আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব

 

বাহ্যিক জ্ঞান ও আত্মিক জ্ঞান

সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন

আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য পীরের নিকট বায়াত গ্রহণ

পীরের নিকট বায়াত গ্রহণের বিষয়ে পবিত্র কোরআন শরীফের  নির্দেশনা

 

পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, মহান আল্লাহ্ তায়লা বলেন, “আমিতো বহু জীন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা বোঝেনা, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখেনা এবং  তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনেনা। এরা পশুর মতো বরং তার ছেয়েও পথভ্রষ্ঠ। এরাই উদাসীন” (সূরা আ’রাফ, আয়াত-১৭৯)। পবিত্র আয়াতে বোঝা গেল- বাহ্যিক হৃদয় দ্বারা বাহ্যিক জগতের পরিচয় জানা, চোখ দিয়ে দেখা ও কান দ্বারা শোনা ছাড়াও আত্মিক হৃদয়, চোখ ও কান রয়েছে। আরো এরশাদ হয়েছে, “এরাই তারা, আল্লাহ যাদের হৃদয়, কান ও চোখ মোহর করে দিয়েছেন, আর ওরাই তো গাফেল। নিশ্চয়ই উহারা আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে”(সূরা নাহল, আয়াত ১০৮-১০৯)। আয়াতদ্বয়ের আলোকে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে, বাহ্যিক জগত ছাড়াও আর একটি জগত আছে যা আত্মিক জগত নামে পরিচিত।

বাহ্যিক জ্ঞান ও আত্মিক জ্ঞান

সৃষ্টি জগত দু’ভাগে বিভক্ত। বস্তুজগত ও আত্মিক জগত। বস্তু বা দৃশ্যমান জগতের সাথে আমরা দৈহিক ভাবে নানা কলা- কৌশল তথা নিয়ম পদ্ধতির মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। পক্ষান্তরে আত্মিক বা অদৃশ্য জগত হলো অত্যন্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও রহস্যময় জগত। এই জগতের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বস্তুজগত বা দৃশ্যমান জগতের যোগাযোগ মাধ্যম সম্পূর্ণ অচল। একমাত্র পরিশুদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত আত্মার সাহায্যেই আত্মিক জগতের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগেও আমরা অনেকেই আত্মিক জগত সম্পর্কে নানা মত পোষণ করে থাকি। এও মনে করি যে, আত্মিক জগত সম্পর্র্কে চিন্তা করারও কোন প্রয়োজন নেই, আর তা করলে ঈমানহারা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মৃত্যুর পরই কেবল সে জগতের প্রশ্ন আসে। আবার অনেকেই মনে করে থাকি যে, আত্মিক জগত শুধু কল্পনারই জগত ইত্যাদি। প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টির সুচনালগ্ন থেকেই মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আগত নবী-রাসূলগণ ও পরে তাঁদের উত্তরসূরী অসংখ্য মহামানব এবং তাদের অনুসারীগণ আত্মিক জগতের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয়তম বন্ধু হযরত রাসূল (সঃ)-এর দিদার লাভে ধন্য হয়েছেন। জেনেছেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির রহস্য। কিন্তু বিজ্ঞানের এই চরম উন্নতির যুগেও আত্মিক জগতের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত নই, এটা আমাদের জন্য চরম ব্যর্থতা। আর এজন্য পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “যে ইহলোকে অন্ধ সে পরলোকেও অন্ধ এবং আরো বেশী পথভ্রষ্ঠ”(সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৭২)।

