সামা-ইসলামী সঙ্গীত

 

সামা কি ?

বিভিন্ন প্রকার সামা

হাদিস শরীফের বর্ণনা

আধ্যাত্মিকতার আলোকে সঙ্গীত

এশকে এলাহী

শানে রাসূল সাঃ

 

 

সামা কি ?

আল্লাহর প্রেমমূলক সঙ্গীতকে ‘সামা’ বলে অভিহিত করা হয়। ‘হামদ’ (আল্লাহর স্তুতি), না’ত (হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রশস্তি), গযল (আল্লাহ্র প্রেমমূলক গান),
মুরশিদী (পীর-মুরশিদের প্রশংসামূলক সঙ্গীত), মারিফাতী (তত্ত্বমূলক গান), আধ্যাত্মিক সঙ্গীত, দেশপ্রেমমূলক সঙ্গীত প্রভৃতিকে ‘সামা’ বা বিশুদ্ধ সঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত করা হয়ে থাকে। সামা বা আধ্যাত্মিক সঙ্গীত দ্বারা সূফীগণ নিজ অন্তরে আধ্যাত্মিক অনুতূতিকে জাগিয়ে তোলে এবং আল্লাহর ধ্যানে নিবিষ্ট হন। সামা এর শ্রবণকারীকে আধ্যাত্মিক রাজ্যে টেনে নিয়ে যায়
এবং মুহূর্তে সাধকের মনে আধ্যাত্মিক ভাব জাগিয়ে তোলে। ‘সামা’ প্রকৃত শ্রবণকারীকে ‘জজবার’ (ভাবন্মোদনা) পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাই চিশতীয়া ও মৌলবীয়া তরীকার সূফীগণ কিছু শর্ত সাপেক্ষে ‘সামা’ শ্রবণকে বৈধ বলে মত দিয়েছেন।

