সম্পদ আছে তুমি কি এর চেয়ে আরও অধিক কিছুর প্রয়োজন বোধ কর? সে বলল, হ্যাঁ, প্রয়োজন তো আছেই। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, তুমি এখানে যা এনেছ ফিরায়ে নিয়ে যাও। কেননা সকলের চেয়ে নীচ দরিদ্র তুমিই। সত্যি কথা এই যে, তোমার অবস্থাকে দরিদ্রতা না বলে ভিক্ষাবৃত্তি বলা সঙ্গত। অতঃপর তিনি স্বাগতভাবে বললেন, আমি দারিদ্রের অন্বেষণ করে অভাবশূন্যতা লাভ করেছি আর লোকে ধন-দৌলত অন্বেষণ করে দরিদ্রতা লাভ করেছে। আর এক ব্যক্তি দশ হাজার দেরহাম তাঁকে দান করতে চাইল। তিনি বললেন, তুমি এই সামান্য কয়েক হাজার দেরহামের বিনিময়ে আমার নাম দরবেশীর তালিকা থেকে মুছে ফেলতে চাও?
যখন তাঁর উপর গায়েব হতে আল্লাহ পাকের ফায়েজমূলক কোন হালের উদয় হত, তখন তিনি বলতেন, কোথায় দুনিয়ার রাজা বাদশাহগণ? তারা এসে দেখুক, এখানে কি বিচিত্র কাণ্ড ঘটছে? তা দেখে তারা নিজেদের বাদশাহীর মোহে মুগ্ধ থাকার জন্য লজ্জিত হোক।
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আউলিয়াগণের দলভুক্ত হতে চাও? সে বলল, হ্যাঁ, চাই। তিনি বললেন, তবে দুনিয়ার কোন বস্তুর প্রতি এক রেণু পরিমাণ অনুরাগও মনে স্থান দিও না। আল্লাহ তায়ালার প্রতি মনোযোগী ও অনুরাগী হয়ে যাও, নিজেকে আল্লাহ ভিন্ন অপরাপর যাবতীয় পদার্থের মোহ থেকে মুক্ত করে ফেল।হালালা খাদ্য খাও, রাত্রি কালে জাগ্রত থেকে নফল ইবাদত করলে এবং দিবসে নফল রোজা যথেষ্ট পরিমাণ রাখতে না পারলেও হালাল খাদ্যের ফলে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টিজনক অবস্থায় উন্নত হওয়া তোমার পক্ষে সহজ হয়ে পড়বে। তিনি আরো বলেছেন, কোন মানুষই হালাল খাদ্য না খেয়ে শুধু রোজা, নামাজ, হজ্ব এবং জেহাদ করে অলি-আল্লাহর দরজা লাভ করতে পারেনি।
লোকেরা হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে বলিল, উমুক স্থানে একজন যুবক খুব রিয়াজন ও ইবাদত করে থাকে এবং তিনি খোদা প্রেমে একান্ত বিভোর। হযরত ইবরাহীম আদহাম রাঃ বললেন, তোমরা আমাকে তার কাছে নিয়ে চল, আমি তাকে একটু দেখব। তিনি সেখানে পৌঁছালে যুবক তাঁকে তিন দিনের জন্য আথিথেয়তা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। তার অনুরোধে তিনি তিন দিনের জন্য সেখানে অবস্থান করলেন এবং যুবকের ইবাদতের অবস্থা অনুধাবন করতে লাগলেন। লোকেরা যুবকটির ইবাদতের অবস্থা তাঁর কাছে যা বলেছিল তিনি তার থেকে বেশি দেখতে পেলেন। হযরত ইবরাহীম রাঃ তা দেখে নিজের প্রতি ধিক্কার দিতে লাগলেন, আমি তো যৎসামান্য রিয়াজত করে নিরুৎসাহ ও ম্লান হয়ে পড়ি। আর এই ব্যক্তি সারারাত্রি জাগ্রত থেকে চঞ্চল গতিতে ইবাদত করে থাকে। হঠাৎ তাঁর মনে হল, আচ্ছা তার অবস্থা একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক, তা হলে বুঝা যাবে তার কার্যকলাপের মধ্যে শয়তানের কোন দখল আছে কি না? আর তার সমুদয় আমল খাঁটি আল্লাহর জন্য কিনা? অতঃপর তিনি মনে মনে বললেন, প্রথমে খোঁজ নিয়ে দেখা যাক, যে হালাল খাদ্য আহার করা যাবতীয় আমল খাঁটি হওয়ার মূল ভিত্তি, এতে তার কোন ত্র“টি আছে কিনা। তিনি অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন তার খাদ্য হালাল রুজি দ্বারা সংগৃহীত হচ্ছে না। তিনি মনে মনে বললেন, আল্লাহু আকবর, এই ব্যক্তি শয়তান। অতঃপর তিনি উক্ত যুবককে বললেন, তুমিও তিন দিনের জন্য আমার আতিথ্য গ্রহণ কর এবং আমার সঙ্গে আমার বাড়ি চল। এই বলে যুবককে নিজের সঙ্গে নিয়ে আসলেন। তিন দিন যাবত তাকে নিজের হালাল খাদ্য খাওয়ালেন। এর ফলে যুবকের সেই উৎসাহ ও চাঞ্চল্যকর অবস্থার অবনতি ঘটল। তার পূর্বের সেই উদ্যম, আগ্রহ এবং এশক রইল না। সে বলল হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম কে বললেন, আপনি আমার একি সর্বনাশ করলেন? তিনি বললেন, আমি তোমার কোন সর্বনাশ করিনি। আসল ব্যাপার এই যে, তোমার জীবিকা হালাল ছিল না। সে কারণে হারাম জীবিকার সঙ্গে শয়তান তোমার অভ্যন্তরে যাতায়াত করত। এখন আমার হালাল খাদ্য তোমার ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র আসল ব্যাপার প্রকাশ পেয়েছে। এতে তুমি বুঝতে পারবে যে, এই খেদমতের অর্থাৎ ইবাদরেত ভিত্তি হালাল লোকমার উপর।
তিনি একদিন সুফইয়ান রাঃ কে বললেন, তোমার দ্বীনী এলেম যথেষ্ট রয়েছে কিন্তু তোমার মধ্যে সামান্য মাত্র বিশ্বাসের অভাব রয়েছে।
বর্ণিত আছে, হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ দিনের বেলায় মাঠ হতে ঘাস সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতেন এবং বিক্রি লব্ধ অর্থ গরীব-দুঃখী ও দরবেশদের মাঝে বিতরণ করতেন। অতঃপর নিজে সারারাত্র জাগ্রত থেকে ভোর পর্যন্ত ইবাদত করতেন। লোকে জিজ্ঞেস করল, বলুন তো, কোন সময় আপনার ঘুম আসে না কেন? তিনি উত্তর করলেন, কারণ এই যে, মুহূর্তের জন্য আমার চক্ষুর অশ্র“ বর্ষণ বন্ধ হয় না। তোমরাই বল, এমন অবস্থার লোকদের কাছে নিদ্রা কেমন করে আসতে পারে? কথিত আছে, তিনি নামাজ শেষ করামাত্র দুই হাতে নিজের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতেন এবং বলতেন, আমার আশঙ্কা হচ্ছে পাছে আমরা এই নামাজ আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হওয়ার উপযোগী হয়নি বলে আমার মুখের উপর না নিক্ষেপ করা হয়।
কথিত আছে, একদিন তাঁর কোন খাদ্যাই জুটল না। তিনি বললেন, এলাহী ! আমি এর শোকরানা স্বরূপ চার রাকআত নামাজ পড়ব। দ্বিতীয় রাত্রেও তাঁর কোন খাদ্য জুটল না। এবারও তিনি শোকরানা স্বরূপ চার রাকআত নামাজ পড়লেন। এইভাবে সাত রাত্র কেটে গেল তার কোন খাদ্য জুটল না এবং প্রতি রাত্রে তিনি চার রাকআত নামাজ পড়লেন। অবশেষে তিনি দুর্বল হয়ে পড়লেন, এবং প্রার্থনা করলেন, এলাহী ! এখন যদি আপনি কিছু খাবার দান করেন, তবে খুবই ভাল হয়। তৎক্ষণাৎ সেখানে এক যুবক এসে জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি খাদ্যের আবশ্যক আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যুবক বলল, আচ্ছা তবে আপনি আমার দাওয়াত গ্রহণ করুন এবং আমার বাড়ি চলুন। যুবক তাঁকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছল এবং তাঁর চেহারার প্রতি দৃষ্টি করেই উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, হুজুর আমি তো আপনারই সেই পুরাতন গোলাম। আমার যা কিছু দেখছেন, সবই আপনার। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, আমি তোমাকে আজাদ করে দিলাম এবং তোমার কাছে যা কিছু আছে তা সবই তোমাকে দান করে দিলাম। এখন আমাকে অনুমতি দাও আমি বাসস্থানে চলে যাই। অতঃপর তিনি আবার আল্লাহ পাকের দরবারে আরজ পেশ করলেন, ইয়া আল্লাহ ! আমি প্রতিজ্ঞা করছি, অতঃপর আমি একমাত্র আপনাকে ভিন্ন অন্য কোন বস্তুই প্রার্থনা করব না। কেননা আমি আপনার কাছে এক টুকরা রুটি চেয়েছিলাম আপনি গোটা দুনিয়া আমার সামনে এনে হাজির করলেন।
আ’তায়ে সালমী আবদুল্লাহ মুবারক রাঃ হতে বর্ণিত, একবার হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ সফরে গিয়াছিলেন। তাঁর কাছে পথের সম্বল কিছুই ছিল না। ৪০ দিন পর্যন্ত তিনি অনাহারে দিন কাটালেন। কিন্তু সঙ্গীদের কষ্ট হবে মনে করে কারো কাছে কিছু চাননি।
সাহাল ইবনে ইবরাহীম বলেন, আমি একদা হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহামের সাথে সফরে গিয়েছিলাম। ঘটনা চক্রে আমি পীড়িত হয়ে পড়লাম, তাঁর কাছে যা কিছু ছিল সবই তিনি আমার খানাপিনায় ব্যয় করে ফেলেন। অতঃপর তিনি নিজের গাধাটি বিক্রয় করেও আমার জন্য ব্যয় করলেন।  আমি আরোগ্য লাভ করে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, গাধাটি কোথায়? তিনি বললেন, বিক্রি করে দিয়েছি। আমি বললাম, এখন আমি কিসে আরোহণ করব? তিনি বললেন, আমার কাঁধে করে চড়। আমি অত্যন্ত দুর্বল ছিলাম, না চড়ে উপায় ছিল না। তিনি আমাকে কাঁধে করে তিন মঞ্জিল পথ পাড়ি দিলেন। আ’তায়ে সালমী বলেন, এক সময়ে তাঁর কাছে কোন খাদ্য-দ্রব্য ছিল না। একদিক্রমে পনের দিন তিনি বালু খেয়ে জীবন ধারণ করেছিলেন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বলেছেন, মক্কা মুয়াজ্জামায় অবস্থানকালে ৪০ বছর মক্কা শরীফের কোন ফল আহার করিনি। কেননা সৈন্য বিভাগের লোকেরা মক্কার অনেকগুলো ফলের বাগান ক্রয় করে রেখেছিল।
তিনি পায়ে হেঁটে বহুবার হজ্ব করেছিলেন কিন্তু যমযম কূপের পানি পান করেননি। কেননা, কূপের বালতি ছিল বাদশাহ, বাদশাহ প্রদত্ত বালতি দ্বারা পানি উঠায়ে পান করা তিনি পছন্দ করেননি।
যদি কেহ হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ এর নিকট মুরিদ হয়ে তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য আবেদন করত, তবে তিনি তার প্রতি তিনটি শর্ত আরোপ করতেন। ১. সকলের খেদমত তিনি নিজে করবেন, ২. নামাজের আজান তিনি নিজে দিবেন ও ৩. খাদ্যদ্রব্য কিছু পাওয়া গেলে তা সকলে সমানভাবে নণ্টন করে খাবেন। একবার জনৈক নবাগত মুরিদ এরূপ শর্ত আরোপের পর বলে উঠলেন, হযরত ! আমার দ্বারা এই শর্ত মেনে চলা সম্ভব হবে না। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, তোমার সততা দেখে আমি বিস্মিত হলাম।
এক ব্যক্তি দীর্ঘকাল হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ এর সংসর্গে থাকার পর বিদায় গ্রহণকালে বললেন, হযরত ! আপনি আমার মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি দেখতে পেয়েছেন, অনুগ্রহ পূর্বক সে সম্বন্ধে আমাকে অবহিত করে দিন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, ভাই ! আমি তো তোমাকে সর্বদা বন্ধুরূপে দেখেছি, কাজেই তোমার কোন দোষ আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি। তোমার ভিতরে কোন দোষ আছে কি না তা অপর কারো কাছে জিজ্ঞেস কর।
লোকেরা তাঁর কাছে একদিন জিজ্ঞাসা করল, যখন থেকে আপনি এই ফকিরী অবলম্বন করেছেন, তখন থেকে আজ পর্যন্ত কোন দিন কোন কিছু আনন্দও লাভ করেছেন? তিনি উত্তর করলেন, কয়েকবারই লাভ করেছি। তন্মেধ্যে প্রথমবারের কথা বলছি। একদিন আমি খেয়া নৌকা চড়ে নদী পার হচ্ছিলাম, আমার পরিধানে ময়লা ও ছেঁড়াফাটা কাপড় এবং মাথায় ধুলাবালিপূর্ণ আলুথালু চূল দেখে নৌকার আরোহীরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, তার মধ্যে এক কৌতুকী লোক বারবার আমার মাথার চুল টানছিল এবং ঘাড়ে ধাক্কা মারছিল। নফসের এই অপমান ও লাঞ্ছনা লক্ষ্য করে আমি খুবই আনন্দ অনুভব করছিলাম। কেননা আমি তখন মনে করছিলাম, নফসের যেমন শান্তি হওয়া উচিত ছিল, তেমন শান্তিই সে পাচ্ছে। ইতিমধ্যে হঠাৎ নদীর পানিতে প্রচণ্ড আলোড়ন আরম্ভ হল। আরোহীরা সকলে মনে করল, নৌকা ডুবে যাবে। মাঝি বলল, নৌকা থেকে একজনকে নদীতে ফেলে দিন, তাহলে নদীর উত্তেজনা থেমে যাবে। আরোহীরা এসে আমার কান ধরে আমাকে নদীতে ফেলে দিতে চাইল। কিন্তু আমার কান স্পর্শ করতেই নদীর উত্তেজনা থেমে গেল, নৌকাও স্থির হয়ে গেল। যখন তারা আমার কান ধরেছিল, তখন আমি খুবই আনন্দ অনুভব করছিলাম। কেননা, আমি দেখতে পেলাম, নফসের যেমন শাস্তি হওয়া উচিত তেমন শাস্তিই সে পাচ্ছে। তিনি বললেন, আর একবার আমি একটু বিশ্রাম করার জন্য এক মসজিদে গেলাম, কিন্তু লোকেরা আমাকে মসজিদে শয়ন করার অনুমতি দিল না। অথচ আমি এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, আমার মুহূর্তকাল দাঁড়ায়ে থাকার শক্তিও ছিল না। আমি শুয়ে পড়লাম। লোকেরা আমার পা ধরে টেনে মসজিদের সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসল এবং আমাকে ধাক্কা মেরে বাইরের দিকে ফেলে দিল। আমি গড়ায়ে পড়ার সময় প্রত্যেকটি সিঁড়িতে পড়ে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত খেতে খেতে একেবারে নিচে গিয়ে পড়লাম। প্রত্যেক সিঁড়ির উপর পড়ে শরীরে চোট লাগতেই মারেফাত রাজ্যের এক এক অংশের গোপন রহস্য আমার কাছে উদঘাটিত হতে লাগল। তখন আমি মনে মনে বলতে লাগলাম- আহা কতই না আনন্দের বিষয় হত যদি সিঁড়ির সংখ্যা আরও অধিক হত। তা হলে আমি মারেফাতের গোপন রহস্য আরো জানতে পারতাম এবং আরো আনন্দ লাভ করতে পারতাম। আর একবার আমি ঘটনাক্রমে এক মজলিশে গিয়ে পড়লাম। সেই মজলিশে একজন লোকও আমার পরিচিত ছিল না। আমি নীরবে বসে আছি, এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমার মাথার উপর প্রসাব ঢেলে দিল। এতে আমি খুব আনন্দ অনুভব করলাম। আর একবার আমার গয়ে একটি চামড়ার চাড়র ছিল, তা উকুনে পরিপূর্ণ ছিল। উকুন আমাকে দংশন করতেছিল, তখন হঠাৎ আমার বাদশাহী আমলের মূল্যবান ও সুকোমল মসৃণ পোষাকের কথা স্মরণ হল এবং নফস ভিতর থেকে ফরিয়াদ করতে লাগল, কেমন আরাম ত্যাগ করে তুমি আমাকে এই কষ্টে ফেললে? তখন আমি নফসকে তার আকাক্সিক্ষত দ্রব্য থেকে বঞ্চিত হতে দেখে খুব আনন্দ অনুভব করলাম।
একদিন খলিফা মুতাসেম বিল্লাহ হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার পেশা কি? তিনি উত্তর করলেন, আমি দুনিয়াকে এর প্রত্যাশীদের জন্য ত্যাগ করেছি এবং আখেরাতকে এর অন্বেষণকারীদের জন্য ত্যাগ করেছি আর নিজের জন্য এই জগতে খোদার জিকিরকে বেছে নিয়েছি এবং পরজগতে নিজের জন্য আল্লাহ পাকের দীদারকে পছন্দ করেছি। আর এক ব্যক্তি একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে জিজ্ঞাসা করল, আপনার পেশা কি? তিনি জান না যে, আল্লাহর কাজে মগ্ন লোকদের কোন পেশার প্রয়োজন হয় না?
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ খোদার উপর ভরসা করে ময়দানের দিকে বের হয়ে পড়লেন। সেখানে কয়েকদিন পর্যন্ত তাঁর কোন খাদ্যই জুটল না। নিকটেই তাঁর এক বন্ধু ছিল, তিনি তাঁর কাছে যেতে মন্সথ করলেন, কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর খেয়াল হল, বন্ধুর কাছে গেলে তো আমার তাওয়াক্কুল নষ্ট হয়ে যাবে। অত্রএব, তিনি বন্ধুর কাছে না গিয়ে এক মসজিদে ঢুকে পড়লেন এবং বলে উঠলেন, “আমি সেই পবিত্র সত্তার উপর ভরসা করলাম যিনি  চিরঞ্জীব, যাঁর কখনও মৃত্যু নেই।” একথা শেষ হতে না হতে গায়েব থেকে আওয়াজ আসল, “সেই সত্তা একান্ত পবিত্র, যিনি দুনিয়ার বুক থেকে সত্যিকার তাওয়াক্কুলকারীদের উঠায়ে নিয়েছেন, তুমি একজন ভণ্ড তাওয়াক্কুলকারী।” তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন?” আবার গায়েব হতে আওয়াজ আসল, “এমন ব্যক্তি কেমন করে তাওয়াক্কুলকারী হতে পারে, যে ব্যক্তি খাদ্যের জন্য দুনিয়ার বন্ধুর শরণাপন্ন হওয়ার ইচ্ছা মনে স্থান দিতে পারে? আবার একথাও বলে যে, আমি এমন পবিত্র সত্তার উপর ভরসা করলাম, যিনি চিরঞ্জীব ও অমর। আর মিথ্যাকে তাওয়াক্কুল আখ্যা দেয়।”
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ একবার জনৈক তাওয়াক্কুলকারী ‘যাহেদ’ ব্যক্তিকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেমন করে এবং কোথা থেকে রিজিক পেয়ে থাকেন? তিনি উত্তর করলেন, রিজিক কেমন করে কোথা থেকে আসে। আমি সে তথ্য অবগত নই। রিজিকদাতাকে এসম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা উচিত। এসমস্ত অনর্থক কথার সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই।
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বলেন, একদিন আমি একটি গোলাম ক্রয় করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি? সে জবাব দিল, আপনি আমাকে যে নামে ডাকেন, তাই আমার নাম হবে। আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম, তুমি কি খাও? সে জবাব দিল, আপনি যা খেতে দিবেন তাই খাব। আমি আবার জানতে চাইলাম, তুমি কি কাপড় পর? সে উত্তর করল, আপনি যা পরাবেন তাই পরব। আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম, তুমি কি কাজ কর? সে এবারেও বলল, আপনি যা করতে নির্দেশ দিবেন তাই করব। আবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমর মন কি চায়? সে উত্তর করল, কামনা বাসনার সঙ্গে গোলামের কি? গোলামের এ সমস্ত উত্তর শুনে আমি নিজের মনকে বললাম, ওরে নিঃস্ব ! তুই সারা জীবনও কোনদিন আল্লাহ তায়ালার এরূপ গোলাম হতে পারলি না। এমন দাসত্ব আমাকে এই গোলামের নিকট হতে শিক্ষা করা উচিত। এই বলে আমি রোদন করতে করতে বেহুশ হয়ে পড়লাম।
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কখনও চারজানু হয়ে বসতেন না। লোক তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, একদিন আমি চারজানু হয়ে বসেছিলাম, তখন গায়েব হতে আওয়াজ আসল, হে আদহামের পুত্র ! গোলাম কি কখনও তার মালিকের সামনে এরূপ শান-শওকাতের সাথে বসতে পারে! তৎক্ষণাৎ আমি তওবা করে দুইজানু হয়ে নামাজের কায়দায় বসলাম, তখন থেকে আর কখনও আমি চারজানু হয়ে বসিনি।
একবার কয়েকজন লোক তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কার বান্দা ! এই প্রশ্ন শুনে তিনি কাঁপতে লাগলেন। কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। একটু পরেই উঠে এই আয়াতটি পাঠ করলেন-
নিঃসন্দেহে, আসমানে এবং জমীনে যা কিছু রয়েছে, সবকিছুই রাহমান আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে দাসরূপে আগত।
লোকে তখন জিজ্ঞাসা করল, আপনি প্রথমেই এই উত্তর দিলেন না কেন? তিনি বললেন, আমি ভয় করলাম, যদি বলি আমি তাঁর বান্দা, তবে তিনি আমার কাছে তাঁর দাসত্বের হক আদায় করবেন। অথচ তাঁর দাস নহি একথা তো বলতে পারি না। লোকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি আপনার সময় কিভাবে অতিবাহিত করেন? তিনি বললেন, আমার কাছে চারটি বাহন রয়েছে, আমি তাদের ছেড়ে রেখেছি। যখন আমার প্রতি কোন নেয়ামত প্রকাশিত হয় তখন, আমি শোকরের বাহনে চড়ে তার সম্মুখীন হই। আর যখন কোন বন্দেগী প্রকাশ পায়, তখন এখলাসের বাহনে আরোহণ করে তার এস্তেকবাল করি। আর যখন কোন বালা-মুসিবত সামনে এসে উপস্থিত হয় তখন সবরের বাহনে চড়ে থাকি। আর আমার দ্বারা কোন গুনাহের কাজ হয়ে গেলে তখন সবরের বাহনে আরোহণ করি।
একদিন কোন এক জায়গায় আউলিয়াকেরামের একটি সম্মেলন বসেছিল। সেখানে হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ সেখানে বসতে চাইলে তাঁরা তাঁকে অনুমতি দিলেন না। বরং বললেন, তুমি এখান থেকে চলে যাও, এখনও তোমার শরীর থেকে বাদশাহীর গন্ধ আসছে। হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার রাঃ বলেন, আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাই, উক্ত আউলিয়ায়ে কেরাম এমন খোদা প্রেমিক এবং সংসারত্যাগী হওয়া সত্ত্বেও যখন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে তাঁদের মজলিশে বসার অনুমতি দিলেন না তখন জানি না, অন্য কেহ সেখানে বসতে চাইলে কি বলতেন।
একবার কতিপয় লোক হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে জিজ্ঞাসা করল, অন্তরের উপর আল্লাহ তায়ালা থেকে পর্দা পড়ে কেন? (অর্থাৎ অন্তরের অবস্থা এমন কেন হয় যে, আল্লাহ পাকের মহব্বতের প্রতি আকৃষ্ট হয় না।) তিনি উত্তর করলেন, কারণ আল্লাহ তায়ালা যে বস্তুকে ঘৃণা করেন অন্তরসমূহ তাকে ভালবাসে আর এই খেলাধুলার ঘর দুনিয়ার অস্থায়ী সৌন্দর্যের মোহে অন্তর মত্ত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে চিরস্থায়ী ঘর বেহেশত এবং তার অনন্ত নেয়ামতসমূহকে ছেড়ে বসেছে। আর এমন দেশ, এমন জীবন এবং এমন সাধক থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
হযরত আহমদ যাযরাওয়াইহ বলেন, হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ একদিন তাওয়াফ করার সময় এক ব্যক্তিকে বললেন, তুমি চারটি দুর্গম মঞ্জিল অতিক্রম না করা পর্যন্ত নেককারদের দরজায় পৌঁছতে পারবে না- ১. নেয়ামতের দরজা নিজের জন্য বন্ধ কর এবং দুঃখ কষ্টের দরজা খুলে দাও, ২. সম্মানের দরজা নিজের জন্য বন্ধ কর এবং অপমান ও লাঞ্ছনার দ্বার মুক্ত করে দাও, ৩. নিদ্রার দ্বার নিজের জন্য বন্ধ কর এবং জাগ্রত থাকার দ্বার খুলে দাও, ৪. ধন দৌলতের দ্বার নিজের জন্য বন্ধ কর এবং দরিদ্রতার দ্বার মুক্ত করে দাও।
এক ব্যক্তি হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ এর কাছে এসে বলল, আয় শায়খ ! আমি আমার নফসের প্রতি ভীষণ অত্যাচার করেছি। আপনি আমাকে এমন কোন নসিহত করুন, যাতে আমি সর্বদা সম্মুখে রেখে চলতে পারি। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, তুমি যদি আমার নসিহত কবুল কর, তবে আমি মোমাকে ছয়টি খাছলত শিখায়ে দিচ্ছি। এই ছয়টি খাছলত নিজের মধ্যে জন্মাতে পারলে আর কোন কিছুই তোমর কোন ক্ষতি করতে পারবে না- ১. যখন তুমি আল্লাহ পাকের কোন নাফরমানীর কাজ করবে, কখন থেকে আল্লাহ তায়ালার কোন রিজিক খেও না। সে ব্যক্তি বলল, রিজিকদাতা তো তিনি ছাড়া আর কেহ নেই। তবে আমি রিজিক কোথা থেকে খাব? তিনি বললেন, তাঁর রিজিক খেয়ে তাঁরই নাফরমানী করা কিছুতেই সঙ্গত হয় না, ২. কোন গুনাহের কাজ করতে হলে তাঁর রাজ্য থেকে বের হয়ে কর। সে বলল, মাশরেক থেকৈ মাগরেব পর্যন্ত তো সবই তাঁর রাজ্য। এই রাজ্য ছেড়ে আমি আর কোথায় যাব? তিনি বললেন, তাঁরই রাজ্যে বাস করে তাঁরই নাফরমানী করবে, তা সঙ্গত হয় কেমন করে? ৩. যখন তুমি কোন গুনাহের কাজ করতে চাও তখন এমন স্থানে গিয়ে করবে যেখানে তিনি তোমাকে দেখতে না পান। সে বলল, তিনি তো অন্তরের গোপন কথাও জানতে পারেন এবং একটি রেণুও তাঁর দৃষ্টির বাইরে থাকতে পারে না, তবে আমি এমন স্থান কোথায় পাব? হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, তুমি তাঁরই রিজিক খাবে, তাঁর রাজ্যে বাস করবে আবার তাঁর সামনেই তাঁর নাফরমানী করবে? ৪. যখন মালাকুল মউত তোমার রূহ কবয করতে আবেন, তখন তুমি তাঁকে বলে দিও, আমাকে একটু সময় দিন, আমি তওবা করে নেই। সে বলল, তিনি কখনও আমার কথা শুনবেন না। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, তোমার যখন এমন ক্ষমতা নেই যে, মালাকুল, মউতকে নিজ কাজ সম্পাদনে বাধা প্রদান করবে এবং মৃত্যুর পূর্বে তওবা করি নিবে, তখন এই মুহূর্তকেই সুবর্ণ সুযোগ মনে করে তোমার কৃত গুনাহের জন্য তুমি তওবা করে নাও। ৫. মুনকার নাকীর ফেরেশতাদ্বয় যখন কবরে তোমার কাছে আসবে, তখন তাঁদের কবর থেকে তাড়ায়ে দিও। সে বলল, তা আমার ক্ষমতার বাইরে। তখন তিনি বললেন, তাহলে তোমার অবশ্য কর্তব্য হল এখন থেকে তাঁদের প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করে রাখা। ৬. যখন কেয়ামতে বিচারের হুকুম হবে, পাপীগণকে দোযখে নিয় যাও তখন তুমি বল, আমি তো যাব না। লোকটি বলল, তারা বলপূর্বক টেনে নিয়ে বাবে। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, অতএব এখন তোমার অবশ্য কর্তব্য কোন গুনাহের কাজ না করা। লোকটি এসমস্ত কথা শুনে বলল, আপনি যা বললেন, তা একান্ত সত্য। লোকটি খাঁটি তওবা করল এবং সেই তওবার উপর ঠিক থেকে ইহলোক ত্যাগ করল।
একবার কয়েকজন লোক এসে হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে প্রশ্ন করল, আমরা দোয়া করি আমাদের দোয়া কবুল হয় না কেন? তিনি উত্তরে বললেন, এর কারণ এই যে, তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে জান কিন্তু তাঁর বন্দেগী কর না। তাঁর রাসূল সাঃ কে চিন, কিন্তু তাঁর সুন্নতের অনুসরণ কর না। কুরআন শরীফ পড়, কিন্তু তদানুযায়ী আমল কর না। আল্লাহ পাকের নেয়ামত ভোগ কর, কিন্তু তার শোকরগুজারী কর না। তোমরা খুব ভাল করেই জান যে, বেহেশত আল্লাহ পাকের ফরমাবরদার বান্দাগণের জন্য সাজায়ে রাখা হয়েছে, অথচ তোমরা তার অন্বেষণ কর না। আর এও তোমরা খুব ভাল করেই জান যে, খোদার নাফরমান বান্দাদের জন্য দোজখের মধ্যে আগুনের বেড়ী এবং তওকসমূহ প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। অথচ তোমরা তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজছ না। আরও তোমরা জান যে, শয়তান তোমাদের মহাশত্র“, কিন্তু তোমরা তাকে শত্র“ মনে কর না। বরং তোমরা তার অনুসরণ করে চলেছ। তোমরা আরও অবগত আছ যে, মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তার জন্য সামান ও সম্বল সংগ্রহ করছ না। নিজের মাতা-পিতা, সন্তান-সন্তুতি ও আত্মীয়-স্বজনকে নিজ হস্তে নিয়া কবরে শুয়ায়ে আসছ, কিন্তু সে সমস্ত ঘটনা থেকে নিজেরা উপদেশ গ্রহণ করছ না এবং নিজের দোষ-ত্র“টি থেকে নিবৃত্ত হচ্ছো না। তা সত্ত্বেও অপরের দোষ-ত্র“টি খুঁজে বেড়াচ্ছ। যাদের এরূপ অবস্থা বলত, তাদের দোয়া কেমন করে কবুল হবে?
একবার কয়েকজন লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করল, মানুষ যদি ক্ষুধার্ত হয় এবং তার কাছে খাবার না থাকে তবে কি করবে? তিনি বললেন, সবর করবে, একদিন, দুইদিন, তিনদিন। প্রশ্নকারীরা বলে উঠল, মানলাম দশদিন সবর করবে, তারপর কি করবে? তিনি বললেন, তারপরও সবর করবে এবং এই অবস্থায় মরে যাবে। তাতে খুনের দায় হত্যাকারীর উপর বর্তিবে।
একবার কয়েকজন লোক হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কে দাওয়াত করল। তিনি দাওয়াতের স্থানে উপস্থিত হলে লোকেরা অন্য কারও অপেক্ষা করতে থাকল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, সে বড়ই বদমেজাজ লোক। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, লোকে প্রথমে রুটি খায়, পরে গোশ্ত খায়, তোমরা প্রথমেই গোশ্ত খেতে আরম্ভ করে দিলে? (তাও মরা ভাইয়ের গোশ্ত) অর্থাৎ গীবত করতে আরম্ভ করে দিলে?
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কোন এক হাম্মামে (গোসলখানায়) গেলেন। তাঁর পরিধানের কাপড় ছেঁড়া ও ময়লা দেখে হাম্মামের লোকেরা তাঁকে প্রবেশ করতে দিল না। তিনি উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, দরিদ্র লোককে যখন শয়তানের ঘরে ঢুকতে দেয়া হল না, তখন আল্লাহ তায়ালার ঘরে ইবাদত বন্দেগী ব্যতীত কেমন করে ঢুকতে দেয়া হবে?
হযরত ইবরাহীম আবনে আদহাম রাঃ বলেছেন, একবার আমি আল্লাহ তায়ালার উপর তায়াক্কুল করে কোন এক জঙ্গল অতিক্রম করছিলাম। তিন দিন পর্যন্ত আমার কোন খাদ্যই জুটেনি। হঠাৎ শয়তান এসে আমাকে বলতে লাগল, তুমি বলখের বাদশাহী এবং তথাকার নেয়ামত ত্যাগ করে এই লাভ করেছ যে, আজ ক্ষুধার্ত ও তৃণ্ষার্ত অবস্থায় কাবা শরীফের হজ্ব করতে যাচ্ছ। তুমি কি বলখের সিংহাসনে সমাসীন থাকলে, আজ রাজকীয় সমারোহের সাথে হজ্বে যেতে পারতে না? আমি আসমানের দিকে মুখ তুলে বললাম, এলাহী ! তুমি আমাকে পেরেশান করার জন্য বন্ধুর বিরুদ্ধে শত্র“কে নিযুক্ত করেছ? আমি তোমারই সাহায্যে এই পথ অতিক্রম করে যেতে পারি। তৎক্ষণাৎ আমি এক গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে ইবরাহীম ! তোমার পকেটের মধ্যে যা কিছু আছে তা বের করে ফেলে দাও, তাহলে তোমার অগোচরে যা কিছু আছে, আমিও তা বের করে ফেলে দিব। আমি তখনই পকেটে হাত দিলাম। চার দাঙ্গ পরিমাণ রূপা ছিল, আমি যাত্রাকালে তা পকেট থেকে ফেলে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি পকেট থেকে তা বের করে ফেলে দেওয়া মাত্র শয়তান আমার কাছ থেকে পলায়ন করল এবং গায়েব হতে আমার মধ্যে শক্তি এসে পড়ল।
তিনি বলিয়াছেন, কোন এক ফলের বাগানের মালিক কিছু দিনের জন্য আমাকে তার বাগানের প্রহরার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। একবার বাগানের মালিক আমাকে বললেন, কয়েকটি মিষ্ট আনার নিয়ে আস। আমি তাঁকে কয়েকটি আনার দিলাম। কিন্তু ঘটনাক্রমে আনারগুলো সব টক ছিল। মালিক বললেন, এতদিন ধরে আনার খাচ্ছ, কিন্তু এখনও কোন গাছের আনার মিষ্ট এবং কোন গাছের আনার টক তা চিনতে পারলে না? একথা শুনে আমি বললাম, আপনি  আমার হাতে বাগান সোপর্দ করেছেন বাগান প্রহরা দেবার জন্য, বাগানের ফল খাওয়ার জন্য নয়। মালিক তা শুনে বললেন, আপনার এই পরহেযগারী দেখে মনে হচ্ছে যে, আপনি ইবরাহীম ইবনে আদহাম। যখন আমি বুঝতে পারলাম যে, লোকটি আমাকে চিনতে পেরেছে, তখনই আমি বাগান ত্যাগ করে চলে গেলাম।
তিনি আরো বলেছেন, এক রাত্রে আমি জিবরাইল আঃ কে স্বপ্নে দেখলাম, তাঁর হাতে একটি কিতাব রয়েছে। তা কিসের কিতাব? জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, এতে আল্লাহ তায়ালার বন্ধুগণের নাম লিখব। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমার নামও কি লিখবেন? তিনি বললেন, তুমি আল্লাহ পাকের বন্ধুর শ্রেণীভুক্ত নও। আমি বললাম, তাঁর বন্ধু না হলেও তাঁর বন্ধুদের বন্ধু বটে। একথা শুনে হযরত জিবরাইল আঃ বললেন, এই মাত্র আল্লাহ তায়ালার হুকুম এসেছে, তোমার নাম যেন সকলের আগে লিখি। তাতে নিরাশার মাঝে আশার সঞ্চার হল।
তিনি বললেন, আমি একরাতে বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যে ছিলাম। আমি একখানা চাটাইয়ের মধ্যে নিজেকে লুকায়ে রাখতাম। কেননা, খাদেম রাতে কাউকে মসজিদে থাকতে দিত না। রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হলে মসজিদের দরজা খুলে গেল এবং চটের লেবাস পরিহিত একজন বৃদ্ধ লোক মসজিদে প্রবেশ করলেন, তাঁর সঙ্গে চটের লেবাস পরিহিত আরো চল্লিশ জন দরবেশ প্রবেশ করলেন, তাঁরা মেহরাবের সামনে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। অতঃপর বৃদ্ধ মেহরাবের দিকে পিঠ রেখে অন্য সকলের দিকে মুখ করে বসলেন। তন্মেধ্যে একজন বললেন, আজ এই মসজিদে আমরা ছাড়াও একজন লোক আছে। বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, আদহামের পুত্র ইবরাহীম চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত ইবাদতের স্বাদ পাচ্ছে না। বৃদ্ধের এ কথা শুনে আমি বের হয়ে এসে বললাম, আপনি সত্যই বলেছেন, আপনাকে খোদার কসম দিয়ে বলছি, আমাকে এর কারণ বলে দিন। তিনি বললেন, অমুক দিন আপনি বসরা শহরে খেজুর ক্রয় করেছিলেন। দোকানের নিচে দোকানদারের একটি খেজুর পড়েছিল, আপনি তা আপনার মনে করে নিজের খেজুরের সাথে মিশায়েছিলেন। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম একথা শুনামাত্র বসরা শহরে চলে যান এবং সেই দোকানদারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। দোকানদার তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন এবং বললেন, পরের হক আত্মসাৎ করা যখন এত গুরুতর কাজ, তখন আমি আজ থেকে খেজুর বিক্রি করা বন্ধ করলাম। অতঃপর সে এই কাজ থেকে তওবা করল এবং দোকান ছেড়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হল এবং পরিশেষে আবদাল শ্রেণীভুক্ত হল।

একদিন কোন অরণ্য পথ অতিক্রমকালে হযরত ইবরাহীম আদহাম রাঃ এর সাথে জনৈক সিপাহীর সাক্ষাৎ হল। সিপাহী তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে? তিনি উত্তর করলেন, আমি একজন গোলাম। সে আবার প্রশ্ন করল, তোমার বাসস্থান কোথায়? তিনি কবরস্তানের দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন। সিহাহী বলল, তুমি আমার সাথে বিদ্রুপ করছ? এই বলে সে তাঁকে বেদম ্রহার করল, এমন কি তাঁর মাথা ফেটে গেল। এতেও সে তাঁকে রেহাই দিল না, তাঁর গলায় রশি লাগায়ে রাস্তার উপর দিয়ে টানতে লাগল। ইতিমধ্যে কয়েকজন লোক সেখানে এসে পড়ল এবং বলতে লাগল, মূর্খ ! তুমি এরূপ কেন করলে? তুমি কি জান না যে, ইনি হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম? সিপাহী তা শুনে হরত ইবরাহীম আদহামের পায়ের উপর পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম বরাঃ বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছ সে জন্য আমি তোমাকে দোয়া করছি। কেননা, আমার সাথে তোমার এই নির্দয় ব্যবহারের বিনিময়ে আমার জন্য বেহেশত নির্ধারিত রয়েছে, আর তুমি দেকযখে যাও তাও আমার কাম্য নয়। সিপাহী বলল, আমার প্রশ্নের উত্তরে আপনি কেন বললেন, যে আপনি গোলাম? তিনি উত্তর করলেন, গোলাম বৈ কি, এমন কে আছে যে, খোদার গোলাম নয়? সিপাহী বলল, আমি আপনাকে বাসস্থানের কথা জিজ্ঞাসা করলে আপনি কবরস্তানের দিকে ইঙ্গিত করলেন কেন? তিনি বললেন, প্রতিদিন শহরের আবাদী অনাবদ হয়ে কবরস্তানের আবাদী বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুনিয়া একটি মুসাফিরখানা। কবরস্তানই তো সকলের প্রকৃত বাসস্থান।
কোন একজন বুযুর্গ বেহেশতীদের স্বপ্নে দেখলেন, প্রত্যেকের হাতে এবং আঁচলে মণি-মুক্তা পরিপূর্ণ। আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, এই আয়োজন কিসের জন্য। তাঁরা উত্তর করলেন, এক মূর্খ হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহামের মাথা ফাটায়ে দিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদের আদেশ করলেন, ইবরাহীম আদহাম বেহেশতে প্রবেশ করা মাত্র তাঁর মাথার উপর মোতি বর্ষণ করো। এই জন্য আমরা মোতি দ্বারা আঁচল পূর্ণ করে নিয়েছি, তিনি বেহেশতে প্রবেশ করা মাত্র তাঁর মাথার উপর মোতি বর্ষণ করব।
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ জনৈক মাতালের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন যে, ধুলা-মাটি লেগে তার মুখখানি বিশ্রি হয়ে গেছে। তিনি মাতালের এই অবস্থা দেখে তৎক্ষণাৎ পানি এনে তার মুখখান খুয়ে পরিষ্কার করে দিলেন এবং বললেন, যে মুখে আল্লাহ পাকের পবিত্র নাম জিকর করা হয়, তা ধুলা-বালিতে কদাকার হয়ে রয়েছে। আহা! বড়ই বেইজ্জতির কথা। অতঃপর তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন। একটু পরে মাতাল লোকটির হুশ ফিরে আসলে লোকে বলল, হযরত ইবরাহীম আদহাম তোমার মুখের ধুলা-মাটি ধুয়ে দিয়েছেন এবং এরূপ বলেছেন। সেই ব্যক্তি বলল, আমিও আজ থেকে তওবা করলাম, আর কখনও শরাব স্পর্শ করব না। তার পর এক রাতে হযরত ইবরাহীম আদহাম স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তুমি আমার জন্য উক্ত মাতালের মুখ ধুয়ে দিয়েছে, আমি তোমার অন্তর ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলাম।
অলিয়ে কামেল হযরত মুহাম্মদ মুবারক রাঃ বলেছেন, আমি এক সময় হযরত ইবরাহীম আদহামের সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাসের ময়দানে ছিলাম। মাধ্যাহ্নিক বিশ্রামের সময় আমরা একটি আনার গাছের নিচে অবতরণ করলাম এবং কয়েক রাকাত নামাজ পড়লাম। আমি আনার গাছটি থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে আবু ইসহাক (ইবরাহীম আদহাম) ! আমাকে সম্মানিত করুন এবং আমার কিছু ফল ভক্ষণ করুন। হযরত ইবরাহীম আদহাম রাঃ মস্তক সম্মুখের দিকে নত করলেন। গাছটি তিনবার উপরোক্ত কথা বলল, অতঃপর আমাকে বলল, হে আবু মুহাম্মদ ! আপনি হযরত ইবরাহীম আদহামের কাছে একটু সুপারিশ করুন, তিনি যেন আমার কিছু ফল ভক্ষণ করেন। আমি বললাম হে আবু ইসহাস ! আপনি কি এই গাছটির আবেদন শুনছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, শুনছি। এই বলে তিনি দাঁড়ালেন এবং গাছ থেকে দু’টি আনার ছিঁড়ে একটি আমাকে দিলেন এবং অপরটি নিজে খেলেন। গাছটি ছোট ছিল এবং আনারও টক ছিল। আমরা ফিরার পথে দেখলাম, গাছটি বেশ বড় এবং তার পাতাও খুব ঘন হয়েছে। এবার দেখলাম আনারগুলি বেশ মিষ্ট। পরে দেখা গেল, গাছটিতে বছরে দুইবার করে আনার ধরছে। সেই গাছের আনারের বরকত দেখে লোকে তার নাম দিয়েছিল, ‘রোম্মানুল আবেদীন’। দেশ-বিদেশের আবেদ এবং দরবেশগণ আসলে সেই গাছের নিচে বসতেন।