দেহ আর আত্মার সমন্বয়েই মানুষ। আত্মা ছাড়া দেহ মৃত লাশ। আর প্রত্যেক মানুষ মূলতঃ দু‘টি দেহের অধিকারী। একটি তার জৈবিক বা জড় দেহ যা রক্ত মাংস ও হাড্ডিযুক্ত, অপরটি হচ্ছে আলোক বা ইথারিক দেহ যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু আলোক দেহধারীর ছবি দেখা যায় ও তার কথাও শোনা যায়। ওই দেহধারীর বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই টেলিভিশন নামক যন্ত্রে। টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে একজন জড় দেহের মানুষকে আধুনিক বিজ্ঞানের কলা কৌশলের মাধ্যমে ইথারিক বা আলোক দেহে রূপান্তরিত করে সমগ্র বিশ্বে ইথার তথা তরঙ্গে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে টেলিভিশন নামক গ্রাহক যন্ত্রের দ্বারা পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে তাৎক্ষণিক জড় দেহধারী ব্যক্তির আলোক দেহ দেখা যায় ও তার কথাও শোনা যায়। টিভিতে আমরা যে ছবি দেখি তা ধরা ছোয়ার বাইরে। কিন্তু তার ছবি ও কথা কোনটিই মিথ্যা নয়। এতো সামান্য জ্ঞানের অধিকারী মানুষের আবিস্কারকৃত কলা কৌশলের ফল। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম ‘ইন্টারনেট’। এর সাথে আলোকময় জগতের যোগাযোগ পদ্ধতির অনেকটা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন, একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপে ইন্টারনেট কানেকশন সংযোগ করে ঘরে বসে পৃথিবীর যেকোন দেশের খবরাখবর নেয়া ও ছবি দেখা যায়। তেমনি ডিস এ্যান্টিনার মাধ্যমে টেলিভিশন নামক যন্ত্রে বিশ্বের খবরাখবর নেয়া ও ছবি দেখা যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যদি গভীর ভাবে চিন্তা করি তা হলেই আত্মিক জগতের চিত্র আমাদের সামনে অনেকটাই পরিস্কার হয়ে যায়। তবে এইযে জাগতিক কলাকৌশলের বিষয়ে আলোচনা করলাম এগুলো হলো মহান আল্লাহ্ পাকের সৃষ্টি ক্ষুদ্র জ্ঞানের মানুষের আবিস্কার যা জাগতিক জ্ঞানের ফসল। অপরদিকে আত্মিক জগতের সাথে যোগযোগ করতে হলে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর এই আত্মিক জ্ঞান অর্জনের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে সবিস্তারে বর্ণনা রয়েছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহ্রই এবং সব কিছুকে আল্লাহ্ পরিবেষ্টন করে আছেন” (সূরা নেসা, আয়াত-১২৬)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে,“তিনি (আল্লাহ্) যাকে ইচ্ছা হিকমত(বিশেষ জ্ঞান)প্রদান করেন এবং যাকে হিকমত প্রদান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয় এবং বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শুধু শিক্ষা গ্রহণ করে” (সূরা বাকারা-২৬৯)। প্রথমোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ পাক বিশ্বজাহানের মালিক এবং সমগ্র বিশ্ব জগত তিনি পরিবেষ্টন করে আছেন। অর্থাৎ তিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতে বিরাজমান। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ্ দয়া করে যাকে ইচ্ছা তাকেই ‘হিকমত’ বিশেষ জ্ঞান (তাঁকে জানার জ্ঞান) দান করেন। আর যাকে ওই বিশেষ জ্ঞান দান করেন তাঁকে প্রভূত কল্যাণও দান করে থাকেন। আর বোধশক্তিসম্পন্ন অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞানের অধিকারীগণই প্রকৃত শিক্ষা লাভের ক্ষমতা রাখেন। মহান আল্লাহ পাকের জ্ঞানে যারা জ্ঞানী তারা সাধারণ মানব নন বরং তারা বিশেষ মর্যদাশীল ব্যক্তি,তারা আল্লাহ পাকের মনোনিত ব্যক্তি, তারা আল্লাহ্ পাকের বন্ধু বলে পরিগণিত। আল্লাহ্র