দ্বিতীয় পর্ব
নবী রাসূলগণের জীবন থেকে শিক্ষা
.
হযরত আহমদ মুসতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সা.
।
হযরত যুলকিফল আ.
কুরআন মজিদে ‘যুলকিফল’ নামটি দুবার উল্লেখ হয়েছে। দু’বারই অন্যান্য নবীদের সাথে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একবার উল্লেখ হয়েছে সূরা আল আম্বিয়াতে। সেখানে বলা হয়েছে এভাবে, “আর ইসমাঈল, ইদ্রিস ও যুলকিফল, এরা সবাই ছিলো ধৈর্যশীল। আমার রহমত দ্বারা এদের সিক্ত করেছিলাম। এরা ছিলো যোগ্য সৎ কর্মশীল।” (সূরা ২১, আল আম্বিয়াঃ ৮৫-৮৬)
সূরা সোয়াদে তাঁর কথা উল্লেখ হয়েছে এভাবে-
“ইসমাঈল, আলইয়াসা আর যুলকিফলের কথা স্মরণ করো। এরা সবাই ছিলো উত্তম মানুষ।” (আয়াত- ৪৮)
যুলকিফল ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন নবী। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুব আ. এর পুত্র। ‘যুলকিফল’ শব্দের অর্থ ভাগ্যবান। দুনিয়াবী দৃষ্টিতে নয়, পরকালীন দৃষ্টিতে ভাগ্যবান। এটি তাঁর আসল নাম নয়, বরং এটি ছিলো তাঁর উপাধি। তাঁর মূল নাম ছিলো ‘বিশর’। যুলকিফল যদি আইয়ুব আ. এর পুত্র হয়ে থাকেন, তবে পিতার পরেই তিনি নবী হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন যুলকিফল আসলে বাইবেলে উল্লেখিত যিহিস্কেল নবী। যিহিস্কেল মুসলমানদের কাছে হিযকীইল নামে পরিচিত। তাঁর এই পরিচয়টি সঠিক মনে হয়।
বাইবেলের যিহিস্কেল পুস্তক থেকে জানা যায়, রাজা বখতে নযর যখন শেষবার জেরুজালেম ধংস করেন, তাঁর আগে তিনি বহু বনী ইসরাইলীদের বন্দী করে নিয়ে যান। বখতে নযর ইরাকের খাবুর নদীর তীরে বনী ইসরাইলী বন্দীদের একটি উপনিবেশ গড়ে তোলেন। এর নাম ছিলো তেলআবিব। এখানেই খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৪ অব্দে হযরত হিযকীইল নবুয়ত লাভ করেন। এ সময় তাঁর বয়েস ছিলো ত্রিশ বছর। এখানে তিনি বাইশ বছর যাবত বনী ইসরাইলীদের মাঝে নবুয়তের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বীন প্রচারের কাজকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর লোকেরা যখন তাঁর বাড়িতে শোক প্রকাশের জন্যে আসে, তখন তিনি এতো দুঃখের মাঝেও তাঁদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখাতে থাকেন।
এই হিযকীইল বা যিহিস্কেলই ছিলেন হযরত যুলকিফল আ.। তিনি সেই সব নবীদের একজন যারা নিজেদের জীবনের একটি অংশ বন্দী হিসেবে কাটিয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান। দিনরাত আল্লাহর দীনের কাজে নিমগ্ন থাকতেন। মানুষকে আল্লাহর ভয় দেখাতেন। তিনি শাসকদের সবসময় সত্য সততা ও ন্যায়পরায়নতার ব্যাপারে সতর্ক করতেন।
।
হযরত মুসা কালিমুল্লাহ আ.
মূসা আ.-এর পরিচয়
মূসা ইবনে ইমরান বিন ক্বাহেছ বিন ‘আযের বিন লাভী বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইব্রাহিম আ.। অর্থাৎ মূসা হলেন ইব্রাহিম আ.-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। মূসা আ.-এর পিতার নাম ছিল ‘ইমরান’ ও মাতার নাম ছিল ‘ইউহানিব’। তবে মায়ের নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। উল্লেখ্য যে, মারিয়াম আ.-এর পিতার নামও ছিল ‘ইমরান’। যিনি ছিলেন হযরত ঈসা আ.-এর নানা। মূসা ও ঈসা উভয় নবীই ছিলেন বনী ইসরাঈল বংশীয় এবং উভয়ে বনী ইসরাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (সাজদাহ- ৩২, ছফ -৬১)। মূসার জন্ম হয় মিসরে এবং লালিত-পালিত হন মিসর সম্রাট ফেরাউনের ঘরে। তাঁর সহোদর ভাই হারূণ আ. ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড় এবং তিনি মূসা আ.-এর তিন বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী তীহ্ প্রান্তরে বনী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। হযরত মূসা আ. পঞ্চাশ বছর বয়সে নবী হয়ে ফেরাউনের দরবারে পৌঁছেন। অতঃপর তেইশ বছর দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পর ফেরাউন ডুবে মরে এবং বনী ইসরাঈল মিসর থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় মূসা আ.-এর বয়স ছিল সম্ভবতঃ আশি বছর।
উল্লেখ্য যে, হযরত আদম আ., ইয়াহ্ইয়া আ. ও ঈসা আ. ব্যতীত প্রায় সকল নবীই চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন। হযরত মূসা আ.ও চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন বলে অধিকাংশ বিদ্বান মত পোষণ করেছেন। সেমতে হযরত মূসা আ.-এর বয়সকে নিম্নরূপে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন, প্রথম ৩০ বছর মিসরে, তারপর ১০ বছর মাদিয়ানে, তারপর মিসরে ফেরার পথে তূর পাহাড়ের নিকটে ‘তুবা’ উপত্যকায় ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ। অতঃপর ২০ বছর মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান। তারপর ৬০ বছর বয়সে বনী ইসরাঈলদের নিয়ে মিসর হতে প্রস্থান এবং ফেরাউনের সলিল সমাধি। অতঃপর আদি বাসস্থান কেন‘আন অধিকারী আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম অমান্য করায় অবাধ্য ইস্রাঈলীদের নিয়ে ৪০ বছর যাবত তীহ্ প্রান্তরে উন্মুক্ত কারাগারে অবস্থান ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের সন্নিকটে মৃত্যু সম্ভবতঃ ৮০ থেকে ১০০ বছর বয়সের মধ্যে। মূসা আ.-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। আমাদের নবী সা. সেখানে একটি লাল ঢিবির দিকে ইশারা করে সেস্থানেই মূসা আ.-এর কবর হয়েছে বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, হযরত আদম আ. থেকে ইব্রাহিম আ. পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সর্বমোট এক লক্ষ চবিবশ হাজার নবী-রাসূলের প্রায় সবাই ইসরাঈল বংশের ছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন সেমেটিক। কেননা ইব্রাহিম আ. ছিলেন সাম বিন নূহ-এর ৯ম অধঃস্তন পুরুষ। এজন্য ইব্রাহিমকে ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীদের পিতা বলা হয়।
হযরত মূসা আ. ও ফেরাউনের কাহিনী
সুদ্দী ও মুররাহ প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস ও আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ রা. এবং বহু সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন যে, ফেরাউন একদা স্বপ্নে দেখেন যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিক হতে একটি আগুণ এসে মিসরের ঘর-বাড়ি ও মূল অধিবাসী ক্বিবতীদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অথচ অভিবাসী বনী ইসরাঈলদের কিছুই হচ্ছে না। ভীত-চকিত অবস্থায় তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অতঃপর দেশের বড় বড় জ্যোতিষী ও জাদুকরদের সমবেত করলেন এবং তাদের সম্মুখে স্বপ্নের বৃত্তান্ত বর্ণনা দিলেন ও এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। জ্যোতিষীগণ বলল যে, অতি সত্বর বনী ইসরঈলের মধ্যে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। যার হাতে মিসরীয়দের ধ্বংস নেমে আসবে।
মিসর সম্রাট ফেরাউন জ্যোতিষীদের মাধ্যমে যখন জানতে পারলেন যে, অতি সত্বর ইসরাঈল বংশে এমন একটা পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, যে তার সাম্রাজ্যের পতন ঘটাবে। তখন উক্ত সন্তানের জন্ম রোধের কৌশল হিসাবে ফেরাউন বনী ইসরাঈলদের ঘরে নবজাত সকল পুত্র সন্তানকে ব্যাপকহারে হত্যার নির্দেশ দিল। উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে হত্যা করতে থাকলে এক সময় বনী ইসরাঈল কওম যুবক শূন্য হয়ে যাবে। বৃদ্ধরাও মারা যাবে। মহিলারা সব দাসীবৃত্তিতে বাধ্য হবে। অথচ বনী ইসরাঈলগণ ছিল মিসরের শাসক শ্রেণী এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতি। এই দূরদর্শী কপট পরিকল্পনা নিয়ে ফেরাউন ও তার মন্ত্রীগণ সারা দেশে একদল ধাত্রী মহিলা ও ছুরিধারী জল্লাদ নিয়োগ করে। মহিলারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে বনী ইসরঈলের গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা করত এবং প্রসবের দিন হাযির হয়ে দেখত, ছেলে না মেয়ে। ছেলে হলে পুরুষ জল্লাদকে খবর দিত। সে এসে ছুরি দিয়ে মায়ের সামনে সন্তানকে যবেহ করে ফেলে রেখে চলে যেত। এভাবে বনী ইসরঈলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। ইবনু কাছীর বলেন, একাধিক মুফাসসির বলেছেন যে, শাসকদল ক্বিবতীরা ফেরাউনের কাছে গিয়ে অভিযোগ করল যে, এভাবে পুত্র সন্তান হত্যা করায় বনী ইসরঈলের কর্মজীবী ও শ্রমিক শ্রেণীর ঘাটতি হচ্ছে। যাতে তাদের কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। তখন ফেরাউন এক বছর অন্তর অন্তর পুত্র হত্যার নির্দেশ দেয়। এতে বাদ পড়া বছরে হারূণের জন্ম হয়। কিন্তু হত্যার বছরে মূসার জন্ম হয়। ফলে পিতা-মাতা তাদের নবজাত সন্তানের নিশ্চিত হত্যার আশংকায় দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ মূসা আ.-এর মায়ের অন্তরে ‘ইলহাম’ করেন। যেমন আল্লাহ পরবর্তীতে মূসাকে বলেন, ‘‘আমরা তোমার উপর আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’। ‘যখন আমরা তোমার মাকে প্রত্যাদেশ করেছিলাম, যা প্রত্যাদেশ করা হয়’। ‘(এই মর্মে যে,) তোমার নবজাত সন্তানকে সিন্দুকে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দাও’। ‘অতঃপর নদী তাকে তীরে ঠেলে দেবে। অতঃপর আমার শত্রু ও তার শত্রু (ফেরাউন) তাকে উঠিয়ে নেবে এবং আমি তোমার উপর আমার পক্ষ হতে বিশেষ মহববত নিক্ষেপ করেছিলাম এবং তা এজন্য যে, তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।’ (ত্বোয়াহা -৩৭-৩৯)। বিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেন এভাবে, “আমরা মূসার মায়ের কাছে প্রত্যাদেশ করলাম এই মর্মে যে, তুমি ছেলেকে দুধ পান করাও। অতঃপর তার জীবনের ব্যাপারে যখন শংকিত হবে, তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে। তুমি ভীত হয়ো না ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আমরা ওকে তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব এবং ওকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করব।” মূলতঃ শেষের দু’টি ওয়াদাই তাঁর মাকে নিশ্চিন্ত ও উদ্বুদ্ধ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘মূসা জননীর অন্তর (কেবলি মূসার চিন্তায়) বিভোর হয়ে পড়ল। যদি আমরা তার অন্তরকে সুদৃঢ় করে না দিতাম, তাহলে সে মূসার (জন্য অস্থিরতার) বিষয়টি প্রকাশ করেই ফেলত। (আমরা তার অন্তরকে দৃঢ় করেছিলাম এ কারণে যে) সে যেন আল্লাহর উপরে প্রত্যয়শীলদের অন্তর্ভুক্ত থাকে’।
মূসা আ. নদীতে নিক্ষিপ্ত হলেন
ফেরাউনের সৈন্যদের হাতে নিহত হবার নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখা দিলে আল্লাহর প্রত্যাদেশ (ইলহাম) অনুযায়ী পিতা-মাতা তাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে সিন্দুকে ভরে বাড়ীর পাশের নীল নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। অতঃপর স্রোতের সাথে সাথে সিন্দুকটি এগিয়ে চলল। ওদিকে মূসার (বড়) বোন তার মায়ের হুকুমে সিন্দুকটিকে অনুসরণ করে নদীর কিনারা দিয়ে চলতে লাগল (ত্বোয়াহা -৪০)। এক সময় তা ফেরাউনের প্রাসাদের ঘাটে এসে ভিড়ল। ফেরাউনের পুণ্যবতী স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চাটিকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। ফেরাউন তাকে বনী ইসরাঈল সন্তান ভেবে হত্যা করতে চাইল। কিন্তু সন্তানহীনা স্ত্রীর অপত্য স্নেহের কারণে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ফেরাউন নিজে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কারণ আল্লাহ মূসার চেহারার মধ্যে বিশেষ একটা মায়াময় কমনীয়তা দান করেছিলেন (ত্বোয়াহা-৩৯)। যাকে দেখলেই মায়া পড়ে যেত। ফেরাউনের হৃদয়ের পাষাণ গলতে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। বস্ত্ততঃ এটাও ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ। ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে ফেরাউনের স্ত্রী তার স্বামীকে বললেন, ‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি। একে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি’। আল্লাহ বলেন, ‘অথচ তারা (আমার কৌশল) বুঝতে পারল না’। মূসা এক্ষণে ফেরাউনের স্ত্রীর কোলে পুত্রস্নেহ পেতে শুরু করলেন। অতঃপর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য রাণীর নির্দেশে বাজারে বহু ধাত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু মূসা কারুরই বুকে মুখ দিচ্ছেন না। আল্লাহ বলেন, “আমরা পূর্ব থেকেই অন্যের দুধ খাওয়া থেকে মূসাকে বিরত রেখেছিলাম’। এমন সময় অপেক্ষারত মূসার ভগিনী বলল, ‘আমি কি আপনাদেরকে এমন এক পরিবারের খবর দিব, যারা আপনাদের জন্য এ শিশু পুত্রের লালন-পালন করবে এবং তারা এর শুভাকাংখী’? রাণীর সম্মতিক্রমে মূসাকে প্রস্তাবিত ধাত্রীগৃহে প্রেরণ করা হল। মূসা খুশী মনে মায়ের দুধ গ্রহণ করলেন। অতঃপর মায়ের কাছে রাজকীয় ভাতা ও উপঢৌকনাদি প্রেরিত হতে থাকল।এভাবে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে মূসা তার মায়ের কোলে ফিরে এলেন। এভাবে একদিকে পুত্র হত্যার ভয়ংকর আতংক হতে মা-বাবা মুক্তি পেলেন ও নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া সন্তানকে পুনরায় বুকে ফিরে পেয়ে তাদের হৃদয় শীতল হল। অন্যদিকে বহু মূল্যের রাজকীয় ভাতা পেয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহের দুশ্চিন্তা হতে তারা মুক্ত হলেন। সাথে সাথে সম্রাট নিয়োজিত ধাত্রী হিসাবে ও সম্রাট পরিবারের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাঁদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেল। এভাবেই ফেরাউনী কৌশলের উপরে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী হল।
আল্লাহ বলেন, ‘তারা চক্রান্ত করেছিল এবং আমরাও কৌশল করেছিলাম। কিন্তু তারা (আমাদের কৌশল) বুঝতে পারেনি’ (নমল, আয়াত ৫০)।
যৌবনে মূসা আ.
দুগ্ধ পানের মেয়াদ শেষে মূসা আ. ফেরাউন-পুত্র হিসাবে তার গৃহে শান-শওকতের মধ্যে বড় হতে থাকেন। আল্লাহর রহমতে ফেরাউনের স্ত্রীর অপত্য স্নেহ ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী রক্ষাকবচ। এভাবে ‘যখন তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণবয়ষ্ক মানুষে পরিণত হলেন, তখন আল্লাহ তাকে বিশেষ প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে ভূষিত করলেন’। মূসা আ. সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। দেখলেন যে, পুরা মিসরীয় সমাজ ফেরাউনের একচ্ছত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে কঠোরভাবে শাসিত। ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ এই সুপরিচিত ঘৃণ্য নীতির অনুসরণে ফেরাউন তার দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল ও একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আর সেটি হল বনু ইসরাঈল। প্রতিদ্বন্দ্বী জন্মাবার ভয়ে সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। এভাবে একদিকে ফেরাউন অহংকারে স্ফীত হয়ে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ পালনকর্তা ও সর্বাধিপতি’ ভেবে সারা দেশে অনর্থ সৃষ্টি করছিল। এমনকি সে নিজেকে ‘একমাত্র উপাস্য’ বলতেও লজ্জাবোধ করেনি। অন্যদিকে মযলূম বনী ইসরাঈলদের হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। অবশেষে আল্লাহ মযলূমদের ডাকে সাড়া দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘দেশে যাদেরকে দুর্বল করা হয়েছিল, আমরা চাইলাম তাদের উপরে অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা করতে ও দেশের উত্তরাধিকারী করতে’। ‘এবং আমরা চাইলাম তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে এবং ফেরাউন, হামান ও তাদের সেনাবাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে, যা তারা সেই দুর্বল দলের তরফ থেকে আশংকা করত’।
যুবক মূসা খুনী হলেন
মূসার হৃদয় মযলূমদের প্রতি করুণায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ওদিকে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। মূসা একদিন দুপুরের অবসরে শহরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। এমন সময় তাঁর সামনে এক কান্ড ঘটে গেল। তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। যাদের একজন যালেম সম্রাটের ক্বিবতী বংশের এবং অন্যজন মযলূম বনু ইসরঈলের। মূসা তাদের থামাতে গিয়ে যালেম লোকটিকে একটা ঘুষি মারলেন। কি আশ্চর্য লোকটি তাতেই অক্কা পেল। মূসা দারুণভাবে অনুতপ্ত হলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, “একদিন দুপুরে তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন অধিবাসীরা ছিল দিবানিদ্রার অবসরে। এ সময় তিনি দু’জন ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। এদের একজন ছিল তার নিজ গোত্রের এবং অপরজন ছিল শত্রুদলের। অতঃপর তার নিজ দলের লোকটি তার শত্রুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্য চাইল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বললেন, ‘নিশ্চয়ই এটি শয়তানের কাজ। সে মানুষকে বিভ্রান্তকারী প্রকাশ্য শত্রু’। ‘হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপরে যুলুম করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’।
পরের দিন ‘জনৈক ব্যক্তি ছুটে এসে মূসা আ.কে বলল, হে মূসা! আমি তোমার শুভাকাংখী। তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, এই মুহূর্তে তুমি এখান থেকে বের হয়ে চলে যাও। কেননা সম্রাটের পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে’। এই লোকটি মূসা আ. এর প্রতি আকৃষ্ট ও তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল। একথা শুনে ভীত হয়ে মূসা আ. সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে। যেমন আল্লাহ বলেন,‘অতঃপর তিনি সেখান থেকে ভীত অবস্থায় বের হয়ে পড়লেন পথ দেখতে দেখতে এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা কর’। ‘এরপর যখন তিনি (পার্শ্ববর্তী রাজ্য) মাদিয়ান অভিমুখে রওয়ানা হলেন, তখন (দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে) বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার প্রভু আমাকে সরল পথ দেখাবেন’।আসলে আল্লাহ চাচ্ছিলেন, ফেরাউনের রাজপ্রাসাদ থেকে মূসাকে বের করে নিতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে পরিচিত করতে। সাথে সাথে আল্লাহ তাঁকে তৎকালীন একজন শ্রেষ্ঠ নবীর গৃহে লালিত-পালিত করে তাওহীদের বাস্তব শিক্ষায় আগাম পরিপক্ক করে নিতে চাইলেন।
হযরত মূসা আ. এর পরীক্ষা সমূহ
অন্যান্য নবীদের পরীক্ষা হয়েছে সাধারণতঃ নবুয়ত লাভের পরে। কিন্তু হযরত মূসা আ. এর পরীক্ষা শুরু হয়েছে তার জন্ম লাভের পর থেকেই। বস্ত্ততঃ নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে তাঁর জীবনে বহু পরীক্ষা হয়েছে। যেমন আল্লাহ মূসা আ.-কে শুনিয়ে বলেন, ‘আর আমরা তোমাকে অনেক পরীক্ষায় ফেলেছি’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪০)।
নবুয়ত লাভের পূর্বে তাঁর প্রধান পরীক্ষা ছিল তিনটি। যথাঃ ১. হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া, ২. মাদিয়ানে হিজরত, ৩. মাদিয়ান থেকে মিসর যাত্রা। অতঃপর নবুয়ত লাভের পর তাঁর পরীক্ষা হয় প্রধানতঃ চারটিঃ ১. জাদুকরদের মুকাবিলা, ২. ফেরাউনের যুলুমসমূহ মুকাবিলা, ৩. সাগরডুবির পরীক্ষা ও ৪. বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান।
নবুয়ত–পূর্ব ১ম পরীক্ষা : হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া
হযরত মূসা আ. এর জন্ম হয়েছিল তাঁর কওমের উপরে আপতিত রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়ংকর বিভীষিকার মধ্যে। আল্লাহ তাঁকে অপূর্ব কৌশলের মাধ্যমে বাঁচিয়ে নেন। অতঃপর তাঁর জানী দুশমনের ঘরেই তাঁকে নিরাপদে ও সসম্মানে লালন-পালন করালেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মা ও পরিবারকে করলেন উচ্চতর সামাজিক মর্যাদায় উন্নীত। অথচ মূসা আ. এর জন্মকে ঠেকানোর জন্যই ফেরাউন তার পশুশক্তির মাধ্যমে বনু ইসরঈলের শত শত শিশু পুত্রকে হত্যা করে চলছিল। যা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।
২য় পরীক্ষা : মাদিয়ানে হিজরত
অতঃপর যৌবনকালে তাঁর দ্বিতীয় পরীক্ষা হল- হিজরতের পরীক্ষা। মূলতঃ এটাই ছিল তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি হবার পরে ১ম পরীক্ষা। অনাকাংখিত ও আকস্মিক হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে জীবনের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত্র মূসা আ. ফেরাউনের রাজ্যসীমা ছেড়ে কপর্দকহীন অবস্থায় পার্শ্ববর্তী রাজ্য মাদিয়ানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর মূসা আ. এই ভীতিকর দীর্ঘ সফরে কিভাবে চলেছেন, কি খেয়েছেন সেসব বিষয়ে তাফসীরকারগণ বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন। রওয়ানা হবার সময় যেহেতু মূসা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহর উপরে সমর্পণ করেছিলেন এবং প্রত্যাশা করেছিলেন ‘নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা আমাকে সরল পথ দেখাবেন’, অতএব তাঁকে মাদিয়ানের মত অপরিচিত রাজ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া ও সসম্মানে সেখানে বসবাস করার যাবতীয় দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে নিজেকে সঁপে দিলে আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমান পূর্ব জর্দানের মো‘আন সামুদ্রিক বন্দরের অনতিদূরেই ‘মাদইয়ান’ অবস্থিত।
মাদিয়ানের জীবন : বিবাহ ও সংসার পালন
মাদিয়ানে প্রবেশ করে তিনি পানির আশায় একটা কূপের দিকে গেলেন। সেখানে পানি প্রার্থী লোকদের ভিড়ের অদূরে দু’টি মেয়েকে তাদের তৃষ্ণার্ত পশুগুলি সহ অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর হৃদয় উথলে উঠলো। কেউ তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না। মূসা নিজে মযলূম। তিনি মযলূমের ব্যথা বুঝেন। তাই কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করে মেয়ে দু’টির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, ‘আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ না রাখালরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে চলে যায়। অথচ আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ’ (যিনি ঘরে বসে আমাদের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছেন)। ‘অতঃপর তাদের পশুগুলি এনে মূসা পানি পান করালেন’ (তারপর মেয়ে দু’টি পশুগুলি নিয়ে বাড়ী চলে গেল)। মূসা একটি গাছের ছায়ায় বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার উপর যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষী’। হঠাৎ দেখা গেল যে ‘বালিকাদ্বয়ের একজন সলজ্জ পদক্ষেপে তাঁর দিকে আসছে’। মেয়েটি এসে ধীর কণ্ঠে তাকে বলল, ‘আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, যাতে আপনি যে আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময় স্বরূপ আপনাকে পুরস্কার দিতে পারেন’।
উল্লেখ্য যে, বালিকাদ্বয়ের পিতা ছিলেন মাদইয়ান বাসীদের নিকটে প্রেরিত বিখ্যাত নবী হযরত শু‘আয়েব আ.। মূসা আ. ইতিপূর্বে কখনো তাঁর নাম শোনেননি বা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর কাছে পৌঁছে মূসা তাঁর বৃত্তান্ত সব বর্ণনা করলেন। শু‘আয়েব আ. সবকিছু শুনে বললেন, ‘ভয় করো না। তুমি যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছ’। ‘এমন সময় বালিকাদ্বয়ের একজন বলল, আববা! এঁকে বাড়ীতে কর্মচারী হিসাবে রেখে দিন। কেননা আপনার কর্ম সহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে, সে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’। ‘তখন তিনি মূসাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার বাড়ীতে কর্মচারী থাকবে। তবে যদি দশ বছর পূর্ণ করো, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসাবে পাবে’। ‘মূসা আ. বললেন, আমার ও আপনার মধ্যে এই চুক্তি স্থির হল। দু’টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেকোন একটি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যা বলছি, আল্লাহ তার উপরে তত্ত্বাবধায়ক’। মূলতঃ এটাই ছিল তাদের বিয়ের মোহরানা। সেযুগে এ ধরনের রেওয়াজ অনেকের মধ্যে চালু ছিল। যেমন ইতিপূর্বে ইয়াকূব আ. তাঁর স্ত্রীর মোহরানা বাবদ সাত বছর শ্বশুর বাড়ীতে মেষ চরিয়েছেন। এভাবে অচেনা-অজানা দেশে এসে মূসা আ. অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এবং অন্যান্য নিরাপত্তাসহ অত্যন্ত মর্যাদাবান ও নির্ভরযোগ্য একজন অভিভাবক পেয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে পেলেন জীবন সাথী একজন পতি-পরায়ণা বুদ্ধিমতী স্ত্রী। অতঃপর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে মূসা আ. এর দিনগুলি অতিবাহিত হতে থাকলো। সময় গড়িয়ে এক সময় মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি চাকুরীর বাধ্যতামূলক আট বছর এবং ঐচ্ছিক দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন।
৩য় পরীক্ষা: মিসর অভিমুখে যাত্রা ও পথিমধ্যে নবুয়ত লাভ
মোহরানার চুক্তির মেয়াদ শেষ। এখন যাবার পালা। পুনরায় স্বদেশে ফেরা। দুরু দুরু বক্ষ। ভীত-সন্ত্রস্ত্র মন। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। তবুও যেতে হবে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন সবাই রয়েছেন মিসরে। আল্লাহর উপরে ভরসা করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে বের হলেন পুনরায় মিসরের পথে। শুরু হল তৃতীয় পরীক্ষার পালা। উল্লেখ্য, দশ বছরে তিনি দু’টি পুত্র সন্তান লাভ করেন এবং শ্বশুরের কাছ থেকে পান এক পাল দুম্বা।
পরিবারের কাফেলা নিয়ে মূসা আ. রওয়ানা হলেন স্বদেশ অভিমুখে। পথিমধ্যে মিসর সীমান্তে অবস্থিত সিনাই পর্বতমালার তূর পাহাড়ের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হল। এখুনি প্রয়োজন আগুনের। কিন্তু কোথায় পাবেন আগুণ। পাথরে পাথরে ঘষে বৃথা চেষ্টা করলেন কতক্ষণ। প্রচন্ড শীতে ও তুষারপাতের কারণে পাথর ঘষায় কাজ হল না। দিশেহারা হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ অনতিদূরে আগুনের হলকা নজরে পড়ল। আশায় বুক বাঁধলেন। স্ত্রী ও পরিবারকে বললেন, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর। আমি আগুণ দেখেছি। সম্ভবতঃ আমি তা থেকে তোমাদের জন্য কিছু আগুণ জ্বালিয়ে আনতে পারব অথবা সেখানে পৌঁছে পথের সন্ধান পাব’ (ত্বোয়াহা-১০)। একথা দৃষ্টে মনে হয়, মূসা আ. পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। পথিমধ্যে শাম অঞ্চলের শাসকদের পক্ষ থেকে প্রধান সড়কে বিপদাশংকা ছিল। তাই শ্বশুরের উপদেশ মোতাবেক তিনি পরিচিত রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় চলতে গিয়ে মরুভূমির মধ্যে পথ হারিয়ে ডান দিকে চলে তূর পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে গেলেন। মূলতঃ এ পথ হারানোটা ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ।
হযরত মূসা আ. আশান্বিত হয়ে যতই আগুনের নিকটবর্তী হন, আগুনের হল্কা ততই পিছাতে থাকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সবুজ বৃক্ষের উপরে আগুণ জ্বলছে। অথচ গাছের পাতা পুড়ছে না; বরং তার উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ে অভিভূত মূসা আ. এক দৃষ্টে আগুণটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ এক গুরুগম্ভীর আওয়ায কানে এলো তাঁর চার পাশ থেকে। মনে হল পাহাড়ের সকল প্রান্ত থেকে একই সাথে আওয়ায আসছে। মূসা আ. তখন তূর পাহাড়ের ডান দিকে ‘তুবা’ উপত্যকায় দন্ডায়মান। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন তিনি আগুনের কাছে পৌঁছলেন, তখন আওয়ায এলো, হে মূসা!’ ‘আমিই তোমার পালনকর্তা। অতএব তুমি তোমার জুতা খুলে ফেল। তুমি পবিত্র উপত্যকা তুবায় রয়েছ’ (ত্বোয়াহা-১১-১২)। এর দ্বারা বিশেষ অবস্থায় পবিত্র স্থানে জুতা খোলার আদব প্রমাণিত হয়। অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব তোমাকে যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাক’। ‘নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর’। ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকে তার কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’। ‘সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতে বিশ্বাস রাখে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে নিবৃত্ত না করে। তাহলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’ (ত্বোয়াহা-১৩-১৬)।
এ পর্যন্ত আক্বীদা ও ইবাদতগত বিষয়ে নির্দেশ দানের পর এবার কর্মগত নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলছেন, ‘হে মূসা! তোমার ডান হাতে ওটা কি?’ ‘মূসা আ. বললেন, এটা আমার লাঠি। এর উপরে আমি ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগপালের জন্য গাছের পাতা ঝেড়ে নামাই। তাছাড়া এর দ্বারা আমার অন্যান্য কাজও চলে’। ‘আল্লাহ বললেন, হে মূসা! তুমি ওটা ফেলে দাও’। ‘অতঃপর তিনি ওটা (মাটিতে) ফেলে দিতেই তা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল’। ‘আল্লাহ বললেন, তুমি ওটাকে ধর, ভয় করো না, আমি এখুনি ওকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ১৭-২১)। এটি ছিল মূসাকে দেওয়া ১ম মু‘জেযা। কেননা মিসর ছিল ঐসময় জাদুবিদ্যায় শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী দেশ। সেখানকার শ্রেষ্ঠ জাদুকরদের হারিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই নবুয়তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা আবশ্যক ছিল। সেজন্যই আল্লাহ মূসাকে সবদিক দিয়ে প্রস্ত্তত করে দিচ্ছিলেন। এর ফলে মূসা আ. নিজের মধ্যে অনেকটা শক্তি ও স্বস্তি লাভ করলেন।
১ম মু‘জেযা প্রদানের পর আল্লাহ তাকে দ্বিতীয় মু‘জেযা প্রদানের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার হাত বগলে রাখ। তারপর দেখবে তা বের হয়ে আসবে উজ্জ্বল ও নির্মল আলো হয়ে, অন্য একটি নিদর্শন রূপে’। ‘এটা এজন্য যে, আমরা তোমাকে আমাদের বিরাট নিদর্শনাবলীর কিছু অংশ দেখাতে চাই’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ২২-২৩)।
নয়টি নিদর্শন
আল্লাহ বলেন, ‘আমরা মূসাকে নয়টি নিদর্শন প্রদান করেছিলাম’ (ইসরা, আয়াত ১০১; নামল, আয়াত ১২)। এখানে ‘নিদর্শন’ অর্থ একদল বিদ্বান ‘মু‘জেযা’ নিয়েছেন। তবে ৯ সংখ্যা উল্লেখ করায় এর বেশী না হওয়াটা জরুরী নয়। বরং এর চেয়ে অনেক বেশী মু‘জেযা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। যেমন পাথরে লাঠি মারায় ১২টি গোত্রের জন্য বারোটি ঝর্ণাধারা নির্গমন, তীহ্ প্রান্তরে মেঘের ছায়া প্রদান, মান্না-সালওয়া খাদ্য অবতরণ প্রভৃতি। তবে এ নয়টি ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা ফেরাউনী সম্প্রদায়কে প্রদর্শন করা হয়েছিল।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. উক্ত ৯টি মু‘জেযা নিম্নরূপে গণনা করেছেন। যথা- (১) মূসা আ.-এর ব্যবহৃত লাঠি, যা নিক্ষেপ করা মাত্র অজগর সাপের ন্যায় হয়ে যেত (২) শুভ্র হাত, যা বগলের নীচ থেকে বের করতেই জ্যোতির্ময় হয়ে সার্চ লাইটের মত চমকাতে থাকত (৩) নিজের তোতলামি, যা মূসার প্রার্থনাক্রমে দূর করে দেওয়া হয় (৪) ফেরাউনী কওমের উপর প্লাবণের গযব প্রেরণ, অতঃপর (৫) পঙ্গপাল (৬) উকুন (৭) ব্যাঙ (৮) রক্ত এবং অবশেষে (৯) নদী ভাগ করে তাকে সহ বনু ইসরাঈলকে সাগরডুবি হতে নাজাত দান। তবে প্রথম দু’টিই ছিল সর্বপ্রধান মু‘জেযা, যা নিয়ে তিনি শুরুতে ফেরাউনের নিকটে গিয়েছিলেন (সূরা নমল, আয়াত ১০, ১২)।
অবশ্য কুরআনে বর্ণিত আয়াত সমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথমে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের উপরে দুর্ভিক্ষের গযব এসেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,‘আমরা পাকড়াও করেছিলাম ফেরাউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল-ফসলাদির ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩০)।
সিনাই হতে মিসর
আল্লাহ পাক হযরত মূসা আ.কে নবুয়ত ও প্রধান দু’টি মু‘জেযা দানের পর নির্দেশ দিলেন, হে মূসা! ‘তুমি ফেরাউনের কাছে যাও। সে উদ্ধত হয়ে গেছে’। ভীত সন্ত্রস্ত মূসা বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ উন্মোচন করে দিন’ ‘এবং আমার কাজ সহজ করে দিন’। ‘আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন’ ‘যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ ‘এবং আমার পরিবারের মধ্য থেকে একজনকে আমার সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন’। ‘আমার ভাই হারূণকে দিন’। ‘তার মাধ্যমে আমার কোমর শক্ত করুন’ ‘এবং তাকে (নবী করে) আমার কাজে অংশীদার করুন’। ‘যাতে আমরা বেশী বেশী করে আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারি’ ‘এবং অধিক পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি’। ‘আপনি তো আমাদের অবস্থা সবই দেখছেন’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ২৪-৩৫)।
হযরত মূসা আ. এর উপরোক্ত দীর্ঘ প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ বললেন, ‘হে মূসা! তুমি যা যা চেয়েছ, সবই তোমাকে দেওয়া হল’। শুধু এবার কেন, ‘আমি তোমার উপরে আরও একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৩৬-৩৭)। বলেই আল্লাহ মূসা আ.কে তার জন্মের পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া ও ফেরাউনের ঘরে লালন-পালনের চমকপ্রদ কাহিনী শুনিয়ে দিলেন।
হযরত মূসা আ. এর প্রার্থনা কবুলের সাথে সাথে আল্লাহ হারূণ আ.কে মিসরে অহীর মাধ্যমে নবুয়ত প্রদান করলেন (মারিয়াম, আয়াত ৫৩) এবং তাকে মূসা আ. এর আগমন বার্তা জানিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে মূসা আ. কে সার্বিক সহযোগিতা করার এবং তাকে মিসরের বাইরে এসে অভ্যর্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি বনু ইসরঈলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এগিয়ে এসে যথাযথভাবে সে নির্দেশ পালন করেন।
হযরত মূসা আ. হলেন কালীমুল্লাহ
তুবা প্রান্তরের উক্ত ঘটনা থেকে হযরত মূসা আ. কেবল নবী হলেন না। বরং তিনি হলেন ‘কালীমুল্লাহ বা আল্লাহর সাথে বাক্যালাপকারী। যদিও শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সা. মে‘রাজে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু দুনিয়াতে এভাবে বাক্যালাপের সৌভাগ্য কেবলমাত্র হযরত মূসা আ.-এর হয়েছিল। আল্লাহ বিভিন্ন নবীকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশিষ্টতা দান করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মূসা! আমি আমার বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং আমার বাক্যালাপের মাধ্যমে তোমাকে লোকদের উপরে বিশিষ্টতা দান করেছি। অতএব আমি তোমাকে যা কিছু দান করলাম, তা গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞ থাক’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৪)। এভাবে আল্লাহ পাক হযরত মূসা আ.-এর সাথে আরেকবার কথা বলেন, সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার পরে শামে এসে একই স্থানে ‘তাওরাত’ প্রদানের সময় (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৮, ১৪৫)। এভাবে মূসা আ. হলেন ‘কালীমুল্লাহ। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপের পর উৎসাহিত ও পুলকিত মূসা এখানে তূর পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় কিছু দিন বিশ্রাম করলেন। অতঃপর মিসর অভিমুখে রওয়ানা হলেন। সিনাই থেকে অনতিদূরে মিসর সীমান্তে পৌঁছে গেলে যথারীতি বড় ভাই হারূণ ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এসে তাঁদেরকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন।
হযরত মূসা আ.-এর মিসরে প্রত্যাবর্তন
ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের বিরুদ্ধে অলৌকিক লাঠি ও আলোকিত হস্ত তালুর দু’টি নিদর্শন নিয়ে মূসা আ. মিসরে পৌঁছলেন। ফেরাউন ও তার সভাসদ বর্গকে আল্লাহ ‘জাহান্নামের দিকে আহবানকারী নেতৃবৃন্দ’ হিসাবে এবং তাদের সম্প্রদায়কে ‘ফাসেক’ বা পাপাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ পাক মূসা আ.কে বললেন ‘তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনবলীসহ যাও এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না’। ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও। সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে’। ‘তোমরা তার কাছে গিয়ে নম্রভাষায় কথা বলবে। তাতে হয়ত সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে’। ‘তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আশংকা করছি যে, সে আমাদের উপরে যুলুম করবে কিংবা উত্তেজিত হয়ে উঠবে’। ‘আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা ভয় করো না। আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি তোমাদের (সব কথা) শুনবো ও (সব অবস্থা) দেখব’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪২-৪৬)।
ফেরাউনের নিকটে হযরত মূসা আ.-এর দাওয়াত
আল্লাহর নির্দেশমত হযরত মূসা ও হারূণ আ. ফেরাউন ও তার সভাসদবর্গের নিকটে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর মূসা আ. ফেরাউনকে বললেন, ‘হে ফেরাউন! আমি বিশ্বপ্রভুর পক্ষ হতে প্রেরিত রাসূল’। ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি দৃঢ়চিত্ত। আমি তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন নিয়ে আগমন করেছি। অতএব তুমি বনু ইসরাঈলগণকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও’ (আ‘রাফ, আয়াত ১০৪-১০৫)। মূসা আ. এর এ দাবী থেকে বুঝা যায় যে, ঐ সময় বনী ইসরঈলের উপরে ফেরাউনের ও তার সম্প্রদায়ের যুলুম চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং তাদের সঙ্গে আপোষে বসবাসের কোন রাস্তা ছিল না। ফলে তিনি তাদেরকে সেখান থেকে বের করে আনতে চাইলেন। তবে এটা নিশ্চিত যে, মূসা তখনই বনু ইসরাঈলকে নিয়ে বের হয়ে যাননি। মূসা ফেরাউনকে বললেন,….‘তুমি বনু ইসরাঈলদের উপরে নিপীড়ন করো না’। ‘আমরা আল্লাহর নিকট থেকে অহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপরে আল্লাহর আযাব নেমে আসে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪৭-৪৮)। একথা শুনে ফেরাউন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘মূসা! তোমার পালনকর্তা কে’? ‘মূসা বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন’। ‘ফেরাউন বলল, তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কি?’ ‘মূসা আ. বললেন, তাদের খবর আমার প্রভুর কাছে লিখিত আছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না’। একথা বলার পর মূসা আ. আল্লাহর নিদর্শন সমূহ বর্ণনা শুরু করলেন, যাতে ফেরাউন তার যৌক্তিকতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তিনি বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, ‘যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন এবং তাতে চলার পথ সমূহ তৈরী করেছেন। তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন’। ‘তোমরা তা আহার কর ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুসমূহ চরিয়ে থাক। নিশ্চয়ই এতে বিবেকবানদের জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪৯-৫৪)।
মু‘জেযা ও জাদু
মু‘জেযা অর্থ মানুষের বুদ্ধিকে অক্ষমকারী। অর্থাৎ এমন কর্ম সংঘটিত হওয়া যা মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতা বহির্ভূত। (১) ‘মু‘জেযা’ কেবল নবীগণের জন্য খাছ এবং ‘কারামত’ আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের মাধ্যমে কখনো কখনো প্রকাশ করে থাকেন। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। (২) মু‘জেযা নবীগণের মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। পক্ষান্তরে জাদু কেবল দুষ্ট জিন ও মানুষের মাধ্যমেই হয়ে থাকে এবং তা হয় অদৃশ্য প্রাকৃতিক কারণের প্রভাবে। (৩) জাদু কেবল পৃথিবীতেই ক্রিয়াশীল হয়, আসমানে নয়। কিন্তু মু‘জেযা আল্লাহর হুকুমে আসমান ও যমীনে সর্বত্র ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন শেষনবী সা.-এর অঙ্গুলী সংকেতে আকাশের চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। (৪) মু‘জেযা মানুষের কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু জাদু স্রেফ ভেল্কিবাজি ও প্রতারণা মাত্র এবং যা মানুষের কেবল ক্ষতিই করে থাকে।