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ এক পাহাড়ের টিলায় বসে একজন বুযুর্গের সাথে আলাপ করছিলেন। উক্ত বুযুর্গ জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহওয়ালা কামেল লোকের চিহ্ন কি? তিনি বললেন, কামেল লোক যদি পাহাড়কে চলতে বলে, তখনই তা চলতে আরম্ভ করে। তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই পাহাড় চলতে আরম্ভ করল। হযরত ইবরাহীম আদহাম রাঃ বললেন, হে পাহাড় ! আমি তোমাকে চলার জন্য আদেশ করিনি, আমি শুধু তোমাকে দিয়ে দৃষ্টান্ত দিয়েছিলাম। তৎক্ষণাৎ পাহাড় থেমে গেল।
একবার হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ নৌকায় চড়ে নদী পার হতে ইচ্ছা করলেন, কিন্তু কাছে পয়সা কড়ি ছিল না। মাঝিরা বলল, একটি দিনার দিন তাহলে আমরা আপনাকে নৌকায় উঠাতে পারি। তিনি দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে হাত উুঠায়ে বললেন, এলাহী ! মাঝিরা আমার কাছে নৌকার ভাড়া চাচ্ছে, আমার কাছে তো পয়সা-কড়ি কিছুই নেই। তৎক্ষণাৎ নদীর তীরের সমস্ত বালুকা স্বর্ণ হয়ে গেল, তিনি সেখান থেকে এক মুষ্ঠি স্বর্ণ নিয়ে মাঝিকে দিয়ে দিলেন। মাঝি আনন্দিত মনে তাঁকে পার করে দিল।
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ দাজলা নদীর তীরে বসে নিজের ছেঁড়া কাপড় সেলাই করছিলেন। এমন সময় একব্যক্তি এসে বলল, আপনি বলখের বাদশাহী ত্যাগ করে কি লাভ করেছেন? তিনি নিজের হাতের সূঁচটি নদীতে ফেলে দিলেন এবং নদীর দিকে অঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করলেন, তখনই নদীর হাজার হাজার মাছ এক একটি স্বর্ণের সূঁচ মুখে নিয়ে সেখানে ভেসে উঠল। হরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ বললেন, আমি স্বর্ণের সূঁচ চাই না। আমরা নিজের সূঁচটি চাই, একথা বলামাত্র একটি ক্ষুদ্র ও দুর্বল মাছ তাঁর সূঁচটি মুখে করে এনে তাঁর সামনে রাখল। হযরত ইবরাহীম আদহাম রাঃ লোকটিকে বললেন, আমি বলখের বাদশাহী ত্যাগ করে যা লাভ করেছি, তন্মেধ্যে সর্ব নিকৃষ্ট এটি।
একদিন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ কূপের মধ্যে পানি তুলার জন্য বালতি ফেলিলেন। টেনে তুলে দেখলেন, বালতি স্বর্ণে ভর্তি হয়ে আছে। তিনি তা ফেলে দিয়ে আবার বালতি ফেললেন, এবার টেনে তুলে দেখলেন, বালতি রৌপ্যে ভর্তি হয়ে আছে। এবারও তিনি তা ফেলে দিয়ে আবারও বালতি নিচে নামালেন, এবার তুলে দেখেন বালতি মোতিতে পূর্ণ। তখন তিনি আসমানের দিকে মুখ তুলে বললেন, এলাহী ! আপনি খুব অবগত আছেন যে, আমি এসবের ধোঁকায় আর পড়ব না। আপনি দয়া করে আমাকে পানি দিন, আমি ওজু করব। এবার বালতি কূপে ফেলে টেনে দেখলেন, বালতিটি পরিষ্কার পানিতে পূর্ণ হয়েছে।
একবার হযরত ইবরহীম আদহাম রাঃ একদল দরবেশ সহ কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমেধ্যে তাঁরা একটি দুর্গের কাছে পৌঁছে দেখতে পেলেন, দুর্গের দ্বারে বহু কাঠ পড়ে আছে। সঙ্গীরা বললেন, আজ আমরা এখানেই রাত যাপন করব। বহু কাঠ পড়ে আছে। তা দ্বারা আগুন জ্বালায়ে শরীর গরম করা যাবে। পানির ঝর্ণাও নিকটে রয়েছে। তাঁরা সকলে সেখানে অবস্থান করলেন এবং আগুন জ্বালায়ে দিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে জনৈক দরবেশ বললেন, এসময় কিছু হালাল গোশত পেলে এই আগুনে কাবাব করে খাওয়া যেত। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ নামাজ পড়তেছিলেন, সালাম ফিরায়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা আছে, তিনি ইচ্ছা করলে আমাদের জন্য হালাল গোশত পাঠায়ে দিতে পারেন। একথা বলেই তিনি আবার নামাজ আরম্ভ করলেন। সবে মাত্র নিয়ত বেধেছেন, এমন সময়ে বাঘের গর্জন শোনা গেল। দরবেশগণ সেদিকে দৃষ্টি করতেই দেখলেন, একটি বন্য গাধা তাদের সামনে দণ্ডায়মান। তাঁরা বন্য গাধাটিকে ধরে জবাহ করলেন এবং তার গোশত কাবাব করে খেতে লাগলেন। বাঘটি অদূরে বসেই তাঁদের খাওয়া দেখতে লাগল।
শোনা যায়, হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ শেষ বয়সে লোক চক্ষুর আড়ালে কোথাও চলে যান এবং এমনভাবে আত্মগোপন করেন যে, তাঁর কবরের সন্ধান কেউ পেল না। কেহ বলেন, বাগদাদে তাঁর কবর রয়েছে। কেহ বলেন, শাম দেশে। কেহ বলেন, তাঁর কবর হযরত লূত আঃ এর কবরের পার্শ্বে অবস্থিত এবং মাটির নিচে ধ্বসে গেছে। তিনি লোক সমাজ থেকে আত্মগোপন করে সেখানে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই তাঁর ইন্তেকাল হয়। বর্ণিত আছে, হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে গায়েব থেকে একটি আওয়াজ আসল, তোমরা জেনে রাখ, “দুনিয়ার শান্তি দুনিয়া ত্যাগ করে চলে গেছে।” মানুষ এই আওয়াজ শুনে চিন্তা করতে লাগল। দেখা যাক কি ঘটে, ইতিমধ্যে সংবাদ ছড়ায়ে পড়ল, হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাঃ ইন্তেকাল করেছেন।

হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ

তরিকতপন্থীগণের ইমাম, হাকীকত বিশারদ, আউলিয়ায়ে কেরামের অগ্রনায়ক, অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন মহাপুরুষগণের বরেণ্য খাজা ওসমান হারুনী রাঃ পবিত্র আউলিয়া সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি হাজী শরীফ যেন্দনী রাঃ এর মুরিদ ছিলেন। (হাজী শরীফ যেন্দনী বোখারা শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যেন্দানা নামক স্থানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি খাজা মাউদুদ চিশতি রাঃ এর মুরিদ ও প্রধান খলিফা ছিলেন। তিনি ৫৮৬ হিজরী সালের ৬ই রজব ১২০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং যেন্দানাতেই সমাহিত হন।) হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ আধ্যাত্মিক মর্যাদায় নিজের যুগে অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয় ছিলেন। তিনি খোরাসান প্রদেশের হারুন নগরের অধিবাসী ছিলেন। এই নগরটি নিশাপুরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত।
জীবনে তিনি অধিকাংশ সময় দেশ ভ্রমণে কাটায়ে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ও খ্যাতনামা প্রায় সকল মাশায়েখ এবং পীর মোর্শেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের সোহবতে থেকে জাহেরি ও বাতেনী এলম শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর ইন্তেকালের তারিখ সম্ভন্ধে মতভেদ রয়েছে। সফিনাতুল আউলিয়া এবং অন্যান্য কিতাবে তাঁর ইন্তেকালের তারিখ ৬১৭ হিজরির ১৬ই রজব উল্লেখ আছে। কোন কোন ঐতিহাসিক ৬০৭ হিজরি লিখেছেন। যা হোক একথায় সকলে একমত আছেন যে, তিনি খুব দীর্ঘায়ু ছিলেন। তাঁর মাজার মক্কা মোয়াজ্জমার খানায়ে কাবা ও জান্নাতুল মুয়াল্লা নামক কবরস্থানের মধ্যস্থলে অবস্থিত। আখবারুচ্ছালেহীন কিতাবে লিখিত আছে, মক্কা মোয়াজ্জমার উপর নজদীদের ক্ষমতা লাভের পূর্বে মাজারটির চিহ্ন বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তারা ক্ষমতা লাভের পর তা ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
তিনি ছিলেন কাশফ ও কারামতের অধিকারী, হাকীকতের সূক্ষèতত্ত্ব সম্বন্ধে অভিজ্ঞ, শরিয়ত ও তরিকতের বিশেষজ্ঞ এবং অতি উচ্চস্তরের অলিআল্লাহ। হযরত খাজা আজমিরী রাঃ এর মত সুমহান ব্যক্তিত্বের পীর এবং মোর্শেদ ছিলেন। তাই খাজা ওসমান হারুনী রাঃ এর উচ্চ শান এবং উন্নত মর্যাদার জ্বলন্ত প্রমাণ।
তাঁর পীর মোর্শেদ হযরত হাজী শরীফ যেন্দনী রাঃ তাঁকে খেলাফতের খেরকা পরাবার সময় তাঁর মস্তকে চতুষ্কোণ তুর্কী টুপী পরায়ে দিয়ে বলেন, হে ওসমান ! এই চার কোণবিশিষ্ট টুপিটির উদ্দেশ্য চারটি বস্তু অবশ্যই বর্জন করা, ক. তরকে দুনিয়া, খ. তরকে আখেরাত, গ. একান্ত আবশ্যকের অতিরিক্ত আহার ও নিদ্রা বর্জন করা, ঘ. নফসের সর্ববিধ খাহেশ বর্জন করা। তিনি তাঁকে আরও বলেছেন, এই টুপিটি মস্তকে ধারণ করার সেই ব্যক্তিই যোগ্য যে উপরোক্ত চারটি বস্তু বর্জন করবে। সকল মানুষকে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং নিজেকে সকলের চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করবে। যার মধ্যে এই গুণ ধাকবে না, সে এই টুপী পরিধানের যোগ্য হবে না। বরং এই টুপী পরিধান করা তার জন্য হারাম।
হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ স্বীয় পীর মোর্শেদের এই নির্দেশগুলো জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তিনি কঠোর ও দুঃসাধ্য রিয়াজত ও সাধনা করেছিলেন। তিনি সুদীর্ঘ তিন বছর যাবত কঠিন সাধনা ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে জীবন যাপন করেন। অতঃপর পীর সাহেব তাঁর এমতেহান নিয়ে যখন দেখতে পেলেন যে, তিনি সর্বপ্রকারে সফলকাম হয়েছেন, তখন তিনি তাঁকে অনুগ্রহপূর্বক খেলাফতের খেরকা প্রদান পূর্বক নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন। এরপর পীর সাহেবের এজাজতক্রমে নিয়ে তিনি দেশ ভ্রমণে বের হন এবং বহু দূর-দূরান্তের দেশসমূহ ভ্রমণ করে তথাকার ওলামা ও মাশায়েখে কেরামের সাক্ষাৎ ও সংসর্গ লাভ করেন।
হযরত খাজা আজমিরী রাঃ কে মুরিদ করার পর যখন তিনি মক্কা মোয়াজ্জমায় গমন করেন, তখন হযরত খাজা আজমিরী রাঃও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। মক্কা শরীফ হতে তিনি মদিনা মনোয়ারা গমন করেন। অতঃপর সেখান হতে বদখশান গমন করেন। বদখশানে এবং তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় যে সমস্ত বুযুর্গানে দ্বীন বাস করতেন তাঁদের সকলেরই সাক্ষাৎ এবং সংসর্গ লাভ করেন। মোটকথা, দশ বছর পর্যন্ত দেশ ভ্রমণে নিবৃত্ত থাকেন। অতঃপর বাগদাদ শরীফে আগমন করে কিছুকাল সেখানে বাস করেন। এর পর পুনরায় দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। এবারেও তিনি পূর্ণ দশ বছর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের ও পর্যটনের পর পুনরায় বাগদাদ শরীফে ফিরে আসেন।
সিয়ারুল আরেফীন কিতাবে বর্ণিত আছে যে, খাজা আজমিরী রাঃ তাঁর কাছ থেকে খেলাফতের খেরকা লাভ করার পর বিদায় গ্রহণ করে চলে গেলে খাজা উসমান হারুনী তাঁর মহব্বতের আকর্ষণে খাজা আজমিরী রাঃ এর কাছে যাবার জন্য রওয়ানা হলেন। ঘটনাক্রমে পথিমধ্যে তিনি অগ্নিপূজকদের একটি গ্রামে উপনীত হলেন। অগ্নিপূজকেরা সেখানে এক বিরাট অগ্নিকুণ্ড প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। উক্ত অগ্নিকুণ্ডের উপর একটি মনোরম গুম্বদও ছিল। এই অগ্নিকুণ্ডের আগুন প্রতিদিন জ্বালায়ে প্রখর করা হত। তথাকার অধিবাসীরা এই অগ্নিকে পূজা করত। হযরত খাজা সাহেব এই অগ্নিকুণ্ডের অনতিদূরে নদীর তীরে বিশ্রামের জন্য অবতরণ করেছিলেন। তিনি রুটি তৈরী করার জন্য ফকরুদ্দিন নামের এক মুরিদকে নিকটস্থ পল্লী হতে আগুন আনার জন্য পাঠালেন এবং আটাও ক্রয় করে আনতে বললেন। খাদেম বস্তির মধ্যে গিয়ে আটা ক্রয় করল। অতঃপর অগ্নিকুণ্ডের কাছে গিয়ে অগ্নিপূজকদের কাছে অগ্নি চাইল। অগ্নিপূজকেরা আগুন দিতে অসম্মতি জানাল। খাদেম অনোন্যপায় হয়ে আগুন ব্যতীতই হযরত খাজা সাহেবের কাছে ফিরে সমুদয় ঘটনা নিবেদন করল।
হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ নিজেই অগ্নিকুণ্ডের কাছে চলে গেলেন এবং অগ্নিপূজকদের উপদেশ দিতে লাগলেন যে, অগ্নিকে পূজা করলে কোন লাভ হবে না। এই অগ্নিকুণ্ড তো সামান্য পানি দিয়েই নির্বাপিত হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, আগুন কোন স্থায়ী পদার্থ নয়। সুতরাং এমন অস্থায়ী বস্তুর পূজা করা নিরর্থক ও নিষ্ফল যা নিজের অস্তিত্বই টিকায়ে রাখতে সক্ষম নয়। তেমন পদার্থের পূজা করে তোমরা কি ফল লাভ করার আশা করতে পার? পূজারীরা বলল, এই আগুনের অস্তিত্ব সুমহান, এই জন্যই আমরা তার পূজা করছি।
খাজা সাহেব বললেন, তোমরা এতকাল ধরে এই আগুনের পূজা করছো, তোমাদের পা এর ভিতরে ঢুকায়ে দাও তো, আমি দেখতে চাই, তা তোমাদের পা পোড়ায় কি না। তারা উত্তর করল, পোড়ানোই আগুনের বিশেষত্ব। অতএব, তা আমাদের পোড়াবে না কেন? ফলকথা, তারা খাজা সাহেবের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হল এবং খাজা সাহেবের উপদেশের প্রতি কোনই মনোযোগ দিল না।
খাজা সাহেব তখন নিজের স্বভাবসিদ্ধ একটি কারামত দেখালেন। তা দেখে তারা বিস্ময়ে অবাক ও নিরুত্তর হয়ে পড়ল। হযরত খাজা সাহেবের প্রভাবে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে বলে মনে হল। তা অনুভব করে খাজা সাহেব পুনরায় তাদের নসিহত করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ নসিহত শ্রবণ করে তারা সকলে হযরত খাজা সাহেবের হাতে তওবা করতঃ ঈমান আনল।
হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ অতি উচ্চ স্তরের আবেদ ও যাহেদ ছিলেন। তাঁর অধিকাংশ সময়ই রিয়াজতে এবং মুজাহাদায় অতিবাহিত হত। তিনি অতি সামান্য মাত্রায় আহার করতেন। রাতে খুব অল্প সময়ই ঘুমাতেন। দিবারাত্রির মধ্যে দুই বার কুরআন শরীফ খতম করতেন। দুনিয়ার মাল-মাত্তা ও সাজ সরঞ্জামের প্রতি তাঁর আদৌ কোন আগ্রহ এবং উৎসাহ ছিল না।
হযরত খাজা আজমিরী রাঃ তাঁর সম্বন্ধে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ এর মুরিদানদের মধ্যে কোন এক ব্যক্তির মৃত্যু হলে খাজা সাহেবের সঙ্গে আমিও তাঁর জানাজায় অংশ নিলাম। দাফন শেষে লোকজন চলে গেল, কিন্তু আমি তার কবরের কাছে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ালাম। দেখতে পেলাম, আযাবের ফেরেশতারা খুব ভয়ঙ্কর আকৃতিতে তার কবরে প্রবেশ করল। ঠিক সেই মুহূর্তে খাজা উসমান হারুনী রাঃও সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি ফেরেশতাদের বললেন, এইব্যক্তি আমার মুরিদ, তোমরা তাকে আযাব দিও না। ফেরেশতারা আল্লাহ তায়ালার আদেশে বললেন, এই ব্যক্তি আপনার সত্যিকারের মুরিদ ছিল না; বরং সে আপনার হুকুমের খেলাপ কাজ করত। তিনি বললেন, একথা সত্য, এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তবুও এই ব্যক্তি নিজেকে আমার সাথে সম্পর্কীত মনে করত। তৎক্ষণাৎ আল্লাহ পাকের নির্দেশ আসল, আমি তাকে মাফ করে দিলাম।
অমিয়বাণী :
হযরত খাজা উসমান হারুনী রাঃ বলেছেন,
মৃত্যু, অনাহার এবং দারিদ্র এই তিনটি বস্তুকে যে ভালবাসে সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মুমিন।
হালাল খাদ্য খাও, হালাল উপার্জনের কাপড় পর এবং তওবা কর। হিংসা বিদ্বেষ অতি নিকৃষ্ট কাজ, একে অন্তরে কখনও স্থান দিও না।
তিনি বলেছেন, এলম দুই প্রকার, এক প্রকারের এলম মহান আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে হাসিল করা হয়। আর এক প্রকারের এলম সাধারণভাবে শিক্ষা করা হয়। এইরূপে আমলও দুই প্রকার, এক প্রকারের আমল খাস আল্লাহ পাকের জন্য করা হয়। তা খাস লোকের আমল। আর এক প্রকারের আমল মানুষের নিকট প্রিয় হওয়ার জন্য করা হয়। তা শুধু রিয়াকারী ছাড়া আর কিছুই নয়। এরূপ আমল কখনও হিতকর নয়। এর কোন বিনিময় পাওয়া যাবে না।
ঈমান দুই প্রকারের, এক প্রকারের ঈমান এই যে, লোকে মুখে স্বীকার করে বটে, কিন্তু মনে তৎপ্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থাকে না, সন্দেহের দোলায় দোদুল্যমান। তা মুনাফেকের ঈমান। আর এক প্রকারের ঈমান মুখ ও অন্তর উভয়ের দ্বারা সমভাবে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ যা কিছু মুখে বলে মনেও তৎপ্রতি বিশ্বাস রাখে। তা নেককার লোকের ঈমান। এইরূপ ব্যক্তিই প্রকৃত মুমিন।
সীরাত গ্রন্থে দেখা যায়, খাজা সাহেবের দুইটি আকাঙ্ক্ষা ছিল- ১. মক্কা মোয়াজ্জমায় দাফন করা, ২. খাজা আজমিরী রাঃ আল্লাহ পাকের অলির স্তরে উন্নীত হওয়া। তাঁর উভয় আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হয়েছিল।

হযরত খাজায়ে খাজেগান মঈন উদ্দীন হাসান চিশত সানজরী রহ.

হযরত খাজায়ে খাজেগান মুঈনুদ্দীন হাসান সানজরী রাঃ ঐ সমস্ত বিখ্যাত আউলিয়ায়ে কেরামের অন্যতম যাদের জন্য জামানা আবহমান কাল পর্যন্ত গৌরববোধ করে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত করতে থাকবে। তাঁর মর্যাদা ও খ্যাতি অতুলনীয় অনুপম। কুফরীর কেন্দ্র হিন্দুস্তানে ইসলামের আলো তাঁরই ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে বিকশিত হয়েছিল এবং হিন্দুস্তানে ইসলামী হুকুমতের ভিত্তিপ্রস্তরও তাঁরই পবিত্র হস্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : হযরত মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতি সানজরী রাঃ ৫৩৬ হিজরি মতান্বরে ইমাম গাজ্জালী রাঃ এর ইন্তেকালের একত্রিশ বছর পরে অর্থাৎ, ৫৩৭ হিজরিতে পারস্যের সীস্তান বা সেজেস্তান প্রদেশের সানজা নামক নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান একজন ধনবান ও প্রভাবশালী বণিক ছিলেন। তিনি জাহেদ ও আবেদ ছিলেন। অতএব, হযরত খাজা গরিবনাওয়াজ আরাম ও আয়েশের মধ্যে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। তিনি নিজ ঊর্ধ্বতন দ্বাদশতম পুরুষের মাধ্যমে পিতামাতা উভয় দিক হতে হযরত আলী রাঃ এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ছিলেন। সুতরাং তিনি পিতা ও মাতা উভয় দিক হতেই সাইয়্যেদ।
খোরাসানে হিজরত : হযরত খাজা আজমীরী রাঃ যেকালে জন্মগ্রহণ করেন, তখন ইসলামী দুনিয়া মালাহেদা, বাতেনিয়্যাহ, বিশেষ করে দুর্ধর্ষ তাতারীদের অত্যাচারে জর্জরিত ছিল। মোটকথা, সেই যুগটি ইসলামী দুনিয়ার জন্য এক ভীষণ সঙ্কটময় ও মহা পরীক্ষার যুগ ছিল। সীস্তান ও খোরাসান অঞ্চলও অত্যাচারীদের ধ্বংসলীলা ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। চতুর্দিক শুধু খুন খারাবী আর হাহাকার করত, তদুপরি দেশের রাজনৈতিক কোন্দলও এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। মুসলমানেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের একদল অপর দলকে পর্যুদস্ত ও ধ্বংস করার জন্য সর্বদা পশ্চাতে লেগে থাকত। বিশেষ করে মালাহেদা ও বাতেনিয়্যাহ ফেরকদ্বয় দেশের মধ্যে এক দারুন ত্রাসের সৃষ্টি করে রেখেছিল। ফলকথা, এসব ঘটনাবলীর কারণে তাঁর পিতা সিস্তান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান হিজরত করে খোরাসানে চলে আসলেন। খাজা আজমীরী রাঃ এখানেই প্রতিপালিত হতে থাকেন। কিন্তু এই স্থানটিও সেই অত্যাচারী তাতারীদের আক্রমণ হতে মুক্ত ছিল না। বরং অল্পকালের মধ্যে খোরাসানের অবস্থা অন্যান্য অঞ্চল হতেও শোচনীয় হয়ে পড়ল। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত তাঁর চোখের সামনে এই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা একই ভাবে চলতেছিল। সুতরাং এসমস্ত পাশবিক অপকাণ্ড দেখে দেখে দুনিয়াবাসীর প্রতি তাঁর মন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ল।
খোরাসানে তৎকালীন ধর্মীয় পরিবেশ : ধর্ম ও মাজহাবের পরিপ্রেক্ষিতে তখন সমগ্র ইসলামী দুনিয়ার অবস্থা বড়ই অশান্ত ক্ষং বিশৃঙ্খল ছিল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বহু ফেরকার উদ্ভব হয়েছিল। বাবুক খোররামী ‘খোরামী’ মাযহারেব প্রবর্তন করেছিল। আবুমুসলিম খোরাসানীর অভ্যুত্থানও এখান হতেই আরম্ভ হয়েছিল। রাওয়ান্দিয়া ফেৎনার উদয়ও এই খোরাসান হতেই হয়েছিল, আলমুসান্ন ‘ভণ্ডনবী’ এখানেই নবুয়তের দাবি করেছিল। হাসান ইবনে শব্বাহর বিশ্ববিশ্রুত ধ্বংসাত্মক ফেরকার উদ্ভব এখান হতেই হয়েছিল। ধর্মদ্রোহী মালাহেদগণ এই দেশ হতেই গজায়ে উঠেছিল। ফলকথা, সর্বপ্রকারের বাতেল ফেরকাসমূহ এই খোরাসান হতেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং সমগ্র ইসলামী বিশ্বে এক ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।
খোরাসানের এই দুর্দিনে হিজরি  সালে, তাঁর পিতা খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান রাঃ ইন্তেকাল করেন। এসময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ১৫ বছর। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণে তাঁর কিশোর মন এমনিতেই ব্যথিত ছিল, তদুপরি পিতার মৃত্যুতে তিনি আরও আঘাত পেলেন। কিন্তু তিনি হতাশ হলেন না। তখন হতেই তিনি মাতা বিবি নূর এর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হতে থাকেন। কিন্তু অতি অল্প দিনের মধ্যে তাঁর মাতাও পরলোকগমন করেন। ফলে জীবন সংগ্রামের এই মহা রণক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়লেন।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি ওয়ারিস সূত্রে কেবল একটি বাগান ও একটি চাক্কী প্রাপ্ত হলেন। অতঃপর তিনি ঐ বাগানটির দেখাশুনা করে তার আয়ের দ্বারাই জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাগানের ও সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম তিনি নিজের হাতেই করতেন।
জীবনে বিপ্লব আনয়নকারী সর্বপ্রথম ঘটনা : হযরত খাজা আজমীরী রাঃ একদিন বাগানের কাজে পরিশ্রান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিতেছিলেন, এমন সময় হঠাৎ ইব্রাহিম কান্দুযী নামক এক ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি দুনিয়ার সকল আবিল্য এবং ঝামেলা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র থেকে জীবন যাপন করতেন। খাজা আজমীরী রাঃ তাঁকে দেখে অতিথি সেবার উদ্দেশ্যে তাঁকে একটি গাছের ছায়ায় নিয়ে বসালেন এবং পাকা আঙ্গুরের একটি গুচ্ছ এনে তাঁর হাতে দিলেন। হযরত ইব্রাহিম কান্দযী রাঃ গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে খাজা আজমীর রাঃ কে চিনতে পারলেন। তিনি খাজা আজমীরীকে নিজের মনের মত মানুষ পেয়ে স্বীয় থলি হতে একটি ফল বের করে তার একটি টুকরা চিবায়ে তাঁর মুখের মধ্যে ফেলে দিলেন। উক্ত ফল টুকরা তাঁর গলার নিচে নামতেই হযরত খাজা সাহেবের অন্তঃকরণে এক অপূর্ব পরিবর্তন এনে দিল। তার বরকতে তাঁর মানসিক অবস্থার মধ্যে এক বিরাট বিপ্লবের সৃষ্টি হল। জীবনের গতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে পড়ল। এশকে এলাহী তাঁর অন্তরে প্রভাব বিস্তার করতে লাগল।
সেই বুযুর্গ ব্যক্তি নিজের কাজ সম্পন্ন করে চলে গেলেন। এদিকে খাজা সাহেব এক নতুন বৈপ্লবিক সংকল্পের সিদ্ধান্ত নিলেন। বাগান, চাক্কী এবং অন্যান্য যাবতীয় সরঞ্জাম বিক্রি করে তার মূল্য বাবত প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়ে সম্পূর্ণ একা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভর করে বের হয়ে পড়লেন।
চিশতি উপাধির কারণ : হযরত খাজা আজমীরী রাঃ কে চিশতি বলার কারণ এই যে, তাঁর পীর মোর্শেদের সিলসিলা চিশতিয়া তরিকার আদি পীর হযরত খাজা ইসহাক ইরাকী শামী চিশতি রাঃ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই মহপুরুষ হতেই সর্বপ্রথম চিশতি উপাধি আরম্ভ হয়।
খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত কোন একটি গ্রামের নাম চিশত। হযরত খাজা ইসহাক রাঃ এর জন্মভূমি শামদেশ। কিন্তু আল্লাহর বান্দাদের হেদায়েত করার জন্য এবং হাকিকত প্রার্থী ও মারেফাত অন্বেষণকারীদের কে বাতেনী রহস্যাবলী তালকীন দিবার জন্য তিনি চিশতকে নিজের কেন্দ্রস্থল ও বাসস্থান করে নিয়েছিলেন। এই কারণে তাঁকে চিশতি বলা হত এবং তাঁর সিলসিলাভুক্ত সকল বুযুর্গাণে দ্বীনকে চিশতি বলা হয়।
খাজা ওসমান হারূনী রাঃ হতে বিদায় গ্রহণ : আড়াই বছর হযরত খাজা ওসমান হারূনী রাঃ এর দরবারে থেকে তাঁর নিকট হতে বাতেনী কামালিয়ত এবং হাকীকতের রহস্যাবলী সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান লাভের পর খাজা আজমীরী রাঃ পীরের দরবার হতে বিদায় গ্রহণ করেন। এই আড়াই বছরের মধ্যে তিনি পীরের বহু খেদমতে কষ্টসাধ্য রিয়াযত ও মুজাহাদা করেছিলেন। খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ বলেন, খাজা আজমীরী রাঃ তাঁর রিয়াযত ও সাধনার প্রাথমিক অবস্থায় এমন দুঃসাধ্য তরিকার নাফসের সাথে জেহাদ করেছিলেন যে, পন্থা অবলম্বন করেছিলেন করেছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী মহাপুরুষদের মধ্যে এর দৃষ্টান্ত অতি বিরল। তিনি একাধারে সাত শত দিন পর্যন্ত মাত্র ৫ মেসকাল পরিমাণ রুটি দিয়ে ইফতার করতেন, রোজা রাখতেন এবং তিনি মাত্র একখানা চাদর পরিধান করতেন। কোন স্থানে ছিঁড়ে গেলে তার অন্যত্র হতে এক টুকরো কেটে ছিন্নস্থানে তালি লাগাতেন।
পীর-মোর্শেদ হযরত খাজা ওসমান হারুনী রাঃ হতে বিদায় গ্রহণ করে তিনি সর্বপ্রথমে হজ্বের উদ্দেশ্যে দামেশক ও হেজাজ হয়ে মক্কা মোয়াজ্জমায় পৌঁছে হজ্ব সমাধা করেন। তারপর মদিনা শরীফে গমন করে সরাসূলুল্লাহ সাঃ এর পবিত্র রওজা শরীফ জেয়ারত করলেন। অতঃপর সেখান থেকে বাগদাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে বহু ওলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখে কেরামের মজলিসে হাজির হয়ে তাঁদের সংসর্গ লাভ করেন। তাদের মধ্যে হযরত শেখ নজমুদ্দীন কোবরা রাঃ এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাগদাদ হতে সাত মাইল দূরবর্তী সানজার নামক স্থানে খাজা আজমীরী রাঃ তাঁর সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন।
শেখ নজমুদ্দীন কোবরা রাঃ এর খেদমতে কিছুকাল অবস্থান করার পর হযরত খাজা আজমীরী রাঃ বাগদাদে এসে বসবাস করতে থাকেন। এই সময়ে বাগদাদের খলিফা ছিলেন আলমুস্তানজেদবিল্লাহ আব্বাসী। তখন আব্বাসী খেলাফত বড়ই সঙ্কটময় অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতেছিল।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর যুগে সমগ্র ইসলাম বিশ্ব যদিও সংকটময় অবস্থায় নিমজ্জিত ছিল, তথাপি সেই যুগে বহু চিন্তাবিদ, শ্রেষ্ঠ ওলামা ও মাশায়েখে কেরাম বিদ্যমান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে হযরত খাজা শামসুদ্দীন তাবরেযী রাঃ, হযরত শেখ শেহাবুদ্দীন সাহরাওয়ার্দী রাঃ, হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন আত্তার রাঃ, হযরত বাহাউদ্দিন মুলতানী রাঃ, হযরত জিয়াউদ্দীন সাহরাওয়ার্দী রাঃ, হযরত খাজা ওয়াজীহুদ্দীন সাহরাওয়ার্দী রাঃ, হযরত আহমদ কবীর রেফাঈ রাঃ, হযরত শেখ ইয়অসের রাঃ, হযরত আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী রাঃ, হযরত মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী রাঃ, হযরত নেজামুদ্দীন গজনবী রাঃ, হযরত শেখ সাদী সিরাজী রাঃ প্রমুখ বুযুর্গের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ বাগদাদে অবস্থানকালে বাগদাদের জামে মসজিদে প্রত্যহ এলম ও মারেফাতের মজলিশ করতেন। এসমস্ত মজলিশে তিনি এলম, তরিকত ও মারেফাতের তালিম প্রদান করতেন। উক্ত উচ্চ মর্যাদাশালী ও কামেল বুযুর্গ ব্যক্তিগণ এই সকল মজলিশে উপস্থিত থেকে ফায়দা হাসিল করতেন।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ শেখ নজমুদ্দীন কোবরা রাঃ এর সাক্ষাৎ করার পর জিয়াল নামক স্থানে এসে হযরত সৈয়্যেদ বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। এই সাক্ষাৎকার কোন একটি পাহাড়ের পাদদেশে হয়েছিল। এইস্থানে উভয় বুযুর্গ ৫৭ দিন পর্যন্ত একসঙ্গে বাস করেন। অতঃপর খাজা আজমীরী রাঃ বাগদাদ অভিমুখে চলে যান। কেউ কেউ বলেন, পীরের নিকট হতে খেলাফতের খেরকা লাভ করার পর খাজা আজমীরী রাঃ বাগদাদে গিয়েছিলেন, কিন্তু পথিমধ্যে সানজার নামক গ্রামে খাজা নাজমুদ্দীন কোবরা রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর তাঁরা উভয়ে ‘জুদী’ নামক পাহাড়ে গিয়ে হযরত বড়পীর মহিউদ্দিন আবদুল কাদির জিলানী রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এখান থেকে তাঁরা তিনজনই একসঙ্গে জীলানে গমন করেন। সেখান হতে খাজা আজমীরী রাঃ বাগদাদে এসে বসবাস করতে থাকেন।
ইস্পাহানে : সেকালে ইস্পাহানে শেখ মাহমুদ ইস্পাহানী রাঃ নামে এক বিখ্যাত অলিয়ে কামেল বাস করতেন। খাজা আজমীরী রাঃ ইস্পাহানে পৌঁছে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রথম সাক্ষাতেই তাঁরা দীর্ঘ সময় বসে মারেফাতের সূক্ষèতত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করেন এবং উভয়ে একে অন্যের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, কাশফ ও মর্যাদা সম্বন্ধে অবহিত হন। এই সময়ে তিনি খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃও ইস্পাহানে অবস্থান করতেছিলেন। তিনি তখন হযরত খাজা মাহমুদের মুরিদগণের হালকায় প্রবেশ করার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করতেছিলেন। এমন সময় হযরত আজমীরী রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। তাঁর প্রভাবে তিনি এমন আকর্ষিত হলেন যে, শেখ মাহমুদ ইস্পাহানী রাঃ এর মুরিদ হওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর প্রতি ঝুঁকে পড়েন। কিছুদিন আজমীরী রাঃ এর সোহবতে থেকে তালিম ও ফয়েজ হাসিল করার পর খাজা আজমীরী রাঃ স্বীয় চাদর মোবারক খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে প্রদান করেন এবং লোকদের মারেফাত ও হাকিকতের পথ প্রদর্শন করার অনুমতি প্রদান করেন।
পীর-মোর্শেদের প্রদত্ত এই মোবারক ও সম্মানজনক খেরকাটিকে হযরত কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ আশাতীত শ্রেষ্ঠ নেয়ামতরূপে গ্রহণ করেছিলেন। আজীবন তিনি তা নিজের প্রাণের চেয়েও অধিক যত্ন করতেন। তাঁর ইন্তেকালের সময় নিকটবর্তী হলে তিনি এই মোবারক চাদরখানি খাজা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ কে দান করেন। তিনি ইহধাম ত্যাগ করার সময় উক্ত চাদরটিকে সুলতানুল আউলিয়া হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়াকে দান করে যান। তাঁর ইন্তেকালের সময় এই তাবারুকটি শেখ নাসীরুদ্দীন চেরাগে দেহলবী রাঃ এর হস্তগত হয়।

হিন্দুস্তানে : ৭১২ খৃষ্টাব্দে মোহাম্মদ বিন কাসেমের সাথে যে সকল মুসলমান ভারতে এসে সিন্ধু দেশ জয় করেন, তারা তখন সিন্ধুতেই বসতী স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের এই বিজয়ের কোন প্রতিক্রিয়া ভারতবর্ষের অবশিষ্ট অংশের উপর পতিত হয়নি।
মোহাম্মদ বিন কাসেমের সাথে যে সমস্ত মুসলমান ভারতবর্ষে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁরাও ধর্ম প্রচারের কাজ অবশ্যই করেছিলেন। সে যুগে ভারতবর্ষে কোন কোন শ্রেষ্ঠ সূফিয়ায়ে কেরামের সন্ধানও পাওয়া যায়, যারা সিন্ধু, পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় ইসলাম প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই প্রচেষ্টার প্রভাব ভারতবর্ষের অভ্যন্তরভাগে পরিদৃষ্ট হয়নি এবং এসমস্ত মহাপুরুষদের সঠিক ইতিহাসও পাওয়া যায় না বলেই আমরা খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ কে ভারতবর্ষের প্রথম মারেফাতের আলো বা প্রদীপ বলে মনে করি।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ যে সময় ভারতবর্ষে আগমন করেন তখন এদেশে প্রাচীন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাস করত। ইতিপূর্বে এইরূপ ধর্ম ও তার অনুসারী মানুষ খাজা আজমীরী রাঃ এর দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। তৎকালে ভারতবাসীরা কেবল মূর্তিই পূজা করত।
অতএব, তিনি স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করলেন, হিন্দুস্তানই সবচেয়ে অধিক হেদায়তের মুহতাজ। সত্যের পূজারী ও আল্লাহওয়ালা লোকের প্রথম ফরজ আল্লাহ পাকের এই হতভাগ্য বান্দাদের হেদায়ত করা এবং পরকালের আজাব হতে তাদের মুক্ত করে সৎপথে আনেন। যদিও ইতিপূর্বে তিনি কোন স্থানেই এক মাসের অধিক সময় অবস্থান করেননি। কিন্তু ভারতবর্ষের অবস্থা দর্শন করে স্থায়ীভাবে বসতিস্থাপনপূর্বক খোদার বান্দাগণকে খোদার পথের দিকে আনয়নের সংকল্প স্থির করে তিনি পেশওয়ার হয়ে লাহোর আগমন করে হযরত দাতা গঞ্জেবখশ রাঃ এর মাজারে থেকে চিন্তা করতে লাগলেন, কোন স্থানে স্থায়ীভাবে বাস করবেন।
আজমীরে সংকল্প : অবশেষে খাজা আজমীরী রাঃ তাওহীদ ওমারেফাতের রূহানী রাজধানী আজমীর শহাকেই স্বীয় কেন্দ্রস্থল সাব্যস্ত করলেন। সত্য বলতে গেলে এই মনোনয়ন একটি বিস্ময়কর কাজ ছিল। এলহামী সাহায্য ব্যতীত কেবল মানবীয় বুদ্ধি এরূপ মনোনয়ন কখনও করতে পারত না।
এই ভূখণ্ডটি সর্বপ্রকারে হেদায়তের কেন্দ্র বরং রাজ্যের কেন্দ্রস্থল করার জন্যও অতিশয় উপযোগী স্থান ছিল। হেদায়তের কেন্দ্র এই জন্য যে, তখন পর্যন্ত সেখানে ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়নি। বিশেষ করে তার চতুর্দিকে রাজপুতনার রাজ্যসমূহ বিরাজমান ছিল। এই রাজ্যগুলো ইসলাম ধর্মের উন্নতি এবং তাওহীদে ইসলামের তালীমের পক্ষে নিশেষ বাধারূপ ছিল। সুতরাং তথাকার লোকদের সর্বাগ্রে হেদায়ত এবং তাবলীগ করা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। আর আজমীর শহরটি রাজ্যের কেন্দ্র হওয়ার উপযোগী এই কারণে ছিল যে, এই শহরটি গোটা ভারতের কেন্দ্রস্থল। সকল অঞ্চলের সাথে এর দূরত্ব ও যোগাযোগ সম্পর্ক সমান। শহরটির চারদিকে পর্বতমালা বেষ্টিত। তা শহরটি রক্ষার জন্য একটি দৃঢ় প্রাচীর রূপে বিদ্যমান। ফলকথা, অবস্থা ও অবস্থিতির পরিপেক্ষিতে আজমীরকে প্রকারান্তরে ভারতের কেন্দ্রস্থল বলা যেতে পারে। জাহেরী বাদশাহী এবং রূহানী বা বাতেনী বাদশাহী উভয়বিধ শাসন এবং তাবলীগের জন্য এই স্থানটি কেন্দ্রের উপযোগী ছিল।