বন্ধুগণই আত্মিক জগতের সাথে যোগাযোগের ক্ষমতা রাখেন এবং অপরকেও আত্মিক জগতের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন। সৃষ্টির শুরু থেকে যত নবী-রাসূল জগতে আগমন করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ রেখে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ধর্ম প্রচার এবং মানব জাতিকে হেদায়েতের কাজ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাঁর নিজ সম্পর্কে এরশাদ করেন, “তিনি (আল্লাহ্) আদি, তিনিই অন্ত, তিনি প্রকাশ, তিনি গুপ্ত এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত”(সূরা হাদিদ, আয়াত-৩)। অর্থাৎ সৃষ্টি জগত সৃজনের আগে মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কোন কিছুই ছিলনা, সৃষ্টি জগত ধ্বংস হওয়ার পরও তিনি থাকবেন, তিনি সৃষ্টির মাঝেই নিজেকে প্রকাশ করেছেন,আবার তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে গোপন অবস্থায় আছেন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, “আমি গুপ্ত ধনাগার ছিলাম, নিজকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম, তাই সৃষ্টি জগত সৃজন করলাম” (সিররুল আসরার)। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক গোপনে না থেকে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ভালবাসলেন এবং সৃষ্টিকেই তাঁর ভালবাসার মাধ্যম হিসেবে বেঁচে নিলেন। হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ আরো বলেন, “মানবজাতি আমার গুপÍ ভেদ এবং আমি মানুষের গুপ্ত রহস্য” (সিররুল আসরার)। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সমগ্র সৃষ্টিরাজির উপর প্রাধান্য বিস্তার করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়েছে। এরপরও মানুষ হিসেবে আমরা আত্মিক জগতের কথা ভাবিনা, আল্লাহ পাকের দিদার লাভের চিন্তা করিনা বা কি করে তাঁর দিদার লাভ করা যায় সেই পথের সন্ধানও করিনা। অথচ মহান আল্লাহ পাকের মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল-মানুষের মাধ্যমে তাঁর গুনাবলী প্রকাশ পাবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন,“ পৃথিবীর সব গাছ যদি কলম হয়, আর এই যে সমুদ্র এর সঙ্গে যদি সাত সমুদ্র যোগ দিয়ে কালি হয় তবুও আল্লাহ্র গুণাবলী লিখে শেষ করা যাবেনা। আল্লাহ্তো শক্তিমান তত্ত্বজ্ঞানী” (সূরা লোকমান, আয়াত-২৭)। এই অসীম গুনাবলীর অধিকারী মহান আল্লাহ গোপন অবস্থা থেকে প্রকাশ পেয়ে তাঁর গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে চেয়েই মানব সৃষ্টি করেন। আল্লাহ্ পাক মানুষকে এতো উচ্চ মর্যাদায় দিয়েছেন যে, তাঁর প্রতিনিধি করে মানুষকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ প্রদত্ত এই উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে আমরা নিজেরাই হয়ত অনেকে জানিনা। এছাড়া মানুষের সার্বিক প্রয়োজনে এই সৃষ্টি জগত সৃজিত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, “তোমরা কি দেখনা আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন?” (সূরা লুকমান, আয়াত-২০)। বস্তুতঃ আল্লাহ্র অনুগ্রহ ব্যতীত কারো চলার শক্তি নেই। আরো এরশাদ হয়েছে, “তিনি (আল্লাহ্) পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন; তিনি সর্ব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত”(সূরা বাকারা-২৯)। এই সৃষ্টি জগত দু‘ভাগে বিভক্ত। যার একটি হলো বস্তু জগত বা দৃশ্যমান জগত আর অপরটি আলোকময় তথা আত্মিক জগত। আর সে জগত অনন্ত অসীম।

সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন

মানুষ প্রধানতঃ দুটি আত্মার অধিকারী। একটি জীবাত্মা বা নফস যা মানব সৃষ্টির চার উপাদান আগুন, পানি, মাটি ও বায়ু’র সমন্বয়ে সৃষ্ট এবং অপরটি পরমাত্মা বা রূহ যা মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আঃ)-এর মাঝে তাঁর রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছেন। আমরা সবাই হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তান হিসেবে আমাদের মাঝেও রূহ বিদ্যমান। জীবাত্মা অত্যন্ত শক্তিশালী। এই জীবাত্মাই মহান আল্লাহ্ তায়ালার সত্তা রূহ্কে ধারণ করেছে। আর রূহই হচ্ছে মানুষের কাছে আল্লাহ্ পাকের আমানত। জীবাত্মা মূলত সচ্ছ ও পরিশুদ্ধ। কিন্তু এর কিছু শত্রু আছে যেগুলো নফসকে আক্রান্ত করে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই ষড় রিপু নফসকে কলুষিত করে। যেমন জীবানুমুক্ত পানি পান করে জীবের জীবন রক্ষা পায়। যদি পানিতে বিষ মিশ্রিত হয় তখন পানি হয় বিষাক্ত। আর এই বিষাক্ত পানি পান করলে জীবের প্রাণনাশ হয়। তেমনি পরিশুদ্ধ জীবাত্মা যখন ষড়রিপু দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন তা কলুষিত হয়ে যায় এবং দুনিয়ার লোভ আর ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অশান্তি সৃষ্টি হয় ব্যক্তি জীবন থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় জীবন পর্যন্ত। কলুষিত নফস ধারী ব্যক্তি শান্তি ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে  অশান্তির পথে ধাবিত হয়। কাজেই জীবাত্মা যাতে ষড়রিপু দ্বারা আক্রান্ত হতে না পারে সেজন্যই আত্মশুদ্ধি লাভ করা প্রয়োজন। পরিশুদ্ধ জীবাত্মা হলো বাহন আর রূহ সোয়ারী। এই দু‘য়ে মিলে আত্মিক জগত ভ্রমণ করতে পারে এবং আত্মিক জগতের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে, কি করে ষড়রিপুর আক্রমণ প্রতিরোধ করে জীবাত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখা  যায়। জীবাত্মাকে নফস নামেও অভিহিত করা হয়। হযরত রাসূল (সঃ) বলেছেন, “নফসের সাথে যুদ্ধ করাই প্রকৃত জেহাদ”। তিনি আরো বলেন, “যে নিজকে (নিজের নফসকে) চিনতে পেরেছে, সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে”। তাহলে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে, হযরত রাসূলে পাক (সঃ)-এর শিক্ষা পদ্ধতি কি ছিল?  তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। সুদীর্ঘ ১৫ বছর হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় ধ্যান সাধনা তথা মোরাকাবা করেছেন। মক্কা থেকে ৩ মাইল দূরে যে হেরা পর্বতের গুহা প্রায় পৌণে দুইশ’ বছর পরও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে, যেখানে উঠতে রাসূল (সঃ) প্রেমিকদের আজো হিমসিম খেতে হয়, সেই নির্জন মরু পাহাড়ের গুহায় তিনি যৌবনের ১৫ টি বছর ধ্যান সাধনায় কাটিয়েছেন। এই ধ্যান সাধনার বিদ্যার মাধ্যমেই তিনি তাঁর প্রভুর সন্ধান পেয়ে পবিত্র বাণী প্রাপ্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর অনুসারী তথা মুসলিমদেরকে সেই ধ্যান সাধনার বিদ্যাই শিক্ষা দিয়েছেন। আর ওই বিদ্যায় বিদ্বান হয়ে নিজেদের জীবাত্মা তথা নফসকে পরিশুদ্ধ করে (আত্মশুদ্ধি লাভ করে) মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসূল (সঃ)-এর প্রেমে দেওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম কাফেরদের শত অত্যচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন হাসিমুখে। তাঁরা নিজেদের ধন-সম্পদ, আত্মিয়-স্বজনের মায়া পরিত্যাগ করে রাসূল (সঃ)-এর প্রেমে জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে তাঁর সাথে মদিনায় হিযরত করেছেন। অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সঃ)-এর নির্দেশে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে হাসিমুখে শহীদের মর্যাদা লাভ করেছেন। আমরা সেই সে জাতি, উম্মতে মোহাম্মদী, মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী। পরম সৌভাগ্য যে, আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে দয়া করে উম্মতে মোহাম্মদীর মর্যাদা দান করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যে শিক্ষায় নিজের জীবাত্মা বা নফসকে পরিশুদ্ধ করা যায়, যে শিক্ষায় আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায়, সেই মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা, ধ্যান সাধনার শিক্ষা, মোরাকাবার শিক্ষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে নফসের খায়েসে, শয়তানের ধোঁকায় পড়ে দুনিয়া লোভী হয়ে পাপাচারের মাধ্যমে যেমন নিজেদেরকে (জীবাত্মা বা নফসকে) কলুষিত করে অশান্তিতে ভুগছি, তেমনি আমাদের এমন কার্যাদিতে সমাজেও অশান্তি বাড়ছে। ধর্ম পালন করেও ধর্মের প্রকৃত স্বাদ বা ফল আমরা ভোগ করতে পারছিনা।