জাদুতে মানুষের সাময়িক বুদ্ধি বিভ্রম ঘটে। যা মানুষকে প্রতারিত করে। এজন্যে একে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। মিসরীয় জাতি তথা ফেরাউনের সম্প্রদায় ঐ সময় জাদু বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং জ্যোতিষীদের প্রভাব ছিল তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অত্যধিক। সেকারণ তাদের চিরাচরিত ধারণা অনুযায়ী মূসা আ.-এর মু‘জেযাকে তারা বড় ধরনের একটা জাদু ভেবেছিল মাত্র। তবে তারা তাঁকে সাধারণ জাদুকর নয়, বরং ‘বিজ্ঞ জাদুকর’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল (আ‘রাফ, আয়াত ১০৯)। কারণ তাদের হিসাব অনুযায়ী মূসার জাদু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, যা তাদের আয়ত্তাধীন জাদু বিদ্যার বাইরের এবং যা ছিল অনুপম ও অনন্য বৈশিষ্ট্য মন্ডিত।
পরবর্তীকালে সুলায়মান আ.-এর সময়ে ইরাকের বাবেল নগরী তৎকালীন পৃথিবীতে জাদু বিদ্যায় শীর্ষস্থান লাভ করে। তখন আল্লাহ সুলায়মান আ.-কে জিন, ইনসান, বায়ু ও পশুপক্ষীর উপর ক্ষমতা দিয়ে পাঠান। এগুলিকে লোকেরা জাদু ভাবে এবং তার নবুয়তকে অস্বীকার করে। তখন আল্লাহ হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য বুঝানোর জন্য প্রেরণ করেন। যাতে লোকেরা জাদুকরদের তাবেদারী ছেড়ে নবীর তাবেদার হয়।
নবুয়ত পরবর্তী ১ম পরীক্ষা : জাদুকরদের মুকাবিলা
মূসা আ. ও ফেরাউনের মাঝে জাদু প্রতিযোগিতার দিন ধার্য হবার পর মূসা আ. পয়গম্বর সূলভ দয়া প্রকাশে নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহলে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দিবেন। যারাই মিথ্যারোপ করে, তারাই বিফল মনোরথ হয়’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬১)। কিন্তু এতে কোন ফলোদয় হল না। ফেরাউন উঠে গিয়ে ‘তার সকল কলা-কৌশল জমা করল, অতঃপর উপস্থিত হল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬০)। ‘অতঃপর তারা তাদের কাজে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করল এবং গোপনে পরামর্শ করল’। ‘তারা বলল, এই দু’জন লোক নিশ্চিতভাবেই জাদুকর। তারা তাদের জাদু দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায় এবং আমাদের উৎকৃষ্ট জীবনধারা রহিত করতে চায়’। ‘অতএব (হে জাদুকরগণ!) তোমরা তোমাদের যাবতীয় কলা-কৌশল সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধভাবে এসো। আজ যে জয়ী হবে, সেই-ই সফলকাম হবে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৩-৬৪)।
জাদুকররা ফেরাউনের নিকট সমবেত হয়ে বলল, জাদুকর ব্যক্তিটি কি দিয়ে কাজ করে? সবাই বলল, সাপ দিয়ে। তারা বলল, আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমাদের উপরে এমন কেউ নেই, যে লাঠি ও রশিকে সাপ বানিয়ে কাজ করতে পারে (‘হাদীছুল কুতূন’ নাসাঈ, ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর)। অতএব ‘আমাদের জন্য কি বিশেষ কোন পুরস্কার আছে, যদি আমরা বিজয়ী হই’? ‘সে বলল, হ্যাঁ। তখন অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৩-১১৪)।
জাদুকররা উৎসাহিত হয়ে মূসাকে বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি (তোমার জাদুর লাঠি) নিক্ষেপ কর, না হয় আমরা প্রথমে নিক্ষেপ করি’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৫)। মূসা আ. বললেন, ‘তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারা ‘তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৪), তখন লোকদের চোখগুলিকে ধাঁধিয়ে দিল এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল ও এক মহাজাদু প্রদর্শন করল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৬)। ‘তাদের জাদুর প্রভাবে মূসা আ. এর মনে হল যেন তাদের রশিগুলো ও লাঠিগুলো (সাপের ন্যায়) ছুটাছুটি করছে’। ‘তাতে মূসা আ. এর মনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৬-৬৭)। এমতাবস্থায় আল্লাহ ‘অহি’ নাযিল করে মূসাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘তুমিই বিজয়ী হবে’ ‘তোমার ডান হাতে যা আছে, তা (অর্থাৎ লাঠি) নিক্ষেপ কর। এটা তাদের সবকিছুকে যা তারা করেছে, গ্রাস করে ফেলবে। তাদের ওসব তো জাদুর খেল মাত্র। বস্ত্ততঃ জাদুকর যেখানেই থাকুক সে সফল হবে না’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৮-৬৯)।
জাদুকররা তাদের রশি ও লাঠি সমূহ নিক্ষেপ করার সময় বলল, ‘ফেরাউনের মর্যাদার শপথ! আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৪)। তারপর মূসা আ. আল্লাহর নামে লাঠি নিক্ষেপ করলেন। দেখা গেল তা বিরাট অজগর সাপের ন্যায় রূপ ধারণ করল এবং জাদুকরদের সমস্ত অলীক কীর্তিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৫)।
এদৃশ্য দেখে যুগশ্রেষ্ঠ জাদুকরগণ বুঝে নিল যে, মূসার এ জাদু আসলে জাদু নয়। কেননা জাদুর সর্বোচ্চ বিদ্যা তাদের কাছেই রয়েছে। মূসা আ. তাদের চেয়ে বড় জাদুকর হলে এতদিন তার নাম শোনা যেত। তার উস্তাদের খবর জানা যেত। তাছাড়া তার যৌবনকাল অবধি সে আমাদের কাছেই ছিল। কখনোই তাকে জাদু শিখতে বা জাদু খেলা দেখাতে বা জাদুর প্রতি কোনরূপ আকর্ষণও তার মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। তার পরিবারেও কোন জাদুকর নেই। তার বড় ভাই হারূণ তো সর্বদা আমাদের মাঝেই দিনাতিপাত করেছে। কখনোই তাকে এসব করতে দেখা যায়নি বা তার মুখে এখনকার মত বক্তব্য শোনা যায়নি। হঠাৎ করে কেউ বিশ্বসেরা জাদুকর হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে অলৌকিক কোন সত্তার নিদর্শন রয়েছে, যা আয়ত্ত করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। এ সময় মূসা আ. এর দেওয়া তাওহীদের দাওয়াত ও আল্লাহর গযবের ভীতি তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করল। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং বাতিল হয়ে গেল তাদের সমস্ত জাদুকর্ম’। ‘এভাবে তারা সেখানেই পরাজিত হল এবং লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৮-১১৯)। অতঃপর ‘তারা সিজদায় পড়ে গেল’। এবং ‘বলে উঠল, আমরা বিশ্বচরাচরের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যিনি মূসা ও হারূণের রব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৬-৪৮; ত্বোয়াহা, আয়াত ৭০; আ‘রাফ, আয়াত ১২০-১২১)।
পরাজয়ের এ দৃশ্য দেখে ভীত-বিহবল ফেরাউন নিজেকে সামলে নিয়ে উপস্থিত লাখো জনতার মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য জাদুকরদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘আমার অনুমতি দানের পূর্বেই তোমরা তাকে মেনে নিলে? নিশ্চয়ই সে (অর্থাৎ মূসা) তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১; আ‘রাফ, আয়াত ১২৩; শো‘আরা, আয়াত ৪৯)। অতঃপর সম্রাট সূলভ হুমকি দিয়ে বলল,‘শীঘ্রই তোমরা তোমাদের পরিণাম জানতে পারবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৯)। জবাবে জাদুকররা বলল, ‘কোন ক্ষতি নেই। আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করব’। ‘আশা করি আমাদের পালনকর্তা আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সমূহ ক্ষমা করবেন’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৯-৫১; ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১-৭৩; আ‘রাফ, আয়াত ১২৪-১২৬)।
ফেরাউনের ছয়টি কুটচাল
জাদুকরদের পরাজয়ের পর ফেরাউন তার রাজনৈতিক কুটচালের মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চাইল। তার চালগুলি ছিল, (১) সে বলল: এই জাদুকররা সবাই মূসার শিষ্য। তারা চক্রান্ত করেই তার কাছে নতি স্বীকার করেছে। এটা একটা পাতানো খেলা মাত্র। আসলে ‘মূসাই হল বড় জাদুকর’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১)। (২) সে বলল, মূসা তার জাদুর মাধ্যমে ‘নগরীর অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বের করে দিতে চায়’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১০) এবং মূসা ও তার সম্প্রদায় এদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। (৩) সে বলল মূসা যেসব কথা বলছে ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সেসব কথা কখনো শুনিনি’। (৪) সে বলল, হে জনগণ! এ লোকটি তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে ও দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’। (৫) সে বলল, মূসা তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন ব্যবস্থা রহিত করতে চায়’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৩)। (৬) সে মিসরীয় জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিয়েছিল এবং একটির দ্বারা অপরটিকে দুর্বল করার মাধ্যমে নিজের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রেখেছিল। নিজেই সবকিছু করলেও লোকদের খুশী করার জন্য ফেরাউন বলল, ‘অতএব হে জনগণ! তোমরা এখন কি বলতে চাও’? (শো‘আরা, ৩৫; আ‘রাফ, ১১০)।
জাদুকরদের সত্য গ্রহণ
ধূর্ত ও কুটবুদ্ধি ফেরাউন বুঝলো যে, তার ঔষধ কাজে লেগেছে। এখুনি মোক্ষম সময়। সে সাথে সাথে জাদুকরদের হাত-পা বিপরীতভাবে কেটে অতঃপর খেজুর গাছের সাথে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিল। সে ভেবেছিল, এতে জাদুকররা ভীত হয়ে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে। কিন্তু ফল উল্টা হল। তারা একবাক্যে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিল,
‘আমরা তোমাকে ঐসব সুস্পষ্ট নিদর্শন (ও মু‘জেযার) উপরে প্রাধান্য দিতে পারি না, যেগুলো (মূসার মাধ্যমে) আমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং প্রধান্য দিতে পারি না তোমাকে সেই সত্তার উপরে যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনেই যা করার করবে’। ‘আমরা আমাদের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যাতে তিনি আমাদের পাপসমূহ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ, (তার পাপসমূহ) তা মার্জনা করেন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭২-৭৩)।
তারা আরও বলল, ‘আমরা (তো মৃত্যুর পরে) আমাদের পরওয়ারদিগারের নিকটে ফিরে যাব’। ‘বস্ত্ততঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো কেবল একারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সমূহের প্রতি, যখন তা আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। অতএব ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ধৈর্যের দুয়ার খুলে দাও এবং আমাদেরকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান কর’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৫-১২৬)।
জাদুকরদের মুসলমান হয়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিল মুকাবিলার পূর্বে ফেরাউন ও তার জাদুকরদের উদ্দেশ্যে মূসার প্রদত্ত উপদেশমূলক ভাষণ। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহলে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দিবেন। বস্ত্ততঃ তারাই বিফল মনোরথ হয়, যারা মিথ্যারোপ করে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬১)।
মূসার মুখে একথা শুনে ফেরাউন ও তার সভাসদরা অহংকারে স্ফীত হলেও জাদুকর ও সাধারণ জনগণের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে জাদুকরদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে যায় এবং তারা আপোষে বিতর্কে লিপ্ত হয়। যদিও গোপন আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভবতঃ রাজকীয় সম্মান ও বিরাট অংকের পুরস্কারের লোভে পরিশেষে তারা একমত হয়।
জনগণের প্রতিক্রিয়া
আল্লাহ বলেন, ‘ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে তার সম্প্রদায়ের কিছু লোক ব্যতীত কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি। আর ফেরাউন তার দেশে ছিল পরাক্রান্ত এবং সে ছিল সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউনুস, আয়াত ৮৩)। এতে বুঝা যায় যে, ক্বিবতীদের মধ্যে গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা বেশী থাকলেও প্রকাশ্যে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল।
উল্লেখ্য যে, অত্র আয়াতে ‘তার কওমের কিছু লোক ব্যতীত’ বলতে ইবনু আববাস রা. ‘ফেরাউনের কওমের কিছু লোক’ বলেছেন। কিন্তু ইবনু জারীর ও অনেক বিদ্বান মূসার নিজ কওম ‘বনু ইসরঈলের কিছু লোক’ বলেছেন। এর জবাবে হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, এটা প্রসিদ্ধ কথা যে, বনু ইসরঈলের সকলেই মূসাকে নবী হিসাবে বিশ্বাস করত একমাত্র ক্বারূণ ব্যতীত। কেননা সে ছিল বিদ্রোহী এবং ফেরাউনের সাথী। আর মূসার কারণেই বনু ইসরাঈলগণ মূসার জন্মের আগে ও পরে সমানভাবে নির্যাতিত ছিল (আ‘রাফ, ১২৯)। অতএব অত্র আয়াতে যে মুষ্টিমেয় লোকের ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবেই ছিলেন ক্বিবতী সম্প্রদায়ের। আর তারা ছিলেন, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া, ফেরাউনের চাচাতো ভাই জনৈক মুমিন ব্যক্তি যিনি তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন এবং ফেরাউনের খাজাঞ্চি ও তার স্ত্রী। যেকথা ইবনু আববাস রা. বলেছেন।
ফেরাউনের স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
জাদুকরদের সঙ্গে মুকাবিলা তথা সত্য ও মিথ্যার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ফেরাউনের নেককার স্ত্রী ও মূসার পালক মাতা ‘আসিয়া’ উক্ত মুকাবিলার শুভ ফলাফলের জন্য সদা উদগ্রীব ছিলেন। যখন তাঁকে মূসা ও হারূণের বিজয়ের সংবাদ শোনানো হল, তখন তিনি কালবিলম্ব না করে বলে ওঠেন, ‘আমি মূসা ও হারূণের পালনকর্তার উপরে ঈমান আনলাম’। নিজ স্ত্রীর ঈমানের এ খবর শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফেরাউন তাকে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বে বিবি আসিয়া কাতর কণ্ঠে স্বীয় প্রভুর নিকটে প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ঈমানদারগণের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ফেরাউনের স্ত্রীর, যখন সে বলেছিল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তোমার নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর! আমাকে ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের হাত থেকে উদ্ধার কর এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (তাহরীম, আয়াত ১১)।
নবুয়ত–পরবর্তী ২য় পরীক্ষা : বনু ইসরাঈলদের উপরে আপতিত ফেরাউনী যুলুম সমূহ
জাদুর পরীক্ষায় পরাজিত ফেরাউনের যাবতীয় আক্রোশ গিয়ে পড়ল এবার নিরীহ বনু ইসরাঈলগণের উপর। জাদুকরদের ঈমান আনয়ন, অতঃপর তাদের মৃত্যুদন্ড প্রদান, বিবি আসিয়ার ঈমান আনয়ন ও তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান ইত্যাদি নিষ্ঠুর দমন নীতির মাধ্যমে এবং অত্যন্ত নোংরা কুটচাল ও মিথ্যা অপবাদ সমূহের মাধ্যমে মূসার ঈমানী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল ফেরাউন। কিন্তু এর ফলে জনগণের মধ্যে মূসার দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে ফেরাউন ও তার অহংকারী পরিষদবর্গ নতুনভাবে দমন নীতির কৌশলপত্র প্রণয়ন করল। তারা নিজেরা বিধর্মী হলেও সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করল। অন্যদিকে ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’-এই কুটনীতির অনুসরণে ফেরাউনের ক্বিবতী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কেবল বনু ইসরাঈলদের উপরে চূড়ান্ত যুলুম ও নির্যাতনের পরিকল্পনা করল।
১ম যুলুমঃ বনু ইসরঈলের নবজাতক পুত্রসন্তানদের হত্যার নির্দেশ জারি
ফেরাউনী সম্প্রদায়ের নেতারা ইতিপূর্বে ফেরাউনকে বলেছিল, ‘আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে এমনি ছেড়ে দিবেন দেশময় ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বাতিল করে দেবার জন্য? (আ‘রাফ, ১২৭)। নেতারা মূসা ও হারূণের ঈমানী দাওয়াতকে ‘ফাসাদ’ বলে অভিহিত করেছিল। এক্ষণে দেশময় মূসার দাওয়াতের ব্যাপক প্রসার বন্ধ করার জন্য এবং ফেরাউনের নিজ সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকদের ব্যাপকহারে মূসার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্রোত বন্ধ করার জন্য নিজেদের লোকদের কিছু না বলে নিরীহ বনু ইসরাঈলদের উপরে অত্যাচার শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ফেরাউন বলল, ‘আমি এখুনি টুকরা টুকরা করে হত্যা করব ওদের পুত্র সন্তানদেরকে এবং বাঁচিয়ে রাখব ওদের কন্যা সন্তানদেরকে। আর আমরা তো ওদের উপরে (সবদিক দিয়েই) প্রবল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৭)। এভাবে মূসার জন্মকালে বনী ইসরঈলের সকল নবজাতক পুত্র হত্যা করার সেই ফেলে আসা লোমহর্ষক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তির ঘোষণা প্রদান করা হল।
দল ঠিক রাখার জন্য এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের রোষাগ্নি প্রশমনের জন্য ফেরাউন অনুরূপ ঘোষণা দিলেও মূসা ও হারূণ সম্পর্কে তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয়নি। যদিও ইতিপূর্বে সে মূসা আ.কে কারারুদ্ধ করার এমনকি হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল (শো‘আরা,২৯; মুমিন ৪০)। কিন্তু জাদুকরদের পরাজয়ের পর এবং নিজে মূসার সর্পরূপী লাঠির মু‘জেযা দেখে ভীত বিহবল হয়ে পড়ার পর থেকে মূসার দিকে তাকানোর মত সাহসও তার ছিল না।
যাই হোক ফেরাউনের উক্ত নিষ্ঠুর ঘোষণা জারি হওয়ার পর বনু ইসরাঈলগণ মূসা আ. এর নিকটে এসে অনুযোগের সুরে বলল, ‘তোমার আগমনের পূর্বেও আমাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে। আবার এখন তোমার আগমনের পরেও তাই করা হচ্ছে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৯)। অর্থাৎ তোমার আগমনের পূর্বে তো এ আশায় আমাদের দিন কাটত যে, সত্বর আমাদের উদ্ধারের জন্য একজন নবীর আগমন ঘটবে। অথচ এখন তোমার আগমনের পরেও সেই একই নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাহলে এখন আমাদের উপায় কি? আসন্ন বিপদের আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমের লোকদের সান্ত্বনা দিয়ে মূসা আ. বললেন, ‘তোমাদের পালনকর্তা শীঘ্রই তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করে দিবেন এবং তোমাদেরকে দেশে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর’ (আ‘রাফ, আয়ত ১২৯)। তিনি বললেন,‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকটে এবং ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এ পৃথিবী আল্লাহর। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। বস্ত্ততঃ চূড়ান্ত পরিণাম ফল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৮)।
হযরত মূসা আ. তাদেরকে আরও বলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহর উপরে ঈমান এনে থাক, তবে তাঁরই উপরে ভরসা কর যদি তোমরা আনুগত্যশীল হয়ে থাক’। জবাবে তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপরে এ যালেম কওমের শক্তি পরীক্ষা করো না’। ‘আর আমাদেরকে অনুগ্রহ করে কাফের সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (ইউনুস, আয়াত ৮৪-৮৬)।
উপরোক্ত আয়াত সমূহে বুঝা যায় যে, পয়গম্বর সূলভ দরদ ও দূরদর্শিতার আলোকে মূসা আ. স্বীয় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমকে মূলতঃ দু’টি বিষয়ে উপদেশ দেন। এক– শত্রুর মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা এবং দুই– আল্লাহর সাহায্য না আসা পর্যন্ত সাহসের সাথে ধৈর্য ধারণ করা। সাথে সাথে একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, সমগ্র পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর। তিনি যাকে খুশী এর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন এবং নিঃসন্দেহে শেষফল মুত্তাক্বীদের জন্যই নির্ধারিত।
ফেরাউনের বিরুদ্ধে মূসা আ. এর বদ দো‘আ
‘হযরত মূসা আ. বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি ফেরাউনকে ও তার সর্দারদেরকে পার্থিব আড়ম্বর সমূহ ও সম্পদরাজি দান করেছ, যা দিয়ে তারা লোকদেরকে তোমার রাস্তা থেকে বিপথগামী করে। অতএব হে আমাদের প্রভু! তুমি তাদের সম্পদরাজি ধ্বংস করে দাও ও তাদের অন্তরগুলিকে শক্ত করে দাও, যাতে তারা অতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান না আনে, যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’। জবাবে আল্লাহ বললেন, তোমাদের দো‘আ কবুল হয়েছে। অতএব তোমরা দু’জন অটল থাক এবং অবশ্যই তোমরা তাদের পথে চলো না, যারা জানে না’ (ইউনুস, আয়াত ৮৮-৮৯)।
মূসা ও হারূণের উপরোক্ত দো‘আ আল্লাহ কবুল করলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে করলেন না। বরং সময় নিলেন অন্যূন বিশ বছর। এরূপ প্রলম্বিত কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহ মাযলূমের ধৈর্য পরীক্ষার সাথে সাথে যালেমেরও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন এবং তাদের তওবা করার ও হেদায়াত প্রাপ্তির সুযোগ দেন। যাতে পরে তাদের জন্য ওযর পেশ করার কোন সুযোগ না থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান’ (মুহাম্মদ, আয়াত ৪৭)।
প্রশ্ন হতে পারে, এত যুলুম সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের হিজরত করার নির্দেশ না দিয়ে সেখানেই পুনরায় ঘর বানিয়ে বসবাসের নির্দেশ দিলেন কেন? এর জবাব দু’ভাবে দেওয়া যেতে পারে।
এক– ফেরাউন তাদেরকে হিজরতে বাধা দিত। কারণ বনু ইসরাঈলগণকে তারা তাদের জাতীয় উন্নয়নের সহযোগী হিসাবে এবং কর্মচারী ও সেবাদাস হিসাবে ব্যবহার করত। তাছাড়া পালিয়ে আসারও কোন পথ ছিল না। কেননা নীলনদ ছিল বড় বাধা। নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলে ফেরাউনী সেনারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করত।
দুই– ফেরাউনী সম্প্রদায়ের মধ্যে মূসা ও হারূণের দাওয়াত সম্প্রসারণ করা। মূলতঃ এটিই ছিল আল্লাহর মূল উদ্দেশ্য। কেননা যতদিন তারা মিসরে ছিলেন, সেখানকার অধিবাসীদের নিকটে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছেন এবং তার ফলে বহু আল্লাহর বান্দা পথের সন্ধান পেয়ে ধন্য হয়েছেন। ফেরাউন দেখেছিল তার দুনিয়াবী লাভ ও শান-শওকত। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছিলেন তাওহীদের প্রচার-প্রসার ও মানুষের হেদায়াত। সেটিই হয়েছে। ফেরাউনেরা এখন মিসরের পিরামিডের দর্শনীয় বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। অথচ মিসর সহ বলা চলে পুরা আফ্রিকায় এখন ইসলামের জয়-জয়কার অব্যাহত রয়েছে।
ফেরাউনী সম্প্রদায়ের উপরে আপতিত গযব সমূহ এবং মূসা আ.-এর মু‘জেযা সমূহ
ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী ফেরাউনের জাদুকরদের সাথে শক্তি পরীক্ষার ঘটনার পর মূসা আ. অন্যূন বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে আল্লাহর বাণী শোনান এবং সত্য ও সরল পথের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। এ সময়কালের মধ্যে আল্লাহ মূসা আ.-কে প্রধান ৯টি মু‘জেযা দান করেন। তবে প্লেগ মহামারী সহ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। মোট নিদর্শনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। যার মধ্যে প্রথম দু’টি শ্রেষ্ঠ মু‘জেযা ছিল অলৌকিক লাঠি ও আলোকময় হস্ততালু। যার পরীক্ষা শুরুতেই ফেরাউনের দরবারে এবং পরে জাদুকরদের সম্মুখে হয়ে গিয়েছিল। এরপর বাকীগুলি এসেছিল ফেরাউনী কওমের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে তাদেরকে সাবধান করার জন্য। মূলতঃ দুনিয়াতে প্রেরিত সকল এলাহী গযবের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষের হেদায়াত। যেমন আল্লাহ বলেন,‘কাফির ও ফাসিকদেরকে (জাহান্নামের) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) আমরা অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা (আমার দিকে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ, আয়াত ৩২)।
মযলূম বনু ইসরাঈলদের কাতর প্রার্থনা এবং মূসা ও হারূণের দো‘আ আল্লাহ কবুল করেছিলেন। সেমতে সর্বপ্রথম অহংকারী ফেরাউনী কওমের দুনিয়াবী জৌলুস ও সম্পদরাজি ধ্বংসের গযব নেমে আসে। তারপর আসে অন্যান্য গযব বা নিদর্শন সমূহ। সেগুলি একে একে বর্ণনা করা হল। যাতে এযুগের মানুষ তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
মোট নিদর্শন সমূহ, যা মিসরে প্রদর্শিত হয়–
১. লাঠি, ২. প্রদীপ্ত হস্ততালু, ৩. দুর্ভিক্ষ, ৪. তূফান, ৫. পঙ্গপাল, ৬. উকুন, ৭. ব্যাঙ, ৮. রক্ত, ৯. প্লেগ ও ১০. সাগরডুবি। প্রথম দু’টি এবং মূসার ব্যক্তিগত তোতলামি দূর হওয়াটা বাদ দিয়ে বাকী ৮টি নিদর্শন নিম্নে বর্ণিত হল-
তূফান
দুর্ভিক্ষের পরে মূসা আ.-এর দো‘আর বরকতে পুনরায় ভরা মাঠ ও ভরা ফসল পেয়ে ফেরাউনী সম্প্রদায় পিছনের সব কথা ভুলে যায় ও গর্বে স্ফীত হয়ে মূসা আ.-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে থাকে। তারা সাধারণ লোকদের ঈমান গ্রহণে বাধা দিতে থাকে। তারা তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পুনরায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে। ফলে তাদের উপরে গযব আকারে প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস নেমে আসে। যা তাদের মাঠ-ঘাট, বাগান-ফসল, ঘর-বাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এতে ভীত হয়ে তারা আবার মূসা আ.-এর কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার তারা ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা করে ও আল্লাহর নিকটে দো‘আ করার জন্য মূসা আ.-কে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। ফলে মূসা আ. দো‘আ করেন ও আল্লাহর রহমতে তূফান চলে যায়। পুনরায় তারা জমি-জমা আবাদ করে ও অচিরেই তা সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। এ দৃশ্য দেখে তারা আবার অহংকারী হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আসলে আমাদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যেই প্লাবন এসেছিল, আর সেকারণেই আমাদের ফসল এবার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ও বাম্পার ফলন হয়েছে। আসলে আমাদের কর্ম দক্ষতার ফল হিসাবে এটাই উপযুক্ত। এভাবে তারা অহংকারে মত্ত হয়ে আবার শুরু করল বনী ইসরাঈলদের উপরে যুলুম-অত্যাচার। ফলে নেমে এল তৃতীয় গযব।
পঙ্গপাল
একদিন হঠাৎ হাজর হাজার পঙ্গপাল কোত্থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ফেরাউনীদের সব ফসল খেয়ে ছাফ করে গেল। তারা তাদের বাগ-বাগিচার ফল-ফলাদি খেয়ে সাবাড় করে ফেলল। এমনকি কাঠের দরজা-জানালা, আসবাব-পত্র পর্যন্ত খেয়ে শেষ করল। অথচ পাশাপাশি বনু ইসরাঈলদের ঘরবাড়ি, শস্যভূমি ও বাগ-বাগিচা সবই সুরক্ষিত থাকে।
এবারও ফেরাউনী সম্প্রদায় ছুটে এসে মূসা আ.-এর কাছে কাতর কণ্ঠে নিবেদন করতে থাকে, যাতে গযব চলে যায়। তারা এবার পাকা ওয়াদা করল যে, তারা ঈমান আনবে ও বনু ইসরাঈলদের মুক্তি দেবে। মূসা আ. দো‘আ করলেন ও আযাব চলে গেল। পরে ফেরাউনীরা দেখল যে, পঙ্গপালে খেয়ে গেলেও এখনও যা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ফলে তারা আবার শয়তানী ধোঁকায় পড়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল ও পূর্বের ন্যায় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন শুরু করল। ফলে নেমে এল পরবর্তী গযব ‘উকুন’।
উকুন
‘উকুন’ সাধারণতঃ মানুষের মাথার চুলে জন্মে থাকে। তবে এখানে ব্যাপক অর্থে ঘুণ পোকা ও কেড়ি পোকাকেও গণ্য করা হয়েছে। যা ফেরাউনীদের সকল প্রকার কাঠের খুঁটি, দরজা-জানালা, খাট-পালংক ও আসবাব-পত্রে এবং খাদ্য-শস্যে লেগেছিল। তাছাড়া দেহের সর্বত্র সর্বদা উকুনের কামড়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এভাবে উকুন ও ঘুণপোকার অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে এক সময় তারা কাঁদতে কাঁদতে মূসা আ.-এর দরবারে এসে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো এবং প্রতিজ্ঞার পরে প্রতিজ্ঞা করে বলতে লাগলো যে, এবারে আযাব ফিরে গেলে তারা অবশ্যই ঈমান আনবে, তাতে বিন্দুমাত্র অন্যথা হবে না। মূসা আ. তাদের জন্য দো‘আ করলেন এবং আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল এবং পূর্বের ন্যায় অবাধ্য আচরণ শুরু করল। আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার অবকাশ দেওয়াকে তারা তাদের ভালত্বের পক্ষে দলীল হিসাবে মনে করতে লাগল এবং হেদায়াত দূরে থাক, তাদের অহংকার ক্রমে বাড়তে লাগল। মূলতঃ এগুলো ছিল তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের অবস্থা। নইলে সাধারণ মানুষ মূসা ও হারূণের দাওয়াত অন্তরে কবুল করে যাচ্ছিল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর এতেই ছিল মূসা আ.-এর সান্ত্বনা। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে উদ্বুদ্ধ করি। অতঃপর তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়। ফলে উক্ত জনগোষ্ঠীর উপরে আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা উক্ত জনপদকে সমূলে বিধ্বস্ত করি’ (ইসরা, আয়াত ১৬)। ফেরাউনীদের উপরে সেই অবস্থা এসে গিয়েছিল। তাদের নেতারা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা তাদের লোকদের বুঝাতে লাগলো যে, এসবই মূসার জাদুর খেল। আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই। ফলে নেমে এল এবার ‘ব্যাঙ’-এর গযব।
ব্যাঙ
বারবার বিদ্রোহ করা সত্ত্বেও দয়ালু আল্লাহ তাদের সাবধান করার জন্য ও আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনরায় গযব পাঠালেন। এবার এল ব্যাঙ। ব্যাঙে ব্যাঙে ভরে গেল তাদের ঘর-বাড়ি, হাড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, বিছানা-পত্তর সবকিছু। বসতে ব্যাঙ, খেতে ব্যাঙ, চলতে ব্যাঙ, গায়ে-মাথায় সর্বত্র ব্যাঙের লাফালাফি। কোন জায়গায় বসা মাত্র শত শত ব্যাঙের নীচে তলিয়ে যেতে হত। এই নরম জীবটির সরস অত্যাচারে পাগলপরা হয়ে উঠল পুরা ফেরাউনী জনপদ। অবশেষে কান্নাকাটি করে ও কাকুতি-মিনতি করে তারা এসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো মূসা আ.-এর কাছে। এবার পাকাপাকি ওয়াদা করল যে, আযাব চলে যাবার সাথে সাথে তারা ঈমান আনবেই। কিন্তু না, যথা পূর্বং তথা পরং। ফলে পুনরায় গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। এবারে এল ‘রক্ত’।
রক্ত
তাদের অহংকার ও ঔদ্ধত্য চরমে উঠলে হঠাৎ একদিন দেখা গেল ‘রক্ত’। খাদ্য ও পানপাত্রে রক্ত, কূয়া ও পুকুরে রক্ত, তরি-তরকারিতে রক্ত, কলসি-বালতিতে রক্ত। একই সাথে খেতে বসে বনু ইসরঈলের থালা-বাটি স্বাভাবিক। কিন্তু ফেরাউনী ক্বিবতীর থালা-বাটি রক্তে ভরা। পানি মুখে নেওয়া মাত্র গ্লাসভর্তি রক্ত। অহংকারী নেতারা বাধ্য হয়ে বনু ইস্রাঈলী মযলূমদের বাড়ীতে এসে খাদ্য ও পানি ভিক্ষা চাইত। কিন্তু যেমনি তাদের হাতে তা পৌঁছত, অমনি সেগুলো রক্তে পরিবর্তিত হয়ে যেত। ফলে তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। না খেয়ে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। অবশেষে পূর্বের ন্যায় আবার এসে কান্নাকাটি। মূসা আ. দয়া পরবশে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু ঐ নেতাগুলো পূর্বের মতই তাদের গোমরাহীতে অনড় রইল এবং ঈমান আনলো না। এদের এই হঠকারিতা ও কপট আচরণের কথা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে, ‘অতঃপর তারা আত্মম্ভরিতা দেখাতে লাগলো। বস্ত্ততঃ এরা ছিল পাপাসক্ত জাতি’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৩)। ফলে নেমে এল এবার প্লেগ মহামারী।
প্লেগ
রক্তের আযাব উঠিয়ে নেবার পরও যখন ওরা ঈমান আনলো না, তখন আল্লাহ ওদের উপরে প্লেগ মহামারী প্রেরণ করেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। অনেকে এটাকে ‘বসন্ত’ রোগ বলেছেন। যাতে অল্প দিনেই তাদের সত্তর হাজার লোক মারা যায়। অথচ বনু ইসরাঈলরা ভাল থাকে। এলাহী গযবের সাথে সাথে এগুলি ছিল মূসা আ.-এর মু‘জেযা এবং নবুয়তের নিদর্শন। কিন্তু জাহিল ও আত্মগর্বী নেতারা একে ‘জাদু’ বলে তাচ্ছিল্য করত।
প্লেগের মহামারীর ফলে ব্যাপক প্রাণহানিতে ভীত হয়ে তারা আবার এসে মূসা আ.-এর নিকটে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল। মূসা আ. আবারও তাদের জন্য দো‘আ করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা পূর্বের ন্যায় আবারো ওয়াদা ভঙ্গ করল। ফলে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অবধারিত হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যাদের উপরে তোমার প্রভুর আদেশ নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা কখনো বিশ্বাস আনয়ন করে না, যদিও সব রকমের নিদর্শনাবলী তাদের নিকটে পৌছে যায়, এমনকি তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’ (ইউনুস, আয়াত ৯৬-৯৭)।
সাগর ডুবি
ক্রমাগত পরীক্ষা ও অবকাশ দানের পরও যখন কোন জাতি সম্বিত ফিরে পায় না। বরং উল্টা তাদের অহংকার বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে ওঠে, তখন তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমরা মূসার প্রতি এই মর্মে অহী করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্কপথ নির্ধারণ কর। পিছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশংকা কর না এবং (পানিতে ডুবে যাওয়ার) ভয় কর না’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭৭)।
আল্লাহর হুকুম পেয়ে মূসা আ. রাত্রির সূচনা লগ্নে বনু ইসরাঈলদের নিয়ে রওয়ানা হলেন। তাঁরা সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। এ সমুদ্র কোনটা ছিল এ ব্যাপারে মুফতী মুহাম্মদ শফী তাফসীর রূহুল মা‘আনীর বরাত দিয়ে ৮৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ওটা ছিল ‘ভূমধ্যসাগর’। একই তাফসীরে ৪৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘লোহিত সাগর’। মিসরের আধুনিক তাফসীরকার তানতাভীও (মৃঃ ১৯৪০ খৃঃ) বলেন যে, লোহিত সাগরে ডুবে মরা ফেরাউনের লাশ ১৯০০ খৃষ্টাব্দের মে মাসে পাওয়া গিয়েছিল’। যদিও তা ১৯০৭ সালে পাওয়া যায়।
নবুয়ত–পরবর্তী ৩য় পরীক্ষা ও নাজাত লাভ
হযরত মূসা আ. এর নবুয়তী জীবনে এটি ছিল একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা। হযরত ইব্রাহিম আ. এর অগ্নি পরীক্ষার ন্যায় এটিও ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক মহা পরীক্ষা। পিছনে ফেরাউনের হিংস্র বাহিনী, সম্মুখে অথৈ সাগর। এই কঠিন সময়ে বনু ইসরঈলের আতংক ও হাহাকারের মধ্যেও মূসা আ. ছিলেন স্থির ও সংকল্পবদ্ধ। দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় তিনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাসে অটল থাকেন এবং সাথীদের সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। ফেরাউন খবর জানতে পেরে তার সেনাবাহিনীকে বনু ইসরাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল’ (শো‘আরা, আয়াত ৬০)। ‘অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসা আ. এর সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলল, ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম’। ‘তখন মূসা আ. বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন’। ‘অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল’। ‘ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপর দলকে (অর্থাৎ ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম’। ‘এবং মূসা ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম’। ‘অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম’ (শো‘আরা, আয়াত ৬০-৬৬)। এখানে ‘প্রত্যেক ভাগ’ বলতে তাফসীরকারগণ বারো গোত্রের জন্য বারোটি ভাগ বলেছেন। প্রত্যেক ভাগের লোকেরা পানির দেওয়াল ভেদ করে পরস্পরকে দেখতে পায় ও কথা বলতে পারে, যাতে তারা ভীত না হয়ে পড়ে। মূসা ও বনু ইসরাঈলকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে দেখে ফেরাউন সরোষে ঘোড়া দাবড়িয়ে সর্বাগ্রে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দু’দিক থেকে বিপুল পানি রাশি ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর বনু ইসরাঈলকে আমরা সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা বশতঃ। অতঃপর যখন সে (ফেরাউন) ডুবতে লাগল, তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনছি এ বিষয়ে যে, সেই সত্তা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যার উপরে ঈমান এনেছে বনু ইসরাঈলগণ এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন’ (ইউনুস, আয়াত ৯০)। আল্লাহ বললেন, ‘এখন একথা বলছ? অথচ তুমি ইতিপূর্বে না-ফরমানী করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’। ‘অতএব আজ আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে দিচ্ছি। যাতে তোমার পশ্চাদ্বর্তীদের জন্য তুমি নিদর্শন হতে পার। বস্ত্ততঃ বহু লোক এমন রয়েছে যারা আমাদের নিদর্শনাবলীর বিষয়ে বেখবর’ (ইউনুস, আয়াত ৯১-৯২)।
স্মর্তব্য যে, সাগরডুবির দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার পরেও ভীত-সন্ত্রস্ত বনী ইস্রাঈলীরা ফেরাউন মরেছে কি- না বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফলে মূসা আ. আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন। তখন আল্লাহ তার প্রাণহীন দেহ বের করে দিলেন। অতঃপর মূসার সাথীরা নিশ্চিন্ত হল। উল্লেখ্য যে, ফেরাউনের মমিকৃত দেহ অক্ষতভাবে পাওয়া যায় ১৯০৭ সালে এবং বর্তমানে তা মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
এতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ফেরাউনের সময় মিসরীয় সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাদের সময়ে লাশ ‘মমি’ করার মত বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়। পিরামিড, স্ফিংক্স হাজার হাজার বছর ধরে আজও সেই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি ধারণ করে আছে, যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।
বনু ইসরঈলের অবাধ্যতা ও তাদের উপরে আপতিত পরীক্ষা সমূহের বিবরণ
মূর্তি পূজার আবদার
বনু ইসরাঈল কওম মূসা আ.-এর মু‘জেযার বলে লোহিত সাগরে নির্ঘাত ডুবে মরা থেকে সদ্য নাজাত পেয়ে এসেছিল এবং গোটা ফেরাউনী গোষ্ঠীকে সাগরে ডুবে মরার মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরিয়া আসার পথে কিছুদূর অগ্রসর হতেই তারা এমন এক জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করল, যারা বিভিন্ন মূর্তির পূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের পূজা-অর্চনার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে তাদের মন সেদিকে আকৃষ্ট হল এবং মূসা আ.-এর কাছে গিয়ে আবেদন করল, ‘তাদের মূর্তিসমূহের ন্যায় আমাদের জন্যও একটা মূর্তি বানিয়ে দিন’। মূসা বললেন, ‘তোমরা দেখছি মূর্খতায় লিপ্ত জাতি’। তিনি বলেন, ‘এরা যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তা ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তারা করছে, তা সব বাতিল’। ‘তিনি আরও বললেন,‘আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য সন্ধান করব? অথচ তিনি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৮-১৪০)।
তাওরাত লাভ
অতঃপর আল্লাহ মূসা আ.কে অহীর মাধ্যমে ওয়াদা করলেন যে, তাকে সত্বর ‘কিতাব’ (তাওরাত) প্রদান করা হবে এবং এজন্য তিনি বনু ইসরাঈলকে সাথে নিয়ে তাকে ‘তূর পাহাড়ের দক্ষিণ পার্শ্বে’ চলে আসতে বললেন (ত্বোয়াহা, আয়াত ৮৩-৮৪)। অতঃপর মূসা আ. আগে এসে আল্লাহর হুকুমে প্রথমে ত্রিশ দিন সিয়াম ও এ‘তেকাফে মগ্ন থাকেন। এরপর আল্লাহ আরও দশদিন মেয়াদ বাড়িয়ে দেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৪২)। ইবনু আববাস রা. বলেন, এই দশদিন ছিল যিলহজ্জের প্রথম দশদিন, যা অতীব বরকতময়। ইবনু কাছীর বলেন, ১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন মূসার মেয়াদ শেষ হয় ও আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ হয়। একই দিন শেষনবী মুহাম্মদ সা.-এর উপর দ্বীন পরিপূর্ণতার আয়াত নাযিল হয় (মায়েদাহ ৩)। যথাসময়ে আল্লাহ মূসার সঙ্গে কথা বললেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৩)। অতঃপর তাঁকে তাওরাত প্রদান করলেন, যা ছিল সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ও সরল পথ প্রদর্শনকারী (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৩)। দীর্ঘ বিশ বছরের অধিককাল পূর্বে মিসর যাওয়ার পথে এই স্থানেই মূসা আ. প্রথম আল্লাহর সাথে কথোপকথনের ও নবুয়ত লাভের মহা সৌভাগ্য লাভ করেন। আজ আবার সেখানেই বাক্যালাপ ছাড়াও এলাহী গ্রন্থ তাওরাত পেয়ে খুশীতে অধিকতর সাহসী হয়ে তিনি আল্লাহর নিকটে দাবী করে বসলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখা দাও। আমি তোমাকে স্বচক্ষে দেখব। আল্লাহ বললেন, তুমি আমাকে (এ দুনিয়াতে) কখনোই দেখতে পাবে না। তবে তুমি (তূর) পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক। সেটি যদি স্বস্থানে স্থির থাকে, তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তার প্রভু উক্ত পাহাড়ের উপরে স্বীয় জ্যোতির বিকীরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা আ. জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। অতঃপর যখন তার জ্ঞান ফিরে এল, তখন বলল, হে প্রভু! মহা পবিত্র তোমার সত্তা! আমি তোমার নিকটে তওবা করছি এবং আমি বিশ্বাসীদের মধ্যে অগ্রণী’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৩)।