রাজনৈতিক পরিবেশ : ভারতবর্ষে তৎকালে মুসলমানদের অবস্থা নিতান্ত টলটলায়মান ছিল। ভারতীয়গণ তখন গজনবীদের আক্রমণের কথা বিস্মৃত হয়েছিল। মাহমুদ গজনবীর দুর্বল উত্তরাধিকারীগণের রাজশক্তির প্রদীপ তখন প্রায় নিভু নিভু ছিল।  সীমান্তের মুসলমানগণ একদিকে কাওয়ারাযমীদের, অপর দিকে তাতারীদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ায় ভারতবর্ষের দিকে চোখ তুলে  তাকাবার অবকাশ পাচ্ছিল না। কিন্তু ঘোরী বংশের সেতারা তখন উন্নতির পথে ছিল। শেহাবুদ্দীন ঘোরীর ক্রমবর্ধমান প্রতাপ হিন্দু রাজন্যবর্গের জন্য আতঙ্কস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়েছিল। লাহোর তখন গজনবী শাসকদের অধিকারে ছিল। শেহাবুদ্দীন ঘোরী ইতিপূর্বে হিন্দু রাজাদের কাছে দুই দুইবার পরাজিত হওয়ার কারণে তিনি প্রতিশোধ কামনায় অস্থির ও অশান্ত জীবন যাপন করতেছিলেন। হিন্দুস্তানের চারদিকে হিন্দু রাজাদের আধিপত্য বিস্তৃত ছিল। তারমধ্যে পৃথ্বী রাজের ক্ষমতা সর্বাপেক্ষা অধিক দৃঢ় ও শক্তিশালী ছিল। আর দিল্লী ও আজমীর ছিল হিন্দুদের কেন্দ্রস্থল।
দিল্লীতে : প্রতাপশালী হিন্দু রাজত্বের আমলে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ চল্লিশ জন দরবেশ সহ দিল্লী পৌঁছে শহরের অদূরে এক সাময়িকভাবে আস্তানা স্থাপন করলেন। এসময়ে দিল্লীর হিন্দু রাজন্যদের প্রতাপ ছিল অপরিসীম। শেহাবুদ্দীন ঘোরীর মত বীর ও বাহাদুর শাসকও ইতিপূর্বে দিল্লী এবং আজমীরের রাজাদের কাছে দুই দুইবার পরাজিত হয়েছিল। এসমস্ত কারণে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে অত্যন্ত বিদ্বেষ বিদ্যমান ছিল।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ দিল্লী পৌঁছেই হেদায়তের কাজ আরম্ভ করেছিলেন। যদিও তখন হিন্দুদের সামনে ইসলামের নাম উচ্চারণ করাও তাদের উত্তেজিত করার সামিল ছিল। কিন্তু খাজা আজমীরী রাঃ এর আধ্যাত্মিক শক্তি এবং খাঁটি নিয়তের আকর্ষণ, ওয়াজ নসিহতের গাম্ভীর্য, স্বভাবের নম্রতা ও চরিত্র মাধুর্যের কারণে হিন্দুরা তাঁকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। মুসলমানেরা যেমন ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে তাঁর কথার প্রতি মনোনিবেশ করত, সেরূপ হিন্দুরাও তাঁকে সুদৃষ্টিতে দেখত। ফলে, মুসলিম ও অমুসলিম জনতা ক্রমান্বয়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে লাগল। তা সত্ত্বেও তিনি দিল্লীতে অবস্থান করা পছন্দ করলেন না সত্ত্বরই সেখান থেকে আজমীরের দিকে যাত্রা করলেন। অবশ্য দিল্লী ত্যাগ করার পূর্বে  তিনি নিজে তাঁর প্রসিদ্ধ ও খাস খলিফা হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ কে দিল্লীতে নিজের প্রতিনিধি নিযুক্ত করলেন এবং তাঁকে দিল্লীতে থেকেই সত্য প্রচারের দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ প্রদান করলেন।
আজমীরে : খাজা আজমীরী রাঃ ৫৬১ হিজরীতে আজমীর পৌঁছেন। এসময়ে আজমীর ও তার চারপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন পৃথ্বীরাজ। খাজা সাহেব শহরের অদূরবর্তী এক ময়দানের একটি বৃক্ষের তলদেশে এসে বিশ্রাম করতে লাগলেন। বর্তমান দরগাহ শরীফের সীমারেখার মধ্যে যে উচ্চ বেদীটি আউলিয়া মসজিদ নামে পরিচিত, তাই খাজা সাহেবের সর্বপ্রথম বিশ্রামাগার বা যেখানে তিনি প্রথমে এসে বসেছিলেন। এইস্থানটি পৃথ্বিরাজের উটের বাথান ছিল। উটপালকরা এসে যখন দেখল যে, উটের বাথানে একদল মুসলমান ফকির এসে আড্ডা গড়েছেন। তখন তারা ফকিরদের বলল, এ তো পৃথ্বীরাজের উট বসার স্থান। খাজা সাহেব উত্তরে বললেন, ক্ষতি কি? বিশাল মাঠ, উটেরা এসে এক পার্শ্বে বসে পড়বে। আমাদেরও বিশ্রাম নিতে দাও। কিন্তু উট পালকেরা একথার প্রতি কর্ণপাত না করেই খাজা সাহেবের সাথে কর্কশ ব্যবহার করতে লাগল। খাজা সাহেব বললেন, আচ্ছা, আমরা চলে যাচ্ছি, রাজার উটই এখানে বসে থাকবে। একথা বলেই তিনি এখান থেকে উঠে অন্যত্র চলে গেলেন। সন্ধ্যাকালে রাজার উটের পাল চারণভূমি হতে এসে সেই মাঠে নিত্য অভ্যাস অনুযায়ী বসে পড়ল। রাতটা তো স্বাভাবিক ভাবে কাটল, কিন্তু প্রাতঃকালে যখন উটপালকরা এসে উটগুলোকে চারণভূমিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠাতে চাইল, তখন একটি উটও উঠতে পারল না। এখন তারা বুঝতে পারল যে, তা নিশ্চয় দরবেশদের অসন্তুষ্ট করার ফল, সুতরাং তারা সকলে রাজার কাছে উপস্থিত হয়ে সমুদয় অবস্থা জানাল। রাজা বললেন, যাঁর বদদোয়ার ফলে উটের উত্থান শক্তি রহিত হয়েছে, তাঁর দোয়ায় আবার তাদের উঠার শক্তি ফিরে আসবে। অন্য কোন উপায় নেই। যাও, ফকিরদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। ফকির দরবেশগণ দয়ালু লোক হয়ে থাকেন। অবশ্যই তাঁরা ক্ষমা করে দিবেন এবং উটগুলোও উঠতে পারবে।
অতএব, উটপালকেরা খাজা সাহেবের কাছে এসে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল। খাজা সাহেব ছিলেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ সাঃ এর দৌহিত্র। তিনি সদয় হয়ে বললেন, যাও যার আদেশে উটগুলো বসে রয়েছে, তাঁর আদেশে তারা উঠে দাঁড়াবে। উট চালকেরা প্রত্যাগমন করে দেখল, উটগুলো সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দাঁড়ায়ে রয়েছে। খাজা সাহেবের এই কারামত দেখে হিন্দুজনগণ আতঙ্কিত ও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ল।
যাহোক, এই বিরূপ পরিবেশের মধ্যেও তিনি যেরূপ নীরবতার সাথে জীবন যাপন করতে লাগলেন, তাতে পৃথ্বীরাজের পক্ষ হতে তাঁর বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ না হওয়াই সঙ্গত ছিল। হাঁ, তবে একটি অভিযোগ এই হতে পারত যে, তাঁর পরশমণি তুল্য ক্রিয়াশীল সংশ্রব এবং জাদুকরী ভাষা এমন অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করতেছিল যে, যে কেহ তাঁর কাছে আসত, সে তৎক্ষণাৎ তাঁর ভক্তে হয়ে পড়ত এবং অতি অল্প দিনের মধ্যেই তাওহীদের প্রকৃত তথ্য এবং খোদা পুরুস্তীর শান উপলব্ধি করতে সক্ষম হত। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই সহস্র লোক তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ লোকদের মধ্যে তাঁর কারামত ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের খ্যাতি ছড়ায়ে পড়ল।
পৃথ্বিরাজের উটপালকেরা উটের বাথান হতে খাজা সাহেবকে উঠায়ে দিলে তিনি সেখান থেকে অনতিদূরে আনাসাগর নামক নদীর তীরে গিয়ে আস্তানা স্থাপন করেন। এই আনাসাগরের উভয় তীরে হিন্দুদের বহু দেবমন্দির বিদ্যমান ছিল। তার মধ্যে একটি মন্দির ছিল অতি বড় এবং জাঁকজমকপূর্ণ। আমীর ওমরাগণ এবং স্বয়ং রাজা এই মন্দিরে আসত। এই প্রধান ও শ্রেষ্ঠ মন্দিরটির ব্যয় নির্বাহের জন্য কয়েকটি গ্রামও ওয়াকফ করা ছিল। আনাসাগরের উভয় তীরের এই মন্দিরগুলোতে প্রতি রাতে কয়েক মণ তৈল খরচ হত এবং কয়েক শত পূজারী সর্বদা এই মন্দির গুলোর সেবায় নিয়োজিত থাকত।
বলা বাহুল্য, হিন্দুদের এমন ধর্মীয় কেন্দ্রস্থলে খাজা সাহেব এবং তাঁর সঙ্গীদের উপস্থিতি পূজারী ও সেবাইত এবং সাধারণ হিন্দুরা কোনক্রমেই বরদাশত করতে পারতেছিল না। সুতরাং পূজারী ও সেবাইতগণের মিলিত এক প্রতিনিধিদল রাজ দরবারে এসে আবেদন জানাল যে, মুসলমান ফকিরদের অবস্থানের দরুন ধর্মমন্দিরের পবিত্রতা ক্ষুন্ন হচ্ছে। অতএব, যে কোন প্রকারেই হোক তাদের মন্দির অঞ্চল হতে বিতাড়িত করা উচিত। কেননা, এই দরবেশরা যদি কিছুকাল এখানে টিকে থাকতে পারে, তবে এখন তাদের এখান থেকে বিতাড়িত করার যে সামান্য সম্ভাবনা আছে, তাও থাকবে না। তখন আক্ষেপ ও অনুতাপ করা বিফল হবে।
স্বাভাবিক ভাবেই মুসলমানদের প্রতি হিন্দুরা বিদ্বেষ ভাবপন্ন ছিল। দ্বিতীয়তঃ, এই সময়ে সীমান্তের মুসলিম বাদশাহগণ সমগ্র আর্যবর্তকে নিজেদের অধিকারে আনায় চেষ্টায় হিন্দুস্তানের উপর পুনঃপুনঃ আক্রমণ চলাতেছিল। তদুপরি হিন্দুদের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে হযরত খাজা সাহেবের ব্যক্তিগত এবং রূহানী প্রভাব হিন্দু জাতিয়তাবাদকে চুরমার করে দেশীয় রাজবর্গদের দুর্বল করে দিতেছিল। মোটকথা, এসকল ঘটনাবলীর কারণে পৃথ্বীরাজ খাজা সাহেবের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল এবং তাঁর খাঁটি ধর্মীয় মিশনকে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা বলে স্থির করল। যার ফলে পৃথ্বীরাজ পূজারিন ও সেবাইতদের প্রতিনিধিদেরকে অনুমতি দিল যে, সরকারী লোকদের সহায়তায় ফরিকদের মন্দিরের পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে বিতাড়িত করা হোক। অনুমতি পেয়ে তারা খাজা সাহেবের বিরোধিতায় লেগে গেল।
হযরত খাজা সাহেবের এক মুরিদ পৃথ্বীরাজের সভাসদ ছিল। ধর্মের বিভিন্নতা সত্ত্বেও পৃথ্বীরাজ তাকে খুব সম্মান করত। এই ভক্তপ্রবর প্রায়ই পৃথ্বীরাজের দরবারে খাজা সাহেবের ভূয়সী প্রশংসা করত এবং খাজা সাহেবের প্রতি তার অনুরাগ ও ম্রদ্ধার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করত। যর কারণে পৃথ্বীরাজ তার প্রতি খুবি বিরক্ত হয়ে উঠল এবং তাকে তিরস্কার করতে ও তার সাথে কর্কশ হতে কর্কশতর ব্যবহার করতে লাগল। কিন্তু ভক্তপ্রবর জানত না যে, তার প্রতি পৃথ্বীরাজের এত অসন্তোষ ও রোষের একমাত্র কারণ হযরত খাজা সাহেব। কাজেই সে হযরত খাজা সাহেবের দরবারে এসে আরজ করল, রাজা পৃথ্বীরাজ আমার প্রতি ক্রমশঃ অসন্তুষ্ট ও অপ্রশন্ন হয়ে চলেছেন। তার এই অসন্তোষ ও ক্রোধ দেখে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে আমার কোন ভয়ঙ্কর ক্ষতি না করে বসে। অতএব, আপনার কোন প্রকার আপত্তি না থাকলে আমার সম্বন্ধে তার কাছে একটু সুুপারিশ করুন। হযরত খাজা সাহেব কোনরূপ দ্বিধা সংকোচ না করে তার জন্য পৃথ্বীরাজের কাছে সুপারিশ লিপি লিখে দিলেন।
এই সুপারিশ লিপি পৃথ্বীরাজের ক্রোধের অগ্নিকে আরও অধিক উত্তেজিত করে দিল। সুতরাং সে ক্রোধ ও অহংকারের ভাষায় তার সভাষদণকে বলল, এই ব্যক্তি (হযরত খাজা সাহেব) আমার রাজ্যে কোন অধিকারে এসেছো এবং নানা প্রকার অলৌকিক ক্রিয়া কলাপ প্রদর্শন করে এবং নানা প্রকার চিত্তাকর্ষক কথা শুনায়ে সে সাধারণ লোকদের পথভ্রষ্ট করছো।
বিদ্বেষপরায়ণ হিন্দুদের এই বিরোধিতামূলক আচরণের সময় হযরত খাজা সাহেবের কতকগুলো কারামত এবং অলৌকিক ক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছিল, যা দর্শন করে সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন লোকও খাজা সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়তেছিল। শাদীদেব ও জয়পালযোগী খাজা সাহেবের সাথে তন্ত্র-মন্ত্রে প্রতিযোগীতা করে পরাজয় বরণ ও তৎপর ইসলাম কবুল করা সম্বন্ধে দুটি প্রসিদ্ধ ঘটনা ঘটে। এখানে তা উল্লেখ করা হল।
শাদীদেব একজন শ্রেষ্ঠ মোহন্ত ও যাদুকর ছিল। খাজা সাহেবকে ইন্দ্রজালের সাহায্যে সেখান থেকে বিতাড়িত করার জন্য পৃথ্বীরাজ শাদীদেবকে ডাকায়ে আনলেন। শাদীদেব তার সহচরসহ হযরত খাজা সাহেবকে পর্যুদস্ত করার উদ্দেশ্যে আসল বটে, কিন্তু হযরত খাজা সাহেবের দৃষ্টি তার প্রতি পতিত হওয়ামাত্র সে মন্ত্রমুগ্ধের মত নিজের তন্ত্র-মন্ত্র সব কিছুই ভুলে গেল। অতঃপর হযরত খাজা সাহেবের বুযুর্গী উপলব্ধি করে তাকে কষ্ট দেয়ার সংকল্প ত্যাগ করে তাঁর পবিত্র হস্তে ইসলাম কবুল করল। এই ঘটনার পর হিন্দুরা আরও দ্বিগুণভাবে খাজা সাহেবের প্রতি জ্বলে উঠল।
পৃথ্বীরাজের গুরু রাজা জয়পাল যোগী হিন্দুস্তানের একজন বিরাটকায় অজগর এবং আগুনের চক্র সৃষ্টি করেছিল এবং তার যাদুর প্রভাবে সম্পূর্ণ ময়দানে এক ধুম্র জালের সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত খাজা সাহেব তা দেখে নিজের লাঠি দিয়ে নিজের ও সহচরবৃন্দের চতুর্দিকে একটি রেখা আঁকলেন এবং কোন কিছুর প্রতি তিনি ভ্রুক্ষেপ না করে নামাজে মশগুল হয়ে গেলেন। নামাজান্তে এক মুষ্টি ধুলা নিয়ে তাতে আল্লাহর নামে ফুঁ দিয়ে যাদুকরদের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। ফলে সমস্ত অজগর, অগ্নিচক্র ও ধুম্রজাল বিলীন হয়ে গেল।
জয়পাল যোগী এবং তাঁর সাথীরা প্রথমতঃ খাজা সাহেবের রোখাচক্রের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য বহু চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারল না। দ্বিতীয়তঃ খাজা সাহেবের ধুলি নিক্ষেপের ফলে সমস্ত অজগর, অগ্নি চক্র ও ধুম্রজাল বিলীন হয়ে যাওয়ায় উপলব্ধি করল যে, হযরত খাজা সাহেবের এ সমস্ত ক্রিয়াকলাপ ঐন্দ্রজালিক কিংবা যাদু নয়। বরং ঐশী শক্তির প্রভাবেই এরূপ ঘটছে। অতএব কাল বিলম্ব না করে সদলবলে রাজা জয়পালও ইসলাম গ্রহণ করলেন। ইসলাম গ্রহণের পর খাজা সাহেব জয়পালের নাম রাখলেন আবদুল্লাহ বিয়াবানী। বিয়াবানী অতঃপর হযরত খাজা সাহেবরে সোহবতে থেকে অতি উচ্চ স্তরের কামালিয়ত হাসিল করেন এবং ৫৯২ হিজরির ২১ শে জামাদিউল উলায় হযরত খাজা সাহেবের নিকট হতে খেলাফত লাভ করেন। এসমস্ত কারণে পৃথ্বীরাজ তার সভাষদমণ্ডলী ও দেশের সাধারণ হিন্দুরা রাগান্বিত হওয়া এবং পৃথ্বীরাজ স্বীয় দরবার কক্ষে উপস্থিত সভমণ্ডলীকে লক্ষ্য করে হযরত খাজা সাহেবের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা স্বাভাবিক ছিল।
পৃথ্বীরাজের প্রতি খাজা সাহেবের সাবধান বাণী : ইতিমধ্যে খাজা সাহেব পৃথ্বীরাজকে ইসলাম প্রহণের দাওয়াতনামা পাঠালেন। পত্রে তিনি ইসলামের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্বদ্ধে পৃথ্বীরাজকে যথেষ্ট উপদেশ প্রদান করেন এবং প্রতিমাপূজার পরিণাম সম্পর্কে বিষদ বিবরণ দান করে বলেন, তা একদিন তোমার জন্য বিশেষ লজ্জা ও অনুতাপের কারণ হবে। কিন্তু সে হযরত খাজা সাহেবের উপদেশের প্রতি আদৌ ভ্রুক্ষেপ করল না। বরং এখন হতে সে হযরত খাজা সাহেব এবং মুসলমান প্রজাদের প্রতি কটুক্তি ও প্রকাশ্যে বিরোধিতা আরম্ভ করে দিল।
পৃথ্বীরাজ ক্রোধভরে স্বীয় দরবার কক্ষে বসে হযরত খাজা সাহেবের বিরুদ্ধে যে অশোভন উক্তি করেছিল তা হযরত খাজা সাহেবের কর্ণগোচর হল। তিনি ক্রোধভরে এক খণ্ড কাগজে “আমি তোমাকে জীবিতই ইসলামী সেনাবাহিনীর হস্তে সমর্পণ করলাম।” লিখে পৃথ্বীরাজের কাছে পাঠায়ে দিলেন।
যেদিন তিনি পৃথ্বীরাজকে লিখে পাঠালেন যে, আমি তোমাকে জীবিত অবস্থায়ই মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে সোপর্দ করলাম। সেই রাতেই হযরত খাজা সাহেব শেহাবুদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরীকে স্বপ্নযোগে আদেশ করলেন, শীঘ্র হিন্দুস্তান আক্রমণ কর। এবার তুমি জয়লাভ করবে। কেহ কেহ বলেন, সুলতান মোহাম্মদ ঘোরী স্বপ্নে দেখণেলন, নূরানী চেহারাধারী এক ব্যক্তি সিংহাসনের উপর সমাসীন। বহু চাকর-নকর তাঁর সামনে সারিবদ্ধ হয়ে করজোড়ে দণ্ডায়মান। তাদের মধ্য হতে এক খাদেম অগ্রসর হয়ে সুলতানের হাত ধরে মুসলিম সেনাবাহিনীর সোপর্দ করে বলল, তোমাকে হিন্দুস্তানের রাজত্ব প্রদান করা হল। সুলতান প্রাতঃকালে মুসাহেবদের কাছে এই স্বপ্ন বর্ণনা করলে তাঁরা মোবারকবাদ জানায়ে বললেন, এই স্বপ্নে তাবীর হল, অচিরেই আপনার হাতে ভারতবর্ষ বিজিত হবে।
এই স্বপ্নের প্রেরণায়ই সুলতান শেহাব্দ্দুীন মোহাম্মদ ঘোরী দ্বিতীয়বার হিন্দুস্তান আক্রমণ করে বিজয় লাভ করে। এই জন্যই ঐতিহাসিকগণ সুলতান মোহাম্মদ ঘোরীর এই ভারত বিজয়কে খাজা আজমীরী রাঃ এর ভবিষ্যদ্বানী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
ভারতবর্ষে মুসলিম হুকুমত প্রতিষ্ঠা : মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধে বিজয় লাভের পর পৃথ্বীরাজের পুত্র মুসলিম অধিনতা স্বীকার করায় মোহাম্মদ ঘোরী তাকেই গজনী রাজ্যের ফরমাবরদার ও করদাতারূপে আজমীরের সিংহাসনে বসালেন এবং কুতুবুদ্দীন আইবেককে স্বীয় প্রতিনিধিরূপে সমগ্র ভারতের (মুসলিম বিজিত অংশের) শাসক নিযুক্ত করলেন।
মোহাম্মদ ঘোরী ভারত বিজয় সমাপ্ত করে প্রথমে আজমীর শরীফে হযরত খাজা সাহেবের দরবারে এসে তাঁর কদমবুছি করেন এবং সেখানেই জুমার নামাজ আদায় করেন। তারপর পূর্ণ তিন দিন হযরতের দরবারে থাকার পর গজনী ফিরে যান। মোহাম্মদ ঘোরী জানতেন, এই সফলতা হযরত খাজ আজমীরী রাঃ এর দোয়ার বরকতেই সম্ভব হয়েছে।
আজমীরে ইসলামী যুগ : কুতুবুদ্দীন আইবেক সাইয়্যেদুসসাদাত সায়্যেদ হাসান মাশহাদী রাঃ কে আজমীর শহরের কোতওয়াল নিযুক্ত করলেন। সাইয়্যেদ হাসান মাশহাদী রাঃ শিয়া মাজহাব অবলম্বী ছিলেন। এই কারণে হযরত খাজা সাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্রমশঃ ঘনিষ্ট হতে ঘনিষ্টতর|

খাজা আজমীরী রাঃ এর শেষ যুগ : এই সময়ে তাঁর প্রভাব এমন স্তরে পৌঁছেছিল যে, যারা এখনও পর্যন্ত ঈমান আনেনি, তারাও তাঁকে সম্মান এবং মর্যাদার চোখে দেখতেন। তাঁর রাব্বানী মিশনের জন্য টাকা পয়সা এবং হাদিয়া তোহফা প্রদান করে সাহায্য করত।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর মুরিদ ও খলিফা হযরত কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ তাঁর নির্দেশক্রমে দিল্লীতে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর হেদায়েতের আলোকসমূহের একটি প্রদীপ তাঁরই বরকতে দিল্লীতে প্রজ্বলিত করেছিলেন। দিল্লীই ছিল তৎকালে ভারতাধিপতি মুসলিম সম্রাটগণের কেন্দ্রস্থল ও আবাসস্থল।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর মোর্শেদ হযরত ওসমান হারূনী রাঃ সুলতান আলতামাশের শাসনামলে দিল্লীতে তশরিফ এনেছিলেন। সুলতান আলতামাশ যদিও বাদশা ছিলেন কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল ফকির। কম খাওয়া এবং কম শয়ন করা তাঁর অভ্যাস ছিল। তিনি হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর একান্ত ভক্ত ছিলেন। তিনি খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর মুরিদ এবং খলিফা ছিলেন। তিনি চিমতিয়া খান্দানের প্রতি খুব ভক্তি ও মহব্বত রাখতেন। বাদশাহ হয়েও তিনি নিজের কাজ কর্ম যথাসম্ভব নিজের হাতেই করতেন, চাকর নকরদের কখনও কষ্ট দিতেন না। রাতে শয়ন কালে বালতি ও রশি নিজের চৌকির নিচে রাখতেন। যেন তাহাজ্জুদের সময় অজু ও অন্যান্য কাজের প্রয়োজন হলে নিজেই কূপ হতে পানি উঠায়ে নিতে পারেন।
হযরত খাজা সাহেবের ওফাত : হিজরি ৬৩৩ সালে হযরত খাজা গরিবনেওয়াজ মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতি সানজরী রাঃ ইন্তেকাল করেন। আজমীর শরীফেই তাঁর মাজার শরীফ বিদ্যমান। প্রতি বছর রজব মাসে তাঁর ওরোছ শরীফ উদযাপিত হয়। সে পবিত্র অনুষ্ঠানে দেশ বিদেশ হতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান যোগদান করেন এবং তাঁর মাজার শরীফ জেয়ারত করেন।
বিবাহ ও সন্তান : হযরত খাজা সাহেব নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে ও রিয়াজতে লিপ্ত ছিলেন। অতঃপর তিনি নবীর সুন্নত রক্ষার্থে বিবাহ করেন। তাঁর দুই পত্মী ছিলেন। একজনের নাম আমাতুল্লাহ আর অপর জনের নাম ছিল বিবি ইসমত।
হযরত খাজা সাহেব রাঃ এর ঔরসজাত সন্তান-সন্তুতিগণ হলেন- খাজা ফখরুদ্দীন, আবুল খায়ের খাজা যিয়াউদ্দিন এবং শায়খ হোসামুদ্দীন নামে তিন পুত্র এবং বিবি হাফেয জামাল নামে এক কন্যা।
হযরত খাজা ফখরুদ্দীন রাঃ কোন এক জেহাদে শহীদ হন। তাঁর মাজার শরীফ কৃষ্ণগড়ে সারদার নগরে অবস্থিত। তা আজমীর হতে ষোল ক্রোশ দূরবর্তী একটি শহর। তাঁর সন্তানগণ হতে হযরত খাজা আজমীরী রাঃ বংশধর আজ পর্যন্ত চলে আসছে।
হযরত শায়খ হোসামুদ্দীন রাঃ কারামতের অধিকারী বুযুর্গ ছিলেন। তাঁর মাজার শরীফ কাসবা সাম্ভারে অবস্থিত।
হযরত খাজা সাহেবের একমাত্র কন্যা বিবি হাফেয জামালের বিবাহ শেখ রাযী রাঃ এর সাথে হয়। হযরত খাজা সাহেব স্বয়ং কন্যার তালিম ও তরবিয়াত দিয়ে তাঁকে বুযুর্গের স্তরে পৌঁছেছিলেন। হযরত আজমীরী রাঃ এর এই কন্যা তাঁর নির্ধারিত সময় অনুসারে হিন্দু রমনীদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতেন। তাঁর গর্ভজাত দুই পুত্র সন্তান ছিল। তারা অল্প বয়সেই মারা যান। তাঁর মাজার শরীফ পিতার মাজার শরীফের পিছনের দিকে অবস্থিত।
হযরত খাজা সাহেবের ইবাদত ও রিয়াজতের পদ্ধতি ঃ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ এর রিয়াজত ও ইবাদতের ধরন ছিল অসাধারণ। অধিকাংশ সময় এক সপ্তাহ পর্যন্ত কিছুই আহার করতেন না। সাধারণত পাঁচ মেসকাল ওজনের রুটি শুধু পানিতে ভিজায়ে তা দিয়ে রোজার ইফতার করতেন।
তিনি সবসময় অজুর সাথে থাকতেন। সত্তর বছর পর্যন্ত তিনি এশার নামাজের অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। সারা জীবনে তিনি দিনে রোজা রাখতেন এবং রাতে কঠোর ইবাদত করতেন। দিবা-রাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুইবার কুরআন শরীফ খতম করতেন। প্রত্যেক খতমের পর গায়েব হতে আওয়াজ আসত “মুঈনুদ্দীন ! আমি তোমার কুরআন শরীফ খতম কবুল করলাম। তাছাড়াও তাঁর বহু অজিফা ছিল।
আখলাক : তিনি বড়ই মধুর এবং অমায়িক চরিত্রের মানুষ ছিলেন। ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, স্নেহ, দয়া তথা সর্ববিধ মানবিক গুণে তিনি পরিপূর্ণ ছিলেন। হিংসা বিদ্বেষ হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ছিলেন। এই কারণেই প্রত্যেক দলের ও ধর্মের লোক তাঁকে মনে প্রাণে সম্মান করত এবং প্রথম সাক্ষাতেই তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ত।
তাঁর ক্ষমাগুণ সম্বন্ধে হযরত খাজা কুতবুদত্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ বলেন, আমি কখনও তাঁকে কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হতে দেখিনি। একবার তিনি স্বীয় খাদেম শেখ আলীকে সঙ্গে নিয়ে সফর করতেছিলেন। পথিমধ্যে এক ব্যক্তি শেখ আলীর কাপড় ধরে টানাটানি আরম্ভ করল। খাজা আজমীরী রাঃ লোকটিকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আপনার এই খাদেম আমার কাছে ঋণী। সে আমার ঋণ পরিশোধ করছে না। হযরত খাজা সাহেব বললেন, আমার খাদেম যদি সত্যিই তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকে, তবে এই চাদরের নিচ হতে তোমার প্রকৃত প্রাপ্য নিয়ে যাও। লোকটি ছিল লোভী। সে তার প্রকৃত প্রাপ্যের চেয়ে অধিক নিল। ফলে আল্লাহ পাকের ইশারায় তৎক্ষণাৎ তার হাত অবশ হয়ে গেল। তখন সে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। হযরত খাজা সাহেব তখনই তাকে ক্ষমা করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত পূর্ববস্থা প্রাপ্ত হল।
আর একদিন একব্যক্তি কারো প্ররোচনায় হযরত খাজা সাহেবকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আসল। তিনি পূর্বেই তা জানতে পেরেছিলেন। সে ব্যক্তি তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে খুব ভক্তি ও শ্রদ্ধার ভাব দেখাতে লাগল। হযরত খাজা সাহেব যদিও জানতেন যে, এই লোকটি প্রতারণামূলক ব্যবহার করছে, কিন্তু তিনি তাকে নিজের কাছে বসায়ে বললেন, তুমি যে উদ্দেশ্যে এসেছো তা পূর্ণ কর।
এই কথা শুনামাত্র লোকটির শরীরে কম্পন আরম্ভ হল। সে তৎক্ষণাৎ বগলের ভিতর হতে একটি ছোরা বের করে হযরত খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে রেখে বলল, আপনি আমাকে এই কাজের সমুচিত শাস্তি প্রদান করুন। আমি সানন্দে তা গ্রহণ করব। হযরত খাজা সাহেব বললেন, আমার সঙ্গে যে অসদ্ব্যবহার করে, তার সঙ্গেও আমি সদ্ব্যবহার করি। এই বলে তিনি তাকে মাফ করে দিলেন। সে তওবা করে হযরত খাজা সাহেবের খেদমতে অবস্থান করতে লাগল।
ইসলাম প্রচার : হযরত খাজা সাহেব রাঃ এর প্রধান কাজ ছিল ইসলাম প্রচার। তিনিই সর্বপ্রথম এমন একটি সিলসিলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার দ্বারা শুধু সাধারণ অমুসলমানই ইসলাম গ্রহণপূর্বক মারেফতের মঞ্জিলসমূহ অতিক্রম করেনি। বরং বহু আল্লাহ ওয়ালা বুযুর্গ লোকও এই সিলসিলার উসিলায় রূহানিয়াতের স্তরসমূহ অতিক্রম করে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন।
যে সময়ে হযরত খাজা সাহেব হিন্দুস্তানে আগমন করেছিলেন তখন হিন্দুস্তানের কোথাও কোন ইসলামী রীতি-নীতি দৃষ্টিগোচর হত না। তাঁর চেষ্টার ফলে অতি দ্রুত চারদিকে ইসলামী তাহযীব ছড়ায়ে পড়েছিল। মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। দিল্লী এবং আজমীরের মত কোফরস্থানেও আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগল এবং তাঁর চেষ্টার ফলে হিন্দুস্তানে ইসলামী হুকুমত প্রবল প্রতাপের সাথে প্রতিষ্ঠিত হল।
তিনি ষাট জনেরও অধিক পূর্ণ তত্ত্বজ্ঞানী ও সুযোগ্য খলিফাকে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন এলাকায় তাবলীগের কাজে নিযুক্ত করেন। তারা তৎকালীন ভারতবষের্ংর দূর দূরান্তে ছড়ায়ে পড়ে আল্লাহর বান্দাগণকে আল্লাহর পথ প্রদর্শনে নিয়োজিত হন।
তিনি নিঃস্ব, দরিদ্র, ইয়াতিম, মুসাফির ও তালেবে- এলেমদের জন্য ব্যাপকভাবে লঙ্গরখানাও খুলেছিলেন। হিন্দুস্তানে এই শ্রেণীর লঙ্গরখানাই ছিল প্রথম। হযরত খাজা সাহেবের কাছে শিক্ষা ও দীক্ষাপ্রাপ্ত যে সমস্ত লোক নিজ নিজ সময়ে শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত আউলিয়রূপে অতীত হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই এই লঙ্গরখানা দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন। লঙ্গরখানার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি কখনও কারো কছে এক কপর্দকও সাহায্য চাইতেন না। যখন যা প্রয়োজন হত, নিজের মুসাল্লার এক কোণ উল্টায়ে তার নিচ হতে নিয়ে খাদেমকে দিয়ে দিতেন। এই লঙ্গরখানায় প্রত্যহ হাজার হাজার রোক আহার করত। খাজা সাহেবের রকারামত এই ছিল যে, উপস্থিত যত লোকের খানা পাক হত, ঘটনাক্রমে তার তিন চার গুণ বেশী লোক আসলেও সেই খাদ্যেই সকলের প্রয়োজন মিটত।
বাতেনী কামালিয়ত : হযরত খাজা মাহবুবে এলাহী নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ বলেন, আজমীর রাজ্যে সেওয়ান নামক নগরে হামীদ নামক এক ধনী লোক বাস করত। সে খুবই সুদর্শন ছিল। সে সুন্দরী রমণী দেখলেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ত। হামীদের বন্ধু-বান্ধব ও মুসাহেবরা সর্বদা তার সঙ্গে থেকে তাকে পথভ্রষ্টতা ও মন্দ কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করত। ঘটনাক্রমে তার সুবুদ্ধির উদয় হল। সে ঐসমস্ত খারাপ বন্ধু-বান্ধবদের ত্যাগ করে হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর খেদমতে অবস্থান করতে লাগল। অতি অল্প কয়েকদিনের সংসর্গের ফলেই সে সর্বপ্রকারের মন্দ কাজ ত্যাগ করে সরল ও সৎপথে এসে পড়ল। তার অসৎ বন্ধু-বান্ধব ও মুসাহেবরা তাকে পুনরায় পথভ্রষ্ট করার জন্য চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের কোন চেষ্টাই আর কার্যকরী হল না।
হযরত খাজা সাহেব তার প্রতি খাস তাওয়াজ্জুহ প্রদান করলেন। ফলে হামীদ সেওয়ানীর চোখ খুলে গেল, অন্তর নূরময় হয়ে গেল। অবশেষে তিনি আল্লার অলির দরজায় পৌঁছলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ধর্মপথে দৃঢ়তা দান করলেন।
একবার হযরত আজমীরী রাঃ এক কাফেরের প্রতি দৃষ্টি করে বললেন, এই ব্যক্তি পারলৌকিক নেয়ামতের অধিকারী একজন অলি আল্লাহ। এক জন কাফের সম্পর্কে হযরত খাজা সাহেবের এরূপ উক্তি শ্রবণ করে লোকে অবাক হয়ে রইল। কিছুদিন পর সেই ব্যক্তি হযরত খাজা সাহেবের খেদমতে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করল এবং তাঁর সোহবতে থেকে আউলিয়া শ্রেণীভুক্ত হয়ে গেল। তখন লোকে হযরত খাজা সাহেবের পূর্ববর্তী উক্তির তাৎপর্য বুঝতে পারল। এইরূপে অধিকাংশ লোহ-কঠিন মানুষ হযরত খাজা গরীব নাওয়ায রাঃ এর অনুগ্রহ দৃষ্টির ফলে স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়ে যেত। অর্থাৎ, তাঁর সোহবতের ফলে মন্দ হতে মন্দতর ব্যক্তিও নেনকার মূর্ত প্রতীক হয়ে যেত।
একবার তিনি বলখের নিকটবর্তী কোন এক বাগানে অবস্থান করতেছিলেন। সে সময় একদা তাঁর খাদেম একটি পাখি শিকার করে এনে তার কাবাব প্রস্তুত করতেছিল। তখন বলখে মাওলানা জিয়াউদ্দিন বলখী নামে একজন হাকীম ছিলেন। হাকীম সহেবের আকীদা খারাপ ছিল। তিনি তাসাউফের ঘোর বিরোধী ছিলেন। হাকীম সাহেব বলতেন, তাসাউফ একটি অনর্থক বিষয়, জ্ঞানহীন লোকেরা তাতে লিপ্ত হয়। ঘটনাক্রমে হাকীম সাহেব সেই বাগানে এসে উপস্থিত হলেন।
হযরত খাজা সাহেবের খাদেমকে কাবাব প্রস্তুত করতে দেখে তাঁর কাবাব খাওয়ার ইচ্ছা হল। খাজা সাহেব তখন নামাজে মশগুল ছিলেন। হাকীম সাহেব সেখান থেকে একটু দূরে বসে মনে মনে ভাবতেছিলেন, এই বুযুর্গ লোকটি নামাজ শেষ করলে তাঁর কাছে কাবাব খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন। হযরত খাজা সাহেবের নামাজ শেষ হলে খাদেম কাবাব এনে তাঁর সামনে রাখলেন। হযরত খাজা সাহেব খাদেমকে বললেন, এই কাবাব হাকীম সাহেবকে দিয়ে এসো। খাদেম তশতরী উঠায়ে হাকীম সাহেবের সামনে উপস্থিত করল। হাকীম সাহেব তা হতে কিছু কাবাব তুলে দিতেই তাঁর অন্তর হতে সমস্ত দার্শনিক মতবাদ বিলীন হয়ে গিয়ে সেখানে মারেফাতের গূঢ় তত্ত্বসমূহ স্থান অধিকার করে নিল, হাকীম সাহেব আত্মহারার মত হয়ে গেলেন। হযরত খাজা সাহেব হাকীম সাহেবের অবস্থা দেখে অবশিষ্ট কাবাবটুকু তার মুখে উঠায়ে দিলেন। তার বরকতে হাকীম সাহেব আত্মহারা অবস্থা হতে সজ্ঞানে ফিরে আসলেন। অতঃপর হাকীম সাহেব হযরত খাজা সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়লেন এবং কিছুকাল হযরত খাজা সাহেবের সোহবতে থেকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন।
হযরত খাজা সাহেব বাগদাদে অবস্থানকালে সেখানে সাতজন বিখ্যাত অগ্নিপূজক বাস করত। তারা খুব রিয়াযত ও ইবাদত করত, খুব অল্প আহার করত। খুব কম ঘুমাত। তাদের এই কঠোর সাধনা দেখে বহু লোক তাদের ভক্ত হয়ে পড়েছিল। তারা যখন হযরত খাজা আজমীরীর খ্যাতি, বুযুর্গী এবং কামালিয়াতের কাহিনীসমূহ শুনতে পেল, তখন তারা সাতজন একই সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসল। হযরত খাজা সাহেব তাদের প্রতি নজর করতেই তারা ভয়ে কাঁপতে লাগল এবং তাদের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সুতরাং তারা হযরত খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে লুটায়ে পড়ল। হযরত খাজা সাহেব বললেন, তোমরা প্রকৃত মাবুদকে ত্যাগ করে অগ্নিপূজা করছো তোমাদের লজ্জা হয় না।
তাঁরা বলল, আমরা অগ্নির উপাসনা এই জন্য করছি, যেন কাল পরলোকে অগ্নি আমাদেরকে দগ্ধ না করে। হযরত খাজা সাহেব বললেন, তোমরা পথভ্রষ্ট হয়েছো, আল্লাহ তায়ালার ইবাদত না করা পর্যন্ত অগ্নি হতে কখনও রক্ষা পেতে পারবে না।
তারা বলল, আপনি কি সেই খোদারই ইবাদত করে থাকেন? তিনি বললেন, নিশ্চয় ! আমি সেই প্রকৃত মাবুদেরই ইবাদত করছি, তিনি ভিন্ন জমিন ও আসমানের মধ্যে ইবাদতের উপযুক্ত আর কেহ নেই। তারা বলল, অগ্নি আপনাকে দগ্ধ করে না? হযরত খাজা সাহেব বললেন, আমি তো তাঁরই বান্দা। অগ্নি তাঁর বান্দা মুঈনুদ্দীনের জুতাও গন্ধ করতে পারে না। তারা বলল, যদি ব্যাপার এইরূপ হয়, তবে আমরা সকলে আপনার খোদার প্রতি ঈমান আনব।
খাজা সাহেব তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পা মোবারক হতে জুতা খুলে অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, হে অগ্নি ! সাবধান, মুঈনুদ্দীনের জুতায় যেন আঁচ না লাগে। তাঁর নির্দেশ অগ্নি অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। খাজা সাহেবের জুতা যেমনটি ছিল তেমনই রয়ে গেল। তা দেখে সমাগত অগ্নিপূজকেরা সকলেই কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে মুসলমান হয়ে গেল এবং তাঁর সোহবতে অবস্থান করতে লাগল।
একবার খাজা সাহেব কোন একটি দেব মন্দিরে তশরিফ নিলেন। উক্ত মন্দিরে তখন সাতজন পূজারী উপাসনায় মগ্ন ছিল। তাদের দৃষ্টি হযরত খাজা সাহেবের প্রতি পতিত হতেই বাতেনী আধ্যাত্মিক শক্তি তাদের এমনভাবে আত্মহারা করে দিল যে, তৎক্ষণাৎ তারা হযরত খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে লুটায়ে পড়ে ইসলাম গ্রহণ করল। খাজা সাহেব তাদের সকলের নাম হামীদুদ্দীন রাখেন। অতঃপর হযরত খাজা সাহেবের তাওয়াজ্জুর ফলে তারা প্রত্যেকেই উচ্চস্তরের অলি হয়েছিলেন।
অমিয়বাণী :
হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ বলেছেন,
সুলুকে তরিকত : ‘সুলুক’ সম্বন্ধে হযরত খাজা আজমীরী রাঃ বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তাঁর বিশেষ রকমের আশেকগণকে বেহেমতে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিবেন। তখন তাঁরা আরজ করবেন, বেহেশত তাদেরই দেয়া উচিত যে ব্যক্তি বেহেশতের লোভে আপনার ইবাদত করেছে। আমরা চাই না। খাজা আজমীরী রাঃ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন কোন ব্যক্তিকে নিজের রেজা দান করেন, তখন সে বেহেশত নিয়ে আর কি করবে? তিনি আরো বলেছেন, সম্ভব হলে, যোগ্যতা ও সংসারবিরাগ তো বায়ুর মত তোমার উপর যখন তখন প্রবাহিত হতে থাকে।
তিনি বলেছেন, মুসলমান ভাইকে অপমান ও অপদস্ত করলে তোমার যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, রাশি রাশি পাপও তোমার সে পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে না।
আমি আমার পীর হযরত খাজা ওসমান হারূনী রাঃ হতে শুনেছি যে, দুনিয়াতে আল্লাহ পাকের এমন দোস্তও রয়েছেন যে, আল্লাহ তায়ালা এক মুহূর্তের জন্যও তাদের দৃষ্টির অন্তরালে থাকলে তারা বিলুপ্ত হয়ে যাবেন এবং তাঁর ইবাদত করতে পারবেন না।
তরিকতের প্রথম পথ শরিয়ত। তরিকতপন্থী প্রথমে শরিয়তের পথে দৃঢ়পদে চলতে থাকে এবং তার সমস্ত আহকাম পূর্ণরূপে পালন করে। তৎপর সে তরিকতের পথ পেতে আরম্ভ করে। এই পথেও যখন সে তার সমস্ত শর্তাবলী শরিয়তের সকল আহকামের পায়রবী করি পালন করতে থাকে, তখন সে মারেফাতের রাস্তা প্রাপ্ত হয়। এই পথেও যখন সে দৃঢ়তার সাথে চলতে থাকে এবং আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও ফরমাবরদারীতে কোন প্রকার শৈথিল্য না করে, তখন সে হাকীকতের রাস্তা প্রাপ্ত হয়।
তিনি বলেছেন, কোন কোন মাশায়েখ তরিকতের একশত ধাপ বর্ণনা করেছেন, তারমধ্যে সপ্তদশ ধাপ কাশফ এবং কারামতের। কিন্তু চিশতিয়া তরিকার মাশায়েখগণ তরিকতের ধাপ পনেরটি বলেছেন, তারমধ্যে পঞ্চম ধাপ কাশফ এবং কারামতের। এই ধাপে উন্নীত হলে খুব সাবধানতা এবং দৃঢ় সংকল্পের প্রয়োজন হয়, অন্যথায় তার পরবর্তী ধাপে উন্নীত হওয়া সুকঠিক। এ স্তরে এসে দুনিয়া এবং তার মধ্যস্থিত সবকিছু এমন কি নিজের সত্তাকেও ভুলে যেতে হয়, অন্যথায় তরিকতের শেষ মঞ্জিল পর্যন্ত পৌঁছানো যায় না। এ সমস্ত বিষয় আয়ত্ত না করে তরিকত প্রাপ্তির দাবি করা মিথ্যা।
একবার হযরত জুনাইদ বোগদাদী রাঃ কেহ জিজ্ঞাসা করল, আপনি আল্লাহ পাকের দীদারের আকাংখী কেন হয়? তিনি উত্তর করলেন, আমি এমন বস্তুর প্রতি আকাক্সক্ষা করি না, যা মুসা আঃ প্রার্থনা করে পাননি। অথচ হযরত মুহাম্মদ সাঃ প্রার্থনা না করেই প্রাপ্ত হয়েছেন। বান্দার আকাক্সক্ষার কি প্রয়োজন? সে তার উপযুক্ত হলেই তিনি নিজেই পর্দা উঠায়ে নিবেন। দীদার এমনই হাসিল হবে, আকাঙ্ক্ষার কি দরকার?
