যুগে যুগে রাসূল প্রেমের নিদর্শন

 

 রাসূল পাক সা. এর প্রতি দরূদ পাঠ করতে আল্লাহর নির্দেশ

রাসূল পাক সা. এর শুভাগমনে খুশি উদযাপন করতে আল্লাহর নির্দেশ

রাসূল পাক সা. এর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে হাদিস শরীফের নির্দেশনা

সাহাবাগণের রাসূল সা. প্রেমের নিদর্শন

নবীজীর প্রেমিক হযরত ওয়াইস করণী রা.

নবীজীর প্রেমিক রাসূলনোমা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.

 বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর রাসূল প্রেম

 

রাসূল পাক সা. এর প্রতি ভালবাসা ঈমানের অন্যতম অঙ্গ। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই এ বিষয়ে বেখেয়াল থাকেন অথবা ভিন্ন আকীদা পোষণ করেন। যা মোটেও কাম্য নয়। যাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুল-মাখলুকাতের কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তাঁর প্রতি ভালবাসার কারণের সৃষ্টিকর্তা এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাই আল্লাহর বান্দা হিসেবে এবং রাসূল পাক সা. এর উম্মত হিসেবে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য রাসূল পাক সা.কে সবকিছুর উপর ভালবাসা প্রদর্শন করা।

হুব্বে রাসূল মানে রাসূল প্রেম-রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। আনাস বিন মালেক (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন: “তিনটি জিনিষ যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে। এক. আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তার নিকট দুনিয়ার সব কিছু হতে প্রিয় হওয়া, দুই. কোন মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও তিন. ঈমান আনার পর কুফরিতে ফিরে যাওয়াতে এমন অপছন্দ করবে, যেমন আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে।”
হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম নবী ও রাসূল। তাঁর ওপর ঈমান রাখা ও তাঁকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসা মুমিনের একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের একাধিক বর্ণনায় মুমিনদের রাসূলের প্রতি অগাধ প্রেম-ভালোবাসা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। যে হৃদয়ে নবীজির উপর সম্মানবোধ নেই, মায়া ও অনুভূতির দৈন্যতা রয়েছে, উহাতে ঈমানের অস্তিত্ব থাকতে পরে না। শুধু সম্মানের অনুভূতিই যথেষ্ট নয়, বরং মুমিনেরা তাদের স্বীয় জীবনের সঞ্চিত ধন-সম্পদ, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সব কিছুর উপর আল্লাহর রাসূলকে অগ্রাধিকার দেবে। তা নবী (সা.) এর প্রতি ভালোবাসারই দাবি। এ ক্ষেত্রে কুরআনের বক্তব্য সুস্পষ্ট: “নিশ্চয়ই মুমিনদের নিকট নবী তাদের স্বীয় জীবনের চাইতেও মর্যাদার ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার” (সূরা আল আহযাব : ৬) এর সারকথা হলো, প্রত্যক মুসলমানের পক্ষে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসা ও তার নির্দেশ পালন করা স্বীয় পিতামাতার নির্দেশের চাইতেও অধীক করণীয়। যদি পিতা মাতার নির্দেশ মহানবী (সা.) এর নির্দেশের বিপরীত হয়, তা পালন করা মোটেও জায়েজ নয়। এমনকি রাসূল (সা.) এর নির্দেশকে নিজের সকল আশা-আকাঙ্খার চাইতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আল্লাহর হাবীব বলেন- ‘এমন কোন মুমেন নেই যার পক্ষে আমি ইহকাল ও পরকালে সমস্ত মানবকূলের চাইতে হিতাকাঙ্খী ও আপনজন নই’। (বুখারী)
এ ক্ষেত্রে নবী (সা.) এর বাণীও স্বরণযোগ্য: “তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না একমাত্র আমিই তার কাছে তার জীবন, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা এবং দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।” (বুখারী ও মুসলিম)
রাসূল (সা.)-কে যে যতটুকু ভালোবাসে তার মধ্য ততটুকু ঈমান রয়েছে। ঈমান অধ্যায়ন করার বিষয় নয়, উহা অন্তরে ধারণ করার বিষয়। যারা আল্লাহ ও তার হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে মন, প্রাণ ও হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছেন তারাই হলেন ঈমানদার বা মুমেন।

আল্লাহ্ তা’লার তাঁর রাসূল (দ)-কে বলেছেন তিনি যেন তাঁর উম্মাতকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে যারা আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি করে তাদের প্রতি রাসূসুল্লাহ (দ)-কে ভালোবাসাও অবশ্য কর্তব্য হয়েছে। এরশাদ হয়েছে- “হে মাহবুব, আপনি বলে দিন: ওহে মানবকুল! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো তবে আমার অনুগত হও, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত – ৩১)। মহানবীকে ভালোবাসার এই অবশ্য কর্তব্য বিষয়টির মানে হলো তাঁকে মান্য করা, তাঁর স্মরণ (যিকর) করা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁকে নিয়ে গর্ব করা, যেমনিভাবে আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে নিয়ে গর্ব করেছেন তাঁরই পবিত্র কেতাবে- “নিশ্চিয় আপনার চরিত্র মহা মর্যাদাময়” (সূরা ক্বলম, আয়াত-৪)।

মু’মিন মুসলমানদের ঈমানের পূর্ণতা রাসূল প্রেমের ওপর নির্ভরশীল। বোখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত একটি সহীহ হাসীসে রাসূলে খোদা (দ) এরশাদ ফরমান- “তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের পুত্র, পিতা ও সকল মানব জাতির চেয়ে তোমাদের কাছে প্রিয়ভাজন হই”। বোখারী শরীফে উদ্ধৃত অপর এক হাসীসে তিনি বলেন- “তোমাদের কেউই ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে তোমাদের আপন সত্তার চেয়েও প্রিয় পাত্র হই।”

রাসূল পাক সা. এর প্রতি দরূদ পাঠ করতে আল্লাহর নির্দেশ

ঈমানের পূর্ণতা রাসূলপ্রেমের ওপর নির্ভরশীল। কেননা আল্লাহ্ তা’লা ও ফেরেশতাকুল নিরন্তর তাঁর সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত করছেন, যেমনি ভাবে কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে- “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ মহানবী (দ)-এর প্রতি সালাত-সালাম তথা দুরূদ প্রেরণ করেন” (সূরা আহযাব, আয়াত-৫৬)। অতঃপর খোদায়ী আদেশ জারি হয়েছে একই আয়াতে করীমায়- “ওহে ঈমানদারবর্গ! তোমরাও পূর্ণ সম্মানসহ তাঁর প্রতি দুরূদ প্রেরণ কর” (সূরা আহযাব, আয়াত-৫৬)। এ আয়াতে প্রতিভাত হয় যে মো’মেন মুসলমান হবার বৈশিষ্ট্য মহানবী (দ:)-এর প্রতি দুরূদ-সালাম প্রেরণের ওপর নির্ভরশীল এবং এর দ্বারাই প্রকাশমান। হে আল্লাহ! বিশ্বনবী (দ:), তাঁর আহল তথা পরিবার সদস্যবৃন্দ ও আসহাবে কেরাম (সম্মানিত সঙ্গী)-বৃন্দের প্রতি শান্তি ও আশীর্বাদ বর্ষণ করুন।

রাসূল পাক সা. এর শুভাগমনে খুশি উদযাপন করতে আল্লাহর নির্দেশ

এ বিশ্ব জগতে রাসূলুল্লাহ (দ)-এর শুভাগমন উপলক্ষে আমাদের খুশি উদযাপন করতে আদেশ করা হয়েছে; এরশাদ হয়েছে- “হে রাসূল, বলুন: আ্ল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা (রহমত)-প্রাপ্তিতে মানব জাতির উচিৎ খুশি উদযাপন করা” (সূরা ইউনুস, আয়াত-৫৮)। এই আদেশ জারি করা হয়েছে এ কারণে যে খুশি উদযাপন দ্বারা আল্লাহর করুণার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়। আর আল্লাহ্ তা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা মহানবী (দ) ছাড়া কী হতে পারে? যেমন এরশাদ হয়েছে-

“এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি কিন্তু বিশ্ব জগতের জন্যে রহমত করে (পাঠিয়েছি)” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)।