বিভিন্ন প্রকার সামা

আল্লাহ তায়ালার অপূর্ব্ব দান মানুষের শ্রবণ শক্তি। মানুষ শুনিয়াই ঈমান গ্রহণ করে। নবীদের দাওয়াত ও আহ্বান শুনিবার পরই তাঁহাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। মূলতঃ জ্ঞান লাভের একটি উত্তম ও কার্য্যকরী পন্থা হইল শ্রবণ করা। আর সামা হইল আল্লাহর জ্ঞান লাভের একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। কোন কোন বিষয়ে সামা শ্রবণ করা বান্দার জন্য ফরজ ও ওয়াজিব। কোন সামা পছন্দনীয়, কোনটা মুবাহ বা নির্দোষ আবার কোনটা হারাম। আবার কোনটা মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। হযরত ইমাম গাজ্জালী রাঃ কিমিয়ায়ে সাআদাত গ্রন্থের ১৭৫ পৃষ্ঠায় সামাকে তিন ভাগে ভাগ করিয়াছেন।
তিনি বলিয়াছেন, “প্রথম প্রকার মোবাহ সামা। সাধারণ লোকের মধ্যে অনেকে কৌতুক প্রিয়তা বশতঃ আমোদ উপভোগের উদ্দেশ্যে সামা শ্রবণ করিয়া থাকে। এই সম্পর্কে তাহারা (ধর্মীয় হিসাবে) উহার ভাল-মন্দ সম্বন্ধে তত গভীর চিন্তা করে না; বরং অবহেলা বশতঃ নিছক আমোদ উপভোগের উদ্দেশ্যেই নির্দোষ মনে করিয়া কেবল খেল-তামাশা স্বরূপ তাহারা উহা শ্রবণ করিয়া থাকে। এই আমোদ ও তামাশা স্বভাবতঃ অমনোযোগী ও সাধারণ স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের কাজ।
অতএব, যেহেতু এই গোটা সংসারই একটা লীলা-খেলা এবং তামাশা; কাজেই এই ধরনের লোকদের সামাও এই তামাশা শ্রেণীরই অন্তর্গত। এই স্থলে এই রূপ করা বিধেয় নহে যে, যেহেতু সামা আনন্দদায়ক এবং শুনিতে ভাল লাগে, মন প্রফুল্ল হয় তখন তাহা হারাম। কেননা, আনন্দদায়ক বস্তু মাত্রই হারাম নহে। আনন্দদায়ক বস্তু সমূহের মধ্যে যে গুলি হারাম বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে, সে গুলি আনন্দদায়ক এবং ভাল লাগিবার কারণেই হারাম হয় নাই; বরং এই কারণে হারাম হইয়াছে যে, তাহাতে মানুষের সদ গুণাবলী নষ্ট হয়।
যেমন, ভাবিয়া দেখ, সুদৃশ্য পাখী গুলির সুমিষ্ট গান মানুষের মনে খুবই আনন্দ দান করে এবং ভাল লাগে, অথচ তাহা হারাম নহে; বরং সবুজ বর্ণের বিচিত্র বৃক্ষলতা পরিশোভিত প্রান্তরে, কলকল রবে প্রবাহিত স্রোতস্বিনীর কিনারে সদ্য প্রস্ফুটিত চিত্তহারী পুষ্প এবং অফুটন্ত পুষ্প উদ্যানে প্রাতঃকালীন ও সান্ধ্য ভ্রমণ মনে বিশেষ আনন্দ দান করে এবং খুবই ভাল লাগে, কিন্তু সে শ্রবণ হারাম নহে। কর্ণের পক্ষে সুমধুর তান ঠিক তেমনই আনন্দদায়ক যেমন চক্ষুর নিকট মনোরম সবুজ প্রান্তর ও স্রোতস্বিনীর চিত্তাকর্ষক দৃশ্য। নাসিকার নিকট কস্তুরীর ঘ্রাণ আরামদায়ক, জিহ্বার পক্ষে উপাদেয় ও সুস্বাদু খাদ্য তৃপ্তিকর এবং বুদ্ধির পক্ষে সূক্ষ্ জ্ঞান চর্চা অতি আনন্দদায়ক।
এই রূপে চক্ষু, নাসিকা, রসনা ও বুদ্ধি নামক ইন্দ্রিয় গুলি স্বাদ পাইয়া থাকে। তবে সামার সুমধুর তান হইতে শ্রবণের স্বাদ উপভোগ করা কর্ণের পক্ষে কেন হারাম হইবে? সুগন্ধ দ্রব্যের ঘ্রাণ লওয়া, সবুজ বরণ প্রান্তরে মনোরম শোভা দর্শনে উহা হইতে আনন্দ উপভোগ করা যেই রূপ মোবাহ কিন্তু হারাম নহে, যেই রূপ ক্রীড়া-কৌতুক, ফুর্ত্তির মনোভাব সূচক (নির্দোষ) ‘সামা’ শ্রবণ করাও মোবাহ হারাম নহে।
দ্বিতীয় প্রকার : হারাম (নিষিদ্ধ) সামা। যাহার অন্তর কোন কু-প্রবৃত্তি কিংবা অসৎ আসক্তিতে কলুষিত থাকে, তাহার পক্ষে সামা শ্রবণ করা হারাম। যথা- কাহারও হৃদয় কোন কুলটা রমণী কিংবা ছোকরার প্রণয়ে আসক্ত রহিয়াছে, উক্ত রমণী বা ছোকরাকে সামনে রাখিয়া মিলন স্বাদ অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি করিবার বাসনায় সামার সুমধুর সুর শ্রবণে মত্ত হওয়া তাহার পক্ষে হারাম। ‘সামা’ শ্রবণে লিপ্ত হওয়া- যাহাতে অনুরাগ ও আসক্তি আরও বৃদ্ধি পায়; অথবা অলঙ্কার পূর্ণ ভাষার দ্ব্যর্থবোধক পদাবলী, যথা- ঘন, কৃষ্ণ কেশরাশি; সুডৌল গণ্ডদেশের মধ্যস্থিত তিলকবিন্দু এবং চন্দ্রিমা সদৃশ মুখাকৃতি প্রভৃতি চিত্ত উন্মাদক সামা শ্রবণে লিপ্ত হইয়া নিজের প্রিয়জন অর্থাৎ সেই রমণী বা ছোকরার রূপ কল্পনায় বিভোর হওয়া- এই জাতীয় সামা শ্রবণ করাও হারাম। কারণ এই যে, ইহাতে শরীয়ত বিরোধী জঘন্য কামাগ্নি উত্তেজিত হইয়া উঠে। অথচ এই জাতীয় কামাগ্নি প্রশমিত রাখা ওয়াজিব।
সুতরাং সামা শ্রবণের সাহায্যে এই কামাগ্নিকে উত্তেজিত করা জায়েজ, যখন নিজের স্ত্রী কিংবা ক্রীতদাসীর প্রতি আসক্তি এবং কামভাব বৃদ্ধি করিবার মানসে শ্রবণ করা হইয়া থাকে। স্ত্রীকে তালাক না দেওয়া পর্য্যন্ত এবং ক্রীতদাসীকে বিক্রয় করিয়া না ফেলা পর্য্যন্ত তাহাদের সহিত ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকা জায়েজ আছে। স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার এবং ক্রীতদাসীকে বিক্রয় করিয়া ফেলিবার পর তাহাদের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করা অবশ্যই হারাম।
তৃতীয় প্রকার : সদ্ভাব বর্ধক ‘সামা’। অন্তরে খোদা-প্রেম কিংবা কোন সদ্ভাব বা সদাসক্তি লুকায়িত থাকিলে সেই মর্মের ‘সামা’ উক্ত সদ্ভাব গুলিকে সবল ও সতেজ করিয়া তোলে। এই জাতীয় ‘সামা’ বৈধ।
হযরত দাতা গঞ্জে বখশ রাঃ কাশফুল মাহজুব গ্রন্থে লিখিয়াছেন, “পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে যে ভাবে সমস্ত হালাল ও উপকারী সৌন্দর্য্যময় বস্তু দেখা, সুগন্ধিযুক্ত বস্তুর ঘ্রাণ নেওয়া, সমস্ত হালাল ও পবিত্র বস্তু খাওয়া এবং দেহের জন্য সমস্ত নরম ও আরামপ্রদ বস্তু ব্যবহার করা যায়েজ ও মুবাহ। তেমনি যে সমস্ত আওয়াজ অশ্লীল বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও মানুষের নৈতিক চরিত্র বিনষ্টকারী তাহা ব্যতীত অন্যান্য আওয়াজের সামা শ্রবণ করা জায়েজ এবং মুবাহ। ঐ আওয়াজ গদ্য হউক বা পদ্য হউক বা কাব্য, প্রবন্ধ আকারে পাঠ করা হউক অথবা সুরের সহিত। কেননা সুললিত কণ্ঠ মানুষকে প্রভাবিত করিবার সবচাইতে কার্য্যকর উপায়। যদি কেউ বলে যে, সুললিত কণ্ঠ এবং সুর তাহার ভাল লাগে না, তাহা হইলে মনে করিতে হইবে যে, সে হয়ত ভুল বলিয়াছে অথবা কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে অথবা সে মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে গণ্য নয়। বরং সমস্ত জীব-জন্তু হইতে পৃথক কোন সৃষ্টি। কেননা সুললিত কণ্ঠে শুধু মানুষই নয়, জীবজন্তু পর্য্যন্ত প্রভাবিত হইয়া থাকে।”