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ বলেন, তরিকতপন্থী এবং আল্লাহ তায়ালার হাবিব উভয়ে এই হিসাবে এক যে, উভয়ে সর্বদা এই ভয়ে আল্লাহ তায়ালার ফরমাবদার থাকেন যে, কোন ত্র“টি বশতঃ পাছে বিতাড়িত করা না হয়।
আরেফ সেই ব্যক্তি যিনি সমগ্র আলমকে জানেন এবং তা হতে লক্ষ লক্ষ তথ্য বর্ণনা করে থাকেন এবং মহব্বত সম্বন্ধীয় সমস্ত জটিল প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম হন। তিনি সর্বদা এশকের আবেগে মত্ত থাকেন এবং বিস্ময়ের সাথে আল্লাহ পাকের কুদরতের তামাশা দেখতে থাকেন। দাঁড়ালে দোস্তের খেয়ালে দাঁড়ান, আর জাগ্রত অবস্থায় দোস্তের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যের চতুর্দিকে তাওয়াফ করতে থাকেন। আরেফদের উপর কখনও কখনও এমন অবস্থা উপস্থিত হয় যে, এক কদমে শ্রেষ্ঠত্বের পর্দা পর্যন্ত পৌঁছে যান, আবার এক কদমে স্বস্থানে ফিরে আসেন। তা কামালিয়তের সর্বনিম্ন স্তর।
কোন একজন বুযুর্গের মুখে আমি আরেফের পরিচয় এইরূপে শুনেছি যে, আরেফ সেই ব্যক্তিÑ যিনি উভয় জগত হতে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ পাকের একত্বের ময়দানে গিয়ে পৌঁছেন। এই পথ সেই ব্যক্তিই অবলম্বন করতে পারে যিনি আল্লাহ ভিন্ন অন্য পদার্থ হতে নিঃসম্পর্ক হয়ে যান।
আরেফদের এমন একটি স্তর আছে যেখানে পৌঁছে তাঁর সমগ্র দুনিয়া এবং তার মধ্যস্থিত সবকিছুকে নিজেই দুই অঙ্গুলির মাঝখানে দেখতে পান। আরেফ তিনিই যিনি যাকিছু কামনা করেন, নিজেই সামনে উপস্থিত দেখেন। আর যে কথাই মুখে উচ্চারণ করেন তার জবাব গায়েব হতে তৎক্ষণাৎ শুনতে পান। মহব্বতের ক্ষেত্রে আরেফ লোকের নিম্নতম অবস্থা এই যে, তাঁর মধ্যে আল্লাহ পাকের গুণাবলী প্রকাশ পেতে আরম্ভ করে।
আরেফের উপর যখন কোন অবস্থার উদয় হয় এবং তিনি তাতে বিলীন হয়ে যান, আর এই অবস্থায় যদি তাঁর সামনে হাজার হাজার রাজ্য পেশ করা হয়, যাতে বিচিত্র ও আশ্চর্য ধরনের পদার্থ সমূহ থাকে, তবুও তিনি তার প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেন না।
আরেফ ব্যক্তির লক্ষণ এই যে, তিনি সর্বদা হাসিমুখে থাকেন। তিনি যখন মুচকি হাসেন তখন তাঁকে ফেরেশতা জগতে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যবর্তী বলে মনে হয়ে থাকে।
যেই আরেফ কামেল হন, আল্লাহ তায়ালাই জানেন, তাঁর মর্যাদা কত এবং কোন স্তর পর্যন্ত? তাঁর অধিকার কোন পর্যন্ত এবং কখন তিনি স্ব-স্থানে ফিরে আসেন।
হযরত খাজা সাহেব হযরত জুননুন মিসরী রাঃ হতে একটি বাণী উদ্ধৃত করেছেন, মানুষ আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করার লক্ষণ এই যে, নীরবতা অবলম্বন করবে এবং লোকালয় হতে দূরে সরে থাকবে।
খাজা আজমীরী রাঃ বলেন, একবার হযতর খাজা হাসান বসরী রাঃ হযরত রাবেয়া বসরী রাঃ, হযরত মালেক দীনার রাঃ এবং খাজা শকীক বলখী রাঃ বসরা নগরে কোন একস্থানে একই মজলিশে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে খাঁটি মহব্বত সম্বন্ধে আলোচনা চলতেছিল। খাজা হাসান বসরী রাঃ বলেন, খাঁটি প্রেমিক সেই ব্যক্তি যিনি ব্যথা-বেদনা ও দুঃখ-কষ্টে পড়লে সবর করেন। রাবেয়া বসরী রাঃ বলেন, হে খাজা ! তা হতে অহংকারের গন্ধ আসছে। মালেক ইবনে দীনার রাঃ বলেন, আল্লাহ তায়ালার মহব্বতের দাবিতে সেই ব্যক্তিই খাঁটি ও সত্যবাদী, যিনি দোস্তের তরফ হতে আগত প্রত্যেক দুঃখ ও বিপদে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর সন্তুষ্ট থাকেন। হযরত রাবেয়া বসরী বলেন, এর চেয়েও উত্তম হওয়া বাঞ্ছনীয়। খাজা শকীক বলখী রাঃ বলেন, সত্যিকারের খোদা প্রেমিক তিনি যাকে রেণু রেণু করে কেটে ফেললেও উঃ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করে না। আবেয়া বসরী রাঃ বললেন, আশেক ব্যক্তির প্রতি কোন দুঃখ-কষ্টকে লক্ষ্যের বাইরে ফেলে রাখেন। হযরত খাজা আজমীরী রাঃ বলেন, আমিও তা জানি।
আশেকের অন্তঃকরণ মহব্বতের অগ্নিকুণ্ড। আল্লাহ ভিন্ন যাকিছুই সেই অন্তকরণে প্রবেশ করে, তাকে পোড়ায়ে ছাইভষ্ম করে ফেলে। কেননা, তাদের এশকের আগুনের চেয়ে অধিকতর প্রখর তেজ অন্য কোন আগুনেই নেই।
হযরত খাজা আজমীরী রাঃ বলেন, এক রাতে হযরত রাবেয়া বসরী আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে লাগলেন, এই শব্দ শুনে লোকগণ ঘর হতে বের হয়ে আগুন নিভাতে তাঁর বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল। কোন একজন আল্লাহ ওয়ালা লোক বললেন, এই লোকগুলো কত আহমক ! রাবেয়া বসরীর আগুন নিভাতে এসেছে। আরে, তাঁর তো সীনার ভিতরে আগুন জ্বলছে। দোস্তের মিলন ব্যতীত এই আগুন নিভার নয়।
হযরত খাজা সাহেব বলেছেন, মানসুর রাঃ কে কেহ প্রশ্ন করল, দোস্তের এশকের মধ্যে কামালিয়ত কাকে বলে? তিনি বললেন, এশকের কামালিয়ত এই যে, মাশুক যদি পরীক্ষা করার জন্য আশেকের মাথা কাটতে চায়, তবে তাতে কোন আপত্তি করবে না। মাশুকের সন্তুষ্টিতেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং তাঁর সন্দর্শনে এমন মগ্ন থাকবে যে, কোন কিছুর প্রতিই খেয়াল থাকবে না।

কুতুবুল আকতাব খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ

হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ ছিলেন কুতবুল আকতাব। তিনি তরিকতের পথে কঠোর পরিশ্রম ও রিয়াযতকারীদের অগ্রণী এবং দরবেশী সিলসিলার গৌরব। তিনি হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ এর খাস মুরিদ ও সর্বপ্রধান খলিফা এবং বাবা ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ এর পীর ও মোর্শেদ।
বংশ পরিচয় : হযরত খাজা কুতবুদ্দীন রাঃ এর আসল নাম বখতিয়ার, ‘কুতবুদ্দীন’ তাঁর উপাধি। তিনি হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রাঃ এর বংশধর সাইয়্যেদ। তাঁর বংশের সিলসিলা এইরূপ খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী ইবনে সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন, ইবনে সাইয়্যেদ মোহাম্মদ, ইবনে সাইয়্যেদ আহমদ, ইবনে সাইয়্যেদ রাযিউদ্দীন, ইবনে সাইয়্যেদ হোসামুদ্দীন ইবনে সাইয়্যেদ রশীদুদ্দীন, ইবনে সাইয়্যেদ জাফর, ইবনে সাইয়্যেদ নক্কিয়্যুল ওজুদ, ইবনে সাইয়্যেদ আলী মুসা রেজা, ইবনে সাইয়্যেদ মুসা কাযেম ইবনে হযরত ইমাম যইনুল আবেদীন, ইবনে হযরত সাইয়্যেদনা ইমাম হুসাইন রাঃ।
হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ তুর্কিস্তানের ‘আউশ’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন বলে তাঁকে আউশী বলা হত। তাছাড়া তাঁকে ‘কাকী’ বলার বিভিন্ন কারণ কিতাবে উল্লেখ আছে- তার কারণ এখানে উল্লেখ করা হল :
তুর্কি ভাষায় রুটিকে কাক বলা হয়। যেহেতু প্রাথমিক অবস্থায় দীর্ঘ দিন যাবৎ তিনি জায়নামাজের নিচ হতে গায়েবী রুটি প্রাপ্ত হতেন, যা দিয়ে গোটা পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হত। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে তিনি এইরূপে ‘কাক’ অর্থাৎ রুটি পেতেন বলে তিনি ‘কাকী’ অর্থাৎ, গায়েবী রুটিওয়ালা নামে প্রসিদ্ধ হয়ে পড়েন।
আজও পর্যন্ত তাঁর মাজার শরীফে সেই ‘কাক’ বা রুটি বিতরণ করা হয়ে থাকে। তা তাঁর জীবন কালের সেই স্মৃতিই বহন করে চলেছে।
তালিম ও তরবিয়াত : হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর দুই বছর বয়সেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাতা অত্যন্ত পরিশ্রম ও যত্ম সহকারে তাঁর প্রতিপালন করেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি মাওলানা আবু হাফস রাঃ এর কাছে এলম শিক্ষা করতে আরম্ভ করেন। মাওলানা সাহেব তাঁর জাহেরী ও বাতেনী এলমে পূর্ণ জ্ঞান দান করেন এবং তরিকতের পথের নিয়ম-পদ্ধতি উত্তমরূপে শিক্ষা দান করেন। তিনিও খুব মনোযোগ ও পরিশ্রমের সাথে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
সিয়ারুল আকতারের বর্ণনা হতে বুঝা যায়, হযরত খাজা কুতবুল আকতাব রাঃ আউশ হতে বাগদাদে গমন করেন এবং সেখানকার আবুল লাইস সমরকন্দী নামক মসজিদে অবস্থান করতে থাকেন। এখানেই হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ এর সাথে তাঁর সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ ঘটে এবং এ সময়েই তিনি হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন।
৫২২ হিজরীর রজব মাসে হযরত খাজা আজমীরী রাঃ তাঁকে খেলাফতের খেরকা পরায়ে দেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র সতের বছর। অতঃপর তিনি সমরকন্দ, গযনী, বাগদাদ ও আজমীর হয়ে দিল্লী পৌঁছেন। তৎকাল সুলতান আলতামাশ হিন্দুস্তানের সম্রাট ছিলেন। সুলতান তাঁর একান্ত ভক্ত ছিলেন এবং পরিশেষে তাঁর কাছে মুরিদও হন।
ইবাদত ও রিয়াযত : সংসার বিরাগ ও তরিকতের কাজে পরিশ্রমের অভ্যাস বাল্যকাল হতেই হযরত খাজা কুতবুদ্দীন রাঃ এর স্বভাবগত হয়ে পড়েছিল। হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর কাছে বায়াত হওয়ার পর তিনি ইবাদত ও রিয়াযতের প্রতি আরও ঝুকে পড়েন। দিবারাত্রির মধ্যে তিনি একশত রাকাত নামাজ পড়তেন এবং প্রত্যেক রাতে তিন হাজার বার হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করতেন। মোটকথা তিনি সবটুকু সময় ইবাদতের মধ্যে কাটায়ে দিতেন।
কেহ তাঁর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে আসলে ইবাদতের তন্ময়তা কাটায়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে তাঁর কিছুক্ষণ বিলম্ব হত বটে কিন্তু সাক্ষাৎকামী ব্যক্তির সামনে এসে তাঁদের বক্তব্য শ্রবণ করতেন। তৎপর কিছু বলার থাকলে বলতেন নতুবা এখন আমাকে ক্ষমা করুন বলেই উঠে পড়তেন এবং পুনরায় ইবাদতে মশগুল হতেন।
এক বিধর্মী বণিক তাঁর প্রতিবেশী ছিল। প্রথম প্রথম তিনি তার কাছ থেকে ধারে জিনিসপত্র ক্রয় করতেন। অবশ্য তিনি তাকে সর্বদা বলতেন তোমার ঋণ ত্রিশ টাকা পর্যন্ত পৌঁছলে তুমি আর আমাকে ধারে কোন জিনিসই দিও না। ইতিমধ্যে হাদিয়া তোহফা এসে পৌঁছলে তা হতে বণিকের ঋণ পরিশোধ করে দিতেন। একবার তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, আর কখনও ঋণ গ্রহণ করবেন না। অতঃপর আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীতে প্রত্যহ জায়নামাজের নিচে গায়েব হতে রুটি পেতেন। তাতেই তাঁর পরিবারের সকলের আহারের কাজ সম্পন্ন হত। বণিক মনে মনে ভাবল, খাজা সাহেব হয়ত তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এই কারণেই এখন আর ধারে জিনিসপত্র নেন না। সুতরাং সে তার স্ত্রীকে হযরত খাজা সাহেবের বাড়িতে প্রকৃত ব্যাপার অনুসন্ধান করার জন্য পাঠালেন। খাজা সাহেবের বিবি প্রকৃত ঘটনা তার কাছে ব্যক্ত করলেন, সেদিন হতে গায়েবী রুটি পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
শেখ নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ বলেন, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ নিজের ভক্তবৃন্দকে আদেশ করেছিলেন- খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ এর ৫০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ সর্বদা পরিশোধ করে দিও। এক দীর্ঘকাল পর্যন্ত খাজা আজমীরী রাঃ এর ভক্তবৃন্দ এই নিয়মে খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ এর ঋণ পরিশোধ করতে থাকলেন। কিন্তু খাজা বখতিয়ার কাকী কামালিয়তের স্তরে পৌঁছবার পর হতে তিনি এই সাহায্য আর গ্রহণ করতেন না।
ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে, হযরত কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ প্রতি রাতে তিন হাজার বার হুজুর সাঃ এর প্রতি দরূদ পাঠ করতেন। এই সময়েই তিনি বিবাহ করেন। এই কারণে তিনি প্রথম তিন রাত সেই অজিফা পাঠ করতে পারেননি। তৃতীয় দিনে হযরত রাসূল সাঃ সেখানকার এক নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তিকে স্বপ্নযোগে দেখাল যে, বখতিয়ার কাকীকে বলে দিও, প্রত্যেক রাতে সে আমার কাছে যে হাদিয়া প্রেরণ করত তিন রাত যাবত তা আমার কাছে পৌঁছেনি। হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি স্ত্রীকে যথারীতি তালাক দিয়েছিলেন এবং দুনিয়ার যাবতীয় আবিল্য ও সম্পর্ক হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি লাভ করলেন।
হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ বলেন, এক বুযুর্গ বলেছেন, চল্লিশ বছর রিয়াযত করেও আমি কিছুই লাভ করতে পারিনি। অতঃপর কথা বলা ও আহারের মাত্রা কমায়ে দিলাম এবং মানুষের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিলাম। তৎপর আমার সামনে সবকিছু আলোকিত হয়ে গেল। এখন হতে আরশে মুআল্লা এবং আযমতের  পর্দ পর্যন্ত সকল পদার্থ আমার দৃষ্টিগোচর হতে লাগল।
হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ বাগদাদে গমন করেন এবং সেখানকার বহু বুযুর্গানে দ্বীন ও কামেল অলি আল্লাহগণের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাঁহাদের সোহবতে অবস্থান করতে থাকেন। হযরত শেখ শেহাবুদ্দীন সাহরাওয়ার্দী এবং হযরত আওহাদুদ্দীন কেরমানী রাঃ এর নিকট হতেও ফয়েজ হাসিল করেন।
হিন্দুস্তানে গমন : হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ বাগদাদে অবস্থান কালে জানতে পারেন যে, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ খোরাসান হতে হিন্দুস্তান অভিমুখে রওয়ানা হয়েছেন। তখন তিনিও বাগদাদ হতে হিন্দুস্তানের দিকে যাত্রা করেন।
দিল্লীতে আগমন : হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ দিল্লীর পথে মুলতানে পৌঁছে সেখানকার বিখ্যাত অলিয়ে কামেল হযরত বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। হযরত যাকারিয়া হযরত কুতবুল আকতাব কে অতিশয় স্নেহ ও প্রীতির সাথে সম্বর্ধনা করেন। কুতবুল আকতাব তাঁর খানকায়ে কিছুদিন অবস্থান করেন। এই সময়ে মোগলেরা হিন্দুস্তানের উপর আক্রমণ করেছিল। তৎকালীন মুলতানের অধিপতি ক্কাবাচা হযরত কুতবুল আকতাব রাঃ এর কাছে উপস্থিত হয়ে ফয়েজ ও দোয়া প্রার্থনা করলে তিনি দোয়া করেছিলেন। এই যুদ্ধে মোগলেরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিল। তা ছিল তাঁর এক বিশেষ কারামত। অতঃপর মুলতান হতে তিনি দিল্লী গমন করেছিলেন। দিল্লীর নিকট পৌঁছলে সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ খাদেম ও লশকর সহ তাঁকে মহাধুমধামের সাথে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। সুলতান হযরত কুতবুল আকতাবের বাসস্থানের ব্যবস্থা শহরেই করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি ফিলুখেরীতে অবস্থান করাই পছন্দ করলেন। প্রথমে সুলতান আলতামাশ সপ্তাহে দুইবার তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ফয়েজ ও বরকত হাসিল করতে থাকেন। অবশেষে সুলতান তাঁর খেদমতে অতি সানুনয়ে আরজ করলেন, হযরত শহর হতে এতদূরে আসলে রাজ কাজের বিশেষ ক্ষতি হয়। সুতরাং সুলতানের একান্ত আন্তরিকতাপূর্ণ অনুরোধে হযরত কুতবুল আকতাব শেষ পর্যন্ত দিল্লী শহরের অভ্যন্তরেই বাস করতে সম্মত হন এবং মালেক আইনুদ্দীনের মসজিদে অবস্থান করতে থাকেন।
শায়খুল ইসলাম হযরত জামালুদ্দীন বস্তামী রাঃ এর ইন্তেকালের পর সুলতান আলতামাশ হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ কে উক্ত পদে নিযুক্ত করতে চাইলেন। কিন্তু হযরত খাজা বখতিয়ার রাঃ তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। অগত্যা শেখ নাজমুদ্দীন সোগরাকে উক্ত পদে নিযুক্ত করা হল। শেখ নাজমুদ্দীন সোগরা খাজা ওসমান হারুনী রাঃ এর মুরিদ ছিলেন। কিন্তু হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে তাঁর অন্তর বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে উঠল।
ইতিমধ্যে হযরত খাজা কুতবুল আকতাব সাক্ষাৎ ও কদমবুছির অদম্য আকাক্সক্ষা জ্ঞাপনপূর্বক হযরত খাজা আজমীরী রাঃ কে একখানা পত্র লিখলেন। খাজা আজমীরী রাঃ স্বীয় মুরিদের বিচ্ছেদানল নির্বাণের উদ্দেশ্যে স্বয়ং দিল্লীতে তশরিফ আনেন। হযরত খাজা চিশতি রাঃ এর আগমন সংবাদ জানতে পেরে সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে দিল্লীর সমস্ত বিশিষ্ট ও সাধারণ এবং প্রধান প্রধান অলিগণ দলে দলে তাঁর খেদমতে এসে হাজির হলেন। কিন্তু দিল্লীর শাইখুল ইসলাম শেখ নাজমুদ্দীন সোগরা আসলেন না। সুতরাং হযরত খাজা আমীরী রাঃ সাক্ষাঃ লাভের জন্য স্বর্য় তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। তখন শাইখুল ইসলাম তাঁর কাছে আরজ করলেন, কুতুব সাহেবের প্রতি জনসাধারণের ভক্তি ও আসক্তি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমার মর্যাদা ও সম্মান লোপ পেতে চলেছে। সুতরাং শাইখুল ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হযরত খাজা আজমীরী রাঃ হযরত কুতুব সাহেবকে দিল্লী ত্যাগ করে তাঁর সাথে আজমীর যেতে আদেশ করলেন। সুলতান এই সংবাদ শুনতে পেয়ে স্বয়ং হযরত খাজা সাহেবের খেদমতে উপস্থিত হয়ে বহু কাকুতি মিনতি পূর্বক আরজ করলেন, কুতুব সাহেবকে যেন দিল্লীতেই রাখা হয়। কিন্তু হযরত খাজা সাহেব তাঁর কথায় কর্ণপাত করলেন না। বরং কুতুব সাহেবকে নিয়ে আজমীর চলে যাওয়াই স্থির করলেন।
কিন্তু দিল্লী বাসীরা কুতুব সাহেবকে দিল্লী ছেড়ে যেতে দেখে প্রেমাতুর প্রেমিকের মত কান্নার রোল তুলল। এমনকি, তারা কুতুব সাহেব যেখানে পা ফেলতেন সেখানকার মাটি তুলে তাবারুকস্বরূপ চোখে মুখে ও বুকে মাখতে লাগলেন। হযরত খাজা আজমীরী রাঃ তাঁর প্রতি দিল্লী বাসীর আন্তরিকতাপূর্ণ ভালবাসা দেখে বললেন, বাবা কুতবুদ্দীন তুমি এখানেই থাক। তুমি এই স্থান ত্যাগ করলে দিল্লীবাসীদের অন্তর জ্বলে পুড়ে কাবাব হয়ে যাবে। আমি তা চাই না। শেষ পর্যন্ত হযরত কুতবুল আবতার হযরত খাজা আজমীরী রাঃ এর নির্দেশ অনুসারে দিল্লীতেই থেকে গেলেন। কেবল হযরত পীর সাহেবের নির্দেশ মোতাবেক ইন্তেকালের পূর্বে একবার আজমীর শরীফে তশরীফ নিয়ে তাঁর সাথে শেষ বারের মত সাক্ষাৎ করেছিলেন।
হযরত খাজা বখতিয়ার ও সুলতান আলতামাশ : সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃকে অন্তরের সাথে ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। শাহী দরবারের অমাত্যবর্গ এবং আমীর ওমরাদের উপরও এর প্রভাব বিশেষ ভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। রাজ্যের প্রজা সাধারণও এই শুভ ক্রিয়া হতে বঞ্চিত ছিল না। কেননা, হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ সুলতান আলতামাশকে রাজ্যের প্রজা সাধারণ ও ফকির দরবেশদের সাথে যেরূপ সদ্ব্যবহার ও দয়া দাক্ষিণ্যের নির্দেশ দিতেন। তিনি তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে প্রতিপালন করতেন। সুলতান নিজেও একজন আবেদ ও যাহেদ ছিলেন। নামাজ, রোজা ও অজিফা ইত্যাদি দৃঢ়ভাবে পালন করতেন এবং ইসলামের সকল বিধান সর্বদা মেনে চলতে চেষ্টা করতেন। বাদশা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজের অধিকাংশ কাজ নিজেই করতেন। চাকর ও নওকরদের সর্বদা নিজের খেদমত ও পরিচর্যার জন্য দণ্ডায়মান রাখতেন না। রাতে ছদ্মবেশে রাজ্যে মধ্যে ঘোরাফেরা করে প্রজা সাধারণের অভাব অভিযোগ ও দুঃখ কষ্টের সন্ধান নিতেন এবং তার যথাবিহিত প্রতিকার করতেন। গরিব দুখীদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করতেন এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি সর্বদা তীক্ষ দৃষ্টি রাখতেন। বস্তুত আলতামাশের সদ্ব্যবহার, সদাশয়তা ও ন্যায় বিচারের ফলে জনগণ তাঁকে অতিশয় সম্মান ও ভক্তি করত।
খাজা সাহেব স্বীয় মলফুযাতে লিখেছেন, একদা রাতে সুলতান আলতামাশ আমার পা জড়ায়ে ধরে অনেকক্ষণ নিরবে বসে থাকলেন। আমি বললাম, আমাকে আর কতক্ষণ কষ্ট দিতে থাকবে? যা বলার আছে বলে ফেল। তখন সে বলতে লাগল, আল্লাহ তায়ালা আমাকে রাজত্ব দান করেছেন, কিন্তু কেয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তায়ালা আমাকে রাজ কর্তব্য পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন এবং তার হিসাব নিকাশ তলব করবেন, তখনও আমি যেন আপনার ছায়া হতে বঞ্চিত না হই। আমি একথায় সম্মতি প্রদান না করা পর্যন্ত আলতামাশ আমার পা ছাড়েনি।
হযরত কুতবুুল আকতাবের এস্তেগনা ও সবর ঃ স্বয়ং বাদশাহ হযরত খাজা সাহেবের একান্ত ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও খাজা সাহেব কখনও বাদশাহের কাছে নিজের অভাব অনটনের বিষয় প্রকাশ হতে দেননি। তাঁর ঘরে সর্বদা অভাব অনটন লেগেই থাকত। পরিবারের সকলেই দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপন করত। কখনও একান্ত প্রয়োজন হলে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার গ্রহণ করে কাজ সমাধা করতেন। হযরত খাজা সাহেবের ঘরে এরূপ অভাব অনটন থাকা সত্ত্বেও তাঁর দানশীলতা ও বদান্যতার অবস্থা এইরূপ ছিল যে, লঙ্গরখানার জন্য হাদিয়া তোহফা যা কিছুই আসত তৎক্ষণাৎ তা মুসাফির মেহমান ও সমাগত গরিব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন।
একবার রাজ দরবারে এক আমীর এখতিয়ারুদ্দীন আইবেক হযরত খাজা কুতবুল আকতাবের খেদমতে উপস্থিত হয়ে কয়েকটি গ্রাম তাঁর জন্য ওয়াকফ করার ইচ্ছা জ্ঞাপন করল। কিন্তু তিনি তাকে স্পষ্টভাবে এরূপ করতে নিষেধ করলেন। তাছাড়াও আলতামাশের প্রধান উজির একদা এইরূপ ইচ্ছা জ্ঞাপন করলে কুতবুল আকতাব রাঃ বললেন, আমাদের চিশতিয়া তরিকার আউলিয়ায়ে কেরামের মধ্যে কেহই কোন সময় কারও দ্বারা প্রদত্ত জায়গির কবুল করেননি। যদি তাঁদের মধ্যে কেহ এরূপ করতেন, তবে আমিও গ্রহণ করতাম। সুতরাং যদি আমি আপনার এই জায়গীর গ্রহণ করি, তবে কিয়ামত দিবসে আমি চিশতিয়া তরিকার আউলিয়ায়ে কেরামকে কিরূপে মুখ দেখাব?
কাউয়ালী : কাউয়ালী শ্রবণের প্রতি তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। তিনি অনেক সময় কাউয়ালীর মজলিশের আয়োজন করে কাউয়ালী শুনতেন। কোন কোন সময় তিনি কাজী হামীদুদ্দীন নাগূরীর খানকায় গমনপূর্বক কাউয়ালীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করাতেন। এতদা কাউয়ালীর মজলিশে এক কাউয়াল এই বয়েতটি পাঠ করল-
সুরূদ চীস্ত কে চান্দী ফোনুনে এশক দরুস্ত
সুরূদ মুহরেম এশকাস্ত ও এশক মুহরেম উস্ত ॥
অর্থাৎ- সকাউয়ালী কি বস্তু যে, তাতে এত এশক ব্যথা বেদনার উৎপত্তি হয়ে থাকে? কাউয়ালী এশকের সহস্য এবং এশক তাঁর সহস্য বৈ আর কিছুই নয়।
এই বয়েতটি হযরত খাজা কুতবুল আকতাবের উপর এমন প্রভাব সৃষ্টি করল যে, তিনি সাতদিন পর্যন্ত বেহুশ হয়ে রইলেন, অবশ্য নামাজের সময় হলে তাঁর হুশ ফিরে আসত এবং তিনি যথাসময়ে নামাজ আদায় করতেন। নামাজ আদায় করার পরেই পুনঃ বেহুশ হয়ে পড়তেন। এইরূপে সাতদিন অতিবাহিত হল।
ওফাত : কবি শেখ আহমদ জামির কাসীদা পাঠকালে এই বয়াতটি- কোশতেগানে খনজরে তসলীম রাঃ ! হারযমাঁ আয গায়ব জানে দীগারাস্ত ॥
অর্থাৎ- আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির সামনে আত্ম সমর্পণের খঞ্জরে যাঁরা নিহত হন, তাঁরা প্রত্যেক সময় গায়েব হতে নিত্য নতুন প্রাণ লাভ করে থাকেন।
আবৃত্তি করাতাম্র হযরত কুতবুল আকতাব রাঃ ভাববেগে সংগাহীন হয়ে পড়লেন এবং চার দিন চার রাত পর্যন্ত এই বয়েতটির ভাব মত্ততায় অস্থির ও অজ্ঞান হয়ে থাকলেন এবং এই অজ্ঞান অবস্থায়ই পঞ্চম রাত অর্থাৎ, ৬৩৩ হিজরির ১৪ই রবিউল আউয়াল হযরত কুতবুল আকতাব খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ আল্লাহ পাকের সন্ধিানে চলে গেলেন।
বস্তুতঃ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির সামনে যাঁরা আত্মসমর্পণ করে প্রাণ দান করেন, তাঁরা প্রতি মুহূর্তে নিত্য নতুন প্রাণ লাভ করে থাকেন। খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর ইন্তেকালের সময় পবিত্র মস্তক হযরত হামীদুদ্দীন নাগূরী রাঃ এর জানুর উপর এবং তাঁর দুই পা হযরত শেখ বদরুদ্দীন গযনবী রাঃ এর কোলের উপর ছিল। তাঁর জানাজার নামাজ সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ পড়ায়েছিলেন।
ওফাতের কিছুকাল পূর্বে একদিন ঈদের নামাজান্তে বাড়ির দিকে ফেরার সময় হঠাৎ পথিমধ্যে এক স্থানে থেমে গেলেন এবং সঙ্গীগণকে বললেন, আমি এই স্থানটি হতে এশকের সুগন্ধি পাচ্ছি। অতঃপর উক্ত স্থানটি তার মালিকের কাছ থেকে ক্রয় করে নেন। ঐ স্থানটিতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
হযরত খাজা সাহেবের জানাজার নামাজ পড়ার জন্য যখন লক্ষ লক্ষ লোক সমবেত হল। তখন খাজা সাহেবের অসিয়ত অনুযায়ী খাজা আবু সাঈদ রাঃ জনসমুওদ্রর মথ্যস্থলে দাঁড়ায়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করলেন যে, ব্যক্তি জীবনে কখনও কোন হারাম কাজ করেনি, জীবনে কখনও আসরের সুন্নত কাযা হয়নি সেই ব্যক্তিই তাঁর জানাজা নামাজে ইমাম হবেন। এই ঘোষণা শুনেই উপস্থিত আউলিয়া ও ওলামায়ে কেরামগণের মধ্যে কেহই ইমাম হবার জন্য অগ্রসর হলেন না। এইভাবে বহুক্ষণ কেটে গেল, তবুও কেহ অগ্রসর হচ্ছে না দেখে সম্রাট শামসুদ্দীন আলতামাশ অগ্রসর হয়ে বললেন, আমি আমার এই গোপনীয়তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু হযরত পীর সাহেব কেবলার অসিয়ত পালন না করে উপায় নেই। অতঃপর তিনি জানাজার নামাজ পড়ালেন।
হযরত বখতিয়ার কাকী রাঃ বলেছেন, এক বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আমি আজমীর শরীফের জামে মসজিদে আমার পীর ও মোর্শেদ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ কে কদমবুসি করার সৌভাগ্য লাভ করলাম। তখন তাঁর মসলিশে বহু দরবেশ মুরিদান ও আউলিয়ায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন। তখন মালাকুল মউত সম্বন্ধে আলোচনা চলতেছিল, হযরত পীর সাহেব কেবলা বললেন, মৃত্যু না হলে দুনিয়ার মূল্য এক কড়িও হত না। উপস্থিত দরবেশগণ জিজ্ঞাসা করল, কেন? তিনি বললেন, মৃত্যু একটি সেতু স্বরূপ। তা বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলায়ে দেয়। অতঃপর বললেন, বন্ধুত্ব মুখে মুখে সম্পন্ন করো না। অন্তরের সাথে তাকে সম্পন্ন করো। বন্ধু ভিন্ন আর যত বস্তুর সাথে তোমর সম্পর্ক রযেছে তাকে ছিন্ন করে ফেল। তা হলে তুমি আরশের চতুর্দিকে তাওয়াফ করতে সক্ষম হবে। অতঃপর তিনি পুনরায় বললেন, আরেফ লোকের দৃষ্টান্ত দীপ্তিমান সূর্যের মত। যার আলোকে সমগ্র দুনিয়া আলোকিত হয়ে থাকে। তিনি আরো বললেন, হে দরবেশগণ ! আমাকে এখানে আনা হয়েছে। আমার সমাধিও এখানেই হবে। অল্প কয়েকদিন পরেই আমি পরলোকের দিকে যাত্রা করব। তৎপর শেখ আলী সাঞ্জারী কে লক্ষ্য করে বললেন, কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীর নামে হুকুমনামা লিখে দাও যে, সে যেন দিল্লী চলে যায়। তথাকার গদীনেশীন আমি তাকেই নিযুক্ত করলাম, সে দিল্লীতেই থাকবে। হুকুমনামা লিখিত হলে তা তিনি আমাকে (বখতিয়ার কাকীকে) দান করলেন। আমি বশ্যতা ও আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ মস্তক অবনত করলাম। অতঃপর আমাকে কাছে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। আমি তাঁর কাছে পৌঁছলে তিনি টুপী ও পাগড়ী আমার মাথায় পরায়ে দিলেন এবং তাঁর পীর হযরত খাজা ওসমান হারুনী রাঃ এর লাঠি আমার হাতে দিলেন ও খেরকা পরায়ে দিয়ে কুরআন মজিদ, জায় নামাজ এবং খড়ম জোড়া আমাকে দান করে বললেন, তা হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর আমানত। তা চিশতিয়া সিলসিলার খাজেগানে কেরামের মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে। তুমি তাকে জারি রেখ। যাতে কাল কিয়ামতের ময়দানে চিশতিয়া সিলসিলার খাজেগানের সম্মুখে আমাকে লজ্জিত হতে না হয়। আবার আমি (বখতিয়ার কাকী) মাথা নত করে আনুগত্য জ্ঞাপন করলাম। অর্থাৎ, অবস্থায় ভাষায় প্রকাশ করলাম যে, হযরতের আদেশ আমি যথাযথভাবে পালন করব। অতঃপর আমি দুই রাকাত নামাজ আদায় করলে হযরত পীর সাহেব কেবলা আমার হাত ধরে এবং আমার মুখ আসমানের দিকে তুলে ধরে বললেন, যাও তোমাকে আল্লাহ পাকের হাতে সোপর্দ করলাম। আমি তোমাকে তোমার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছায়ে দিলাম। অতঃপর তিনি বললেন, মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব চার বস্তুর মধ্যে নিহিত আছে- ১. অভাব অনটনের সময় অভাবশূন্যতা প্রকাশ করা, ২. ক্ষুধার্ত অবস্থায় উদর পূর্তি ও তৃপ্তির ভাব প্রকাশ করা, ৩. দুঃখ ও চিন্তার সময় প্রফুল্ল ও আনন্দিত থাকা, ৪. দুশমনের সাথেও প্রীতি এবং মিত্রতার ভাব প্রকাশ করা। হযরত পীর সাহেব কেবলা আরও বললেন, যেখানেই যাবে কারও মনে কষ্ট দিবে না। আরও বললেন, যেখানেই অবস্থান করবে পুরুষের মত অবস্থান করবে।
অতঃপর আমি দিল্লীতে এসে বসবাস করতে লাগলাম। দিল্লীর সমস্ত শাসকশ্রেণী, ওমারাগণ ও জনসাধারণ আমার প্রতি ঝুঁকে পড়তে লাগল। আমার দিল্লী পৌঁছবার পর চল্লিশ দিন হবার পূর্বেই হঠাৎ একদিন আজমীর হতে একজন লোক এসে সংবাদ দিল যে, হযরত খাজা আজমীরী রাঃ ইন্তেকাল করেছেন। আমি তৎক্ষণাৎ আজমীর শরীফ অভিমুখে রওনা করলাম।
হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ এর রচনাবলী : হযরত বখতিয়ার কাকী রাঃ রচিত দুইটি কিতাবের নাম উল্লেখ দেখা যায়। ১. দিওয়ান, ২. ফাওয়ায়েদুস সালেকীন। শেষোক্ত কিতাবটিতে তাঁর সাতটি মজলিশে বর্ণিত উপদেশাবলী হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ কর্তৃক সংকলিত হয়েছে।
এই কিতাবটিতে তরিকতপন্থীদের জন্য সমস্ত জরুরী হেদায়েতসমূহ রয়েছে। এই কিতাবখানি হতে যে সমস্ত তালিমের সন্ধান পাওয়া যায় তা এইÑ উদরপূর্ণ করে আহার করা উচিত নয়, বরং শুধু ইবাদত করার শক্তি বজায় রাখার জন্য আবশ্যক পরিমাণ আহার করবে। মানুষের কাছে আড়ম্বর প্রকাশের উদ্দেশ্যে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধানকারী তরিকত পথের ডাকাত। অল্প আহার, অল্প শয়ন, অল্প কথা বলা এবং দুনিয়ার সাজ সরঞ্জাম হতে বেঁচে থাকা একান্ত কর্তব্য। উক্ত কিতাবটিতে তিনি আরও বলেছেন, তরিকতপন্থীর কর্তব্যÑ সর্বদা আল্লাহ পাকের মহব্বতের মধ্যে ডুবে থাকা অর্থাৎ, মহব্বতে এলাহীর নেশায় মত্ত অবস্থায় তার অবস্থা এইরূপ হওয়া উচিত যে, তার সীনার মধ্যে জমিন ও আসমান ঢুকে পড়লেও সে তা কিছু মাত্র উপলব্ধি করতে পারবে না। বন্ধুর তরফ হতে যাকিছু পাওয়া যায় তাই আশাতীত নেয়ামতরূপে গ্রহণ করবে।
হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার রহস্য সমূহ গোপন রাখবে। তরিকতের পথে সাহস উন্নত ও দৃঢ় হতে হবে। যাতে আল্লাহ পাকের রহস্যসমূহ প্রকাশ পেতে দেইনি। তরিকতপন্থীর জন্য শরিয়তের পাবন্দী একান্ত জরুরী। চাই সে ভাবমত্ততার অবস্থা হোক বা অন্য কোন অবস্থা হোক।
হযরত কুতবুল আকতাবের দরগাহ ঃ হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর মাজার শরীফ পুরাতন দিল্লীতে কাসরা মোহর অলি নামক স্থানে অবস্থিত। কুতুব মিনারও এখানেই দণ্ডায়মান আছে। এই অঞ্চলটি সাধারণতঃ কুতবুল আকতাব রাঃ এর নামেই বিখ্যাত। এই স্থানে বহু সংখ্যক আউলিয়ায়ে কেরাম সমাহিত আছেন।
খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ এর মাজারটি উন্মুক্ত কাঁচা। তা খুব চওড়া ও প্রশস্ত, তার চর্তুষ্পার্শে নওয়াব খুরশীদ জাহ হায়দরাবাদী কর্তৃক নির্মিত ছঙ্গে মরমরের জালীদার কাটরা। ১৯৪৭ সনের মুসলিম বিরোধী আন্দোলনের সময় হিন্দুদের হাতে কাটরাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে গান্ধিজীর হস্তক্ষেপের ফলে পুনরায় তা নির্মাণ করে দেওয়া হয়। মাজার শরীফের উপরিভাগ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলার মত দেখা যায়।
হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ এর মাজার পূর্ব-দক্ষিণ কোণের দিকে শ্বেত পাথরের জালী এবং দরজা মোগল সম্রাট পররোখসিয়ার কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। জালীর বাহিরে পূর্বদিকে হযরত খাজা সাহেবের পুরাতন মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের নিচে হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন নিজামী সিলসিলায়ে নিযামিয়ার মুজাদ্দিদের মাজার অবস্থিত।
হযরত খাজা সাহেবের মাজারের পশ্চিম দিকে মোগলদের নির্মিত মতি মসজিদ অবস্থিত এবং তার দক্ষিণ দিকে শাহেনশাহে আলম ও শাহেনশাহে আকবারে সানীর কবর।
হযরত খাজা কুতবুল আকতাবের বাসগৃহগুলি আজও তাঁর নামে বিদ্যমান রয়েছে। তা কুতুব মিনারের পূর্ব দিকে তোগলকাবাদ দুর্গের দিকে যাবার ডান পার্শ্বে অবস্থিত।
অমিয়বাণী :
হযরত খাজা কুতবুল আকতাব রাঃ বলেছেন,
মানুষ নাফসানী খাহেশের পায়রবীও করবে এবং আল্লাহ তায়ালার দরবারেও মর্যাদা লাভ করবেÑ তা কিরূপে সম্ভব হতে পারে?
যে ব্যক্তি আমীর ওমারা ও দুনিয়াদার লোকদের সঙ্গে উঠবসা করে সে তরিকতের পথে ধর্মভ্রষ্ট।
যে সকল অলি আল্লাহ পাকের গোপন রহস্যকে প্রকাশ করে দেন, তাঁরা ভাবাবেগের বশীভূত হয়েই এরূপ করে থাকেন।
তত্ত্বজ্ঞানী আরেফগণ দোস্তের তরফ হতে সমাগত বিপদ-আপদসমূহের মধ্যে দোস্তের সন্তুষ্টি দেখতে পান।
দরবেশীর পথে চলা এক কথা এবং ভাণ্ডার সঞ্চয় করা অন্য কথা। হয়ত দরবেশ হও অন্যথায় ভাণ্ডার সঞ্চয় কর।
দরবেশদের অনাহারে থাকা তাদের ইচ্ছাধীন, কেননা, সমগ্র দুনিয়াকে তার করতলগত করে দেয়া হয়েছে। সে যদৃচ্ছা ব্যয় করতে পারে, কিন্তু সে তা করে না বরং অন্যকে দান করে এবং নিজে অনাহারে থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি করতে পারে।
যে ব্যক্তি খোদাপ্রেমের দাবি করে এবং বিপদ-আপদের সময় চিৎকার করে বেড়ায় সে মহব্বতের দাবিতে মিথ্যাবাদী।
অসৎ সংসর্গের চেয়ে অধিক ক্ষতিকর মানুষের জন্য আর কিছুই নেই।
তরিকতের পথিক যদি কোন এক নির্দিষ্ট পথের উপর চলতে থাকে, আর পূর্ণ আশা ও পূর্ণ বিশ্বাস রাখে, তবে সে অবশ্যই কামালিয়তের দরজায় পৌঁছে যায়।
বুযুর্গানে দ্বীনের মজলিশে উপযুক্ত স্থানের সন্ধান না করে যেখানে স্থান পাও সেখানেই বসে পড়।
মানুষের কর্তব্য- সে যে বস্তু হতে তওবা করেছে তাকে চিরশত্রু জ্ঞান করা।
মানুষ যে পর্যন্ত দুনিয়ার ধান্দায় মশগুল থাকে, সে পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে পৌঁছতে পারে না।
দরবেশদের যদি প্রত্যহ এক লক্ষ দেশও অতিক্রম করতে হয়, তবুও তাকে সামনের দিকেই অগ্রসর হতে হবে।
পীরের অন্তরের শক্তি ও পবিত্রতা এরূপ থাকা আবশ্যক যা দিয়ে তিনি মুরিদের সীনার মরিচা, মলিনতা ও সংসারাসক্তিকে দূর করে দিতে পারেন। অর্থাৎ তাঁর মধ্যে যেন আর কোন প্রকার শঠতা, প্রবঞ্চনা, হিংসা ও কুপ্রবৃত্তি অবশিষ্ট থাকতে না পারে। অতঃপর মারেফাতের রহস্য সম্বন্ধে তাকে অবহিত করবেন।
দোয়া দুই প্রকার নেক দোয়া ও বদ দোয়া। কারও জন্য বদ দোয়া করা উচিত নয়, নেক দোয়া খুব উত্তম বস্তু। বিশেষ করে যে নেক দোয়া বুযুর্গ লোকের মুখ দিয়ে বের হয়।
মুরিদের পক্ষে পীরের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি উভয় প্রকারে একই প্রকার খেদমত হওয়া উচিত।
কয়েকটি কারামত : হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ মাতা বলেছেন যে, কুতবুদ্দীন যে রাতে ভূমিষ্ঠ হয়, সেই রাতে প্রায় মধ্যভাগে আমি হঠাৎ ঘুম হতে জেগে দেখলাম যে, আমার ঘরটি এক অপূর্ব জ্যোতিতে আলোকিত হয়ে আছে। সেই আলোকে আমি আসমান পর্যন্ত স্পষ্টরূপে দেখতে পেলাম, আমি তাতে ভীত ও বিস্মিত হয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে আরজ করলাম, এলাহী ! এই আলোর রহস্য কি এই অধম বাঁদীকে বলে দিন। তখন গায়েবী আওয়াজ আসল, এখন তোমার গর্ভস্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় হয়েছে। তা সেই সন্তানেরই কালবের নূর। একটু পরেই আমার প্রসব বেদনা আরম্ভ হল এবং আমার একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। ভূমিষ্ঠ হয়ে সে মাথা ঝুকায়ে সেজদা করল এবং উচ্চ স্বরে আল্লাহ নাম জিকির করল। এই জিকিরের আওয়াজ প্রতিবেশীরাও শুনতে পাচ্ছিল এবং সে স্পষ্টরূপে কলেমা শরীফও উচ্চারণ করতেছিল। তাছাড়া সে তাঁর সতর ঢেকে দেওয়ার জন্য এবং তাড়াতাড়ি গোসল করায়ে দেওয়ার জন্যও বলেছিল।
হযরত কুতবুল আকতাবের বয়স যখন চার বছর চার মাস তখন তার মাতা একজন ভৃত্যকে সঙ্গে দিয়ে তাকে নিকটস্থ মক্তবে বিসমিল্লাহর সবক নেওয়ার জন্য মিষ্টান্নাদি সহ পাঠায়েছিলেন। মধ্যপথে তাদের সাথে একজন বৃদ্ধ লোকের সাক্ষাৎ হল। বৃদ্ধ লোকটি ভৃত্যকে বললেন, এই নেকবখত শিশুটিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ভৃত্য উত্তর করল, মক্তবে ভর্তি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। বৃদ্ধ লোকটি পুনরায় বললেন, শিশুটিকে মাওলানা আবু হাফসের কাছে নিয়ে যাও। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ আলেম এবং আল্লাহওয়ালা কামেল লোক। ভৃত্য তাতে সম্মত হলে তিনি তাদের সঙ্গে নিয়ে মাওলানা আবু হাফসের মজলিশে উপস্থিত হলেন এবং মাওলানা সাহেবের উপর শিশুটির শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করলেন। তৎপর তিনি বিদায় হয়ে চলে গেলেন। বৃদ্ধ লোকটি চলে যাওযার পর মাওলানা আবু হাফস রাঃ তাদের বললেন, যে বৃদ্ধ লোকটি তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছিলেন তোমরা কি তাঁকে চিন? ভৃত্য বলল, জি না, আমরা ইতিপূর্বে কখনও তাঁকে দেখিনি। পথে তাঁর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। আমরা মক্তবে যাচ্ছিলাম, তিনিই আমাদেরকে আপনার এখানে এনেছেন। মাওলানা আবু হাফস রাঃ বললেন, তিনিই হযরত খাজা খেজের আঃ।