যেহেতু মহানবী (দ)-কে সমগ্র মানবজাতির জন্যে রহমত করে পাঠানো হয়েছে, সেহেতু শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ই নয় বরং সমস্ত মানুষের প্রতি তাঁর সত্তা মোবারকের ওপর খুশি উদযাপন করা অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে।

রাসূল পাক সা. এর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে হাদিস শরীফের নির্দেশনা

কোনো এক ব্যক্তি হুজুর পাক (দ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ)! শেষ বিচার দিবস কখন হবে”? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “তুমি এর জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ”? ওই ব্যক্তি জবাব দিলেন, “কিছুই না; তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি।” অতঃপর মহানবী (দ) এরশাদ ফরমালেন- “তুমি যাদের ভালোবাস, তাঁদের সাথে থাকবে।” এই হাদীসের রওয়ায়াতকারী হযরত আনাস (রা:) বলেন, ‘রাসূলে খোদা (দ)-এর ওই কথা শুনে আমরা যতো খুশি হয়েছিলাম তাঁর চেয়ে বেশি খুশি আগে কখনো হই নি। অতএব, আমি হুজুর পূর নূর (দ), হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত ওমর (রা:)-কে ভালোবাসি এবং আশা করি যে এর ফলে আমি তাঁদের সঙ্গে থাকবো, যদিও আমার আমল তাঁদের মতো নয়।”

একবার কেউ একজন রাসূলুল্লাহ (দ)-এর কাছে এসে আরয করলেন, “হে আল্লাহর নবী! আমি আপনাকে আমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমি আপনাকে স্মরণ করি এবং আপনার কাছে এসে আপনাকে দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে পারি না। আমি জানি আমি পরলোকবাসী হবো এবং আপনিও বেসালপ্রাপ্ত হবেন; এও জানি আপনি তখন বেহেশতে (নবীকুল সরদার হিসেবে) নবীদের সাথে উচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত হবেন। তখন তো জান্নাতে আপনার দেখা পাবো না।” এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তা’লা আয়াত নাযেল করলেন- “এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও রাসূল (দ)-এর হুকুম মান্য করে, তবে সে তাঁদের সঙ্গ লাভ করবে যাদের প্রতি আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন- অর্থাৎ নবীবৃন্দ, সত্যনিষ্ঠ বুযূর্গানে দ্বীন, শাহাদাৎপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও সৎ-কর্মপরায়ণ মানবকুল। এঁরা কতোই উত্তম সঙ্গী” (সূরা নিসা, ৬৯ আয়াত)!

মহানবী (দ) ওই ব্যক্তিকে ডেকে উপরোক্ত আয়াতে করীমা তেলাওয়াত করে শুনালেন। এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাবারানী এবং মারদাওয়াইহ্ হযরত আয়েশা (রা:) ও হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে। এছাড়া ইমাম কাজী আয়াজ (রহ:) তাঁর প্রণীত ’শেফা শরীফ’ গ্রন্থে ও ইবনে কাসির তার তাফসীর পুস্তকে একটি বর্ণনা করেছেন। আল বাগাভীও এটি বর্ণনা করেছেন তাঁর তাফসীরে। হযরত ওমর (রা:) বর্ণিত অপর এক হাদীসেও বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে: এক ব্যক্তিকে মদ পানের কারণে মহানবী (দ) প্রতিনিয়ত শাস্তি দিতেন; একবার তাঁকে ধরে আনা হলে তাঁকে আবারও প্রহারের শাস্তি দেয়া হয়। এমতাবস্থায় উপস্থিত কেউ একজন “আল্লাহর লা’নত পড়ুক তাঁর ওপর! তাঁকে কতো ঘন ঘনই না ধরে আনা হয়”-  এ কথাটি বলে উঠলে, রাসূলে পাক (দ) তাঁকে বারণ করে বলেন, “ওকে লা’নত দেবে না; আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ও আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে’ (আল্ বুখারী)।

মহানবী সা. এরশাদ করেন, “আমাকে ভালোবাসেন আমার এমন উম্মাতদের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যারা আমার পরে আসবেন এবং যারা নিজেদের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের বিনিময়ে আমাকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হবেন” (সহীহ মুসলিম, ‘জান্নাত ও এর আশীর্বাদ এবং জান্নাতী মানব সম্প্রদায়’ শীর্ষক অধ্যায়)।