আল্লাহ বললেন, হে মূসা! আমি আমার ‘রিসালাত’ এবং বাক্যালাপের মাধ্যমে লোকদের (নবীগণের) উপরে তোমাকে বিশিষ্টতা দান করেছি। সুতরাং যা কিছু আমি তোমাকে দান করলাম তা গ্রহণ কর ও কৃতজ্ঞ থাক’। ‘আর আমরা তার জন্য ফলক সমূহে লিখে দিয়েছিলাম সর্বপ্রকার উপদেশ ও সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে। অতএব তুমি এগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং স্বজাতিকে এর কল্যাণকর বিষয়সমূহ দৃঢ়তার সাথে পালনের নির্দেশ দাও। শীঘ্রই আমি তোমাদেরকে দেখাব পাপাচারীদের বাসস্থান’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৪-১৪৫)।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তখতী বা ফলকে লিখিত অবস্থায় তাঁকে কিতাব প্রদান করা হয়েছিল। আর এই তখতীগুলোর নামই হল ‘তাওরাত’।
গো–বৎস পূজার শাস্তি
হযরত মূসা আ. গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করে নিজেদের উপরে যুলুম করেছ। অতএব এখন তোমাদের প্রভুর নিকটে তওবা কর এবং নিজেদেরকে পরস্পরে হত্যা কর। এটাই তোমাদের জন্য তোমাদের স্রষ্টার নিকটে কল্যাণকর’… (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৪)। এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়।
তূর পাহাড় তুলে ধরা হল
এরপরেও কপট বিশ্বাসী ও হঠকারী কিছু লোক থাকে, যারা তাওরাতকে মানতে অস্বীকার করে। ফলে তাদের মাথার উপরে আল্লাহ তূর পাহাড়ের একাংশ উঁচু করে ঝুলিয়ে ধরেন এবং অবশেষে নিরুপায় হয়ে তারা সবাই আনুগত্য করতে স্বীকৃত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের মাথার উপরে তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদের যে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তা মযবুতভাবে ধারণ কর এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা স্মরণে রাখ, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পার’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৩)। কিন্তু গো-বৎসের মহববত এদের হৃদয়ে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, এতকিছুর পরেও তারা শিরক ছাড়তে পারেনি। আল্লাহ বলেন, ‘কুফরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস প্রীতি পান করানো হয়েছিল’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৯৩)। যেমন কেউ সরাসরি শিরকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কেউবা মুখে তওবা করলেও অন্তরে পুরোপুরি তওবা করেনি। কেউবা শিরককে ঘৃণা করতে পারেনি। কেউ বা মনে মনে ঘৃণা করলেও বাহ্যিকভাবে মেনে নিয়েছিল এবং বাধা দেওয়ার কোন চেষ্টা করেনি। আল্লাহ যখন তূর পাহাড় তুলে ধরে ভয় দেখিয়ে তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেন, তখনও তাদের কেউ কেউ (পরবর্তীতে) বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৯৩)। যদিও অমান্য করলাম কথাটি ছিল পরের এবং তা প্রমাণিত হয়েছিল তাদের বাস্তব ক্রিয়াকর্মে। যেমন আল্লাহ এইসব প্রতিশ্রুতি দানকারীদের পরবর্তী আচরণ সম্বন্ধে বলেন, ‘‘অতঃপর তোমরা উক্ত ঘটনার পরে (তোমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে) ফিরে গেছ। যদি আল্লাহর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহ তোমাদের উপরে না থাকত, তাহলে অবশ্যই তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে’’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৪)।
আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার জিদ ও তার পরিণতি
হযরত মূসা আ. তূর পাহাড়ে তাওরাত প্রাপ্ত হয়ে বনু ইসরঈলের কাছে ফিরে এসে তা পেশ করলেন এবং বললেন যে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব। তোমরা এর অনুসরণ কর। তখন কিছু সংখ্যক উদ্ধত লোক বলে উঠলো, যদি আল্লাহ স্বয়ং আমাদের বলে দেন যে, এটি তাঁর প্রদত্ত কিতাব, তাহলেই কেবল আমরা বিশ্বাস করব, নইলে নয়। হতে পারে তুমি সেখানে চল্লিশ দিন বসে বসে এটা নিজে লিখে এনেছ। তখন মূসা আ. আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে তাঁর সাথে তূর পাহাড়ে যেতে বললেন। বনী ইসরাঈলরা তাদের মধ্যে বাছাই করা সত্তর জনকে মনোনীত করে মূসা আ.-এর সাথে তূর পাহাড়ে প্রেরণ করল। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহর বাণী স্বকর্ণে শুনতে পেল। এরপরেও তাদের অবাধ্য মন শান্ত হল না। শয়তানী ধোঁকায় পড়ে তারা নতুন এক অজুহাত তুলে বলল, এগুলো আল্লাহর কথা না অন্য কারু কথা, আমরা বুঝবো কিভাবে? অতএব যতক্ষণ আমরা তাঁকে সশরীরে প্রকাশ্যে আমাদের সম্মুখে না দেখব, ততক্ষণ আমরা বিশ্বাস করব না যে, এসব আল্লাহর বাণী। কিন্তু যেহেতু এ পার্থিব জগতে চর্মচক্ষুতে আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা কারু নেই, তাই তাদের এই চরম ধৃষ্টতার জবাবে আসমান থেকে ভীষণ এক নিনাদ এল, যাতে সব নেতাগুলোই চোখের পলকে অক্কা পেল।
অকস্মাৎ এমন ঘটনায় হযরত মূসা আ. বিস্মিত ও ভীত-বিহবল হয়ে পড়লেন। তিনি প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! এমনিতেই ওরা হঠকারী। এরপরে এদের এই মৃত্যুতে লোকেরা আমাকেই দায়ী করবে। কেননা মূল ঘটনার সাক্ষী কেউ থাকল না আমি ছাড়া। অতএব হে আল্লাহ! ওদেরকে পুনর্জীবন দান কর। যাতে আমি দায়মুক্ত হতে পারি এবং ওরাও গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। আল্লাহ মূসার দো‘আ কবুল করলেন এবং ওদের জীবিত করলেন। এ ঘটনা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে-
‘আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা! কখনোই আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তখন তোমাদেরকে পাকড়াও করল এক ভীষণ নিনাদ (বজ্রপাত), যা তোমাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল’। ‘অতঃপর তোমাদের মৃত্যুর পর আমরা তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৫-৫৬)।
বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের নির্দেশ
সাগরডুবি থেকে মুক্তি পাবার পর হতে সিনাই উপত্যকা পেরিয়ে তূর পাহাড়ে পৌঁছা পর্যন্ত সময়কালে মূর্তিপূজার আবদার, গো-বৎস পূজা ও তার শাস্তি, তাওরাত লাভ ও তা মানতে অস্বীকার এবং তূর পাহাড় উঠিয়ে ভয় প্রদর্শন, আল্লাহ্কে স্বচক্ষে দেখার জিদ ও তার পরিণতি প্রভৃতি ঘটনা সমূহের পর এবার তাদের মূল গন্তব্যে যাত্রার জন্য আদেশ করা হল। অবাধ্য জাতিকে তাদের আদি বাসস্থানে রওয়ানার প্রাক্কালে মূসা আ. তাদেরকে দূরদর্শিতাপূর্ণ উপদেশবাণী শুনান এবং যেকোন বাধা সাহসের সাথে অতিক্রম করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। সাথে সাথে তিনি তাদেরকে বিগত দিনে আল্লাহর অলৌকিক সাহায্য লাভের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অভয়বাণী শুনান। যেমন আল্লাহর ভাষায়,
‘আর যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহরাজি স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে নবীগণকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে এমন সব বস্ত্ত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননি’। ‘হে আমার সম্প্রদায়! পবিত্র ভূমিতে (বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরে) প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর তোমরা পশ্চাদদিকে প্রত্যাবর্তন করবে না। তাতে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (মায়েদাহ, আয়াত ২০-২১)।
নবুয়ত–পরবর্তী ৪র্থ পরীক্ষা : বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান
আল্লাহ পাক মূসা আ.-এর মাধ্যমে বনী ইসরাঈলকে আমালেক্বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাম দখল করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, শামের ভূখন্ড তাদের ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে (মায়েদাহ, আয়াত ২১)। কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু এইসব বিলাসী কাপুরুষেরা আল্লাহর কথায় দৃঢ় বিশ্বাস আনতে পারেনি।
মূসা আ. আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য বনী ইসরাঈলকে সাথে নিয়ে মিসর থেকে শাম অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যথা সময়ে তাঁরা জর্দান নদী পার হয়ে ‘আরীহা’ পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। এটি ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মহানগরী সমূহের অন্যতম, যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। যা আজও স্বনামে বিদ্যমান রয়েছে। মূসা আ.-এর সময়ে এ শহরের অত্যাশ্চর্য জাঁক-জমক ও বিস্তৃতি ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে।
শিবির স্থাপনের পর মূসা আ. বিপক্ষ দলের অবস্থা ও অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ১২ জন সর্দারকে প্রেরণ করলেন। যারা ছিলেন হযরত ইয়াকূব আ.-এর বারো পুত্রের বংশধরগণের ‘বারোজন প্রতিনিধি, যাদেরকে তিনি আগেই নির্বাচন করেছিলেন স্ব স্ব গোত্রের লোকদের দেখাশুনার জন্য’ (মায়েদাহ, আয়াত ১২)। তারা রওয়ানা হবার পর বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে বিপক্ষ দলের বিশালদেহী বিকট চেহারার একজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। ইস্রাঈলী রেওয়ায়াত সমূহে লোকটির নাম ‘আউজ ইবনে ওনুক’ বলা হয়েছে এবং তার আকার-আকৃতি ও শক্তি-সাহসের অতিরঞ্জিত বর্ণনা সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে (ইবনু কাছীর)। যাই হোক উক্ত ব্যক্তি একাই বনু ইসরঈলের এই বার জন সরদারকে পাকড়াও করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গেল এবং অভিযোগ করল যে, এই লোকগুলি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতলব নিয়ে এসেছে। বাদশাহ তার নিকটতম লোকদের সাথে পরামর্শের পর এদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন এই উদ্দেশ্যে যে, এরা গিয়ে তাদের নেতাকে আমালেক্বাদের জাঁক-জমক ও শৌর্য-বীর্যের স্বচক্ষে দেখা কাহিনী বর্ণনা করবে। তাতে ওরা ভয়ে এমনিতেই পিছিয়ে যাবে। পরবর্তীতে দেখা গেল যে, বাদশাহর ধারণাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। এই ভীত-কাপুরুষ সর্দাররা জিহাদ দূরে থাক, ওদিকে তাকানোর হিম্মতও হারিয়ে ফেলেছিল।
বনু ইসরঈলের বারো জন সর্দার আমালেক্বাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বজাতির কাছে ফিরে এল এবং আমালেক্বাদের বিস্ময়কর উন্নতি ও অবিশ্বাস্য শক্তি-সামর্থ্যের কথা মূসা আ.-এর নিকটে বর্ণনা করল। কিন্তু মূসা আ. এতে মোটেই ভীত হননি। কারণ তিনি আগেই অহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। সেমতে তিনি গোত্রনেতাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আমালেক্বাদের শৌর্য-বীর্যের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, ইউশা‘ বিন নূন ও কালেব বিন ইউক্বেন্না ব্যতীত বাকী সর্দাররা গোপনে সব ফাঁস করে দিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ফলে যা হবার তাই হল। এই ভীতু আরামপ্রিয় জাতি একেবারে বেঁকে বসলো।
‘তারা বলল, হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনো সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। যদি তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়, তবে নিশ্চিতই আমরা সেখানে প্রবেশ করব’ (মায়েদাহ, আয়াত ২২)। অর্থাৎ ওরা চায় যে, মূসা আ. তার মু‘জেযার মাধ্যমে যেভাবে ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরে আমাদের উদ্ধার করে এনেছেন, অনুরূপভাবে আমালেক্বাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত অট্টালিকা ও সম্পদরাজির উপরে আমাদের মালিক বানিয়ে দিন। অথচ আল্লাহর বিধান এই যে, বান্দাকে চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু বনু ইসরাঈলরা এক পাও বাড়াতে রাজি হয়নি। এমতাবস্থায় ‘তাদের মধ্যকার দু’জন আল্লাহভীরু ব্যক্তি (সম্ভবতঃ পূর্বের দু’জন সর্দার হবেন, যাদের মধ্যে ইউশা‘ পরে নবী হয়েছিলেন), যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, (মূসা আ.-এর আদেশ মতে) ‘তোমরা ওদের উপর আক্রমণ করে (শহরের মূল) দরজায় প্রবেশ কর। (কেননা আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে,) যখনই তোমরা তাতে প্রবেশ করবে, তখনই তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে। আর তোমরা আল্লাহর উপরে ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (মায়েদা, আয়াত ২৩)।
কিন্তু ঐ দুই নেককার সর্দারের কথার প্রতি তারা দৃকপাত করল না। বরং আরও উত্তেজিত হয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মূসা আ.-কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হে মূসা! আমরা কখনোই সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ তারা সেখানে আছে। অতএব তুমি ও তোমার পালনকর্তা যাও এবং যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানেই বসে রইলাম’ (মায়েদাহ, আয়াত ২৪)। নবীর অবাধ্যতার ফলস্বরূপ এই জাতিকে ৪০ বছর তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থাকতে হয় (মায়েদাহ, আয়াত ২৬)। অতঃপর এইসব দুষ্টমতি নেতাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী বংশধররা হযরত ইউশা‘ বিন নূন আ.-এর নেতৃত্বে জিহাদ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পুনর্দখল করে।
বনু ইসরঈলের এই চূড়ান্ত বেআদবী ছিল কুফরীর নামান্তর এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যা পরবর্তীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। বদরের যুদ্ধের সময়ে শেষনবী মুহাম্মদ সা. কিছুটা অনুরূপ অবস্থায় পতিত হয়েছিলেন। অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অল্প সংখ্যক সবেমাত্র মুহাজির মুসলমানের মোকাবেলায় তিনগুণ শক্তিসম্পন্ন সুসজ্জিত বিরাট কুরায়েশ সেনাবাহিনীর আগমনে হতচকিত ও অপ্রস্ত্তত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য যখন নবী মুহাম্মদ সা. আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তখন মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আনছারী রা. দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কস্মিনকালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা আ.-এর স্বজাতি তাঁকে বলেছিল, ‘তুমি ও তোমার প্রভু যাও যুদ্ধ করগে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদা, আয়াত ২৪)। বরং আমরা আপনার ডাইনে, বামে, সামনে ও পিছনে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন’। বিপদ মুহূর্তে সাথীদের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল সা. অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।
বাল‘আম বা‘ঊরার ঘটনা :
ফিলিস্তীন দখলকারী ‘জাববারীন’ তথা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের শক্তিশালী নেতারা মূসা আ. প্রেরিত ১২ জন প্রতিনিধিকে ফেরৎ পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। কারণ তারা মূসা আ.-এর মু‘জেযার কারণে ফেরাউনের সসৈন্যে সাগরডুবির খবর আগেই জেনেছিল। অতএব মূসা আ.-এর বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান বন্ধ করার জন্য তারা বাঁকা পথ তালাশ করল। তারা অত্যন্ত গোপনে বনু ইসরঈলের ঐ সময়কার একজন নামকরা সাধক ও দরবেশ আলেম বাল‘আম ইবনে বা‘ঊরা কাছে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ লোক পাঠাল। বাল‘আম তার স্ত্রীর অনুরোধে তা গ্রহণ করল। অতঃপর তার নিকটে আসল কথা পাড়া হল যে, কিভাবে আমরা মূসার অভিযান ঠেকাতে পারি। আপনি পথ বাৎলে দিলে আমরা আরও মহামূল্যবান উপঢৌকনাদি আপনাকে প্রদান করব। বাল‘আম উঁচুদরের আলেম ছিল। যে সম্পর্কে তার নাম না নিয়েই আল্লাহ বলেন, ‘আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সেই লোকটির অবস্থা, যাকে আমরা আমাদের নিদর্শন সমূহ দান করেছিলাম। অথচ সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। আর তার পিছনে লাগল শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৭৫)।
কথিত আছে যে, বাল‘আম ‘ইসমে আযম’ জানত। সে যা দো‘আ করত, তা সাথে সাথে কবুল হয়ে যেত। আমালেক্বাদের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে সে অবশেষে মূসার বিরুদ্ধে দো‘আ করল। কিন্তু তার জিহবা দিয়ে উল্টা দো‘আ বের হতে লাগল যা আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যেতে লাগল। তখন সে দো‘আ বন্ধ করল। কিন্তু অন্য এক পৈশাচিক রাস্তা সে তাদের বাৎলে দিল। সে বলল, বনু ইসরাঈলগণের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে দিতে পারলে আল্লাহ তাদের উপরে নারায হবেন এবং তাতে মূসার অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে’। আমালেক্বারা তার পরামর্শ গ্রহণ করল এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে বনু ইসরঈলের নেতাদের সেবাদাসী হিসাবে অতি গোপনে পাঠিয়ে দিল। বড় একজন নেতা এফাঁদে পা দিল। আস্তে আস্তে তা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হল। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এল। বনু ইস্রাঈলীদের মধ্যে প্লেগ মহামারী দেখা দিল। কথিত আছে যে, একদিনেই সত্তর হাজার লোক মারা গেল। এ ঘটনায় বাকী সবাই তওবা করল এবং প্রথম পথভ্রষ্ট নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হল। অতঃপর আল্লাহর গযব উঠে গেল। সম্ভবতঃ সম্প্রদায়ের নেতাদের ক্রমাগত অবাধ্যতা, শঠতা ও পাপাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এবং একসাথে এই বিরাট জনশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় মূসা আ. বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।
তীহ্ প্রান্তরের ঘটনাবলী :
নবীর সঙ্গে যে বেআদবী তারা করেছিল, তাতে আল্লাহর গযবে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক হয়ত এ জাতিকে আরও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহপুষ্ট একটি জাতি নিজেদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতার ফলে কিভাবে আল্লাহর অভিসম্পাৎগ্রস্ত হয় এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার শিকার হয়, পৃথিবীর মানুষের নিকটে দৃষ্টান্ত হিসাবে তা পেশ করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেভাবে দৃষ্টান্ত হয়েছে ফেরাউন একজন অবাধ্য ও অহংকারী নরপতি হিসাবে। আর তাই বনী ইসরঈলের পরীক্ষার মেয়াদ আরও বর্ধিত হল। নিম্নে তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কিছু নিদর্শন বর্ণিত হল।-
১. মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান
ছায়াশূন্য তপ্ত বালুকা বিস্তৃত মরুভূমিতে কাঠফাটা রোদে সবচেয়ে প্রয়োজন যেসব বস্ত্তর, তন্মধ্যে ‘ছায়া’ হল সর্বপ্রধান। হঠকারী উম্মতের অবাধ্যতায় ত্যক্ত-বিরক্ত মূসা আ. দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহর নিকটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। দয়ালু আল্লাহ তাঁর দো‘আ সমূহ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর বিশেষ রহমত সমূহ নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে একটি হল উন্মুক্ত তীহ্ প্রান্তরের উপরে শামিয়ানা সদৃশ মেঘমালার মাধ্যমে শান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করা। যেমন আল্লাহ এই অকৃতজ্ঞ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘স্মরণ কর সে কথা, যখন আমরা তোমাদেরকে ছায়া দান করেছিলাম মেঘমালার মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৭)।
২. ঝর্ণাধারার প্রবাহ
ছায়ার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ত হল পানি। যার অপর নাম জীবন। পানি বিহনে তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত উম্মতের আহাজারিতে দয়া বিগলিত নবী মূসা আ. স্বীয় প্রভুর নিকটে কাতর কণ্ঠে পানি প্রার্থনা করলেন। কুরআনের ভাষায়, ‘আর মূসা যখন স্বীয় জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরের উপরে আঘাত কর। অতঃপর তা থেকে বেরিয়ে এলো (১২টি গোত্রের জন্য) ১২টি ঝর্ণাধারা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল (অর্থাৎ মূসার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে নিল) নিজ নিজ ঘাট। (আমি বললাম,) তোমরা আল্লাহর দেওয়া রিযিক খাও আর পান কর। খবরদার যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬০)।
৩. মান্না ও সালওয়া খাদ্য পরিবেশন
মরুভূমির বুকে চাষবাসের সুযোগ নেই। নেই শস্য উৎপাদন ও বাইরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। কয়েকদিনের মধ্যেই মওজুদ খাদ্য শেষ হয়ে গেলে হাহাকার পড়ে গেল তাদের মধ্যে। নবী মূসা আ. ফের দো‘আ করলেন আল্লাহর কাছে। এবার তাদের জন্য আসমান থেকে নেমে এলো জান্নাতী খাদ্য ‘মান্না ও সালওয়া’- যা পৃথিবীর আর কোন নবীর উম্মতের ভাগ্যে জুটেছে বলে জানা যায় না।
‘মান্না’ এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা বনু ইসরাঈলদের জন্য আসমান থেকে অবতীর্ণ করতেন। আর তা ছিল দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর ‘সালওয়া’ হচ্ছে আসমান থেকে আগত এক প্রকার পাখি।প্রথমটি দিয়ে রুটি ও দ্বিতীয়টি দিয়ে গোশতের অভাব মিটত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘কামআহ হল মান্ন-এর অন্তর্ভুক্ত’। এতে বুঝা যায় ‘মান্ন’ কয়েক প্রকারের ছিল। ইংরেজীতে ‘কামআহ অর্থ করা হয়েছে ‘মাশরূম’ (Mashroom)। আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মান্ন একপ্রকার আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার করা যায়। ‘সালওয়া’ একপ্রকার চড়ুই পাখি, যা ঐসময় সিনাই এলাকায় প্রচুর পাওয়া যেত। ব্যাঙের ছাতার মত সহজলভ্য ও কাই জাতীয় হওয়ায় সম্ভবত একে মাশরূম-এর সাথে তুলনীয় মনে করা হয়েছে। তবে মাশরূম ও ব্যাঙের ছাতা সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস। কয়েক লাখ বনু ইসরাঈল কয়েক বছর ধরে মান্না ও সালওয়া খেয়ে বেঁচে ছিল। এতে বুঝা যায় যে, মান্ন ছিল চাউল বা গমের মত কার্বো-হাইড্রেট-এর উৎস এবং সালওয়া বা চড়ুই জাতীয় পাখির গোশত ছিল ভিটামিন ও চর্বির উৎস। সব মিলে তারা পরিপূর্ণ খাবার নিয়মিত খেয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়। অবাধ্য বনু ইসরাঈলরা এগুলো সিরিয়ার তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দী জীবনে বিপুলভাবে পেয়েছিল আল্লাহর বিশেষ রহমতে। ঈসার সাথী হাওয়ারীগণ এটা চেয়েছিল (মায়েদাহ, আয়াত ১১২-১১৫)। কিন্তু পেয়েছিল কি-না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
দুনিয়ায় বসেই জান্নাতের খাবার, এ এক অকল্পনীয় অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই হতভাগারা তাতেও খুব বেশীদিন খুশী থাকতে পারেনি। তারা গম, তরকারি, ডাল-পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘… আমরা তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’। (আমরা বললাম) এসব পবিত্র বস্ত্ত তোমরা ভক্ষণ কর (কিন্তু ওরা শুনল না, কিছু দিনের মধ্যেই তা বাদ দেওয়ার জন্য ও অন্যান্য নিম্নমানের খাদ্য খাবার জন্য জিদ ধরলো)। বস্ত্ততঃ (এর ফলে) তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৭)।
আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যখন তোমরা বললে, হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাদ্যের উপরে কখনোই ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। কাজেই তুমি তোমার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্য-শস্য দান করেন, যা জমিতে উৎপন্ন হয়; যেমন তরি-তরকারি, কাকুড়, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। মূসা আ. বললেন, তোমরা উত্তম খাদ্যের বদলে এমন খাদ্য পেতে চাও যা নিম্নস্তরের? তাহলে তোমরা অন্য কোন শহরে চলে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পাবে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬১)।
তাওরাতের শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন
ইহুদীরা তাদের এলাহী কিতাব তাওরাতের শাব্দিক পরিবর্তন নবী মূসা আ.-এর জীবদ্দশায় যেমন করেছিল, অর্থগত পরিবর্তনও তারা করেছিল। যেমন হযরত মূসা আ. যখন তাদের ৭০ জন নেতাকে সাথে নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহর গযবে মৃত্যুবরণ করে পুনরায় তাঁর রহমতে জীবিত হয়ে ফিরে এল, তখনও এই গর্বিত জাতি তাওরাত যে আল্লাহর নাযিলকৃত গ্রন্থ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সাথে সাথে একথাও জুড়ে দিল যে, আল্লাহ তা‘আলা সবশেষে একথাও বলেছেন যে, তোমরা যতটুকু পার, আমল কর। আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দিব’। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। তাদের এই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে লোকেরা বলে দিল যে, তওরাতের বিধান সমূহ মেনে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তখনই আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ তূর পাহাড়ের একাংশ উপরে তুলে ধরে তাদের হুকুম দিলেন, হয় তোমরা তাওরাত মেনে নাও, না হয় ধ্বংস হও। তখন নিরুপায় হয়ে তারা তাওরাত মেনে নেয়। মূসা আ.-এর মৃত্যুর পরেও তাওরাত, যবূর ও ইঞ্জীল গ্রন্থগুলিতে তারা অসংখ্য শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে এই কিতাবগুলি আসল রূপে কোথাও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। ইহুদীদের তাওরাত পরিবর্তনের ধরন ছিল তিনটি। এক. অর্থ ও মর্মগত পরিবর্তন, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। দুই. শব্দগত পরিবর্তন যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ইহুদীদের মধ্যে একটা দল আছে, যারা আল্লাহর কালামকে (যেখানে শেষনবীর আগমন সংবাদ ও তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে) তার স্বস্থান হতে পরিবর্তন করে দেয়’ (নিসা, আয়াত ৪৬ ; মায়েদাহ, আয়াত ১৩, ৪১)। এই পরিবর্তন তারা নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থে শাব্দিকভাবে এবং মর্মগতভাবে উভয়বিধ প্রকারে করত। ‘এভাবে তারা কখনো শব্দে, কখনো অর্থে এবং কখনো তেলাওয়াতে (মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে) পরিবর্তন করত। পরিবর্তনের এ প্রকারগুলি কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক খ্রীষ্টানও একথা কিছু কিছু স্বীকার করে’। আল্লাহর কিতাবের এইসব পরিবর্তন তাদের মধ্যকার আলেম ও যাজক শ্রেণীর লোকেরাই করত, সাধারণ মানুষ যাদেরকে অন্ধ ভক্তির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস ঐসব লোকদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে বলত, এটি আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে- যাতে এর বিনিময়ে তারা সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৭৯)।
আল্লাহ বলেন, ‘এইসব লোকেরা মিথ্যা কথা শোনাতে এবং হারাম ভক্ষণে অভ্যস্ত’ (মায়েদাহ, আয়াত ৪২)। জনগণ তাদের কথাকেই সত্য ভাবত এবং এর বিপরীত কিছুই তারা শুনতে চাইত না। এভাবে তারা জনগণের রব-এর আসন দখল করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে’ (তওবাহ, আয়াত ৩১)।
হযরত মূসা আ. ও খিযির আ. এর কাহিনী
এ ঘটনাটি বনু ইসরঈলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে মূসা আ.-এর সঙ্গে জড়িত। পিতা ইব্রাহিম আ. সহ বড় বড় নবী-রাসূলগণের জীবনে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মূসা আ.-এর জীবনে এটাও ছিল অনুরূপ একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে। আনুষঙ্গিক বিবরণ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত বন্দীশালায় থাকাকালীন সময়ে ঘটেছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ: সহিহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত উবাই বিন কা‘ব রা. প্রমুখ রাসূলুল্লাহ সা. হতে বর্ণিত হাদিস হতে এবং সূরা কাহফ ৬০ হতে ৮২ পর্যন্ত ২৩টি আয়াতে বর্ণিত বিবরণ থেকে যা জানা যায়, তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নে বিবৃত হল।-
ঘটনার প্রেক্ষাপট
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, একদিন হযরত মূসা আ. বনু ইসরঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? ঐ সময়ে যেহেতু মূসা আ. ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর চাইতে অধিক জ্ঞানী ছিলেন না, তাই তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পছন্দ হয়নি। কেননা এতে কিছুটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’। আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা শুনে মূসা আ. প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারি’। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের (সম্ভবতঃ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থল) দিকে সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে’। মূসা আ. স্বীয় ভাগিনা ও শিষ্য (এবং পরবর্তীকালে নবী) ইউশা‘ বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের ঢেউয়ের ছিটা মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও থলে থেকে বেরিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। ইউশা‘ ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু মূসা আ. ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে গেলেন। অতঃপর তারা আবার পথ চলতে শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন। অতঃপর মূসা আ. নাশতা দিতে বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ওযর পেশ করে আনুপূর্বিক সব ঘটনা মূসা আ.-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (কাহফ, ৬৩)। তখন মূসা আ. বললেন, ঐ স্থানটিই তো ছিল আমাদের গন্তব্য স্থল। ফলে তাঁরা আবার সেপথে ফিরে চললেন। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, একজন লোক আপাদ-মস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মূসা আ. তাকে সালাম করলেন। লোকটি মুখ বের করে বললেন, এদেশে সালাম? কে আপনি? বললেন, আমি বনু ইসরঈলের মূসা। আপনার কাছ থেকে ঐ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে দান করেছেন’। খিযির আ. বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না হে মূসা! আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি আপনাকে দেননি। পক্ষান্তরে আপনাকে তিনি যে জ্ঞান দান করেছেন, তা আমাকে দেননি’। মূসা আ. বললেন, ‘আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করব না’ (কাহফ, ৬৯)। খিযির আ. বললেন, ‘যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি’।
১. অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য একটা নৌকা পেলেন। অতঃপর নৌকা থেকে নামার সময় তাতে ছিদ্র করে দিলেন। শারঈ বিধানের অধিকারী নবী মূসা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারলেন না। কেননা বিনা দোষে অন্যের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া স্পষ্টভাবেই অন্যায়। তিনি বলেই ফেললেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি একটা গুরুতর মন্দ কাজ করলেন’। তখন খিযির আ. বললেন, আমি কি পূর্বেই বলিনি যে, ‘আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আ. ক্ষমা চাইলেন। ইতিমধ্যে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে খিযির আ. মূসা আ.-কে বললেন, ‘আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফোঁটা পানির সমতুল্য’।
২. তারপর তাঁরা সমুদ্রের তীর বেয়ে চলতে থাকলেন। কিছু দূর গিয়ে তাঁরা সাগরপাড়ে খেলায় রত একদল বালককে দেখলেন। খিযির আ. তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে তাকে হত্যা করলেন। এ দৃশ্য দেখে মূসা আ. আৎকে উঠে বললেন, একি! একটা নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা করলেন? এ যে মস্তবড় গোনাহের কাজ’। খিযির আ. বললেন, আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আ. আবার ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন, ‘এরপর যদি আমি কোন প্রশ্ন করি, তাহলে আপনি আমাকে আর সাথে রাখবেন না’ (কাহফ, ৭৫)।
৩. ‘অতঃপর তারা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি জনপদে পৌঁছলেন, তখন তাদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেয়ে সেটাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তখন মূসা আ. বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন’। খিযির আ. বললেন ‘এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হল। এখন যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, আমি সেগুলির তাৎপর্য বলে দিচ্ছি’ (কাহফ, আয়াত ৭৮)।
তাৎপর্য সমূহ :
প্রথমতঃ নৌকা ছিদ্র করার বিষয়। সেটা ছিল কয়েকজন মিসকীন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা এ দিয়ে সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি সেটিকে ছিদ্র করে দিলাম এজন্য যে, ঐ অঞ্চলে ছিল এক যালেম বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে লোকদের নৌকা ছিনিয়ে নিত’। নিশ্চয়ই ছিদ্র নৌকা সে নিবে না। ফলে দরিদ্র লোকগুলি নৌকার সামান্য ত্রুটি সেরে নিয়ে পরে তাদের কাজে লাগাতে পারবে।
দ্বিতীয়তঃ বালকটিকে হত্যার ব্যাপার। তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্য হবে ও কাফের হবে। যা তার বাপ-মায়ের জন্য ফিৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমি চাইলাম যে, দয়ালু আল্লাহ তার পিতা-মাতাকে এর বদলে উত্তম সন্তান দান করুন, যে হবে সৎকর্মশীল ও বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী। যে তার পিতা-মাতাকে শান্তি দান করবে’।
তৃতীয়তঃ পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দেওয়ার ব্যাপার। উক্ত প্রাচীরের মালিক ছিল নগরীর দু’জন পিতৃহীন বালক। ঐ প্রাচীরের নীচে তাদের নেককার পিতার রক্ষিত গুপ্তধন ছিল। আল্লাহ চাইলেন যে, বালক দু’টি যুবক হওয়া পর্যন্ত প্রাচীরটি খাড়া থাক এবং তারা তাদের প্রাপ্য গুপ্তধন হস্তগত করুক। (খিযির বলেন,) ‘বস্ত্ততঃ আমি নিজ ইচ্ছায় এ সবের কিছুই করিনি’ (কাহফ, আয়াত ৮২)।
হযরত খিযির আ. কে ছিলেন?
কুরআনে তাঁকে ‘আমাদের বান্দাদের একজন’ (কাহফ, আয়াত ৬৫) বলা হয়েছে। বুখারী শরীফে তাঁর নাম খিযির আ. বলে উল্লেখ করা হয়েছে’। সেখানে তাঁকে নবী বলা হয়নি। জনশ্রুতি মতে তিনি একজন ওলী ছিলেন এবং মৃত্যু হয়ে গেলেও এখনও মানুষের বেশ ধরে যেকোন সময় যেকোন মানুষের উপকার করেন। ফলে জঙ্গলে ও সাগর বক্ষে বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য আজও অনেকে খিযির আ. এর অসীলা পাবার জন্য তার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল কুরআনে হযরত মুসা আ. কে অনেক বড় মর্যাদাবান নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলী। আল কুরআনে হযরত মুসা আ. এর নাম যতবেশী উল্লেখ করা হয়েছে আর কোন নবীর নাম এতো বেশী উল্লাখ করা হয়নি। আল কুরআনে হযরত মুসা আ. এর নাম উল্লেখ হয়েছে ১৩৬ বার। হযরত মুসার সংগ্রামী জীবন বিস্তারিত জানা যাবে নিম্নোক্ত সুরাগুলো পড়লে – আল বাকারাঃ ৪০-১০২ আয়াত। আল আরাফঃ ১০৩-১৭১ আয়াত। ইউনুসঃ ৭৫-৯৩ আয়াত। আল কাহাফঃ ৬০-৮২ আয়াত। তোয়াহাঃ ৯-৯৮ আয়াত। শোয়ারা” ১০-৬৭ আয়াত। আল কাসাসঃ ৩-৪৭ আয়াত এবং ৭৬-৮৪ আয়াত। আল মুমিন/গাফিরঃ ২৩-৫৪ আয়াত।
।
হযরত হারুন আ.
পরিচয়
হযরত মুসা আ. এর বড় ভাই হযরত হারুন আ.।তিনি মুসা আ. এর চেয়ে তিন বছরের বড় । আল্লাহ যখন মুসা আ. কে রাসূল নিয়োগ করেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন তিনি যেন তাঁর ভাই হারুনকেও রাসূল নিয়োগ করে তাঁর হাত শক্ত করেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং হারুন আ.কে মুসা আ. এর সহযোগী রাসূল নিয়োগ করেন। হযরত হারুন ছিলেন বনী ইসরাইলদের শ্রেষ্ঠ রাসূলগনের একজন। তিনি ছিলেন সুবক্তা।
আল্লাহর বাণী প্রচার
মহান আল্লাহ বলেন, “আমি মূসা ও হারুনের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। তাঁদের উভয়কে আমি উদ্ধার করেছি মহাকষ্ট থেকে। আমি তাঁদের সাহায্য করেছি। ফলে তারা বিজয়ী হয়েছে। তাঁদের আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। তাঁদের উভয়কে আমি সুস্পষ্ট কিতাব দান করেছি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের উভয়ের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছি। মুসা ও হারুনের প্রতি বর্ষিত হোক সালাম। এভাবেই আমি উপকারী লোকদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। আসলে ওরা দু’জনেই ছিলো আমার প্রতি বিশ্বস্ত দাস।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১৪-১২২)
আল্লাহর এ বাণী থেকে হযরত হারুন আ. এর সঠিক মর্যাদা বুঝা যায়। তিনি ভাই মুসার সাথে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। ফেরাউনকে দাওয়াত প্রদান করেন। ফেরাউন তাঁদের দুজনকেই মিথ্যাবাদী বলে অস্বীকার করে। সে বলে, এরা দুই ভাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার জন্যে এসেছে। অতঃপর ফেরাউন হযরত মুসা ও হারুন দুজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। অতপর মুসা ও হারুনের সাথে ফেরাউনের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়, তাঁর পরিণতিতে আল্লাহ ফেরাউনকে ধংস ও নির্মূল করে দেন। ফেরাউন ডুবে মরার পর সিনাই উপত্যকায় থাকাকালে হযরত মুসা আ. হযরত হারুনকে নিজের খলিফা বা ভারপ্রাপ্ত নেতা মনোনীত করে চল্লিশ দিনের জন্যে তূর পাহাড়ে নির্জনবাসে যান। হযরত হারুন আ. ভারপ্রাপ্ত নেতা থাকাকালেই সামেরি গো-বাছুর বানিয়ে সেটার পূজা করতে বলে সকলকে। হারুন তাঁকে বারণ করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতি দ্বিধাবিভক্ত হবার উপক্রম হয়ে পড়ায় তিনি সেই পদক্ষেপ নেননি। হযরত মুসা আ. চল্লিশ দিন পর তাওরাত নিয়ে ফেরত এসে হযরত হারুনের উপর ক্রোধান্বিত হন। এ ঘটনাটি কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে –
“(গো-বাছুর পুজা করতে নিষেধ করে) হারুন আ. তাঁদের বলেছিলো, হে আমার জাতি তোমরা তো পরীক্ষায় পড়েছো। তোমাদের প্রভু বড় করুণাময়। কাজেই তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার নির্দেশ মান। কিন্তু তারা তাঁকে বলে দিলো মুসা আ. ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা করবো। মুসা আ. ফিরে এসে বলল- হে হারুন তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন এদেরকে আমার অনুসরণের পথে আনতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে? তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করলে? হারুন বলল- হে আমার সহোদর ভাই, আমার দাড়ি ও চুল ধরে টেনো না। আমার ভয় হচ্ছিলো তুমি এসে বলবে- হারুন তুমি কেন বনী ইসরাইলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলে? কেন আমার কথা রক্ষা করোনি।” (সূরা তোয়াহা, আয়াত ৯০-৯৪)
অন্যস্থানে বলা হয়েছে, “মুসা নিজের ভাইয়ের চুল ধরে টানলো। হারু বললো – হে আমার সহোদর, এই লোকগুলো আমায় কোণঠাসা করে ফেলেছিলো এবং আমাকে হত্যা করার জন্যে উদ্যত হয়েছিলো। কাজেই তুমি শত্রুদের কাছে আমায় হেয় করো না এবং আমাকে জালিম গণ্য করো না। তখন মুসা দোয়া করলো – হে প্রভু, আমাকে আর আমার ভাইকে ক্ষমা করে দাও। আর আমাদেরকে প্রবেশ করাও তোমার অনুগ্রহের মধ্যে। তুমিই তো সব দয়াবানের বড় দয়াবান।” (সূরা আল আরাফ, আয়াত ১৫০-১৫১)
এ থেকে বুঝা যায়, হযরত হারুন জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নিজ কওমকে সত্য পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে জাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হোক এটা তিনি চাননি। আসলে তিনি ছিলেন বড়ই প্রজ্ঞাবান ও মহান রাসূল।
হযরত মুসা আ. এর মৃত্যুর এগারো মাস পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাই মুসার মতই তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সংগ্রামী পুরুষ। তারা দুই ভাই নেতৃত্ব প্রদান করেন এক বিশাল জাতির।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল কুরআনে হযরত হারুনের নাম ২০ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব স্থানে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো – আল বাকারা- ২৪৮। আন নিসা- ১৬৩। আল আনয়াম- ৮৪। আল আরাফ- ১২২, ১৪২। ইউনুস- ৭৫। মারিয়াম- ২৮, ৫৩। তোয়াহা- ৩০, ৭০, ৯০, ৯২। আল আম্বিয়া- ৪৮। আল মুমিনুন- ৪৫। আলফুরকান – ৩৫। আশ শুয়ারা- ১৩, ৪৮। আল কাসাস- ৩৪। আস সাফফাত- ১১৪, ১২০।
।
হযরত দাউদ আ.