হযরত কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর প্রধান খলিফা হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ বলেন, আমি একবার হযরত কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর কদমবুসির জন্য আরজ নিয়ে তাঁর দরবারে উপস্থিত হলাম। তখন কাজী হামীদুদ্দীন, সৈয়্যেদ নূরুদ্দীন মুবারক, মাওলানা আলাউদ্দীন প্রমুখ বুযুর্গ তাঁর মজলিশে উপস্থিত ছিলেন। মজলিশে তখন খানায়ে কাবার হজ্ব সম্বন্ধে আলোচনা চলতেছিল। প্রসঙ্গক্রমে হযরত মোর্শেদ কেবলা রাঃ বললেন, আল্লাহ পাকের খাস বান্দাগণ যেখানেই থাকুন না কেন তাঁরা হজ্ব করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, আল্লাহ তায়ালা তখনই খানায়ে কাবাকে সেখানে তাঁদের তাওয়াফ করার জন্য পাঠায়ে দেন। তাঁর এই কথাটি শুনামাত্র সকলের মাঝে চাঞ্চল্যের ভাব প্রকাশ পেল। এমতাবস্থায় আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, খানায়ে কাবা আমাদের সামনে উপস্থিত। তখনই আমরা সকলে খানায়ে কাবার যথারীতি তাওয়াফ ও জিয়ারত করলাম। জিয়ারত ও তাওয়াফ শেষ হলে গায়েবী আওয়াজ আসল, তোমাদের সকলের হজ্ব কবুল হয়েছে।
একদিন কুতবুদ্দীন আইবেক স্বর্ণমুদ্রায় পূর্ণ কয়েকটি তোড়া হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার রাঃ এর দরবারে পেশ করলেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অসম্মতি জানায়ে মৃদু হেসে বললেন, এতে আমার প্রয়োজন নেই। তাঁর এই জবাব শুনে কুতবুদ্দীন আইবেক মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেন। হযরত খাজা বখতিয়ার রাঃ কাশফের সাহায্যে তাঁর এই অসন্তুষ্টি জানতে পেরে তিনি নিজের পায়ের নিচের জায়নামাজের চাটাইয়ের একটি কোণ তুলে ধরে কুতবুদ্দীন আইবেককে বললেন, নজর করে দেখ, কুতবুদ্দীন আইবেক সেদিকে তাকেয় দেখলেন, চাটাইয়ের তলদেশ দিয়ে একটি নহর প্রবাহিত রয়েছে। অসংখ্য স্বর্ণ ও রৌপ্যের থলি উক্ত নহরের স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে কুতবুদ্দীন আইবেক অতিশয় বিস্মিত ও লজ্জিত হলেন।
বাবা ফরিদ্ুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ বলেন, একবার আমি হযরত খাজা কুতবুদ্দীন রাঃ এর সঙ্গে সফর করতেছিলাম। একদা আমরা এমন একটি স্থানে গিয়ে পৌঁছলাম যে স্থানটি ছিল অতিশয় বিপজ্জনক। চতুর্দিকে নিবিড় বন, হিংস্র জন্তুতে পরিপূর্ণ। সামনে নদী, তা পার হওয়ার জন্য অন্য কোন ব্যবস্থা ছিল না। এমতাবস্থায় হরত পীর সাহেব আমার দিকে তাকায়ে বললেন, কেমন করে আমরা নদী পার হব? আর নদীর ওপারে যেতে না পারলে বাঘ ভাল্লুক এবং হিংস্র জন্তু হতে নিরাপদ হওয়া যাবে না। আমিও তখন সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন ছিলাম, কাজেই তাঁর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলাম না। তখন তিনি হাসিমুখে সূরায়ে এখলাস পাঠ করলেন। তৎক্ষণাৎ নদীর পানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে চলার মত একটি পরিষ্কার পথ সৃষ্টি করে দিল। তিনি আমার হাত ধরে ঐ পথ দিয়ে ওপারে চলে গেলেন।
এক দরিদ্র বৃদ্ধা খাজা কুতবুদ্দীন রাঃ এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করল, হযরত ! অনেক দিন হল আমার নয় বছর বয়স্ক একটি ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। বহু অনুসন্ধান করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমি যাতেতাকেফিরে পাই তজ্জন্য একটু দোয়া করুন। বৃদ্ধার আবেদন শুনে তিনি কিছুক্ষণ অধোমুখী হয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, তোমার ছেলে তোমার বাড়িতেই আছে। ঠিক সেই সময় এক ব্যক্তি এসে বৃদ্ধাকে সংবাদ দিল যে, তোমার ছেলে বাড়ি এসেছে। বৃদ্ধা দৌড়ায়ে বাড়িতে গিয়ে পুত্রকে কোলে জড়ায়ে ধরে বললেন, বাবা তুই এত দিন কোথায় ছিলি এবং কেমন করে আসলি? ছেলে বলল, আমি এক সওদাগরের সঙ্গে রোম দেশে চলে গিয়েছিলাম, উক্ত সওদাগর আমাকে সেখানে ফেলে চলে এসেছিল। ফলে আমি সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতেছিলাম। কিছুক্ষণ পূর্বে এক বুযুর্গ লোকের সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে বললেন, তোমার মা তোমাকে হারায়ে কান্নাকাটি করে অস্থির, চল, তার সঙ্গে গিয়ে দেখা কর। আমি তাঁকে বললাম, আমার মা কোথায় আছেন? তিনি বললেন, তিনি নিকটেই আছেন। এই বলেই তিনি আমাকে নিয়ে শহরের বাইরে চলে আসেন এবং আমাকে বলেন, চক্ষু বন্ধ কর। আমি চক্ষু বন্ধ করলাম, পর মুহূর্তে চক্ষু খুলে দেখতে পেলাম, আমি নিজ বাড়িতে ঘরের দ্বারে দণ্ডায়মান।
কুতবুল আকতাব খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার রাঃ স্বয়ং বলেছেন, একদিন চলতে চলতে আমরা একি নদীর তীরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমরা তখন তিন দিনের অনাহারী ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি বকরী কয়েকটি রুটি মুখে করে এন আমাদের সামনে রেখে দিল। আমরা তাকে বকরীবেশে আল্লাহর প্রেরিত দূত মনে করে রুটিগুলো আহার করলাম এবং আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি বিচ্ছু দ্রুত গতিতে আমাদের সামনে আসল এবং পরমুহূর্তেই নদীর তীরের দিকে চলল, আমরাও তার পিছনে পিছনে চললাম।
বিচ্ছুটি নদীর তীরে পৌঁছামাত্র নদীর তীর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে নদীর তলদেশ দিয়ে একটি শুষ্ক পথ বের হয়ে পড়ল। সেই পথ ধরে বিচ্ছুটির পিছনে পিছনে চলে আমরাও নদীর অপর পাড়ে গিয়ে পৌঁছলাম এবং আমরা সেখানে এক বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পেলাম যে, একটি রোক মৃতের মত পড়ে আছে এবং একটি কাল সাপ তাকে দংশন করার জন্য ফনা বিস্তার করে আছে। এমতাবস্থায় বিচ্ছুট লাফায়ে গিয়ে সাপটিকে দংশন করল। ফলে সাপটি তৎক্ষণাৎ মরে দেল। এর পরক্ষণেই আমরা আর বিচ্ছুটকে দেখতে পেলাম না। লোকটির কাছে আমরা গিয়ে দেখলাম, সে একজন শরাবী, শরাবের নেশায় মাতাল হয়ে পড়ে রয়েছে। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে আমরা বিস্ময়ের সাথে ভাবতেছিলাম, একজন শরাবীর প্রতি আল্লাহ পাকের এত মেহেরবাণী। এমন সময়ে আমরা গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেলাম, আমি যদি শুধু নেককারদেরই হেফাযত করি, তবে গুনাহগার লোকদের হেফাযত কে করবে? অতঃপর লোকটির জ্ঞান ফিরে আসলে আমাদের কাছ থেকে সমুদয় ঘটনা শ্রবণ করে বিশেষ লজ্জিত এবং আর কখনও শরাব স্পর্শ করবে না বলে তওবা করল।
সুলতান আলতামাশের ভাগিনা ও পোষ্যপুত্র হযরত খাজা কুতবুদ্দীন রাঃ এর কাছে মুরিদ হওয়ার জন্য আসলে তিনি বললেন, তুমি এখনও মুরিদের যোগ্য হওনি। ফকির দরবেশদের প্রতি তোমার আন্তরিক মহব্বত আছে বটে, কিন্তু দুনিয়ার মোহ অন্তরে থাকা পর্যন্ত ফকিরদের সঙ্গে তোমার মহব্বত কোনই কাজে আসবে না। হযরত কুতবুদ্দীন রাঃ এই মন্তব্য শুনে সুলতানের ভাগিনা সাদুদ্দীন তৎক্ষণাৎ বাড়িতে ফিরে গেলেন এবং নিজের যথাসর্বস্ব ফকির মিসকীনদের মধ্যে বিলায়ে দিলেন। অতঃপর দুনিয়ার মোহ অন্তর হতে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলে পুনরায় হযরত বখতিয়ার কাকী রাঃ এর খেদমতে হাজির হলেন।
এবার হযরত বখতিয়ার কাকী রাঃ হযরত হামীদুদ্দীন দাগোরীকে বললেন, এখন তাকে মুরিদ করে নেও। কাজী নাগোরী রাঃ হযরত খাজা সাহেবের নির্দেশক্রমে সাদুদ্দীনকে মুরিদ করলেন এবং তাঁর প্রতি এমন তাওয়াজ্জুহ দিলেন যে, মুহূর্তে তাঁর অন্তরের সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করে স্বচ্ছ কাঠের মত করে ফেললেন। অতঃপর খাজা কুতবুদ্দীন রাঃ তাঁকে বললেন, একবার উপরের দিকে তাকায়ে আরশ ও কুরসী এবং নিচের দিকে তাকায়ে সপ্তম স্তর জমিনের তলদেশ পর্যন্ত দেখতে পেল। অতঃপর কাজী নাগোরী সাহেবকে বললেন, আজ এ পর্যন্তই থাকুক। এইরূপে সাদুদ্দীন তাম্বুলী রাঃ আউলিয়ায়ে কেরামের দলভুক্ত হলেন।
একদিন হযরত সাদুদ্দীন তাম্বুলী রাঃ হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার রাঃ এর দরবারে উপস্থিত থাকা অবস্থায় তাঁর মামু সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ হযরত খাজা সাহেবের জিয়ারতে আসলেন। পথে পথে তিনি কল্পনা করছিলেন, ফকির দরবেশের কোন কারামত থাকলে আজ অবশ্যই আমার সামনে কিছু খাবার উপস্থিত করা হবে। তাঁর ধারণা ছিল, খাজা সাহেবের গৃহে দিনের পর দিন উপবাস চলে। আজ অকস্মাৎ কিছু খাবার চাইলে যদি তিনি উপস্থিত করতে পারেন। তবে তা তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার পরিচায়ক হবে। যা হোক, সুলতান দরবারে হাজির হয়ে বললেন, হযরত আজ আমি ভুকা, কিছু খাবার দিন। একথা শুনামাত্র হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ সামনের দিকে হাত বাড়ালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এক থালা উৎকৃষ্ট ধরণের গরম রুটি তাঁর হাতে এসে উপস্থিত হল। তখন তিনি তা সুলতানের সামনে রেখে দিলেন। সুলতান তাতে বিস্মিত হলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার আরজ করলেন, হযরত ! শুধু রুটি কেমন করে খাওয়া যায়? একথা শুনে হযরত সাহেব হযরত কাজী হামীদুদ্দীন নাগোরী রাঃ এর দিকে ইশারা করলেন। তিনি হযরত খাজা সাহেবের অজুর জায়গা হতে এক দলা কাদা মাটি এনে রুটির উপর রাখলেন, আর অমনি তা উৎকৃষ্ট হালুয়া হয়ে গেল।
একবার একাধারে কয়েকদিন যাবত হযরত খাজা সাহেবের পরিবারবর্গের উপবাস চলতেছিল। তাঁর পুত্র কথা প্রসঙ্গে তা কোনও এক ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করে দিলে সে ব্যক্তি এই দীর্ঘ উপবাসের কথা জানতে পেরে বহু খাদ্য সামগ্রীসহ হযরত খাজা সাহেবের দরবারে হাজির হয়ে আরজ করলেন, হযরত ! আপনার পরিবারে উপবাস চলতেছে তা পূর্বে আমার জানা ছিল না, সংবাদ জানতে পেরেই আমি এই খাদ্য দ্রব্য নিয়ে এসেছি। তা শুনে হযরত খাজা সাহেব বললেন, যে ব্যক্তি তোমার কাছে আমার পরিবারের গোপন কথা প্রকাশ করেছে, তার ঘাড় যেন ভেঙ্গে যায়। তিনি এই কথাটি মুখ হতে বের করা মাত্র তাঁর পুত্র গৃহের ছাদ হতে পড়ে যায়। ফলে তার ঘাড় ভেঙ্গে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

হযরত শায়খ ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ

সুলতানুস সালেকীন, শামসুল আরেফীন, শায়খ ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর মাসউদ রাঃ মুলতান অঞ্চলের ঐসমস্ত আউলিয়া কেরামের অন্যতম, যাদের জন্য জামানা চিরকাল গর্ববোধ করবে। হযরত খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ তাঁর পীর-মোর্শেদ এবং হযরত খাজা গরিব নেওয়ায মঈনুদ্দীন চিশতি সানজরী রাঃ এর দাদাপীর ছিলেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : হযরত বাবা গঞ্জেশকর মাসউদের ঊর্ধ্বতন পূর্ব পুরুষ কাবুল রাজ্যের বিখ্যাত অলিয়ে কামেল ফররোখ শাহ রাঃ। তাঁর নিম্নতম চতুর্থ পুরুষের সন্তান হযরত শেখ শোআইব আঃ সুলতান মাহমুদ গযনবীর সহোদর ভগ্নীকে বিবাহ করেন। হযরত শেখ শোআইবের পিতা হযরত শেখ আহমদ রাঃ  তাতারীদের আক্রমণে কাবুল রাজ্যের পতন কালে তাতারীদের হাতে শহীদ হন এবং শেখ শোআইব রাঃ কাবুল হতে হিজরত করে লাহোর এবং সেখান থেকে কাসূরে গমন পূর্বক সেখানকার কাজী সাহেবের মেহমান স্বরূপ অবস্থান করেন। কাসূরের কাজী সাহেব মুলতানের শাহী দরবারে সুপারিশ করে তাঁকে অল্প দিনের মধ্যেই খোটোয়ালের কাজীর পদে বহাল করে দেন। এই শেখ শোআইব রাঃ এর পুত্র শেখ জামাল উদ্দিন সুলাইমান রাঃ এলম, ফজিলত এবং রূহানিয়াতের খুব কামেল ছিলেন। তিনি মুলতানের হযরত মাওলানা ওয়াজিহুদ্দীন খাজান্দী রাঃ এর কন্যা কুরসুম খাতুন মতান্তরে মারয়াম বানুকে বিবাহ করেন। তাঁরই গর্ভে হযরত শেখ জামালুদ্দিন সুলাইমান রাঃ এর তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। পুত্রদের নাম যথাক্রমে ফরিদুদ্দীন মাসউদ, আআযযুদ্দীন মাহমুদ ও নাজীবুদ্দিন মুতাওয়াক্কেল এবং কন্যার নাম বিবি হাজেরা। হযরত পীরানে পীর দাস্তেগীর সাইয়্যেদ আবদুল কাদির জিলানী রাঃ এর প্রপৌত্র হযরত শেখ আবদুর রহিমের সাথে বিবি হাজেরার বিবাহ হয়। এই বিবি হাজেরাই হযরত মাখদুম আহমদ আলাউদ্দীন আলী আহমদ সাবের রাঃ কালিয়ারীর মাতা।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা : হযরত বাবা গঞ্জেশকর মাসউদ রাঃ শৈশবেই পিতৃহারা হন। জন্মের পর চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে মাতা তাঁকে খোটোয়ালের মক্তবে মাওলানা সাইয়্যেদ নাজির আহমদ সাহেবের খেদমতে পাঠায়ে দেন। তাঁর কাছে তিনি দ্বীনি এলমের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে থাকেন। এগার বছর বয়সে তিনি কুরআন শরীফ হেফয করেন। তিনি এই এগার বছর বয়সেই স্বীয় উস্তাদ মাওলানা সইয়্যেদ নাজির আহমদ ও মাতার সাথে হজ্ব করতে যান।
বাবা সাহেব মুলতানে : পবিত্র মক্কা শরীফ হতে ফিরে আসার পর তাঁর মাতা তাঁকে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য মুলতানে পাঠায়ে দেন। মুলতানে তৎকালে বহু সুদক্ষ ও সুবিজ্ঞ আলেমগণ স্থানে স্থানে মাদ্রাসা স্থাপনপূর্বক দ্বীনি এলম শিক্ষা দিতেন। পিতৃহীন বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ মুলতানে কোন এক মসজিদে থেকে বহু দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে এলম হাসিল করতে থাকেন। শহরে তিনি ‘কাযীবাচ্চা’ নামে খ্যাত হন। শৈশব হতেই খোদাপ্রেমের বীজ তাঁর হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বলে তিনি সর্বদা চিন্তামগ্ন ও ভাবাতুর অবস্থায় থাকতেন। লোকে তাঁকে আল্লাহর পাগল বলে মনে করত।
হযরত শেখ আবুল কাসেম জালালুদ্দীন তাবরেযী রাঃ প্রথমবার মুলতানে পৌঁছে সেখানকার অধিবাসীদের মুলতানের আউলিয়া ও বুযুর্গানে দ্বীন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে লোকেরা তাঁকে ‘কাযীবাচ্চার’ ঠিকানা বলে দিলেন। তিনি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে একটি আনার দান করেন এবং সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপের পর প্রত্যাগমন করলেন। হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন আনারটি ভেঙ্গে উপস্থিত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। বণ্টনকালে আনারের একটি বীজ মাটিতে পড়ে যডায়, তিনি তা উঠায়ে নেন এবং তা দিয়ে নিজে রোজার ইফতার করেন। আনার বীজের রস পেটে প্রবেশ করা মাত্র তাঁর অন্তর রাজ্য এক অপূর্ব আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি এর কারণ বুঝতে না পেরে বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন।
এই সময় হযরত খাজা কুতবুল আকতারব কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ মুলতানে অবস্থান করতেছিলেন। একদিন বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ মসজিদে বসে ‘আননাফে’ নামক তাসাউফের একটি জটিল কিতাব অধ্যয়ন করতেছিলেন। এমন সময় একজন বুযুর্গ মসজিদে উপস্থিত হন। এই বুযুর্গ একটি অপরিণত বয়স্ক বালকের হাতে আননাফে কিতাব দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কিতাব পড়ছ? হযরত বাবা ফরিদুদ্দিন কিতাব হতে চক্ষু তুলে প্রশ্নকারীর দিকে তাকায়ে উত্তর দিলেন, ‘আননাফে’। তিনি মৃদু হেসে তাঁকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, এই কিতাবটি কি তোমার কোন উপকার করবে? এই প্রশ্নের সাথেই আবার উভয়ের চার চক্ষুর মিলন হতেই বাবা ফরিদুদ্দীন রাঃ এর অন্তরে এক বিশেষ রকমের ক্রিয়ার উদ্ভব হল। তিনি উত্তর করলেন, জি না, এই কিতাবটি আমার কোন উপকার করছে না তবে হুজুরের দয়া দৃষ্টি এ অধমের প্রতি অর্পিত হলে অধমের জন্য উপকার হতে পারে। এতটুকু বলেই তিনি উক্ত বুযুর্গের পদপ্রান্তে লুটায়ে পড়লেন। আগন্তুক বুযুর্গ স্নেহে তাঁকে হাতে ধরে উঠালেন।
বাবা গঞ্জেশকর অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হযরত আপনার মহান নামটি কি জানতে পারি? বুযুর্গ বললেন, আমার নাম কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী। বাবা গঞ্জেশকর বললেন, হযরত দয়া করে আমাকে আননাফে কিতাবটি পড়ায়ে দিন। তিনি বললেন, আমি মাওলানা মিনহাজুদ্দীন তিরমিযীর মসজিদে অবস্থান করছি, সেখানে এসো। এর পর হতে বাবা গঞ্জেশকর রাঃ যথারীতি উক্ত মসজিদে গিয়ে হযরত কুতবুল আকতাবের কাছে আননাফে কিতাব পড়তে লাগলেন।
কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ মুলতান হতে দিল্লী যাত্রা করলেন। হযরত ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ আননাফে অধ্যয়নকারী ছাত্র দুই মঞ্জিল পর্যন্ত স্তাদজীর পশ্চাদনুসরণ করার পর তাঁকে খেদমতের জন্য সঙ্গে নেবার আবেদন জানালেন। কিন্তু উস্তাদজী তাঁকে বুঝায়ে ও প্রবোধ দিয়ে বললেন যে, দ্বীনি এলম শিক্ষা সমাপ্ত করে তুমি আমার কাছে এসো। বে-এলম দরবেশ শয়তানের ক্রীড়ানক হয়ে থাকে।
একথা যেমন সত্য যে, বেএলম দরবেশ শয়তানের খেলার পুতুল, তদ্রুপ এও সত্য যে, দরবেশবিহীন আলেমও শয়তানের খেলার পুতুল। এর তত্ত্বকথা এই যে, যে এলম আল্লাহর পথ দেখায় না তা মূর্খতা। প্রথম দৃষ্টিতেই আমরা দেখতে পাই এলমের অহংকারে মত্ত হয়েই ইবলিস অপমানের চরম সীমায় পৌঁছায়ে ছিল। এলম ছাড়া যেমন আল্লাহ তায়ালাকে চিনা যায় না, তেমনি এলম আবার আল্লাহকে চিনার পথে অন্তরায়ও হয়ে থাকে।
হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ এখানে বলেছেন যে, বে-এলম দরবেশ শয়তানের ক্রীড়ানক, তা অনুধাবন করার বিষয়। শুধু বে-এলম অর্থাৎ মূর্খ লোককে তিনি শয়তানের খেলার পুতুল বলেননি বরং বে-এলম দরবেশের কথা বলেছেন।
হযরত খাজা বুতবুল আকতাবের ইচ্ছা ছিল না যে, যার প্রতি তঁর খাস দৃষ্টি পড়েছে সে এমনভাবে জাযবার স্রোতে ভেসে যাক। এজন্য তিনি ছাত্রটিকে সতর্ক করলেন, যেন উন্নতি ও কামালিয়তের কোন একটির প্রতি তার ঝোঁক না চেপে বসে।
মসজিদে অবস্থান কালে একদা হযরত খাজা সাহেবের স্নেহ ও মমতায় সাহসী হয়ে ছাত্রটি (হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন) সেই আনার বীজের ক্রিয়া সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হযরত কুতবুল আখতাব রাঃ বললেন, প্রত্যেকটি আনারের মধ্যে একটি মাত্র বীজ আল্লাহ তায়ালার নূরে পরিপূর্ণ থাকে। সেই বীজটি দ্বারাই তুমি রোজার ইফতার করেছিলে, এই কারণেই তোমার অন্তর খোদার নূরে আলোকিত হয়ে দিয়েছিল। ছাত্রটি এই রহস্য শ্রবণ করে কৃতজ্ঞতায় মস্তক অবনত করে ফেলল।
যেই কাযীবাচ্চাকে হযরত জালালুদ্দীন তাবরেযী রাঃ আনার প্রদান করেছিলেন, আননাফে কিতাব অধ্যয়ন করতে দেখে যার প্রতি হযরত কুতবুল আকতাবের দৃষ্টি পতিত হয়েছিল, আজলে শিরাজী যাঁকে ‘লঙ্গরে আলম’ উপাধি প্রদান করেছিলেন, শেখ সাইফুদ্দিন বাখোরযী যাঁর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন- এই ছেলেটি কালে যুগের শ্রেষ্ঠ মাশায়েখগণের অন্যতম হবে। তাঁর সন্তানে ও মুরিদানে দুনিয়া ভরে যাবে। শায়খুল শোয়ুখ হযরত শেহাবুদ্দীন সাহরাওয়ার্দী রাঃ স্বয়ং যাঁকে স্বরচিত আওারেফুল মাআরফ কিতাবের কিছু অংশ পড়ায়েছিলেন, খাজা কুতবুল আকতাব যাঁকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন। খাজা আজমিরী রাঃ যাঁকে ‘শাহবায’ বলতেন এবং নিজের সিলসিলার উজ্জ্বল প্রদীপ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, সর্বশেষে সুলতানুল মাশায়েখ বাদায়ুনী যাঁকে শায়খে-কাবীর উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, শায়খ বলেছিলেন, ইনিই সেই মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী, হযরত ফরিদুল হক ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর নামে পরিচিত ও বিখ্যাত। তিনি নিজে সিলসিলার প্রবর্তক এবং ‘দ্বিতীয় আদম’ নামে পরিচিত।
তাযকেরা লেখকগণ আননাফে পড়ার সময়ে হযরত বাবা গঞ্জেশকরের বয়স বিশ বছর বলেছেন। কেননা, ৫৮৯ হিজরিতে হযরত সুলতানুল হিন্দ খাজা আজমিরী রাঃ কুতবুল আকতাব হযরত বখতিয়ার কাকীকে খেলাফত দান করেন এবং এই বছরই তিনি খলিফারূপে মুলতানে যান, তথায় এসময়ে তাঁর সাথে হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ এর সাক্ষাৎ হয়েছিল। অতএব, হযরত গঞ্জেশকরের জন্ম যেহেতু ৫৬৯ হিজরিতে, সুতরাং এসময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল বিশ বছর এবং সেই বয়সেই তিনি মুলতানে হযরত কুতবুল আকতাবের হাতে বায়াত হন। বায়াত হওয়ার পরই তিনি হযরত পীর-মোর্শেদের সাথে দিল্লীতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু মোর্শেদ তাঁকে বললেন, দ্বীনি এলমের তালিম পূর্ণ কর তৎপর আমার দরবারে এসো।
অতএব, উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি কান্দাহারে গমন করেন সেখানে হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ নাজির আহমদ বোখারীর কাছে ৫৯৩ হিজরি পর্যন্ত অধ্যয়নরত থাকেন। এই সময়ে মাতার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে খোটোয়াল যাতায়াত করতেন। মাতা তাঁকে সর্বদা উৎসাহ প্রদান করতেন। মাওলানা বোখারী রাঃ নিজের সমুদয় এলম শরবতরূপে তাঁকে পান করায়ে দিলেন। যার স্বাদ জীবনে তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। তিনি ফেকাহ ও হাদিস শাস্ত্রে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। উত্তম ও প্রশংসনীয় গুণাবলী তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। এসময়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে, পীর-মোর্শেদ সাহেবের নির্দেশ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়েছে।
খেলাফত : মায়ের পরামর্শক্রমে হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর মাসউদ রাঃ দিল্লীর পথে ঊছ নামক স্থানে পৌঁছায়ে চল্লিশ দিন যাবৎ মসজিদে হাজ্বের মধ্যে চিল্লায়ে মা’কুস করলেন। গাছের সাথে রশি দিয়ে কূপের মধ্যে ঝুলে পড়তেন এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন রশিদুদ্দীন মীনাঈ ভোরে রশি টেনে তাঁকে উঠাতেন। এইরূপে চল্লিশ দিন পূর্ণ করার পর দুর্বলতা, কৃশতা সত্ত্বেও তিনি দিল্লীর দিকে চললেন।
৬১১ হিজরির ২রা রমজান মতান্তরে ২৫ শে জিলহজ্ব হযরত খাজা কুতবুল আকতাব কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর দরবারে কাজী হামিদুদ্দীন নাগূরী, মাওলানা সামসুদ্দীন তুরক, খাজা মাহমুদ আলাউদ্দিন কেরমানী, বদরুদ্দীন গাযনবী, বোরহানুদ্দীন বলখী, যিয়াউদ্দীন রোমী, নূরুদ্দীন গাযনবী প্রমুখ উপস্থিত আউলিয়া কেরামের মধ্যে আলোচনা চলতেছিল যে, পীরের অন্তরে শক্তি বলে মুরিদের সীনা হতে মরিচা দূর করতে পারে। ঠিক সেই সময়ে হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ হৃদয় ভরা আগ্রহ নিয়ে আশা ও ভয়ের সাথে দরবারে হাজির হলেন। দরবারে প্রবেশ করা মাত্র তাঁর আগ্রহ, জ্ঞান ও এলম সবকিছু লোপ পেয়ে গেল। দীর্ঘ দিনের বিচ্ছেদ তাঁদের মধ্যস্থলে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল খাড়া করে দিল। তিনিও কিছু বলতে পারলেন না। হযরত কুতবুল আকতাবও তাঁর প্রতি ফিরে তাকালেন না। মাওলানা শামসুদ্দীন তুরক সাহেব মজলিশের রীতি অনুসারে তাঁকে বসতে ইশারা করলেন। কিন্তু তিনি তা অনুভবই করতে পারলেন না। হতবুদ্ধি ও নিশ্চল ভাবে দাঁড়ায়ে থাকলেন। পরিচয়ের কি উপায় অবলম্বন করবেন কিছুই স্থির করতে পারলেন না। মুলতানের মসজিদে থাকা কালে অনুগ্রহের দৃষ্টি অর্পণের কথা, আননাফে পড়ার কথা, এলম হাসিল সম্পূর্ণ করার পর খেদমতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়ার কথা স্মরণ করায়ে দিবেন কি না ভেবে ঠিক করতে পারলেন না। কে জানে সে সব কথা তাঁর খেয়াল আছে কি না। এইরূপে সাত পাঁচ ভাবতেছিলেন এমন সময় কানে আওয়ায আসল- মাওলানা ফরিদ ! সব কাজ শেষ করে এসেছো তো? শব্দ কানে আসতেই পীর সাহেবের পদপ্রান্তে লুটায়ে পড়লেন। কদম মোবারক স্পর্শ করতেই আর কোন পার্থক্য থাকল না। মধ্যকার দেয়াল সরে গেল। হযরত খাজা কুতবুল আকতাব আবার বললেন, আল্লাহ ওয়ালা লোকেরা এইরূপে সিঁড়ির পর সিঁড়ি অতিক্রম করে থাকে। কিন্তু এর সৌভাগ্য সকলের ভাগ্যে জোটে না। তা শুধু আল্লাহ পাকের অনুগ্রহের মেহেরবাণীর উপর নির্ভরশীল। অসম্পূর্ণ চেষ্টাও আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে ফলবতী হয়ে থাকে। এই বলেই ‘চার তরফী টুপী’ খেলাফতের নিদর্শন স্বরূপ পরায়ে দিলেন এবং পুনরায় বায়াত করলেন এবং বললেন, মুরিদের পক্ষে উপস্থিত অনুপস্থিত উভয় সময় একই ভাবে পীরের খেদমত করা কর্তব্য। বিশেষ করে পীরের ইন্তেকাল হলে আরও অধিক খেদমত করা কর্তব্য।
গঞ্জেশকর : এই উপাধি সম্পর্কে গ্রন্থকারেরাদুই তিন রকমের কারণ বর্ণনা করেছেন। সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ কারণ এই যে, পুনর্বার বায়াত করার পর পীর সাহেব তাঁর গজনী দরজার কাছে একটি কামরায় স্থান দিয়ে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। দীর্ঘদিনের সফর, রিয়াজত এবং সবেমাত্র চিল্লায়ে মা’কুস পালন করার ফলে শরীর যদিও খুব কৃশ এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিল তথাপি পীরের নির্দেশ পালনে ব্রতী হলেন। তিনি দিন রোজা রাখার পর ইফতার করার মত তাঁর কাছে কিছুই ছিল না। তখন এক শরাবী কিছু খাদ্যদ্রব্য তাঁর সামনে পেশ করলে তিনি তা দিয়ে ইফতার করলেন। কিন্তু তাঁর পাকস্থলী সেই খাদ্য কবুল করল না, বরং বমি হয়ে গেল। তৎপর পীর সাহেবের কাছে ব্যাপারটি খুলে বললে তিনি বললেন, সেই খাদ্য মাদকতাপূর্ণ ছিল। বের হয়ে গিয়ে ভালই হয়েছে, এখন আরও তিনটি রোজা রাখা আবশ্যক। অতঃপর গায়েব হতে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়েই ইফতার করো। পীরের নির্দেশ অনুযায়ী পুনরায় তিন দিন রোজা রাখলেন, কিন্তু তৃতীয় দিনেও ইফতারের সময় কিছুই পাওয়া গেল না। পরবর্তী প্রভাবে তীব্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে তিনি জমিনের উপর হাত মারলে কয়েকটি কঙ্কর হাতের তালুতে বেধে গেল। তাকে গায়েবী দান মনে করে মুখে দিয়ে অনুভব করলেন, তার স্বাদ মিষ্টি। এখন মনে করলেন, তা গায়েবী দানই বটে। পরবর্তী দিন পীর সাহেবের খেদমতে এসে পূর্ণ ঘটনা বিশদভাবে বর্ণনা করলেন, হযরত পীর সাহেব বললেন, রূহ যখন নফসকে বশীভূত করে তখন স্থায়ী মিষ্টতা লাভ হয়। অতএব, মোবারক হোকÑ তুমি গঞ্জেশকর অর্থাৎ, মিষ্টতার আকর হয়ে গেলে।
অন্য রেওয়ায়েতে দেখা যায়, শৈশবে তাঁর মাতা তাঁকে নামাজের পাবন্দ করার জন্য প্রত্যেক নামাজের সময় মুসল্লার নিচে চিনির একটি পুরিয়া রেখে দিতেন এবং বাবা ফরিদকে বলতেন, যে সমস্ত শিশু নামাজ পড়ে তারা প্রত্যহ নামাজের মুসল্লার নিচ থেকে আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে চিনি পেয়ে থাকে। একদিন তাঁর মাতা মুসল্লার নিচে চিনির পুরিয়া রাখতে ভুলে গেলেন। নামাজের সময় পার হয়ে গেলে মাতা চিন্তিত মনে পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাসউদ তুমি নামাজ পড়েছ কি? তিনি উত্তর করলেন, হাঁ মা, নামাজও পড়েছি এবং চিনির পুরিয়াও পেয়েছি। এই উত্তর শুনে মা খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন এবং বুঝতে পারলেন, এই শিশুর প্রতি গায়েবী মদদ আছে। তখন হতে তিনি পুত্রকে গঞ্জেশকর বলতে লাগলেন। আজ পর্যন্ত লোকমুখে সেই উপাধি মশহুর হয়ে আছে।
যা হোক, হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন মাসউদ রাঃ সেই হুজরার মধ্যে থেকে ইবাদত ও রিয়াজত করতে লাগলেন। প্রথমে প্রতিদিন এবং পরে এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ পর পর একবার পীর সাহেবের খেদমতে হাজির হতেন। এর কিছুদিন পর হযরত খাজা সুলতানুল হিন্দ মুঈনুদ্দীন চিশতি রাঃ দিল্লীতে আগমন করেন। তাঁর কদমবুছি করার জন্য দিল্লীর লোক দলে দলে তাঁর খেদমতে ভিড় করতে লাগলেন। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশও আসলেন, কিন্তু বাবা গঞ্জেশকর আসলেন না। সুলতানুল হিন্দ তাঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ বললেন, সে চিল্লা করছে। তা শুনে তিনি বললেন, তুমি সত্যই বখতিয়ার। এমন ‘শাহবায’ কবলে এনেছো, যেই শাহবাযের বাস সিদরাতুল মুনতাহার এদিকে নহে। এমন লোকের উপর আর কঠোরতা করা সমীচীন নয়, চিল্লা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
অতঃপর তাঁরা উভয়ে বাবা সাহেবের হুজরায় গেলেন এবং বাবা সাহেবকে উভয়ের মাঝখানে রেখে দীর্ঘক্ষণ ধরে দোয়া করলেন- আল্লাহ পাক ! ফরিদকে কবুল করুন। গায়েব হতে আওয়াজ আসল, আমি ফরিদকে কবুল করলাম। অতঃপর তাঁরা উভয়ে তাঁকে প্রচুর পরিমাণে রূহানী ফয়েজ দান করলেন এবং বললেন, ফরিদ এমন একটি প্রদীপ যা আমাদের সিলসিলাকে উজ্জ্বল করবে এবং যুগের অদ্বিতীয় হবে। হযরত সুলতানুল হিন্দ রাঃও তাঁকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন। এই বরকতেই আজ পর্যন্ত তাঁকে বাবা উপাধিতে স্মরণ করা হয়। উভয়ে বাবা সাহেবকে ফয়েজ দানের পর হযরত কুতবুল আকতাব বাবা সাহেবকে বললেন, দাদা পীরের কদমবুছি কর। বাবা সাহেব খাজা বখতিয়ার কাকীর কদমবুছি করলেন। খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ বললেন, আমি তোমাকে বললাম, দাদা পীরের কদমবুছি কর, তুমি আমার কদমবুছি করলে? বাবা সাহেব উত্তর করনে, ঐ কদম ব্যতীত আর কোনই কদমই আমি দেখতে পাই না। এই জবাব শুনে খাজা আজমীরী রাঃ বললেন, বখতিয়ার ! মাসউদ ঠিকই বলছে। সে মঞ্জিলের দরজায় পৌঁছে গেছে, সেখানে এক ভিন্ন দ্বিতীয়ের অস্তিত্ব নেই। কাজেই সেখানে তুমি ভিন্ন আমি তাঁর দৃষ্টিতে আসব কেন?
হযরত বাবাজী দিল্লীতে অবস্থান কালের শেষের দিকে হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী রাঃ বাবা সাহেবকে নিজের কাছে রেখে অজু করায়ে দেয়ার কাজে নিযুক্ত করলেন। একদিন রাতে ঘরে আগুন ছিল না। অর্থাৎ, অজুর পানি গরম করার জন্য আগুনের প্রয়োজন। সুতরাং অন্ধকারের মধ্যে তিনি আগুনের সন্ধানে বের হলেন। বস্তির একটি গৃহের মধ্যে মানুষের আওয়াজ পেয়ে তিনি উক্ত গৃহের দরজায় দাঁড়ায়ে আগুন চাইলেন। ঘরের মালিক দরজা ফাঁক করে দৃষ্টি করতেই দেখল সুদর্শন চেহারা ও সুঠাম দেহ বিশিষ্ট এক যুবক দরজায় দণ্ডায়মান। যুবকের মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য চাঁদের সৌন্দর্যকেও হার মানাচ্ছে। ঘরের মালিকাও খুব সুন্দরী ছিল, সে আকর্ষণের ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল, যুবক আগুন দিয়ে কি করবে? কোথাও আগুন লাগাবার মতলব আছে কি? বাবা সাহেব কোন উত্তর না দিয়ে শুধু আগুনই চাইতে লাগলেন। অবশেষে মেয়েলোকটি আগুনের মূল্য চেয়ে বলল, যুবক, চোখের বিনিময়ে আগুন পেতে পার, তুমি তোমার একটি চোখ আমাকে দাও তবে আমি তোমাকে আগুন দিতে পারি। পীর সাহেবের মহব্বত ও খেদমতের আগ্রহ তাঁকে এই বিনিময়ের প্রতি প্রস্তুত করে দিল। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর বাম চোখটি খুলে স্ত্রীলোকটির দিকে নিক্ষেপ করলেন। স্ত্রীলোকটি তা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল এবং নির্বুদ্ধিতার জন্য অনুতপ্ত হয়ে যুবককে আগুন দিয়ে দিল। বাবা সাহেব হযরত পীর সাহেবকে অজু করাতে লাগলেন, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, চক্ষু বেধে রেখেছো কেন? বাবা সাহেব বললেন, চক্ষু উঠেছে। হযরত পীর সাহেব বললেন, চক্ষুর বাঁধন খুলে দাও, উঠে থাকলে ভাল হয়ে গেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ বাঁধন খুলে দেখলেন চক্ষুর গর্তে চক্ষু বিদ্যমান অবশ্য পূর্বের চেয়ে কিঞ্চিত বড় আকারের। ফলে, পরবর্তীতে ফরিদুদ্দীন রাঃ এর বাম চোখ ডান চোখের চেয়ে কিঞ্চিত বড় দেখা যেত।
হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন মাসউদ রাঃ বলেন, হযরত পীর সাহেব রাঃ কিছুদিন ধরে আমাকে বিয়ে করার জন্য নির্দেশ দিতে লাগলেন। কিন্তু লজ্জা ও আদবের খাতিরে আমি তা এড়ায়ে চলতে লাগলাম। অবশেষে তিনি একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিয়ে করতে অস্বীকার করছো কেন? ভয়ে ভয়ে উত্তর করলাম, যদি অনুপযুক্ত সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তবে তাদের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে লজ্জিত হতে হবে। হযরত পীর সাহেব বললেন, ভাল সন্তান জন্মিলে তা তোমার, আর অসৎ সন্তান জন্মিলে তাদের দায়িত্ব আল্লাহ পাকের ও আমার। অতএব, এখন বিয়ে করতে আর অসম্মত হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
হাঁসীতে অবস্থান : হযরত পীর সাহেব বিয়ে করার জন্য নির্দেশ দিলে তিনি হাঁসীতে গিয়ে বিয়ে করেন এবং বার বছর হাঁসীতে অবস্থান করেন। ৬৩২ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম দিকে হযরত বাবা সাহেব দিল্লীতে হযরত পীর সাহেব কেবলার খেদমতে গিয়ে পৌঁছলেন। একদিন অবস্থানের পর পুনরায় হাঁসীতে ফিরে যেতে চাইলে হযরত পীর সাহেব বললেন, আজ নয় কাল যেও। আমি জানি, ‘আরদানার’ আকর্ষণ তোমাকে হাঁসী যেতে বাধ্য করছে এবং তুমি অবশ্যই যাবে। আল্লাহ তায়ালার বিধান এইরূপ যে, আমার আখেরী সফরের সময়ে তুমি আমার নিকটে থাকবে না। আমার পীর সাহেবের ইন্তেকালের সময়ে আমি অনুপস্থিত ছিলাম। আমি শেষ বিদায়ের সময় তোমার আমানতগুলো কাজী হামীদুদ্দীন নুগূরী রাঃ এর কাছে দিয়ে যাব। আমার ইন্তেকালের পর পঞ্চম দিনে তুমি তোমার আমানতসমূহ তাঁর কাছ থেকে নিয়ে যেও।
অতঃপর পীর সাহেব আমার দ্বীনি এবং দুনিয়াবী উন্নতির জন্য উপস্থিত সকলের দ্বারা সূরায়ে ফাতিহা ও সূরায়ে এখলাস পড়ালেন এবং স্বীয় মুসাল্লাখানি আমাকে দান করে দুই রাকাত নামাজ পড়তে আমাকে আদেশ দান করলেন। পরবর্তী দিন রোখছত করার সময় আমাকে উপদেশ দান করলেন, আপন পীরের রীতিনীতির উপর দৃঢ়পদ থেকো। বিনয় এবং নম্রতা অবলম্বন করো, দুঃখ-কষ্টে ও বিপদে-আপদে কখনও ঘাবড়ায়ো না। দুনিয়া এবং আখেরাতে তুমিই আমার বন্ধু। আমার স্থান প্রকৃতপক্ষে তোমারই স্থান, অতঃপর মুআনাকা (আলিঙ্গন) করে বললেন, ………………. এটাই তোমার ও আমার মধ্যে শেষ বিদায়। খোদা হাফেজ।
হাঁসীতে ফিরে আসার পর ১৪ই রবিউল আউয়াল দিবাগত রাতে স্বপ্ন যোগে তিনি আপন পীর-মোর্শেদ হযরত খাজা কুতবুল আকতাব কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর ইন্তেকালের খবর প্রাপ্ত হলেন। পরবর্তী দিন ভোরে হাঁসী হতে রওয়ানা করে চতুর্থ দিনগত রাতে দিল্লী গিয়ে পৌঁছলেন এবং মাজার শরীফ জেয়ারত করলেন। তৎপরবর্তী প্রভাতে কাজী হামীদুদ্দীন নাগূরী রাঃ তাঁকে পীর সাহেবের জামা, আসা (লাঠি) এবং কাঠের খড়ম জোড়া দান করলেন। বাবাজী জামাটি পরিধান করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন এবং সাজ্জাদায় গিয়ে বসলেন। তিনি হযরত পীর সাহেব মরহুমের বাড়ীতে তিনি দিন অবস্থান করে অতঃপর হাঁসীতে ফিরে যাবেন বলে ঘোষণা দিবেন। দিল্লী বাসীরা তাঁকে বহু অনুরোধ করলেন, হযরত কুতবুল আকতাবের বাণী ‘আমার স্থানই তোমার স্থান’ স্মরণ করায়ে দিলেন, কিন্তু তিনি কিছুই শুনলেন না। তিনি বললেন, যে নেয়ামত তিনি আমাকে দান করে গিয়েছেন, তার জন্য শহর এবং জঙ্গল একই সমান। অতঃপর …… যেখানেই তোমরা থাক না কেন আল্লাহ পাক তোমাদের সঙ্গে আছেন বলে হযরত বাবা সাহেব জুমআর নামাজের পর হাঁসী অভিমুখে যাত্রা করলেন।
হাঁসীতে পৌঁছেই কয়েক দিন পরেই তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। অতঃপর হযরত জামালুদ্দীন রাঃ এবং শেখ মুনতাযারুদ্দীন রাঃ কে খেলাফত প্রদান করেন এবং শেখ মুনতাযারুদ্দীন রাঃকে খেলাফত দান করেন এবং এর কিছু দিন পর আজমীর শরীফ গমন করেন। সেখানে তিনি হযরত সুলতানুল হিন্দ রাঃ এর মাজারের পার্শ্বে এতেকাফ করলেন। আরাফার রাতে এশার নামাজের পর মাজারের পাশে বসে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে লাগলেন। পনের পারা তেলাওয়াত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাজার হতে শব্দ আসল, অমুক জাগার অমুক অক্ষরটি ছুটে গেছে। অর্থাৎ, শুদ্ধ ও পূর্ণরূপে উচ্চারিত হয়নি। বাবা সাহেব বলেন, আম উক্ত সূরাটি পুনরায় তেলাওয়াত করলাম এবং তৎপর পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম হলে আবার আওয়াজ আসল, এখন ঠিক হয়েছে। আমি পূর্ব ভুল-ত্র“টির জন্য চিন্তা করতে লাগলাম, হায় ! আমার হাশর কিরূপ হবে। তৎক্ষণাৎ মাজার শরীফ হতে সান্ত¡নাবাণী আসল- “এরূপ ব্যক্তি ক্ষমাপ্রাপ্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত। যা হোক খাজা মরহুম হতে বহু ফয়েজ হাসিল করে হযরত বাবা সাহেব হাঁসীতে ফিরে আসলেন।”
অজুধনে গমন : হাঁসীতে ফিরে আসার কিছুদিন পইে হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ এর নিজ জন্মভূমি খোটোয়ালে চলে যান। খোটোয়ালে পৌঁছেই স্বীয় বসবাসের জন্য নিকটবর্তী অজুধন নামক স্থান পছন্দ করলেন। এখান থেকে তিনি খেলাফতের কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। এই স্থানটিই তাঁর জীবনের অবশিষ্ট কালের জন্য বাসস্থান হয়ে রইল।