হযরত রাসূল (সঃ)-এর যুগে তাঁর কাছ থেকে সাহাবায়েকেরাম ধ্যান সাধনার বিদ্যার মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে ধর্ম পালন করতঃ শান্তির পধে চলার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। এমনকি তাঁরা আত্মিক জগতের সাথে যোগাযোগ করতেও সক্ষম হয়েছেন। তাঁরা ছিলেন উজ্জল নক্ষত্র। আর তাঁরা তা করতে পেরেছেন, হযরত রাসূল (সঃ)-কে অনুকরণ ও অণুসরণ করে। পবিত্র হাদিসে হযরত রাসূল(সঃ) বলেছেন, “শরীয়ত আমার বাক্য(কথা), তরীকত আমার কাজ, হাকীকত আমার অবস্থা এবং মারেফাত আমার নিগুঢ় রহস্য।” হযরত রাসূল (সঃ) তাঁর অনুসারীগণকে শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফাতের বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। শরীয়ত যেমন দেহ পরিষ্কার করে তেমনি মারেফাত আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনে সহায়তা করে। হযরত রাসূল (সঃ)-এর ওফাত লাভের পর চার খলিফার যুগ পর্যন্ত হযরত রাসূল (সঃ)-এর মৌলিক শিক্ষা চালু ছিল। এজন্য ওই যুগকে ইসলামের স্বর্ণ যুগ বলা হতো। পরবর্তীতে বিশেষ করে কারবালা যুদ্ধের পর দুরাচার এজিদ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসলাম হয়ে পড়ে শুধু শরীয়ত সর্বস্ব। বেলায়েতের যুগে যাঁরা এজিদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, এজিদকে সমর্থন করেননি, তাঁরা ছিলেন মোহাম্মদী ইসলামের প্রকৃত ধারক ও বাহক। আর তাঁদের মাধ্যমেই দুনিয়াতে টিকে আছে প্রকৃত মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা-এলমে শরীয়ত ও এলমে মারেফাত যা মানুষের বাহ্যিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধতা আনয়ন করে। বেলায়েতের যুগে অসংখ্য অলী-আল্লাহ্, মোর্শেদ তথা পথপ্রদর্শক জগতে আগমন করেছেন, যাঁরা হযরত রাসূল (সঃ)-এর শিক্ষায় মানুষকে শিক্ষিত করেছেন। যাঁরা শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফতের বিদ্যা শিক্ষা লাভ করে ধর্ম পালন করেছেন তাঁরাই সফলকাম হয়েছেন।

আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য পীরের নিকট বায়াত গ্রহণ

একদিকে যেমন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত রাসূল (সঃ)-এর স্বরূপ উদ্ঘাটন করে জগতবাসীর কাছে প্রকাশ করেছেন, তেমনি যুগের মানুষকে শরীয়ত, তরীকত, হাকিকত ও মারেফাতের বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রকৃত আশেকে রাসূলের মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য পীর-মোর্শেদের প্রয়োজন। একজন আদর্শ মোর্শেদ পারেন সঠিক পথ প্রদর্শক করতে। হযরত রাসূল (সঃ)-এর শিক্ষা লাভের মাধ্যমে কি করে বাহ্যিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করা যায় সেই পথ তিনি দেখিয়ে থাকেন। তাঁর প্রদর্শিত পথে চলে যারা সফলকাম হয়েছেন তারাই প্রকৃত মুমেন বা আশেকে রাসূল। আর একজন মুমেন তথা আশেকে রাসূলই পারেন আত্মিক চরম উৎকর্ষতার সুবাধে ধর্ম পালন করে শান্তিতে বসবাস করতে। শরীয়ত ও মারেফাতের জ্ঞান অর্জন এবং জীবাত্মা বা নফসকে ষড়রিপুর তাড়নামুক্ত রাখতে মোর্শেদের সান্নিধ্য লাভ ও তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি চর্চার বিকল্প নেই। মোর্শেদকে অনুসরণ ও তাঁর গোলামীর মাধ্যমেই আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করা যায়। তাই, আমাদের প্রত্যেকের প্রয়োজন আদর্শ মোর্শেদের সাহচর্য লাভের চেষ্টা করা।