মহান আল্লাহ হযরত দাউদ আ. কে দান করেছিলেন বিরাট মর্যাদা। তাঁকে অধিকারী করেছিলেন অনেক গুণাবলীর। তিনি ছিলেন একাধারে-
১. বিরাট উচ্চ মর্যাদার নবী।
২. তাঁর উপর নাযিল হয়েছিলো ‘যবুর’ কিতাব।
৩. তিনি ছিলেন অসীম সাহসী বীর সেনানী।
৪. তিনি ছিলেন এক বিরাট সাম্রাজ্যের সম্রাট।
৫. তিনি ছিলে একজন সফল বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক।
৬. ছিলেন মহাজ্ঞানী, ন্যায় বিচারক।
৭. তিনি ছিলেন মুমিনদের নেতা।
৮. ছিলেন আল্লাহর আইনের শাসক।
৯. তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় সুবক্তা ও সুভাষী।
১০. পাখি ও পর্বত তাঁর সাথে আল্লাহর তসবিহতে মশগুল থাকতো।
১১. তিনি ছিলেন পরম জনদরদী, জনসেবক।
১২. মহান আল্লাহ প্রাকৃতিক জগতের অনেক কিছুকেই তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন।
১৩. তিনি ছিলে পরম আল্লাহভীরু, আল্লাহওয়ালা।
১৪. তিনি ছিলে একজন নবীর পিতা। তাঁর পুত্র সুলাইমানকেও আল্লাহ নবুয়ত দান করেছিলেন।
১৫. আল কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।
বিশেষ মর্যাদার অধিকারী
বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ছিলেন মাত্র দু’জন। তাঁরা হলেন পিতা ও পুত্র হযরত দাউদ আ. ও হযরত সুলায়মান আ.। বর্তমান ফিলিস্তীন সহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। সে কারণে আল্লাহ তার শেষ নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তারা যেসব কথা বলে তাতে তুমি সবর কর এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদকে স্মরণ কর। সে ছিল আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৮)। হযরত দাউদ আ. হলেন আল্লাহর একমাত্র বান্দা, যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করেছিলেন এবং সেমতে হযরত দাউদ আ. এর বয়স ৬০ হতে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়।
জালূত ও তালূতের কাহিনী এবং হযরত দাউদ আ. এর বীরত্ব
সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে হযরত মূসা আ. ও হযরত হারূণ আ. যখন বনু ইসরাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৩)। কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদা, আয়াত ২৪)। এতবড় বেআদবীর পরে মূসা আ. তাদের ব্যাপারে নিরাশ হলেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দু’ভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।
জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে অতিবাহিত করার পর হযরত মূসা আ. এর শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের চাপিয়ে দেন। বনু ইসরাঈলরা আবার নিগৃহীত হতে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে যায়। এক সময় শ্যামুয়েল নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-‘তুমি কি মূসার পরে বনু ইসরাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হতে ! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হল তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ জালেমদের ভাল করেই জানেন’ (বাক্বারাহ -২৪৬)। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-
‘‘তাদের নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। জবাবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হলেন প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হতে তোমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ। এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ, আয়াত, ২৪৭-২৪৮)। এক্ষণে যখন বনু ইসরাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন। সিন্দুকটি তালূতের বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ঠ হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইসরাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।
সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হলে তিনি কথিত মতে ৮০ হাজার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাউদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ: ‘অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হতে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক আজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হতেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৪৯)।
বস্ত্ততঃ নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত সাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাজারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্ত্তবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন হযরত দাউদ আ.। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫০)। জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাউদ আ. নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন। তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হলেন না। কিন্তু দাউদ আ. নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাউদ আ. ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাউদ আ. পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাউদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাউদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫১)।
হযরত দাউদ আ.-এর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী
১. ছাগপাল ও শস্যক্ষেতের মালিকের বিচার
একদা দু’জন লোক হযরত দাউদ আ. এর নিকটে একটি বিষয়ে মীমাংসার জন্য আসে। তাদের একজন ছিল ছাগপালের মালিক এবং অন্যজন ছিল শস্য ক্ষেতের মালিক। শস্যক্ষেতের মালিক ছাগপালের মালিকের নিকট দাবী পেশ করল যে, তার ছাগপাল রাত্রিকালে আমার শস্যক্ষেতে চড়াও হয়ে সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। সম্ভবতঃ শস্যের মূল্য ও ছাগলের মূল্যের হিসাব সমান বিবেচনা করে হযরত দাউদ আ. শস্যক্ষেতের মালিককে তার বিনষ্ট ফসলের বিনিময় মূল্য হিসাবে পুরা ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে দিয়ে দিতে বললেন। বাদী ও বিবাদী উভয়ে বাদশাহ দাউদ আ. এর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার মুখে পুত্র সুলায়মানের সাথে দেখা হয়। তিনি মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সব খুলে বলল। তিনি পিতা দাউদ আ. এর কাছে গিয়ে বললেন, আমি রায় দিলে তা ভিন্নরূপ হত এবং উভয়ের জন্য কল্যাণকর হত’। অতঃপর পিতার নির্দেশে তিনি বললেন, ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে সাময়িকভাবে দিয়ে দেওয়া হউক। সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দ্বারা উপকার লাভ করুক। পক্ষান্তরে শস্যক্ষেতটি ছাগপালের মালিককে অর্পণ করা হউক। সে তাতে শস্য উৎপাদন করুক। অতঃপর শস্যক্ষেত্র যখন ছাগপালে বিনষ্ট করার পূর্বের অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন তা ক্ষেতের মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং ছাগপাল তার মালিককে ফেরৎ দেওয়া হবে’। হযরত দাউদ আ. রায়টি অধিক উত্তম গণ্য করে সেটাকেই কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ কর দাউদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করেছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফয়সালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।
২. ইবাদত খানায় প্রবেশকারী বাদী–বিবাদীর বিচার
হযরত দাউদ আ. যেকোন ঘটনায় যদি বুঝতেন যে, এটি আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষা, তাহলে তিনি সাথে সাথে আল্লাহর দিকে রুজু হতেন ও ক্ষমা প্রার্থনায় রত হতেন। এরই একটি উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতগুলিতে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আপনার কাছে কি সেই বাদী-বিবাদীর খবর পৌঁছেছে, যখন তারা পাঁচিল টপকিয়ে দাউদ আ. এর ইবাদতখানায় ঢুকে পড়েছিল’? (ছোয়াদ ২১) ‘যখন তারা দাউদ আ. এর কাছে অনুপ্রবেশ করল এবং দাউদ তাদের থেকে ভীত হয়ে পড়ল, তখন তারা বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা দু’জন বিবদমান পক্ষ। আমরা একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছি। অতএব আমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করুন, অবিচার করবেন না। আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’। ‘(বিষয়টি এই যে,) সে আমার ভাই। সে ৯৯টি দুম্বার মালিক আর আমি মাত্র একটি মাদী দুম্বার মালিক। এরপরও সে বলে যে, এটি আমাকে দিয়ে দাও। সে আমার উপরে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করে’। ‘দাউদ বলল, সে তোমার দুম্বাটিকে নিজের দুম্বাগুলির সাথে যুক্ত করার দাবী করে তোমার প্রতি অবিচার করেছে। শরীকদের অনেকে একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করে থাকে, কেবল তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। অবশ্য এরূপ লোকের সংখ্যা কম। (অত্র ঘটনায়) দাউদ ধারণা করল যে, আমরা তাকে পরীক্ষা করছি। অতঃপর সে তার পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়ল ও আমার দিকে প্রণত হল’। অতঃপর আমরা তাকে ক্ষমা করে দিলাম। নিশ্চয়ই তার জন্য আমাদের নিকটে রয়েছে নৈকট্য ও সুন্দর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (ছোয়াদ, আয়াত ২১-২৫)।
৩. শনিবার ওয়ালাদের পরিণতি
বনু ইসরাঈলদের জন্য শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট ও পবিত্র দিন। এ দিন তাদের জন্য মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকূলের বাসিন্দা ছিল এবং মৎস্য শিকার ছিল তাদের পেশা। ফলে দাউদ আ.-এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা ঐদিন মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ হতে আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তি নেমে আসে এবং তিনদিনের মধ্যেই তারা সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। ঘটনাটি পবিত্র কুরআনে নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ মদীনার ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আর তোমরা তো তাদেরকে ভালভাবে জানো, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছিল। আমরা তাদের বলেছিলাম, তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’। ‘অতঃপর আমরা এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ হিসাবে রেখে দিলাম’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৫-৬৬)।
উক্ত বিষয়ে সূরা আ‘রাফের ১৬৪-৬৫ আয়াতের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে তৃতীয় আরেকটি দল ছিল, যারা উপদেশ দানকারীদের উপদেশ দানে বিরত রাখার চেষ্টা করত। বাহ্যতঃ এরা ছিল শান্তিবাদী এবং অলস ও সুবিধাবাদী। এরাও ফাসেকদের সাথে শূকর-বানরে পরিণত হয় ও ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘আর যখন তাদের মধ্যকার একদল বলল, কেন আপনারা ঐ লোকদের উপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা তাদের আযাব দিতে চান কঠিন আযাব? ঈমানদারগণ বলল, তোমাদের পালনকর্তার নিকট ওযর পেশ করার জন্য এবং এজন্য যাতে ওরা সতর্ক হয়’। ‘অতঃপর তারা যখন উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা সেসব লোকদের মুক্তি দিলাম, যারা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করত এবং পাকড়াও করলাম জালেমদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের পাপাচারের কারণে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৬৪-৬৫)।
তালূতের পরে বনু ইসরাঈলগণের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। যালেম বাদশাহদের দ্বারা তারা শাম দেশ হতে বিতাড়িত হয়। বিশেষ করে পারস্যরাজ বুখতানছর যখন তাদেরকে শাম থেকে বহিষ্কার করলেন, তখন তাদের একদল হেজাযে গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিল। এই উদ্দেশ্যে যে, আমরা দাউদ ও সুলায়মানের নির্মিত বায়তুল মুক্বাদ্দাস হারিয়েছি। ফলে এক্ষণে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম-ইসমাঈলের নির্মিত কা‘বা গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। যাতে আমরা বা আমাদের বংশধররা শেষনবীর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়। সেমতে তারা আরবে হিজরত করে এবং ইয়াছরিবে বসবাস শুরু করে।
হযরত দাউদ আ.-এর জীবনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
১. নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান ও আমানতদার হওয়া। আরও প্রয়োজন প্রজ্ঞা, ন্যায়নিষ্ঠা ও উন্নতমানের বাগ্মিতা। যার সব কয়টি গুণ হযরত দাউদ আ.-এর মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণে ছিল।
২. এলাহী বিধান দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিকেই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। বরং দ্বীনদার শাসকের হাতেই দুনিয়া শান্তিময় ও নিরাপদ থাকে। হযরত দাউদ-এর শাসনকাল তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।
৩. দ্বীনদার শাসককে আল্লাহ বারবার পরীক্ষা করেন। যাতে তার দ্বীনদারী অক্ষুণ্ণ থাকে। হযরত দাউদ আ. সে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন। বস্ত্ততঃ তিনি ছিলেন আল্লাহর দিকে সদা প্রত্যাবর্তনশীল।
৪. যে শাসক যত বেশী আল্লাহর শুকরগুযারী করেন, আল্লাহ তার প্রতি তত বেশী সদয় হন এবং ঐ রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি নাযিল করেন। বস্ত্ততঃ দাউদ আ. সর্বাধিক ইবাদতগুযার ছিলেন এবং একদিন অন্তর একদিন সিয়াম পালন করতেন।
৫. যে শাসক আল্লাহর প্রতি অনুগত হন, আল্লাহ দুনিয়ার সকল সৃষ্টিকে তার প্রতি অনুগত করে দেন। যেমন দাউদ আ.-এর জন্য পাহাড়-পর্বত, পক্ষীকুল এবং লোহাকে অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল কুরআনে হযরত দাউদ আ. এর নাম উল্লেখ হয়েছে ১৬ বার। কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে তা আপনাদের বলে দিচ্ছি – সূরা আল বাকারা ; ২৫১। আন নিসা ; ২৬৩। আল মায়িদা ; ৭৮। আল আনয়াম ; ৮৪। বনি ইসরাইল ; ৫৫। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯। আন নামল ; ১৫, ১৬। সাবা ; ১০, ১৩। সোয়াদ ; ১৭, ২২, ২৪, ২৬, ৩০।
।
হযরত সুলাইমান আ.
হযরত দাউদ আ.-এর ইন্তেকালের পর সুযোগ্য পুত্র হযরত সুলায়মান আ. তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আবির্ভাবের ন্যূনাধিক দেড় হাজার বছর পূর্বে তিনি নবী হন। হযরত সুলায়মান আ. ছিলেন পিতার ১৯জন পুত্রের অন্যতম। আল্লাহ পাক তাকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নবুয়তের সম্পদে সমৃদ্ধ করেন। এছাড়াও তাঁকে এমন কিছু নেয়ামত দান করেন, যা অন্য কোন নবীকে দান করেননি। হযরত সুলায়মান আ.-এর মোট বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তের বছর বয়সে রাজকার্য হাতে নেন এবং শাসনের চতুর্থ বছরে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তিনি ৪০ বছর রাজত্ব করেন। তবে তিনি কত বছর বয়সে নবী হয়েছিলেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। শাম ও ইরাক অঞ্চলে পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের তিনি বাদশাহ ছিলেন। তাঁর রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিল। কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ৭টি সূরায় ৫১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
বাল্যকালে হযরত সুলায়মান আ.
১. আল্লাহ পাক হযরত সুলায়মান আ.কে বাল্যকালেই গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দান করেছিলেন। ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যে পিতা হযরত দাউদ আ. যেভাবে বিরোধ মীমাংসা করেছিলেন, বালক সুলায়মান তার চাইতে উত্তম ফায়সালা পেশ করেছিলেন। ফলে হযরত দাউদ আ. নিজের পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্রের দেওয়া প্রস্তাব গ্রহণ করেন ও সে মোতাবেক রায় দান করেন। উক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘‘আর স্মরণ কর দাউদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।
ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ভূষিত হযরত সুলায়মান আ.কে পরবর্তীতে যথার্থভাবেই পিতার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাউদ আ. এর উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন’ (নমল, আয়াত ১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা দাউদ আ. এর জন্য সুলায়মানকে দান ‘করেছিলাম। কতই না সুন্দর বান্দা সে এবং সে ছিল (আমার প্রতি) সদা প্রত্যাবর্তনশীল’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩০)।
২. আরেকটি ঘটনা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যা নিম্নরূপ: ‘দু’জন মহিলার দু’টি বাচ্চা ছিল। একদিন নেকড়ে বাঘ এসে একটি বাচ্চাকে নিয়ে যায়। তখন প্রত্যেকে বলল যে, তোমার বাচ্চা নিয়ে গেছে। যেটি আছে ওটি আমার বাচ্চা। বিষয়টি ফায়সালার জন্য দুই মহিলা খলীফা দাউদ আ. এর কাছে এলো। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন। তখন তারা বেরিয়ে সুলায়মানের কাছে এলো এবং সবকথা খুলে বলল। সুলায়মান তখন একটি ছুরি আনতে বললেন এবং বাচ্চাটাকে দু’টুকরা করে দু’মহিলাকে দিতে চাইলেন। তখন বয়োকনিষ্ঠ মহিলাটি বলল, ইয়ারহামুকাল্লাহু ‘আল্লাহ আপনাকে অনুগ্রহ করুন’ বাচ্চাটি ঐ মহিলার। তখন সুলায়মান কনিষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন’।
হযরত সুলায়মান আ. এর বিশেষ গুণাবলী
হযরত দাউদ আ.-এর ন্যায় হযরত সুলায়ামন আ.-কেও আল্লাহ বিশেষ কিছু গুণাবলী দান করেছিলেন, যা আর কাউকে দান করেননি। যেমন: ১. বায়ু প্রবাহ অনুগত হওয়া, ২. তামাকে তরল ধাতুতে পরিণত করা, ৩. জিনকে অধীনস্ত করা, ৪. পক্ষীকূলকে অনুগত করা, ৫. পিপীলিকার ভাষা বুঝা, ৬. অতুলনীয় সাম্রাজ্য দান করা, ৭. প্রাপ্ত অনুগ্রহ রাজির হিসাব না রাখার অনুমতি পাওয়া। নিম্নে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হল:
১. বায়ু প্রবাহকে তাঁর অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর হুকুম মত বায়ু তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত স্থানে বহন করে নিয়ে যেত। তিনি সদলবলে বায়ুর পিঠে নিজ সিংহাসনে সওয়ার হয়ে দু’মাসের পথ একদিনে পৌঁছে যেতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ ও বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত…’ (সাবা, আয়াত ১২)।
আল্লাহ বলেন, ‘‘আর আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম প্রবল বায়ুকে। যা তার আদেশে প্রবাহিত হত ঐ দেশের দিকে, যেখানে আমরা কল্যাণ রেখেছি। আর আমরা সকল বিষয়ে সম্যক অবগত রয়েছি’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮১)। অন্যত্র আল্লাহ উক্ত বায়ুকে رُخَاء বলেছেন (ছোয়াদ, আয়াত ৩৬)। যার অর্থ মৃদু বায়ু, যা শূন্যে তরঙ্গ-সংঘাত সৃষ্টি করে না। عَاصِفَةٌ ও رُخَاء দু’টি বিশেষণের সমন্বয় এভাবে হতে পারে যে, কোনরূপ তরঙ্গ সংঘাত সৃষ্টি না করে তীব্র বেগে বায়ু প্রবাহিত হওয়াটা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং সুলায়মানের অন্যতম মু‘জেযা।
২. তামার ন্যায় শক্ত পদার্থকে আল্লাহ সুলায়মান আ. এর জন্য তরল ধাতুতে পরিণত করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তার জন্য গলিত তামার একটি ঝরণা প্রবাহিত করেছিলাম…’ (সাবা, আয়াত ১২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ গলিত ধাতু উত্তপ্ত ছিল না। বরং তা দিয়ে অতি সহজে পাত্রাদি তৈরী করা যেত। হযরত সুলায়মান আ. এর পর থেকেই তামা গলিয়ে পাত্রাদি তৈরী করা শুরু হয় । পিতা দাউদ আ. এর জন্য ছিল লোহা গলানোর মু‘জেযা এবং পুত্র সুলায়মানের জন্য ছিল তামা গলানোর মু‘জেযা। আর এজন্যেই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন, ‘‘হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। বস্ত্ততঃ আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ’’ (সাবা, আয়াত ১৩)।
দু’টি সূক্ষ্মতত্ত্ব
ক. হযরত দাউদ আ.-এর জন্য আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক শক্ত ও ঘন পদার্থ লোহাকে নরম ও সুউচ্চ পর্বতমালাকে অনুগত করে দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে সুলায়মান আ.-এর জন্য আল্লাহ শক্ত তামাকে গলানো এবং বায়ু, জিন ইত্যাদি এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্ত্তকে অনুগত করে দিয়েছিলেন, যা চোখেও দেখা যায় না। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহর শক্তি বড়-ছোট সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত।
(খ) এখানে আরেকটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর তাক্বওয়াশীল অনুগত বান্দারা আল্লাহর হুকুমে বিশ্বচরাচরের সকল সৃষ্টির উপরে আধিপত্য করতে পারে এবং সবকিছুকে বশীভূত করে তা থেকে খিদমত নিতে পারে।
৩. জিনকে তাঁর অধীন করে দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর জিনের মধ্যে কিছুসংখ্যক তার (সুলায়মানের) সম্মুখে কাজ করত তার পালনকর্তার (আল্লাহর) আদেশে…’ (সাবা, আয়াত ১২)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা তার অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে, যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এছাড়া অন্য আরও কাজ করত। আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮২)।
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৭-৩৮)।
বস্ত্ততঃ জিনেরা সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত তুলে আনত এবং সুলায়মানের হুকুমে নির্মাণ কাজ সহ যেকোন কাজ করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকত। ঈমানদার জিনেরা তো সওয়াবের নিয়তে স্বেচ্ছায় আনুগত্য করত। কিন্তু দুষ্ট জিনগুলো বেড়ীবদ্ধ অবস্থায় সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত।
৪. পক্ষীকুলকে হযরত সুলায়মান আ. এর অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাউদ আ. এর উত্তরাধিকারী হয়েছিল এবং বলেছিল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’’ (নমল, আয়াত ১৬)।
পক্ষীকুল তাঁর হুকুমে বিভিন্ন কাজ করত। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পত্র তিনি হুদহুদ পাখির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী বিলক্বীসের কাছে প্রেরণ করেছিলেন।
৫. পিপীলিকার ভাষাও তিনি বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘অবশেষে সুলায়মান তার সৈন্যদল নিয়ে পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল। তখন পিপীলিকা (নেতা) বলল, হে পিপীলিকা দল! তোমরা স্ব স্ব গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদের পিষ্ট করে ফেলবে’’। ‘তার এই কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল… (নমল, আয়াত ১৮-১৯)।
৬. তাঁকে এমন সাম্রাজ্য দান করা হয়েছিল, যা পৃথিবীতে আর কাউকে দান করা হয়নি। এজন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়। নিশ্চয়ই তুমি মহান দাতা’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৫)।
উল্লেখ্য যে, পয়গম্বরগণের কোন দো‘আ আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে হয় না। সে হিসাবে হযরত সুলায়মান আ. এ দো‘আটিও আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমেই করেছিলেন। কেবল ক্ষমতা লাভ এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এর পিছনে আল্লাহর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করা এবং তাওহীদের ঝান্ডাকে সমুন্নত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। কেননা আল্লাহ জানতেন যে, রাজত্ব লাভের পর সুলায়মান আ. তাওহীদ ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করবেন এবং তিনি কখনোই অহংকারের বশীভূত হবেন না। তাই তাঁকে এরূপ দো‘আর অনুমতি দেওয়া হয় এবং সে দো‘আ সর্বাংশে কবুল হয়।
৭. প্রাপ্ত অনুগ্রহরাজির হিসাব রাখা বা না রাখার অনুমতি প্রদান। আল্লাহ পাক হযরত সুলায়মান আ.-এর রাজত্ব লাভের দো‘আ কবুল করার পরে তার প্রতি বায়ু, জিন, পক্ষীকুল ও জীব-জন্তু সমূহকে অনুগত করে দেন। অতঃপর বলেন, ‘‘এসবই আমার অনুগ্রহ। অতএব এগুলো তুমি কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও, তার কোন হিসাব দিতে হবে না’। ‘নিশ্চয়ই তার (সুলায়মানের) জন্য আমার কাছে রয়েছে নৈকট্য ও শুভ পরিণতি’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৯-৪০)।
বস্ত্ততঃ এটি ছিল হযরত সুলায়মান আ. এর আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার প্রতি আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত একপ্রকার সনদপত্র। পৃথিবীর কোন ব্যক্তির জন্য সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন সত্যায়নপত্র নাযিল হয়েছে বলে জানা যায় না। অথচ এই মহান নবী সম্পর্কে ইহুদী-নাসারা বিদ্বানরা বাজে কথা রটনা করে থাকে।
হযরত সুলায়মান আ. এর জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী
১. ন্যায় বিচারের ঘটনা : ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় তাঁর দেওয়া প্রস্তাব বাদশাহ দাউদ আ. গ্রহণ করেন ও নিজের দেওয়া পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্র সুলায়মানের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী রায় দেন ও তা কার্যকর করেন। এটি ছিল সুলায়মানের বাল্যকালের ঘটনা, যা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)। এ ঘটনা হযরত দাউদ আ.-এর কাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে।
২. পিপীলিকার ঘটনা : হযরত সুলায়মান আ. একদা তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী সহ একটি এলাকা অতিক্রম করছিলেন। ঐ সময় তাঁর সাথে জিন, মানুষ পক্ষীকুল ছিল। যে এলাকা দিয়ে তাঁরা যাচ্ছিলেন সে এলাকায় বালির ঢিবি সদৃশ পিপীলিকাদের বহু বসতঘর ছিল। সুলায়মান বাহিনীকে আসতে দেখে পিপীলিকাদের সর্দার তাদেরকে বলল, তোমরা শীঘ্র পালাও। নইলে পাদপিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যাবে। হযরত সুলায়মান আ. পিপীলিকাদের এই বক্তব্য শুনতে পেলেন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ: ‘‘সুলায়মান দাউদ আ. এর স্থলাভিষিক্ত হল এবং বলল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’ (নমল, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সুলায়মান আ. এর সম্মুখে তার সোনাবাহিনীকে সমবেত করা হল জিন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে। তারপর তাদেরকে বিভিন্ন ব্যুহে বিভক্ত করা হল’। ‘অতঃপর যখন তারা একটি পিপীলিকা অধ্যুষিত এলাকায় উপনীত হল, তখন এক পিপীলিকা বলল, ‘হে পিপীলিকা দল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে’। ‘তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল এবং বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে ক্ষমতা দাও, যেন আমি তোমার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকর্মাদি করতে পারি এবং তুমি আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’’ (নমল, আয়াত ১৬-১৯)।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে প্রমাণিত হয় যে, হযরত সুলায়মান আ. কেবল পাখির ভাষা নয়, বরং সকল জীবজন্তু এমনকি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার কথাও বুঝতেন। এজন্য তিনি মোটেই গর্ববোধ না করে বরং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া আদায় করেন এবং নিজেকে যাতে আল্লাহ অন্যান্য সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করেন সে প্রার্থনা করেন। এখানে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, তিনি কেবল জিন-ইনসানের নয় বরং তাঁর সময়কার সকল জীবজন্তুরও নবী ছিলেন। তাঁর নবুয়তকে সবাই স্বীকার করত এবং সকলে তাঁর প্রতি আনুগত্য পোষণ করত। যদিও জিন ও ইনসান ব্যতীত অন্য প্রাণী শরীয়ত পালনের হকদার নয়।
৩. ‘হুদহুদ’ পাখির ঘটনা : হযরত সুলায়মান আ. আল্লাহর হুকুমে পক্ষীকুলের আনুগত্য লাভ করেন। একদিন তিনি পক্ষীকুলকে ডেকে একত্রিত করেন ও তাদের ভাল-মন্দ খোঁজ-খবর নেন। তখন দেখতে পেলেন যে, ‘হুদহুদ’ পাখিটা নেই। তিনি অনতিবিলম্বে তাকে ধরে আনার জন্য কড়া নির্দেশ জারি করলেন। সাথে তার অনুপস্থিতির উপযুক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করলেন। উক্ত ঘটনা কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ: ‘সুলায়মান পক্ষীকুলের খোঁজ-খবর নিল। অতঃপর বলল, কি হল হুদহুদকে দেখছি না যে? না-কি সে অনুপস্থিত’ (নমল, আয়াত ২০)। সে বলল, ‘আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা যবহ করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ’। ‘কিছুক্ষণ পরেই হুদহুদ এসে হাযির হয়ে বলল, (হে বাদশাহ!) আপনি যে বিষয়ে অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার নিকটে ‘সাবা’ থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি’ (নমল, আয়াত ২০-২২)।
উল্লেখ্য যে, ‘হুদহুদ’ এক জাতীয় ছোট্ট পাখির নাম। যা পক্ষীকুলের মধ্যে অতীব ক্ষুদ্র ও দুর্বল এবং যার সংখ্যাও দুনিয়াতে খুবই কম। বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. একদা নও মুসলিম ইহুদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রা.-কে জিজ্ঞেস করেন, এতসব পাখী থাকতে বিশেষভাবে ‘হুদহুদ’ পাখির খোঁজ নেওয়ার কারণ কি ছিল? জওয়াবে তিনি বলেন, সুলায়মান আ. তাঁর বিশাল বাহিনীসহ ঐসময় এমন এক অঞ্চলে ছিলেন, যেখানে পানি ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা হুদহুদ পাখিকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, সে ভূগর্ভের বস্ত্ত সমূহকে এবং ভূগর্ভে প্রবাহিত পানি উপর থেকে দেখতে পায়। হযরত সুলায়মান আ. হুদহুদকে এজন্যেই বিশেষভাবে খোঁজ করছিলেন যে, এতদঞ্চলে কোথায় মরুগর্ভে পানি লুক্কায়িত আছে, সেটা জেনে নিয়ে সেখানে জিন দ্বারা খনন করে যাতে দ্রুত পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়’। একদা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. ‘হুদহুদ’ পাখি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তখন নাফে‘ ইবনুল আযরক্ব তাঁকে বলেন, ‘জেনে নিন হে মহা জ্ঞানী! হুদহুদ পাখি মাটির গভীরে দেখতে পায়। কিন্তু (তাকে ধরার জন্য) মাটির উপরে বিস্তৃত জাল সে দেখতে পায় না। যখন সে তাতে পতিত হয়’। জবাবে ইবনু আববাস রা. বলেন, ‘যখন তাক্বদীর এসে যায়, চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়’। চমৎকার এ জবাবে মুগ্ধ হয়ে ইবনুল ‘আরাবী বলেন, ‘এরূপ জবাব দিতে কেউ সক্ষম হয় না, কুরআনের আলেম ব্যতীত’।
৪. রাণী বিলক্বীসের ঘটনা : হযরত সুলায়মান আ.-এর শাম ও ইরাক সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী ইয়ামন তথা ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী ছিলেন বিলক্বীস বিনতুস সারাহ বিন হাদাহিদ বিন শারাহীল। তিনি ছিলেন সাম বিন নূহ আ.-এর ১৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর ঊর্ধ্বতন ৯ম পিতামহের নাম ছিল ‘সাবা’। সম্ভবতঃ তাঁর নামেই ‘সাবা’ সাম্রাজ্যের নামকরণ হয়।আল্লাহ তাদের সামনে জীবনোপকরণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং নবীগণের মাধ্যমে এসব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে আল্লাহর অবাধ্য হয় এবং ‘সূর্য পূজারী’ হয়ে যায়। ফলে তাদের উপরে প্লাবণের আযাব প্রেরিত হয় ও সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ সূরা সাবা ১৫ হতে ১৭ আয়াতে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
দুনিয়াবী দিক দিয়ে এই ‘সাবা’ সাম্রাজ্য খুবই সমৃদ্ধ এবং শান-শওকতে পূর্ণ ছিল। তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মান আ. এর কিছু জানা ছিল না বলেই কুরআনী বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়। পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ সাম্রাজ্য সম্পর্কে পূর্বে না জানা এবং পরে জানার মধ্যে যে কি মঙ্গল নিহিত ছিল, তা পরবর্তী ঘটনাতেই প্রমাণিত হয়েছে এবং রাণী বিলক্বীস মুসলমান হয়ে যান। বস্ত্ততঃ হুদহুদ পাখি তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মান আ. এর নিকটে এসে প্রথম খবর দেয়। তার বর্ণিত প্রতিবেদনটি ছিল কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ :
‘‘আমি এক মহিলাকে সাবা বাসীদের উপরে রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে’। ‘আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলীকে সুশোভিত করেছে। অতঃপর তাদেরকে সত্যপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। ফলে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয় না’’ (নমল, আয়াত ২৩-২৪)।
হযরত সুলায়মান আ. বলল, ‘‘এখন আমরা দেখব তুমি সত্য বলছ, না তুমি মিথ্যাবাদীদের একজন’। ‘তুমি আমার এই পত্র নিয়ে যাও এবং এটা তাদের কাছে অর্পণ কর। অতঃপর তাদের কাছ থেকে সরে পড় এবং দেখ, তারা কি জবাব দেয়’। ‘বিলক্বীস বলল, হে সভাসদ বর্গ! আমাকে একটি মহিমান্বিত পত্র দেওয়া হয়েছে’। ‘সেই পত্র সুলায়মানের পক্ষ হতে এবং তা হল এই: করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’। ‘আমার মোকাবেলায় তোমরা শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার নিকটে উপস্থিত হও’। ‘বিলক্বীস বলল, হে আমার পরিষদ বর্গ! আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না’। ‘তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। অতএব ভেবে দেখুন আপনি আমাদের কি আদেশ করবেন’।
‘রাণী বলল, রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত লোকদের অপদস্থ করে। তারাও এরূপ করবে’। ‘অতএব আমি তাঁর নিকটে কিছু উপঢৌকন পাঠাই। দেখি, প্রেরিত লোকেরা কি জবাব নিয়ে আসে’। ‘অতঃপর যখন দূত সুলায়মান আ. এর কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান আ. বলল, তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদের দেওয়া বস্ত্ত থেকে অনেক উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক’। ‘ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী সহ আগমন করব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমরা অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কার করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত’। ‘অতঃপর সুলায়মান আ. বলল, হে আমার পরিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে আছ বিলক্বীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?’ ‘জনৈক দৈত্য-জ্বিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান ও বিশ্বস্ত’। ‘(কিন্তু) কিতাবের জ্ঞান যার ছিল সে বলল, তোমার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা এনে দিব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখল, তখন বলল, এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি শুকরিয়া আদায় করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের কল্যাণের জন্য তা করে থাকে এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত ও কৃপাময়’ (নমল, আয়াত ৪০)।
‘হযরত সুলায়মান আ. বলল, বিলক্বীসের সিংহাসনের আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বস্ত্ত চিনতে পারে, না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা সঠিক পথ খুঁজে পায় না?’ ‘অতঃপর যখন বিলক্বীস এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল: আপনার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটিই হবে। আমরা পূর্বেই সবকিছু অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহ হয়ে গেছি’। ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহর পরিবর্তে সে যার উপাসনা করত, সেই-ই তাকে ঈমান থেকে বিরত রেখেছিল। নিশ্চয়ই সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল’। ‘তাকে বলা হল, প্রাসাদে প্রবেশ করুন। অতঃপর যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল, তখন ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। ফলে সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান আ. বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলক্বীস বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করলাম’ (নমল, আয়াত ২৭-৪৪)।
সূরা নমল ২২ হতে ৪৪ আয়াত পর্যন্ত উপরে বর্ণিত ২৩টি আয়াতে রাণী বিলক্বীসের কাহিনী শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪০তম আয়াতে ‘যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিল’ বলে কাকে বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে তাফসীরবিদগণ মতভেদ করেছেন। তার মধ্যে প্রবল মত হল এই যে, তিনি ছিলেন স্বয়ং হযরত সুলায়মান আ.। কেননা আল্লাহর কিতাবের সর্বাধিক জ্ঞান তাঁরই ছিল। তিনি এর দ্বারা উপস্থিত জিন ও মানুষ পরিষদ বর্গকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমাদের সাহায্য ছাড়াও আল্লাহ অন্যের মাধ্যমে অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করে থাকেন। ‘আর এটি হল আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ (নমল ৪০)। দ্বিতীয়তঃ গোটা ব্যাপারটাই ছিল একটা মু‘জেযা এবং রাণী বিলক্বীসকে আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বস্ত্ততঃ এতে তিনি সফল হয়েছিলেন এবং সুদূর ইয়ামন থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে বিলক্বীস তার সিংহাসনের আগাম উপস্থিতি দেখে অতঃপর স্ফটিক স্বচ্ছ প্রাসাদে প্রবেশকালে অনন্য কারুকার্য দেখে এবং তার তুলনায় নিজের ক্ষমতা ও প্রাসাদের দীনতা বুঝে লজ্জিত ও অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়ে যান। মূলতঃ এটাই ছিল হযরত সুলায়মান আ. এর মূল উদ্দেশ্য, যা শতভাগ সফল হয়েছিল।
৫. ‘ইনশাআল্লাহ না বলার ফল : সহিহ বুখারী ও মুসলিমে এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনার সারমর্ম এই যে, একবার হযরত সুলায়মান আ. এ মনোভাব ব্যক্ত করলেন যে, রাত্রিতে আমি (আমার ৯০ বা ১০০) সকল স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব। যাতে প্রত্যেকের গর্ভ থেকে একটি করে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে ও পরে তারা আল্লাহর পথে ঘোড় সওয়ার হয়ে জিহাদ করবে। কিন্তু এ সময় তিনি ‘ইনশাআল্লাহ (অর্থঃ ‘যদি আল্লাহ চান’) বলতে ভুলে গেলেন। নবীর এ ত্রুটি আল্লাহ পছন্দ করলেন না। ফলে মাত্র একজন স্ত্রীর গর্ভ থেকে একটি অপূর্ণাঙ্গ ও মৃত শিশু ভূমিষ্ট হল’। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সুলায়মান বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাদশাহ হলেও এবং জিন, বায়ু, পক্ষীকুল ও সকল জীবজন্তু তাঁর হুকুম বরদার হলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অতএব তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ বলতে ভুলে যাওয়াটা ছোটখাট কোন অপরাধ নয়। এ ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয় যে, যারা যত বড় পদাধিকারী হবেন, তাদের ততবেশী আল্লাহর অনুগত হতে হবে এবং সর্বাবস্থায় সকল কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। সর্বদা বিনীত হয়ে চলতে হবে এবং কোন অবস্থাতেই অহংকার করা চলবে না।
৬. হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনী : হযরত সুলায়মান আ.-এর রাজত্বকালে বেঈমান জিনেরা লোকদের ধোঁকা দিত এই বলে যে, সুলায়মান জাদুর জোরে সবকিছু করেন। তিনি কোন নবী নন। শয়তানদের ভেল্কিবাজিতে বহু লোক বিভ্রান্ত হচ্ছিল। এমনকি শেষ নবী সা.-এর সময়েও যখন তিনি হযরত সুলায়মান আ.-এর প্রশংসা করেন, তখন ইহুদী নেতারা বলেছিল, আশ্চর্যের বিষয় যে, মুহাম্মদ সুলায়মানকে নবীদের মধ্যে শামিল করে হক ও বাতিলের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন জাদুকর মাত্র। কেননা স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ কি বায়ুর পিঠে সওয়ার হয়ে চলতে পারে? (ইবনু জারীর)।
এক্ষণে সুলায়মান আ. যে সত্য নবী, তিনি যে জাদুকর নন, জনগণকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এবং নবীগণের মু‘জেযা ও শয়তানদের জাদুর মধ্যে পার্থক্য বুঝাবার জন্য আল্লাহ পাক হারূত ও মারূত নামে দু’জন ফেরেশতাকে ‘বাবেল’ শহরে মানুষের বেশে পাঠিয়ে দেন। ‘বাবেল’ হল ইরাকের একটি প্রাচীন নগরী, যা ঐসময় জাদু বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। ফেরেশতাদ্বয় সেখানে এসে জাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে থাকেন এবং জাদুকরদের অনুসরণ থেকে বিরত হয়ে যেন সবাই সুলায়মানের নবুয়তের অনুসারী হয়, সেকথা বলতে লাগলেন।
জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য এই যে, জাদু প্রাকৃতিক কারণের অধীন। কারণ ব্যতীত জাদু সংঘটিত হয় না। কিন্তু দর্শক সে কারণ সম্পর্কে অবহিত থাকে না বলেই তাতে বিভ্রান্ত হয়। এমনকি কুফরীতে লিপ্ত হয় এবং ঐ জাদুকরকেই সকল ক্ষমতার মালিক বলে ধারণা করতে থাকে।
পক্ষান্তরে মু‘জেযা কোন প্রাকৃতিক কারণের অধীন নয়। বরং তা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে সম্পাদিত হয়। নবী ব্যতীত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তাঁর ‘কারামত’ বা সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও একইভাবে সম্পাদিত হয়। এতে প্রাকৃতিক কারণের যেমন কোন সম্পৃক্ততা নেই, তেমনি সম্মানিত ব্যক্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা হাত নেই। উভয় বস্ত্তর পার্থক্য বুঝার সহজ উপায় এই যে, মু‘জেযা কেবল নবীগণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যারা আল্লাহভীতি, উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং পবিত্র জীবন যাপন সহ সকল মানবিক গুণে সর্বকালে সকলের আদর্শ স্থানীয় হন।
আর নবী ও অলীগণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নবীগণ প্রকাশ্যে নবুয়তের দাবী করে থাকেন। কিন্তু অলীগণ কখনোই নিজেকে অলী বলে দাবী করেন না। অলীগণ সাধারণভাবে নেককার মানুষ। কিন্তু নবীগণ আল্লাহর বিশেষভাবে নির্বাচিত বান্দা, যাদেরকে তিনি নবুয়তের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন।
বস্ত্ততঃ সুলায়মান আ.-এর নবুয়তের সমর্থনেই আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে বাবেল শহরে পাঠিয়ে ছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘(ইহুদী-নাসারাগণ) ঐ সবের অনুসরণ করে থাকে, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। অথচ সুলায়মান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে জাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত এবং বাবেল শহরে হারূত ও মারূত দুই ফেরেশতার উপরে যা নাযিল হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। বস্ত্ততঃ তারা (হারূত-মারূত) উভয়ে একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা এসেছি পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই তুমি (জাদু শিখে) কাফির হয়ো না। কিন্তু তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যার দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। অথচ আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা তারা কারু ক্ষতি করতে পারত না। লোকেরা তাদের কাছে শিখত ঐসব বস্ত্ত যা তাদের ক্ষতি করে এবং তাদের কোন উপকার করে না। তারা ভালভাবেই জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করবে, তার জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ, যদি তারা জানতো’। ‘যদি তারা ঈমান আনত ও আল্লাহভীরু হত, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত, যদি তারা জানত’ (বাক্বারাহ, আয়াত ১০২-১০৩)।
৭. বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ ও সুলায়মান আ.-এর মৃত্যুর বিস্ময়কর ঘটনা : বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম আ.-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বাগৃহ নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হযরত ইয়াকূব আ. তা পুনর্নির্মাণ করেন। তার প্রায় হাজার বছর পরে দাউদ আ. তার পুনর্নির্মাণ শুরু করেন এবং সুলায়মান আ.-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও বাকী ছিল। এমন সময় হযরত সুলায়মান আ. এর মৃত্যুকাল ঘনিয়ে এল। এই কাজগুলি অবাধ্যতাপ্রবণ জিনদের উপরে ন্যস্ত ছিল। তারা হযরত সুলায়মান আ. এর ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে রেখে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলায়মান আ. আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যুর জন্যে প্রস্ত্তত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভিতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হল। আল্লাহর হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়ে গেল না। জিনেরা ভয়ে কাছে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হলে আল্লাহর হুকুমে কিছু উই পোকার সাহায্যে লাঠি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং সুলায়মান আ.-এর লাশ মাটিতে পড়ে যায়। উক্ত কথাগুলি আল্লাহ বলেন নিম্নোক্ত ভাবে- ‘অতঃপর যখন আমরা সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহলে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আযাবের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না’ (সাবা, আয়াত ১৪)। হযরত সুলায়মান আ. এর মৃত্যুর এই ঘটনা আংশিক কুরআনের আলোচ্য আয়াতের এবং আংশিক ইবনে আববাস রা. প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাছীর)।
হযরত সুলায়মান আ. এর এই অলৌকিক ইন্তেকাল কাহিনীর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
১. মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে নবী-রাসূল যে-ই হৌন না কেন, এক সেকেন্ড আগপিছ হবে না।
২. আল্লাহ কোন মহান কাজ সম্পন্ন করতে চাইলে যেকোন উপায়ে তা সম্পন্ন করেন। এমনকি মৃত লাশের মাধ্যমেও করতে পারেন।
৩. ইতিপূর্বে জিনেরা বিভিন্ন আগাম খবর এনে বলত যে, আমরা গায়েবের খবর জানি। অথচ চোখের সামনে মৃত্যুবরণকারী সুলায়মান আ.-এর খবর তারা জানতে পারেনি এক বছরের মধ্যে। এতে তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী অসার প্রমাণিত হয়।
হযরত সুলায়মান আ.-এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
১. নবুয়ত ও খেলাফত একত্রে একই ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া সম্ভব।
২. প্রকৃত মহান তিনিই, যিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অহংকারী হন না। বরং সর্বদা আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।
৩. শত্রুমুক্ত কোন মানুষ দুনিয়াতে নেই। সুলায়মান আ. এর মত একচ্ছত্র এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাদশাহর বিরুদ্ধেও চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার চালানো হয়েছে।
হযরত সুলায়মান আ. এর ইন্তেকাল ও রাজত্বকাল
সুলায়মান আ. ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। তন্মধ্যে ৪০ বছর তিনি রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রাহবা‘আম ১৭ বছর রাজত্ব করেন। অতঃপর বনু ইসরঈলের রাজত্ব বিভক্ত হয়ে যায়। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আবির্ভাবের প্রায় ১৫৪৬ বছর পূর্বে হযরত সুলায়মান আ. ইন্তেকাল করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল কুরআনে হযরত সুলাইমানের নাম ১৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব জায়গায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হলো – সূরা আল বাকারা ; ১০২। আন নিসা ; ১৬৩। আল আনয়াম ; ৮৪। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯, ৮১। আন নামল ; ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ৩০, ৩৬, ৪৪। সাবা ; ১২। সোয়াদ ; ৩০, ৩৪। তবে বিস্তারিত ঘটনা আপনারা আরো জানতে পারবেন সূরা আল আম্বিয়া ; ৭৮-৮২ আয়াতে। সূরা আন নামল ; ১৫-৪৪ আয়াতে। সূরা সাবা ; ১২-১৪ আয়াতে এবং সূরা সোয়াদ ; ৩০-৪৪ নম্বর আয়াতে।
।
হযরত ইলিয়াস আ.