ঘর-বাড়ি ও পরিজন বিহীন আহলে সুফফা’র নিঃস্ব মুহাজের সাহাবীদের যেমন মদিনার দ্বারে দ্বারে গিয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর হাদিস শুনাতেন। সেরূপ হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃও ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ধরে অজুধনের দ্বারে দ্বারে যেতেন। এদেশের আউলিয়ায়ে কেরামের মধ্যে বাবা সাহেবই প্রথম অলি, যিনি ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে দ্বারে দ্বারে গিয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য প্রকৃতপক্ষে ভিক্ষা করা নয়। বরং নিজের বিনয় নম্রতা ও সৎস্বভাব মানব সমাজকে দেখায়ে তাদের অন্তরকে বস করা এবং নিজের রূহানী ও  আখলাকী ক্রিয়া মানুষের অন্তরে ঢুকায়ে তাদের রূহের সংশোধন করা। এর আরও একটি উদ্দেশ্য এই ছিল যে, দ্বারে দ্বারে ঘুরে দেশবাসী হতে দান গ্রহণ করে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত খানকার লঙ্গরখানা চালু রাখা। বস্তুতঃ এই খানকার দ্বারা তিনি হাজার হাজার ক্ষুধাতুর লোককে পেট ভরে খাওয়াতেন এবং তাদের ক্ষুধার চিন্তা হতে মুক্ত রেখে নিজের তত্ত্বাবধানে আল্লাহ পাকের ইবাদত করাতেন। মোটকথা, তিনি এরূপ পরিশ্রম ও কষ্টের সাহায্যে অজ্ঞানান্ধ মানব সমাজের মধ্যে নিজের এলম, ফজিলম কামালিয়ত প্রকাশ করা একান্ত জরুরী মনে করেছিলেন। এই উপায়ে তিনি শরিয়ত ও তরিকতে শিক্ষা প্রদানে যতটুকু কৃতকার্যতা লাভ করেছেন, জাহেরী এলমধারী আলেমগণ তার কাছেও পৌঁছতে সক্ষম হননি।
একবার এক দুঃখিনী বৃদ্ধা স্ত্রীলোক দুধের কলসি মাথায় করে বাবা সাহেবের খেদমতে এসে অভিযোগ করল যে, যোগী ও যাদুকরেরা তার উপর অন্যায়ভাবে জুলুম করছে, তাদের বিনা পয়সায় দুধ না দিলে দুধে কীট জন্মে। কাজেই আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে এসেছি, যাতে এই যাদুকরেরা আপনার কোন ক্ষতি করতে না পারে। বাবা সাহেব বৃদ্ধা স্ত্রীরোককে বলরেন, মা, তুমি আমার প্রতি স্নেহবশতঃ সাবধান করে দিতে এসেছো, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু মা, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করি না। কাজেই যোগীরা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তুমিও যোগীদের পরিবর্তে খোদার ভয় নিজের অন্তরে স্থান দাও। দেখবে যোগী ও যাদুকরেরা তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। এই উপদেশ বাণী শ্রবণ করে বৃদ্ধা মনে এত শান্তি পেল যে, নিজের সমূহ বিপদের কথা ভুলে গেল।
এই দিকে যোগীদের আশ্রমে দুধ পৌঁছতে দেরী হওয়ায় যোগীর চেলা চামুণ্ডারা বুড়ীর খোঁজে বের হয়ে পড়ল। তারা খুঁজতে খুঁজতে বাবা সাহেবের এখানে এসে বুড়ীকে দেখতে পেল। বাবা সাহেব মিষ্ট কথায় চেলাদের বসায়ে বুঝালেন যে, নিজের জীবিার জন্য অপরের উপর জুলুম করা উচিত নয়। অপরকে কষ্ট দিয়ে বা অপরের উপরর জুলুম করে যে জীবিকা অর্জন করা হয় তা পরিণামে হলাহলে পরিণত হয়। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং সৃষ্ট প্রাণীদের জীবিকার জিম্মাদার। তাঁরই উপর ভরসা রাখা উচিত। অপরদিকে প্রধান যোগী চেলা চামুণ্ডাদের বিলম্ব দেখে ক্রোধে অধির হয়ে স্বয়ং সেখানে এসে উপস্থিত হল। চেলা চামুণ্ডাদেরকে এখানে বসায়ে রাখা হয়েছে দেখতে পেয়ে প্রধান যোগী বাবা সাহেবের সাথে কর্কশ ব্যবহার করতে এবং মন্ত্র পড়ে বাবাজীর মজলিস উড়াতে দিতে চাইল। কিন্তু মন্ত্র পড়তে গিয়ে তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ল। মন্ত্র-তন্ত্র সমস্তই অন্তর হতে যেন মুছে গেল। সে কিছুই স্মরণ করতে পারল না। প্রথমে সে মনে করল, হয়ত অত্যন্ত ক্রোধের কারণেই সে মন্ত্র-তন্ত্র উচ্চারণ করতে পারছে না। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তো এই ছিল যে, নফসের যাদু, রূহানিয়াতের শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে গিয়েছে। কোন ক্রমেই যখন সে একটি মন্ত্রও উচ্চারণ করতে পারল না, তখন অস্থির ও পেরেশান হয়ে বাবা সাহেবের পায়ের উপর লুটায়ে পড়ল এবং মাটিতে মাথা ঘর্ষণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। অবশেষে আর কখনও বস্তি বাসীদের উৎপীড়ন না করার প্রতিশ্রুতি দিলে বাবা সাহেব তাকে ক্ষমা করে দিলেন। অতঃপর তারা সকলে বাবা সাহেবের হাতে তওবা করল। এইরূপে যোগীরা দমে গেল এবং অজুধন হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ এর বশীভূত হল। অতঃপর হযরত বাবা সাহেব অজুধনকেই তাঁর রূহানিয়াত প্রচারের কেন্দ্রস্থল করে নিলেন।
হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি আজমিরী রাঃ সর্বপ্রথম হিন্দুস্তানে চিশতিয়া তরিকা প্রচার করেন। তাঁরই চির বসন্ত পুষ্পোদ্যানের আতর ছড়ান সুগন্ধি বিস্তারকারী ফুল হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ চল্লিশ বছর কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমের পর যখন খেলাফতের গদীর কর্তব্য পালন করতে আসলেন, তখন তাঁর এতদিনের অপরিচিত জন সমাজের চরিত্র গঠনে রূপান্তরিত হয়ে গেল। আত্ম বিস্মৃতি তাবলীগের আকৃতি পরিগ্রহণ করল। অবিখ্যাত এবং অপ্রসিদ্ধ থাকা তিনি পছন্দ করলেন। কোন প্রকারেই তিনি ইজ্জত ও খ্যাতির, পার্থিব কোন পন্থার সাহায্যে কাজ করেননি। কোন বিজ্ঞাপন বা প্রচারপত্রও ছড়াননি। রাজা বাদশাহদের দরবার হতে সর্বদা দূরে থাকতেন। স্বীয় বংশগত মহব্বত এবং সোহবতের রীতিনীতির উপরই তিনি স্থায়ীভাবে নিজেদেরে সিলসিলার ভিত্তি স্থাপন করলেন এবং সর্বপ্রকার দলগত পার্থক্যের অবসান করে দিলেন। তাঁর কলবের উত্তাপ, দৃষ্টির বশীকরণ ক্ষমতা, কথার মিষ্টতা, চরিত্রের মাধুর্য, নেককারী ও পরহেজগারীর আলো এবং অকপট জিন্দেগীর পবিত্রতা মানব সমাজে এক বিরাট আলোড়ন তুলল। জনপ্রিয়তা স্বয়ং এসে তাঁর পদচুম্বন করল। তিনি আল্লাহ পাকের নিদর্শনসমূহের মধ্য হতে একটি দীপ্তিমান আলোক স্তম্ভ ছিলেন, যা হতে বহু দূরবর্তী স্থান পর্যন্ত আলো ছড়ায়ে পড়ল।
হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ অজুধনে ২৭ বছর মানুষের খেদমত এবং আল্লাহ তায়ালার ধর্ম প্রচার করলেন। অজুধনে দিল্লীর মত মানুষের গোপন ষড়যন্ত্র এবং মুনাফেকী ব্যবহার ছিল না। এখানকার লোকেরা নিজেদের স্বার্থপরতা এবং নফসের বশ্যতায় লিপ্ত থেকে নিজ নিজ খোদার উপাসনা করত। তাদের ভুল পথের পথিক বলা যেতে পারে, কিন্তু নিজ নিজ মতবাদে ও বিশ্বাসে তারা পরিপক্ক এবং সুদৃঢ় ছিল। ধর্ম ও মাজহাব নির্বিশেষে এখানকার লোকেরা প্রথমে সম্পূর্ণরূপে হযরত বাবা সাহেবের বিরোধিতা করেছে। পরে কিছু লোক তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ল, আর কিছু লোক নিঃসম্পর্ক থাকল। পূর্বে যেখানে যাদুকর, যোগী ও মোল্লাদের কর্তৃত্ব ছিল, প্রথমে মাপকাঠি বিশুদ্ধ ভাবে বুঝতে না পারার কারণে ভক্তেরাও তাঁর তালিম পূর্ণরূপে বুঝতে পারেনি। কিন্তু সোহবতের ফয়েজ যখন তাদের চক্ষু খুলে দিল তখন তার বুঝতে পারল যে, তারা এতদিন কেমন ভুলের বোকামীর মধ্যে ডুবে ছিল।
পক্ষান্তরে বাবা সাহেবের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে বিরোধীরা নিজেদের পদমর্যাদা রক্ষার জন্য আস্তিন গুটায়ে জোরে-শোরে বিরোধিতা আরম্ভ করল। সর্বপ্রথম যোগীরা বাবা সাহেবের সাথে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করল, অতঃপর যাদুকরেরা হাত পা বের করল এবং সর্বশেষে মুসলমান শাসক ও কাজীগণ নিজেদের বাহাদুরী প্রদর্শন করল। কিন্তু সকলেই নিতান্ত অপমানিত হয়ে হার মানল। হযরত বাবা সাহেবের মহান চরিত্রের সামনে কারও কোন বিরোধীতা ফলপ্রসু হল না।
একদিন কোন একজন যোগী পরীক্ষা করার জন্য হযরত বাবা সাহেবের দরবারে এসে যথারীতি দণ্ডবৎ (প্রণাম) করার জন্য জমিনের উপর মস্তক অবনত করল। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও মাথা উঠাতে পারল না। অবশেষে হযরত বাবা সাহেব তাকে হাত ধরে সোজা খাড়া করে দিলেন। ভয়ে তার শরীর কাঁপতেছিল। মুখ হতে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। বাবা সাহেব তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, তোমার কোন ভয় নেই। তুমি স্বাধীনভাবে নিজের ক্রিয়া কলাপ প্রদর্শন কর। সে যখন বুঝতে পারল যে, তার সমুদয় ক্ষমতাই লোপ পেয়েছে, তখন সে হযরত বাবা সাহেবের  বুযুর্গী স্বীকার করে তাঁর সাগরেদী লাভ করার জন্য প্রার্থনা জানাল। বাবা সাহেব তাকে কলেমা পড়ায়ে মুসলমান করলেন। সে চলে গেলে বাবা সাহেব উপস্থিত লোকদের বললেন, প্রতিযোগিতা করতে এসে সে জমিনে মস্তক রাখতেই আমার খেয়াল হল, সে যেন মাথা উঠাতে না পারে। আল্লাহর মেহেরবাণীতে তাই হয়েছে, অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাকে সত্য পথে আসার তৌফিক দান করেছেন।
এক যাদুকর হযরত বাবা সাহেবকে যাদু করল। যাদুর ক্রিয়ায় তিনি দিন দিন রুগ্ন ও দুর্বল হতে লাগলেন। খাদেমগণ অনুসন্ধান করে শেহাবুদ্দীন যাদুকরের কবর হতে একটি পুতুল বের করে আনলেন। তাতে বহু সংখ্যক সুচবিদ্ধ করা ছিল। একটি একটি করে সবগুলো সুচ খুলে ফেলা হলে হযরত বাবা সাহেব শক্তি বোধ করতে লাগলেন। অজুধনের শাসনকর্তা যাদুকরকে ধরে শাস্তি দেয়ার জন্য বাবা সাহেবের খেদমতে পাঠালেন, কিন্তু বাবা সাহেব তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ অতি উচ্চ পর্যায়ের এলমের অধিকারী ছিলেন। তৎকালে মাওলানা সৈয়্যেদ বদরুদ্দীন ইসহাকী জাহেরী এলমে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে খ্যাত ছিলেন। তিনি ফকির দরবেশদের অবহেলা করতেন। একদিন ঘটনাক্রমে হযরত বাবা সাহেবের দরবারে এসে তাঁর সাথে আলোচনাক্রমে তাঁর অগাধ এলমের সন্ধান পেয়ে তাঁর মুরিদ হয়ে গেলেন।
বাদশাহ বুলবনের কাছে চিঠি : একবার তিনি এক মজলুম মোল্লা সাহেবের জন্য সুপারিশ করে দিল্লীর বাদশাহ বুলবনকে লিখলেন, “আমি এই ব্যক্তির অভিযোগ আল্লাহর কাছে পেশ করলাম। অতঃপর তোমার কাছে পাঠালাম। তুমি তাকে কিছু দান করলে তা আল্লাহ তায়ালারই দান হবে এবং এই ব্যক্তি তোমার শোকরগুজার থাকবে। আর যদি তুমি তাকে কিছু দান না কর, তবে এই নিবারণ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতেই হবে এবং তোমাকে মাজুর অক্ষম মনে করা হবে।”
এই পত্রে তাঁর ভাষাজ্ঞানও প্রকাশ পেয়েছে এবং এও প্রকাশ পেয়েছে যে, তাঁর লক্ষ্য সর্বক্ষণ এবং সকল ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার দিকেই থাকত এবং দুনিয়ার লোকদের বিন্দুমাত্রও ভয় করতেন না।
একবার তিনি অসুস্থ অবস্থায় একটি লাঠিতে ভর করে চলতেছিলেন। হঠাৎ তিনি লাঠিটি হাত হতে ফেলে দিলেন। উপস্থিত লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমার মনে উদয় হল- এই লাঠিটির উপর ভর করার কারণেই আমি চলতে পারছি, এই কারণেই আমি তা ফেলে দিলাম। কেননা, মানুষের নির্ভর ও ভরসা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উপরই থাকা উচিত।
এক মোল্লা সাহেবের ঘটনা : হযরত সুলতানুল মাশায়েখ খাজা নিজামুদ্দিন রাঃ বলেন, অজুধনের কাছে এক গ্রামে এক মোল্লা সাহেব বাস করতেন। নিজের এলমের জন্য তিনি খুবই গর্বিত ছিলেন। ফকির দরবেশদের বড়ই ঘৃণা এবং অবহেলার চোখে দেখতেন। একদিন তিনি হযরত শায়খুল আলম বাবা সাহেবের দরবারে উপস্থিত হলেন। তখন দরবারে আরও কয়েকজন লোক উপস্থিত ছিলেন। মোল্লা সাহেব এসেই নিজের এলম ও সর্ববিষয়ে জ্ঞানের বাহাদুরী বর্ণনা আরম্ভ করলেন। হযরত শায়খুল আলম তার কাহিনী শুনতে শুনতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাওলানা ! ইসলামের রুকন কয়টি? তিনি উত্তর করলেন, পাঁচটি- ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাত। হযরত শায়খুল আলম বললেন, আমি তো ষষ্ঠ একটি রুকনের কথাও শুনেছি। মোল্লা সাহেব খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন, না, ষষ্ঠ রুকন বলতে কিছু নেই। আপনি কিছু শুনলে ভুল শুনেছেন। হযরত বাবা সাহেব বললেন, জী না আমি একজন নির্ভরযোগ্য আলেমের কাছে শুনেছি। ইসলামের ষষ্ঠ রুকন ‘রুটি’। তা শুনে মোল্লা সাহেব আরো রাগান্বিত হয়ে বললেন, আপনাদের সঙ্গে এই জন্যই আমার বিরোধ। আপনাদের এলম মোটেও নেই। কিংবা থাকলেও খুব অল্প। অযথা আলেম সাজার জন্য যে বিষয়ে কিছু জানেন না, সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে থাকেন। আমি ইসলামের যে পাঁচটি রুকনের কথা বলেছি, তা হাদিসের কিতাব সমূহে এবং ফেকাহের কিতাব সমূহে উল্লেখ আছে। আপনি যে ষষ্ঠ রুকনের কথা বলেছেন তা হাদিসের কিতাবেও নেই, ফেকাহের কিতাবেও নেই। হযরত বাবা সাহেব মৃদু হেসে বললেন, মাওলানা ! তা কুরআনেও আছে, হাদিসেও আছে, ফেকাহের কিতাবেও আছে। তা শুনে মোল্লাজী অন্তরে রাগান্বিত হয়ে দাঁড়ায়ে পড়লেন এবং বললেন, আল্লাহ পাক বলেছেন, “নসিহতের পরে জালেম কওমের কাছে বসো না।” অতএব আমি যাচ্ছি। শায়খুল আলম খুব বিনয়ের সাথে তাকে বসতে বললেন, কিন্তু মোল্লা সাহেব চলে গেলেন।
মোল্লা সাহেবের বিপদ : মোল্লা সাহেব বাবা সাহেবের মজলিশ হতে রাগান্বিত হয়ে চলে আসার কিছু দিন পর হজ্বের সফরে বের হলেন। মক্কা মোয়াজ্জমায় গিয়ে সাত বছর সেখানে অবস্থান করলেন। অতঃপর দেশে প্রতাবর্তনের মানসে হিন্দুস্তানগামী জাহাজে আরোহণ করে দেশের দিকে যাত্রা করলেন। চার দিন পর সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজখানি ধ্বংস হয়ে গেল। মোল্লা সাহেব ধ্বংস প্রাপ্ত জাহাজের এককানা তক্তা অবলম্বনে কোন প্রকারে ভাসতে ভাসতে কূলে এসে পৌঁছলেন। সেখানকার পাহাড়ী অঞ্চল শুষ্ক ও অনুর্বর। কোন গাছ-পালা বা তৃণলতার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মোল্লা সাহেব ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর অবস্থায় তিন দিন পর্যন্ত পাহাড়ের এক গুহায় বসে থাকলেন। এই সময় হঠাৎ সেখানে একজন লোক এসে উপস্থিত হল। তার মাথায় একটি খাঞ্চা ছিল, সে উচ্চৈঃস্বরে বলল, আমি রুটি বিক্রি করি। মোল্লা সাহেব বললেন, আমি একজন আলেম, আমি সাত বার হজ্জ করেছি, দেশে ফেরার পথে জাহাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমার পকেটে একটি পয়সাও নেই, আমি তিন দিন তিন রাত অনাহারী। আগন্তুক ব্যক্তি বলল, আমার কাছে খাদ্যদ্রব্য আছে, পানিও আছে। কিন্তু আমি দোকানদার, মূল্য ব্যতীত খাদ্য ও পানি দিতে পারি না। মোল্লা সাহেব বললেন, তুমি মুসলমান? সে বলল, হাঁ, আলহামদুলিল্লাহ। মোল্লা সাহেব তাকে মুসাফির, মেহমান ও বিপন্ন লোকদের সাহায্য করার ফজিলত ও সওয়াব সম্বন্ধে ওয়াজ শুনালেন এবং বুঝালেন, আমি ক্ষুধার্ত ও পিপাসাতুর। তুমি কিছু খাদ্য ও পানি দান করে আমার প্রাণ বাঁচাও। সে বলল, আপনি সব কিছুই ঠিক বলতেছেন কিন্তু আমি দোকানদার, এটাই আমার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। আমি মূল্য ব্যতীত আপনাকে খাদ্য এবং পানীয় কিছুই দিতে পারি না। এই বলেই সে চলে যেতে উদ্যত হল। মোল্লা সাহেব তাকে বললেন, তুমি কেমন মুসলমান? আমার অবস্থার প্রতি তোমার দয় হয় না? সে মুখ ফিরায়ে জবাব দিল, দয়া করতে গেলে আজই আমার দোকানদারী শেষ হয়ে যাবে। তবে হাঁ, আমি এই শর্তে দয়া করতে পারি যে, যদি তুমি তুখে বল, আমি আমার সাতটি হজ্জের সওয়াব তোমাকে দান করলাম। মোল্লা সাহেব চিন্তা করলেন, মুখে বলে ওেয়া এমন কিছুই তো নয়। এতে আমার সওয়াব যেতে পারে না। অতএব, মোল্লা সাহেব মুখে বলে ফেললেন, আমি রুি ও পানির বিনিময়ে আমার সাতটি হজ্বের সওযাব তোমাকে দান করলাম। এই কথা শুনেই লোকটি খাদ্য ও পানির খাঞ্চা তাঁর সামনে রেখে দিল। মোল্লা সাহেব পেট ভরে রুটি খেলেন এবং ঠাণ্ডা পানি পান করলেন।
অতঃপর মোল্লা সাহেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথায় থাক? এখানে কোন জনবসতিও আছে কি? সে বলল, আমি শুধু রুটি বিক্রি করি। এর বেশি আমি কিছু বলতে চাই না, বলেই সে খালিখাঞ্চা নিয়ে গুহা ত্যাগ করে চলে গল। মোল্লা সাহেবও তার পিছনে পিছনে এই উদ্দেশ্যে বের হলেন দেখবেন সে কোন দিক হতে এসেছে। কিন্তু একটু অগ্রসর হতেই লোকটি পাহাড়ের মোড়ের মধ্যে কোথাও অদৃশ হয়ে গেল। বহু তালাশ করেও কোন সন্ধান পেলেন না। অগত্যা মোল্লা সাহেব সমুদ্রের তীরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন, কোন জাহাজ বা নৌকা পাওয়া যায় কি না, এই অবস্থায়ও তিন দিন তিন রাত অতিবাহিত হয়ে গেল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তিনি আবার যার পর নাই কাতর হয়ে পড়লেন। এমন সময়ে সেই লোকটি খাদ্য পানীয়ের খাঞ্চা মাথায় করে পুনরায় এসে উপস্থিত হল। এবারে সে মোল্লা সাহেব হতে তাঁর সারা জীবনের রোজার সওয়াব প্রদানের স্বীকৃতি নিয়ে তাঁকে রুটি ও পানি দান করল এবং খালি খাঞ্চা নিয়ে চলে গেল। মোল্লা সাহেব এবারও লোকটির বাসস্থানের সন্ধান নেয়ার জন্য পিছনে পিছনে দৌড়ালেন। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার তিন দিন তিন রাত অতীত হওয়ার পর যখন মোল্লা সাহেব পুনরায় ক্ষুধা ও পিপাসায় মরণাপন্ন হয়ে পড়লেন, তখন সেই লোকটি খাদ্য ও পানীয়ের খাঞ্চা নিয়ে পুনরায় এসে উপস্থিত হল এবং মোল্লা সাহেব হতে তাঁর সার জীবনের জাকাতের সওয়াব নিয়ে তাঁকে রুটি ও পানি দিয়ে চলে গেল। অতৎপর তিন দিন তিন রাত পরে এসে মোল্লা সাহেবের সারা জীবনের নামাজের সওয়াব নিয়ে তাকে রুটি ও পানি দিয়ে চলে গেল। এবারে তিন দিন তিন রাত পরে যখন লোকটি রুটি ও পানি নিয়ে হাজির হল, তখন মোল্লা সাহেব বললেন, আমি তোমাকে সাত হজ্জের সওয়াব দান করেছি, সারা জীবনের রোজা, নামাজ এবং জাকাতের সওয়াব দান করেছি। এখন আমার কাছে আর কিছ্ইু অবশিষ্ট নেই। লোকটি বলল, আমি এই কাগজ ও দোয়াত কলম এনেছি, আপনি এতে লিখে দিন যে, আমি এক বেলার রুটি ও পানির বিনিময়ে আমার সাতটি হজ্ব বিক্রি করেছি। এক বেলার রুটি ও পানির বিনিময়ে আমার সারা জীবনের রোজার সওয়াব বিক্রি করেছি, পুনরায় এক বেলার রুটি ও পানির বিনিময়ে আমার সারা জীবনের নামাজের সওয়াব বিক্রি করেছি। আর আজ আমি এক বেলার রুটি ও পানির বিনিময়ে এই নিদর্শন লিখে দিতেছি। মোল্লা সাহেব অবিকল  সেই এবারত লিখে দিলন এবং তার নীচে নিজের নাম ঠিকানা লিখে কাগজখণ্ড তার হাতে দিলেন। তিনি আহার শেষ করে একান্ত বিনয়ের সাথে বললেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বল, তুমি কোথায় থাক। আমি তোমার সঙ্গে সেখানে যাব এবং মেহনত মুজুরি করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করব। এখন আমার কাছে তোমাকে দেয়ার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। লোকটি রাগান্বিত হয়ে বলল, আমি তোমাকে কিছুই দিতে বলতে পারি না। এই বলেই সে বাসনপত্র মাথায় এবং কাগজখণ্ড পকেটে নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। মোল্লা সাহেব এখন সবল। তিনিও তাকে অনুসরণ করে বস্তির পথ অনেবষণে ধাবিত হলেন। কিন্তু সে খুব দ্রুতবেগে দৌড়ায়ে চলল, মোল্লা সাহেবও পিছনে পিছনে দৌড়ালেন। কিছু দূর গিয়েই লোকটি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। মোল্লা সাহেব আনন্দিত হলেন। এবার আমি তাকে ধরে ফেলব। তিনি আরো দ্রুত বেগে দৌড়ালেন। কিন্তু একটু অগ্রসর হয়ে তিনিও হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন এবং তিনি উঠার পূর্বেই লোকটি নিজের ভাণ্ড বাসন কুড়ায়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। অবশেষে মোল্লা সাহেব অনোন্যপায় হয়ে পুনঃ সমুদ্রে পাড়ে এস পূর্ব অভ্যাস অনুযায়ী জাহাজের অপেক্ষায় বসে থাকলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন বহু দূরে একখানা জাহাজ যাচ্ছে। তিনি নিজের পাগড়ী নেড়ে চিৎকার করতে লাগলেন, আমায় সাহায্য কর, আমায় সাহায্য কর। জাহাজের নাবিক তা দেখে জাহাজ থামালেন এবং একখানি নৌকা পাঠালেন। মোল্লা সাহেব তাতে আরোহণ করে জাহাজে আসলেন। এই জাহাজ হাজীদের নিয়ে হিন্দুস্তানের দিকে যাচ্ছিল। হাজিরা মোল্লা সাহেবের খুব সম্মান ও খাতির করল। মোল্লা সাহেব খুব আরামের সাথে হিন্দুস্তানে গিয়ে নিজ ছেলেমেয়ের সাথে মিলিত হলেন।
অতঃপর একদিন শায়খুল আলম বাবা সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। মোল্লা সাহেব যখন বাবা সাহেবের দরবারে পৌঁছলেন, তখন বহু বড় বড় আলেম ফাজেল ও ফকীহগণ তাঁর খেদমতে করজোড়ে উপস্থিত ছিলেন। হযরত বাবা সাহেবের দৃষ্টি মোল্লা সাহেবের প্রতি পড়তেই তিনি তাঁর সম্মানের জন্য দাঁড়ায়ে গেলেন এবং হাসি মুখে তাঁকে বললেন, আসুন আসুন মোল্লা সাহেব বহুকাল পরে আপনার সাক্ষাৎ পেলাম। আমি তো সব সময়ই আপনাকে স্মরণ করে থাকি। বলুন তো, এতদিন পর্যন্ত আমর এখানে আসেননি কেন?
মোল্লা সাহেবর নিজের শুষ্ক অভ্যাস অনুযায়ী হযরত বাবা সাহেবের সাথে মুসাফাহা করলেন এবং খুব অহংকার ঔদ্ধতের সাথে বাবা সাহেবের কাছে এরূপভাবে বসে পড়লেন, যেন তিনি বাবা সাহেবের সমমর্যাদার লোক কিংবা বাবা সাহেবের চেয়েও তার মর্যাদা বড়। উপস্থিত সকলেই তার এরূপ ব্যবহার খুবই নাপছন্দ করলেন। কিন্তু হযরত বাবা সাহেবের ভয়ে সকলেই নীরব থাকলেন। কেহই তার মেহমানকে আদব রক্ষা করে চলার জন্য কিছুই বলতে সাহস করলেন না।
অবশেষে হযরত বাবা সাহেব মোল্লা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, হাঁ মোল্লা সাহেব ! আপনি তো বললেন না যে, এতকাল যাবৎ আমার এখানে কেন আসেননি? মোল্লা সাহেব খুব অহংকার ও গর্বের সাথে উত্তর দিলেন, জনাব ! আমি দেশে ছিলাম না। হজ্জ করতে গিয়েছিলাম। সাত বছর মক্কা শরীফে অবস্থান করে সাতবার হজ্জ করেছি। সাতবার মদিনা শরীফ গিয়ে হুজুর সাঃ এর রওজা শরীফ জেয়ারত করেছি। উভয় হরম শরীফে নামাজ ও রোজার যে প্রচুর সওয়াব পাওয়া যায় তা আমি লাভ করেছি। এখন আমি সাত বছর পরে সেখান থেকে ফিরে এসেছি। পথে জাহাজ ধ্বংস হওয়ায় বহু কষ্টও ভোগ করেছি। কিন্তু আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীতে পথের সমস্ত কষ্টের ও বিপদের অবসান হয়েছে এবং আমি সম্পূর্ণ নিরাপদে ও শান্তিতে বাড়ি পৌঁছেছি, সকল পরিবার পরিজনকে সুখ শান্তিতে দেখতে পেয়ে আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করেছি।
হযরত বাবা সাহেব মোল্লাজীর কথা শুনে বললেন, আপনি বড়ই ভাগ্যবান লোক ! সাত হজ্জ করেছেন, সাত বার মদিনা শরীফ জেয়ারত করেছেন, সাত বছর পর্যন্ত উভয় হরম শরীফে নামাজ পড়েছেন ও রোজা রেখেছেন। সোবহানাল্লাহ ! বড়ই সৌভাগ্য আপনি লাভ করেছেন। বলুন তো এখন তো আর আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং রাগান্বিত নন? মোল্লা সাহেব বললেন, আমি আপনার প্রতি অসন্তুষ্টই কখন ছিলাম? হযরত বাবা সাহেব বললেন, সাত বছর পূর্বে আপনি আমার এখান থেকে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে গিয়েছেন। আমি সেই অসন্তোষের কথাই বলছি। মোল্লা সাহেব বললেন, কি ঘটনা ঘটেছিল তা আমার স্মরণ নেই। স্মরণ করায়ে দিলে হয়ত স্মরণ হতে পারে।
হযরত বাবা সাহেব বললেন, আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইসলামের রুকন কয়টি? আপনি উত্তর দিয়েছিলেন, ইসলামের রুকন পাঁচটি, ঈমান, নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ্ব। তদুত্তরে আমি বলেছিলাম, ইসলামের আরও একটি রুকন আছে- রুটি। তাতে আপনি খুব রাগান্বিত হয়ে এখান থেকে চলে যান এবং যাওয়ার সময় কুরআন শরীফের একটি আয়াতও পাঠ করেছিলেন যে, “নসিহত করার পর যালেমদের কাছে আর বসো না।” আপনি যেন আয়াতের সাহায্যে আমাকে যালেম সাব্যস্ত করেছিলেন। এজন্য আমার মনে খুবই কষ্ট হয়েছিল এবং তদবধি প্রত্যহ আমি আপনাকে স্মরণ করতাম।
মোল্লা সাহেবের বায়াত গ্রহণ : তা শুনে মাওলানা সাহেব হেসে উঠে বললেন, হাঁ হাঁ, আমার স্মরণ হয়েছে। তা ঠিকই কথা, আজও আমি তাই বলছি যে, অকির দরবেশগণ এলমের ভাবে কিংবা স্বল্প এলম বশত এমন সব কথা বলে ফেলেন যা শরিয়াতে সম্পূর্ণ বিরোধী। ইসলামের রুকন তো পাঁচটিই বটে, ষষ্ঠ আর একটি রুকন তে কিছুই নেই। হযরত বাবা সাহেব বললেন, মাওলানা ! আমি বে-এলম বা আমার এলম অল্প। কিন্তু তা লিখিত দেখতে পাচ্ছি যে, ইসলামের ষষ্ঠ রুকন রুটি। মাওলানা রাগান্বিত হয়ে বললেন, যদি কোথাও লিখিত দেখে থাকেন, তবে আমাকে দেখান। হযরত বাবা সাহেব তৎক্ষণাৎ খাদেমকে আদেশ করলেন, আমার অমুক কিতাবটি নিয়ে আস। হযরত বাবা সাহেব উপস্থিত অন্যান্য লোকদের বললেন, তোমরা সকলে আমার কাছ হতে দূরে সরে যাও। সকলে দূরে সরে গেলে তিনি মাওলানাকে আরও নিকটে আসতে বললেন এবং কিতাবের পাতা  উল্টাতে লাগলেন। মাওলানাও দেখতে লাগলেন, কিন্তু কিতাবে কোন অক্ষরই দেখতে পেলেন না। সবই সাদা দেখতে পেয়ে বলতে চাইলেন যে, এর পাতাগুলো তো সাদা কোন অক্ষরই নেই। ঠিক এই সময় হঠাৎ মাওলানা তাঁর নিজের হাতের লেখা সেই কাগজখানা দেখতে পেলেন যা তিনি সেই ব্যক্তিকে লিখে দিয়েছিলেন, যে ব্যক্তি তাকে পাহাড়ের গুহায় তিন দিন পর পর রুটি এনে খাওয়াতেন। নিজের হাতে লেখা সেই এবারত পড়ামাত্র মাওলানা সাহেব চিৎকার করে উঠে বাবা সাহেবের পায়ের উপর লুটায়ে পড়লেন এবং তওবা করে তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করলেন। সেদিন হতেই মাওলানা সাহেব সম্পূর্ণরূপে নিরবতা অবলম্বন করলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত কারও সঙ্গে কথা বললেন না। অধিকাংশ সময়ই রোদন করতেন।
আরও একটি ঘটনা : একব্যক্তি হযরত শায়খুল আলমের দরবারে এসে নিজের বিপদের কথা জানাল যে, ডাকাতেরা তার স্ত্রীকে ছিনায়ে নিয়ে গেছে। তদবধি সে খানাপিনা ত্যাগ করেছে। হযরত তাকে বললেন, আমি দোয়া করি, তুমি তোমার স্ত্রীকে পেয়ে যাবে। তুমি অনাহারে থেকো না, রীতিমত খানাপিনা কর। সে খানা খাইল এবং কিছু দিন হযরত বাবা সাহেবের খেদমতে অবস্থান করল। ইতিমধ্যে হাতে বেড়িপরা এক ব্যক্তি সিপাহী পরিবেষ্টিত অবস্থায় হযরত বাবা সাহেবের দরবারে এসে পৌঁছল এবং বলল, আমাকে দিল্লীর বাদশাহের দরবারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানি না আমার কি দশা হবে। আমার জন্য একটু দোয়া করুন। আমি এই সিপাইদের বহু অনুরোধ ও কাকুতি মিনতি করে এখানে আসার জন্য রাজি করিয়েছি। হযরত বাবা সাহেব বললেন, আমি তোমার জন্য দোয়া করব, তুমি আমার এই মেহমানকে সঙ্গে নিয়ে যাও। দিল্লী গিয়ে তুমি রাজ দরবার হতে মুক্তি লাভ করলে আমার এই মেহমানকে একটি বাদী খরিদ করে দিও। সে বলল, বহুত আচ্ছা হযরত ! আমি আপনার এই আদেশ অবশ্যই পালন করব। সে ব্যক্তি হযরতের সেই মেহমানকে সঙ্গে নিয়ে গেল। দিল্লীতে বাদশাহের সামনে তাকে পেশ করা হলে বাদশাহ তাকে বেকসূর খালাশ করে দিল। অতঃপর সে বাজারে গিয়ে একটি সুন্দরী বাদী খরিদ করল এবং ওয়াদা অনুযায়ী হযরত বাবা সাহেবের মেহমানকে দিল। মেহমান বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখল যে, সেই বাদীই তার স্ত্রী।
আরও একটি ঘটনা : হযরত বাবা সাহেব যে সময়ে দেশ ভ্রমনে বের হয়েছিলেন সে সময় একদিন তিনি একটি গাধার পিঠে আরোহণ করে কোন এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। নিকটেই কুমারের একটি ঘর দেখতে পেয়ে হযরত বাবা সাহেব সেখানে গেলেন এবং কুমারের কাছে তার ঘরে ঢুকবার অনুমতি চাইলেন। সে বলল, এখানে একটি স্ত্রীলোকের প্রসব-বেদনা আরম্ভ হয়েছে। কয়েকদিন যাবৎ বেদনায় ভুগছে কিন্তু সন্তান ভূমিষ্ঠ হচ্ছে না। এমতাবস্থায় তোমাকে কোথায় স্থান দিব। হযরত বললেন, আমাকে স্থান দাও এখনই স্ত্রীলোকের সন্তান ভূমিষ্ঠ হযে যাবে। কুমার তাঁকে ঘরে ঢুকবার অনুমতি দিল। তিনি বললেন, আমার গাধাটিকেও ঢুকবার অনুমতি দাও। কুমার বলল, এখানে মানুষ থাকারই স্থান নেই। গাধার স্থান কোথায় দিব? তিনি বললেন, আমার গাধার স্থান না হলে আমিও প্রবেশ করব না। অগত্যা কুমার তাঁর গাঘাটিকেও ভিতরে আনার অনুমতি দিল। হযরত ঘরে ঢুকেই কুমারের চুল্লীর কাছ থেকে এক খণ্ড খাপরা নিয়ে কয়লা দ্বারা তাতে একটি শে’এর লিখলেন, যার অর্থ- আমারও স্থান হয়েছে আমার গাধার স্থান হয়েছে। তুমি এখন ইচ্ছা হয় সন্তান প্রসব কর, ইচ্ছা না হয় প্রসব করিও না।

অতঃপর তিনি খাপরাট কুমারে হাতে দিয়ে বললেন, এটা প্রসূতীর পেটের উপর রেখে দাও। সে তা তার পেটের উপর রাখতেই তৎক্ষণাৎ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে গেল। অথচ এই শে’এরটিতে আল্লাহ বা রাসূলের নামও ছিল না। তা কোন বরকতময় ইবারতও ছিল ন, বরং একটি হাসি কৌতুকের শে’এর কিন্তু তখন হতে আজ পর্যন্ত খাপরার উপর লিখিত এ তাবিজটি পরীক্ষা করে বিস্ময়কর ফল পাওয়া গেছে।
একদিন এক খাস মুরিদ মুহাম্মদ শাহ ঘোরী একান্ত অস্থির অবস্থায় হযরতের খেদমতে এসে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করল। আমার ভাই মুমূর্ষ অবস্থায়, তার জন্য একটু দোয়া করুন। হয়ত সে এখন মরে গিয়েছে। হযরত তাকে কাছে বসায়ে সান্তনা দিতে লাগলেন, তুমি এখন যেরূপ অস্থির হয়েছ এরূপ সর্বক্ষণ আমারও হয়। এতে পেরেশান হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ তায়ালার মর্জির উপর সবর করা কর্তব্য। আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া কুফুরী। দুঃখের পরেই শান্তি আসে। আল্লাহর রহমতের প্রতি বিশ্বাস রাখলে সমস্ত বিপদই সহজ হয়ে যায় এবং আল্লাহ পাক দয়া করেন। তুমি এখন বাড়ি যাও, তোমার ভাইকে গিয়ে দেখাশুনা কর। তার এই পীড়া মৃত্যুপীড়া নয়।
একবার তিনি অভ্যাস অনুযায়ী মুরাকাবায় বসে জিকির করতে করতে বেহুশ হয়ে পড়লেন। অতঃপর জ্ঞান ফিরে আসলে তিনি আবদুল্লাহ মোহাম্মদ খালজীকে বললেন, এইমাত্র ভাই বাহাউদ্দিন জাকারিয়ার ইন্তেকাল হয়ে গেল। পরে অনুসন্ধানেও তা সত্য বলে জানা গিয়াছে। এই দিনটি মুহাররম মাসের প্রথম তারিখ ছিল।
মুরিদগণের তালিম ও তারবিয়াত : মুরিদ ও পীরের মধ্যে পরস্পর যে চুক্তি হয়ে তাকে বায়াত বলে। মুরিদ ওয়াদা করে পীরের হেদায়ত অনুযায়ী আমল করবে আর পীর মুরিদকে সরল পথ প্রদর্শন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পীরের হেদায়েত দৃঢ়ভাবে মেনে চলার মত যোগ্যতা মুরিদের মধ্যে থাকা আবশ্যক। হযরত শায়খে কাবীর (বাবা সাহেব) বায়াত করার পর সর্বপ্রথম মুরিদের বিবেক, আত্মম্ভরিতা, গর্ব, নিজকে ভাল মনে করা ইত্যাদি বিষয়গুলোর সমূলে উৎপাটন করে দিতেন এবং তার এলম ও জ্ঞানকে তরিকতের পথে চলার বিঘ্ন হতে দিতেন না। জাহেরী এলমের ও অনর্থক আলোচনা ও সমালোচনায় মুরিদকে লিপ্ত হতে দিতেন না। তবে যাদের নিজের বিশেষ কাজের জন্য মনোনীত করতেন, অর্থাৎ, খেলফত প্রদানের যোগ্য মনে করতেন, তাদেরকে বিশেষ নিয়মে গড়ে তুলতেন। যেমন জমাল হাঁসবী, মুনতাজাবুদ্দীন মুতাওয়াক্কেল আলী, আহমদ সাবের, ইউসুফ, হামীদুদ্দীন নাগূরী, বদরুদ্দীন এসহাক প্রমুখ রাহেমাহুমুল্লাহর প্রতি তাঁদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন উপায়ে খাস তাওয়াজ্জুহ প্রদান করেছিলেন।
একবার এক সহপাঠী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নিজের এলমের দ্বারা কি ফায়দা লাভ করেছো? তিনি উত্তর দিলেন, আমলের জন্যই এলম হাসিল করা, পড়ে তদনুযায়ী আমল করা এতটুকুই যথেষ্ট।
হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ হযরত সুলতানুল আউলিয়া মাওলানা নিজামুদ্দিন রাঃ কে সমস্ত এনআম এবং খেলাফত দান করে বললেন, তোমাকে আল্লাহ তায়ালার হাতে সোপর্ধ করে দিলাম। আমিও আমার পীর হযরত কুতবুল আকতাবের ইন্তেকালের সময় উপস্থিত ছিলাম না। তুমিও আমার অন্তিম মুহূর্তে আমার কাছে থাকবে না। অতঃপর তিনি মাওলানা বদরুদ্দীন ইসহাক দ্বারা খেলাফতনামা লিখায়ে দিলেন এবং বললেন, শেখ জামালুদ্দিন হাঁসবীর দ্বারা সীল মারায়ে নিও। আর দিল্লীতে শেখ মুনতাজাবুদ্দীন রাঃ কে দেখায়ে নিও। অতঃপর সুলতানজীর মাথা নিজের কোলে টেনে নিলেন এবং নিজের মুখের লালা তাঁর মুখে দিয়ে বললেন, আল্লাহর কালাম হেফজ করে নিও। দ্বীন এবং দুনিয়া উভয়ই তোমাকে দান করা হয়েছে। যাও হিন্দুস্তানের কর্তৃত্ব গ্রহণ কর। তা বলে তাঁকে বিদায় করে দিলেন।
ইন্তেকাল : সারা জীবনের রিয়াজত ও মুজাহাদার ফলে রূহ যখন চরম পূর্ণতা লাভ করল, তখন ৬৬৬ হিজরির ৫ই মহররম হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ কে তাঁর রূহের রূহ আল্লাহ তায়ালা নিজের কাছে উঠায়ে নিলেন। তিনি অন্তিম মুহূর্তে এই বয়েতটি পাঠ করেছিলেন,
দর কোয়ে তু আশেকাঁ চুনাঁ জাঁ বদেহান্দ !
কাঁজা মালাকুল মাওত নাগুনজাদ হারগেয !!
অর্থাৎ, আপনার গলিতে আপনার প্রেমিকগণ এমনভাবে প্রাণ দান করে থাকেন যে, সেখানে মালাকুল মাওত কখনও স্থান পায় না।
যে রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন তার পূর্ববর্তী দিন তিনি পাঁচ বার কুরআন শরীফ খতম করেন। তারপর মোরাকাবা ও জিকিরে মশগুল হন। সন্ধ্যাকালে উপস্থিত সকল লোককে বললেন, আমাকে একাকী থাকতে দাও। আমি ডাকলে আবার এসো। এশার নামাজ শেষ করতেই পয়গাম এসে পড়ল। পয়গাম শ্রবণ করা মাত্র অজ্ঞান হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংগা প্রাপ্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি নামাজ পড়েছি? লোকেরা বলল জি হাঁ, নামাজ পড়েছেন। তিনি বললেন, ক্ষতি কি? আর একবার পড়ে নেই। এই বলে তিনি পুনরায় নামাজ পড়লেন এবং পরক্ষণেই পুনঃ সংগাহীন হয়ে পড়লেন। এইরূপ তিনবার করলেন। নামাজের ও সেজদার অভ্যাস তাঁর খুব বেশি ছিল। মৃত্যু কালেও সেই অভ্যাসে শিথিলতা আসেনি। অবশেষে শেষ সেজদার মধ্যে তিনি উচ্চস্বরে “ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু” বলে আল্লাহ পাকের সন্নিধানে চলে গেলেন।
স্বভাব ও আচরণ : হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ কখনও সুনাম ও সুখ্যাতির প্রত্যাশী ছিলেন না। কিন্তু সুখ্যাতি তাঁর কার্য-কলাপের উপর আসক্ত ছিল, তাঁর মধ্যে বাহ্যিক আড়ম্বর ও কৃত্রিমতার নামগন্ধও ছিল না। খোদায়ী আখলাক নিজের মধ্যে ফুটায়ে তোলার কারণে তাঁর অকৃত্রিম মহব্বতের সামনে সারা দুনিয়া করজোড়ে দণ্ডায়মান থাকত। তাঁর দানশীলত শত্র“-মিত্র সকলেরই সমান উপকার সাধন করত। গায়েবী ধনরত্মে তাঁর ভাণ্ডার সর্বদা পরিপূর্ণ থাকত। এতদ্ভিন্ন হাদিয়া তোহফাও তাঁর কাছে প্রচুর পরিমাণে আসত। কিন্তু কোন টাকা-পয়সা কখনও ভাণ্ডারে সঞ্চিত হতে দিতেন ন। বরং তৎক্ষণাৎ বিতরণ করে দিতেন।
তাঁর দেহ ছিল নিতন্ত কৃশ এবং মাংসবিহীন। পুরাতন ও ছেঁড়া অথচ খুব পরিষ্কার কাপড়ই ছিল তাঁর নিত্য পরিধেয়। পবিত্রতা তাঁর এত প্রিয় ছিল যে, দিনে রাতে বহুবার গোসল করতেন, সন্দেহ দূর না হওয়া পর্যন্ত বার বার কাপড় ধুতেন।
একবার কোন একজন মুরিদ তাঁকে একটি নতুন জামা দান করলে তিনি তার মন রক্ষার্থে একবার পরিধান করলেন বটে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ খুলে তা নজীবুদ্দীন মুতাওয়াক্কেল রাঃ কে দিয়ে বললেন, ছেঁড়া ও পুরাতন এবং গ্রন্থীযুক্ত কাপড়েই আমি শান্তি পাই। তাঁর একটি মাত্র গুদড়ী ছিল। দিনে তার উপর বসতেন এবং রাতে তা মুড়ি দিয়ে শয়ন করতেন। তাও এত খাট ছিল যে, মাথার দিকে টানলে পা খালি হয় যেত। তাই পায়ের উপর অন্য একখানি টুকরা ফেলে নিতেন। আর মোর্শেদের নিকট থেকে প্রাপ্ত লাঠিটি বালিশের কাজ দিত,খাওয়াও খুব সংক্ষেপ ছিল। অধিকাংশ সময়ই লবণহীন খাদ্য খেতেন। একবার খাদেম মাহবুবে এলাহী রাঃ মুদি হতে কিছু লবণ এনে তাঁর খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে দিয়েছিলেন। তিনি মুখে দিয়েই বললেন, তা সন্দেহজনক, ফকির মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করে দাও। অতঃপর হযরত মাহবুবে এলাহী নিজের ভুল স্বীকার করলে হযরত শেখ বললেন, ধার নিয়ে খাওয়ার চেয়ে ফকিরের পক্ষে মরে যাওয়াই শ্রেয়।
অধিকাংশ সময়েই তিনি রোজা রাখতেন, প্রতি তৃতীয় দিবসে একটু শরবত দ্বারা ইফতার করতেন। সময় সময় শরবতের সাথে কিছু ছাতু মিশান হত। এক গ্লাস শরবত প্রস্তুত করলে তার অধিকাংশ কিংবা এক তৃতীয়াংশ উপস্থিত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে বাকী অংশটুকু েিজ পান করতেন। এশার নামাজের পর ঘিয়ে ভাজা দুইটি রুটি বের করা হত, তাও শরবতের মত বণ্টন করে অবশিষ্টাংশ নিজে খেতেন। এইরূপে প্রত্যেক তৃতীয় দিবসে এক পোয়া দেড় পোয়া রুটি পেটে পৌঁছত। প্রতিদিন এশার নামাজের পর উপাদেয় নানা প্রকারের খাদ্যের খাঞ্চা এনে উপস্থিত মুরিদান ও মুসাফিরদে সামনে রাখা হত। তিনি আনন্দের সাথে সকলকে পরিবেশন করে খাওয়াতেন। কিন্তু নিজে কিছুই খেতেন না। আঙ্গুর তাঁর কাছে খুবই লোভনীয় ফল ছিল, তাই কখনও কখনও আঙ্গুর খেতেন।
শেষ বয়সে রোগের কারণে মাঝে মাঝে রোজা কাযা করতে হত। একদিন রমজান মাসে হযরত সুলতানুল আউলিয়া রাঃ বাবা সাহেবের রোগ শয্যার পার্শ্বে গিয়ে বসলে তিনি তাঁকে এক ফালি খোরবুযা দিলেন। সুলতানজী মনে করলেন, হযরতের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার এই সৌভাগ্য আর কখনও জীবনে নাও হতে পারে। এখনই এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। পরে উপর্যুপরি দুইমাস কাফফারার রোজা রাখব। এই ভেবে আমি খোরবুযা মুখে দিতে উদ্যত হলে তৎক্ষণাৎ হযরত শেখ আমাকে বারণ করলেন এবং বললেন, আমার জন্য শরিয়তের পক্ষ হতে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু তোমার জন্য অনুমতি কোথায়?