পীরের নিকট বায়াত গ্রহণের বিষয়ে পবিত্র কোরআন শরীফের  নির্দেশনা

পীরের নিকট বায়াত গ্রহণ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন পাকে বহু নির্দেশ আছে । তবে পীর শব্দটি পবিত্র কোরআন পাকে নেই । কারণ পীর শব্দটি ফার্সি ভাষা হতে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে । যেমনঃ নামাজ, রোজা, ফিরিস্তা, খোদা, ইত্যাদি শব্দগুলো কোরআন শরীফে-এ নেই । কারণ উহা ফার্সি শব্দ , তবে এর প্রতিটি ফার্সি শব্দেরই প্রতিশব্দ কোরআন শরীফ আছে, যেমনঃ নামাজ- সালাত, রোজা- সাওম, ফেরেশতা-মালাকুন ইত্যাদি । আবার সালাত আরবি শব্দটি স্থান বিশেষ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় । অনুরূপভাবে পীর ফার্সি শব্দের প্রতিশব্দ পবিত্র কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শব্দে প্রকাশ করেছেন, যথাঃ ‘অলি’ বহুবচনে আউলিয়া, মুর্শিদ, ইমাম, বহুবচনে আইম্মা, হাদি, ছিদ্দিকিন, ইত্যাদি ।

নিম্নে কিছু আয়াত শরিফের অর্থ পেশ করা হলঃ

হে মুমিনগণ! তোমরা অনুসরণ কর, আল্লাহ্ পাক এর, তাঁর রাসুল পাক (দঃ) এর এবং তোমাদের মধ্যে যারা ধর্মীয় নেতা ।

— সুরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৫৯

স্মরণ কর! সেই দিনকে যেদিন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাঁদের (ইমাম) নেতা সহ আহ্বান করব ।

— বনি ইসরাইল, আয়াতঃ ৭১

মুমিন পুরুষ ও মুমিনা মেয়েলোকের ভিতর হতে কতেক কতেকের বন্ধু ।

— সুরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৭১

তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে ।

— সুরাঃ আল-ইমরান, আয়াতঃ ৭১

অনুসরণ কর তাঁদের যারা তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাহে না, এবং যারা সৎ পথ প্রাপ্ত ।

— সুরাঃ ইয়াসিন, আয়াতঃ ২১

যে বিশুদ্ধ চিত্তে আমার অভিমুখি হয়েছে তাঁর পথ অনুস্মরণ কর

— সুরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ১৫

জিকির সম্বন্ধে তোমাদের জানা না থাকলে জিনি জানেন তাঁর নিকট হতে জেনে নাও ।

— সুরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ৭

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (ছাদেকিন) সত্যবাদী গণের সঙ্গী হয়ে যাও ।

— সুরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১১৯

নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাকের রহমত (মুহসিনিন) আউলিয়া কিরামগনের নিকটবর্তী ।

— সুরাঃ আরাফ, আয়াতঃ ৫৬

আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত হয় এবং তিনি (আল্লাহ্) যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনো তাঁর জন্য কোন পথপ্রদর্শনকারী (মুরশিদ) পাবে না ।

— সুরাঃ কাহাফ, আয়াতঃ ১৭

সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় নেই, এবং তারা কোন বিষয় এ চিন্তিতও নহে । তাঁদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহর কথার কোন পরিবর্তন হয় না, উহাই মহা সাফল্য ।

— সুরাঃ ইউনুছ, আয়াতঃ ৬২-৬৪

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় কর, এবং তাকে পাবার জন্য (নৈকট্য লাভের) অছিলা তালাশ কর ।

— সুরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ৩৫