হযরত ইলিয়াস আ. ছিলেন বনী ইসরাইলদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবী। ছিলেন বড় ইবাদত গুজার, আল্লাহভীরু এবং বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কুরআন মজিদে তাঁর নাম তিন বার উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ হয়েছে সূরা আনয়ামের ৮৫ আয়াতে এবং সূরা সাফফাতের ১২৩ ও ১৩০ আয়াতে। তিনি আল্লাহর কাছে বড় মর্যাদাবান ও সম্মানিত ছিলেন। কুরআন মজিদে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উপর সালাম বর্ষিত হয়েছে। বাইবেলে তাঁর নাম বলা হয়েছে ‘ইলিয়া’।
হযরত ইলিয়াস আ. এর সময় ও এলাকা
আধুনিক কালের গবেষকগণ খ্রিষ্টপূর্ব ৮৭৫ থেকে ৮৫০ এর মাঝামাঝি সময়টাকে তাঁর নবুয়ত কাল বলে চিহ্নিত করেছেন। হযরত ইলিয়াস আ. ছিলেন জিল’আদের অধিবাসী। সেকালে জিল’আদ বলা হত জর্ডানের উত্তরাঞ্চলকে। এলাকাটি ইয়ারমুক নদীর দক্ষিণে অবস্থিত।
কুরআনে তাঁর মর্যাদার বর্ণনা
কুরআনে হযরত ইলিয়াস আ. –কে হযরত ইব্রাহিম আ. এর বংশধর শ্রেষ্ঠ নবীদের একজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল আনয়ামে বলা হয়েছে, “ইব্রাহিমকে আনি ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের সবাইকে সত্য পথ প্রদর্শন করেছি, যা প্রদর্শন করেছিলাম ইতোপূর্বে নূহকে। তাছাড়া তাঁর বংশধরদের মধ্যে দাইদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা এবং হারুনকে সঠিক পথ দেখিয়েছি। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। তাঁর সন্তানদের মধ্য থেকে যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকেও সঠিক প্রদর্শন করেছি। এরা প্রত্যেকেই ছিলো যোগ্য সংস্কারক। তাঁরই বংশ থেকে ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুতকেও সঠিক পথ দেখিয়েছি। এদের প্রত্যেককে আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদা দিয়েছি।” (সূরা আল আনয়াম, ৮৪-৮৬)
তাঁর সংস্কারমুলক কাজ
সূরা আস-সাফফাতে তাঁর সংস্কারমুলক কাজের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার বর্ণনা দেয়া হয়েছে, “আর ইলিয়াসও ছিলো একজন রাসূল। স্মরণ করো, সে তাঁর জাতিকে যখন বলেছিলো, তোমরা কি সতর্ক হবে না? তোমরা কি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রভু মহামহিম স্রষ্টা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে বা’আলের পূজা অর্চনা করবে? কিন্তু তারা তাঁকে অস্বীকার করলো। কাজেই এখন অবশ্যি তাঁদের হাজির করা হবে শাস্তি ভোগের জন্যে, তবে আল্লাহর নিষ্ঠাবান দাসদের নয়। আর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি অব্যাহত রেখেছি। ইলিয়াসের প্রতি সালাম। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি। সে ছিলো আমার একনিষ্ঠ মুমিন দাসদেরই একজন।” (সূরা ৩৭, আস-সাফফাত, আয়াত ১২৩-১৩২)
বা’আল কে?
আল্লাহর উপরোক্ত বানী থেকে জানতে পারলাম হযরত ইলিয়াসের জাতি বা’আলের পূজা অর্চনা করতো। বা’আলের কাছেই প্রার্থনা করতো এবং তাকেই খোদা বলে ডাকতো। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছিলো। এই বা’আল কে?
‘বা’আল’ এর আভিধানিক অর্থ স্বামী বা পতি। প্রাচীনকালে সিরিয়া ও জর্ডান অঞ্চলে পূজনীয়, উপাস্য, প্রভু এবং দেবতা অর্থে এ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। সেকালে লেবাননের ফিনিকি সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের সবচে’ বড় দেবতাটিকে বলতো বা’আল। এ ছিলো পুরুষ দেবতা। এ মূর্তিটির স্ত্রীর নাম ছিলো আশারাত। এ ছিল সবচে’ বড় দেবী। আবার কোন কোন সম্প্রদায় সূর্য পূজা করতো। তারা সূর্যকেই বা’আল বলতো। আর চন্দ্র অথবা শুক্রগ্রহ ছিল এদের আশারাত। ইতিহাস থেকে জানা যায় সেকালে বেবিলন থেকে মিশর পর্যন্ত গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বা’আলের পূজা বিস্তার লাভ করে। বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলের মুশরিক জাতিগুলো বা’আলের পুজায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছিলো।
বনী ইসরাইলের বা’আল পূজা
হযরত মুসা আ. এর পর বনী ইসরাইলদের মধ্যে বা’আল পুজার প্রবনতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তারা বা’আল পুজায় চরম আসক্ত হয়ে পড়ে। জানা যায় তারা কোন একস্থানে বা’আলের যজ্ঞবেদী তৈরি করে নিয়েছিল এবং সেখানে তারা বা’আলের নামে বলিদান করতো। একবার একজন খাঁটি মুমিন এই বেদীটি ভেঙ্গে ফেলে। পরদিন লোকেরা সমাবেশ লরে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দাবী করে। অবশেষে হযরত সামুয়েল, তালুত, দাউদ এবং সুলাইমান বনী ইসরাঈলকে মূর্তি পুজার কলুষতা থেকে মুক্ত করেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সে রাষ্ট্র থেকে শিরক ও মূর্তি পূজা উচ্ছেদ করেন। কিন্তু সুলাইমান আ. এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রহুবমের অযোগ্যতার কারণে বনী ইসরাইল রাজ্য ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়ে যায়। একভাগে ছিল বাইতুল মাকদাস সহ দক্ষিন ফিলিস্তিন নিয়ে গঠিত ইহুদী রাষ্ট্র। আর উত্তর ফিলিস্তিনের নাম থাকে ইসরাইল রাষ্ট্র।
ইসরাইল রাষ্ট্রের লোকেরা আবার মূর্তি পুজায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তারা শিরক, মূর্তিপূজা, ফাসেকী, চরিত্রহীনতা এবং যাবতীয় বদ আমলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। বা’আল কে তারা দেবতা বানিয়ে নেয়। তারা নবীদের বংশধর হয়েও আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলের উপাসনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।
মুক্তির বানী নিয়ে এলেন
বনী ইসরাইল শিরক ও চরম পাপাচারের কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। এ সময় মহান আল্লাহ ইলিয়াসকে নবুয়ত দান করেন। বনি ইসরাইলকে সতর্ক করার নির্দেশ দেন। তাঁদেরকে মুক্তি এবং কল্যাণের পথে আসার আহবান জানাতে বলেন। ইলিয়াস আ. শাসকবর্গ ও জনগণের সামনে হাজির হন। তাঁদের সতর্ক হতে বলেন। আল্লাহকে ভয় করতে বলেন। মূর্তিপূজা ও পাপাচার ত্যাগ করতে বলেন। বা’আলকে পরিত্যাগ করতে বলেন। তাঁদেরকে আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে জীবন যাপন করতে বলেন। তখন ইসরাইলের রাজা ছিলেন আখিয়াব। আখিয়াব লেবাননের (সেকালে লেবাননকে বলা হত সাঈদা) মুশরিক রাজ কন্যাকে বিয়ে করে নিজেও মুশরিক হয়ে পড়েন। হযরত ইলিয়াস আখিয়াবের কাছে এসে বলে দেন, তোমার পাপের কারণে এখন আর ইসরাইল রাজ্যে এক বিন্দু বৃষ্টিও হবে না। শিশির এবং কুয়াশাও পড়বে না।
আল্লাহর নবীর উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হলো। সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে থাকলো। এবার আখিয়াবের হুশ হলো। সে হযরত ইলিয়াসকে সন্ধান করে আনলো। অনুনয় বিনয় করে হযরত ইলিয়াসকে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করতে বললো। হযরত ইলিয়াস আ. এই সুযোগে বা’আলকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আখিয়াবকে শর্ত দিলেন, একটি জনসমাবেশ ডাকতে হবে। সেখানে বা’আলের পূজারীরা বা’আলের নামে বলিদান করবে এবং আমি আল্লাহর নামে কুরবানী করবো। গায়েবী আগুণ এসে যে পক্ষের কুরবানীকে জালিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়ে যাবে সে পক্ষের মা’বুদকেই সত্য বলে মেনে নিতে হবে। আখিয়াব এ শর্ত মেনে নিলো । তারপর আখিয়াব সাধারণ জনসমাবেশ ডাকলো। সেখানে সাড়ে আটশো বা’আল পূজারী একত্রিত হলো। কুরবানী হলো, বলিদান হলো। অতপর আকাশ থেকে আগুণ এসে হযরত ইলিয়াসের কুরবানীকে ভস্মীভূত করে দিয়ে গেলো। সমস্ত জনগণের সামনে বা’আল মিথ্যা খোদা বলে প্রমাণিত হলো। জনগণ বা’আল পূজারীদের হত্যা করলো। হযরত ইলিয়াস আ. সেখানেই আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করলেন। সাথে সাথেই আকাশে মেঘ করলো। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
নবীর উপর নির্যাতন
কিন্তু আখিয়াব ছিলো স্ত্রৈণ। স্ত্রৈণ মানে স্ত্রীর অনুগত। সে স্ত্রীর গোলামী থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাঁর মুশরিক স্ত্রী হযরত ইলিয়াসের ঘোরতর শত্রু হয়ে পড়ে। স্ত্রীর খপ্পরে পড়ে আখিয়াব আল্লাহর নবীর উপর নির্যাতন শুরু করে। তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা ঘোষণা করে দেয়, বা’আল পূজারীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, ইলিয়াসকেও সেভাবে হত্যা করা হবে। তারা অত্যাচার নির্যাতনের দাপটে জনগণের মুখ বন্ধ করে দিলো। হযরত ইলিয়াস আ. একাকী হয়ে পড়লেন। তিনি বাধ্য হয়ে দেশ থেকে হিজরত করেন এবং সিনাই পর্বতের পাদদেশে আশ্রয় নেন।
সংস্কার কাজ চালিয়ে যান
হযরত ইলিয়াস আ. কয়েকবছর সিনাইর পাদদেশে অবস্থান করেন। এরি মধ্যে দক্ষিণ ফিলিস্তিনের ইয়াহুদী শাসক ইয়াহুরাম ইসরাইল রাজ্যের শাসক আখিয়াবের মুশরিক কন্যাকে বিয়ে করেন।
তাঁর প্রভাবে ইহুদী রাজ্যেও ব্যাপক ভাবে মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হয়। ইলিয়াস এখানে আসেন। তাঁদের সতর্ক করেন। তাদের আল্লাহর পথ দেখান। মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করতে বলেন। মর্মস্পর্শী অনেক উপদেশ দিয়ে রাজা ইয়াহুরামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রও প্রদান করেন। কিন্তু তারা শিরক, মূর্তিপূজা ও পাপাচার থেকে বেরিয়ে আসেনি। শেষ পর্যন্ত রাজা ধ্বংস হয়ে যায়।
কয়েক বছর পর হযরত ইলিয়াস আ. আবার ইসরাইল রাষ্ট্রে ফিরে আসেন। আখিয়াব ও তাঁর পুত্র আখযিয়াকে সঠিক পথে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কিন্তু তাঁরাও আল্লাহর পথে ফিরে আসেনি। অবশেষে হযরত ইলিয়াসের বদদোয়ায় আখিয়াব রাজ পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।
হযরত ইলিয়াস আ. এর সুখ্যাতি
জীবদ্দশায় হযরত ইলিয়াস আ. এর প্রতি চরম অত্যাচার নির্যাতন চালালেও তাঁর ইন্তেকালের পর বনী ইসরাইল তাঁর ভক্ত অনুরক্ত হয়ে পড়ে। বাইবেল থেকে জানা যায়, বনি ইসরাইল ধারণা করতো, ইলিয়াস আ. কে আল্লাহ তায়ালা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তিনি আবার পৃথিবীতে আসবেন। তারা ইলিয়াস আ. এর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলো। তাঁর আটশো বছর পরে হযরত ঈসা আ. এর জন্ম হয়। তিনি তাঁর সাথীদের বলে যান, ইলিয়া (ইলিয়াস) আটশো বছর আগে অতীত হয়ে গেছেন। তিনি আর পৃথিবীতে আসবেন না। যাই হোক, পরবর্তী লোকদের মাঝে হযরত ইলিয়াসের প্রচুর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সেকথাই মহান আল্লাহ কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন, “ আর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি ছড়িয়ে দিয়েছি। ” (সুরা আস সাফফাত, আয়াত ১২৯)
।
হযরত আলইয়াসা আ.
আল কুরআনে হযরত আলইয়াসা
“ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুত এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদাবান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৬)
“আর ইসমাঈল, আলইয়াসা যুলকিফলের কথা স্মরণ করো। এরা প্রত্যেকেই ছিলো মহোত্তম।’’ (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৮)
আল কুরআনে হযরত আলইয়াসার নাম এই দুইটি স্থানেই উল্লেখ হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী রাসূলদের মাঝে গণ্য করেছেন। তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন অনেক বড় মর্যাদা ও উচ্চাসন। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের শ্রেষ্ঠ নবীগণের অন্যতম। ইহুদী খ্রিষ্টানদের কাছে তাঁদের গ্রন্থাবলীতে তিনি ইলিশা (Elisha) হিসেবে পরিচিত।
প্রশিক্ষণ ও মনোনয়ন
হযরত আলইয়াসা ছিলেন হযরত ইলিয়াস আ. এর ছাত্র ও শিষ্য। হযরত ইলিয়াস আ. তাঁকে উত্তম প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তোলেন। কুরআন মজিদে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরণ নেই। বাইবেলে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইলিয়াস আ. কে নির্দেশ প্রদান করেন আলইয়াসাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে যোগ্য করে গড়ে তুলতে। এ নির্দেশ অনুযায়ী ইলিয়াস হযরত আলইয়াসার বসবাসের এলাকায় গিয়ে পৌঁছান।
হযরত ইলিয়াস দেখতে পান, আলইয়াসা বার জোড়া গরু নিয়ে জমিতে চাষ দিচ্ছেন। তিনি তাঁর পাশ দিয়ে যাবার কালে নিজের চাদর তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে আলইয়াসা ক্ষেতখামার চাষবাস ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাথে চলে আসেন। প্রায় দশ বারো বছর আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের প্রশিক্ষণাধীনে থাকেন। অতঃপর ইলিয়াসকে উঠিয়ে নেবার পর আল্লাহ আলইয়াসাকে নবুয়ত দান করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, হযরত আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের চাচাত ভাই ছিলেন।
সংশোধনের কাজ
হযরত ইলিয়াস আ. এর ইন্তেকালের পর হযরত আলইয়াসা আ. বলিষ্ঠভাবে ইসরাইলী শাসক ও জনগণকে সংশোধনের পদক্ষেপ নেন। শিরক, মূর্তিপূজা ও আনাচারের মূল অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলো স্বয়ং রাজ পরিবার। হযরত আলইয়াসা আ. তাঁদের সতর্ক করে দেন। আল্লাহর ভয় দেখান। কিন্তু কিছুতেই তারা আল্লাহর পথে আসতে রাজি হয়নি।
শেষ পর্যন্ত হযরত আলইয়াসা আ. জনৈক যিহুকে রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যিহু রাজ পরিবারকে হত্যা করে এবং বা’আলের পূজা নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু জনগণের মনমগজে মূর্তি পুজার কুসংস্কার বদ্ধমূল হয়ে থাকে। হযরত আলইয়াসার মৃত্যুর পর পুনরায় ইসরাইলী সমাজ শিরকের পুতিগন্ধময় গহবরে নিমজ্জিত হয়।
।
হযরত ইউনুস আ.
হযরত ইউনুস বিন মাত্তা আ.-এর কথা পবিত্র কুরআনের মোট ৬টি সূরার ১৮টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউনুস ৯৮ আয়াতে তাঁর নাম ইউনুস, সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াতে ‘যুন-নূন’ এবং সূরা ক্বলম ৪৮ আয়াতে তাঁকে ‘ছাহেবুল হূত’ বলা হয়েছে। ‘নূন’ ও ‘হূত’ উভয়ের অর্থ মাছ। যুন-নূন ও ছাহেবুল হূত অর্থ মাছওয়ালা। একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন।
হযরত ইউনুস আ. এর দেশ
হযরত ইউনুস আ. একজন সম্মানিত নবী ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে সরাসরি কুরআনে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। হাদিস, তাফসির ও ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি সিরিয়ার লোক ছিলেন এবং ইসরাইল বংশের লোক ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আসিরিয়াবাসীদের হিদায়াতের জন্যে ইরাকে যেতে নির্দেশ দেন। সে হিসেবে তিনি ইরাকে গিয়ে আসিরিয়াবাসীকে আল্লাহর পথে আনবার চেষ্টা সংগ্রামে লিপ্ত হন। হযরত ইউনুস আ. বর্তমান ইরাকের মূছেল নগরীর নিকটবর্তী ‘নীনাওয়া’ জনপদের অধিবাসীদের প্রতি প্রেরিত হন। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে। বারবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতিমধ্যে তার কওমের উপরে আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। জনপদ ত্যাগ করার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তিনদিন পর সেখানে গযব নাযিল হতে পারে। তারা ভাবল, নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে ইউনুস আ. এর কওম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শিরক হতে তওবা করে এবং জনপদের সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং গবাদিপশু সব নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বাচ্চাদের ও গবাদিপশু গুলিকে পৃথক করে দেয় এবং নিজেরা আল্লাহর দরবারে কায়মনোচিত্তে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তারা সর্বান্ত:করণে তওবা করে এবং আসন্ন গযব হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, “অতএব কোন জনপদ কেন এমন হল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম” (সূরা ইউনুস, আয়াত ৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুসের কওমের প্রশংসা করা হয়েছে।
ওদিকে ইউনুস আ. ভেবেছিলেন যে, তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব নাযিল হয়নি, তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, এখন তার কওম তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন।
মাছের পেটে হযরত ইউনুস আ.
আল্লাহ বলেন, “আর ইউনুস ছিল পয়গম্বরগণের একজন”। “যখন সে পালিয়ে যাত্রী বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছল”। “অতঃপর লটারীতে সে অকৃতকার্য হল”। “অতঃপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল। এমতাবস্থায় সে ছিল নিজেকে ধিক্কার দানকারী” (সূরা ছাফফাত, আয়াত ১৩৯-১৪২)।
আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইউনুস আ. নিজ কওমকে ছেড়ে এই হিজরতে বেরিয়েছিলেন বলেই অত্র আয়াতে তাকে মনিবের নিকট থেকে পলায়নকারী বলা হয়েছে। যদিও বাহ্যত এটা কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু পয়গম্বর ও নৈকট্যশীলগণের মর্তবা অনেক ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ তাদের ছোট-খাট ত্রুটির জন্যও পাকড়া করেন। ফলে তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় পতিত হন।
হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হলে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য লটারী হলে পরপর তিনবার তাঁর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। সাথে সাথে আল্লাহর হুকুমে বিরাটকায় এক মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মাছের পেটে তিনি হযম হয়ে যাননি। বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা (ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ৮৭-৮৮)। মাওয়ার্দী বলেন, মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)।
ইউনুস আ. মাছের পেটে কত সময় বা কতদিন ছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন- ১. এক ঘণ্টা ছিলেন, ২. তিনি পূর্বাহ্নে প্রবেশ করে অপরাহ্নে বেরিয়ে আসেন, ৩. ৩ দিন ছিলেন, ৪. ৭ দিন ছিলেন, ৫. ২০ দিন ছিলেন, ৬. ৪০ দিন ছিলেন।
হযরত ইউনুস আ. মুক্তি পেলেন
আল্লাহ বলেন, “অতঃপর যদি সে আল্লাহর গুণগানকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হত” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩)। ‘তাহলে সে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকত’?। ‘অতঃপর আমরা তাকে একটি বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন সে রুগ্ন ছিল’। ‘আমরা তার উপরে একটি লতা বিশিষ্ট বৃক্ষ উদ্গত করলাম’। ‘এবং তাকে লক্ষ বা ততোধিক লোকের দিকে প্রেরণ করলাম’। ‘তারা ঈমান আনল। ফলে আমরা তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিলাম” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩-১৪৮)।
অন্যত্র আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর এবং মাছওয়ালার (ইউনুসের) মত হয়ো না। যখন সে দুঃখাকুল মনে প্রার্থনা করেছিল’। ‘যদি তার পালনকর্তার অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহলে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন এবং তাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন’ (ক্বলম, আয়াত ৪৮-৫০)।
অন্যত্র ইউনুস আ. এর ক্রুদ্ধ হয়ে নিজ জনপদ ছেড়ে চলে আসা, মাছের পেটে বন্দী হওয়া এবং ঐ অবস্থায় আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
“এবং মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে (আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তার উপরে কোনরূপ কষ্ট দানের সিদ্ধান্ত নেব না’। ‘অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমা লংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৭-৮৮)।
ইউনুস আ.-এর উক্ত দো‘আ ‘দো‘আয়ে ইউনুস’ নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘বিপদগ্রস্ত কোন মুসলমান যদি (নেক মকছূদ হাছিলের নিমিত্তে) উক্ত দো‘আ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তা কবুল করেন’।
উপরোক্ত আয়াত সমূহে প্রতীয়মান হয় যে, ইউনুস আ. মাছের পেটে থাকার পরে আল্লাহর হুকুমে নদীতীরে নিক্ষিপ্ত হন। মাছের পেটে থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি রুগ্ন ছিলেন। ঐ অবস্থায় সেখানে উদ্গত লাউ জাতীয় গাছের পাতা তিনি খেয়েছিলেন, যা পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। অতঃপর সুস্থ হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিজ কওমের নিকটে চলে যান। যাদের সংখ্যা এক লক্ষ বা তার বেশী ছিল। তারা তাঁর উপরে ঈমান আনলো। ফলে পুনরায় শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করেন এবং দুনিয়া ভোগ করার সুযোগ দেন।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
১. খালেছ তওবা ও আকুল প্রার্থনার ফলে অনেক সময় আল্লাহ গযব উঠিয়ে নিয়ে থাকেন। যেমন ইউনুসের কওমের উপর থেকে আল্লাহ গযব ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
২. আল্লাহ ইচ্ছা করলে যেকোন পরিবেশে ঈমানদারকে রক্ষা করে থাকেন।
৩. পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা ও জলচর প্রাণী সবাই আল্লাহর হুকুমে ঈমানদার ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত হয়। যেমন মাছ ও লতা জাতীয় গাছ ইউনুসের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিল।
৪. আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ব্যতীত দো‘আ কবুল হয় না।
৫. আল্লাহর প্রতিটি কর্ম তার নেককার বান্দার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। যা বান্দা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআন মজিদে হযরত ইউনুস আ. এর নাম উল্লেখ হয়েছে ৬ বার। এর মধ্যে চার বার ইউনুস আর দুইবার মাছওয়ালা বলে উল্লেখ হয়েছে। সূরা আন নিসা ১৬৩। আল আনয়াম ৮৬। ইউনুস ৯৮। আস সাফফাত ১৩৯। আল আম্বিয়া ৮৭। আল কলম ৪৮।
।
হযরত যাকারিয়া আ.
শ্রেষ্ঠ রাসূলদের একজন
হযরত যাকারিয়া আ. ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাসূলদের একজন। মহান আল্লাহ গোটা বিশ্ববাসীর উপর যাদের সম্মানিত করেছেন, তিনি তাঁদেরই অন্যতম। তাছাড়া তিনি সেইসব নবী রাসূলদেরও একজন, মানুষকে সত্য পথে আসার আহবান করার কারণে যাদেরকে আল্লাহর দুশমনরা যাদের হত্যা করেছিলো। তাই তিনি একজন শহীদ নবী। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসূল। তিনি হযরত ইব্রাহিম ও ইয়াকুব আ. এর বংশধর। মহান আল্লাহর বাণী, “আর আমি ইব্রাহিমকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেককে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি, যা দেখিয়েছিলাম ইতোপূর্বে নুহকে। একই পথ দেখিয়েছি আমি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা, হারুণকে। মুহসিন লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। আমি একই পথ দেখিয়েছি যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ইলিয়াস ও ঈসা কে। এরা সবাই ছিলো সংস্কারক। সেই পথই দেখিয়েছি আমি ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস ও লুতকে। এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম ৮৪-৮৬)
নেতৃত্বদান
বনি ইসরাইলের ধর্মীয় কার্যক্রমের কেন্দ্র ছিল বাইতুল মাকদাস। বনি ইসরাইলের মধ্যে হযরত হারুন আ. এর বংশধর একটি গোত্রের উপর দায়িত্ব ছিল বাইতুল মাকদাসের রক্ষণাবেক্ষণের। হযরত যাকারিয়া আ. ছিলেন এ গোত্রের প্রধান। গোত্রীয় প্রধান হিসেবে তিনিই ছিলেন এই মহান ধর্মীয় কেন্দ্রের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক। তাকেই করতে হত এই ঘরের সেবা ও পরিচর্যা। ধর্মের দাওয়াত ও শিক্ষা প্রচার এবং সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় অসৎ কাজ থেকে বারণ ও বাধা দানই ছিলো তাঁর মিশনের মূল কাজ। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগত দাস এবং সত্য সততা ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক।
একটি ছেলে দাও আল্লাহ
কিন্তু হযরত যাকারিয়া আ. এই ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নিয়ে ছিলেন খুবই চিন্তিত। তাঁর বংশে এমন কোন যোগ্য লোক ছিলো না তাঁর মৃত্যুর পর যে এই মহান দায়িত্ব পালন করতে পারতো। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই পরবর্তী দায়িত্বের ব্যাপারে তিনি সব সময়ই ছিলেন চিন্তিত। এখন তাঁর বয়স প্রায় একশো বছর। চিন্তা তাঁর বেড়েই চললো। হঠাৎ ঘটে গেলো একটি ঘটনা। ঘটনাটির আছে একটি পূর্ব কথা –
হযরত ঈসা আ. এর নানী আল্লাহর কাছে মানত করলেন, হে আল্লাহ, আমার এখন যে সন্তানটি হবে, আমি ওকে তোমার জন্যে নজরানা দিলাম। ও তোমার জন্যে উৎসর্গিত হবে। তুমি এই নজরানা কবুল করে নাও। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর একটি ছেলে হবে এবং তিনি ওকে বাইতুল মাকদাসে ধর্মের কাজের জন্যে বিশেষভাবে নিয়োগ করবেন। কিন্তু মানুষ যা চায় তা হয় না। আল্লাহ যা চান তাই হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর একটি মেয়ে হলো। তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন মরিয়ম। মরিয়ম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে মানত অনুযায়ী ওকে তিনি পৌঁছে দিলেন বাইতুল মাকদাসে। এখন প্রশ্ন দেখা দিলো, সেখানে ওর দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করবে কে? মরিয়মকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলেন অনেকে। এ দায়িত্ব পালনের জন্যে এগিয়ে এলেন হযরত যাকারিয়া আ.। আরো এগিয়ে এলেন অন্যান্য গোত্রের ধর্মীয় নেতারা। তারা সবাই দাবী করলেন এ মহৎ সেবা প্রদানের। নিজের দাবী ত্যাগ করছেন না কেউই। ফলে অনুষ্ঠিত হলো কোরা (লটারি)। লটারিতে নাম উঠেছে হযরত যাকারিয়া আ. এর । তিনি দেখাশুনা শুরু করতে লাগলেন মরিয়মকে, এদিকে তিনি মরিয়মের খালু হন। হযরত যাকারিয়ার স্ত্রী এবং মরিয়মের মা সহোদর বোন। ফলে মরিয়মের সেবা ও আদর যত্ন হতে লাগলো সুন্দর ও নিখুঁতভাবে। মরিয়ম ই’তেকাফ ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে নিজের আত্মার অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। একদিনের ঘটনা। হযরত যাকারিয়া আ. বাইতুল মাকদাসের সেই নির্দিষ্ট ঘরে দেখতে এলেন মরিয়মকে। কক্ষে ঢুকেই তিনি অবাক। দেখলেন মরিয়মের সামনে সাজানো রয়েছে অনেক সুস্বাদু ফল। এইসব ফল এই মওসুমের ফল নয়। জেরুজালেমে তো এখন এই ফল পাওয়া যায় না। বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মরিয়ম এ ফল তুমি কোথায় পেলে?
মরিয়ম : আল্লাহ পাঠিয়েছেন।
এ জবাব শুনে হযরত যাকারিয়া আ. এর অন্তরে আশার উদয় হলো। তিনি ভাবলেন, যে আল্লাহ মরিয়মকে বেমওসুমের ফল দিতে পারেন, তিনি ইচ্ছে করলে তো আমাকেও বুড়ো বয়সে ছেলে দিতে পারেন। তিনি দু’হাত উঠালেন আল্লাহর দরবারে। একটি ছেলে চাইলেন আল্লাহর দরবারে। তাঁর সেই দোয়া কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে, “প্রভু, তোমার বিশেষ ক্ষমতা বলে আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো। তুমি তো অবশ্যি দোয়া শ্রবণকারী। ” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৭-৩৮)
“যাকারিয়া চুপে চুপে তাঁর প্রভুকে ডাকলো। সে বললো – প্রভু, আমার হাড়গুলো পর্যন্ত নরম হয়ে গেছে। মাথা বার্ধক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রভু। তোমার কাছে কিছু চেয়ে আমি কখনোই ব্যর্থ হইনি। আমি আমার পরে নিজের যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকার আশংকা করছি। এদিকে আমার স্ত্রী হলো বন্ধ্যা। তাই তুমি তোমার বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দান করো। যে হবে আমার ও ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারী। আর হে প্রভু, তুমি ওকে তোমার পছন্দনীয় মানুষ বানিয়ো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ২-৬)
“আর যাকারিয়ার কথা স্মরণ করো। যখন সে তাঁর প্রভুকে ডেকে বলেছিল, প্রভু, আমাকে একাকী ছেড়ে দিও না আর সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী তো তুমিই।” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯)
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি কিছু করতে চাইলে বলেন, ‘হও’ আর সাথে সাথে তা হয়ে যায়। তিনি তাঁর দাস ও রাসূল যাকারিয়ার দোয়া কবুল করলেন। তিনি বৃদ্ধ পিতা আর বন্ধ্যা মায়ের ঘরে সন্তান দান করলেন। একটি সুপুত্র। নাম তাঁর ইয়াহিয়া। তিনি হযরত যাকারিয়া আ. এর শুধু একটি সুপুত্রই ছিলেন না, সেই সাথে আল্লাহ তাঁকে রিসালাতও দান করেন।”
হত্যা করা হলো তাঁকে
হযরত যাকারিয়া আ. ছিলেন হযরত ঈসা আ. এর লাগভাগ পূর্বেকার নবী। তাঁর বয়সের শেষ আর হযরত ঈসা আ. এর আগমন প্রায় একই সময়। আর এসময়টা ছিল এখন থেকে মাত্র দুই হাজার বছর পূর্বে। এ সময় ফিলিস্তিনের ইহুদীরা প্রকাশ্যে যিনা, ব্যাভিচার ও অশ্লীল কাজ করতো। যে দু’চারজন ভালো মানুষ ছিলেন তারা ছিলেন নির্যাতিত। পাপ ও পাপিষ্ঠদের সমালোচনা করলে জীবনের নিরাপত্তা ছিলো না।
কিন্তু হযরত যাকারিয়া আ. ছিলেন আল্লাহর নবী। মানুষকে অন্যায় অপরাধের কাজ থেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করাই নবীর কাজ। নবী ও নবীর সত্যিকারের অনুসারী ঈমানদারেরা কখনো অত্যাচার ও নির্যাতনকে ভয় পান না। তাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে বিরত রাখার এবং সঠিক পথে ডাকার কাজ করে যান।
হযরত যাকারিয়া আ. বনী ইসরাইলকে মন্দ কাজ করতে নিষেধ করেন। পাপের পথে বাধা সৃষ্টি করেন এবং তাঁদেরকে আল্লাহর পথে তথা সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানাতে থাকেন। তাঁর ভালো কাজের আদেশ আর মন্দ কাজের বাধাদানকে পাপিষ্ঠ শাসক আর সমাজের অপরাধী নেতারা বরদাশত করতে পারেনি। তারা হযরত যাকারিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কারণে ইহুদী রাষ্ট্রের রাজা ইউআসের নির্দেশে আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়া আ.কে ইহুদীরা হাইকালে সুলাইমানিতে পাথর মেরে হত্যা করে। এভাবে বনী ইসরাইল হত্যা করেছে বহু নবীকে। তাঁদের এইসব জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে আল কুরআনে মহান আল্লাহ বনী ইসরাইলকে লক্ষ্য করে বলেন, “যখনই তোমাদের প্রবৃত্তির কামনার বিপরীত কোন জিনিস নিয়ে আমার কোন রাসূল তোমাদের কাছে এসেছে, তখনই তোমরা তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেছো, কাউকেও মিথ্যা বলেছো, আর কাউকে হত্যা করেছো।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত ৮৭)
কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইহুদীরা হযরত যাকারিয়াকে করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল কুরআনে হযরত যাকারিয়াকে অতি উচ্চ মর্যাদার নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মজিদে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সাতবার। যেসব সূরা ও আয়াতে উল্লেখ হয়েছে সেগুলো- সূরা আলে ইমরানে ৩৭ নং আয়াতে দুইবার। একই সূরা আয়াত ৩৮। সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৫। সূরা মরিয়ম, আয়াত ২ ও ৭। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯।
শিক্ষা
আল কুরাআনের আলোকে আমরা হযরত যাকারিয়ার জীবনী থেকে কয়েকটি বড় বড় শিক্ষা লাভ করতে পারি। সেগুলো হলো –
১. পুত পবিত্র জীবন যাপন।
২. আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিনয়।
৩. যা কিছু চাওয়ার কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।
৪. আল্লাহকে সর্বশক্তিমান জানতে হবে।
৫. আল্লাহর কাছে সৎ ও নেক্কার সন্তান প্রার্থনা করতে হবে।
৬. মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে।
৭. মন্দ কাজে প্রতিবাদ করতে হবে এবং বাধা দিতে হবে।
৮. ধৈর্য ও দ্রঢ়তার সাথে আল্লাহর পথে অটল থাকতে হবে।
৯. প্রয়োজনে আল্লাহর পথে শহীদ হবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।
।
হযরত ইয়াহইয়া আ.
তাঁর জন্ম আল্লাহর একটি নিদর্শন
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমস্ত ক্ষমতার উৎস ও মালিক। এই পৃথিবীর সব তাঁর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। সব কিছুই তাঁর বেধে দেয়া নিয়ম ও বিধানের অধীন। কোনো কিছুতে তাঁর বেধে দেয়া নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে তা হয়ে যায় ধ্বংস। তাঁর বেধে দেয়া সুনির্দিষ্ট নিয়মেই জন্ম হয় সব মানুষের। নিয়ম যেহেতু তিনিই তৈরি করেছেন, তাই নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করলে তিনিই করতে পারেন, আর কেউ নয়। কখনো কখনো তিনি মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করেছেন। বাবা মা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন আদম ও হাওয়াকে। বাবা ছাড়া শুধু মা থেকেই সৃষ্টি করেছেন হযরত ঈসা আ. কে। আবার প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা ইব্রাহিম এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতা হযরত সারাহকে দান করেছেন পুত্র ইসহাককে। এই একই রকম ঘটনা ঘটেছে হযরত ইয়াহিয়া আ. এর ক্ষেত্রে। প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা হযরত যাকারিয়া এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছেন হযরত ইয়াহিয়া আ.।
আপনারা হয়তো যাকারিয়ার জীবনীতে দেখেছেন, তাঁর কোন সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে বন্ধ্যা স্ত্রীর ঘরে তিনি আল্লাহর কাছে আল্লাহর পছন্দনীয় সন্তান প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করে বলেন, তুমি সন্তান পাবে। আল্লাহ তাঁকে সুসংবাদ দেন এভাবে –
“যাকারিয়া যখন মেহরাবে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিল তখন ফেরেশতারা তাঁকে ডেকে বলল – আল্লাহ আপনাকে ইয়াহিয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। সে (অর্থাৎ ঈসা আঃ) আল্লাহর একটি হুকুমকে সত্যায়িত করবে। সে হবে একজন নেতা, সততার প্রতীক এবং একজন সংস্কারক নবী।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৯)
সূরা মরিয়মে বলা হয়েছে – “হে যাকারিয়া, তোমার প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তাঁর নাম হবে ইয়াহিয়া। এ নামে কোন লোক আমি এর আগে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৭)
সূরা আল আম্বিয়াতে বলা হয়েছে, “আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছি আর তাঁকে ইয়াহিয়াকে দান করেছি আর এজন্যে তাঁর স্ত্রীকে যোগ্য করে দিয়েছিলাম গর্ভ ধারণ করার জন্যে। কারণ তারা কল্যাণের কাজে আপ্রাণ চেষ্টা করত, ভয় আর আশা নিয়ে আমাকে ডাকত এবং আমার প্রতি ছিল তারা অবনত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯০)
এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ কুদরতে বৃদ্ধ পিতা মাতার ঘরে জন্মের ব্যবস্থা করেন হযরত ইয়াহিয়ার। ইয়াহিয়া নামটি সরাসরি আল্লাহর দেয়া নাম। মহান আল্লাহই পিতা যাকারিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর পুত্রের নাম যেন ইয়াহিয়া রাখা হয়।
হযরত ইয়াহিয়া ও হযরত ঈসা আ.