হাদিস শরীফের বর্ণনা

গান শুনিবার বিষয়ে সহীহ হাদীস গ্রন্থে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত আয়েশা রাঃ বর্ণনা করিয়াছেন, আমার নিকট বসিয়া এক দাসী গান করিয়াছিল। এমন সময় হযরত উমর রাঃ আগমন করেন এবং ভিতরে প্রবেশ করিবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। দাসী হযরত উমর রাঃ এর আগমন টের পাইল তখন সেস্থান হইতে সে পলায়ন করিল। হযরত উমর রাঃ ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইলেন, হুজুর সা. মুচকি হাসিতেছেন। হযরত উমর রাঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি কেন হাসিতেছেন? তিনি তখন বলিলেন, দাসী আমাদের নিকট বসিয়া গান করিতেছিল। তোমার আগমন টের পাইয়া সে পালাইয়া গেল। হযরত উমর রাঃ বলিলেন, রাসূলুল্লাহ সা. যাহা শুনিয়াছেন আমি তাহা না শুনিয়া বিরত হইব না।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এই আলোকে সামা’কে মূল্যায়ন করিয়াছেন। তদুপরি চিশতিয়া তরীকার ঊর্ধ্বতন পীর-মোর্শেদ হযরত খাজায়ে খাজেগান গরীবে নেওয়াজ হযরত মঈন উদ্দীন চিশতী রাঃ যে আলোকে আল্লাহ প্রেমে বিভোর হইয়া সামা শ্রবণ করিতেন, তাহা অবশ্যই বৈধ বলিয়া ঘোষণা দিয়াছেন। এই ক্ষেত্রে প্রণিধান যোগ্য যে, কুরআনুল করিমে কোথাও গান-বাজনাকে হারাম বা অবৈধ বলা হয় নাই।