সাহাবাগণের রাসূল সা. প্রেমের নিদর্শন

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর সাহাবীগণের যে ভালোবাসা ছিলো, সত্যিই তা পবিত্র ও অতুলনীয়। পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন নজীর খোঁজে পাওয়া যায় না। অতুলনীয় সেই ভালোবাসার হৃদয়ছোঁয়া কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিয়েই আমার আজকের আলোচনা।
এক. ইসলামের সূচনালগ্নের কথা। তখন মাত্র ঊনচল্লিশজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতিক্রমে হযরত আবু বকর রা. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন। প্রথম যেদিন বক্তৃতা করলেন সেদিনই মুশরিকদের গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো, হিংস্র হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ল ওরা হযরত আবু বকর রা. এর উপর। ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো সারা শরীর। দীর্ঘ সময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকলেন তিনি। তারপর সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্রই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন প্রিয় নবীজি কেমন আছেন? তার মমতাময়ী মা পুত্রকে কিছু খাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু হযরত আবু বকর রা. শপথ করে বললেন, নবীজির সাক্ষাত লাভের পূর্বে কোন আহার গ্রহণ করবেন না। এরপর রাতে লোক চলাচল বন্ধ হলে পরম মমতাময়ী মাতা পুত্রকে নিয়ে প্রিয় নবীজির খেদমতে উপস্থিত হলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা. কে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। হযরত আবু বকরও রা. তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। এভাবে জড়াজড়ি করে তারা উভয়ে খুব কাঁদলেন, কাঁদলো উপস্থিত সকল মুসলমান। এটাই হলো সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কাছে খাদ্য, চিকিৎসা এমনকি পরম মমতাময়ী মায়ের স্নেহ-ভালোবাসাও হার মানে!
দুই. অহুদ যুদ্ধে মুসলিমগণ যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন এক আনসারী মহিলা যুদ্ধে জড়িত লোকজনের কাছে ব্যাকুল হৃদয়ে জানতে চাইলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন? এক ব্যক্তি বলল, তোমার পিতা শহীদ হয়ে গেছেন। মহিলা শুধু ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ে অসহ্য অস্থিরতায় আবারো জানতে চাইলেন, প্রিয় নবীজি কেমন আছেন? প্রিয় নবীর ভালোবাসার কাছে যেন আপন পিতার শাহাদাতের সংবাদও ম্লান হয়ে যাচ্ছে! এরপর এক এক করে তাঁর স্বামী, ভ্রাতা ও পুত্রের শাহাদাতের সংবাদ জানানো হল তাঁকে। কিন্তু তিনি ইন্নালিল্লাহি… উচ্চারণ করে বারবার মানুষের কাছে শুধু প্রিয়নবীর কথাই জিজ্ঞেস করছিলেন। এক সময় তিনি শুনতে পেলেন যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো আছেন। কিন্তু ব্যাকুল হৃদয় তাতেও শান্ত হলো না। এরপর নবীজিকে স্বচক্ষে দেখেই তবে শান্ত হলেন সেই আনসারী মহিলা। এটাই হলো প্রকৃত নবীপ্রেম। প্রিয়নবীর প্রতি পবিত্র ভালোবাসা। যার উপমা মেলে না এ পৃথিবীতে।
তিন. সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ ইবনে আবদি রাব্বিহি। তিনি তার বাগানে ফল-ফলাদি ও গাছ-গাছালি দেখাশোনা করছেন। এমন সময় নবীজির ইন্তিকালের সংবাদ জানতে পেলেন। হৃদয়ের কোমল বৃত্তে তিনি আচমকা প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। দুঃখে শোকে আর মহব্বতের আতিশয্যে আল্লাহর কাছ প্রার্থনা করে বসলেন, হে আল্লাহ! আমার দৃষ্টিশক্তি রহিত করে দাও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে আমি এই চোখ দিয়ে আর কিছুই দেখতে চাই না। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত এই প্রার্থনা বৃথা গেল না। সত্যিই দৃষ্টিশক্তি রহিত করে দেয়া হলো তার। মানুষের প্রতি কি মানুষের এমন ভালোবাসাও হতে পারে, যে ভালোবাসার কাছে নিজের দৃষ্টিশক্তির মহব্বতও হার মানে!
চার. হযরত ওমর রা. এর বীরত্বের কথা কে না জানে? তিনি ছিলেন মানবেতিহাসের এক লৌহমানব। অথচ সে ওমর রা. যখন নবীজির ইন্তিকালের সংবাদ পেলেন তখন তিনি একদম অস্থির হয়ে ওঠলেন। প্রিয়নবীর বিরহের শোক কিছুতেই তিনি সইতে পারছিলেন না, নাঙ্গা তলোয়ার হাতে নিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। আহত ক্রদ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগলেন- যে বলবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছেন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব। প্রিয়নবী তো তাঁর বন্ধুর নিকট গমন করেছেন মাত্র। হযরত ওসমান রা.ও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়লেন। দু’দিন পর্যন্ত কোন আওয়াজ বেরুল না তার কণ্ঠ থেকে। হযরত আলী রা. এমনভাবে চুপসে গেলেন মনে হচ্ছিল যেন তিনি অনুভূতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
পরিস্থিতি যখন জটিলরূপ নিচ্ছিল হযরত আবু বকর রা. তখন নবীপ্রেমের দাবিতেই হৃদয়মন দৃঢ় করে ওঠে দাঁড়ালেন। সকলকে শান্তনা দিয়ে দ্বীপ্ত কণ্ঠে শোনালেন পবিত্র কুরআনের সেই অমোঘ বাণী- ‘আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।’ [সূরা আলে ইমরান : ১৪৪]
কুরআনের এই বাণী শুনে সবাই প্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন।
পাঁচ. কিশোর সাহাবী হযরত যায়েদ বিন হারেসা রা. মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে গোলামরূপে আসার পর তার পিতা কেঁদে কেঁদে তাকে খুঁজে ফিরছিল। এক সময় সন্ধান পেয়ে তার পিতা ও চাচা মদিনায় গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হলো। তারা বিনীত সুরে আরজ করল, হে হাশেম বংশধর! আপনি হারামের অধিবাসী এবং আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। আপনি বন্দী মুক্ত করেন, ক্ষুধার্তদের আহার দান করেন, আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। মুক্তিপণ নিয়ে আমাদের পুত্রকে মুক্ত করে দিন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়েদের পিতাকে বললেন, আপনি ওকে জিজ্ঞেস করুন, ও যদি যেতে চায় তাহলে আপনারা ওকে নিয়ে যান; মুক্তিপণের কোন প্রয়োজন নেই। আর যদি না যেতে চায় তাহলে আমরা ওর ওপর কোন চাপ প্রয়োগ করতে পারব না। এরপর যায়েদ রা. উপস্থিত হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগন্তুক দু’জনের দিকে ইশারা করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এদের চেন? যায়েদ রা. বললেন হ্যাঁ, ইনি আমার পিতা আর ইনি আমার চাচা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার পরিচয়ও তোমার জানা আছে, সুতরাং এখন তোমার ইচ্ছে মনে চাইলে আমার কাছে থাকতে পার, আর ইচ্ছে হলে তাদের সাথেও যেতে পার। বালক যায়েদ জবাব দিলেন আমি আপনার পরিবর্তে আর কাকেই বা পছন্দ করতে পারি আপনিই তো আমার বাবা-চাচার মতো। বালক যায়েদের এ জবাব শুনে পিতা ও চাচা আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে বলে ওঠলেন, যায়েদ! তুমি আজাদির উপর গোলামীকে প্রাধান্য দিচ্ছো?
হযরত যায়েদ রা. বললেন, আমি নবীজির মাঝে এমন সৌন্দর্য দেখেছি, যার বিপরীতে কোন কিছুই পছন্দ করতে  পারি না। একথা শুনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কোলে টেনে নিলেন আর বললেন, একে আমি আমার পুত্র বানিয়ে নিলাম। এক কিশোর সাহাবীরও কি গভীর ভালোবাসা ছিল নবীর প্রতি। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের ভালোবাসাও সেখানে ম্লান হয়ে যায়।
ছয়. অহুদ যুদ্ধের সময় যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শির মোবারকে শিরস্ত্রানের দু’টি কড়া ঢুকে পড়লো। হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উবায়দা রা. অধীর চিত্তে দৌড়ে এলেন। দাঁত দিয়ে শিরস্ত্রাণের কড়া টেনে বের করে আনলেন। হযরত উবায়দা রা. এর একটি দাঁতও ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তিনি দমলেন না অপর কড়াটিও দাঁত দিয়ে টেনে বের করে আনলেন। এতে তার আরেকটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। কড়াটি বেরিয়ে এলে নবীজির মাথা মোবারক থেকে রক্তের ফিনকি ছুটছিল। এ দৃশ্য দেখে সাহাবী মালেক ইবনে সিনান দৌড়ে এলেন এবং তার দুই অধরে নবীজির রক্ত চুষে পান করে ফেললেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, ‘যার রক্তের সাথে আমার রক্ত মিশে গেছে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।’ কি গভীর ভালোবাসা থাকলে মানুষ মানুষের রক্ত পান করতে পারে! সত্যিই কি তা কল্পনীয়?!
সাত. হযরত যায়েদ ইবনে দাসানা রা. কাফিরদের হাতে বন্দী হবার পর পাপিষ্ঠরা তাকে শূলে চড়ানোর আয়োজন করে। তামাশা দেখার জন্য সমবেত হয় অনেক লোক। আবু সুফিয়ান তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, যায়েদ! সত্যি করে বলতো; আল্লাহর শপথ দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হোক আর তোমাকে হাসিমুখে তোমার পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হোক। হযরত যায়েদ রা. দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ! নবীজির যাত্রাপথে একটি কাঁটা লুকিয়ে রাখা হবে আর আমি ঘরে বসে আরাম করবো, এতটুকুও আমার সহ্য হবে না।
হযরত যায়েদের জবাব শুনে সেদিন মক্কার কাফেররা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। আরব নেতা আবু সুফিয়ান মন্তব্য করেছিলেন, মুহাম্মদের প্রতি তার সাথীদের যে ভালোবাসা আমি দেখেছি, অন্য কারো প্রতি এমন ভালোবাসা আমি আর কখনো দেখিনি।
এই হলো সাহাবায়ে কিরামের রাসূল-প্রেমের হৃদয়ছোঁয়া কয়েকটি দৃষ্টান্ত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের থেকেও অধিক ভালোবাসতেন। একবার হযরত আলী রা. এর কাছে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আপনাদের কেমন ভালোবাসা ছিলো? হযরত আলী রা. বললেন, আল্লাহর শপথ! হযরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমরা আমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ ও তৃষ্ণার্ত সময়ে প্রাপ্ত পানির চেয়েও অধিক ভালোবাসতাম।
তাই প্রিয়নবীর প্রতি উম্মত হিসেবে আমাদের হৃদয়েও জাগাতে হবে রসূল-প্রেম। বাস্তবতার আলোকে ফুটিয়ে তোলতে হবে প্রিয়নবীর সুন্নাতসমূহকে। তবেই আমরা শামিল হতে পারবো তাদের কাতারে যারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবেসেছিলেন সত্যিকারের ভালবাসা।

নবীজীর প্রেমিক হযরত ওয়াইস করণী রা.