হযরত ইয়াহিয়া আ. ও হযরত ঈসা আ. এর তিন বা ছয় মাসের বড়। তারা ছিলেন নিকটাত্মীয় এবং পরস্পরের বন্ধু। তারা একজন আরেকজনকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। বয়স ত্রিশ বছর হবার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়া আ. কে নবুয়ত দান করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, সত্যপন্থী, আল্লাহভীরু এবং পবিত্র জীবনের অধিকারী। হযরত ইয়াহিয়া আ. ছিলেন হযরত ঈসা আ. এর সত্যায়নকারী। হযরত ঈসা ছিলেন আল্লাহর বিশেষ নির্দেশ (কালেমা)। আল্লাহর নির্দেশে পিতা ছাড়াই তাঁর জন্ম হয়। লোকেরা তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে থাকে। হযরত ইয়াহিয়া আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈসা আ. এর বিষয়ে সত্য তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, আল্লাহর নির্দেশে বিনা পিতাই ঈসার জন্ম হয়েছে। তিনি আল্লাহর দাস ও রাসূল। আপনারা ঈসাকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে গ্রহণ করুন এবং তাঁর আনুগত্য করুন।
পাঁচটি কাজের নির্দেশ
হযরত ইয়াহিয়া আ. ছোট বেলা থেকেই সব সময় আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। আল্লাহর প্রতি বিনয়, আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে অনেক উন্নত করেন। এরি মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নির্দেশ দেন, “হে ইয়াহিয়া, আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২)
এখানে আল্লাহর কিতাব বলতে তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে তাওরাতের বিধান কায়েম করতে এবং মানুষকে এ কিতাবের বিধান মতো জীবন যাপন করবার আহবান জানাতে নির্দেশ দেন।
তিরমিযি, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমাদে হারেস আশয়ারী থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে হুকুম দিয়েছিলেন মানুষকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে। এ হাদিসে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা. বলেন, “আল্লাহ তায়ালা ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়াকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই পাঁচটি কাজ যেন তিনি নিজে করেন এবং বনী ইসরাইলকে করবার নির্দেশ দেন। কোন কারণে বনী ইসরাইলকে এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে তাঁর বিলম্ব হয়। ফলে হযরত ঈসা তাঁকে বললেন – আল্লাহ পাক আপনাকে পাঁচটি কাজ করতে এবং বনী ইসরাইলকে করবার জন্যে নির্দেশ দিতে বলেছেন। সে নির্দেশ কি আপনি তাঁদের পৌছাবেন না আমি পৌছাবো? ইয়াহিয়া আ. বললেন- হে ভাই, আমার আশংকা হয়, আপনি যদি আমার আগে পৌঁছান তাহলে আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিবেন বা জমিনের নীচে ধসিয়ে দিবেন।
অতঃপর তিনি বনী ইসরাইলকে বাইতুল মাকদাসে সমবেত করলেন। মানুষে মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি মসজিদের মিম্বরে উঠলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী করলেন এবং বললেন – হে জনগণ, আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি নিজে সেগুলো পালন করি এবং তোমাদেরকেও সেগুলো পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেগুলো হলো –
১. তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর আনুগত্য এবং দাসত্ব করবে। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করবে না।
২. তোমাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সালাত কায়েম করতে।
৩. তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সিয়াম পালন করতে।
৪. তিনি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন দান করতে।
৫. তিনি তোমাদের আরো নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর স্মরণে তোমাদের জবানকে সিক্ত রাখতে।
হযরত ইয়াহিয়া আ. অত্যন্ত মানব দরদী নবী। আল কুরআনে তাঁর একটি মহৎ গুণের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, “আমি নিজের পক্ষ থেকে তাঁকে দান করেছি হৃদয়ের কোমলতা।” (আল কুরআন ১৯ ; ২৩)
দাওয়াত দান, পাপ কাজে বাধাদান ও শাহাদাৎ
হযরত ইয়াহিয়া আ. বনী ইসরাইলকে শিরক, বিদআত ও যাবতীয় মন্দ কাজ ত্যাগ করার দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁদেরকে শুধু এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে এবং সততার সাথে চলতে আহবান জানাতে থাকেন। তিনি ট্রান্স জর্ডান এলাকায় তাঁর দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারণ করেন। মানুষকে তিনি পাপ কাজ থেকে তওবা করাতেন এবং যারা তওবা করতেন তাঁদেরকে ব্যাপটাইজ বা গোসল করাতেন। সেজন্যে তিনি ব্যাপটিষ্ট ইয়াহিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। হযরত ইয়াহিয়ার সময় ইহুদীদের শাসক ছিল হিরোদ এন্টিপাস। হিরোদ ইহুদী সমাজে রোমীয় নগ্ন সভ্যতার সয়লাব বিয়ে দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে যিনা, ব্যাভিচার, নগ্নতা, বেহায়াপনতা ও চরিত্রহীনতার প্রসার ঘটানো হতে থাকে। হিরোদ নিজেই ব্যাভিচার ও পাপাচারে লিপ্ত হয়। হযরত ইয়াহিয়া তাঁর অনৈতিক পাপাচারের প্রতিবাদ করতে থাকেন। হিরোদ নিজের অবস্থা বেগতিক দেখে হযরত ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে ফেলে রাখে। চরিত্রহীনরা দেখলো, হযরত ইয়াহিয়া মানুষের মাঝে সৎকর্ম ও পবিত্র জীবন যাপনের যে চেতনা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ফলে মানুষ তাঁদের চরমভাবে ঘৃণা করছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বেড়েই চলেছে মানুষের ক্ষোভ। কারণ মানুষ দেখলো, আল্লাহর নবীকে আটকে রাখা হয়েছে কারাগারে আর পাপিষ্ঠদের লালন করছে সরকার। এমতাবস্থায় শাসক হিরোদ তাঁর এক পালিত নর্তকীর আবদারে হত্যা করলো আল্লাহর নবী হযরত ইয়াহিয়া –কে। তাঁর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে উপহার দিলো নর্তকীকে। এভাবেই বনী ইসরাইলের বদবখত লোকেরা একের পর এক আল্লাহর নবীকে হত্যা করে। এদের সম্পর্কেই আল কুরআনে বলা হয়েছে, “যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে হত্যা করে আল্লাহর নবীদেরকে আর ঐ সব লোকদেরকে যারা ন্যায় ও সুবিচারের নির্দেশ দেয়, এসব অপরাধীদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২১)
আমাদের নবীর সাথে সাক্ষাত
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর যখন মে’রাজ হয়, তখন তাঁর সাথে হযরত ইয়াহিয়া আ. এর সাক্ষাত হয়। হযরত জিবরীলের সাথে প্রিয় নবী আকাশ পেরিয়ে উপরে উঠছিলেন।
তিনি বলেন, “অতঃপর যখন দ্বিতীয় আকাশে পৌঁছলাম দেখলাম, সেখানে ইয়াহিয়া ও ঈসা। তারা দু’জন পরস্পর খালাতো ভাই। জিবরীল আমাকে বললেন – এরা ইয়াহিয়া ও ঈসা এদের সালাম করুন। আমি তাঁদের সালাম করলাম। তারা সালামের জবাব দিয়ে বললেন- মারহাবা- স্বাগতম হে আমাদের মহান ভাই ও মহান নবী।” (সহীহ বুখারী)
আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়া আ.
আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়ার নাম উল্লেখ হয়েছে পাঁচবার। যেসব আয়াতে উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হল- সূরা আলে ইমরান ; ৩৯। সূরা আল আনয়াম ; ৮৫। সূরা মরিয়ম ; ৭, ১২। সূরা আল আম্বিয়া ; ৯০। কুরআন মজিদে হযরত ইয়াহিয়া আ. এর মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, “আমি শৈশবেই তাঁকে প্রজ্ঞা দান করেছি এবং দান করেছি নিজের পক্ষ থেকে কোমলতা ও পবিত্রতা। সে ছিল খুবই আল্লাহভীরু আর বাবা মার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। সে উদ্যত ছিল না আবার অবাধ্যও ছিল না। তাঁর প্রতি সালাম যেদিন তাঁর জন্ম হয় যেদিন তাঁর মরণ হয় এবং যেদিন উঠানো হবে তাঁকে জীবিত করে। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২-১৫)
।
হযরত ঈসা আ.
হযরত ঈসা আ. ছিলেন বনু ইসরাঈল বংশের সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল। তিনি ‘ইনজীল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁরপর থেকে শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আর কোন নবী আগমন করেননি। এই সময়টাকে ‘রাসূল আগমনের বিরতিকাল’ বলা হয়। ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত কাল পূর্বে হযরত ঈসা আ. আল্লাহর হুকুমে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং মুহাম্মাদী শরী‘আত অনুসরণে ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন। তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর সাথে বিশ্ব সংস্কারে ব্রতী হবেন। তাই তাঁর সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তৃত ধারণা দেওয়া অত্যন্ত জরূরী বিবেচনা করে আল্লাহ পাক শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, মূসা আ.-এর অনুসারী হওয়ার দাবীদার ইহুদীরা তাঁকে নবী বলেই স্বীকার করেনি। অন্যদিকে হযরত ঈসা আ.-এর ভক্ত ও অনুসারী হবার দাবীদার খৃষ্টানরা বাড়াবাড়ি করে তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ (তওবাহ, আয়াত ৩০) বানিয়েছে’। বরং ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানরা তাঁকে সরাসরি ‘আল্লাহ’ সাব্যস্ত করেছে এবং বলেছে যে, তিনি হ’লেন তিন আল্লাহর একজন (মায়েদাহ, আয়াত ৭৩)। অর্থাৎ ঈসা, মারিয়াম ও আল্লাহ প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তারা এটাকে ‘বুদ্ধি বহির্ভূত সত্য’ বলে ক্ষান্ত হয়। অথচ এরূপ ধারণা পোষণকারীদের আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘কাফের’ বলে ঘোষণা করেছেন (মায়েদাহ, আয়াত ৭২-৭৩)। কুরআন তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছে। আমরা এখন সেদিকে মনোনিবেশ করব।
উল্লেখ্য যে, হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ১৫টি সূরায় ৯৮টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত ঈসা আ.-এর মা ও নানী
হযরত ঈসা আ.-এর আলোচনা করতে গেলে তাঁর মা ও নানীর আলোচনা আগেই করে নিতে হয়। কারণ তাঁদের ঘটনাবলীর সাথে ঈসা আ. এর জীবনের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের শরীয়তে প্রচলিত ইবাদত-পদ্ধতির মধ্যে আল্লাহর নামে সন্তান উৎসর্গ করার রেওয়াজও চালু ছিল। এসব উৎসর্গীত সন্তানদের পার্থিব কোন কাজকর্মে নিযুক্ত করা হ’ত না। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ঈসার নানী অর্থাৎ ইমরানের স্ত্রী নিজের গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে মানত করলেন যে, তাকে বিশেষভাবে আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে নিয়োজিত করা হবে। তিনি ভেবেছিলেন যে পুত্র সন্তান হবে। কিন্তু যখন তিনি কন্যা সন্তান প্রসব করলেন, তখন আক্ষেপ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কন্যা প্রসব করেছি’? (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অর্থাৎ একে দিয়ে তো আমার মানত পূর্ণ হবে না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তিনি উক্ত কন্যাকেই কবুল করে নেন। বস্ত্ততঃ ইনিই ছিলেন মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা আ.-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাউনের স্ত্রী’।
মারিয়ামের জন্ম ও লালন–পালন
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের মা দো‘আ করে বলল, হে আল্লাহ!) আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’।আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫-৩৭)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া আ. মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৪)।
হযরত ঈসা আ. এর জন্ম ও লালন–পালন
এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া আ. সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল আ. উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
(হে মুহাম্মদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিবরাঈল আ.কে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬-২১)। অতঃপর হযরত জিবরাঈল আ. মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া, আয়াত ৯১ ; তাহরীম, আয়াত ১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)।
অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম, আয়াত ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য সিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম, আয়াত ২২-২৬)।
উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরীয়তে সম্ভবতঃ সিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া আ.-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন সিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম, আয়াত ১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম, আয়াত ২৬)।
আলোচনা
১. যেহেতু হযরত ঈসা আ.-এর জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অলৌকিক, তাই তার গর্ভধারণের মেয়াদ স্বাভাবিক নিয়মের বহির্ভূত ছিল বলেই ধরে নিতে হবে। নয় মাস দশদিন পরে সন্তান প্রসব শেষে চল্লিশ দিন ‘নেফাস’ অর্থাৎ রজঃস্রাব হ’তে পবিত্রতার মেয়াদও এখানে ধর্তব্য না হওয়াই সমীচীন। অতএব ঈসা আ. কে গর্ভধারণের ব্যাপারটাও যেমন নিয়ম বহির্ভূত, তার ভূমিষ্ট হওয়া ও তার মায়ের পবিত্রতা লাভের পুরা ঘটনাটাই নিয়ম বহির্ভূত এবং অলৌকিক। আর এটা আল্লাহর জন্য একেবারেই সাধারণ বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম হবে, মাকে দশ মাস গর্ভধারণ করতে হবে ইত্যাদি নিয়ম আল্লাহরই সৃষ্টি এবং এই নিয়ম ভেঙ্গে সন্তান দান করাও তাঁরই এখতিয়ার। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে ঈসার দৃষ্টান্ত হ’ল আদমের মত। তাকে তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন এবং বলেন, হয়ে যাও ব্যস হয়ে গেল’।‘যা তোমার প্রভু আল্লাহ বলেন, সেটাই সত্য। অতএব তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’’ (আলে ইমরান, আআয়ত ৫৯-৬০)। অর্থাৎ আদমকে যেমন পিতা-মাতা ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসাকে তেমনি পিতা ছাড়াই শুধু মায়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এটাই যে সত্য এবং এর বাইরে যাবতীয় জল্পনা-কল্পনা যে মিথ্যা, সে কথাও উপরোক্ত আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, যে বনু ইস্রাঈলের নবী ও রাসূল হয়ে ঈসা আ.-এর আগমন ঘটলো, সেই ইহুদী-নাসারারাই আল্লাহর উক্ত ঘোষণাকে মিথ্যা বলে গণ্য করেছে। অথচ এই হতভাগারা মারিয়ামের পূর্বদিকে যাওয়ার অনুসরণে পূর্বদিককে তাদের ক্বিবলা বানিয়েছে।
২. এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মারিয়ামকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দিতে বলা হয়েছে, যাতে সুপক্ক খেজুর নীচে পতিত হয়। এটাতে বুঝা যায় যে, ওটা ছিল তখন খেজুর পাকার মৌসুম অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। আর খৃষ্টানরা কথিত যীশু খৃষ্টের জন্মদিন তথা তাদের ভাষায় X-mas Day বা বড় দিন উৎসব পালন করে থাকে শীতকালে ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে। অথচ এর কোন ভিত্তি তাদের কাছে নেই।
এর পরের ঘটনা আমরা সরাসরি কুরআন থেকে বিবৃত করব। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর মারিয়াম তার সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল। তারা বলল, হে মারিয়াম! তুমি একটা আশ্চর্য বস্ত্ত নিয়ে এসেছ’।‘হে হারূণের বোন! তোমার পিতা কোন অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না কিংবা তোমার মাতাও কোন ব্যভিচারিণী মহিলা ছিলেন না’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৭-২৮)। কওমের লোকদের এ ধরনের কথা ও সন্দেহের জওয়াবে নিজে কিছু না বলে বিবি মারিয়াম তার সদ্য প্রসূত সন্তানের দিকে ইশারা করলেন। অর্থাৎ একথার জবাব সেই-ই দিবে। কেননা সে আল্লাহর দেওয়া এক অলৌকিক সন্তান, যা কওমের লোকেরা জানে না। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর মারিয়াম ঈসার দিকে ইঙ্গিত করল। তখন লোকেরা বলল, কোলের শিশুর সাথে আমরা কিভাবে কথা বলব?। ঈসা তখন বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে’। ‘এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি’। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হব’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৯-৩৩)।
ঈসার উপরোক্ত বক্তব্য শেষ করার পর সংশয়বাদী ও বিতর্ককারী লোকদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন, ‘ইনিই হ’লেন মারিয়াম পুত্র ঈসা। আর ওটাই হ’ল সত্যকথা (যা উপরে বর্ণিত হয়েছে), যে বিষয়ে লোকেরা (অহেতুক) বিতর্ক করে থাকে’।‘আল্লাহ এমন নন যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন (যেমন অতিভক্ত খৃষ্টানরা বলে থাকে যে, ঈসা ‘আল্লাহর পুত্র’)। তিনি মহাপবিত্র। যখন তিনি কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, হও! ব্যস, হয়ে যায়’।‘ঈসা আরও বলল, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। (মনে রেখ) এটাই হ’ল সরল পথ’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৪-৩৬)।
কিন্তু সদ্যপ্রসূত শিশু ঈসার মুখ দিয়ে অনুরূপ সারগর্ভ কথা শুনেও কি কওমের লোকেরা আশ্বস্ত হ’তে পেরেছিল? কিছু লোক আশ্বস্ত হ’লেও অনেকে পারেনি। তারা নানা বাজে কথা রটাতে থাকে। তাদের ঐসব বাক-বিতন্ডার প্রতি ইঙ্গিত করেই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল বিভিন্ন (মত ও পথে) বিভক্ত হয়ে গেল (দুনিয়াতে যার শেষ হবে না)। অতএব ক্বিয়ামতের মহাদিবস আগমন কালে অবিশ্বাসী কাফিরদের জন্য ধ্বংস’।‘সেদিন তারা চমৎকারভাবে শুনবে ও দেখবে, যেদিন তারা সবাই আমাদের কাছে আগমন করবে। কিন্তু আজ যালেমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে রয়েছে’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৭-৩৮)।
মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্য
আল্লাহ পাক নিজেই মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ‘তিনি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ইমরান তনয়া মারিয়ামের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ হ’তে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাব সমূহকে সত্যে পরিণত করেছিল এবং সে ছিল বিনয়ীদের অন্যতম’ (তাহরীম, আয়াত ১২)।
মারিয়ামের বৈশিষ্ট্য সমূহ
১. তিনি ছিলেন বিশ্ব নারী সমাজের শীর্ষস্থানীয়া এবং আল্লাহর মনোনীত ও পবিত্র ব্যক্তিত্ব (আলে ইমরান, আয়াত ৪২)।
২. তিনি ছিলেন সর্বদা আল্লাহর উপাসনায় রত, বিনয়ী, রুকুকারিণী ও সিজদাকারিণী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৩)।
৩. তিনি ছিলেন সতীসাধ্বী এবং আল্লাহর আদেশ ও বাণী সমূহের বাস্তবায়নকারিণী (তাহরীম, আয়াত ১২)।
৪. আল্লাহ নিজেই তার নাম রাখেন ‘মারিয়াম’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অতএব তিনি ছিলেন অতীব সৌভাগ্যবতী।
হযরত ঈসা আ.-এর বিশেষ গুণাবলী
১. তিনি ছিলেন বিনা পিতায় পয়দা বিশ্বের একমাত্র নবী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। ২. আল্লাহ স্বয়ং যার নাম রাখেন মসীহ ঈসা রূপে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)।৩. তিনি শয়তানের অনিষ্টকারিতা হ’তে মুক্ত ছিলেন (ঐ,আয়াত ৩৬-৩৭)। ৪. দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি ছিলেন মহা সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর একান্ত প্রিয়জনদের অন্যতম (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)। ৫. তিনি মাতৃক্রোড়ে থেকেই সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন (মারিয়াম, আয়াত ২৭-৩৩; আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। ৬. তিনি বনু ইস্রাঈলগণের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯) এবং শেষনবী ‘আহমাদ’-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন (ছফ, আয়াত ৬)। ৭. তাঁর মোজেযা সমূহের মধ্যে ছিল- ক. তিনি মাটির তৈরী পাখিতে ফুঁক দিলেই তা জীবন্ত হয়ে উড়ে যেত, খ. তিনি জন্মান্ধকে চক্ষুষ্মান ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতে পারতেন, গ. তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন, ঘ. তিনি বলে দিতে পারতেন মানুষ বাড়ি থেকে যা খেয়ে আসে এবং যা সে ঘরে সঞ্চিত রেখে আসে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯; মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।
৮. তিনি আল্লাহর কিতাব ইনজীল প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। তবে তওরাতে হারামকৃত অনেক বিষয়কে তিনি হালাল করেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)।৯. তিনি ইহুদী চক্রান্তের শিকার হয়ে নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ফলে আল্লাহ তাঁকে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫২, ৫৪-৫৫; নিসা, আয়াত ১৫৮)। শত্রুরা তাঁরই মত আরেকজনকে সন্দেহ বশে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে এবং তারা নিশ্চিতভাবেই ঈসাকে হত্যা করেনি’ (নিসা, আয়াত ১৫৭)। ১০. তিনিই একমাত্র নবী, যাকে আল্লাহ জীবিত অবস্থায় দুনিয়া থেকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে তিনি পুনরায় সশরীরে দুনিয়াতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জাল, ক্রুশ, শূকর প্রভৃতি ধ্বংস করবেন। অতঃপর ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন।
হযরত ঈসা আ.-এর কাহিনী
সাধারণতঃ সকল নবীই ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছেন। তবে ঈসা আ. তার কিছু পূর্বেই নবুয়ত ও কিতাব প্রাপ্ত হন। কেননা বিভিন্ন রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আকাশে তুলে নেবার সময় তাঁর বয়স ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে ছিল। তিনি যৌবনে আকাশে উত্তোলিত হয়েছিলেন এবং পৌঢ় বয়সে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিবেন।
হযরত ঈসা আ.-এর দাওয়াত
ঈসা আ. নবুয়ত লাভ করার পর স্বীয় কওমকে প্রধানতঃ নিম্নোক্ত ৭টি বিষয়ে দাওয়াত দিয়ে বলেন, ‘হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের নিকটে আগমন করেছি ১. আল্লাহর রাসূল হিসাবে, ২. আমার পূর্ববর্তী তওরাত কিতাবের সত্যায়নকারী হিসাবে এবং ৩. আমার পরে আগমনকারী রাসূলের সুসংবাদ দানকারী হিসাবে, যার নাম হবে আহমাদ’… (ছফ, আয়াত ৬)। তিনি বললেন, ‘৪. নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। এটাই সরল পথ’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৬)।
তিনি বললেন, ‘আমার আনীত এ কিতাব (ইনজীল) পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতকে সত্যায়ন করে এবং এজন্য যে, ৫. আমি তোমাদের জন্য হালাল করে দেব কোন কোন বস্ত্ত, যা তোমাদের জন্য হারাম ছিল। আর ৬. আমি তোমাদের নিকটে এসেছি তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সহ। অতএব ৭. তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)।
এটার ব্যাখ্যা এসেছে অন্য আয়াতে যে, ‘বস্ত্ততঃ ইহুদীদের পাপের কারণে আমরা তাদের উপরে হারাম করেছিলাম বহু পবিত্র বস্ত্ত, যা তাদের জন্য হালাল ছিল। এটা ছিল ১. আল্লাহর পথে তাদের অধিক বাধা দানের কারণে’। ‘এবং এ কারণে যে, ২. তারা সূদ গ্রহণ করত। অথচ এ ব্যাপারে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, ৩. তারা অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করত। বস্ত্ততঃ আমরা কাফিরদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি’’ (নিসা, আয়াত ১৬০-১৬১)। তিনি আরও বলেন, ‘এবং ইহুদীদের জন্য আমরা ১. প্রত্যেক নখবিশিষ্ট পশু হারাম করেছিলাম এবং ২. ছাগল ও গরু থেকে এতদুভয়ের চর্বি আমরা তাদের জন্য হারাম করেছিলাম। কিন্তু ঐ চর্বি ব্যতীত যা পৃষ্ঠে কিংবা অন্ত্রে সংযুক্ত থাকে অথবা অস্থির সাথে মিলিত থাকে। তাদের অবাধ্যতার কারণে আমরা তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আর আমরা অবশ্যই সত্যবাদী’ (আন‘আম, আয়াত ১৪৬)।
হযরত ঈসা আ.-এর পেশকৃত পাঁচটি নিদর্শন
তাওহীদ ও রিসালাতের উপরে ঈমান আনার দাওয়াত দেওয়ার পরে তিনি বনু ইস্রাঈলকে তাঁর আনীত নিদর্শন সমূহ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। (যেমন-) ১.) আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা পাখির আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুঁক দেই, তখন তা উড়ন্ত পাখিতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। ২. আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং ৩. ধবল-কুষ্ঠ রোগীকে। ৪. আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। ৫. আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯)।
উল্লেখ্য যে, যখন যে দেশে যে বিষয়ের আধিক্য ও উৎকর্ষ থাকে, তখন সেই দেশে সেই বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যুৎপত্তি সহ নবী প্রেরণ করা হয়। যেমন মূসার সময় মিসরে ছিল জাদুবিদ্যার প্রাদুর্ভাব। ফলে আল্লাহ তাঁকে লাঠির মো‘জেযা দিয়ে পাঠালেন। অনুরূপভাবে ঈসা আ.-এর সময়ে শাম বা সিরিয়া এলাকা ছিল চিকিৎসা বিদ্যায় সেরা। সেকারণ ঈসা আ.কে আল্লাহ উপরে বর্ণিত অলৌকিক ক্ষমতা ও মো‘জেযা সমূহ দিয়ে পাঠান। যেমন শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর সময়ে আরবরা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোচ্চ অলংকারে ভূষিত ছিল। ফলে কুরআন তাদের সামনে হতবুদ্ধিকারী মো‘জেযা রূপে নাযিল হয়। যাতে আরবের স্বনামখ্যাত কবিরা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।
দাওয়াতের ফলশ্রুতি
হযরত ঈসা আ.-এর মো‘জেযা সমূহ দেখে এবং তাঁর মুখনিঃসৃত তাওহীদের বাণী শুনে গরীব শ্রেণীর কিছু লোক তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হ’লেও দুনিয়াদার সমাজ নেতারা তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে। কারণ তাওহীদের সাম্য বাণী সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী নেতাদের স্বার্থেই প্রথম আঘাত হেনে থাকে। শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দেয়। ফলে তারা ঈসা আ.-এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়।
বিগত নবীগণের ন্যায় বনু ইস্রাঈলগণ তাদের বংশের শেষ নবী হযরত ঈসা আ.-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্ত শুরু করে। তারা প্রথমেই ঈসা আ.-কে ‘জাদুকর’ বলে আখ্যায়িত করে। যেমন আল্লাহ বলেন, (হে ঈসা!) ‘যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফের তারা বলল, এটা প্রকাশ্য জাদু ব্যতীত কিছুই নয়’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।
উক্ত অপবাদে ঈসা আ. ক্ষান্ত না হয়ে বরং আরও দ্বিগুণ বেগে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যেতে থাকেন। তখন বিরোধীরা বেছে নেয় অতীব নোংরা পথ। তারা তাঁর মায়ের নামে অপবাদ রটাতে শুরু করে। যাতে ঈসা আ. অত্যন্ত ব্যথা পেলেও নবুয়তের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবকিছু নীরবে সহ্য করতে থাকেন। ফলে ঈসা আ.-এর সমর্থক সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে, অবিশ্বাসী সমাজ নেতাদের চক্রান্ত ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবার তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল এবং সেজন্য দেশের বাদশাহকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করল। তারা অনবরত বাদশাহর কান ভারি করতে থাকে এই মর্মে যে, লোকটি আল্লাহ দ্রোহী। সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করতে সচেষ্ট। এসব অভিযোগ শুনে অবশেষে বাদশাহ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। তখন ইহুদীদের এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য আল্লাহ স্বীয় কৌশল প্রেরণ করেন এবং ঈসা আ.-কে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন।
ইহুদীদের উপর প্রেরিত গযব ও তার কারণ সমূহ
হযরত ঈসা আ. এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার কারণে আল্লাহ ইহুদী কাফিরদের উপরে নানাবিধ দুনিয়াবী গযব নাযিল করেন। তাদেরকে কেন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল- সে বিষয়ে অনেকগুলি কারণের মধ্যে আল্লাহ বলেন,
‘‘তারা যে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল, তা ছিল ১. তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে, ২. অন্যায়ভাবে রাসূলগণকে হত্যা করার কারণে এবং ৩. তাদের এই উক্তির কারণে যে, ‘আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন’…। ‘আর ৪. তাদের কুফরীর কারণে এবং ৫. মারিয়ামের প্রতি মহা অপবাদ আরোপের কারণে’। ‘আর তাদের ৬. একথার কারণে যে, ‘আমরা মারিয়াম-পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছিল, না শূলে চড়িয়েছিল। বরং তাদের জন্য ধাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছিল। বস্ত্ততঃ তারা এ ব্যাপারে নানাবিধ কথা বলে। তারা এ বিষয়ে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। শুধুমাত্র ধারণার অনুসরণ করা ব্যতীত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই নেই। আর নিশ্চিতভাবেই তারা তাকে হত্যা করেনি’। ‘বরং তাকে আল্লাহ নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর আল্লাহ হলেন মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’’ (নিসা, আয়াত ১৫৫-১৫৮)।
ইহুদীদের অভিশপ্ত হওয়ার ১০টি কারণ
সূরা নিসা ১৫৫-৬১ আয়াতে ইহুদীদের ইপর আল্লাহর গযব নাযিলের ও তাদের অভিশপ্ত হওয়ার যে কারণ সমূহ বর্ণিত হয়েছে, তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
১. তাদের ব্যাপক পাপাচার, ২. আল্লাহর পথে বাধা দান, ৩. সূদী লেনদেন, ৪. অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ, ৫. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, ৬. নবীগণকে হত্যা করা, ৭. আল্লাহর পথে আগ্রহী না হওয়া এবং অজুহাত দেওয়া যে, আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন, ৮. কুফরী করা, ৯. মারিয়ামের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ও ১০. হযরত ঈসা আ.কে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার মিথ্যা দাবী করা।
হযরত ঈসা আ.-কে হত্যার ষড়যন্ত্র ও তাঁর ঊর্ধ্বারোহণ
তৎকালীন রোম সম্রাট ছাতিয়ূনুস-এর নির্দেশে (মাযহারী) ঈসা আ.-কে গ্রেফতারের জন্য সরকারী বাহিনী ও ইহুদী চক্রান্তকারীরা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে। তারা জনৈক নরাধমকে ঈসা আ.-কে হত্যা করার জন্য পাঠায়। কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ ঈসা আ.-কে উঠিয়ে নেওয়ায় সে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু এরি মধ্যে আল্লাহর হুকুমে তার চেহারা ঈসা আ.-এর সদৃশ হয়ে যায়। ফলে ইহুদীরা তাকেই ঈসা ভেবে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে।
ইহুদী-নাসারারা কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়েই নানা কথা বলে এবং ঈসাকে হত্যা করার মিথ্যা দাবী করে। আল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে তাদের কোনই জ্ঞান নেই। তারা কেবলই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি’(নিসা, আয়াত ১৫৭)। বরং তার মত কাউকে তারা হত্যা করেছিল।
উল্লেখ্য যে, ঈসা আ. তাঁর উপরে বিশ্বাসী সে যুগের ও পরবর্তী যুগের সকল খৃষ্টানের পাপের বোঝা নিজে কাঁধে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খৃষ্টানদের দাবী স্রেফ প্রতারণা ও অপপ্রচার বৈ কিছুই নয়।
আল্লাহর পাঁচটি অঙ্গীকার
ইহুদীদের বিপক্ষে হযরত ঈসা আ. কে সাহায্যের ব্যাপারে আল্লাহ পাঁচটি ওয়াদা করেছিলেন এবং সবক’টিই তিনি পূর্ণ করেন। ১. হত্যার মাধ্যমে নয় বরং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হবে, ২. তাঁকে ঊর্ধ্বজগতে তুলে নেওয়া হবে, ৩. তাকে শত্রুদের অপবাদ থেকে মুক্ত করা হবে, ৪. অবিশ্বাসীদের বিপক্ষে ঈসার অনুসারীদেরকে ক্বিয়ামত অবধি বিজয়ী রাখা হবে এবং ৫. ক্বিয়ামতের দিন সবকিছুর চূড়ান্ত ফায়সালা করা হবে। এ বিষয়গুলি বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতে। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘‘আর স্মরণ কর যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমাকে ওফাত দিব এবং তোমাকে আমার কাছে তুলে নেব এবং তোমাকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করব। আর যারা তোমার অনুসরণ করবে, তাদেরকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করে রাখবো। অতঃপর তোমাদের সবাইকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদের মধ্যকার বিবাদীয় বিষয়ে ফায়সালা করে দেব’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫৫)।
উক্ত আয়াতে বর্ণিত অর্থ ‘আমি তোমাকে ওফাত দিব’। ‘ওফাত’ অর্থ পুরোপুরি নেওয়া। মৃত্যুকালে মানুষের আয়ু পূর্ণ হয় বলে একে ‘ওফাত’ বলা হয়। রূপক অর্থে নিদ্রা যাওয়াকেও ওফাত বা মৃত্যু বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মানুষের প্রাণ নিয়ে নেন তার মৃত্যুকালে, আর যে মরে না তার নিদ্রাকালে’ (যুমার, আয়াত ৪২)। হযরত ঈসা আ. এর অবতরণ, দাজ্জাল নিধন, পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে সহিহ ও মুতাওয়াতির হাদিস সমূহ বর্ণিত হয়েছে। প্রায় সকল বড় বড় নবীই হিজরত করেছেন। এক্ষণে পৃথিবী থেকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া, অতঃপর পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু দান করা- এটা হযরত ঈসা আ.-এর জন্য এক ধরনের হিজরত বৈ কি! পার্থক্য এই যে, অন্যান্য নবীগণ দুনিয়াতেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে হিজরত করেছেন। পক্ষান্তরে ঈসা আ. দুনিয়া থেকে আসমানে হিজরত করেছেন। অতঃপর আসমান থেকে দুনিয়াতে ফিরে আসবেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত এবং তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী।
‘হাওয়ারী’ কারা?
حَوارِىّ শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। অর্থ দেওয়ালে চুনকাম করার জন্য ধবধবে সাদা চুন। পারিভাষিক অর্থে হযরত ঈসা আ.-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হত। কেউ বলেছেন যে, নাবাত্বী ভাষায় হাওয়ারী অর্থ ধোপা। হযরত ঈসা আ. এর খাঁটি অনুসারীগণ ধোপা ছিলেন, যারা কাপড় ধৌত করতেন। পরে তারা ঐ নামেই পরিচিত হন। অথবা এজন্য তাদের উপাধি ‘হাওয়ারী’ ছিল যে, তারা সর্বদা সাদা পোষাক পরিধান করতেন। কোন কোন তাফসীরবিদ তাঁদের সংখ্যা ১২ জন বলেছেন। ঈসা আ.-এর ভক্ত সহচরগণকে যেমন ‘হাওয়ারী’ বলা হয়; শেষনবী মুহাম্মদ সা.-এর ভক্ত সহচরগণকে তেমনি ‘সাহাবী’ বলা হয়। আভিধানিক অর্থে সাহাবী অর্থ সাথী বা সহচর হলেও পারিভাষিক অর্থে রাসূল সা. ব্যতীত অন্যদের সাথীগণকে ‘সাহাবী’ বলা হয় না। কেননা এই পরিভাষাটি কেবল ঐসকল পবিত্রাত্মা ব্যক্তিগণের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন কোন সময় শুধু ‘সাহায্যকারী’ বা আন্তরিক বন্ধু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সা. একদা বলেন, ‘প্রত্যেক নবীর একজন ‘হাওয়ারী’ অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে। তেমনি আমার ‘হাওয়ারী’ হল যুবায়ের’।
ঈসা আ. যখন বনু ইসরঈলের স্বার্থবাদী নেতাদের বিরোধিতা ও চক্রান্ত বুঝতে পারলেন, তখন নিজের একনিষ্ঠ সাথীদের বাছাই করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন এবং সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আমার সত্যিকারের ভক্ত ও অনুসারী কারা? একথাটিই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্তভাবে, ‘যখন ঈসা বনু ইসরঈলের কুফরী অনুধাবণ করলেন, তখন বললেন, কারা আছ আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীগণ বলল, আমরাই আল্লাহর পথে আপনার সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছি। আপনি সাক্ষ্য থাকুন যে আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা সেই সব বিষয়ের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যা তুমি নাযিল করেছ এবং আমরা রাসূলের অনুসারী হয়েছি। অতএব তুমি আমাদেরকে মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নাও’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫২-৫৩)
অন্যত্র এসেছে এভাবে, ‘হে বিশ্বাসী গণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। যেমন মারিয়াম-তনয় ঈসা হাওয়ারীদের বলেছিল, কে আছ আল্লাহর জন্য আমাকে সাহায্যকারী? হাওয়ারীরা বলেছিল, আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। অতঃপর বনু ইসরঈলের একটি দল বিশ্বাস স্থাপন করল এবং অন্যদল প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর আমরা বিশ্বাসীদের সাহায্য করলাম তাদের শত্রুদের উপরে। ফলে তারা বিজয়ী হল’ (ছফ, আয়াত ১৪)।
অবশ্য হাওয়ারীদের এই আনুগত্য প্রকাশের ক্ষমতা আল্লাহ দান করেছিলেন তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে। যেমন তিনি বলেন, ‘আর যখন আমি হাওয়ারীদের মনে জাগ্রত করলাম যে, আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তখন তারা বলল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১১)।
বস্ত্ততঃ শত্রুদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে হযরত ঈসা আ. তাঁর অনুসারীগণের প্রতি উপরোক্ত আহবান জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে বার জন ভক্ত অনুসারী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। অতঃপর তারাই হযরত ঈসা আ.-এর ঊর্ধ্বারোহণের পরে ঈসায়ী ধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যদিও পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে বহু ভেজাল ঢুকে পড়ে এবং তারা বহু দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আজও বিশ্ব খৃষ্টান সমাজ রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্ট্যান্ট নামে প্রধান দু’দলে বিভক্ত। যাদের রয়েছে অসংখ্য উপদল।
ইমাম বাগাভী (রহঃ) সূরা ছফ ১৪ আয়াতের তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ঈসা আ.-এর ঊর্ধ্বারোহণের পর খৃষ্টান জাতি তিন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল তাকে ‘আল্লাহ বলে। একদল তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে এবং একদল তাকে ‘আল্লাহর দাস ও রাসূল’ বলে। প্রত্যেক দলের অনুসারী দল ছিল। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ বাড়তে থাকে। অতঃপর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমন ঘটে এবং তিনি মুমিনদের দলকে সমর্থন দেন। ফলে তারাই দলীলের ভিত্তিতে জয়লাভ করে। বলা বাহুল্য মুমিন ঈসায়ীগণ সবাই ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। ‘বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ সাহায্য করলেন ও তারা বিজয়ী হল’ বলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে। যারা ঈসা ও মুহাম্মদ উভয় নবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং অবিশ্বাসী কাফের মুশরিকদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে বিজয়ী হয়েছেন।
আসমান থেকে খাঞ্চা ভর্তি খাদ্য অবতরণ
হযরত মূসা আ.এর উম্মতগণের জন্য আল্লাহ আসমান থেকে মান্না ও সালওয়ার জান্নাতী খাবার নামিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদা হাওয়ারীগণ ঈসা আ.-এর নিকটে অনুরূপ দাবী করে বসলো। বিষয়টির কুরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন হাওয়ারীরা বলল, হে মারিয়াম-পুত্র ঈসা! আপনার পালনকর্তা কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করে দিবেন? তিনি বললেন, যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে আল্লাহকে ভয় কর’। ‘তারা বলল, আমরা তা থেকে খেতে চাই, আমাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে এবং আমরা জেনে নিব যে, আপনি সত্য বলেছেন ও আমরা সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাব’। ‘তখন মরিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন। তা আমাদের জন্য তথা আমাদের প্রথম ও পরবর্তী সবার জন্য আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ হতে একটি নিদর্শন হবে। আপনি আমাদের রূযী দান করুন। আপনিই শ্রেষ্ঠ রূযীদাতা’। ‘আল্লাহ বললেন, নিশ্চয়ই আমি সে খাঞ্চা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করব। অতঃপর যে ব্যক্তি অকৃতজ্ঞ হবে, আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতে অপর কাউকে দেব না’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১২-১১৫)।
উল্লেখ্য যে, উক্ত খাদ্য সঞ্চিত রাখা নিষিদ্ধ ছিল। তিরমিযীর একটি হাদিসে আম্মার বিন ইয়াসির রা. হতে বর্ণিত হয়েছে যে, উক্ত খাদ্যভর্তি খাঞ্চা আসমান হতে নাযিল হয়েছিল এবং হাওয়ারীগণ তৃপ্তি ভরে খেয়েছিল। কিন্তু লোকদের মধ্যে কিছু লোক তা সঞ্চিত রেখেছিল। ফলে তারা বানর ও শূকরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।
হযরত ঈসা আ.-এর অনুসারীদের কুফরী এবং ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে ঈসা আ.-এর কথোপকথন
হযরত ঈসা আ.-এর ঊর্ধ্বারোহণের ফলে ঈসায়ীদের মধ্যে যে আক্বীদাগত বিভ্রান্তি দেখা দেয় এবং তারা যে কুফরীতে লিপ্ত হয়, সে বিষয়ে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন ঈসা আ.কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহ বলবেন, হে মরিয়াম-তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদের বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর? ঈসা বলবেন, আপনি মহাপবিত্র। আমার জন্য শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোন অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই তা জানেন। বস্ত্ততঃ আপনি আমার মনের কথা জানেন, কিন্তু আমি জানি না কি আপনার মনের মধ্যে আছে। নিশ্চয়ই আপনি অদৃশ্য বিষয়ে অবগত’। ‘আমি তো তাদের কিছুই বলিনি, কেবল সে কথাই বলেছি যা আপনি বলতে বলেছেন যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। বস্ত্ততঃ আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম, যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। আপনি সকল বিষয়ে পূর্ণ অবগত’। ‘এক্ষণে যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞ’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১৬-১১৮)।
এ কথোপকথনটি ক্বিয়ামতের দিন হবে। যার আগে আসমান থেকে অবতরণের পর দুনিয়ায় তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে যাবে।
হযরত ঈসা আ.-এর কাহিনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
হযরত ঈসা আ.-এর নবুয়তী জীবন থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ জানতে পারি। যেমন-
১. সবকিছু মানবীয় জ্ঞান দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। বরং সর্বদা এলাহী সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসী ও আকাংখী থাকতে হয়। যেমন মারিয়াম ও তৎপুত্র ঈসা আ. এর জীবনের প্রতিটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।
২. যারা নিঃস্বার্থভাবে সমাজের কাজ করেন ও পরকালীন মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করেন, স্বার্থপর ও দুনিয়া পূজারীরা তাদের শত্রু হয় এবং পদে পদে বাধা দেয়। কিন্তু সাথে সাথে একদল নিঃস্বার্থ সহযোগীও তারা পেয়ে থাকেন। যেমন হযরত ঈসা আ. পেয়েছিলেন।
৩. দুনিয়াবী সংঘাতে দুনিয়াদারদের পার্থিব বিজয় হলেও চূড়ান্ত বিচারে তাদের পরাজয় হয় এবং তারা ইতিহাসে সর্বাধিক নিন্দিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে নবী ও সমাজ সংস্কারকগণ নির্যাতিত হলেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই বিজয়ী হন এবং সারা বিশ্ব তাদেরই ভক্ত ও অনুসারী হয়। হযরত ঈসা আ.এর জীবন তারই অন্যতম প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল কুরআনে শ্রেষ্ঠ নবী রাসূলগণের সাথে হযরত ঈসা আ. এর নাম উল্লেখ হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদার রাসূল। আল কুরআনে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে ২৫ বার। যে সব সূরায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হল, আল বাকারা, আয়াত ৮৭, ১৩৬, ২৫৩। আলে ইমরান ; ৪৫, ৫২, ৫৫, ৫৯, ৮৪। আন নিসা ; ১৫৭, ১৬৩, ১৭১। আল মায়িদা ; ৪৬, ৭৮, ১১০, ১১২, ১১৪, ১১৬। আল আনয়াম ; ৮৫। মরিয়ম ; ৩৪। আল আহযাব ; ৭। আশ শুরা ; ১৩। যুখরুফ ; ৬৩। আল হাদিদ ; ২৭। আস সফ ; ৬, ১৪।
।
হযরত আহমদ মুসতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সা.