আধ্যাত্মিকতার আলোকে সঙ্গীত

অলি আল্লাহগণের সামা প্রেম আর সাধারণের সঙ্গীত প্রেম এক নহে। সাধারণের সঙ্গীত প্রেম ও শ্রবণ তাহাদের অশ্লীলতার দিকে ধাবিত করিয়া থাকে। অন্যদিকে আহলুল্লাহ বা আল্লাহর অলিগণকে সামা বা মরমী সঙ্গীত তাঁহাদের অন্তরে আল্লাহ-রাসূল প্রেম বৃদ্ধি করিয়া থাকে। এই প্রসঙ্গে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ‘সিররেহক্ক জামেনূর’ কিতাবের ‘সুর ও সঙ্গীত’ অধ্যায়ে লিখিয়াছেন যে, “আহ্লে দেল আল্লাহ অলিগণ হৃদয়ের প্রশস্ততা অন্বেষণের জন্যই কেবল সুর ও সঙ্গীত শুনিয়া থাকেন। তাঁহাদের মাঝে এই সুর-সঙ্গীতের কারণে আল্লাহ প্রেমে প্রতিবন্ধকতা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কল্পনা মোটেও আসে না। অজ্ঞরাই ধারণা করিয়া থাকে যে, অলিগণের মাঝে সুর-সঙ্গীত ও মন-মোহিনী কণ্ঠ গুনাহের কারণ হয় এবং আল্লাহ প্রেমের মাঝে পর্দার সৃষ্টি করে।
আবেদগণ নিজেদের অবস্থা মূল্যায়ন করিয়া দেখিয়াছেন যে, সুন্দর কণ্ঠ তাহাদের ইবাদতে পর্দার সৃষ্টি করে। কেননা, আবেদগণ জাহেরী ভাবে নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত ও কেরাত পড়ায় মশগুল থাকেন। অথচ এই সব বাহ্যিক ইবাদতে অন্তরের কলুষতা বাহির হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। তাঁহারা মনে করেন, এই সব কিছুই মূল ইবাদত। এই গুলির সওয়াব কেয়ামতের দিন তাহারা পাইবেন।
যেহেতু তাহাদের এই পার্থক্য জ্ঞান নাই যে, মধুর কণ্ঠ এবং সুর-সঙ্গীতের তানে অন্তরের কলুষতা ও পর্দা দূর হইয়া যায়। ক্রমে ক্রমে সেই সুরের তানে আল্লাহর প্রেমিকগণ নিজেদের বিলীন করিয়া সুরের মালিক তথা সুর সঙ্গীত ও মধুর কণ্ঠ সৃষ্টিকারী আল্লাহ তায়ালার সহিত মিশিয়া যান। এই অবস্থা কোন তরীকার জন্য সুনির্দিষ্ট নহে, বরং আহ্লে দেল বা পবিত্র অন্তরের অধিকারীদের জন্য সুর-সঙ্গীত আরও সঠিক উপকারী। তাঁহারা নৈকট্য লাভে ধন্য হন এবং তাঁহাদের অন্তর প্রশস্ত হইয়া যায়। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, মধুর কণ্ঠের মালিক ছাড়া আর কিছুই তাঁহাদের নজরে আসে না। এই মধুর কণ্ঠ শুনিয়া তঁাঁহাদের দিল নরম হইয়া যায়। অন্তরে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়।”