হযরত ওয়াইজ কারনী (র:) ইয়েমেনের ‘কারান’ শহরে খুবই সাধারণ এবং একাকী জীবন যাপন করিতেন স্বল্প আহার, রোজা ও অন্ধ ‘মা’-এর সর্বপ্রকার সেবা-সুস্রশা এবং একাকী ইবাদতের মাধমে দিনাতিপাত করিতেন।লোকে হযরত ওয়াইজ কারনী (র:) কে পাগল বলিত এবং পাথর ছুড়িয়া মারিত।তখন তিনি তাহাদেরকে ছোট ছোট পাথর মারিতে বলিতেন যাহাতে ইবাদাতের অসুবিধা না হয়। অন্ধ ‘মা’-এর সুস্রশার ব্যাঘাত হবার ভয়ে সর্বকালের সর্বপেক্ষা শ্রেষ্ট আশেক হযরত ওয়াইজ কারনী (র:), হযরত রসুলপাকের (দঃ) সাথে সাক্ষাত লাভ সম্ভব হয় নাই।’মা’-এর অনুমতির বাহিরে তিনি কোনও কাজ কোনও দিন করেন নাই।

একদা হযরত রসুলপাক (দঃ), সাহাবা-কেরাম (রাঃ) গনের নিকট বলেন যে ” আমার (দঃ) উম্মতের মধ্যে এমন একজন আছেন যাহার প্রার্থনায় ‘রাবিয়া’ ও ‘মাজার’ খামারের সমুদয় ভেড়ার লোমের সংখ্যক উম্মতের সকল গুনাহ মাফ হইবে।” সাহাবা-কেরাম (রাঃ) গণ অতি আগ্রহর সাথে উক্ত উম্মতের সম্পর্কে জানিতে চাহিলে হযরত রসুলপাক (দঃ), অল্প ইতস্ততার পর বলিলেন “তিনি কারন শহরের ওয়াইস।”

হযরত রসুলপাকের (দঃ) ওফাতের পরে নির্দেশ অনুযায়ী হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) ইয়েমেনের ‘কারান’ শহরে যান এবং অতি কষ্টে ওয়াইজ কারনী (র:) কে খুজিয়া বাহির করেন।তখন ওয়াইজ কারনী (রঃ) ইবাদাতে মগ্ন ছিলেন। ইবাদত শেষে আগন্তুকগনকে উদ্দেশ্য করিয়া ওয়াইজ করনী (রঃ) বলিলেন এই প্রথম কেহ আমার ইবাদত দেখিল। অতঃপর হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ), হযরত ওয়াইজ কারনী (রঃ) এর পরিচয় নিশ্চিত হইয়া হযরত ওয়াইজ কারনী (রঃ) এর হস্ত মুবারক চুম্বন করিয়া নির্দেশ মোতাবেক, হযরত রসুলপাকের (দঃ) খিরকা মোবারক হযরত ওয়াইজ কারনী (রঃ) এর হস্তে তুলিয়া দিলে তিনি “হযরত ওয়াইজ কারনী (রঃ)” উক্ত খিরকা মোবারক জড়াইয়া ধরিয়া জঙ্গলের দিকে দৌড়াইয়া গিয়া আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিয়া বলিতে লাগিলেন “হে আল্লাহ তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত হযরত রসুলপাকের (দঃ) সকল উম্মত্গনের সকল গুনাহ মাফ না কর ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এই বস্ত্র পরিধান করিব না।” তখন গায়েবে আওয়াজ হইলো “আমি এক অংশের গুনাহ মাফ করলাম ” এই মুহুর্তে হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ), হযরত ওয়াইজ কারনী (রঃ) এর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। হযরত ওয়াইজ কারনী (রঃ) তখন বলিলেন, “আপনারা কেন আমার সম্মুখে আসিলেন।” আল্লাহপাক সকল উম্মতের গুনাহ মাফ না করা পর্যন্ত আমি আমার প্রার্থনা বন্ধ করতাম না। তখন হযরত রসুলপাকের (দঃ) বর্ণনা করা ‘রাবিয়া’ ও ‘মাজার’ খামারের সমুদয় ভেড়ার লোমের সংখ্যক উম্মতের সকল গুনাহ মাফ করার কথা হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) বলেন।

উহুদের যুদ্ধে হযরত রসুলপাকের (দঃ) দন্ত মোবারক শহীদ হওয়ার খবর জেনে ওয়াইজ কারনী (রঃ) নিজের সবগুলি দাত এক এক করে তুলে ফেলেই শান্তি পেয়েছিলেন, কেননা ওয়াইজ কারনী (রঃ) জানতেন না হযরত রসুলপাকের (দঃ) কোন দন্ত মোবারকটি শহীদ হয়েছিল।

খুবই সাধারণ জীবন যাপনের মধ্যে চলাফিরায় অভ্যস্ত ওয়াইজ কারনী (রঃ) বলিতেন “মৃত্যুর চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমাও এবং উঠিয়া স্মরণ কর বেশিক্ষণ আর বাচিবে না।”
হযরত রসুলপাক (দঃ), বলিতেন “”তাবেয়ীনদের মধ্যে ওয়াইস সর্বপেক্ষা শ্রেষ্ট।”

উয়ায়েস কারনী (রাঃ)ছিলেন একজন মুসলিম কারান (Qaran) নামক স্থানের অধিবাসী যা এখন সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। তিনি হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর সমসাময়িক কালের ব্যাক্তি ছিলেন।তাই নবীজি (সাঃ) তাঁকে সাহাবী হিসাবে উল্লেখ করেছেন, যদিও নবিজী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় নবাজী (সাঃ) এর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ হয় নাই। আল্লাহর প্রেরিত রাসুলকে দেখার আন্তরিক আকুলতার কারণে তাঁর নাম সাহাবী (রাঃ) দের তালিকায় স্থান পায়।

বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বাতুতা হযরত উয়ায়েস কারনী (রাঃ) এর সমাধী সিরিয়ার আর-রাক্বাহ নামক স্থানে উল্রেখ করেন, যেখানে তিনি সিফ্ফিনের যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন।

হযরত উয়ায়েস কারনী (রাঃ) ইসলামে দিক্ষিত হন রাসুলেপাক (সাঃ) এঁর জীবদ্দশায়, যদিও তাঁদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই। রাসুলেপাক (সাঃ)এর ওফাতের পর তিনি হযরত আলী (রাঃ) এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।

ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন ” আমার লোকেদের মাঝে এমন একজন আছে যে শেষ বিচারের দিনে সকল বিশ্বাসীদেরকে হেফাজতের ক্ষমতা রাখে”।সাহাবা (রা) গণ জিজ্ঞাসা করলেন ” কে সেই ব্যক্তি?” তিনি বল্লেন “সে আল্লাহর বান্দা।” তাঁরা প্রত্যুত্তরে বল্লেন “আমরা সবাই আল্লার বান্দা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পয়দা করেছেন।” তাঁরা প্রশ্ন করলেন ” তাঁর নাম কি?” রাসুলে পাক (সাঃ) বল্লেন “উয়ায়েস!” সাহাবা (রা) গণ জিজ্ঞাসা করলেন,”তিনি কোথায়?” তিনি বলেন “ইয়েমেন”। সাহাবা (রা) গণ জিজ্ঞাসা করলেন, “সে যদি আপনাকে ভালোবাসে, তাহলে কেন আপনার খেদমতে হাজির হয় না?” রাসুলে পাক (সাঃ) জবাবে বল্লেন, “সে আমার পথ গ্রহণ করেছে এবং সে একজন বিশ্বাসীর অন্তর্ভুক্ত; শারিরীক ভাবে তাঁর এখানে উপস্থিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নাই। অধিকন্তু তাঁর পরিস্থিতি তাঁকে এখানে আসতে সহায়তা করে না এবং সে তার অচল-অন্ধ মায়ের সেবা করে।সে দিনের বেলা উট চরায়। সেই আয় থেকে নিজে ও তাঁর মায়ের ভরণ পোষন করে। সাহাবা (রাঃ) গন প্রশ্ন করলেন আমরা কি তাঁকে দেখতে পাব?” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,” আবু বকর নয়, তবে ওমর এবং আলী পারবে। তোমরা তাঁকে পাবে ইয়ামেনের একটি গ্রাম শারানীতে এবং তাঁর হাতের তালুতে এবং বুকের পাজরের কাছে সাদা দাগ দেখে তোমরা তাঁকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে।। যখন তোমাদের সাথে তাঁর দেখা হবে, তাঁকে আমার শুভেচ্ছা দেবে আর আর আমার উম্মতদের জন্য দোআ করতে বলবে।”এটা উল্লেখ্য যে হযরত উয়ায়েস এঁর মাতা মারা যাওয়ার পরে তিনি হযরত আলী (রাঃ) এর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য বের হন এবং সিফ্ফিনের যুদ্ধে শাহদাৎ বরন করেন।