নবুয়্যতের ধারা একটি কড়ির মালার মতো। এ মালার প্রথম কড়ির নাম আলম এবং শেষ কড়ির নাম মুহাম্মদ। এ দুইটি কড়ির মাঝে রয়েছে শত শত হাজার হাজার কড়ি।
১. অনন্য তিন বৈশিষ্ট্য
মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সা. কে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্যসব নবী রাসূলদের দান করেননি। সে তিন বৈশিষ্ট্য হলো –
১. সর্বশেষ নবী । তাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা নবুয়তের ধারা শেষ করেছেন। তাঁর নবুয়্তী আদর্শই কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরণীয়।
২. মহান আল্লাহ তাঁকে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্তকার সকল মানুষের নবী ও রাসূল নিযুক্ত করেছেন।
৩. সমগ্র মানব জাতির জন্যে রহমত ও আশীর্বাদ। তাঁকে পাঠানো হয়েছে রহমত, আশীর্বাদ ও অনুকম্পা স্বরূপ সমগ্র মানব জাতির জন্যে। এ তিনটি বিষয়ের প্রমাণ হল আল কুরআনের নিম্নোক্ত তিন আয়াত-
১. মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা আহযাব, আয়াত ৪০)
২. আমরা অবশ্যি তোমাকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছি সমগ্র মানব জাতির জন্যে সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। তবে অধিকাংশ মানুষই এলেম রাখে না। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)
৩. হে মুহাম্মদ, আমরা তোমাকে রাসূল মনোনীত করে পাঠিয়েছি সমগ্র জগতবাসীর জন্যে রহমত (অনুকম্পা ও আশীর্বাদ) হিসেবে। (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)
২. জীবনকাল
হযরত মুহাম্মদ সা. এর জীবনকাল পূর্বকালের নবীগনের জীবনকালের মতো অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট নয়। ইতিহাসে তাঁর জীবনকাল জ্ঞাত ও সুস্পষ্ট। হযরত ঈসা আ. এর পরে তাঁর জন্ম হয়েছে। ঈসা আ. এর জন্ম সাল থেকে খ্রিষ্ট সাল চালু হয়েছে। মুহাম্মদ সা. এর জীবনকালের হিসাব রাখা হয়েছে চন্দ্রমাসের হিসেবে। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা সেটাকে খৃষ্ট বর্ষের সাথে সংযুক্ত করেছেন। সে হিসেবে তাঁর জন্ম তারিখ হল ৯ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, ২২ শে এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস ষোলো দিন, তখন তিনি নবুয়ত লাভ করেন। এটা ছিলো ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। চন্দ্রমাস ছিল রমযান। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।
তাঁর ওফাত হয়েছিল সোমবার। এটা ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরি, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ। জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত মুহাম্মদ সা. এর জীবনকাল ছিল ৬৩ বছর। নবুয়ত ছিল ২৩ বছর। নবুয়ত পূর্ব জীবন ছিল ৪০ বছর। ফলে তাঁর জীবনকাল একেবারেই সুস্পষ্ট।
৩. জন্মস্থান ও বংশ
হযরত মুহাম্মদ সা. এর জন্মস্থান মক্কায়। এটি একটি প্রাচীন শহর। মক্কা বর্তমানে সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। এটি লোহিত সাগরের পূর্ব তীরের জেদ্দা নদী বন্দর থেকে পঞ্চাশ মাইল পূর্বে অবস্থিত। চৌদ্দ শত বছর পূর্বের মক্কা ছিল তরুলতা বিহীন পাহাড় টিলা আর পাথর কংকরময় এক মরু শহর। তখন তাঁদের প্রধান ফসল ছিল খেজুর, কোন কোন এলাকায় আঙ্গুর ও যব। শহরটি প্রধানত ছিল ব্যবসা ও আমদানী নির্ভর। এছাড়া এখানকার লোকেরা উট ও মেষ পালন করত। আর ঘোড়া ছিল তাঁদের বাহাদুরীর প্রতীক।
খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছরেরও কিছু আগের কথা। তখন মক্কায় কোন মানুষ বসবাস করত না। এটি ছিল জনমানবহীন পাথর পর্বতের এক ভুতুরে নির্জনভূমি। তখন নবী ইব্রাহিম আ. তাঁর দুই পুত্রের এক পুত্রকে এখানে পুনর্বাসন করেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল ইসমাঈল আ.।
অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম ও ইসমাঈল আ. মক্কার বুকে নির্মাণ করেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে ইসমাঈলের বংশধর। বাইরের কিছু লোকও এই শহরের আসে পাশে এসে বসবাস করতে থাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে মক্কা নগরী। হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের বংশধরেরা পরবর্তীতে কুরাইশ বংশ নামে খ্যাতি অর্জন করে। এ বংশেরই একটি শাখার নাম বনু হাশেম। বনু হাশেমই কুরাইশদের নেতৃত্ব দান করত। এই বনু হাশেম বংশেই কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঔরসে এবং মা আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.। সুতরাং মুহাম্মদ সা. হযরত ইব্রাহিম আ. এর শ্রেষ্ঠ বংশধর।
৪. নবুয়ত পূর্ব জীবন ও শৈশব
বিশ্বনবী সা. মাতৃগর্ভে। এসময় তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি পথিমধ্যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। বিধবা হয়ে পড়েন মা আমিনা। মাতৃগর্ভে থাকতেই ইয়াতিম হয়ে পড়েন বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.।
তাঁর জন্মকালে জীবিত ছিলেন কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিব, বড় চাচা আবু তালিব, অন্যান্য চাচা এবং ফুফুরা। কুরাইশদের বংশীয় রীতি অনুযায়ী জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই লালন পালন ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে ন্যস্ত করা হয় বেদুইন ধাত্রী মা হালিমার দায়িত্বে। ছয় বছর বয়েস হলে হালিমা তাঁকে মায়ের কোলে ফেরত দিয়ে যান। মা আমিনা ফিরে পান বুকের ধন মুহাম্মদকে। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সবচেয়ে প্রিয় নাতী মুহাম্মদ।তিনি চাচা এবং ফুফুদের কাছেও সর্বাধিক প্রিয়। শিশুকাল থেকেই সবাই হয়ে পড়েন তাঁর গুণমুগ্ধ। সুন্দরতম গুণাবলী আর মহোত্তম আচরণে তিনি শিশুকাল থেকেই সবার সেরা। ফলে সবার প্রিয় মুহাম্মদ। ভবিষ্যতে নেতা এবং সেরা মানুষ হবার সব গুণাবলীই ফুটে উঠেছে শিশু মুহাম্মদের চরিত্রে। মুহাম্মদের বয়স ছয় কি আট। এ সময় মা আমিনা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে দেখাতে মদীনায় নিয়ে যাবেন ওর মাতুলালয়ে। তাছাড়া ওর বাবার কবরও ওখানে। দেখিয়ে আনবেন বাবার কবরও। ফলে তারা মদিনায় এলেন। থাকলেন মাস খানেক। তারপর ফিরে চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে প্রচণ্ড জ্বর আক্রমন করল মা আমিনাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি পথেই মারা গেলেন। সাথে ছিলেন মায়ের সেবিকা উম্মে আয়মান। মায়ের মতই তিনি মুহাম্মদকে লালন পালন করেছেন সারাজীবন। তিনি মুহাম্মদকে কোলে জড়িয়ে ফিরে এলেন মক্কায়। দাদা আব্দুল মুত্তালিব পরম আদর যত্নে গড়ে তুলছিলেন নাতি মুহাম্মদকে। কিন্তু এরি মধ্যে দুই বছরের মাথায় তিনিও ইহকাল ত্যাগ করেন। পরিবর্তন হয় অভিভাবক। এবার মুহাম্মদের অভিভাবকের দায়িত্ব নেন বড় চাচা আবু তালিব। আবু তালিব নিজ সন্তানদের চেয়েও অধিক স্নেহ এবং আদর যত্ন করতেন এতিম ভাতিজা মুহাম্মদকে। আবু তালিব একবার বারো বছর বয়সে মুহাম্মদকে বাণিজ্যিক সফরে সিরিয়ায় নিয়ে যান। এ সফরে আবু তালিব মুহাম্মদ সা. এর মধ্যে প্রতক্ষ করেন অনেক অলৌকিকত্ব। এভাবে তিনি উপযুক্ত অভিভাবকের অধিনেই বেড়ে ওঠেন ছোট বেলা থেকে। এ প্রসঙ্গেই মহান আল্লাহ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তিনি কি তোমায় ইয়াতিম পাননি? তারপর আশ্রয় দেননি।” (আল কুরআন ; ৯৩-৬)
৫. নবুয়ত পূর্বজীবন ; যৌবনকাল
এরি মধ্যে মুহাম্মদ সা. নিজেকে দক্ষ ও সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অপরদিকে সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার ও সমাজ সেবার মাধ্যমে তিনি মক্কার জনগণের নয়নমণিতে পরিণত হন। জনগণ তাঁকে উপাধি দেয় ‘আল আমিন’ ও ‘আস সাদিক’। এর মানে পরম বিশ্বস্ত ও মহা সত্যবাদী। পঁচিশ বছর বয়েসে বিয়ে করেন খাদিজাকে। তিনি ছিলেন খাদিজা তাহিরা- পবিত্র নারী খাদিজা। রূপে গুণে এবং সহায় সম্পদে তিনি ছিলেন মক্কার সেরা নারী। মক্কার সেরা নেতা ও ধনীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি নিজেই স্বামী হিসেবে পছন্দ করে নেন ভবিষ্যতের মহাপুরুষ মুহাম্মদকে। খাদিজার গর্ভে জন্ম হয় বিশ্বনবীর চারকন্যা – উম্মে কুলসুম, যয়নব, রুকাইয়া এবং ফাতিমা। প্রথমে কাসেম নামে একটি পুত্রের জন্ম হয়, কিন্তু জন্মের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাসেম মারা যান। ইতোমধ্যে সামাজিক বিবাদ ফায়সালায়ও মুহাম্মদের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব সবার কাছে সমাদৃত হয়। জনগণ তাঁকে তাঁদের ভবিষ্যতের নেতা ভাবতে থাকে। তাছাড়া সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, নযায়পরায়নতা ও মহৎ মানবীয় গুণাবলীর দিক থেকে জনগণ এমন সেরা মানুষ আর কখনো দেখেনি।
৬. অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ
সেকালে মানব সমাজ ছিল সকল দিক থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারা ডুবে ছিল অন্ধ ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের অটল গহবরে। তাঁদেরকে গ্রাস করে ফেলেছিলো চরিত্রহীনতা ও নৈতিক অধঃপতন। গোত্রীয় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ছিল তারা পর্যদুস্ত। কুসংস্কারের বলীতে তারা ছিলো ধংসোন্মুখ। তাঁদের উপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব। অধিকাংশ মানুষ ছিল দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নারীরা ছিল সম্পূর্ণ অসহায় ও মর্যাদাহীন। ভাস্কর্য পূজা তাঁদের নামিয়ে দিয়েছিলো মানবতার সর্বনিম্নস্তরে। এমতাবস্থায় মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসার প্রয়োজন ছিল এক সাহায্যপ্রাপ্ত মহাবীর মুক্তিদুত। এতিম মুহাম্মদকেই মহান আল্লাহ গড়ে তুলছিলেন সেই মুক্তিদুত হিসেবে।
৭. নবুয়ত লাভ
এদিকে তাঁর বয়েস যখন চল্লিশের কাছাকাছি তখন তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে নির্জনতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। কা’বা থেকে মাইল তিনেক পূর্বদিকের একটি পাহাড়। এর বর্তমান নাম ‘জাবালুন্নুর’ বা জ্যোতির পাহাড়। এ পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে পশ্চিমমুখী বা কাবা মুখী একটি গুহা। গুহাটির নাম হেরা। জাবালুন নুরের চুড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় গিয়ে মুহাম্মদ সা. নীরবে নির্জনে ধ্যান করতে থাকেন। অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মানব সমাজের মুক্তির জন্যে তিনি এক আল্লাহর কল্যাণমুখী হন। ধ্যান করতে থাকেন। তাঁর মহিমা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর সমস্ত মন মস্তিস্কে এক আল্লাহর ধ্যান এবং ভাবনা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এভাবে তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস, তখন রমযান মাসের এক শুভরাত্রে তাঁর কাছে আগমন করেন আল্লাহর দূত হযরত জিব্রাইল আমিন। তখনো তিনি হেরা গুহায় ধ্যানরত। জিবরীল এসে তাঁকে বললেন- ‘পড়ুন’। তিনি বললেন- ‘আমি পড়তে জানি না’। এবার জিবরীল তাঁকে প্রচণ্ড জোরে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলেন – ‘পড়ুন’। জ্ঞানের আলোকে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠলো তাঁর হৃদয়। সাথে সাথে তিনি পড়তে শুরু করলেন – “ইকরা বি ইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক। ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল কালাম। আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়ালাম।” অর্থ “পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে শক্তভাবে আটকে থাকা শিশু থেকে। পড়ো, আর তোমার প্রভু বড়ই দয়াবান, মহিমা মণ্ডিত। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।”
এ অংশটি পরে রাসূল সা. আল কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত হিসেবে সংকলন করেন। হযরত মুহাম্মদ সা. এর প্রতি এটিই ছিল কুরআন নাযিল হবার সুচনা। এটাই ছিল তাঁর নবুয়তী জীবনের সূচনা। আর এটা ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ। ফেব্রুয়ারী মাস। মুহাম্মদ সা. এর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন আসমানী সর্বশেষ কিতাব। তাঁর রিসালাত ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন চিরন্তর এবং সার্বজনীন।
৮. আল্লাহর দিকে আহবানের গুরু দায়িত্ব
নবুয়ত ও রিসালাত হল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহান দায়িত্ব। এ হলো, মানব সমাজের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব। এ হলো মানব সমাজকে এক অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে আহবান করার দায়িত্ব। তাই, মুহাম্মদ সা. মানব সমাজের জন্যে মহান আল্লাহর নিযুক্ত –
১. বার্তাবাহক (রাসূল)।
২. আল্লাহর দিকে আহবায়ক (দায়ী ইলাল্লাহ)।
৩. সুসংবাদদাতা (বাশীর)।
৪. সতর্ককারী (নাযির)।
৫. সত্যের সাক্ষী (শাহেদ)।
৬. সর্বোত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) এবং
৭. মহাসত্যের অনাবীল আলো বিতরণকারী এক সমুজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজাম মুনিরা)।
এ দায়িত্বগুলো তাঁর উপর অর্পিত হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্যে তিনি পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে। গুহায় বসে ধ্যান করার দিন শেষ। মানবতার মুক্তির যে মহান উদ্দেশ্যে তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়েছিলেন, সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের সঠিক দিশা এবং নির্দেশিকা এবার তিনি পেয়ে গেছেন। তাই এবার মানব সমাজকে ধংসের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে।
তাঁকে প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন-
- হে মুহাম্মদ, বলুন- হে মানুষ, আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর বার্তাবাহক। (আল কুরআন ৭ ;১৫৮)
- গোটা মানবজাতির জন্যে আমরা তোমাকে বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছি। (আল কুরআন ৪ ; ৭৯)
- যাতে করে রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হয়। (আল কুরআন ২ ; ১৪৩)
- হে নবী, আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে আর আলো বিতরণকারী সমুজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। (আল কুরআন ৩৩ ; ৪৫-৪৬)
এসব দায়িত্ব পালনে তিনি নিজেকে এতোটাই নিবেদিত করেছিলেন যে, তিনি নিজের জীবনের প্রতিও অনেকটা বেখেয়াল হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তাঁকে এভাবে সতর্ক করেন-
“তারা এ বাণীর প্রতি ঈমান আনে না বলে সম্ভবত দুঃখে শোকে আর হতাশায় তুমি নিজেকেই বিনাশ করে ছাড়বে।” (আল কুরআন ১৮ ;৬)
৯. মানব সমাজকে মুক্তি ও সাফল্যের দিকে আহবান
মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ সা. কে রিসালাতের দায়িত্বে নিযুক্ত করার পর তিনি মানুষকে যেসব বিষয়ের প্রতি আহ্বান করেন এবং যেসব বার্তা তাঁদেরকে পৌঁছান, সংক্ষেপে তা হলো –
১. মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, তিনিই মহান আল্লাহ। মহাবিশ্ব, পৃথিবী ও মানুষ সব কিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সবার প্রভু। তিনিই মহাজগৎ মহাবিশ্বের প্রতিপালক, পরিচালক ও শাসক।
২. তিনি এক ও একক। তিনি সন্তান গ্রহণ করেন না। তিনিও কারো সন্তান না। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। কোন বিষয়েই তাঁর কোন শরীক বা অংশীদার নেই। কোন বিষয়েই তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোন বিষয়েই কারো কাছ থেকে তাঁর কোন সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বোচ্চ ও সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। সবাই ও সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী।
৩. তিনি মানুষকে সৃষ্টি করে তাঁকে একটি সময়ের জন্যে এই পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাঁর হুকুম ও বিধান মতো জীবন যাপন করার জন্যেই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। মানুষের জন্যে জীবন যাপনের নির্দেশিকা সম্বলিত কিতাব পাঠিয়েছেন এবং পৃথিবীকে তাঁর বিধান মতো পরিচালনা করার জন্যে মানুষেরই উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
৪. তিনি বিবেক বুদ্ধি দিয়ে মানুষকে জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী বানিয়েছেন। মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি এবং নৈতিক প্রবৃত্তি অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। পাশবিক প্রবৃত্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করে বিবেক বুদ্ধি তথা নৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী ও বিকশিত করতে বলেছেন। তাঁকে আল্লাহর বিধান ও নৈতিক শক্তিতে পার্থিব জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন।
৫. পার্থিব জীবনের কার্যক্রমের জন্যে মানুষের বিচার হবে। আল্লাহর বিধান এবং মহৎ মানবীয় নৈতিক গুণাবলীর ভিত্তিতে সে তাঁর সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করেছে কিনা, সেটাই হবে বিচারের বিষয়। এ উদ্দেশ্যে মানুষকে পুনরুত্থিত করা হবে। বিচারে সাফল্য অর্জনকারী লোকদের তিনি অনন্তকালের জন্যে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। অপরদিকে বিচারে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে তাঁদেরকে নিমজ্জিত করা হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মধ্যে।
৬. হে মানুষ, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছেন। তোমরা আমাকে আল্লাহর রাসূল মেনে নাও। আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের কিছুই বলছি না। আমি তোমাদের কাছে কেবল আল্লাহর বার্তা ও নির্দেশাবলীই পৌঁছে দিচ্ছি।
৭. হে মানুষ, তোমরা আল্লাহকে এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান মেনে নাও। তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন কর। তাঁর সাথে কাউকেও এবং কোন কিছুকেই শরিক করো না। তোমরা তোমাদের মহৎ মানবীয় ও নৈতিক গুণাবলীকে উন্নত ও বিকশিত করে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা অর্জন কর। তোমরা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাস। সারাজীবন সমস্ত কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কর। আল্লাহর শাস্তিকে ভয় কর। পরকালীন সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে কাজ কর। সর্বপ্রকার অন্যায়, অপরাধ, পাপ, পংকিলতা ও যুলুম অবিচার পরিহার কর। এটাই তোমাদের মুক্তি ও সাফল্যের একমাত্র পথ।
১০. মক্কায় ১৩ বছর দাওয়াত ও আহবান
উপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো, সেগুলোই হযরত মুহাম্মদ সা. এর দাওয়াত ও আহবানের মূল বক্তব্য। মক্কায় ১৩ বছর তিনি মানুষকে এই মূল বিষয়গুলোর দিকেই আহবান করেন। সর্বোত্তম পন্থা আর মর্মস্পর্শী উপদেশের মাধ্যমে তিনি মানুষকে আহবান করেন। তাঁর আহবানের উপকরণ ছিল আল কুরআন। এই ১৩ বছর তাঁর কাছে কুরআন নাযিল হয়েছে ঐ বিষয়গুলোকে চমৎকার যুক্তি, উপমা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত সহকারে বাস্তব ও আকর্ষণীয় ভংগীতে উপস্থাপনের মাধ্যমে। তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবান হিসেবে মানুষের কাছে হুবহু উপস্থাপন করেন আল্লাহর বার্তা আল কুরআন। যারা তাঁর আহবান গ্রহণ করেন, তাঁদের তিনি সঠিক শিক্ষা দান করেন। তাঁদের মাঝে কুরআনের আলো বিতরণকরেন। তাঁদেরকে আল কুরআন শিক্ষা দেন। তাঁদের মানবিক গুণাবলী উন্নত ও বিকশিত করেন। তাঁদের নৈতিক চরিত্র সংশোধন করেন। তাঁদের মাধ্যমে গঠন করেন একটি নতুন সমাজ। মূলত তাঁর দাওয়াত ও আহবানের ছিলো পাঁচটি স্তর। সেগুলো হলো-
১. মানুষের জীবন লক্ষ্যের পরিবর্তন।
২. মানুষের ধ্যান ধারণা, চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন।
৩. মানুষের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন।
৪. সমাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন।
৫. নেতৃত্বের পরিবর্তন।
কুরআনের আলো বিতরণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, দৃষ্টান্ত স্থাপন, এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য এবং সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে তিনি সমাজ ও সাথীদের মাঝে এসব পরিবর্তন সাধন করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “এমনি করে আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের মাঝে পাঠিয়েছি একজন রাসূল। সে তোমাদের প্রতি তেলাওয়াত করে আমাদের আয়াত, তোমাদের জীবনকে করে উন্নত ও বিকশিত করে, তোমাদের শিক্ষা দেয় আল কুরআন ও হিকমাহ। আরো শিক্ষা দেয় তোমরা যা কিছু জানতে না।”(আল কুরআন, ২ ; ১৫১, ৩ ; ১৬৪, ৬২ ; ০২)
১১. দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া
সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবানের প্রতিক্রিয়া আছে। সমস্ত নবী রাসূল মানুষকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবান করেছেন এবং তাঁদের আহবানের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। একইভাবে মুহাম্মদ সা. এর দাওয়াতেরও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাঁর দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া ছিলো নিম্নরূপ-
১. সত্য সন্ধানী ব্যক্তিবর্গ, বিশেষ করে যুবক যুবতীরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। তারা ঈমান এনে রাসুলের সাথে কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
২. কিছু লোক এই দাওয়াতকে সত্য বলে জেনেও অত্যাচার নির্যাতনের ভয়ে কিংবা স্বার্থহানীর আশংকায় ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে।
৩. সমাজের কর্ণধাররা, ধর্মীয় পুরোহিতরা এবং অর্থনৈতিক শোষকরা কোমর বেধে তাঁর বিরোধিতায় নেমে পড়ে।
৪. অধিকাংশ মানুষ নিরবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
৫. আর কিছু লোক বিভিন্নভাবে বিরুদ্ধবাদীদের শিকলে আটকা থাকায় গোপনে ঈমান আনে এবং ঈমান আনার বিষয়টি সময় সুযোগের অপেক্ষায় গোপন রাখে।
প্রতিক্রিয়া যদিও এই পাঁচটি ধারায় বিভক্ত ছিলো, তবু এর মূল ধারা ছিলো দুইটি। অর্থাৎ
১. ঈমান এনে রাসুলের সাথীত্ব গ্রহণকারী ধারা। এবং
২. বিরুদ্ধবাদী ধারা।
এই ১৩ বছরে তিন শতাধিক নারী পুরুষ প্রকাশ্যে ঈমান এনে ইসলামী কাফেলায় শরীক হয়ে যান। এরা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ইসলামের পথে সব ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী দিচ্ছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম দিকেই ঈমান আনেন খাদিজা তাহেরা, আবু বকর, আলী, যায়েদ বিন হারিসা, সায়ীদ বিন যায়িদ, ফাতিমা বিনতে খাত্তাব, যুবায়ের, সা’দ বিনাবি ওয়াক্কাস, উসমান বিন আফফান, আব্দুর রহমান, জাফর বিন আবু তালিব, আবু সালামা, উম্মে সালামা, আবু উবায়দা, তালহা, উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান, উমর বিন খাত্তাব, আবু যর, হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব, বিলাল বিন রিবাহ, মুসআব, আম্মার, ইয়াসার, সুমাইয়া, খাব্বাব, আরকাম, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ, সুহায়েব রুমী, উসমান বিন মাযঊন, উম্মে শুরাইক, রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মদ, উম্মু কুলসুম বিনতে মুহাম্মদ, নঈম বিন আব্দুল্লাহ, লুবাইনা, উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে হাশমা, তাঁর স্বামী আমের বিন রাবীয়া, তোফায়েল দাওসী এবং আরো অনেকে রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
অপরদিকে মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবানের এই মহোত্তম কাজের বিরোধীতায় অগ্রণী ভুমিকা পালন করে স্বয়ং রাসূল সা. এর চাচা আবু লাহাব, তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল, আবু জাহেল, হাকাম বিন আস, উকবার বিন আবু মুয়িত, উতবা, শাইবা, আবুল বুখতরি, আস বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, মুনাব্বিহ, হিন্দা, আবু সুফিয়ান, সুহায়েল, আমর ইবনু আস, আকরামা, খালিদ বিন ওয়ালীদ এবং আরো অনেকে। অবশ্য এদের মধ্যে কয়েকজন পরে ইসলাম কবুল করে আল্লাহর সৈনিক হয়ে যান। তবে তাঁদের অনেকেই বদর যুদ্ধে নিহত হয়। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকেই ইসলাম কবুল করেন। তবে সাহসী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যুবকরাই বেশীরভাগ ইসলাম গ্রহণ করেন। অবশ্য নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যক্তিই রাসূল সা. ও তাঁর সত্যের দাওয়াতের বিরোধীতায় অবতীর্ণ হয়। তারা ঈমানে দীক্ষিত তাঁদের যুবক ছেলে মেয়েদের, আত্মীয়-স্বজনদের এবং দাস-দাসীদের উপরে চরম নির্যাতন চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসূল সা. এর নির্দেশে তাঁর আশির অধিক সাহাবী নবুয়তের পঞ্চম বছরে পার্শ্ববর্তী দেশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।
১২. বন্দী জীবন
কিন্তু রাসূল সা. এবং তাঁর সাথীরা ইসলামের পথ এবং দাওয়াত ও আহবানের কাজ ত্যাগ না করায় কাফির নেতারা আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রাসূল, তাঁর সাথীবৃন্দ এবং তাঁর গোত্র বনু হাশিমকে বয়কট করে। ফলে তারা শি’বে আবু তালিব নামক পার্বত্য উপত্যকায় অন্তরীন হয়ে পড়েন। এখানে চরম দুঃখ দারিদ্রের মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন কাটতে থাকে। চরম খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা গাছের ছাল আহার করেন। তারা ক্ষুধা এবং রোগক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। নবুয়তের সপ্তম বর্ষ থেকে দশম বছরের সূচনা পর্যন্ত তিন বছর তারা এখানে বন্দী থাকেন। অতঃপর পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে বিরোধী নেতারা রাসূল সা. এবং তাঁর সাথীদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়। এই তিন বছরের নিপীড়নের ফলে এ বছরই অর্থাৎ নবুয়তের দশম বর্ষেই ইহকাল ত্যাগ করেন রাসূল সা. এর অভিভাবক চাচা আবু তালিব এবং প্রেরণাদায়িনী স্ত্রী খাদিজা তাহেরা। এখন থেকে রাসূল সা. নিরংকুশভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যান।
১৩. তায়েফে দাওয়াত
মক্কার পরেই তায়েফ ছিল অধিকতর প্রভাবশালী শহর। মক্কার লোকদের আর ঈমান আনার লক্ষণ ক্ষীণ দেখে রাসূল সা. তায়েফের সর্দারদের কাছে মহাসত্যের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তায়েফ যান। তাঁদের দাওয়াত দেন আল্লাহর দিকে। মক্কার নেতারা তাঁর দাওয়াত গ্রহণ না করায় এবং বিরোধিতা করায় তাঁরাও তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় তারা আল্লাহর রাসুলকে লাঞ্ছিত করার লক্ষ্যে তাঁর পিছনে বখাটে যুবকদের লেলিয়ে দেয়। তারা রাসূল সা. কে চরমভাবে নির্যাতন করে, লাঞ্ছিত করে। তাঁর সাথে গিয়েছিলেন তাঁর সেবক যায়েদ। অতঃপর তিনি যায়েদকে নিয়ে ফিরে আসেন মক্কায়।
১৪. মে’রাজ
চরম নির্যাতনের ফলে রাসূল সা. এর একজন মহিলা সাহাবীসহ দুই তিনজন সাহাবী শাহাদাৎ বরণ করেন। অনেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসূল সা. তায়েফের দিক থেকেও নিরাশ হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে তো নিজের রাসূল নিযুক্ত করেছেন স্বয়ং মহাবিশ্বের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি তাঁর রাসূলগণকে এবং রাসূলদের সাথীদেরকে সবসময় বিরোধিতা, অত্যাচার, নির্যাতন এবং প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাইতো আল্লাহ পাক মুহাম্মদ সা. কেও বলে দিয়েছেন, “তোমার পূর্বেও বহু রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের মোকাবেলায় তারা অটল থেকেছে।” (সূরা ৬ আয়াত ৩৪)
এ সময় আল্লাহ পাক তাঁকে মে’রাজ করান। দশম নবুয়ত বর্ষে মে’রাজ সংঘটিত হয়। আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে সাক্ষাত দান করেন। মে’রাজ উপলক্ষ্যে নাযিল হয়েছে সূরা বনী ইসরাইল। তখনকার প্রাসঙ্গিক উপদেশ ও মূলনীতিগুলো মওজুদ রয়েছে এই সূরা বনী ইসরাইলে। রাসূল সা. এর মেরাজের ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল:
মানবকুলের শিরোমনি এবং নবী ও রসূলদের মুকুটমনি হযরত মুহাম্মদ (স:) একদা মক্কাতে শিআবে আবূ ত্ব-লিবে অবস্থিত তাঁর চাচাতো বোন উম্মে হা-নীর ঘরে এশার নামায পড়ে শুয়েছিলেন। তখন তাঁর একপাশে নিদ্রিত ছিলেন প্রাণপ্রিয় চাচা হামযা এবং অন্যপাশে ঘুমাচ্ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ চাচাতো ভাই জাফর (রা.) (ফতহুল বারী)।
অতঃপর তাঁর ঘরের ছাদ ফুঁড়ে জিবরীল আমীন ও মীকায়ীল আ.-এর আগমন তাঁর কাছে হয়। তখন তিনি ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলেন। অতঃপর জিবরিল তাঁকে ঐ ঘর থেকে বের করে মসজিদুল হারামের দিকে হাত্বীমের কাছে নিয়ে আসেন। তখন তাঁর মধ্যে ঘুমের ভাব ছিল। এরপর জিবরীল তাঁর সীনা থেকে নাভীর উপর পর্যন্ত ফেড়ে এবং তাঁর বুক ও পেট থেকে কিছু বের করে সেটাকে যমযম পানি দিয়ে ধুয়ে তাঁর পেটটাকে পাকসাফ করে দেন। তারপর তিনি সোনার একটি তশ্তরী আনেন। যা ঈমান ও হিকমত (শরীআতী জ্ঞান) দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। তদ্বারা তিনি তার সীনাটাকে ভরে দেন এবং তার ফাড়া অংশটা ঠিকঠাক করে দেন। (বুখারী ১ম খন্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা, মুসলিম ১ম খণ্ড, ৯২ পৃষ্ঠা, মিশকাত ৫২৬-৫২৭ পৃষ্ঠা)। তাঁর বুক অপারেশনের কারণে তিনি তন্দ্রালু অবস্থায় যখন কাবা শরীফের নিকটবর্তী হিজর তথা হাত্বীমে ছিলেন তখন জিবরীল তার পায়ে টোকা মারেন। তিনি উঠে বসে কাউকে দেখা না পেয়ে শোবার জায়গায় ফিরে যান। আবার জিবরীল তাঁর পায়ের পাতায় টোকা মারেন। ফলে তিনি উঠে বসেন। এবার জিবরীল তাঁর হাতের নড়াটা ধরেন। অতঃপর তিনি তার সাথে উঠে দাঁড়ান। তারপর মসিজিদুল হারামের দরজার দিকে তিনি রওয়ানা হন। ওখানে একটি সাদা জন্তু ছিল। যা গাধা ও খচ্চরের মাঝামাঝি ছিল। তার দুটি উরুর মধ্যে দুটি ডানা ছিল। যা তার পা দুটির কাছাকাছি ছিল (তফসীরে ত্ববারী, ১৫ খণ্ড, ৩য় পৃষ্ঠা)।
বুরাকের বর্ণনা
ঐ জন্তুটির নাম বুরা-ক্। ওর বর্ণনা সা’লাবীর দুর্বলসূত্রে আছে যে, ওর চেহারাটা মানুষের চেহারার মত। ওর পায়ের ক্ষুরটা জন্তুদের পায়ের ক্ষুরের মত। ওর লেজটা বলদের লেজের মত। ওর আগেপিছেটা ঘোড়ার মত। ওকে যখন রাসূলুল্লাহ কাছে আনা হয় তখন সে লাফালাফি করতে থাকে। ফলে জিবরীল তাকে ছুঁয়ে বলেন, হে বুরাক! তুমি মুহাম্মদ দেখে লাফালাফি করো না। আল্লাহর কসম! তোমার উপর এমন কোন ফেরেশতা চড়েনি এবং এমন কোন প্রেরিত নবীও সওয়ার হননি যিনি মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারেন এবং তিনি আল্লাহর নিকটেও তাঁর চেয়ে মর্যাদাবান হতে পারেন (তফসীরে কুরতুবী, ১০ম খণ্ড, ১৩৬ পৃষ্ঠা)
তিরমিযীতে আনাসের বর্ণনায় আছে, তখন বুরাকটি ঘামেতে ভিজে যায়। ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় আছে, বুরাকটি তখন কাঁপতে থাকে। পরিশেষে সে যমীনে ঠেকে যায়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. তাতে সওয়ার হন। নাসায়ীতে আনাসের বর্ণনায় আছে, ঐ বুরাকটিকে অন্য নবীদের জন্যও নিয়োজিত করা হতো। বিশিষ্ট তা-বিয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব বলেন, এই বুরাকটি সেই জন্তু, যাতে চড়ে ইবরাহীম নবী (সিরিয়া থেকে মক্কায় তার পুত্র) ইসমাঈলকে দেখতে আসেন। ঐ বুরাকটির দৃষ্টি যতদূর যেত ততদূরে তার পা পড়তো (ফাতহুল বারী)
বায়তুল মুকাদ্দাসে রওয়ানা
আনাসের বর্ণনায় ইবনে জারীর বলেন, বুরাকে চড়ার পর রসূলুল্লাহ সা. জিবরীলের সাথে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে রওয়ানা হন। হঠাৎ রাস্তার একদিকে তিনি একটি বুড়ীকে দেখতে পান। তিনি রাসূল সা. বলেন, এটা কে? হে জিবরীল! তিনি বলেন, চলুন, হে মুহাম্মদ! তিনি চলতে থাকেন। আবার রাস্তার ধারে একটি জিনিস তাঁকে ডাকলো, আসুন, হে মুহাম্মদ! তখন জিবরীল তাঁকে বলেন, চলুন, হে মুহাম্মদ! তাই তিনি চলতে লাগলেন। অতঃপর আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কিছু সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্ হল। তাঁরা বললেন, আসসালা-মু আলাইকা, হে হা-শির (যাঁর পরে কেউ নেই)। তখন তাঁকে জিবরীল আ. বলেন, আপনি সালামের জওয়াব দিন। তাই তিনি সালামের জওয়াব দিলেন। তারপর তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয়জনের সাক্ষাত্ পেলেন। তাঁদেরকেও তিনি ঐরূপ বললেন। পরিশেষে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর তাঁর কাছে পানি ও শারাব এবং দুধ পেশ করা হল। তখন রাসুলুল্লাহ সা. দুধটাকে গ্রহণ করলেন। অতঃপর জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, আপনি স্বভাবজাত প্রকৃতিকে পেয়ে গেছেন। আপনি যদি পানিটা পান করতেন তাহলে আপনি ডুবে যেতেন এবং আপনার উম্মতও ডুবে যেত। আর আপনি যদি শরাব পান করতেন তাহলে আপনি পথভ্রষ্ট হতেন এবং আপনার উম্মতও বিভ্রান্ত হয়ে যেত। তারপর জিবরীল বলেন, সেই বুড়ীটা যাকে আপনি রাস্তার ধারে দেখেছিলেন সে হচ্ছে পৃথিবীর সেই অংশ যতটা বয়স এই বুড়ীটার বাকী আছে। আর সে চেয়েছিল যে, আপনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন। সে ছিল আল্লাহর দুশমন ইবলীস। সে চেয়েছিল যে, আপনি তার দিকে ঝুঁকে যান। আর যারা আপনাকে সালাম দিয়েছিলেন তারা হলেন ইবরাহীম এবং মুসা ও ঈসা আ. (তাফসীরে ত্ববারী, ১৫ খণ্ড, ৫ম পৃষ্ঠা)। হাফেজ ইবনে কাসীর বলেন, এর কোন কোন শব্দে আপত্তি এবং অভিনবত্ব আছে (তাফসীর ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠা)।
মুসনাদে বাযযার ও ত্ববারানীতে এবং বাইহাকীর দালা-য়িলুন নুবওঅতে শাদ্দাদ ইবনে আওসের বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, যখন আমরা খেজুর গাছওয়ালা একটি যমিনে পৌঁছলাম তখন জিবরিল বলেন, আপনি এখানে নামুন এবং নামায পড়ুন। তাই আমি নামলাম এবং নামায পড়লাম। তারপর আমরা বুরাকে চড়লাম। অতঃপর জিবরিল বলেন, আপনি কি জানেন, আপনি কোথায় নামায পড়লেন? আমি বললাম, আল্লাহ ভাল জানেন। এবার জিবরিল বললেন, আপনি নামায পড়লেন, ইয়াসরিবে (মদীনা শরীফের পুরাতন নাম) তথা ত্বইবাতে। নাসায়ীর বর্ণনায় আছে, এটাই আপনার হিজরতের জায়গা হবে ইন-শা-আল্লাহ! অতঃপর বুরাকটি চলতে লাগলো এবং যেখানে তার দৃষ্টি পড়ছিল সেখানে সে তার পা-টি ফেলছিল। তারপর আমরা একটি জায়গায় পৌঁছলাম। জিবরীল আমাকে বললেন, এখানে নামুন এবং নামায পড়ুন। তাই আমি নামলাম এবং নামায পড়লাম। অতঃপর জিবরীল বললেন, আপনি কি জানেন, আপনি কোথায় নামায পড়লেন? আমি বললাম, আল্লাহ ভাল জানেন। তিনি বললেন, আপনি মাদ্য়্যান শহরে নামায পড়লেন মূসার গাছের নীচে। অন্য বর্ণনায় আছে, এটা সিনাই পর্বত। যেখানে আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছিলেন।