একবার সাতজন দরবেশ হযরত বাবা সাহেবের খানকায় মুসাফিররূপে আগমন করলেন। তারা প্রত্যেকে নিজেদের খাদ্য মনে মনে স্থির করে নিলেন এবং বললেন, পরীক্ষা করে দেখা যাক আমাদের সামনে আমাদের পছন্দনীয় ও স্থির খাদ্য আসে কি না। যথাসময়ে খাদ্যদ্রব্য এনে উপস্থিত কর হলে তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন যে, প্রত্যেকের সামনেই স্বীয় পছন্দনীয় খাদ্য এনে রাখা হয়েছে। তাতে তাঁরা সকলেই হযরত বাবা সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়লেন।
একবার শেখ জিয়াউদ্দীন নামক এক আলেম হযরত বাবা সাহেবের খেদমতে উপস্থিত হলেন। তিনি এই ভেবে মনে মনে খুব অস্থির হয়ে পড়লেন যে, হযরত শেখ যদি আমার এলম ও জ্ঞানের বাইরে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন, তবে তো আমি খুব লজ্জিত হব। হযরত বাবা সাহেব তাঁর সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁকে সবগুলো প্রশ্নই তাঁর জ্ঞানানুরূপ করলেন। মৌলভী সাহেব বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলেন, শেখ আমার মনের কথা কেমন করে জানতে পারলেন।
হযরত সূফী হামীদুদ্দীন নাগূরী রাঃ এর পৌত্র শেখ শরফুদ্দীন হযরত বাবা সাহেবের কাছে বায়াত হওয়ার জন্য অজুধনে আসলেন। তিনি আসার সময় তাঁর এক কৃতদাসী শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ নিজের হাতে কাটা সূতার প্রস্তুত একখানা পাগড়ীর কাপড় বাবা সাহেবের জন্য পাঠায়ে দিলেন। হযরত বাবা সাহেব তা পেয়ে বাঁদীর মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করলেন। বায়াত গ্রহণের পর শেখ যখন দোয়া করেছেন, তখন বাঁদী আজাদ হবেই। অতএব, পূর্বেই তাকে বিক্রি করে আমার মূলধন উঠায়ে নেয়া উচিত। পরক্ষণেই খেয়াল হল, তাহলে তো আজাদ করার সওয়াব খরিদ্দার পাবে। সুতরাং মূলধন এবং সওয়াব লাভ করার দোটানা চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। অবশেষে নিজেই আজাদ করে দিয়ে সওয়াব হাসিল করার সিদ্ধান্তেই পৌঁছলেন। পরবর্তী দিন হযরত শেখের খেদমতে এসে ঘোষণা করলেন যে, আমি বাঁদীটিকে আজাদ করে দিলাম।
শাসকবৃন্দ এবং কাজী সর্বদা হযরত বাবা সাহেবের প্রতি হিংসা ও শত্র“তা পোষণ করত। একদিন হযরত বাবা সাহেব খানকাহ শরীফের মধ্যে সেজদায় গিয়ে জিকিরে এলাহীতে মশগুল ছিলেন। হযরত সুলতানজী রাঃও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি এসে সর্কশ স্বরে হযরত বাবা সাহেবকে সালাম করল। হযরত শেখ সেজদা হতে মাথা না উঠায়েই সুলতানজীকে জিজ্ঞাসা করলেন, দেখ তো এই আগন্তুক লোকটি হলদে রং এর একজন তুর্কী কি না? তিনি উত্তর করলেন, জী হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তার কোমরে শিকল আছে কি না? তিনি উত্তর করলেন, জী হাঁ, আছে। এই প্রশ্নোত্তর শুনে তুর্কী লোকরি চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। হযরত বাবা সাহেব বললেন, তাকে চলে যেতে বল, অন্যথায় আরও অধিক অপমানিত হবে। সে তৎক্ষণাৎ প্রাণ নিয়ে পলায়ন করল। সম্ভবতঃ তার কাছে ছোরাও লুকায়িত ছিল, হয়তো কোন কাজী বা শাসকের গোপন ইঙ্গিতে এখানে অসদুদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল।
কোন একজন রঈস লোক হযরত বাবা সাহেবের জন্য তাঁর আরেফ নামক এক মুরিদের হাতে একশত স্বর্ণমুদ্রা হাদিয়া পাঠালেন, উক্ত মুরিদ হযরত শেখের কাছে এসে পঞ্চাশটি মুদ্রা পেশ করল। হযরত শেখ মৃদু হেসে বললেন, বেশ তো ভ্রাতৃত্বের অংশ বণ্টন করে নিয়েছ। মুরিদ লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইল এবং বাকী পঞ্চাশটি মুদ্রাও পেশ করল। হযরত শেখ তাকে নিজের সোহবতে রেখে দিলেন, পরে সে হযরতের নামকরা খলিফাদের অন্যতম খলিফা হয়েছিলেন।
সূফী মাওলানা বোরহানুদ্দীন রাঃ শৈশবেই পিতৃহারা হয়ে পড়েন। তাঁর পিতা হযরত জামাল হাঁসবী রাঃ হযরত বাবা সাহেবের অন্যতম প্রধান খলিফা ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মাওলানা বোরহানুদ্দীনের মাতা শিশুপুত্রকে নিয়ে হযরত বাবা সাহেবের দরবারে পৌঁছলেন। হযরত গঞ্জেশকর রাঃ তাঁকে নিজের দায়িত্বে গ্রহণ করলেন এবং শৈশবেই তাঁকে মুরিদ করে নিলেন। মাওলানা বোরহানুদ্দীন এর মাতা বললেন, হযরত ! বোরহানুদ্দীন তো এখনও শিশু। তার উত্তরে হযরত শেখ বললেন, নতুন চাঁদ ছোটই হয়ে থাকে।
বাবা সাহেবের আওলাদ : হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ এর পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা ছিল। পুত্রগণের নাম যথাক্রমে- শেখ নাসিরুদ্দীন নাসরুল্লাহ, শেখ বদরুদ্দীন সুলাইমান, শেখ শেহাবুদ্দীন, খাজা নিজামুদ্দিন ও শেখ ইয়াকুব। কন্যাদের নাম- বিবি মাস্তুরা, বিবি শরীফা ও বিবি ফাতেমা।
প্রধান খলিফাগণ : হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ এর প্রধান খলিফাগণ হলেন- সুলতানুল আউলিয়া হযরত শেখ নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ, শেখ জামালুদ্দীন হাঁসবী রাঃ, শেখ আলী আহমদ সাবের কালীয়ারী রাঃ, শেখ বদরুদ্দীন এসহাক রাঃ ও শেখ আরেফ রাঃ। শেখ জামালুদ্দীন হাঁসবী রাঃ হযরত বাবা সাহেবের খুব প্রিয় ছিলেন। বাবা সাহেব কয়েক বছর হাঁসীতে তাঁর কাছে অবস্থান করেন। হযরত বাবা সাহেব যাকেই খেলাফত প্রদান করতেন, তাকেই বলে দিতেন যে, এই খেলাফতনামায় জামালুদ্দীন হাঁসবীর কাছ থেকে সীল মারায়ে নিও। হযরত জামালুদ্দীন হাঁসবী রাঃ বাবা সাহেবের জীবন কালেই ইন্তেকাল করেন।
শেখ নিজামুদ্দীন সুলতানুল আউলিয়া সাঃ বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ছিলেন। তাঁর দ্বারা চিশতিয়া সিলসিলা চরম উজ্জ্বল ও উন্নত হয়েছিল।
বাবা সাহেবের তিনটি সিলসিলা : হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ হতে চিশতিয়া সিলসিলার তিনটি শাখা বহির্গত হয়। যথা- নিজামিয়্যাহ, সাবেরিয়্যাহ ও জামালিয়্যাহ। জামালিয়্যাহ সিলসিলা পরিশেষে নিজামিয়্যাহ সিলসিলার মধ্যে মিশে গেছে। কেননা, জামালুদ্দীন হাঁসবীর খলিফা এবং তাঁর পৌত্র মাওলানা কুতবুদ্দীন মুনাওয়্যার হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া হতে খেলাফত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আর সাবেরিয়্যাহ খানদান হযরত খাজা মাখদুম আলাউদ্দীন আলী সাবের কালীয়ারী রাঃ হতে জারি হয়েছে। তিনি হযরত বাবা সাহেবের ভাগিনা ছিলেন। কালিয়ার শরীফেই তাঁর মাজার অবস্থিত। তা সাহারানপুর জেলার একটি অঞ্চল।
ইন্তেকাল : হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ ইন্তেকালের সময় হযরত বাবা সাহেব অসিয়ত করলেন, আমার খেরকা, লাঠি, খড়ম ও অন্যান্য তাবাররুকগুলো নিজামুদ্দীন আউলিয়া পাবে। আমার মাজারও সেই নির্মাণ করবে। অতএব, বাবা সাহেবের ইন্তেকালের পর তাঁর লাশ আমানতস্বরূপ দাফন করা হল। অতঃপর হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ অজুধনে আসলে হযরত বাবা সাহেবের অসিয়তকৃত বস্তুগুলো তাঁকে দেয়া হল, তিনি হযরত বাবা সাহেবের লাশ পুনরায় (বর্তমানে যেখানে মাজার অবস্থিত, সেখানে এনে) দাফন করলেন এবং মাজারের উপরে একটি ছোট কোব্বা নির্মাণ করালেন ও মাজারের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দুটি দরজা রাখলেন।
বেহেশতী দরজা : হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ মাজার শরীফের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার পর একদিন মাজারের দক্ষিণ দিকের দরজায় তিনি দণ্ডায়মান ছিলেন, এমন সময় তিনি ভাবাবেগে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, হযরত নবী করিম সাঃ তশরীফ এনে বলেছেন, এই দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে সে বেহেশতী হবে। এই ঘটনার পর হতে জেয়ারতকারীদের জন্য শুধু পূর্ব দিকের দরজাটি খোলা রাখা হয়। দক্ষিন দিকের দরজা- যাকে বেহেশতি দরজা নাম দেয়া হয়েছে তা কেবল ওরোছ শরীফের সময়ে ৫ই মহররম খুলে দেয়া হয়। বছরের অন্যান্য সময়ে তা বন্ধ থাকে।
অমিয়বাণী :
হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ বলেছেন,
নিজের জাহেরী অবস্থা সম্বন্ধে যত জ্ঞান রাখ, বাতেনী অবস্থা সম্বন্ধে তার চেয়ে অধিক জ্ঞান লাভের চেষ্টা কর।
শত্রুকে সৎপরামর্শ দান করে সৎপথে চালিত করে শত্রুতার প্রতিশোধ নেও। আর মিত্রকে বিনয় ও নম্র ব্যবহার দ্বারা বশ করে নেও।
মানুষের পক্ষে নিজের নফসের চিকিৎসা নিজেই করা উচিত।
ফকিরগণ খোদাপ্রেমের অধিকারী আর আলেমগণ জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী। কিন্তু প্রকৃত কামেল লোক তিনিই যিনি খোদাপ্রেম ও আকল উভয়েরই অধিকারী।
একমাত্র খোদা তায়ালার সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন কর। কেননা, তিনি দান করেন আর সকলে গ্রহণ করে। তিনি যা দান করেন তা অপর কেহ কেড়ে নিতে পারে না।
ইউসুফ নামের এক মুরিদ হযরত বাবা সাহেবের কাছে আরজ করল, আমি কিছুই পাচ্ছি না। তিনি উত্তরে বললেন, তা আমার ত্রুটি নয়। তুমি নিজের যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য কর। আল্লাহ তায়ালা না দিলে আমি কি করতে পারি? অনতি পরেই তিনি একটি শিশুকে ইটের পাঁজা হতে একখানি ইট আনতে বললেন, শিশুটি একখানি ভাল ইট আনল। অতঃপর ইউসুফকেও একখানা ইট আনতে বললেন, সে গিয়ে একখানা ভাঙ্গা ইট আনল। তখন হযরত বাবা সাহেব বললেন, ভাঙ্গা ও খারাপ ইটা আনা তোমার কাজ, এতে আমার কোন দোষ নেই। নসিবই হল বড় কথা। অবশ্য এই ইউসুফ পরে হযরত বাবা সাহেব হতে খেলাফত লাভ করেছিলেন।
বাবা সাহেব মুরিদদের তাকীদ করতেন, দুনিয়াদার হতে দূরে সরে থাকা একান্ত আবশ্যক। কখনও সুনাম ও খ্যাতির প্রত্যাশী হইও না। কথা সব সময়েই সংক্ষেপ করবে, আর বিনা প্রয়োজনে কখনও কারও কাছে যেও না।
ফকিরী ও দরবেশীর মধ্যে এমন কোন স্তর নেই যেখানে পৌঁছে ফরিক ভয় ও আশা হতে মুক্ত হতে পারে।
আল্লাহ পাক এবং তাঁর বান্দার মধ্যে দুনিয়াই সর্বপ্রধান পর্দা।
নিজের সত্তা ভুলতে পারলেই আল্লাহ পাকের সাথে মিলিত হওয়া যায়। অন্তরে খোদার ভয় উৎপন্ন করে তাকে সজীব কর।
ধনী লোকের সাথে উঠা-বসা করা ফকিরের জন্য সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর।
নির্বিচারে যার তার খাদ্য স্পর্শ করো না। বরং নির্বিচারে সকলকে খাদ্য দান কর।
শত্র“কে তোমার প্রতি প্রসন্ন দেখলেও তা হতে কোন সময় নির্ভয় হয়ো না।
দান করার সময় নিজের সত্তাকে মাঝখান হতে লোপ করে দাও, নিজের প্রতি মোটেও লক্ষ্য করো না।
অনুমানের উপর কথা বলে দিলকে শয়তানের খেলার পুতুল করা উচিত নয়।
ন্যায় নিষ্ঠা ও ন্যায় বিচারের মধ্যেই সম্মান নিহিত আছে।
শান্তি ও তৃপ্তি লাভের বাসনা থাকলে হিংসা হতে দূরে থাক।
গোপনীয়তা রক্ষা করার নাম দরবেশী। আর চারটি বস্তু হতে নিজেকে রক্ষা করা দরবেশের কর্তব্য- ক. অপরের আয়েবের প্রতি দৃষ্টি দিবে না, খ. শ্রবণের অযোগ্য কথার প্রতি কর্ণপাত করবে না, গ. যা বলা উচিত নয় তা কখনও মুখে আনবে না, ঘ. যে স্থানে যাওয়া সঙ্গত নয় সেখানে কখনও যাবে না।
মানুষের কর্তব্য আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত যে পরিমাণ খাবে, ইবাদত করে তার শোকর প্রকাশ করবে। কেননা, ইবাদতের শক্তি অর্জনের জন্য খাদ্য গ্রহণ করাও ইবাদত। কিন্তু শুধু নফসের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য খাওয়া উচিত নয়।
মানুষ এলমের মূল্য ও মর্যাদা বুঝতে পারলে বা সন্ধান পেলে দুনিয়ার সমস্ত কাজ ত্যাগ করে এলমের পাছে লেগে যেত।
মুমিনের অন্তকরণ পবিত্র উর্বর ভূমির মত। যাতে খোদা প্রেমের বীজ বপন করলে নানা প্রকারের নেয়ামত উৎপন্ন হবে।
খোদা-প্রেমের দাবিদার যে পর্যন্ত সাপের মত খোলস পরিবর্তন না করবে, সে পর্যন্ত খোদা-প্রেমের দাবিতে সে সত্যবাদী প্রমাণিত হতে পারবে না।
মানুষ যা কিছুই করে- তাই মনে করতে হবে যে, এ সমস্ত একমাত্র খোদারই ইচ্ছায় সম্পন্ন হচ্ছে, তাতে নিজের কোন হাত বা কৃতিত্ব নেই।
দরবেশী খেরকা পরিধান করা সহজ, কিন্তু তার হক আদায় করা বড়ই কঠিন। শুধু খেরকা পরিধান করলেই যদি পরলোকে মুক্তি লাভ হত, তবে খেরকা সকলেই পরত।
তাওয়াক্কুল কারী লোকের উপর এমন সময়ও উপস্থিত হয় যখন তাকে মারাত্মক অস্ত্র দ্বারা আঘাত করলে কিংবা তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হলেও তার কোনই খবর হয় না এবং সে কিছুই অনুভব করতে পারে না।
যে ব্যক্তি খোদা হতে যত গাফেল বা অমনোযোগী হবে, সে দুনিয়ার প্রতি ততটুকু লিপ্ত হয়ে পড়বে।
যে ব্যক্তি মওতকে সর্বদা স্মরণ রাখে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি সর্বদা সন্তুষ্ট থাকেন।
ব্যথা বেদনা ও বিপদ-আপদ খোদা প্রেমিকদের খোরক। যেদিন তাঁতেদর প্রতি কোন বিপদ না আসে সেদিন তাঁরা চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন যে, আজ দোস্ত আমাকে স্মরণ করেননি। অতঃপর আবার যখন বিপদে পতিত হন, তখন এই বলে শোকর আদায় করেন যে, দোস্ত এখন আমাকে স্মরণ করেছেন।
ফকির ব্যক্তি জামা পরিধান করে তা মনে করা উচিত নয় যে, সে জামা পরেছে বরং কাফন পরেছে বলে মনে করা উচিত।
এশকের আগুন এমন একটি পদার্থ যা দরবেশের অন্তরের মধ্যেই স্থান পেতে পারে, অন্য কোথাও নয়।
মুরিদ হয়ে প্রথমাবস্থায় সবর করা কর্তব্য। তাতেই কাজ হাসিল হয়, তৎপর মুরিদের অবস্থা দুরুস্ত হয়ে গেলে তখন বরকতসমূহের দরজা খুলে যায়।
বিপদ আপদ মঙ্গলের প্রমাণ। কেননা, বিপদে গুনাহ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
মানুষ বিপদে পতিত হলে তার কারণ সম্বন্ধে চিন্তা করে শিক্ষা গ্রহণ  করা উচিত।
আল্লাহর ওয়াস্তের নিয়ত ব্যতীত দান করলে তা অপব্যয় বলে গণ হয়।
নিজের মধ্যে আদর্শ ও নমুনা স্থাপন না করে ওয়াজ নসিহত করলে তা ক্রিয়াশীল বা ফলপ্রদ হবে না।
বেহেশতে ইবাদতও নেই, এশকও নেই।
লড়াই চলা অবস্থায় সন্ধির চিন্তা নিরর্থক।
আল্লাহ তায়ালা হতে নিঃসম্পর্ক হয়ে নিজের শক্তির উপর নির্ভর করো না।
শত্রুর সাথে কাজে-কর্মে পরামর্শ করলে ক্রমশঃ তার অন্তর হতে শত্র“তা দূর হয়ে যায়।
নিজের প্রকৃত অবস্থা তুমি নিজেই প্রকাশ কর। অন্যথায় লোকে তোমার খোলস খুলে আসল অবস্থা বের করে ফেলবে।
মৃত্যু যেরূপ মানুষকে তালাশ করে বেড়ায়, রিযকও তদ্রুপ মানুষকে তালাশ করে বেড়ায়।
এমন কাজের জন্য চেষ্টা কর যার মাধ্যমে মরেও জীবিত থাকতে পার।
অতিথি সৎকারে বাড়াবাড়ি ও কৃত্রিমতার প্রয়োজন নেই।
অহংকারী ও অবাধ্য লোকের সঙ্গে তুমি অহংকারমূলক ব্যবহার কর।
নিয়মতান্ত্রিক এলম কিছুই নেই। আখলাকই আসল বস্তু, তার দ্বারাই নাজাত হাসিল হয়।
যে ব্যক্তি আল্লাহর কাজে মগ্ন থাকে, তার যাবতীয় কাজ নির্বাহ করে দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ পাক নিজ হাতে গ্রহণ করেন।
নিরপেক্ষ ও নির্লিপ্ত থাকা দুর্বলতার লক্ষণ।
যে বস্তু ক্রয় করতে পাওয়া যায় না তদ্রুপ বস্তু কখনও বিক্রি করো না।
পাপজনক কাজের জন্য গর্ব বোধ করা উচিত নয়।
যে নির্বোধ ব্যক্তি নিজেকে বুদ্ধিমান বলে প্রকাশ করে তা হতে সর্বদা দূরে সরে থেকো।
বাইরের অবস্থা হতে ভিতরের অবস্থা উত্তম রাখা উচিত।
যে কোন উপায়েই হোক সর্বদা নেকী লাভ করার চেষ্টা কর।
কিছু পাইলেও তাতে মগ্ন হয়ে থেক না, কিছু না পেলেও তার জন্য চিন্তিত হয়ো না। অভাবমুক্ত হয়ে থাকাতেই শান্তি।
নফসের আকাক্সক্ষা মিটাতে ঋণ গ্রহণ করার চেয়ে ফকিরের পক্ষে মরে যাওয়াই ভাল। কেননা, ঋণ গ্রহণ এবং তাওয়াক্কুলের মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ।
বংশগত পুরাতন লোকের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখ।
আল্লাহ পাকের দরবারে হাজিরী এবং আল্লাহ পাকের জামার পরিদর্শন রূপ নেয়ামত কুরআন শরীফ দ্বারা হাসিল হয়ে থাকে। কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করার দাবি আল্লাহ পাকের সঙ্গে কথোপকথনের দাবির তুল্য। যার মধ্যে আল্লাহ পাকের সাথে কথোপকথনের রুচি নেই, সে কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের দাবিতে মিথ্যাবাদী।
সাতশত পীরানে তরিকত এক বাক্যে বলেছেন যে- গুনাহের কাজ পরিত্যাগকারীই সর্বাপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান। যে ব্যক্তি কোন কাজে ও বিষয়ে অহংকার করে না, সেই ব্যক্তিই সর্বাধিক জ্ঞানী। অল্পতে তুষ্ট ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা অধিক ধনী, পক্ষান্তরে অল্পে তুষ্ট থাকা যার স্বভাব নয়, সে সর্বাপেক্ষা অধিক দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোক।
আল্লাহ তায়ালার দরবারে কোন বান্দা কিছু প্রার্থনা করে হাত বাড়ালে, আল্লাহ সেই হাতকে খালি ফিরায়ে দিতে লজ্জা বোধ করে থাকেন।

সুলতানুল আউলিয়া মাহবুবে এলাহী হযরত শায়খ নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ

সুলতানুল মাশায়েখ হযরত খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া সাধারণত মাহবুবে এলাহী আখ্যায় আখ্যায়িত হতেন। তিনি সেই সকল আউলিয়ায়ে কেরামের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যাঁদের বদৌলতে হিন্দুস্তান বেলায়েতের নূরে আলোকিত হয়েছে। তিনি হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ এর ঐসকল খলিফাগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাঁরা নিজামিয়া সিলসিলা কায়েম করেছিলেন এবং তার বিস্তার ও উন্নতি কল্পে উল্লেখযোগ্য কাজ করে গিয়েছেন। তিনি গাউস, কুতুব, খোদাগতপ্রাণ প্রভৃতি স্তর অতিক্রম করে মাহবুবে এলাহীর পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন।
বংশ পরিচয় : তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ। তাঁর বংশগত সিলসিলা হযরত আলী রাঃ পর্যন্ত গিয়ে মিলেছে।
জন্ম : হযরত সুলতানুল আউলিয়ার পূর্বপুরুষগণ বোখারা হতে হিজরত করে লাহোরে এসেছিলেন, কিন্তু সিয়ারুল আরেফীন কিতাবে বর্ণিত আছে, তাঁর পিতা আহমদ ইবনে দানয়াল গজনবী হিন্দুস্তানে এসে বাদায়ুনে বসতি স্থাপন করেন, বাদায়ুন যুক্ত প্রদেশের প্রসিদ্ধ জেলা। এই জেলার পতঙ্গী টোলা নামক স্থানে হযরত মাহবুবে এলাহী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা খাজা আলী রাঃ এবং নানা খাজায়ে আরব সাইয়্যেদ আবুল মাক্কাখের সপরিবারে বাদায়ুনে এসে বাস করেন। তাঁরা উভয়েই বুযুর্গ এবং পরস্পর নিকটাত্মীয়ও ছিলেন। খাজায়ে আরবের কন্যা যুলাইখার সাথে খাজা আলীর পুত্র সাইয়্যেদ আহমদের বিবাহ হয়। খাজা আহমদ একজন শ্রেষ্ঠ আলেম ও মুত্তাকী ছিলেন। তৎকালীন দিল্লীর সুলতান তাঁকে বাদায়ুনের কাজী নিযুক্ত করেছিলেন। বাদায়ুনে তাঁর মাজার তাঁর মাজার আজও সর্বসাধারণের জিয়ারতগাহ হয়ে আছে।  হযরত সুলতানুল আউলিয়া মাহবুবে এলাহী হিজরি ৬৩৬ সালের ২৭শে সফর এই বাদায়ুনেই খাজা সাইয়্যেদ আহমদ সাহেবের ঔরসে ও বিনতে খাজায়ে আরবের কন্যা বিবি জুলাইখার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা : হযরত সুলতানুল আউলিয়া পাঁচ বছর বয়ঃক্রমকালে পিতৃহীন হয়ে স্নেহময়ী ও খোদাভক্ত মাতার স্নেহ ছায়ায় প্রতিপালিত হতে থাকেন। মাতা তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্য মক্তবে পাঠান। সেখান হতে কুরআন শরীফ খতম করে মাওলানা আলাউদ্দীন উসূলীর কাছে ফেকাহের কিতাব ক্কুদুরী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পাঠ্যাবস্থায় তাঁকে ফজিলতের সনদ প্রদান কালে বহু ওলামা ও মাশায়েখে কেরাম বলেছিলেন, এই বালকের মস্তক কোন মানুষের সামনে অবনমিত হবে না। তৎকালে দিল্লীই ছিল এলম ও আলেম ফাজেলদের প্রাণকেন্দ্র। মাওলানা শামসুদ্দিন দামগানী অতিশয় উচ্চ পর্যায়োর আলেম এবং দিল্লী শহরে একজন প্রথিত যশা ওস্তাদ ছিলেন। তৎকারে বাদশাহ গিয়াসুদ্দীন বুলবনও তাঁর এলম ও কামালিয়তের বিশেষ মর্যাদা দান করতেন। বাদশাহ তাঁকে ‘শামসুল মূলক’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং মুস্তাওফিউল মূলকে পদটিও তিনি অলংকৃত করেছিলেন। অধ্যাপনার কাজে তাঁর খ্যাতি ছিল অতি প্রসিদ্ধ।
১৬ বছর বয়সে হযরত খাজা মাহবুবে এলাহী নিজামুদ্দীন আউলিয়া দিল্লীতে পৌঁছে এই স্বনামধন্য ওস্তাদের শাগরেদভুক্ত হন। মাওলানা শামসুল মুলক সাহেব এই দুর্লভ মণিকে প্রথম দৃষ্টিতেই চিনতে পেরেছিলেন। অতএব তিনি অপর দুইজন প্রিয় শাগরেদ, কুতবুদ্দীন নাকেলাহ এবং বুরহানুদ্দীন আবদুল বাকীর সঙ্গে তাঁকে নিজ হুজরায় স্থান দেন এবং বিশেষ যত্ন সহকারে শিক্ষা দান করতে থাকেন।
হযরত খাজা মাহবুবে এলাহী মাওলানা শামসুল মূলকের কাছে মোকামাতে হারীরী নামক কিতাবের ৪০ মোকামাহ অধ্যয়ন করেন। তৎকালে দিল্লী শহরে হযরত মাওলানা কামালুদ্দীন নামে আরও একজন কামেল ও দ্বীনদার বুযুর্গ ছিলেন। তিনি স্বীয় যুগে শ্রেষ্ঠ ও বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের মধ্যে পরিগণিত হতেন। সম্রাট গিয়াসুদ্দীন বুলবন মাওলানা কামালুদ্দীনের বুযুর্গী, পরহেজগারী, অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দ্বীন দারী দেখে তাঁকে কাজীর পদে নিযুক্ত করতে চাইলেন। কিন্তু মাওলানা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করত বললেন, আমার কাছে শুধু নামাজ ভিন্ন আর কিছুই নেই তাও আপনি কেড়ে নিতে চাইছেন? হযরত খাজা মাহবুবে এলাহী রাঃ এই মহাপুরুষের কাছে হাদিস শরীফের তালিম হাসিল করেন এবং এই শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন প্রসিদ্ধ ওস্তাদগণের নিকট গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্বন্ধীয় বিদ্যা, ফেকাহ, উসূল, এলমে তাফসীর ও অঙ্কশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকরের কাছে বায়াত : খাজা মাহবুবে এলাহী হেলাল তাশতদারের মসজিদের যেই হুজরায় বাস করতেন, তার কাছে হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ এর ছোট ভাই নাজীবুদ্দীন মুতাওয়াক্কীল রাঃও বাস করতেন। তিনি জাহেরী ও বাতেনী উভয়বিধ এলমেই সুশিক্ষিত ও সুবিজ্ঞ ছিলেন। হযরত খাজা মাহবুবে এলাহী রাঃ অধিকাংশ সময় তাঁর সংসর্গে থাকতেন এবং আলাপ আলোচনা করতেন।
হযরত খাজা সাহেবের নিজস্ব উক্তি : হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ বলেছেন, আমি তখন ছোটই ছিলাম, অর্থাৎ আমার বয়স তখন প্রায় বার বছর। এসময়ে আমি আরবী সাহিত্য অধ্যয়ন করতাম। তখন আবু বকর খাররাত যাঁকে আবু বকর কাউয়ালও বলা হত, মুলতান হতে আমার ওস্তাদের খেদমতে তাশরিফ আনলেন। তিনি আমার ওস্তাদের কাছে হযরত শেখ বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার প্রশংসা করলেন। কিন্তু আমার অন্তরে তার বিশেষ কোন প্রভাব পড়ল না। অতঃপর তিনি বাবা গঞ্জেশকরের বুযুর্গী সম্বন্ধে আলোচনা করলেন। তা শুনে আমি বিচলিত হয়ে পড়লাম। তাঁর মহব্বত আমার হৃদয়ে তরঙ্গায়িত হতে লাগল। অবশেষে অবস্থা এরূপ দাঁড়াল যে, আমি প্রত্যেক নামাজের পর হযরত বাবা ফরিদের নামে তসবিহ পাঠ করতাম এবং রাতে শয়নকালে দশবার শেখ ফরিদ এবং দশবার মাওলানা ফরিদ নাম উচ্চারণ করতাম। আমার বয়স যখন ষোল বছর, তখন আমি আমার মাতা ও ছোট ভাই দিল্লী চলে আসি। ঘটনাক্রমে হযরত বাবা গঞ্জেশকরের ছোট ভাই শেখ নাজীবুদ্দীন রাঃ এর বাসস্থানের নিকটবর্তী একটি প্রকোষ্ঠে আমরা অবস্থান করতে লাগলাম। নাজীবুদ্দিন রাঃ এর সঙ্গে আলাপ আলোচনার ফলে হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকরের প্রতি আমার মহব্বত থাকায় তাঁর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ আমার অন্তরে দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। তা সত্ত্বেও আমি আরও চার বছর পর্যন্ত শহরেই অবস্থান করলাম এবং খুব চেষ্টা ও পরিশ্রম করে  তালিম লাভ করে সনদ প্রাপ্ত হলাম।
অজুধনের দিকে যাত্রা : এক রাতে মাহবুবে এলাহী শহরের জামে মসজিদে অবস্থান করতেছিলেন, সেই প্রভাতে মুয়াজ্জিন মসজিদের মিনারায় চড়ে এই আয়াতটি পাঠ করল :
“যারা ঈমান এনেছে, এখনও কি তাদের দিল আল্লাহ তায়ালার জিকিরে ঝুঁকে পড়ার সময় আসেনি?” তা শ্রবণ করা মাত্র তাঁর অন্তরে এক অভূতপূর্ব অবস্থার উদ্ভব হল। ফলে তিনি সেই প্রভাতেই আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুল করে বাবা গঞ্জেশকরের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে অজুধনের পথে যাত্রা করলেন। যাত্রাকালে কোন প্রকার পাথেয় তাঁর সঙ্গে ছিল না। অজুধনে পৌঁছামাত্র হযরত  বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ তাঁকে দেখেই এই বয়েতটি আবৃতি করলেন-
“আয় আ-তেশে ফেরাকাৎ দিলহা কাবাব কার্দাহ !
সায়লাবে এশতেয়াকাত জানহা খারাব কার্দাহ !!
অর্থ- ওহে তোমার বিচ্ছেদের আগুন দিলকে কাবাব করে দিয়েছে, তোমার মহব্বতের বন্যা প্রাণকে বীরাণ করে দিয়েছে।
স্বরচিত ‘রাহাতুল কুলুব’ কিতাবে হযরত খাজা মাহবুবে এলাহী রাঃ এই সাক্ষাতের বিবরণ লিখেছেন, ৬৫৫ হিজরির ১০ই রজব বুধবার মুসলিম জগতের আশীর্বাদ সুলতানে তরিকতের একজন নগণ্য গোলাম নিজামুদ্দীন বাদায়ুনী সাইয়্যেদুল আবেদীন হযরত শেখ ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর মাসউদ অজুধনী কুদ্দেসা সিররুহুল কদমবুছি করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তিনি তখনই তাঁর মস্তক হতে চারতর্ফি টুপি খুলে এই অধমের মস্তকে পরায়ে দিলেন এবং নিজের খাস খেরকা ও কাঠের খড়মজোড়া দান করলেন, অতঃপর বললেন, হিন্দুস্তানের বেলায়েত এবং আমার সাজ্জাদরূপ নেয়ামত আমি অন্য একজনকে দান করতে চেয়েছিলাম, তখন তুমি অজুধনের পথে ছিলে, এমন সময়ে আমি মাথার উপর হতে আওয়াজ শুনতে পেলাম, অপেক্ষা কর, নিজামুদ্দীন বাদায়ুনী আসছেন, এই বেলায়েত তাকে দান করিও।
অজুধনে অবস্থান : হযরত সুলতানুল আউলিয়া স্বীয় পীর ও মোর্শেদ হযরত বাবা সাহেবের দরবারে হিজরি ৬৫৫ সালের ১০ই রজব উপস্থিত হন এবং হিজরি ৬৫৬ সালের ২রা রবিউল আওয়াল পর্যন্ত তাঁর খেদমতে থেকে তালিম ও তারবিয়াত হাসিল করেন।
অজুধনে দিবা ও রাত্রি ঃ হযরত বাবা সাহেবের খানকায় অবস্থানরত দরবেশগণ অতিশয় দুঃখ-কষ্ট ও সংক্ষিপ্ততার মধ্যদিয়ে জীবন যাপন করতেন। অধিকাংশ সময় তাদের অনাহারে কাটত। সে সময় মাওলানা বদরুদ্দিন এসহাক এবং জামলুদ্দীন হাসূভীর মত বুযুর্গ ব্যক্তিরাও এই দরবারে তালিম ও তরবিয়াত হাসিল করতেন। মাওলানা বদরুদ্দীন লঙ্গরখানার জন্য জঙ্গল হতে লাকড়ী সংগ্রহ করে আনতেন। আর শেখ জামালদ্দীন জঙ্গল হতে এক প্রকার ফল সংগ্রহ করে আনতেন, তা তরকারীরূপেও ব্যবহার করা হত এবং লবণ ও সিরকা মিশায়ে আচারও তৈরি করা হত। হোসাম্দ্দুীন কাবুলী রাঃ এর উপর পানি সংগ্রহের এবং থালা বাসন পরিষ্কার করার দায়িত্ব ছিল আর হযরত খাজা সুলতানুল আউলিয়া রাঃ তরকারি পাক করতেন।
দরবেশী আর কর্জ : খানকার নিকটেই এক মুদির দোকান ছিল। কখনও কখনও তার দোকান হতে লবণ ক্রয় করা হত। একবার হযরত খাজা সাহেবের কাছে লবণ ক্রয় করার মত পয়সা ছিল না। সুতরাং তিনি উক্ত মুদির দোকান হতে ধারে এক দেরহাম মূল্যের লবণ এনে তরকারী পাকালেন। অতঃপর খাবার সামনে হাজির করা হল। হযরত মাওলানা বদরুদ্দীন, মাওলানা জামালুদ্দীন হাঁসুভী, হযরত সুলতানুল আউলিয়া নিজামুদ্দীন রাঃ একই পেয়ালায় আহার করতেন।
হযরত বাবা সাহেব খাবার গ্রাসে উঠাবার জন্য পেয়ালায় হাত রাখতেই তাঁর হাত খুব ভার বোধ হল। তিনি গ্রাস না উঠায়ে বললেন, এই খাদ্য হতে অপব্যয়ের গন্ধ আসছে। জিজ্ঞাসা করা হল, লবণ কোথা হতে আনা হয়েছে? হযরত বাবা সাহেবের এই প্রশ্নে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বহু কষ্টে শুধু এটুকু বললেন, ধারে এনেছি। হযরত বাবা সাহেব বললেন, নিজের নফসের খায়েশ পূর্ণ করার জন্য কারও কাছে ধার নেয়ার চেয়ে দরবেশের পক্ষে মরে যাওয়া শ্রেয়। তাওয়াক্কুল এবং কর্জের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। স্মরণ রেখ ঋণগ্রস্ত দরবেশ যদি ঋণ রেখে মারা যায় তবে কিয়ামতের দিন কর্জের বোঝার চাপে তাঁর ঘাড় নত হয়ে থাকবে। একথা বলে হযরত বাবা সাহেব আদেশ করলেন, সমস্ত তরকারি গরিবদের মধ্যে বিলায়ে দাও।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ বলেন, আমি তখন হতে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনও কারও কাছে ধার করব না এবং নিজেই এই কর্জের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে তওবা করলাম। হযরত বাবা সাহেব কাশফের দ্বারা খাজা সাহেবের তওবার বিষয়ে অবগত হয়ে নিজের আসনের কম্বলখানি খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়াকে দান করে বললেন, ইনশাআল্লাহ কোন সময়ে তোমার ধার গ্রহণের প্রয়োজন হবে না।
পীর ও মুরিদের কথোপকথন : হযরত বাবা সাহেব খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ কে যে সমস্ত উপদেশ ও নসিহত করেছিলেন তার সবগুলোই খাজা সাহেব স্বরচিত কিতাব রাহাতুল কুলুবে সন্নিবেশিত করেছিলেন।
একদা হযরত সুলতানুল আউলিয়া রাঃ হযরত পীর সাহেবের খেদমতে একাকী বসেছিলেন। সে সম্বন্ধে তিনি বলেন, অধম বসে বসে নিদ্রিত পীর সাহেবের শরীর হতে মাছি তাড়াচ্ছি, এমন সময়ে হযরত পীর সাহেব জাগ্রত হয়ে বললেন, খানকার দরবেশগণ কোথায়? আমি বললাম, সকলে ঘুমাচ্ছে। তিনি বললেন, ঘনায়ে বস, তোমাকে একটি কথা বলব, তারপর তিনি বললেন, তুমি দিল্লী দিয়ে রিয়াযত ও ইবাদতে মশগুল হও, বেকার বসে থাকার কোন স্বার্থকতা নেই। তরিকতের অর্ধেক কাজ রোজা রাখা আর নামাজ ও অন্যান্য কাজ বাকী অর্ধেক কাজ।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ বলেন, একদিন হযরত পীর সাহেব বললেন, আমি আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করেছি। তুমি আল্লাহ পাকের কাছে যা চাইবে তাই পাবে।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ বলেন, একবার বাবা সাহেব নিজের খাস হুজরায় থেকে এই বয়েতটি আবৃত্তি করতেছিলেন-
“খাহামকে হামেশা দর রেযায়ে তুযিয়াম !
খাকী শাওয়াম অযিরে পায়ে তু যিয়াম !!
মাকসূদে মান খস্তাহ যে কাওনাইন তু ঈ !
আয বাহরে তু মীরাম অ আয বরাযে তূ যিয়াম !!
অর্থ- আমার ইচ্ছা, আমি তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য জীবিত থাকব, মাটি হয়ে তোমার পদতলে জীবিত থাকব। আমি দুর্বল ও দুরবস্থাগ্রস্তের উভয় জগতের উদ্দেশ্য একমাত্র তুমি।, তোমারই জন্য আমি মৃত্যু বরণ রকব, তোমারই জন্য আমি জীবিত থাকব।
হযরত সুলতানুল আউলিয়া খাজা নিজামুদ্দীন বলেন, বাবা সাহেব এই বয়েতগুলো পড়তে পড়তে নিজের মস্তক মোবরক সেজদায় নিয়ে গেলেন। আমি তা দেখে আমার মাথা তাঁর পদপ্রান্তে স্থাপন করলাম। তিনি আমার প্রতি সদয় হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, যা তোমার চাইবার আছে চাও। আমি প্রার্থনা করলাম দৃঢ়তা, তিনি আমাকে তা দান করলেন।
পীর-মোর্শেদের দরবার হতে বিদায় গ্রহণ : বিদায় গ্রহণের পূর্বে হযরত বাবা সাহেব নিজ মুখের লালা মোবারক খাজা সাহেবের মুখে দিয়ে বললেন, বাবা নিজাম, আল্লাহ পাক তোমাকে দ্বীন এবং দুনিয়া উভয়টিই দান করেছেন, এখানে সব কিছুই বিদ্যমান আছে। অতএব, তুমি হিন্দুস্তান নামক দেশটি গ্রহণ কর। অতঃপর তাঁকে খেলাফত দান করে বললেন, আল্লাহ তোমাকে এলম, আকল ও এশক দান করেছেন। এই তিনটি নেয়ামত যার মধ্যে বিদ্যমান আছে খেলাফতের যোগ্যও সেই ব্যক্তিই বটে। তৎপর অসিয়ত করলেন, যদি একান্তই কারও নিকট হতে ধার নিতে বাধ্য হও, তবে তা অতি সত্বর পরিশোধ করে ফেল। নিজের শত্র“দের সকল অবস্থায় সন্তুষ্ট রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করো, তাদেরকে কষ্ট দিও না, তাদেরকে তোমার প্রতি অপ্রসন্ন হওয়ার সুযোগ দিও না।
খেলাফত প্রদান : খিয়ারুল আউলিয়া কিতাবের বর্ণনানুযায়ী ৬৬৯ হিজরির ১৩ই রমজান এবং রাহাতুল কুলুব কিতাবের বর্ণনানুসারে ৬৫৬ হিজরির ২রা রবিউল আওয়াল তারিখে তিনি হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর হতে খেলাফতের মর্যাদা লাভ করেন। এসম্বন্ধে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া স্বয়ং বলেছেন, হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ আমাকে যখন খেলাফত প্রদান করেন, তখন সেই মজলিসে বহু সুফিয়ায় কেরামও উপস্থিত ছিলেন। বাবা সাহেব সকলকে সম্বোধন করে বললেন, আমি নিজামুদ্দীনকে হিন্দুস্তানের বেলায়েত দান করেছি। হযরত পীর সাহেব কেবলার মুখে এই কথা শ্রবণ করে তাঁর সামনে জমিন চুম্বন করলাম, হযরত খাজা কুতবুল আকতাব কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ প্রদত্ত পাগড়ীটি নামায়ে আমার মাথায় পরায়ে দিলেন। তাঁর নিজের লাঠিটিও আমাকে দান করলেন, নিজ হাতে আমাকে খেরকা পরায়ে দিলেন। অতঃপর বললেন, দুই রাকাত নামাজ পড়। আমি আদেশ পালনার্থে কেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়াতেই হযরত বাবা সাহেব আমার হাত ধারণপূর্বক আসমানের দিকে ইশারা করে বললেন, প্রথমে হাঁসিতে গিয়ে এই খেলাফতনামাখানি শেখ জামালুদ্দীন হাঁসূভীকে দেখাইও এবং তাঁর অনুমোদন নিয়ে দিল্লীর দিকে যাত্রা করো। দিল্লীতে পৌঁছে এই খেলাফতনামাখাটি কাজী মুনতাখাবকে দেখাইও।
দিল্লীতে অবস্থান  : হযরত সুলতানুল আউলিয়া অজুধন হতে দিল্লীতে পৌঁছে নিজের এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করতে লাগলেন। সেই আত্মীয়ের নিকট হতে তিনি একখানা কিতাব ধার নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কিতাবখানি হারায়ে যাওয়ায় তিনি সেই আত্মীয় ব্যক্তিকে বললেন, কিতাবখানি হারায়ে গেছে। আপনি পছন্দ করলে আমি কিতাবখানা নিজ হাতে লিখে আপনার হাওয়ালা করে দিতে পারি। উক্ত আত্মীয় একথা শুনে বললেন, শুকরিয়া কিতাবখানি আমি আপনাকে দান করে ফেললাম, আপনার উপর এ বিষয়ে আমার আর কোন দাবী রইল না।
হযরত সুলতানুল আউলিয়া হযরত পীর সাহেবের নসিহত অনুযায়ী ঐসকল লোকের সাথে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করলেন, যারা তাঁর প্রতি অপ্রসন্ন ছিল এবং নানাবিধ আলাপ ও স্বীয় কোমল ব্যবহার দ্বারা তাদেরকে প্রসন্ন করে ফেললেন।
এক কাপড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি পূর্বে সামান্য কিছু কাপড় ধারে খরিদ করেছিলেন, তাঁর কাছে গমন করে নিজের জন্য যৎসামান্য কিছু টাকা ছিল তা দোকানদারকে দিয়ে অবশিষ্ট পাওনা পরে দিব ওয়াদা করলেন, কিন্তু দোকানদার অবশিষ্ট প্রাপ্য মাফ করে দিলেন।
অজুধনে সফর : মাহবুবে এলাহী হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ অজুধন হতে দিল্লীতে গমনের পর স্বীয় পীর ও মোর্শেদ হযরত বাবা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে বাবা সাহেব তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন, ইয়া আল্লাহ ! নিজামুদ্দীন আপনার কাছে যা প্রার্থনা করে আপনি তাঁকে তা দান করবেন। বস্তুত পীর সাহেবের এই দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করলেন। এই কারণেই তাঁকে ‘মাহবুবে এলাহী’ বলা হয়।
হযরত খাজা সুলতানুল মাশায়েখ বলেন, ৬৬৬ হিজরি সালে আমি তৃতীয়বার হযরত পীর সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে অজুধনে গমন করি, এটাই তাঁর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ। এবার তিনি আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় দোয়া করলেন, আল্লাহ পাক তোমাকে উভয় জগতে সৌভাগ্যশালী করুন, আর তোমাকে দান করুন হিতকর এলম এবং কবুল হওয়ার যোগ্য আমল। অতঃপর বললেন, তুমি এমন বৃক্ষ হবে যার ছায়ায় আল্লাহর বান্দাগণ শান্তি পাবে। অতঃপর নসিহত করলেন, যোগ্যতা অর্জনের জন্য অবিরত পরিশ্রম, চেষ্টা ও সাধ্য সাধনা করতে থেক।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ তালিম তরবিয়ত হাসিল করার পর যখন তরিকত ও রিয়াযতে আত্মনিয়োগ করেন তখনও তাঁর মধ্যে এলেম হাসিল করার আগ্রহ পূর্ববৎ প্রবল থাকা সত্ত্বেও তিনি হযরত বাবা সাহেবকে বললেন, আপনি আদেশ করলে এলম হাসিল করার চেষ্টা ছেড়ে দিতে পারি। হযরত বাবা সাহেব বললেন, আমি এলম শিক্ষা করতে কাউকে কখনও নিষেধ করি না। তুমি উভয়বিধ কাজ করতে থাক, অর্থাৎ এলমও শিক্ষা করতে থাক, এবং আল্লাহ পাকের ইবাদত এবং রিয়াজতেও মশগুল থাক। অতঃপর এই দুইযের মধ্যে যেটি প্রবল হবে তাই থেকে যাবে। তিনি তদরূপই করতে থাকলেন। ফলত কিছুদিন পর আল্লাহ পাকের জিকির ফিকিরে মশগুল থাকা তাঁর মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল, তিনিও তাতে একান্তভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন, শিক্ষকতা ও শিক্ষা গ্রহণের কাজে আপনা হতেই বন্ধ হয়ে গেল। খাজা বান্দা-নওয়াজ বলেন, অধিক রোদনের ফলে হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ এর গণ্ডদ্বয়ে যখমের মত দাগ পড়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, আমি আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে শুনেছি, যহরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ এর চক্ষুদ্বয় মুহূর্তকালের জন্যও শুষ্ক থাকত না, সর্বদা অশ্র“সিক্ত দেখা যেত। যতদিন তিনি ইহজগতে ছিলেন ততদিন রোদনকারীই ছিলেন। এমনকি, দুনিয়া ত্যাগ করার সময়েও রোদন করতে করতেই গিয়েছেন।
হযরত বাবা সাহেবের ইন্তেকাল  : ৬৬৬ হিজরী সালে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ স্বীয় পীর ও মোর্শেদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দিল্লীতে ফিরে আসার অল্প কয়েকদিন পরেই হযরত বাবা সাহেবের ইন্তেকাল হয়। হযরত বাবা সাহেব পুরুষাণুক্রমে প্রাপ্ত চিশতিয়া সিলসিলার পবিত্র আমানত সমূহ ইন্তেকালের সময় হযরত সুলতানুল আউলিয়াকে দেয়ার জন্য হযরত মাওলানা বদরুদ্দীন এসহাক রাঃ এর কাছে রেখে যান। মোর্শেদ কেবলার ইন্তেকালের সংবাদ জ্ঞাত হয়ে হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ অজুধনে গমন করলে মাওলানা বদরুদ্দীন এসহাক রাঃ উক্ত আমানতসমূহ খাজা সাহেবের হাওয়ালা করেন।
দুঃখ-কষ্টের যুগ  : এই সময়ে তিনি নিতান্ত দুঃখ-কষ্ট এবং অপ্রশস্ততার মধ্যদিয়ে জীবন যাপন করতেছিলেন। কখনও কখনও একাধারে কয়েকদিন অনাহারে কাটাতে হত। এসম্বন্ধে তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন, খরবুযা খুব সস্তা ছিল। কিন্তু খরবুযার মৌসুম অতীত হয়ে গেলেও তার স্বাদ আস্বাদন করা আমাদের ভাগ্যে হয়নি। মৌসুম অতীত হওয়ার পর একদা এক ব্যক্তি অনেকগুলি খরবুযা এবং কয়েকটি রুটি নিয়ে হাজির হল, আমি ঐগুলোকে আল্লাহ পাকের প্রেরিত নেয়ামত মনে করে গ্রহণ করলাম। তাছাড়া এই সময়ে আটাও খুব সস্তা ছিল তথাপি দুইটি রুটি প্রস্তুত করার পরিমাণ আটা ক্রয় করার পয়সাও আমাদের কাছে অনেক সময় থাকত না। ফলত অধিকাংশ সময় অনাহারে থাকতে হত।
একবার উপযুপরি তিন দিন অনাহারে থাকার পর হঠাৎ কেহ দরজায় আঘাত করল। হযরত খাজা সাহেব দরজা খুলে দিলে এক ব্যক্তি কিছু শুষ্ক খিচুড়ী তাঁর সামনে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাও তিনি আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত নেয়ামত মনে করে আহার করলেন। এই ঘটনার পর তিনি কয়েকবার উক্ত খিচুড়ির মধুর স্বাদের কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলতেন, সেই খিচুড়ি খাওয়ার পর হতে অদ্যাবধি অন্য কোন খাদ্যে সেরূপ স্বাদ পাইনি।
ঘরে খাবার না থাকলে তাঁর মাতা বললেন, আজ আমরা আল্লাহ পাকের মেহমান। মাতার এই বাক্যটি হযরত খাজা সাহেবের কাছে খুবই ভাল লাগত, সুতরাং ঘরে খাদ্যদ্রব্য থাকলে হযরত খাজা সাহেব আফসুস করে বলতেন, আজ আমার মাতা তাঁর সেই খাস বাক্যটি উচ্চারণ করবেন না।
অভাবশূন্যতার অবস্থা  : এত দুঃখ কষ্ট ও অনাহার জনিত ক্লিশ্যমান অবস্থায়ও অভাবশূন্যতা ও বেপরোয়ার অবস্থা এইরূপ ছিল যে, সুলতান জালালুদ্দীন খালজী একবার হযরত খাজা সাহেবের দুঃখ কষ্ট সম্বন্ধে জানতে পেরে তাঁর কাছে প্রস্তাব পাঠালেন যে, হযরতের অনুমতি পেলে খানকার খাদেমদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কয়েকটি গ্রাম নজরানাস্বরূপ পেশ করতে পারি। হযরত খাজা সাহেবের খাদেমগণ বাদশাহর প্রস্তাব সম্বন্ধে জানতে পেরে সকলে এক বাক্যে হযরত খাজা খেদমতে আবেদন জানালেন যে, বর্তমানে অভাব অনটনের অবস্থায় আমরা কখনও কখনও আপনার ঘর হতে রুটি পেয়ে থাকি, কিন্তু যদি বাদশাহর প্রস্তাবিত নজরানা কবুল করা হয় তবে অতঃপর হতে আমরা আপনার ঘর হতে পানি পান করাও পছন্দ করব না। হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ দরবেশদের এইরূপ মনোভাব জ্ঞাত হয়ে খুবই প্রীত ও সন্তুষ্ট হলেন এবং বাদশাহর নজরানা কবুল করতে অস্বীকার জ্ঞাপন করলেন।
বিপ্লবমূলক ঘটনা  : একবার উপযুপরি চারদিন পর্যন্ত হযরত খাজা সাহেবের খানকায় অনাহার চলতেছিল। খানকার পাশ্বেই খাজা সাহেবের একজন নেককার মহিলা মুরিদ বাস করতেন। তিনি দরবেশদের কথা জানতে পেরে কিছু আটা খানকায় পাঠালেন। শেখ কামালুদ্দিন রাঃ উক্ত আটা একটি মাটির পাত্রে রেখে খাদ্য প্রস্তুত করার জন্য চুলার উপর চড়ায়ে দিলেন, এমন সময় দরবেশী লেবাস পরিহিত একজন মুসাফির এসে কিছু খাবার প্রার্থনা করল। হযরত খাজা সাহেব সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি চুলার উপর হতে খাদ্য ভাণ্ডটি নামায়ে দরবেশদের সামনে রাখলেন। সদ্যপক্ক খাবার খুবই উত্তপ্ত ছিল। কিন্তু দরবেশ সেই গরম খাবারই গ্রাস করে খেয়ে ফেললেন তারপর মাটির পাতিলটিকে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেললেন এবং এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন- শেখ ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর তোমাকে বাতেনী নেয়ামত দান করেছেন। আর আমি তোমার অনাহার ভেঙ্গে ফেললাম।
স্বচ্ছলতার যুগ : আল্লাহর অলিদের পাক যবান হতে যে কথা বের হয় তা পূর্ণ হয়ে থাকে। বস্তুত এই অজ্ঞাত পরিচয় দরবেশদের মুখ হতে যা ব্যক্ত হয়েছিল, তা পূর্ণ হয়েছিল। তারপর দলে দলে অসংখ্য লোক হযরতের মুরিদ হতে লাগল। তারা যে সমস্ত নজর নিয়াজ পেশ করতে লাগল তার পরিমাণ এত ছিল যে, লঙ্গরখানার মুরিদান, আগন্তুক রাহগীর ও মুসাফিরদের প্রয়োজন পূরণ হওযার পরও বহু খাদ্যদ্রব্য উদ্বৃত্ত থেকে যেত।
গিয়াসপুরে বিরক্তি : সুলতান গিয়াসুদ্দীন বুলবনের পৌত্র এবং নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বোগরাকানের পুত্র সুলতান মুয়েযুদ্দীন কায়কোবাদ সুলতান গিয়াসুদ্দীন বুলবনের মৃত্যুর পর হিজরি ৬৮৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করার পর গিয়াসপুরের নিকটবর্তী কিলুখড়ি নামক স্থানে একটি প্রমোদ মহল নির্মাণ করেন। কায়কোবাদ খুবই বিলাসপ্রিয় ছিল। তাছাড়া পরে কিলুখড়ির পার্শ্ববর্তী স্থানে একটি মনোরম শহরও আবাদ করতে লাগল। সুতরাং রাজ্যে বহু আমীর ওমরাগণ এখানে অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করল। একটি বৃহৎ জামে মসজিদও নির্মিত হল। ফলকথা, এই নীরব নিস্তব্ধ স্থানটি দিল্লীর ন্যায় মনোরম ও কোলাহলমুখর শহরে পরিণত হল। প্রত্যহ দলে দলে লোক হযরত খাজা সাহেবের দরবারে যাতায়াত করতে লাগল, কিন্তু এই কোলাহলমুখর পরিবেশ হযরত সুলতানুল আউলিয়ার মন অতিষ্ট করে তুলল। ফলে তিনি গিয়াসপুর পরিত্যাগ করে অন্য কোন স্থানে চলে যেতে মনস্থ করলেন।
ঘটনাচক্রে এ সময়ে হযরত সুলতানুল মাশায়েখের ওস্তাদ হযরত মাওলানা আহমদ মুহাদ্দেস দিল্লীতে ইন্তেকাল করেন। সুতরাং হযরত শেখ স্থির করলেন, তাঁর জেয়ারতে দিল্লী যাবেন এবং দিল্লীর আশপাশেই কোন নির্জন স্থানে বসতি স্থাপন করবেন।
জন-সমাবেশের মধ্যে নির্জনতা : তিনি দিল্লী যাত্রা করার পূর্বেই একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। যা তাঁকে গিয়াসপুর ত্যাগের বাসনা বাদ দিতে বাধ্য করল। হযরত খাজা সাহেব স্বয়ং বলেন, আমি দিল্লী যাত্রা করার চিন্তা করছি এমন সময়ে হালকা পাতলা সুদর্শন এক যুবক আমার কাছে এসে এই শে’এর গুলো পাঠ করল-
রোযেকে তু মাহ শুদী নামী দানাস্তী !