খেরকা মোবারক প্রদান-

দুনিয়া থেকে ওফাতের পূর্বে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) হযরত আলী এবং হযরত উমর (রাঃ)কে তাঁর একটি খেরকা মোবারক প্রদান করেন এবং খেরকা মোবারকটি উয়ায়েস (রাঃ) এর কাছে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি বলেন আমার খেরকা মোবারকটি উয়ায়েসকে দেবে এবং তোমাদের জন্য এবং আমার সকল উম্মতের মাগফেরাতের জন্য তাঁকে দোআ করতে বলবে।” পরবর্তিতে হযরত আলী (রাঃ) এবং উমর (রাঃ) খেরকা মোবারকটি পৌছে দিয়ে তাঁকে দোআ করার জন্য বল্লে তিনি কান্না শুরু করেন। খেরকা মোবারকটি নিয়ে তিনি নির্জনে নিভৃতে চলে যান এবং সেজদায় পড়ে তিনি আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতে থাকেন।তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আমি এই খেরকা মোবারক ততক্ষন পর্যন্ত গ্রহণ করব না, যতক্ষন না আপনি সকল উম্মতি মোহাম্মদিকে ক্ষমা করবেন। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আমাকে এই দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। গায়েবী আওয়াজ এলো-“আমি অসংখ্য উম্মতি মোহাম্মদকে ক্ষমা ঘোষনা করলাম, এবার আপনি খেরকা মোবারক গ্রহণ করুন।” হযরত উয়ায়েস দাবী করেন, আমি সকল উম্মতি মোহাম্মদির মাফি কামনা করছি। এমতাবস্থায় হযরত উমর (রাঃ) উক্ত নির্জন স্থানে উপস্থিত হলে উয়ায়েস (রাঃ) এর একাগ্রতায় চ্ছেদ ঘটে এবং তিনি দোআ বন্ধ করে খেরকা মোবারকটি গায়ে দেন। তিনি বলেন হে উমর! আপনি আমাকে বিরক্ত না করলে এই খেরকা মোবারক ততক্ষন পর্যন্ত আমি গায়ে দিতাম না, যতক্ষন না আল্লাহতায়াল সমস্ত উম্মতি মোহাম্মদীকে ক্ষমা ঘোষনা করতেন।হযরত মোহাম্মদ (সেঃ) বলেন বিশ্বাসী আল্লাহর নুরকে খোজ করবে, এবং কেউ তা অন্তরচক্ষুদ্বারা দেখবে , যা চর্ম চক্ষু দ্বারা পাওয়া যাবে না। এবং জ্ঞ্যান হলো আলো বা নূর যা আল্লাহ যাকে খুশি দান করেন।শারীরিকভাবে কাছাকাছি না থাকলেও সিদ্ধি লাভ হয়। হযরত উয়ায়েস কারনী তারই উদাহরণ। যেহেতু তিনি কখনোই নবিজী (সাঃ) কে চর্মচক্ষু দ্বারা দেখেন নাই কিন্তু তার পরেও তাঁর সকল শিক্ষাই তিনি পেয়েছিলেন।

অন্তর দিয়ে তিনি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর খুবই কাছাকাছি ছিলেন যার কারণে তিনি হযরতের ব্যাথা নিজেও অনুধাবন করতে চেয়েছেন। যার ফলে যখন হযেতের দাঁত মোবারক যুদ্ধে শহীদ হয়, তিনিও তাঁর দাঁত ভেঙে ফেলেন।

হযরত আত্তার (রাঃ) বলেন, উয়ায়েসী পন্থানুযায়ী শারীরিক ভাবে কোন নির্দেশক (পীর) এর প্রয়োজন পড়ে না। জাহেরী এবং বাতেনী জ্ঞ্যানের দ্বারাই তিনি হযরতের দাঁত হারানোর বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন। এটা সরাসরি হযরত মোহাম্দ (সাঃ) এর থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। বিশ্বাসীগন আল্লাহর নূরকে খুজতে থাকে। এটা ততক্ষন অবধারণ করা যায় না যতক্ষন অন্তরদ্বারা তা অনুধাবন করা না যায়। পীর এর কাজ এই নয় যে সে তোমার দ্বারা নির্বাচিত হবে, বরং তাঁর কাজ হচ্ছে সে তোমার আত্মার উন্মেষ ঘটাবে। তাই যখন হযরত আত্তার (রাঃ) বলেন, উয়ায়েসী পন্থানুযায়ী শারীরিক ভাবে কোন নির্দেশক (পীর) এর প্রয়োজন পড়ে না, তখন তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে পীর হচ্ছেন শরীর – উপরন্তু মনের একজন নির্দেশক। পরবর্তিতে এই ধারণার অনেক অপব্যাখ্যা হয়।

হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র বিশিষ্ট বিশ্বস্ত সাহাবী এবং আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) এর নিবেদিত-প্রাণ সঙ্গীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন মহানবী (সাঃ)’র এমন এক সাহাবী যিনি তাঁকে না দেখেই এক আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছিলেন। রাতের বেলায় দীর্ঘ সিজদার পর আকাশের দিকে তাকাতেন এবং উজ্জ্বল তারকারাজি প্রত্যক্ষ করতেন। প্রতিদিন সকালে এবাদতের পর তিনি হয়ে উঠতেন আরও প্রাণবন্ত, উৎফুল্ল ও আশাবাদী। হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ) যে সারা রাত জেগে এবাদত করতেন, এটা সে যুগের সবাই জানতেন। মহান আল্লাহর দরবারে মনের আকুতি, অনুনয় আর বিনীত নিবেদনগুলো তুলে ধরতেন নিজ প্রার্থণায়। কেউ কেউ বলতেন, হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ) সারা রাত কাটিয়ে দিতেন সিজদারত বা রুকুরত অবস্থায়। তবে কেউ কেউ এ বিষয়টাকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করতেন। মানুষের শরীর কিভাবে এতো ধকল বা কষ্ট সইতে পারে? -এটাই ছিল তাদের প্রশ্ন। হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ)’র সামনে এ ধরনের সন্দেহ বা প্রশ্ন উচ্চারিত হলে তিনি কিছু না বলে মুচকি হাসতেন।

হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ)-কে একদিন এক ব্যক্তি বললেন, আপনি সারা রাত জেগে নামাজ পড়েন বলে শুনেছি, অথচ আল্লাহ তো তার বান্দার ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেন নি। জবাবে জনাব ওয়াইস যথারীতি স্মিত হাসি হেসে প্রশান্ত চিত্তে দিগন্তের দিকে তাকালেন। তিনি দেখলেন লোকটি তার বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। এ অবস্থায় হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ) বললেন, “এবাদত ও নামাজ আমার কাছে বিশ্রাম এবং চিত্ত-বিনোদন বা প্রশান্তিতে সময় কাটানোর সমতূল্য। আহা! যদি একটি রাতই সৃষ্টির সূচনা থেকে অসীম সময় পর্যন্ত দীর্ঘ হ’ত! আর আমি যদি ঐ রাতটা রুকু অথবা সিজদারত অবস্থায় কাটিয়ে দিতে পারতাম!”

লোকটি হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ)’র এ বক্তব্য শোনার পর প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হযরত ওয়াইস যেন তার কাছে এক নতুন অধ্যায় বা দিগন্ত খুলে দিলেন। ঐ ব্যক্তি জানতেন, মানুষের মন যখন প্রশান্ত থাকে, তখন শরীরও প্রশান্তি লাভ করে। হযরত ওয়াইস করনী (রহঃ) ‘র ঘর থেকে বের হবার সময় লোকটি আবৃত্তি করলেন পবিত্র কোরআনের এই অমৃত-বাণীঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি।’ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, অস্থিরতা বা অস্থির মন মানুষের ব্যক্তিত্বের একটি দূর্বলতা। এ ধরনের মানুষ ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সিদ্ধান্তহীনতার শিকার এ ধরনের ব্যক্তি যে মানসিক রোগী তা তারা নিজেরাও জানেন না। সমাজে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। মনোস্তাত্ত্বিকদের মতে, মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে বংশগতি বা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, শারীরিক গঠন, শরীরের হরমোন এবং রাসায়নিক উপাদানের মত বাহ্যিক চালিকা-শক্তিগুলোর প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়াও প্রভাব রয়েছে পিতা-মাতা, পরিবার এবং মূল্যবোধসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার মত বাহ্যিক বিভিন্ন চালিকা-শক্তির। মনোস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, নামাজ মানুষের ব্যক্তিত্বের দূর্বলতাগুলো দূর করার মোক্ষম পন্থা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ডক্টর মজিদ মালেক মোহাম্মদী বলেছেন,