এশকে এলাহী

খোদা প্রেমিক, নবী প্রেমিকগণের অন্তরে নানা সময় নানা রকম ভাবের উদয় হইয়া থাকে। তাহাদের অন্তরের প্রেম যমুনায় ভাব তরঙ্গ ঢেউ খেলিয়া যায়। শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফাতের মাধ্যমে হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ এর অন্তর ঐশী প্রেমের সুরের খনি হইয়া যায়। তাই হযরত জানশরীফ রাঃ ‘সুরেশ্বরী’ তথা সুরের ঈশ্বর নামে সুপরিচিত হইয়া ওঠেন। ধীরে ধীরে তাঁহার এই পরিচিতি বাংলার সীমানা পেরিয়ে বাংলা ভাষা-ভাষী বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়াইয়া পড়িয়াছিল।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর পরশে যাহারাই আসিয়াছেন, তাহাদের অন্তরে ঐশী প্রেমের আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছে। সেই ধারা আজো অব্যাহত রহিয়াছে। ঐশী প্রেমের প্রেমবাষ্প যখন তাহাদের কাহারো কাহারো অন্তরে উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে, তখন তাহারা কেহ কলমে-কাগজে, কেহ ইথারে সেই সুর ভাসাইয়া দিয়াছেন। তাহাদের উল্লেখযোগ্য হইয়াছেন মাওলানা ফরখ উদ্দীন রহঃ, মৌলভী আবদুল হাকিম প্রমুখ।
মাওলানা ফরখ উদ্দীন রহঃ এশকে এলাহী বা ঐশী প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া লিখিয়াছেন,

“উঠাইয়া দুই হাত, করিতেছি মোনাজাত,
ওগো আল্লাহ পাক জাত, লা-ইলাহা ইল্লাল্লহ।

তুই বিনে কেহ নাই, নিগতির গতি সাঁই।
এই ভিক্ষা আমি চাই, লা ইলাহা ইল্লাল্লহ।”

মুন্সী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ফকির লিখিয়াছেন

মাওলা তুমি হক্কের হাকিম
তুমি রাহমানুর রাহিম
তাইতো তোমার নামের জিকির
সবাই করে রাত্র-দিন।

তিনি এই চারটি চরণে আল্লাহ তায়ালার প্রতি প্রার্র্থনা করিয়াছেন। তাঁহার গুণাবলী তিনি তুলিয়া ধরিয়াছেন।

জয়নাল আবেদীন স্বদেশী লিখিয়াছেন :

আকাশে বাতাসে জমিনে সাগরে
কোথাও মাওলা দিল না ঠিকানা।

মুমিনের ক্বালবে বাঁধিলো আস্তানা
খুঁজিয়া বেড়ায় পাগলও মাস্তানা।

তিনি আরো লিখিয়াছেন :

কোথায় আমার সাঁই নিরাঞ্জন
কে দিবে তা বলে,

আমার মোর্র্শেদ কেবল বলতে পারে
মোর্র্শেদী কৌশল রে?

শানে রাসূল সাঃ

আল্লাহ তায়ালা প্রেমে পড়িয়া নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ কে সৃষ্টি করিয়াছেন। প্রেমাস্পদের স্মরণে তাঁহার প্রতি ফেরেশতাদের নিয়া নিয়মিত দরূদ-সালাম পেশ করিয়া থাকেন। তাই কুল-মাখলুক নবী সাঃ এর প্রেমে মাতোয়ারা। অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক, গীতিকার তাঁহার শানে কত স্তুতি লিখিয়াছেন ইহার হিসাব নাই। বিশ্বের বুকে যাঁহাকে নিয়া সর্ব্বাধিক চিন্তা-গবেষণা হইয়াছে, তিনি আমাদের প্রিয় রাসূল পাক সাঃ।
একই ভাবে আশেকানে সুরেশ্বরী, আশেকানে নূরশাহ রাঃ এর ভক্তবৃন্দ ছিলেন আশেকে রাসূল সাঃ। কিন্তু অন্তরের ভাব তো সবাই ছন্দে-সুরে প্রকাশ করিতে পারিত না। যাহারা তাহাতে সক্ষম হইয়াছেন, তাহাদের উল্লেখযোগ্য হইলেন কবি তসের আলী, জয়নাল আবেদীন স্বদেশী প্রমুখ।
কবি তসের আলী নবী প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া লিখিয়াছেন এবং গাহিয়া উঠিয়াছেন :

“কাণ্ডারী আছে যার রাসূল
পার হবে সে হীরার ধার
পুল ছেরাতের পুল।”

মুন্সী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ফকির লিখিয়াছেন

নিজে খোদা আশেক হইয়া
ফেরেস্তা সঙ্গে নিয়া
জপে ঐ নামের জপমালা
হুকুম হয় আদমে ঐ নাম জপিতে
অতি মহব্বতের সাথে রে ॥

আবার জয়নাল আবেদীন স্বদেশী নবী সাঃ এর সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করিয়া লিখেন :

আরশেতে ছিলা যখন
আহাদ নাম ছিলো তোমার
মদিনাতে প্রকাশিলা
মোহাম্মদ নামে প্রচার..।