কাঙ্গুশতে নোমায়ে আলামে খাহী শোদ !!
এমরোয কে যুলফাত দিলে খালকে বেরেবুদ !
দার গোশা নাশাস্ত নামী দারাদ শোদ !!
অর্থ- যেদিন তুমি চাঁদ হয়েছিলে, জানতে পারনি একটি জগতের লক্ষ্যস্থল হবে। আজ তোমার কেশরাশি যখন এক সৃষ্ট জগতের প্রাণ হরণ করেছে, তখন কোণে গিয়ে বসা (নির্জনতা অবলম্বন) কোন হিত সাধন করবে না।
অতঃপর সেই আগন্তুক বলতে লাগল, প্রথমতঃ তোমার বিখ্যাত হওয়াই উচিত ছিল না। যে ব্যক্তি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত যেন কিয়ামতের দিনে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সামনে শরমিন্দা হতে না হয়। লোকসমাজ হতে দূরে, নির্জনে  থেকে আল্লাহ তায়ালার স্মরণে মশগুল হওয়া সহজ। প্রকৃত জাহাঁমদের কাজ হল লোক সমাজে বাস করে নির্জনতা অবলম্বন করা। বস্তুতঃ লোকালয়ে থেকে আল্লাহ তায়ালার স্মরণে মশগুল হওয়াতে কোন ক্ষতি নেই।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ বলেন, এই লোকটির নসিহত শোনার পর আমি গিয়াসপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সংকল্প ত্যাগ করলাম।
আমীর খসরুর বায়াত  : হযরত আমীর খসরু রাঃ হযরত খাজা সাহেবের একজন অন্যতম প্রধান খলিফা ছিলেন। তিনি ফার্সী ভাষার একজন দক্ষ কবিও ছিলেন। তাঁর কবিতাসমূহ সমুধুর, হৃদয়গ্রাহী এবং এশক উদ্দীপক ছিল। হযরত খাজা সুলতানুল আউলিয়া রাঃ তাঁর কবিতাসমূহ খুব পছন্দ করতেন।
আমীর খসরুর বায়াত গ্রহণের ঘটনা যোগী হরদেবের শিষ্য মহেন্দ্র ডায়েরীতে এইরূপ লিখেছেন- আমীর খসরু আমার কাছে বলেছেন, আমি অতি শৈশবকালেই হযরত খাজা সাহেবের মুরিদ হয়েছিলাম। আর এই মুরিদ হওয়ার ঘটনাটি খুবই চিত্তাকর্ষক ছিল। একদা আমার পিতা আমীর সাইফুদ্দীন আমাকে ও আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও রওয়ানা হলেন। আমি পিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে হযরত খাজা নিজামুদ্দীন বাদায়ুনী রাঃ এর খেদমতে নিয়ে যাচ্ছি। তোমাদেরকে তাঁর মুরিদ করে দিতে চাচ্ছি।
আমরা হযরত খাজা সাহেবের খানকাহ শরীফে পৌঁছলে আমি বললাম, আমি এখানে দরজার পার্শ্বে বসে থাকি, ভিতরে যাব না। আপনি বড় ভাই সাহেবকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করুন এবং তাঁকে মুরিদ করান। আমি এখানে আপনাদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করতে থাকব।
আমার এইরূপ উত্তর শুনে পিতা মৃদু হেসে আমার বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। আমি দরজার বাইরে বসে বসে মনে মনে একটি শে’এর রচনা করলাম। উদ্দেশ্য এই যে, হযরত খাজা সাহেব যদি কামেল লোক হয়ে থাকেন, তবে তিনি স্বীয় বাতেনী আলোর সাহায্যে আমার এই শে’এর টির অবস্থা জানতে পারবেন এবং শে’এর টির দ্বারাই আমার শে’এর টির জবাব দিবেন। তার পর আমি ভিতরে গিয়ে হযরত শেখের মুরিদ হব। অন্যথায় আমার পিতা ও বড় ভাই সাহেব বের হয়ে আসলে তাঁদের সঙ্গে বাড়িতে ফিরে যাব। আমার রচিত শে’এর টি এই-
ভূআঁ শাহে কে বরআইওয়ানে কাসরাত !
কবুতর গার নাশীনাদ বায গারদাদ !!
গারীবে মাস্তমন্দে বর দর আমদ !
বিয়ায়াদ আন্দুরুঁইয়া বায গারদাদ !!
অর্থ- আপনি এমন বাদশাহ যে, আপনার প্রাসাদের কার্ণিশের উপর একটি কবুতর আসলে তা (আপনার ফয়েজের বরকতে) বায পাখী হয়ে যায়। একজন গরিব মুহতাজ আপনার দ্বারে এসেছে, (বলুন) সে ভিতরে আসবে না ফিরে যাবে।
হযরত আমীর খসরু বলেন, আমি এই শে’এর টি মনে মনে রচনা করে নীরবে বসে হযরত শেখের জওয়াবের অপেক্ষা করতে লাগলাম। এ সময় হযরত শেখের একজন খাদেম দরজার বাইরে এসে আমাকে বললেন, হযরত শেখ আমাকে আদেশ করেছেন, দরজার বাইরে একজন তুর্কযাদা বসে আছে, তার সামনে গিয়ে এই শে’এর টি পাঠ করে চলে আস।
বিয়ায়াদ আন্দরূ মার্দে হাকীকত !
কে বামা এক নাফাস হামরায গার্দাদ !!
আগার আবলাহ বুওয়াদ আঁ মর্দেনা দা !
আযাঁ রাহে কে আমদ বায গার্দাদ !!
অর্থ- হাকীকতের ময়দানে মানুষ ভিতরে চলে আসুক এবং আমার সঙ্গে কিছু কাল রহস্যালাপ করুক। আর যদি সেই আগন্তুক নির্বোধ এবং মূর্খ হয় তবে যে পথে এখানে এসেছে সে পথেই ফিরে যাক।
হযরত আমীর খসরু বলেন, খাদেম এসে যখন হযরত শেখের পক্ষ হতে এই শে’এর দুটি দ্বারা আমার শে’এরটির জবাব দিল, তখন আমি সেই স্থান হতে উঠে উন্মাদের মত খাদেমের সঙ্গে সঙ্গে হযরত শেখের ঘরে প্রবেশ করলাম। আমার পিতা এবং বড় ভাই সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কেরমানী সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন। আমি হযরত শেখের প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখলাম তিনি আমার প্রতি গভীরভাবে তাকায়ে মুচকি হাসছেন। আমি দ্রুত হযরত শেখের পদপ্রান্তে লুটায়ে পড়লাম। হযরত শেখ বললেন, আস, আস, হে হাকীকতের মানুষ। এখানে আস এবং এক মুহূর্ত আমার সঙ্গে রহস্যালাপ কর। অতঃপর আমি হযরত শেখের খেদমতে বায়াত হওয়ার প্রার্থনা করলাম, তিনিও আমাকে তাঁর মুরিদ হওয়ার সৌভাগ্য দান করলেন।
মোর্শেদের সাথে মহব্বত  : হযরত আমীর খসরু রাঃ কেবল একজন শা’এরই ছিলেন না, বরং শাহী দরবারেও তাঁর যথেষ্ট মর্যাদা ও সম্মান ছিল। তাছাড়া তিনি একজন ধনবান ব্যক্তিও ছিলেন। কিন্তু এত ঐশ্বর্যবান মর্যাদাশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অতি নম্র ও ভদ্র ছিলেন বেং অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। আর হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ এর খেদমতে একজন নগণ্য খেদমতগাররূপে থাকতেন। পীর-মোর্শেদের প্রত্যেকটি হুকুম পালন করাকে নিজের সর্বপ্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন। হযরত খাজা সাহ্বেও অন্তরের সাথে তাঁকে স্নেহ করতেন। হযরত আমীর খসরু মোর্শেদের তালিম ও সোহবতের প্রভাবে একাধারে চল্লিশ বছর কাল রোজা রেখেছিলেন। শা’এরীর কারণে তিনি সকলের প্রিয় ছিলেন।
হযরত আমীর খসরূ স্বরচিত শে’এর গুলো হযরত শেখকে আবৃত্তি করে শুনাতেন, তার মধ্যে যে বয়েতটি হযরত খাজা সাহেবের অধিক পছন্দ হত, তা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করতেন। কাউয়ালীর মজলিশে হযরত আমীর খসরু রাঃ স্বরচিত গজলসমূহ অতি গুরুত্বসহকারে পাঠ করতেন। তাছাড়া তিনি হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ এর প্রশংসায়ও বহু শে’এর রচনা করেছেন। তিনি পূর্ণরূপে মোর্শেদের আশেক ছিলেন।
মাহবুবে এলাহীর মাহবুব  : হযরত পীর সাহেবও আমীর খসরুর সাথে গভীর মহব্বত রাখতেন। তিনি বলতেন, শরিয়তে অনুমতি থাকলে আমি অসিয়ত করতাম যে, আমির খসরুকে মৃত্যুর পর আমার কবরের সঙ্গে দাফন করে দিও। যেন আমরা দুইজনে একস্থানে থাকতে পারি। তবুও তিনি এতটুকু অসিয়ত করেছিলেন যে, আমার ইন্তেকালের পর আমীর খসরু বেশি দিন বাঁচবে না। তাঁর ইন্তেকাল হলে তাঁকে তোমরা আমার মাজারের পাশে দাফন করিও। কেননা, সে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, আমি তাঁকে সঙ্গে না নিয়ে বেহেশতে পা রাখব না।
হযরত মোর্শেদ কেবলার ইন্তেকালের সময় হযরত আমীর খসরু রাঃ সুলতান মোহাম্মদ তোগলকের সাথে বাংলাদেশে ছিলেন। একদা হঠাৎ তাঁর মনের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে তিনি সুলতানের নিকট হতে অনুমতি গ্রহণপূর্বক তৎক্ষণাঃ দিল্লী যাত্রা করলেন। দিল্লী পৌঁছে জানতে পারলেন যে, পীর-মোর্শেদ কেবলা স্বীয় মাহবুবে হাকীকীর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছেন। মোর্শেদের ইন্তেকালের সংবাদ শুনে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং অতি কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেন। তারপর সমুদয় ধন-দৌলত গরিব মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করে শোকের লেবাস পরিধান করে হযরত পীর সাহেব কেবলার মাজারের কাছে যান। মাজারের নিকটবর্তী হতেই হযরত আমীর খসরু বিহ্বল অবস্থায় মাজারের উপর ঝাঁপায়ে পড়ে চিৎকার করে বললেন, সোবহানাল্লাহ ! সূর্য জমিনের নিচে হেলে গিযেছে, আর খসরু এখনও জীবিত। একথা বলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
সেদিন হতে তিনি শোকে এত কাতর ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন যে, মৃত্যুমুহূর্ত পর্যন্ত কেহ কোন সময় তাঁর মুখে মৃদু হাসিও দেখতে পায়নি। মোর্শেদের ইন্তেকালের পর তিনি মাত্র ছয় মাস জীবিত ছিলেন। অবশ্য মোর্শেদের অসিয়ত অনুযায়ী তাঁকে তাঁর মাজারের পার্শ্বে দাফন করা হয়নি। লোকে পীর সাহেব কেবলার মাজারের পার্শ্বে দাফন করতে চেয়েছিল। কিন্তু জনৈক খোজা, যিনি হযরত শেখের মুরিদ এবং সুলতান মোহাম্মদ তোগলকের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন, তিনি এই বলে বাধা প্রদান করলেন যে, মুরিদান ও জেয়ারতকারীগণ হযরত শেখ ও আমীর খসরুর কবরের মধ্যে প্রভেদ করতে পারবে না, তারা ধোঁকায় পতিত হবে। সুতরাং হযরত আমীর খসরু রাঃ কে হযরত শেখের মাজারের বেদীর নিচে মুরিদানের কবরস্তানে দাফন করা হল।
মাহবুবে এলাহীর বাদশাহগণ হতে অভাবশূন্যতা : হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ সর্বদা রাজা বাদশাহগণের সংসর্গ হতে দূরে থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাও পছন্দ করতেন না। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই নিয়ম মেনে চলেছেন।
সুলতান আলাউদ্দীনের ভক্তি : সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী হযরত খাজা সাহেবকে অতিশয় ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। হযরত খাজা সাহেবের দর্শন লাভের জন্য তাঁর মনে প্রবল আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন যে, খাজা সাহেব তাঁর চিরন্তন নীতি অনুযায়ী কোন বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করতেন না। তা সত্ত্বেও তিনি হযরত শেখের কাছে বলে পাঠালেন যে, হুজুর একবার রাজধানীতে তশরিফ এনে আমাদের ধন্য করুন। হযরত শেখ তদুত্তরে বলে পাঠালেন, আমি এক কোণে পড়ে রযেছি, আপনার কোন ক্ষতি করছি না। বাদশাহ ও সমস্ত মুসলমানদের জন্য দোয়া করছি। এতদ সত্ত্বেও যদি বাদশাহ আমাকে সাক্ষাৎ করার জন্য পীড়াপীড়ি করেন, তাহলে আমি অন্য কোথাও চলে যাব।
সুলতান হযরত শেখের এই জবাব পেয়ে পুনরায় বলে পাঠালেন, হুজুর যদি রাজদরবারে আসতে না চান, তবে আমি নিজেই হুজুরের খেদমতে হাজির হয়ে যাব। হযরত খাজা সাহেব এর জবাব পাঠালেন যে, আপনি কষ্ট করে এখানে আসবেন না। আমি এখান হতে আপনাকে দোয়া করছি, অদৃশ্যে থেকে দোয়া করলে তা অধিক কার্যকরী ও ফলপ্রদ হয়ে থাকে। তাছাড়াও বলে পাঠালেন যে, আমার ঘরের দুটি দরজা আছে। আপনি এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে আমি অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যাব।
এ সমস্ত পত্রালাপের পরেও হযরত শেখ সাহেবের প্রতি বাদশাহর ভক্তি ও শ্রদ্ধার বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায়নি। হযরত শেখও সর্বদা বাদশাহ আলাউদ্দীন খিলজীর মঙ্গলের ও উন্নতির জন্য দোয়া করতেন। খুব সম্ভব হযরত শেখের দোয়ার বরকতেই আলাউদ্দীন খিলজী বিশাল রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন এবং জয়ের পর জয় করতে লাগলেন। চেঙ্গিশ খাঁর সৈন্যবাহিনী যখন দিল্লী অবরোধ করে ফেলে, তখন বাদশাহর সৈন্যদল শহরে ছিল না। সুতরাং তখন দিল্লী অধিকার করে লওয়া তাতারীদের পক্ষে কোনই কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু হযতর খাজা সাহেবের দোয়ার বরকতে শত্রু সৈন্যদের মনে এমন বয়ের উদয় হল যে, তরা অবরোধ উঠায়ে পলায়ন করল।
সুলতান আলাউদ্দীনের পুুত্র শাহজাদা খেযের খাঁ হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ এর মুরিদ ছিলেন। তিনি পিতার নির্দেশ অনুসারেই হযরত খাজা সাহেবের মুরিদ হয়েছিলেন।
সুলতান আলাউদ্দীন একজন বিজ্ঞ, সুবিচারক এবং খোদাভক্ত সম্রা ছিলেন। একবার তিনি হযরত সুলতানুল আউলিয়াকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে একখানা পত্র লিখলেন। হযরত আপনি বিশিষ্ট ও সাধারণ সকলেরই শ্রদ্ধেয়, আপনার উসিলায় মানুষের দ্বীন দুনিয়ার সকল মাকসূদ পূর্ণ হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা আমাকে রাজ্য দান করেছেন, আমার সামনে রাজ্য সংক্রান্ত কোন প্রয়োজন উপস্থিত হলেই আমি হুজুরকে জানাব, আপনি কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ অনুযায়ী আমাকে পরামর্শ দিবেন। যাতে আমার ও প্রজাবৃন্দের মঙ্গল হয়। অতঃপর পত্রখানি তিনি স্বীয় কনিষ্ঠ পুত্র খেজের খানের মাফত হযরত শেখের খেদমতে পাঠালেন এবং বলে দিলেন, হযরত শেখ এর উত্তরে কি বলেন তা আমাকে এসে জানাবে। খেজের খান চিঠিটি হযরত পীর সাহেবের খেদমতে পৌঁছায়ে দিলেন।
হযরত শেখ পত্রখানি পাঠ করে মজলিশে সকলকে সূরা ফাতেহা পাঠ করতে বললেন। অতঃপর বললেন, রাজা বাদশাহর সঙ্গে ফকিরদের কি সম্পর্ক? আমি ফকির মানুষ, শহরের এক নির্জন কোণে থেকে বাদশাহ ও মুসলিম জনসাধারণের জন্য নেক দোয়া করছি। বাদশাহ এ ব্যাপারে পুনরায় আমাকে অনুরোধ করলে আমি এই রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে যাব। সুলতান আলাউদ্দীন পুত্রের মুখে হযরত খাজা সাহেবের এই উত্তর জেনে অত্যন্ত খুশি হলেন
সুলতান আলাউদ্দিন বহু অনুরোধ উপরোধ করেও যখন হযরত খাজা সাহেবকে নিজ দরবারে আনতে ব্যর্থ হলেন, তখন তাঁকে দরবারে আনার জন্য অন্য এক কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি হযরত শেখের খেদমতে লোক পাঠায়ে আবেদন জানালেন, কয়েকদিন হল আমার ভ্রাতা আলেক খান ও মালেক কাফুরকে ওয়ারাঙ্গল বিজয়ের জন্য পাঠায়েছি কিন্তু সৈন্যবাহিনীর কোন জয় পরাজয়ের সংবাদ পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় হুজুর রাজধানীতে এসে তাদের জন্য একটু দোয়া করলে এবং স্বীয় বাতেনী নূরের আলোকে তাদের অবস্থা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করলে আমার বড়ই উপকার হত।
হযরত খাজা সাহেব তার উত্তরে খাজা সাহেব কে বলে পাঠালেন, বাদশাহের দরবারে আমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ইনশাআল্লাহ আগামী কাল দ্বিপ্রহরের পূর্বেই বাদশাহ যুদ্ধ বিজয়ের সংবাদ পাবেন এবং এর অনতিপরেই তাঁর ভ্রাতা আলেক খাঁন এবং মালেক কাফুর গণিমতের মাল ও সেনাবাহিনীসহ নিরাপদে এসে পৌঁছবেন। অতঃপর হযরত শেখের কথা সত্য প্রমাণিত হলে বাদশাহ আনন্দিত হয়ে তাঁর খেদমতে পাঁচ সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা নজরানাস্বরূপ প্রেরণ করলেন। এই মুদ্রাগুলো যখন শেখের কাছে পৌঁছল, তখন তাঁর মজলিশে এসকেন্দিয়ার অধিবাসী কালান্দর নামের এক দরবেশ উপস্থিত ছিলেন। তিনি উক্ত মুদ্রাগুলো তাঁকেই দিয়ে দিলেন।
হযরত সুলতানুল আউলিয়ার দেহ হতে এক প্রকার অপূর্ব সুঘ্রাণ ছড়াত। একদিন দিল্লীর কোতোয়াল হযরত মাওলানা জহিরুদ্দীন হযরত সুলতানুল আউলিয়ার দরবারে এসে চন্দনের সুবাস পেতে লাগলেন। তিনি মনে করলেন হযরত খাজা সাহেবের ঘরে চন্দন কাঠ জ্বালান হচ্ছে। মাওলানা জহিরুদ্দিন সাহেব ও তাঁর সঙ্গীয় খাদেমগণ ইতস্ততঃ দৃষ্টি করে দেখতে লাগলেন কোথায় চন্দন কাঠ জ্বলছে তার উৎস। হযরত শেখ তাঁদের মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, মাওলানা এটা চন্দন কাঠের সুঘ্রাণ নয়, বরং তা এক অলৌকিক বস্তুর সুঘ্রাণ।
হযরত খাজা সাহেবের মোর্শেদ হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জেশকর রাঃ যে কম্বল তাঁকে দান করেছিলেন তিনি তা কাজী মুহিউদ্দীন সাহেবকে দান করে দেন। আদান প্রদানের সময় তা হতে এক আশ্চর্য রকমের খোশবু ছড়ায়ে পড়ল। কাজী সাহেব মনে করলেন এতে হয়ত কোন সুগন্ধ দ্রব্য মাখান হয়েছিল। তা তারই খোশবু, কিছু দিনের মধ্যেই তা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু দীর্ঘকাল পরেও যখন উক্ত সুগন্ধ না কমে বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। তখন তিনি প্রকৃত ব্যাপার উদঘাটন করার জন্য কম্বলখানি উত্তমরূপে কেঁচে প্রখর রোদে শুকালেন। তাতেও তার সুঘ্রাণ কমল না, বরং আরও বৃদ্ধি পেল। অতএব, তিনি কম্বলখানি নিয়ে হযরত খাজা সাহেবের কাছে গমন করে তাঁকে এ বিষয়ের রহস্য জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত খাজা সাহেব বললেন, কাজী সাহেব ! পানি, সোডা-সাবান, বায়ু কিংবা কোন বস্তুই এই সুঘ্রাণ দূর করতে পারবে না। কেননা, তা আল্লাহর মহব্বতের খোশবু। আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাহবুবদের এই খোশবু দান করে থাকেন।
সুলতানুল আউলিয়া রাঃ সর্বদা রোজা রাখতেন। সন্ধ্যাকালে যৎসামান্য বাসি রুটি দিয়ে ইফতার করতেন। তাও না পেলে অনাহারে কাটাতেন। এই অবস্থা দেখে তাঁকে এক মুরিদ একদিন কিছু খাবার সঙ্গে নিয়ে হযরত শেখের খেদমতে আসলেন এবং আরজ করলেন, হুযুর ! এভাবে অনাহারে থাকলে আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন। তিনি খাদেমের ভক্তি ও আবেগপূর্ণ আবেদনের উত্তরে বললেন, কত দরিদ্র ও মিসকীন মসজিদে অনাহারে পড়ে আছে তাদের কথা মনে পড়লে আমার গলা দিয়ে খাবার নিচের দিকে যায় না। তোমার খাবার তুমি নিয়ে যাও।
কুতুবুদ্দীন মোবারক শাহ যে সময় দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন, সেই সময় হযরত সুলতানুল আউলিয়ার বযুর্গী ও খ্যাতি সারা দেশময় ছড়ায়ে পড়েছিল। তা কুতুবুদ্দীনের সহ্য হল না। তিনি পরশ্রীকাতরতার বশীভূত হয়ে হযরত খাজা সাহেবের মুরিদ সুলতান আলাউদ্দিনের পুত্র খেযের খাঁকে হত্যা করায়ে ফেলল এবং হযরত খাজা সাহেব ও তাঁর মুরিদবর্গকে নানা প্রকারে যন্ত্রণা ও কষ্ট প্রদান করতে লাগলেন। একদিন সুলতান তাঁর খাস মন্ত্রী কাজী গজনবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাজী সাহেব ! শুনতে পেলাম নিজামুদ্দীন আউলিয়ার লঙ্গরখানায় প্রত্যহ দুই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় হয়। এত টাকা আসে কোথা হতে ? কাজী সাহেব ও মনে মনে হযরত সুলতানুল আউলিয়ার প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করতেন। শত্র“তা উদ্ধারের সুবর্ণ সুযোগ মনে করে তিনি বললেন, রাজ্যের আমীর ওমারা ও রাজ কর্মচারীগণই তো তাঁর লঙ্গরখানার এই বিরাট খরচ জোগাচ্ছেন। একথা শুনে সুলতান ঘোষণা করলেন, রাজ্যের আমীর ওমারা ও রাজকর্মচারীদের মধ্যে কেহ নিজামুদ্দীন আউলিয়ার কাছে যাতায়াত করলে সে চাকরী হতে বহিষ্কৃত হবে এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে। আর কোন শাহযাদা সেখানে যাতায়াত করলে তার ভাতা বন্ধ করে দেয়া হবে।
বাদশাহর এই ঘোষণায় ওমারাদের যাতায়াত এবং হাদিয়া তোহফা বন্ধ হয়ে গেল। হযরত সুলতানুল আউলিয়া তা জানতে পেরে লঙ্গরখানার তত্ত্বাবধায়ক খাজা ইকবালকে বললেন, আজ হতে লঙ্গরখানার ব্যয় দ্বিগুণ করে দাও। অর্থের প্রয়োজন হলে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ঐ তাকে হাত দিলেই তোমার প্রয়োজন পরিমাণ টাকা পাবে। হযরত সুলতানুল আউলিয়ার আদেশ অনুযায়ী লঙ্গরখানার ব্যয় পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ হতে লাগল। এই সংবাদ বাদশাহর কানে গেলে তিনি প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করলেন। গুপ্তচর অনুসন্ধানের পর বাদশাহকে জানালেন যে, হযরত সুলতানুল আউলিয়ার নির্দেশ মত প্রত্যহ ঘরের একটি তাকের উপর হতে খরচের টাকা উঠায়ে নেয়া হয়। বাদশাহ তা অবগত হয়ে লজ্জিত হলেন।
একবার বাদশাহ হযরত খাজা সাহেবকে বলে পাঠালেন, হযরত শেখ রুকনুদ্দীন বছরে অন্ততঃ একবার মুলতান হতে এসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর আপনি দিল্লীতে থেকেও আমার দরবারে কখনও আসেন না। হযরত সুলতানুল আউলিয়া বাদশাহর এ কথার জবাবে লিখে পাঠালেন, রাজা বাদশাহদের সাথে সাক্ষাৎ করা আমার পীর ও মোর্শেদের রীতি নয়। বাদশাহ এই জবাবে ক্রোধান্বিত হয়ে তৎক্ষণাৎ হযরত শেখ কে লিখে পাঠালেন, রাজা বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করা আমার পীর ও মোর্শেদের রীতি নয়। বাদশাহর এই জবাবে ক্রোধান্বিত হয়ে তৎক্ষণাৎ হযরত শেখকে বলে পাঠালেন, আমার নির্দেশ আপনাকে অবশ্যই মান্য করতে হবে।
বাদশাহর এইরূপ দৃঢ় নির্দেশ পেয়ে হযরত খাজা সাহেব তাঁর এক খাদেমকে বাদশাহর পীর হযরত মাওলানা যিয়াউদ্দীন রূমীর কাছে এই বলে পাঠালেন যে, আপনি বলে দিন, বাদশাহ যেন ফকির দরবেশদের উত্যক্ত না করে। খাদেম তথায় পৌঁছে দেখল, মাওলানা রূমী মৃত্যু শয্যায় শায়িত, কাজেই সেদিক হতে কোন লাভই হল না। হযরত মাওলানা রূমীর ইন্তেকালের পর তার ফাতেহায় দেশের আলেম, ফাযেল, আউলিয়া, দরবেশ সকলেই উপস্থিত হন, স্বয়ং বাদশাহও এই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। হযরত সুলতানুল মাশায়েখ মজলিসে উপস্থিত হওয়া মাত্র সকলেই উঠে দাঁড়ালেন কিন্তু বাদশাহ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের ভান করে বসে থাকলেন। উপস্থিত আলেম ও আউলিয়াদের কেহ কেহ হযরত সুলতানুল মাশায়েখকে বললেন, বাদশাহ উপস্থিত রয়েছেন, আপনার তাকে সালাম করা উচিত। তিনি বললেন, বাদশাহ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করছেন, তাতে বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়।
হযরত সুলতানুল আউলিয়ার প্রতি সকলের সম্মান প্রদর্শনের দৃশ্য দেখে এতদ্ভিন্ন হযরত শেখ তাঁকে সালাম না করায় বাদশাহ মনে মনে তাঁর প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট হলেন।
এই ঘটনার পর বাদশাহ দেশের সমস্ত আলেম ফাযেল ও আউলিয়া দরবেশকে একত্রিত করে বললেন, আপনারা নিজামুদ্দীন আউলিয়াকে বলে দিন, তিনি যেন প্রত্যহ একবার আমার দরবারে হাজিরা দেন। না পারলে সপ্তাহে একবার, তাও না পারলে অন্ততঃ মাসে একবার। আর এর উত্তরে তিনি কি বলেন, তাও আমাকে অবশ্যই জানাবে। আগন্তুক আলেম ও দরবেশরা সমবেতভাবে হযরত খাজা সাহেবকে বললেন, বাদশাহকে অসন্তুষ্ট করা সমীচীন নয়। তাদের কথা শুনে তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ ! এর অর্থ সকলে ধরে নিলেন যে, তিনি বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হয়েছেন। সুতরাং তারা বাদশাহকে এই মর্মে সংবাদ জানালেন। তা সফর চাঁদের ২৭ তারিখের ঘটনা। এই দিন সন্ধ্যায় বাদশাহ হযরত খাজা সাহেবের আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।
সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে শেখ ওয়াজীহুদ্দিন কোরায়শী এবং আমীর খসরুর ভ্রাতা আইজুদ্দিন উভয়ে একত্রে হযরত নিজামুদ্দীন রাঃ এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, হুজুর ! শুনতে পেলাম আপনি নাকি বাদশাহর সাথে দেখা করতে সম্মত হয়েছেন ? উত্তরে তিনি বললেন, আপনারা এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, আমি কোন অবস্থায়ই আমার পীর-মোর্শেদের রীতি বিরুদ্ধ কাজ করব না। এই জবাব শুনে তাঁরা উভয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। এক দিকে তো বাদশাহ তাঁর সাক্ষাৎ লাভের অপেক্ষা করতেছেন অথচ তিনি কিছুতেই বাদশাহর দরবারে যেতে রাজী নন।এর ফলে বাদশাহর তরফ হতে বিপদের আশঙ্কায় তাঁর চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হযরত সুলতানুল মাশায়েখ তাঁদের মনোভাব আঁচ করতে পেরে বললেন, আমার উপর বাদশাহর কোন ক্ষমতাই চলবে না। আপনারা সে সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকুন। অপর দিকে এই দিন সুলতানুল আউলিয়াকে দরবারে না দেখে বাদশাহ ভাবলেন, এই মাস তো প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে, আগামী মাসের প্রথম তারিখে অবশ্যই তিনি আসবেন।
লঙ্গরখানার পরিচালক খাজা ইকবাল হযরত নিজামুদ্দীন রাঃ এর কাছে আরজ করলেন, হুজুর ! চন্দ্র উদয় দিবসে তো বাদশাহর সাথে আপনার সাক্ষাৎ করার কথা। তাবাররুক স্বরূপ সাথে কি নিতে হবে আমাকে আদেশ করুন। হযরত খাজা সাহেব একথার কোনই উত্তর দিলেন না। পর পর তিনবার একই কথা জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর না পেয়ে খাজা ইকবাল বুঝলেন যে, হযরত পীর সাহেব কেবলা বাদশাহর দরবারে যাবেন না।
মাহবুবে এলাহী হযরত সুলতানুল আউলিয়ার শত্র“ বাদশাহর সফর মাসের ২৯ তারিখ দিবাগত রাত দ্বিপ্রহর অতীত হওয়ার পর আততায়ীর অতর্কিত হামলায় স্বীয় শয্যায়ই নিহত হন। আল্লাহ পাক এইরূপে হযরত সুলতানুল আউলিয়ার শত্র“কে ধ্বংস করে দিলেন এবং তাঁকে স্বীয় পীর-মোর্শেদের তরিকার উপর বহাল থাকতে সাহায্য করলেন।
হযরত সুলতানুল মাশায়েখ নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ গিয়াসপুর হতে পায়ে হেঁটে কিলুখড়িতে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করতেন। একদিন তিনি মনে মনে ভাবলেন, একটি ঘোড়া হলে জুমার নামাজ পড়ার জন্য কিলুখড়িতে যাওয়া আমার পক্ষে সহজ হত। পরদিনই নূরুদ্দিন মালিক তাঁর দরবার উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, হযরত ! গত রাতে আমার পীর আমাকে নির্দেশ দিয়েছে যে, তোমার সব কটি ঘোড়া হযরত সুলতানুল মাশায়েখকে নজরানাস্বরূপ দিয়ে আস। তিনি জুমার নামাজ পড়ার জন্য কিলুখড়ি যেতে অসুবিধা বোধ করছেন। এই নির্দেশ পেয়ে আমি আমার সবকটি ঘোড়াই হযরতের খেদমতে হাজির করেছি। আপনি অনুগ্রহ করে ঘোড়াগুলি গ্রহণ করুন। হযরত সুলতানুল মাশায়েখ বললেন, তুমি তোমার পীরের নির্দেশ পালন করেছ, কিন্তু আমিও আমার পীরের অনুমতি ব্যতীত তোমার এই হাদিয়া গ্রহণ করতে পারি না। পরবর্তী রাতে হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন গঞ্জেশকর রাঃ স্বপ্নযোগে তাঁকে বললেন, শেখ নূরুদ্দীন মালিক আমারই অন্যতম মুরিদ। তোমার জন্য ঘোড়া নিয়ে যেতে আমিই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছি। তুমি সাগ্রহে তা গ্রহণ কর। অতঃপর হযরত নিজামুদ্দীন রাঃ সানন্দে ঘোড়াগুলি গ্রহণ করেন।
একবার কয়েকজন লোক হযরত খাজা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার পথে তাঁর খেদমতে হাদিয়ারূপে পেশ করার জন্য বাজার হতে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকারের জিনিস ক্রয় করল। তাদের মধ্যে একজন তালেবে এলম ছিল। সে ভাবল অনর্থক পয়সা ব্যয় করে কি হবে ? সকলের হাদিয়ার সাথে খাদেম তার পোটলাটিও উঠায়ে নিয়ে যাবে। কে কি দিল তা কি আর তিনি খুঁজে দেখবেন ? অতএব, সে এক টুকরো কাগজে কিছু মাটি বেঁধে নিল। অতঃপর সে তার পুরিয়াটি সকলের হাদিয়ার সাথে হযরতের খেদমতে পেশ করল। খাদেম এসে হাদিয়াগুলো উঠায়ে নিতে আরম্ভ করলে হযরত খাজা সাহেব বললেন, কাগজের এই পুরিয়াটি এখানে রেখে যাও, এতে যে সুরমা রয়েছে তা আমি চোখে লাগাবার জন্য নিজের কাছে রাখব। একথা শুনে উক্ত তালেবে এলম লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে হযরত খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে লুটায়ে পড়ল। তওবা করল। হযরত শেখ তার প্রতি সদয় হয়ে বললেন, তোমার কিসের প্রয়োজন তা আমাকে বল। সে ভয়ে ও লজ্জায় কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু পরে সে হযরতের নেক দৃষ্টির ফলে কামেল হয়েছিল।
একদিন এক ব্যক্তি বুন্দীবাসী শেখ মোহনের বাড়ীর সামনে দিয়ে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিল। শেখ মোহন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ ? সে বলল, হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য দিল্লী যাচ্ছি। তিনি বললেন, হযরত শেখকে আমার সালাম জানায়ে বলো, প্রত্যেক জুমার রাতে আমি কাবা শরীফে তাঁর সাথে মিলিত হয়ে থাকি। একথা শুনলেই তিনি আমাকে চিনতে পারবেন।
হযরত সুলতানুল আউলিয়ার দুনিয়া ব্যাপী খ্যাতি দেখে মক্কা শরীফের কয়েকজন বুযুর্গ ব্যক্তি তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, আফসুস ! এমন একজন বিশ্ববিখ্যাত বুযুর্গ হয়েও আজ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর ঘর জেয়ারত করতে আসলেন না। সেখানে উপস্থিত অপর একজন বুযুর্গ- যিনি চল্লিশ বছর ধরে মক্কা শরীফে বসবাস করতেছিলেন। তিনি বললেন, তোমরা ভুল বলছো, হযরত নিজামুদ্দীন রাঃ প্রায়ই ফজরের নামাজ প্রথম ওয়াক্তে কাবা শরীফে পড়ে থাকেন। একথাটি সাধারণের মধ্যে প্রচার হয়ে পড়ল। এদেশীয় হাজীগণ তা শুনে এসে হযরত সুলতানুল আউলিয়ার মুরিদানদের কাছে বর্ণনা করেন। কিন্তু কোন মুরিদই কোন দিন একথা হযরত শেখের কাছে প্রকাশ করার সাহস পাননি।
মাহবুবে এলাহীর কার্যাবলী : হযরত মাহবুবে এলাহীর ফয়েজ ও বরকতের তোফায়েলে দেশে এক ব্যাপক চারিত্রিক ও সামাজিক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছিল। সুলতান আলাউদ্দিন খালজীর জামানায় খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, শেখ আলাউদ্দীন ও শেখ রুকনুদ্দীন রাঃ এর মত অতি উচ্চ পর্যায়ের সুফীয়ানে কেরাম বিদ্যমান ছিলেন। তাঁদের বাতেনী আনওয়ারের আলোকে জগৎ আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। সহস্র সহস্র মানুষ তাঁদের হাতে বায়াত হয়ে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় জাহানের সাফল্য অর্জন করেছিলেন। জনগণের কাজ কর্ম ও আচার ব্যবহারে সততা সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের আখলাক ও আদতের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রাঃ বাইয়াতের দরজা সাধারণভাবে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তিনি পাপাচারী লোকদের দরবেশী খেরকা পরায়ে দিতেন। তাদের তওবা করায়ে নিজের মুরিদানদের মধ্যে শামিল করায়ে নিতেন। তাঁর কাছে বায়াত গ্রহণের কারণে বহু লোক মন্দ কাজ হতে বিরত হয়েছিল এবং ইবাদতের প্রতি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ হয়েছিল।
হযরত খাজা সাহেব কদাচ কোন দুনিয়াদারের ছায়া মাড়াতেন না। দুনিয়া ও দুনিয়াদারদের কোন বিষয় সম্বন্ধে কিছু শ্রবণ করা তিনি পছন্দ করতেন না। সে সময় এমন কোন মহল্লা ছিল না যেখানে মাসে দুই একবার নেককার লোকদের মজলিস কিংবা কাউয়ালীর মজলিস অনুষ্ঠিত হত না।
ইন্তেকাল : ৭২৫ হিজরীর সালে তিনি পীড়িত হয়ে পড়েন। তিনি অধিকাংশ সময় ইবাদতে ও রিয়াজতে মশগুল থাকতেন এবং প্রায় সময়ই রোজা রাখতেন। সুতরাং শারীরিক দিক হতে খুব দুর্বল ছিলেন। এই সময় রোগের কারণে আরো দুর্বল হয়ে পড়লেন। তদুপরি বয়স নব্বই বছরের নিকটবর্তী হয়েছিল। কাজেই পীড়িত থাকাকালে তাঁর শারীরিক দুর্বলতা খুব দ্রুত বেড়ে চলল। ওফাতের চল্লিশ দিন পূর্ব হতে তিনি পানাহার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেছিলেন। ঔষধপত্রের প্রতি তাঁর আদৌ মনোযোগ ছিল না। তাঁর দু’চোখ সব সময় অশ্রুসিক্ত থাকত। অধিকাংশ সময় তিনি রোদন করতেন। অত্যধিক রোদনের কারণে চেহারা মোবারকের উপর যখমের ন্যায় দাগ পড়েছিল। রোগের সময়ে তাঁর রোদনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। চোখ হতে অবিরত ধারায় অশ্র“ প্রবাহিত হত। খানাপিনার জন্য পীড়াপীড়ি করলে তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর দীদার লাভের জন্য পাগল, তার আবার খানাপিনার প্রয়োজন কিসের?
ঔষধ সেবনের জন্য পীড়াপীড়ি করলে তিনি ঔষধ সেবন না করে বরং বলতেন, এশকের ব্যথায় ব্যথিত ব্যক্তির ঔষধ মাসুকের দীদার ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুলতান মোহাম্মদ তোঘলক খাজা সাহেবের রোগ ক্রমশঃ বৃদ্ধির কথা জানতে পেরে শাহী চিকিৎসকে তাঁর চিকিৎসার জন্য পাঠালেন। আর এও বলে পাঠালেন যে, আপনার রোগের অবস্থায় আপনাকে একটু দেখার আমার একান্ত আগ্রহ, অনুমতি পেলে কদমবুসির জন্য হাজির হতে পারি।
যখন শাহী চিকিৎসক আসলেন তখন হযরত খাজা সাহেব অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। মাঝে মাঝে একটু চেতনা প্রাপ্ত হয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। জ্ঞানপ্রাপ্ত অবস্থায় শিয়রে উপস্থিত মুরিদগণকে জিজ্ঞাসা করতেন, আমি কি নামাজ পড়েছি? যদি উত্তর দেয়া হত যে, আপনি নামাজ পড়েছেন। তাতে তিনি কর্ণপাত না করে পুনরায় নামাজ পড়তে শুরু করতেন।
ইন্তেকালের দিন তিনি সাইয়্যেদ হুসাইন কেরমানীকে বললেন, আমি লঙ্গরখানার পরিচালক ইকবালকে বলে দিয়েছিলাম যে, লঙ্গরখানায় যেন কোন খাদ্য দ্রব্য অবশিষ্ট না থাকে, সব কিছু গরিব দুঃখীদের মাঝে বিলায়ে দেয়া হয়। অন্যথায় তার জন্য তুমিই দায়ী হবে। তুমি তদন্ত করে দেখ তো আমার আদেশ পালন করা হয়েছে কি না? তিনি তদন্ত করে দেখলেন, খানকায় অবস্থানকারী দরবেশদের পরবর্তী বেলার খোরাকের জন্য খাযাঞ্চী কিছু পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য রেখে দিয়েছেন। তিনি হযরত খাজা সাহেবকে তা জানালেন। তাতে হযরত খাজা সাহেব খুবই অসন্তুষ্ট হলেন এবং তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিলেন সমস্ত গুদাম ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেল এবং জমিনের এই ধুলা (শষ্য) বিতরণ করে দাও এবং প্রত্যেকটি মাল-গুদাম ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করে ফেল। সঙ্গে সঙ্গে হযরতের আদেশ পালন করা হল।
শাহী চিকিৎসক হযরত খাজা সাহেবের শয্যাপার্শ্বে পৌঁছলে তিনি চক্ষু বন্ধ করে নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসক তাঁর শিরায় হাত রাখলে তিনি চক্ষু খুললেন। তাঁকে বলা হল যে, সুলতান তার শাহী তবীরকে আপনার চিকিৎসার জন্য পাঠায়েছেন। তিনি এর কোনই উত্তর দিলেন না। নীরবে তবীরের চেহারার প্রতি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। অতঃপর ক্ষীণ স্বরে বললেন, এশকের ব্যথায় ব্যথিত ব্যক্তির ঔষধ মাশুকের দীদার ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওফাতের একটু পূর্বে নিজের খাস পুটলী হতে কোন কোন বস্তু বের করে খলিফাগণকে দান করলেন এবং তাদের কে বিশেষ বিশেষ স্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দান করেন। প্রধান খলিফা শেখ নাসীরুদ্দীন চেরাগে গেহলভীকে হযরত বাবা গঞ্জেশকর রাঃ প্রদত্ত খেরকা, মুসল্লা, কাঠের পাত্র এবং তসবীহ দান করে আদেশ করলেন, তুমি দিল্লীতে থেকে লোকের জুলুম অত্যাচার সহ্য করতে থাক।
সুলতান গিয়াসুদ্দীনের পর সিংহাসনের অধিপতি সুলতান মোহাম্মদও শেখ রুকনুদ্দীন রাঃ এর সাথে সেই সম্পর্ক কায়েম রেখেছিলেন। তিনি খাজা সাহেবের ইন্তেকালের পূর্বে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁকে বলেন, আম্বিয়ায়ে কেরামকে আল্লাহ তায়ালা মৃত্যু ও বেঁচে থাকার মধ্যে স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন। আউলিয়ায়ে কেরাম যেহেতু আম্বিয়ায়ে কেরামেরই স্থলবর্তী সুতরাং তারাও ইচ্ছা করলে মৃত্যু ও বেঁচে থাকার মধ্যে স্বাধীনত পেতে পারেন। আমার আরজ, আপনি যদি আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতেন তা হলে বহু অপূর্ণকে পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে দিতে পারতেন।
একথা শুনে হযরত খাজা মাহবুবে এলাহীর দু’চোখ অশ্র“পূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ আমাকে বলছেন, নিজাম ! তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমি আগ্রহান্বিত। একথা শুনে হযরত শেখ রুকনুদ্দীন এবং উপস্থিত সকল ব্যক্তি কেউ অশ্র“ সংবরণ করতে পারলেন না।
ফজরের নামাজের পর হযরত খাজা সাহেব বললেন, হযরত শায়খুল আলম তসরীফ এনেছেন, আমাকে তাঁর তাজিমের জন্য উঠাও। আমরা তাঁকে ধরে উঠাবার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। এমন সময় হযরত নীরব হয়ে গেলেন। নিঃশ্বাসের গতি বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বুঝতে পারলাম, সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। তখন চাশতের সময় ছিল। সেই মহাশোকের দিনটি ছিল ৭২৫ হিজরির রবিউল আখের চাঁদের ১৮ তারিখ।
মাজার শরীফ : ইন্তেকালের সংবাদ পেয়ে সুলতান মোহাম্মদ তোগলক ও হযরত রুকনুদ্দীন সাহরাওয়ার্দী রাঃ তশরিফ আনেন। সুলতান হযরত খাজা সাহেবের চৌকির নিকটে এসে চেহারা মোবারকের কাপড় উন্মোচন করলেন এবং খুব কাতর হয়ে রোদন করলেন। অতঃপর মুরিদানকে জিজ্ঞাসা করলেন, দাফনের এন্তেজাম কোথায় হবে ? সাইয়্যেদ হুসাইন কেরমানী রাঃ বাদশাহর সামনে অগ্রসর হয়ে বললেন, হযরত খাজা সাহেব তাকে খানকাহর সামনের পুকুরে দাফন করার জন্য অসিয়ত করে গেছেন। বাদশাহও তা পছন্দ করলেন এবং শাহী শ্রমিকদের আনার জন্য আদেশ করলেন। শাহী শ্রমিকরা অল্প সময়ের মধ্যে পুকুর ভরাট করে ফেলল। অতঃপর সেই স্থানে হযরত শেখ সুলতানুল আউলিয়াকে দাফন করা হল এবং মাজার নির্মিত হল।
হযরত শেখ রুকনুদ্দীন সাহরাওয়ার্দী রাঃ মাহবুবে এলাহীর জানাজায় নামাজ পড়ালেন।
হযরত সুলতানুল আউলিয়া বলেন, কাউয়ালীর একটি বিশেষ অবস্থা আছে। মূলতঃ তা হারাম নয়। তা দিয়ে অন্তরের মধ্যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এই আলোড়ন যদি আল্লাহ পাকের মহব্বতে হয়, তবে কাউয়ালী মুস্তাহাব। আর যদি নাজায়েজ প্রেমের দিকে হয়, তবে কাউয়ালী গাওয়া এবং শ্রবণ করা উভয়ই হারাম।