“নামাজী বা মুসল্লীদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হ’ল, তারা খোদার বিধানের কাছে আত্ম-সমর্পিত। তারা সরল পথে থাকেন। প্রতিদিন নামাজে পঠিত আধ্যাত্মিক-বাক্য ও শব্দগুলো নামাজীকে কিছু বিশ্বাস এবং মূলনীতির সাথে সম্পর্কিত করে। ফলে তিনি স্থিরমতি হন এবং একটি সুনির্দিষ্ট পথ বেছে নেন। আর ঐসব আধ্যাত্মিক বাক্য ও শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তির ফলে তিনি হয়ে উঠেন সুস্থির এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও দৃঢ়-চিত্তের অধিকারী। ব্যক্তিত্বের স্থিরতা ও ভারসাম্যপূর্ণ মানসিক অবস্থা একজন মানুষের জীবনে সাফল্য বয়ে আনার জন্য জরুরী।” ডক্টর মজিদ মালেক মোহাম্মদী আরো বলেছেন, নামাজ সমাজে কোনঠাসা বা একঘরে হয়ে পড়া ব্যক্তিত্বের জন্যেও সংকট কাটিয়ে তোলার মাধ্যম। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ইসলাম প্রাত্যহিক নামাজগুলোকে জামাতে আদায় করার ওপর জোর দিয়েছে। একইসাথে প্রাণসঞ্জিবনী জুমার নামাজ মানুষকে উৎসাহ-উদ্দীপনায় টইটম্বুর এক মহতি সমাবেশে একত্রিত করে। ইসলাম যে সামাজিক বা সমাজবদ্ধ ধর্ম জুমার নামাজ তার দৃষ্টান্ত। ইসলামের এসব শিক্ষা নামাজীকে সামাজিক হতে উৎসাহ দেয়। সূরা ফাতিহায় বার বার সমষ্টিবাচক শব্দ বা বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। নামাজের প্রত্যেক রাকাতের পাঠ্য এ সূরা মানুষের একাকীত্ব-পিয়াসী বা স্বাতন্ত্রতাকামী মনোভাব দূর করে। তাই দেখা যায়, ইসলাম সমাজকে ব্যক্তির চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়। যেমন, সূরা ফাতিহায় বলা হয়েছে, আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই। এভাবে নামাজ মানুষকে নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের সংকট থেকে মুক্তি দেয় এবং এ ধরনের মানুষকে সমাজের সাথে সম্পৃক্ত করে।

নবীজীর প্রেমিক রাসূলনোমা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.

‘রাসূলনোমা’ হলো আধ্যাত্মিক জগতের অতি মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চস্তরের একটি উপাধি। আল্লাহর প্রিয় হাবিব সরকারে দো’আলম রাহমাতুল্লিল আলামিন রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও সুগভীর সম্পর্কের কারণে এ উপাধি লাভ করা যায়। ‘রাসূলনোমা’ শব্দের অর্থ হল যিনি সদা-সর্বদা রাসূল পাক সাঃ এর দিদার লাভ করেন এবং তিনি সুপারিশ করলে অন্যকেও জেয়ারত দান করাতে পারেন। এ উপাধি অতি বিরল, আমাদের জানা মতে জগতের বুকে এ উপাধি প্রাপ্ত একমাত্র আল্লাহর অলি উপমহাদেশের আধ্যাত্মবাদের পথ প্রদর্শক রাসূলনোমা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ।
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাঃ এর অতুলনীয় প্রেমিক। তিনি সব সময় রাসূল সাঃ এর মহব্বতে বেকারার বেহুসী অবস্থায় থাকতেন। পলকে তিনি বহু মুরিদকেও রাসূল পাক সাঃ এর দিদার লাভ করায়ে ভাগ্যবান করেছেন। তিনি রাসূল পাক সাঃ এর নিসবত লাভের সময় তাঁকে কদমবুসি করেন। তাঁহার পবিত্র রাঙ্গা চরণ নয়ন জলে ধুয়ে দিয়েছিলেন। রাসূল সাঃ এর প্রেমে তিনি ফারসী ভাষায় অনবদ্য ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ কিতাব রচনা করেছেন। নবী প্রেমের নির্যাসমাখা তাঁর দিওয়ানের প্রতিটি কবিতার ছন্দ, নান্দনিক ভঙ্গিমা এবং ঐশী গজল ও কাসিদা সকলকে মুগ্ধ করে। তিনি বাঙ্গালী হয়েও ফারসী ভাষায় উচ্চমার্গের কিতাব রচনা করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। কিতাবের শুরুতে তিনি লিখেছেন,

মাশরেকে হুব্বে মুহাম্মদ মাতলায়ে দিওয়ানে মা,
মাতলায়ে খুরশিদে এশকেশ সিনায়ে সুজানে মা ॥

অর্থ : মুহাম্মদ সাঃ এর প্রেমের আলোতেই আমার কাব্যের সূচনা,
তাঁর প্রেমের সূর্যোদয়েই আমার মনের জ্বালা যন্ত্রণা ॥

এই আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার আমিরাবাজার ইউনিয়নের মল্লিক সোবাহান হাজীরপাড়া গ্রামে আনুমানিক ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বুযুর্গ পিতার নাম হযরত মাওলানা শাহ সূফী সৈয়্যেদ ওয়ারেছ আলী রাঃ। যিনি পাঞ্জাবে শিখ সমরে শাহাদত বরণ করেন।
পিতার শাহাদতের পর হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ মাতার সঙ্গে মক্কাশরীফ হিজরতের উদ্দেশ্যে জাহাজ যোগে রওয়ানা হলে ঝড়ের কবলে কলিকাতার অদূরে জাহাজ ডুবি হয়। আল্লাহ পাকের রহমতে তিনি বেঁচে যান। তারপর তিনি হুগলী ও কলিকাতা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। পরিণত বয়সে তিনি হযরত শাহ সূফী নূর মোহম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর হাতে বায়াত গ্রহণ করে চিশতিয়া, কাদরিয়া, নকশেবন্দিয়া, মোজাদ্দেদীয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, মাসুমিয়া ও ওয়াইসীয়া তরিকার ফয়েজ নেসবত লাভ করে তাঁর খেলাফত গ্রহণ করেন। তাঁর অসংখ্য ভক্ত-মুরিদের মধ্যে যোগ্য পঁয়ত্রিশজন মুরিদ-খলিফার নাম পবিত্র দিওয়ানে ওয়াইসী কিতাবে লিপিবদ্ধ করে যান।
কর্মময় জীবনে হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা কলিকাতা হাইকোর্টের ফার্ম বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা পদে চাকরি নেন। তখন থেকে তিনি জন সাধারণকে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা দিতে থাকেন এবং মুরিদ করতে আরম্ভ করেন। পরবর্ত্তীতে তিনি কলিকাতা মেটিয়া বুরুজে অবস্থানকারী অযোধ্যার পদচ্যুত বিখ্যাত নওয়াব শাহ ওয়াজেদ আলীর প্রাইভেট সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত হন। অতঃপর তিনি পলিটিক্যাল পেনশন অফিসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এর পদে যোগদান করেন। তিনি সম্মানের সাথে চাকরি জীবন সমাপ্ত পূর্বক জন সাধারণকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা প্রদানের জন্য সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
তিনি মানুষকে ভালবাসতেন এবং ভক্ত-অনুসারীগণকে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে ভালবাসার শিক্ষা দান করেন। তিনি বিশ্বমানবতাবাদের জয়গানে সকলকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাই তাঁর ভক্ত-অনুসারীগণ সকল বিভেদ ভুলে বিশ্ব মানব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য কাজ করে যান। তাঁরা সকলকে পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে শিক্ষা দেন, ধর্মীয় কোন্দল-বিভেদ ভুলে শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যান। ভারত বর্ষ উপ-মহাদেশের বিশেষতঃ বাংলাদেশের সূফীবাদী ও আধ্যাত্মিক পথের অনুসারী অধিকাংশ ব্যক্তি ও দরবার তাঁরই শাখা-প্রশাখা।
রাসূলনোমা হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ এর শিক্ষা প্রেমের শিক্ষা, ভালবাসার শিক্ষা। যা তিনি সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করেছেন রাসূল পাক সাঃ এর প্রতি। তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসার কারণে তিনি শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে সর্ব্বদা রাসূল পাক সাঃ এর দিদার লাভ করতেন এবং কেউ তাঁর কাছে আর্জি মিনতি করলে তিনি কখনো কখনো দয়াপরবশ হয়ে তাকেও রাসূল পাক সাঃ এর দিদার লাভ করিয়ে দিতেন। তিনি সকলকে দেখিয়েছেন ভালবাসার পথ এবং তা বর্ণনা করেছেন স্বরচিত দিওয়ানে ওয়াইসী কিতাবে। জন্মগত ভাবে তিনি বাঙ্গালী হলেও ফারসী ভাষায় অপূর্ব নৈপুণ্যতার সাথে ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ মহাগ্রন্থ রচনা করে বিশ্বব্যাপী ফারসী কবির মর্যাদা লাভ করেন।
উল্লেখ্য যে, এক সময় তিনি নবী পাক সাঃ এর দিদার লাভ করছিলেন না। তাই অশ্রু জলে বুক ভাসিয়ে সংকল্প করলেন যে, সাত দিনের মধ্যে দিদার লাভ না হলে নদীতে ঝাপ দিয়ে ডুবে মরবেন। ছয় দিন পার হয়ে সপ্তম দিনে আসর ওয়াক্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে যখন সাক্ষাৎ মিলল না; তখন তিনি নদী জলে ঝাপ দিয়ে গভীর পানিতে ডুবে যাওয়ার মনস্থির করেছিলেন। এমনই অন্তিম ক্ষণে পিছন হতে ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পেলেন। ব্যাকুল কণ্ঠে কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছেন, ‘ফ-তে-হ- আ-লী-! থা-ম-, থা-ম-’।
তিনি চমকে পিছনে ফিরে তাকালেন। দেখলেন, হযরত রাসূল সাঃ ঘোড়ায় চড়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসছেন। হাত মোবারক উপরে উঠায়ে অপেক্ষা করতে উচ্চ কণ্ঠে নির্দেশ করছেন। নিকটে এসে তিনি ঘোড়া হতে নামলেন। পূত বক্ষে তাঁকে জড়ায়ে স্নেহ ভরে তিরস্কার করতে থাকেন। হযরত ওয়াইসী রাঃ কান্নাভরা কণ্ঠে বললেন, “হুজুর, আপনাকে দীর্ঘদিন না দেখতে পারায় আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছিল। আপনাকে তিলমাত্র না দেখে আমার সহ্য হয় না। আপনি ওয়াদা করুন, যেন এই হত-দরিদ্র সর্ব্বদা আপনার দিদার লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।” রাসূল পাক সাঃ  তখন অনুপম স্মিত হেসে বললেন, “আচ্ছা, তাই হবে।”
তখন হতে হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে সর্ব্বদা রাসূল পাক সাঃ এর দিদার লাভ করতেন। এ সকল ঘটনার অনেক কিছুই তিনি স্বরচিত পবিত্র দিওয়ানে ওয়াইসী কিতাবে বর্ণনা করেছেন। যা পাঠ করে যে কেউ নিঃসন্দেহে রাসূল সাঃ এর প্রকৃত আশেক ও প্রেমিক হতে পারেন।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর রাসূল প্রেম

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কলম সৈনিক, পরাধীন ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রথম প্রবক্তা, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য সাধনার অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে বাংলা সাহিত্যকে উৎকর্ষতার উচ্চ শিখরে সমাসীন করেছিলেন। কবি প্রায় ৭৭ বছর পৃথিবেিত কাল কাটিয়েছেন। কিন্তু সুস্থ ছিলেন মাত্র ৪২/৪৩ বছর। আর ২২/২৩ বছর সাহিত্য সাধনার পূর্ণ সময় পেয়েছেন বলা যায়। দারিদ্র্য, ুধা, যুদ্ধের ডামডোল এবং জেলখানার কয়েদি জীবনের মধ্যেই কলম কালি ও কাগজের কাজ সেরেছেন। নিত্যসঙ্গী দারিদ্র্যের পেষণে জর্জরিত এই কবি প্রায় চার হাজার গান লিখেছেন। এর মাঝে ইসলামী গানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণের। কবির এ সকল ইসলামী গানে একদিকে রয়েছে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও মহিমার বর্ণনা তেমনি অপরদিকে রয়েছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি অগাধ প্রেম, শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা। নিম্নে কবির তেমনি কিছু গান উল্লেখ করা হলো। যাতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি কবি নজরুলের বোধ কেমন ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে।

রাসূল (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমন কেন্দ্রিক গান কবি লিখেছেন,

‘‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে॥

যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে॥”

কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আরব সমাজে রাসূল (সা.) কর্তৃক সাম্য প্রতিষ্ঠা, অধিকার বঞ্চিত মানুষদেরকে অধিকার প্রদান, মানুষ হিসেবে ধনী-গরিব, বাদশাহ-ফকির সকলেই সমান এবং রাসূলের (সা.) অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের চিত্র বর্ণনা করেছেন কবি নজরুল এই গানের শেষ অংশে,

“মানুষে মানুষে অধিকার দিল যে জন

… … …

মানুষের লাগি চির দীন বেশ নিল যে জন

বাদশাহ ফকিরে এক শামিল করিল যেজন

এল ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী।”

আরব জাহানের শুষ্ক মাটির স্বভাবগত কারণেই সেখানে সবুজ প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি হয় কম। মক্কা নগরীর সেই মরু অঞ্চলে রাসূলের আগমনকে বিদ্রোহী কবি সৌরভপূর্ণ ফুটন্ত গোলাপের সাথে তুলনা করেছেন। আর সেই ফুটন্ত গোলাপের খোশবু নিতে বিশ্বজাহানে প্রতিযোগিতা এবং কাড়াকাড়ি যেন শুরু হয়েছে। চাঁদ-সুরুজ, গ্রহ-তারা, নীল আকাশ, বৃক্ষ লতা, বেহেশতের হুর-পরী তথা বিশ্বজাহানের সকল মাখলুক সেই ফুলের খোশবু নিতে মাতোয়ারা। যেমনটি কবি বলেন,

সাহারাতে ফুটল রে

রঙিন গুলে লালা।

সেই ফুলেরই খোশবুতে

আজ দুনিয়া মাতোয়ালা॥

… … …

কেউ বলে হজরত মুহাম্মদ

কেউ বা কমলিওয়ালা॥

পথভোলা মানুষদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে পাপে নিমজ্জিত মানুষকে জাহান্নামের ভয়, জান্নাতের সুসংবাদ সর্বোপরি আল্লাহতায়ালার বিধানকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাঠানো হয়। মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবের মহান শিক্ষকের নিকট হতে সওদা নিয়ে পাপমুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে,

“ইসলামের ঐ সওদা লয়ে

এল নবীন সওদাগর

বদনসিব আয়, আয় গুনাহগার

নতুন করে সওদা কর।

জীবন ভরে করলি লোকসান

আজ হিসাব তার খতিয়ে নে

বিনি মূলে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহেশতি নজর।”

কিয়ামতের দিন হাশরের মাঠে আল্লাহর অসহায় বান্দারা সকলেই নিজের মুক্তির জন্য ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করতে থাকবে। পাপ-পুণ্যের হিসাব দিয়ে মুক্তির সনদ নিতে হবে সেদিন সকল মানুষকে। পরপারের ভয়াবহতম এইদিনে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর শাফায়াত ছাড়া মুক্তির বিকল্প কোনো পথ খোলা থাকবে না বান্দার জন্য। উক্ত গানের অপর অংশে সে কথাটিই বলছেন কবি নজরুল,

শাফায়াতের সাত রাজার ধন

কে নিবি আয় ত্বরা কর॥

কিয়ামতের বাজারে ভাই

মুনাফা যে চাও বহুৎ

এই ব্যাপারির হও খরিদ্দার

লও রে ইহার সীলমোহর॥

কিশোরকালে নবী মুহাম্মদ (সা.) বাণিজ্য উপলক্ষ্যে চাচা আবু তালেবের সাথে সিরিয়া গমন করলে সেখানকার একজন খ্রিস্টান পাদ্রীর নজরে আসে যে রাসূল (সা.)কে তপ্ত রৌদ্রালোকের মাঝে এক খণ্ড মেঘ ছায়া দিয়ে চলছে। নবীপ্রেমকি কবি তাঁর মনোজগতের কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এ মহা মানবকে শুধু মেঘই নয় বরং বিজলি তাঁর গলার মালা হয়ে এবং পূর্ণিমার চাঁদ তাঁর মাথার মুকুট হয়ে শোভাবর্ধন ও ধন্য হতে চায়। হেরা হতে হেলে দোলে-এ গানের শেষ অংশে কবি উল্লেখ করেছেন এভাবে,

আসমানে মেঘ চলে ছায়া দিতে

পাহাড়ের আছুগলে ঝরণার পানিতে

বিজলি চায় মালা হতে

পূর্ণিমার চাঁদ তাঁর মুকুট হতে চায়।

আরশ মহল্লায় আল্লাহ তায়ালার নামের পাশে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নামটিও রয়েছে। এছাড়া সকল নবী ও রাসূল এ কথার সাক্ষ্য দিয়েছেন যে পৃথিবীতে সর্বশেষ নবী হয়ে যার আগমন ঘটবে তার নাম হবে মুহাম্মদ বা আহমাদ এবং তার আগমনের কারণে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের কিতাবের বিধান বাতিল হয়ে যাবে। এ সত্য কথাটি কবি নজরুল ইসলাম তার গানে ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দরভাবে,

সায়্যিদি মাক্কী মাদানী আমার নবী মুহাম্মদ

আদম, নূহ, ইব্রাহিম, দাউদ, সুলেমান, ঈসা

সাক্ষ্য দিল আমার নবীর

সবার কালাম হলো রদ।

নবীপ্রেমিক কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টিতে নবী (সা.) এর পবিত্র চেহারা মুবারক ইউসুফ (আ.) হতে অনেক বেশি সুন্দর যেমনটি কবি তাঁর গানে বলেছেনÑ

হায় জুলেখা মজল বৃথাই

ইউসুফের ঐ রূপ দেখে

দেখলে আমার নবীর সুরত

যোগীন হতো ভস্ম মেখে।

সুমধুর কণ্ঠের জন্য নবী দাউদ (আ.) বিখ্যাত। তাঁর সুললিত কণ্ঠের কুরআন তেলাওয়াত শুনার জন্যনদীর মাঠ তীরে এসে ভীর জমাত। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) এর সুমধুর কণ্ঠের তুলনায় দাউদ (আ.) যেন তুচ্ছ। তাইতো কবি বলেন,

শুনলে নবীর শিরিন জবান

দাউদ মাগিত মদদ।

অপরদিকে মহানবীর নূর কপালে যুক্ত থাকার কারণে নুহ (আ.)-এর কিশতি প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে ডুবল না। অবলীলাক্রমে সামনে এগিয়ে চলল। কবি বলেন,

ছিল নবীর নুর পেশানিতে

তাই ডুবল না কিশতি নুহের।

একই নামের বরকতে ইব্রাহিম (সা.), ইউনুস (আ.)ও মুক্তি পেলেন। ইসলামের দুই বিখ্যাত কাহিনী নবী দরদী কবি অতি সংক্ষেপে কিন্তু শ্রোতার বোধগম্য করে উল্লেখ করেছেন এই গানের শেষ অংশে।

পুড়ল না আগুনে হজরত

ইবরাহিম সে নমরুদের

বাঁচালো ইউনূস মাছের পেটে স্মরণ করে নবীর পদ;

দোজখ আমার হারাম হল

পিয়ে কুরআনের শিবির শহদ॥

কবি নজরুল নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করতেন যদি রাসূলের পায়ের একটু পরশও পেতেন। রাসূলের (সা.) প্রতি কবির অকৃত্রিম ভক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়, এই গানে।

আমি যদি আরব হতাম মদিনার পথ

সেই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত।

সদা বঞ্চিত বাংলাদেশের এই জাতীয় কবির বিশ্বনবীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা কত গভীর ছিল নিম্নের গানে তার আরও প্রমাণ মেলে। নবীর নাম কবি যতই স্মরণ করেন মনের প্রশান্তি ততই বাড়ে। এই তৃপ্তির শেষ নেই, অফুরন্ত। তিনি ব্যাকুল হয়ে প্রিয়তমের নাম জগতে থাকেন। এ গানের শেষ অংশে পরম প্রভুর নিকট আকুতি জানিয়েছেন সদা সর্বদা বিশ্বনবীর নাম যেন তাঁর হৃদয়পটে অম্লান থাকে। যেমন,

মুহম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে

নামে এত মধু আছে কে জানিত আগে।

… … …

ঐ নামে মুসাফির রাহি চাই না তখত শাহানশাহী

নিত্য ও নাম ইয়া ইলাহি

যেন হৃদে জাগে।

বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিতে প্রচারিত কবি নজরুলের আরও একটি বিখ্যাত গান ‘তাওহীদেরই মুর্শিদ আমার মুহাম্মদের নাম, ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদার কালাম।”  এ গানে কবির রাসূল প্রেম সহজ ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য রাসূলের (সা.) দেখানো পথই একমাত্র পথ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কোনো শারীরিক আকার নেই। তিনি তাঁর ক্ষমতা, শক্তি ও জ্ঞানের দ্বারা সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বদ্রষ্টা। এরপরও আল্লাহ তায়ালা আরশে আজিমে অবস্থান করেনÑ তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হাশরের মাঠে বিচারের দিনে একমাত্র আল্লাহর আরশের ছায়া ভিন্ন অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম জপে কবির অন্তরদৃষ্টি সেই আরশ মহল্লায় চলে যাচ্ছে। কবি বলেনÑ

‘ঐ নামের রশি ধরে যাই আল্লাহর পথে

… … …

ঐ নামের বাতি জ্বেলে দেখি আরশে মুকাম।’

রাসূলের পবিত্র পা মোবারক কবির জান্নাতে পৌঁছানোর পালকি। যেমনটি বলেছেন তিনি ‘তাঁর কদম মুবারক যে আমার বেহেশতি আঞ্জাম।’

কবির চঞ্চল চিত্ত আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় মদিনার প্রকৃতির সাথে সখ্যতা গড়ে মদিনার মাটি, বায়ু, আকাশ-বাতাসকে মনের গভীর বন্ধন থেকে জিজ্ঞেস করছেন আল্লাহর এই প্রিয় বন্ধুটি মদিনার কোন কোন জায়গায় বিচরণ করেছেন? বিমোহিত নয়নে সে জায়গাগুলো দেখতে চান তিনি। কবি তাঁর এই গানে বলেন,

আরে ও মদিনা বলতে পারিস কোন সে পথে তোর

খেলত ধুলামাটি নিয়ে মা ফাতেমা মোর।

… … …

মা আয়শা মোর নবীজীর পা ধোয়াতেন যেথা

দেখিয়ে দে সে বেহেশত আমায় রাখ রে আমার কথা।

… … …

কোন্ পাহাড়ের ঝরনা তীরে মেষ চড়াতেন নবী

কোন্ পথ দিয়ে রে যেতেন হেথায় আমার আল আরাবি

তুই কাঁদিস কোথায় বুকে ধরে সেই নবীজির গোর।

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ (রহমত) পাঠান। হে ঈমানদারগণ তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠাও। (সূরা আহযাব, আয়াত-৫৬)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে রাসূলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, মর্যাদা পরিলক্ষিত হয়। কবি নজরুল আল্লাহর এই প্রিয় বন্ধুর শারীরিক অস্তিত্বকে নিজের সাথে আপাদমস্তক অলঙ্কার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। রাসূলের (সা.) প্রতি আমাদের জাতীয় কবির কত গভীর মহব্বত নিম্নের এ গানে তা বুঝা যায়।

হে প্রিয় নবী রাসূল আমার

পড়েছি এ আবরণ নামেরই তোমার

… … …

গাঁথা মোর কুন্তলে তব আহমাদ

বাধা মোর অঞ্চলে তব নাম

দুলিছে গলে মোর তব নাম মনিহার

… … …

তাবিজ ও অঙ্গুরি তব নাম …

ভয়ে ভয়ে পথে পথে ঘুরি যে পাছে কেউ চুরি করে তব নাম

ঐ নাম রূপমোর ঐ নাম আঁখি ধার …।

মুসলিম জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য গান ও কবিতায় রাসূল (সা.) এর প্রতি তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা প্রকাশমান। আট বছরের শিশু বয়সে মসজিদে চাকরি নেয়ার মাধ্যমে রাসূলের প্রতি তার যে দরদের শুরু হয়েছিল বাকরুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তা চালু ছিল।