অতঃপর বুরাকটি তার দৃষ্টি পর্যন্ত পা ফেলে চলতে লাগলো। তারপর আমরা একটা জায়গায় পৌঁছলাম। যার সৌধগুলো আমাদের সামনে প্রকাশিত হল। তখন জিবরীল বললেন, এখানে নামুন এবং নামায পড়ুন। তাই আমি নামলাম এবং নামায পড়লাম। তারপর আমরা বুরাকে চড়লাম। অতঃপর জিবরীল বললেন, আপনি কি জানেন, আপনি কোথায় নামায পড়লেন? আমি বললাম, আল্লাহ ভাল জানেন। তিনি বললেন, এটা বাইতুল লাহাম। যেখানে মারয়্যামের পুত্র ঈসা মাসীহের জন্ম হয়েছিল। তারপর বুরাক আমাদের নিয়ে চলল। পরিশেষে আমরা ইয়ামনী দরজা দিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসের শহরে ঢুকলাম। অতঃপর আমি মসজিদটির কিবলার দিকে এলাম। তারপর তিনি ওখানে বুরাকটি বাঁধলেন। তারপর আমি বাইতুল মুকাদ্দাসের মুসজিদে-আকসায় ঢুকলাম। অতঃপর আমার সামনে নবীদের জমায়েত করা হল। তারপর জিবরীল আমাকে এগিয়ে দিলেন। পরিশেষে আমি তাঁদের ইমামতি করলাম (তফসীর দুররে মানসূর, ৪র্থ খণ্ড, ২৬০, ২৬২, ২৬৩, ২৬৪ পৃষ্ঠা, ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, ৭ম পৃষ্ঠা।
বাইহাকির দালায়িলুন নবুওঅতে ও ইবনে আসা-কিরে আবূসায়ীদ খুদ্রীর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আমি যখন বুরাকে চড়ে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে যাচ্ছিলাম তখন একজন আহ্বানকারী ডান দিক থেকে ডাক দেয়, হে মুহাম্মদ। আমাকে দেখুন। আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু আমি জওয়াব দেয়নি। তারপর একজন আহ্বানকারী বাম দিক থেকে আমাকে ডাক দেয়, হে মুহাম্মদ! আমাকে দেখুন। আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো, কিন্তু আমি জওয়াব দেয়নি। তারপর আমরা চলতেই থাকি। ইত্যবসরে একটি নারী তার বাহু দুটি উলঙ্গ করে এবং সবরকম সৌন্দর্য যা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে তা রয়েছে। অতঃপর সে বলে, হে মুহাম্মদ! আমাকে দেখুন, আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। আমি তার দিকে তাকালাম না। পরিশেষে আমরা বাইতুল মুকাদ্দাসে এসে গেলাম। অতঃপর আমি আমার জন্তুটাকে সেই চক্রে বাঁধলাম, যাতে নবীগণ (তাঁদের জন্তুগুলো) বাঁধতেন। তারপর আমি পথে আমাকে আহ্বানকারীদের সম্পর্কে জিবরীলকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, ডাকদিকের আহবানকারীটি ইহুদী। আপনি যদি ওর ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত ইহুদী হয়ে যেত। বামদিকের আহ্বানকারীটি খৃষ্টান। আপনি যদি ওর ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত খৃষ্টান হয়ে যেতো। আর উলঙ্গ বাহু রংঢং করা নারীটি এই পৃথিবী। আপনি যদি ওর ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত পরকালের উপর এই দুনিয়াকে প্রাধান্য দিত। তারপর আমি এবং জিবরীল বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলাম। অতঃপর আমাদের প্রত্যেকেই দু-রাকাআত নামায পড়লাম।
আবু সায়ীদ খুদরীর (রা.) বর্ণনায় আছে, নবী সা. বলেন, আমি যখন বাইতুল মুকাদ্দাসের কর্মসূচি থেকে অবসর পেলাম তখন একটি সিঁড়ি আমার কাছে আনা হলো। এর চেয়ে সুন্দর জিনিস আমি দেখিনি। এটাই সিঁড়ি যার দিকে মরণাপন্ন ব্যক্তি চেয়ে থাকে যখন তার কাছে মরণ হাজির হয়। অতঃপর জিবরাইল আমাকে তাতে চড়িয়ে দিলেন। পরিশেষে আমি আকাশের দরজাগুলোর মধ্যে একটি দরজার কাছে পৌঁছলাম। যার নাম বা-বুল হাফাযাহ্ তথা সংরক্ষিতকারীদের দরজা। তাতে একজন ফেরেশতা আছে। যার নাম ইসমায়ীল। তার অধীনে বার হাজার ফেরেশতা আছে। ওদের মধ্যকার ফেরেশতার অধীনে বার হাজার করে ফেরেশতা আছে (তাফসীরে ত্ববারী, ১৫ খণ্ড, ১১ পৃষ্ঠা, তাহযীবুল সীরাতি ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, ৯২ পৃষ্ঠা)। বাইহাকীর বর্ণনায় আছে, পৃথিবীর অতি নিকটবর্তী ফেরেশতার নাম ইসমায়ীল। তার সামনে আছে সত্তর হাজার ফেরেশতা। তার প্রত্যেক ফেরেশতার সাথে একলাখ ফেরেশতার বাহিনী আছে। তিনি বলেন, অতঃপর জিবরাইল আকাশটির দরজা খোলার প্রার্থনা করলেন। বলা হলো, কে? তিনি বললেন, জিবরাইল। আবার বলা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সা.। বলা হয়, তার কাছে লোক পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আদম আ. কে সেই আকৃতিতে দেখা গেলো যে আকৃতিতে আল্লাহ তাকে প্রথমদিনে সৃষ্টি করেছিলেন (তাফসীর ইবনে কাসীর, ৩য় খন্ড, ১৩ পৃষ্ঠা)। তারপর আমাদের ২য় আসমানে চড়ানো হলো। অতঃপর জিবরাইল দরজা খোলার প্রার্থনা করলেন। তখন বলা হলো, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরাইল। বলা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সা.। বলা হলো, তার কাছে দূত পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, পাঠানো হয়েছে। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো। হঠাৎ আমি দুই খালাতো ভাইকে পেলাম। তারা হলেন, ঈসা ইবনে মারয়্যাম এবং ইয়াহ্ইয়া ইবনে যাকারিয়্যা। তারা দু’জন আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার ভালোর জন্য দু’আ দিলেন (মুসলিম, ১ম খন্ড, ৯১ পৃষ্ঠা)।
তারপর আমাকে নিয়ে জিবরাইল ৩য় আসমানে চড়লেন। অতঃপর দরজা খোলার আবেদন করলেন। বলা হলো কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ সা.। বলা হলো, তার কাছে দূত পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন- হ্যাঁ। এবার বলা হল তাঁকে স্বাগতম। অতঃপর কি সুন্দর আগমন এটা। তারপর দরজা খোলা হল। অতঃপর যখন আমি ৩য় আকাশে পৌঁছালাম তখন ইউসুফ আ. কে পেলাম। জিবরাইল বললেন, ইনি ইউসুফ আ.। তাকে সালাম করুন। তাই আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জওয়াব দিলেন, তারপর বললেন, সত্ ভাই ও সত্ নবীকে স্বাগতম! (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫২৭ পৃষ্ঠা)। অন্য বর্ণনায় আছে, ইউসুফকে দুনিয়ার অর্ধেক সৌন্দর্য দান করা হয়েছে। (মুসলিম, ১ম খণ্ড, ৯১ পৃষ্ঠা)। আর এক বর্ণনায় আছে, তিনি পূর্ণিমার চাঁদের মত (তাহযীবু সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, ৯৩ পৃষ্ঠা)। তারপর একে একে চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিস আ., পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন আ., ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা আ.-এর সাথে সাক্ষাত্ করলেন। তারপর সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম আ.-এর সাথে সাক্ষাত্ হলে জিবরাইল আ. বললেন, ইনি আপনার বংশ পিতা, তাঁকে সালাম করুন। তাই আমি তাকে সালাম দিলাম। তিনিও সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন সত্ পুত্র ও সত্ নবীকে স্বাগতম। তারপর আমাকে সিদ্রাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত তোলা হলো। অতঃপর হঠাৎ দেখলাম, ওর ফলগুলো বড় বড় কলসির মতো এবং ওর পাতাগুলো হাতির কানের মতো। তিনি বললেন, এটা সিদ্রাতুল মুন্তাহা। ওখানে ৪টি নদী আছে। দু’টি নদী ভেতরমুখী এবং দু’টি নদী বাহিরমুখী। আমি বললাম, এ দু’টি কি? হে জিবরাইল! তিনি বললেন, ভেতরমুখী দুটো জান্নাতের মধ্যকার নদী। আর বাহিরমুখী দু’টি (মিসরের) নীল এবং (ইরাকের) ফোরাত নদী। তারপর আমার জন্য বাইতুল মা’মূরকে তোলা হলো। তারপর আমার কাছে কতিপয় পাত্র আনা হলো- মদের পাত্র ও দুধের পাত্র এবং মধুর পাত্র। আমি দুধেরপাত্র ধরলাম। জিবরাইল বললেন, এটাই তো প্রকৃত স্বভাব যার উপরে আপনি আছেন এবং আপনার উম্মতও আছেন (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, ৫২৭ পৃষ্ঠা)।
অন্য বর্ণনায় আছে, আমি আসমানে বাইতুল মা’মূরে পিঠ ঠেকিয়ে সুন্দরতম পুরুষের বেশে আমাদের বংশ পিতা হযরত ইবরাহীমকে দেখলাম। তার সঙ্গে কিছু লোকও ছিল। অতঃপর আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনিও আমাকে সালাম দিলেন। অতঃপর আমি আমার উম্মতকে দু’টি দলে দেখলাম। একটি ভাগ এমন যাদের দেহে সাদা কাপড় রয়েছে। তারা যেন কাগজের মত। আর একটি ভাগ এমন যাদের দেহে ছাইরং কাপড় রয়েছে। অতঃপর আমি বাইতুল মা’মূরে প্রবেশ করলাম। এমতাবস্থায় আমার সাথে তারাও ঢুকলো যারা সাদা কাপড় পরিহিত ছিল। তারা একপাশে থাকলো। তবে তারা ভার অবস্থায় ছিল। আমি এবং সঙ্গীরা বাইতুল মা’মূরে নামাজ পড়লাম। তারপর আমি এবং সঙ্গীরা বেরিয়ে এলাম। তিনি (জিবরাইল) বলেন, বাইতুল মা’মূর এমন ঘর যাতে প্রত্যেকদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা নামাজ পড়েন তারপর কেয়ামত পর্যন্ত তারা ফিরে আসার সুযোগ আর পায় না। (বাইহাকীর দালায়িলুন নুবুওঅহ্, ২য় খন্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা, তাফসীর দুর্রে মানসুর, ৪র্থ খণ্ড, ২৬৮ পৃষ্ঠা)। তারপর আমাকে সিদরাতুল মুন্তাহার দিকে তোলা হলো। এর প্রত্যেকটি পাতা ঐ উম্মতকে প্রায় ঢেকে ফেলতে পারে। এর মধ্যে একটি ঝর্ণাও আছে। যার নাম সাল্সাবিল, তা থেকে দু’টি স্রোতধারা বের হচ্ছে। একটির নাম কাওসার এবং অপরটির নাম নাহ্রুর রহ্মাহ বা করুণাধারা। অতঃপর তাতে আমি গোসল করলাম। তারপর আমাকে জান্নাতের দিকে তোলা হলো। অতঃপর একটি যুবতী আমাকে স্বাগতম জানালো। আমি বললাম, তুমি কার জন্য? হে যুবতী। সে বললো, (আপনার পালকপুত্র) যায়দ-বিন হারিসার জন্য। অতঃপর আমি কতিপয় নহরধারা দেখলাম স্বচ্ছ পানির এবং কতিপয় নহর দুধের যার স্বাদ পাল্টায়নি। যা পালনকারীদের জন্য মজাদার এবং কতিপয় নহর খাঁটি মধুর। আর ওর পাখিগুলো যেন বড় বড় উটের মতো। ওর কাছে এসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তার সত্ বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছেন যা কোন চোখ দেখেনি এবং কোন কান শোনেনি। আর কোন মানুষের মনের কল্পনায়ও তা আসতে পারে না।
তারপর আমার সামনে জাহান্নাম পেশ করা হলো। তার মধ্যে আল্লাহর গযব ও রাগ এবং তার ডাঁট ও শাস্তি রয়েছে। তার মধ্যে যদি পাথর ও লোহা ফেলা হয় তাহলে সে ওটাকে খেয়ে ফেলবে। তারপর আমাকে সিদ্রাতুল মুন্তাহায় তোলা হলো। তার প্রত্যেকটি পাতায় একটি করে ফেরেশতা আছে । আবূ যর-এর বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ৭ম আসমানের ওপরে আমাকে চড়ানো হলে আমি সেই জায়গাটায় চড়লাম যেখানে আমি (ফেরেশতাদের) কলম চালানোর আওয়াজ শুনতে পাই (বুখারী, কিতাবুস সালাত, ১ম খণ্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা, মিশকাত, ৫২৯ পৃষ্ঠা)। তারপর আমার কাছে ওহি করা হলো যা ওহি করার। প্রত্যেকদিন ও রাতে আমার ওপরে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হলো। তারপর আমি নেমে এলাম। পরিশেষে মূসার কাছে পৌঁছালাম। (মুসলিম, ১ম খন্ড, ৯১ পৃষ্ঠা, মুসান্নাফ ইবনে আবূ শাইবাহ, ১৪ খন্ড, ৩০৪)।
মূসা আ. আমাকে বললেন, আপনাকে কি নির্দেশ দেয়া হলো? আমি বললাম, দিন ও রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ দিন ও রাতে পড়তে পারবে না। কারণ, আল্লাহর কসম! আমি আপনার আগে লোকদেরকে পরীক্ষা করেছি এবং বনী ইসরাইলকে কঠিনভাবে যাচাই করেছি। তাই আপনি আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান। অতঃপর আপনার উম্মতের জন্য তা হাল্কা করার প্রার্থনা করুন। ফলে আমি ফিরে গেলাম। অতঃপর আমার নামাজ দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হলো। এমনিভাবে পাঁচবার প্রার্থনা করায় পঞ্চাশ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ৫২৮ পৃষ্ঠা) আনাসের বর্ণনায় আছে, যখন আমি পালনকর্তা এবং মূসার মাঝে ফেরাফেরি করছিলাম তখন একবার আল্লাহ বললেন, হে মুহাম্মদ এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দিন ও রাতে থাকলো। প্রত্যেক নামাজের জন্য দশ নেকী। তাই যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের পুণ্য দেয়া হবে। (মুসলিম, ১ম খন্ড, ৯১ পৃষ্ঠা, মিশকাত, ৫২৮ পৃষ্ঠা, মুসান্নাফ ইবনে আবূ শাইবাহ, ১৪ খন্ড, ৩০৪ পৃষ্ঠা)।
বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, মেরাজের রাতে রাসূলুল্লাহ সা.কে তিনটি জিনিস দেয়া হয়েছিল: ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ২. সূরা বাকারার শেষাংশ ৩. তার উম্মতের যে ব্যক্তি কোন জিনিসকেই আল্লাহর সাথে শরীক করে না তার ধ্বংসাত্মক পাপগুলোকে ক্ষমা করা (মুসলিম, ১ম খন্ড, ৯৬ পৃষ্ঠা, মিশকাত, ৫২৯ পৃষ্ঠা)।
আনাসের বর্ণনায় আছে, রসূলুল্লাহ সা. বলেন, জিবরীল যখন আমাকে নিয়ে ৭ম আকাশে চড়লেন। পরিশেষে একটি স্রোতধারার কাছে পৌঁছলেন। যার ধারে লাল ও সবুজ মার্বেল এবং মুক্তার পানপাত্র ছিল। এর কাছে সবুজ রং-এর পাখীও ছিল। ওটা সবচেয়ে উত্তম পাখী, যা আমি দেখেছি। তাই আমি জিবরীলকে বললাম, এই পাখীটি কি উত্তম। তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি জানেন, এই নহরটি কি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, এটা সেই কাওসার যা আপনাকে আল্লাহ দান করেছেন। তাতে সোনা ও চাঁদির পাত্র ছিল। যা লাল ও সবুজ পাথরের ছোট ছোট মিহি কাঁকরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তার পানিটা দুধের চেয়েও সাদা। তিনি বলেন, অতঃপর আমি তার পাত্র নিলাম। তারপর ঐ পানি এক আঁজলা নিলাম। তা পানও করলাম। তা ছিল মধুর চেয়েও মিষ্টি এবং কস্তুরির চেয়ে সুগন্ধী (তাফসীর দুর্রে মানসুর, ৪র্থ খণ্ড, ২৬৯ পৃষ্ঠা)।
তারপর তিনি নেমে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা. জিবরীলকে বললেন, আমার কি হল? আমি এমন কোন আসমানবাসীর কাছে আসেনি যারা আমাকে স্বাগতম জানাননি এবং আমার দিকে চেয়ে হাসেননি, কেবলমাত্র একজন ছাড়া। আমি তাকে সালাম দিয়েছি। তিনি তার জবাব দিয়েছেন এবং আমাকে স্বাগতম জানিয়েছেন। কিন্তু ঐ একজন আমার দিকে চেয়ে হাসেননি। জিবরীল বললেন, হে মুহাম্মদ! ইনি জাহান্নামের দারোগা মালেক। আমি যখন থেকে পয়দা হয়েছি তখন থেকে দেখেছি, ইনি হাসেননি। ইনি যদি কারো দিকে চেয়ে হাসতেন তাহলে অবশ্যই আপনার দিকে চেয়েই হাসতেন (ঐ-পৃষ্ঠা-ঐ, তাফসীর দুর্রে মানসুর, ৪র্থ খন্ড, ২৬২ পৃষ্ঠা)। ইবনে মারদোঅহে বর্ণনা করেছেন, জিবরীল ও মুহাম্মদ সা. যখন মসজিদটির বারান্দায় সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তখন জিবরীল বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি আপনার পালনকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করেছিলেন যে, তিনি আপনাকে হূরে-য়ীনদের (জান্নাতের সুলোচনা নারীদের) সাক্ষাত্ করাবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। জিবরীল বললেন, তাহলে চলুন সেইসব নারীর দিকে। অতঃপর তাদেরকে আপনি সালাম দিন। তারপর আমি তাদের কাছে এলাম। অতঃপর তাদেরকে আমি সালাম দিলাম। তারপর তারা আমাকে সালামের জওয়াব দিল। অতঃপর আমি বললাম, আপনারা কারা? তারা বললো, আমরা সর্বোত্তম সুন্দরী (হুরগণ) সত্কর্মশীল সম্প্রদায়ের বিবি। অতঃপর আমি একটু অগ্রসর হলাম। হঠাৎ কিছু দস্তরখানা নজরে পড়লো, যাতে কাটা কাটা গোশতের টুকরো রয়েছে। ওর কাছে কেউই আসছে না। আবার কিছু দস্তরখানা দেখলাম যাতে দুর্গন্ধযুক্ত মাংস রযেছে। এর কাছে কিছু লোক রয়েছে যারা ও থেকে কিছু খাচ্ছে। আমি বললাম, হে জিবরীল এরা কারা? তিনি বললেন, এরা আপনারই উম্মত, যারা হারামের কাছে আসতো এবং হালালকে ছেড়ে দিত ।
তারপর আমি আরেকটু অতিক্রম করলাম। তখন এমন সম্প্রদায়ের দেখা পেলাম যাদের ঠোঁটগুলো উটের ঠোঁটের মত। অতঃপর তাদের মুখগুলো খোলা হচ্ছে। তারপর তাতে অঙ্গারের লোকমাহ (গ্রাস) দেয়া হচ্ছে। তারপর তা তাদের নীচে দিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। অতঃপর আমি তাদেরকে আল্লাহর কাছে চীৎকার করতে শুনলাম। তাই আমি বললাম, এরা কারা? হে জিবরীল! তিনি বললেন, এরা আপনার উম্মতের তারা, অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের মালধন খেত যারা। তারা নিজেদের পেটের মধ্যে কেবলমাত্র আগুন খেতো। তারপর আমি আরেকটু অতিক্রম করলাম। অতঃপর এমন নারীদের দেখলাম, যারা ঝুলছে। অতঃপর আমি তাদেরকে আল্লাহর কাছে চিৎকার করতে শুনতে পেলাম। আমি বললাম, হে জিবরীল! এরা কারা? তিনি বলেন, এরা আপনার উম্মতের ব্যাভিচারিণীগণ। (তাহযীবু সীরাতি ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ৯৩ পৃষ্ঠা)।
তারপর আমি একটু অতিক্রম করলাম। অতঃপর এমন একটি সম্প্রদায়কে পেলাম যাদের পার্শ্বগুলো থেকে মাংস কাটা হচ্ছে। অতঃপর তারা সেটাকে খাবার লুকমাহ বানাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটাকে তোমরাও খাও যেমন তোমরা। (গিবত করে) তোমাদের ভাইদের গোশ্ত খেতে। আমি বললাম, হে জিবরীল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা আপনার উম্মতের পরনিন্দাকারী ও একের কথা অপরকে লাগায় যারা (তাফসীর ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, ১৩ পৃষ্ঠা, দালায়িলুন নবুওঅহ্ ২য় খন্ড ১৩৬ পৃষ্ঠা।
আবু যর রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আমি যখন প্রথম আকাশে চড়লাম তখন একজন লোককে বসা অবস্থায় পেলাম। তার ডানদিকে কিছুলোকের ছায়া দেখলাম এবং তার বামদিকে কিছুলোকের ছায়া দেখলাম। তিনি যখন ডানদিকে দেখছিলেন তখন তিনি হাসছিলেন এবং যখন তিনি নিজের বামদিকে তাকাচ্ছিলেন তখন কাঁদছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, সত্ নবীকে ও সত্ পুত্রকে স্বাগতম! তখন আমি জিবরীলকে বললাম, ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি আদম। আর তার ডান ধারের ছায়াগুলো হচ্ছে জান্নাতবাসী এবং বামধারের ছায়াগুলো জাহান্নামাবাসী। তাই যখন তিনি ডানদিকে দেখছেন তখন হাসছেন এবং যখন বামদিকে দেখছেন তখন তিনি কাঁদছেন (বুখারী, ১ম খন্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা, বা-বু কাইফা ফুরিযাতিস্ সলাত-৩)।
মেরাজ নিয়ে যাই বলা হোক না কেন এটা যে বিনা পর্দায় প্রেমিক প্রেমাষ্পদের মিলন ছিল এ কথা বললে ভুল হবে না। এ ব্যাপারে সূরা আন নজমের শুরুতে কিছু ইঙ্গিত স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন ছুম্মা দানাঃ আও আদনা (তিনি আরও নিকটবর্তী হলেনঃ এবং আরও নিকটবর্তী)। তিনি মাবুদ দয়াময় আল্লাহর কত নিকটবর্তী হয়েছিলেন এ সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই এবং দেয়া সম্ভবও নয়। কারণ ‘দরমিয়ানে আশেক ও মাশেককে’ রানজিস্ত কেরামান কাতেবীনরা হাম খবরনিস্ত প্রেমিক প্রেমাষ্পদের মধ্যে প্রেমের যে খেলা চলে তা সম্পর্কে কেরামান কাতেবীনও কিছুই জানে না। শাব্দিক অর্থে ঊর্ধ্বগমনকে মিরাজ বলে। মহানবী সা. এর জীবনের একটি বিশেষ রজনী রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতের অলৌকিক সফরকে মিরাজ বলা হয়। কোরআনের ভাষায় মিরাজকে আসরা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘সুবহানাল্লাহি আসরা বিআবদিহী লাইলাম মিনাল মাসজিদিল হারামে ইলাল মাসজিদিল আকসাল্লাজি বারাকনা হাওলাহু লিনূরিয়াহুমিন আয়াতিনা ইন্নাহু হুয়াসসামিউল আলীম। [পরম পবিত্র মহিমান্বিত সেই আল্লাহ যিনি তাঁর এক প্রিয় বান্দাকে (মুহাম্মদ সা.) রাতের কিছু সময়ে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন যার চারপাশ আগেই বরকতময় করে রাখা হয়েছিল যেন আমি তাকে অদৃশ্য জগতের নিদর্শনগুলো দেখাতে পারি। কারণ সর্বদৃষ্ট ও সর্বশ্রোতা স্বয়ং তিনিই। মিরাজকে বুঝতে হলে সূরা আন নজমের বিশেষ অধ্যয়ন জরুরি। যেখানে আল্লাহ বলেছেন, ওয়াহুয়া বিলউফুকিল আ’লা সুম্মাদানা ফাতাদাল্লা ফাকানা ক্বাবা কাউসাইনে আউ আদনা (এবং তিনি ঊর্ধ্বদিগন্তে ছুটে চললেন অতঃপর নিকটবর্তী হয়ে যেন ঝুলে রইলেন, তখন উভয়ে দুই ধনুকের ব্যবধান দূরত্বে বা তার থেকে কম দূরত্বে ছিলেন) এই কম দূরত্ব সম্পর্কে আতাউল্লাহ শাহ বুখারীকে তার শাগরেদ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আল্লাহ যেখানে তার পরিমাণ বলেননি তার পরিমাণ মানব মুখে বলা সম্ভব নয়। শাগরেতটি নাছোড়বান্দা হয়ে ধরলে শাহসাব তার পাগড়ি খুলে ছেলেটির মাথা ঢেকে দিয়ে বলেন, ‘তুমি নিজে দেখে লও মেরাজ রাতে নবী সা. আল্লাহর কত কাছে এসেছিলেন’। ছেলেটি যা দেখার তা দেখার পর পাগড়ি সরিয়ে বর্ণনা করতে বললে অপরগতা প্রকাশ করে বলে হুজুর তা বলা সম্ভব নয়, তা শুধু অনুভবের বিষয়, বর্ণনার নয়। আসলে আল্লাহর রহস্যকে গোপন রাখাই ভাল। দিগন্তের নীলিমায় পাহাড়ের গায়ে যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে পাহাড় তা দূর থেকে দেখাই বুদ্ধিমানের কাজ। কাছে গেলে আকাশ দূরে সরে যাবে আর পাহাড়কে মাটি পাথরের স্তূপ মনে হবে। এ জন্যই বলা হয় ‘পাহাড় দূর ছে বাহার’ ‘পাহাড়ে সৌন্দর্য দূরে থেকেই’।
নবী জীবনে মেরাজ কেন? কোন নবীর জীবনেই মেরাজ সংঘটিত হয়নি কেন এর উত্তরে বলা যায় তিনি বিশ্বনবী আখেরী পয়গাম্বর। পৃথিবী মহাবিশ্বের একটি মাত্র ছোট গ্রহ আরও হাজার হাজার গ্রহপুঞ্জ মহাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, সেখানে নবুয়তি দায়িত্ব পালনের জন্যই আল্লাহ তাঁকে ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে বিজলী গতিতে ২৭ বছর নবুয়তি দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। মহানবী সা. এর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ইসলামী দাওয়াতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিবি খাদিজা রা. এবং দাদা আবদুল মোত্তালিবের ইন্তেকালের পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঊর্ধ্বজগতের সবকিছু চাক্ষুস দেখিয়ে মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনেন এবং সব নবীর নামাজের নেতৃত্ব দিয়ে ‘ইমামুল আম্বিয়া’ হিসেবে ভূষিত করেন।
১৫. মদিনায় ইসলামের আলো
মক্কায় রাসূল সা. এর নবুয়তী জীবনের ১৩ বছরের শেষ পর্যায়। নবুয়ত বর্ষ ১২। হজ্জ উপলক্ষ্যে মদিনা থেকে আগত ১২ জন লোক গোপনে রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করেন। তারা ঈমান আনার ঘোষণা দেন এবং মদিনায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে ফিরে যান। রাসূল সা. তাঁর সাহাবী মুসআব –কে মদিনার লোকদেরকে ইসলাম শিক্ষা প্রদান এবং সেখানে ইসলামের দাওয়াতী কাজ প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁদের সাথে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। ফলে পরের বছর হজ্জ উপলক্ষ্যে ৭৫ জন লোক এসে গোপনে আকাবা নামক স্থানে রাসূল সা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তারা রাসূল সা. কে মদিনায় হিজরত করার দাওয়াত দিয়ে যান। মদিনা আক্রান্ত হলে জান-মাল দিয়ে তা প্রতিরোধ করারও শপথ নিয়ে যান।
১৬. হিজরতের প্রস্তুতি
সাহাবীগণের উপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। রাসূল সা. মনে মনে মদিনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সে হিসেবে সাহাবীদেরকে যার যেভাবে সম্ভব গোপনে হিজরত করে মদিনায় চলে যাবার অনুমতি দেন। ফলে যাদেরই হিজরত করার সামর্থ্য ছিল, তারা হিজরত করে মদিনায় চলে যান। থেকে যান আবুবকর। রাসূল সা. তাঁকে নিজের হিজরতের সাথী বানানোর কথা জানিয়ে দেন।
১৭. হত্যার ষড়যন্ত্র
নবুয়তের ১৩ বছর মাত্র পূর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ সাহাবী হিজরত করে মক্কা ছেড়েছেন। এ সময় ইসলামের শত্রুরা আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে এসে তারা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সকালে বের হলেই তাঁকে হত্যা করা হবে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের কথা পরবর্তীতে কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে, “স্মরণ করো, কাফিররা তোমাকে বন্দী করার, কিংবা হত্যা করার, অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করার ষড়যন্ত্র করছিল। তারা লিপ্ত ছিল তাঁদের চক্রান্তে। এদিকে আল্লাহও তাঁর পরিকল্পনা পাকা করে রাখেন। আল্লাহই সবচে’ দক্ষ পরিকল্পনাকারী।” (সূরা আনফাল, আয়াত ৩০)
মহান আল্লাহ তাঁদের চক্রান্তের খবর আগেই তাঁর রাসূলকে জানিয়ে দেন। তিনি তাঁদের চোখে ধুলা দিয়ে বেড়িয়ে পড়েন হিজরতের উদ্দেশ্যে। ব্যর্থ হয়ে যায় আল্লাহর রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্র।
১৮. রাসুলুল্লাহর হিজরত
৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ রমজান প্রথম অহি লাভের পর রাসূলুল্লাহ সাঃ ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। এতে মুষ্টিমেয় মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলেও মক্কার কাফের মুশরিকরা তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে। নির্যাতনের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করলে আল্লাহ পাকের নির্দেশে তিনি মক্কা ত্যাগ করে প্রায় ২৯৬ মাইল উত্তরে অবস্থিত তদানীন্তন ইয়াসরীব নগরীতে চলে যান। হযরত আলী রাঃ কে নিজের বিছানায় ছাদর আবৃত রেখে হযরত আবু বকর রাঃ কে সাথে নিয়ে মক্কা ত্যাগ করেন। পথিমধ্যে সারে গাওরে আত্মগোপন করেছিলেন আর হযরত আলী রাঃ নিজের জীবনের মায়া না করে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর বিছানায় শুয়ে থেকে তাঁকে মক্কা ত্যাগ করতে সহযোগিতা করেছিলেন। শত্রুদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মক্কা থেকে মদিনা উত্তর দিকে হলেও তারা প্রথমে রওয়ানা করেন দক্ষিণ দিকে। কয়েক মাইল দক্ষিণের সওর নামক পাহাড়ের গুহায় তিন দিন অবস্থান করেন। তিন দিন পর সেখান থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এদিকে তার রক্ত পিপাসুরা হন্যে হয়ে খুজেও তাঁর নাগাল পায়নি। তারা তাঁকে ধরার জন্যে শত উট পুরস্কার ঘোষণা করে। এ ঘটনাই ইতিহাসে হিজরত নামে ভাস্বর হয়ে আছে। রাসূলুল্লাহ সাঃ এর আগমনে গোটা ইয়াসরীব আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়। তারা রাসূলুল্লাহ সাঃ কে সানন্দে বরণ করে নেন। পরবর্তীতে ইয়াসরীবের নামকরণ করা হয় মদিনাতুন্নবী (নবীর শহর) যা বর্তমানে মদিনা মুনওয়ারা নামে খ্যাত।
১৯. মদিনায় রাসুলুল্লাহ
রাসুলুল্লাহ সা. আসছেন এ খবর আগেই পৌঁছে গেছে মদিনায়। আনন্দে মাতোয়ারা মদিনা। সম্বর্ধনার বিরাট আয়োজন। মদিনার আবাল বৃদ্ধ জনতা সানিয়াতুল বিদা উপত্যকা পর্যন্ত এগিয়ে এসে তাঁকে সম্বর্ধনা জানায়। মক্কা ত্যাগ করে। মদিনা তাঁকে বরন করে নেয়। তিনিও বরণ করে নেন মদিনাকে। মক্কা বিজয়ের পরেও তিনি ত্যাগ করেননি মদিনা।
২০. মদিনার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু
মদিনার পূর্ব নাম ছিলো ইয়াসরিব। রাসুলুল্লাহর আগমনের ফলে পাল্টে যায় ইয়াসরিবের নাম। তখন থেকে এ শহরের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। সংক্ষেপে মদিনা। মদিনায় আগমনের পরপরই তিনি এখানে ইসলামী সমাজ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন। যেমন –
১. প্রথমে চৌদ্দ দিন কুবা নামক স্থানে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
২. তারপর আসেন মূল অবস্থানের জায়গায়। এখানে জমি ক্রয় করেন। ‘মসজিদে নববী’ প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. হিজরত করে আসা সহায় সম্বলহীন মুসলিম এবং মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। ফলে মুহাজিররা আনসারদের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়।
- ৪. ‘মদিনা সনদ’ নামক খ্যাত মদিনার প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে নেন মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদেরকে, মদিনায় অবস্থানরত বিভিন্ন গোত্র ও কবিলাকে এবং সেখানকার ইহুদী গোত্রগুলোকে। এদের সবাইকে একটি ভৌগোলিক জাতি ঘোষণা করেন। শত্রুদের আক্রমন প্রতিহত করার ব্যাপারে সবাই মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে চুক্তিবদ্ধ হয়।
২১. কুরাইশদের আশংকা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি
মুহাম্মদ সা. হিজরত করে মদিনায় চলে আসার কারণে কুরাইশরা নিজেদেরকে বড় ধরনের বিপদের ঝুঁকির মধ্যে অনুভব করছিল। তারা চিন্তা ভাবনা করে দেখল –
১. মদিনায় থেকে মুহাম্মদ স্বাধীনভাবে তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করার সুযোগ পেয়ে গেল।
২. মুহাম্মদ গোটা আরবে তাঁর ধর্ম ছড়িয়ে দেবে এবং সব গোত্র ও কবিলার উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবে।
৩. সুযোগ মতো মুহাম্মদ মক্কা আক্রমন করে আমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে এবং আমাদের মক্কা থেকে উৎখাত করবে।
এসব ভেবে কুরাইশরা রাসূল সা. এর ভিত মজবুত হবার আগেই মদিনা আক্রমণ করে তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২২. রাসুলের বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধ
এদিকে কুরাইশদের পক্ষ থেকে মদিনা আক্রমন হতে পারে এ কথা রাসূল সা. নিজেও ভেবে রেখেছেন।
বদর যুদ্ধ – কুরাইশরা আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। তাঁদের কাছে ছিল ঘোড়া এবং আধুনিক সব সমরাস্ত্র।
রাসূল সা. তাঁদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তিনশো তের জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করেন। বাহিনীর কাছে অশ্ব এবং আধুনিক অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। দ্বিতীয় হিজরির ১২ বা ১৭ রমযান বদর প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ছিল এক ঐতিহাসিক আদর্শিক যুদ্ধ। অবশেষে এ যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী বিজয়ী হয়। আগ্রাসী কুরাইশ বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে আগ্রাসী কুরাইশদের সেনাপতি আবু জেহেল সহ ৭০ জন নিহত হয় এবং আরো ৭০ জন মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়। এদিকে ২২ জনজন মুসলিম সেনা শাহাদাৎ বরণ করেন। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায়।
উহুদ যুদ্ধ– কুরাইশরা বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পরের বছর তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে আবার মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। এবার তারা তাঁদের প্রভাবিত পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে নেয়। তারা তিন হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। রাসূল সা. যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। যুবকদের আগ্রহের কারণে তিনি মদিনার বাইরে গিয়ে উহুদ পাহাড়ের কাছে শত্রু বাহিনীর মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। সাতশো জানবাজ সাহাবীর বাহিনী নিয়ে তিনি উহুদে এসে পৌঁছান। উহদ পাহাড়কে পেছনে রেখে রাসূল সা. যুদ্ধ লড়ার স্থান নির্ধারণ করেন। পেছনের আইনান পাহাড়ে একটা সুড়ঙ্গ ছিলো। শত্রু বাহিনী এ সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে তাঁদের পেছন দিক থেকে আক্রমন করতে পারে এ আশংকায় রাসূল সা. সুড়ঙ্গ মুখে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী নিযুক্ত করেন। তাঁদের নির্দেশ দেন, যুদ্ধে আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমরা কোন অবস্থাতেই এ স্থান ত্যাগ করবে না। যুদ্ধ শুরু হল। মুসলিম বাহিনীর আক্রমনের তীব্রতায় টিকতে না পেরে কুরাইশ বাহিনী তাঁদের সাজ সরঞ্জাম ফেলে পালাতে শুরু করে। মুসলিম বাহিনী তাঁদের চরম তাড়া করে। এদিকে সুড়ঙ্গ মুখে নিয়োজিত লোকেরা ভাবলো, যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়ী হয়েছে। ফলে তাড়া তাঁদের সেনাপতি আব্দুল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে মূল বাহিনীর সাথে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। আব্দুল্লাহ মাত্র বারো জন তীরন্দাজ নিয়ে নিজের অবস্থানে অটল থাকেন। এদিকে শত্রু পক্ষের অশ্বারোহী দলের প্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ সুড়ঙ্গ পথ অরক্ষিত পেয়ে এখান দিয়ে ঢুকে পড়েন। আব্দুল্লাহ এবং তাঁর সাথীরা তাঁদেরকে প্রতিহত করার প্রাণপন চেষ্টা করে শাহাদাৎ বরণ করেন। খালিদ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা করে। মুসলিম বাহিনী এদের প্রতিহত করার জন্যে পেছনমুখী হলে পলায়নপর শত্রু বাহিনী ঘুরে দাড়ায়। শুরু হয় দ্বিমুখী আক্রমন। ফলে মুসলিম বাহিনী হতভম্ব হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে রাসূল সা. সবাইকে একত্রিত করেন এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুপক্ষকে তাড়া করেন এবং তারা মক্কায় ফিরে যায়। এরই মধ্যে মুসলিম বাহিনীর বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। ৭০ জন সাহাবী শাহাদাৎ বরণ করেন। আহত হন অনেকে। কয়েকজন সৈনিক কর্তৃক সেনাপতির নির্দেশ লংঘনের ফলে মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে এই বিরাট বিপর্যয়।
খন্দকের যুদ্ধ – পঞ্চম হিজরি সন। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হতে না পারলেও কুরাইশরা ভালোভাবেই বুঝেছিল, তাঁরাও বিজয়ী হতে পারেনি। মুসলিমদের স্থান পূর্বের অবস্থায়ই সদর্পে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তারা বিশাল প্রস্তুতি নেয়। আশেপাশের সব মিত্র গোত্রের যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে তারা অগ্রসর হয় মদিনার দিকে। এদিকে রাসূল সা. যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। এবার তিনি এক অভিনব কৌশল গ্রহণ করেন। তাহলো, মদিনায় প্রবেশের গোটা এলাকা জুড়ে তিনি পরীখা খননের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজে এবং সক্ষম সকল সাহাবীরাই পরীখা খননের কাজে অংশ নেন। দশ গজ চওড়া, পাঁচ গজ গভীর সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ পরীখা তারা খনন করে ফেলেন। এতে প্রায় তিন লাখ আট হাজার বর্গগজ মাটি খনন ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়ে রাসূল সা. মাত্র পনের দিনে এ বিশাল যুদ্ধ কৌশল বাস্তবায়ন করেন। এতেই বুঝা যায়, তারা কতটা পরিশ্রম করেছেন। মাথা প্রতি প্রায় এক হাজার বর্গগজের চাইতে বেশী মাটি কাটতে ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। পরিখা খননের কাজ শেষ হতে না হতেই কম বেশী দশ হাজার বাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে কুরাইশরা মদিনার উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়। কিন্তু অভিনব কৌশলের পরিখা দেখে তাঁদের মাথায় হাত। তবে মদিনার ঘরের শত্রু ইহুদীরা কুরাইশদের সাথে গপনে হাত মিলিয়ে ফেলে। ফলে মুসলিমদের বাড়ি ঘরগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। কিন্তু মহান আল্লাহর সাহায্যে কুরাইশ বাহিনী দীর্ঘ এক মাস মদিনা অবরোধ করে রেখেও কোন সুবিধা করতে পারে নি। এ সময় এক রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড় কুরাইশদের তাঁবুগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁদের বাহিনী পুরোপুরি মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং রাতের অন্ধকারেই তারা মদিনা অবরোধ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপরই রাসূল সা. মদিনা সনদ ভঙ্গকারী ইহুদী গোত্র বনু কুরাইশদের চরমভাবে শায়েস্তা করেন। মহান আল্লাহ এ যুদ্ধের পর্যালোচনা করেছেন সূরা আহযাবের ৯-২৭ নং আয়াতে। মহান আল্লাহ বলেন-
“হে মুমিনরা, স্মরণ করো তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের এখানে এসে পড়েছিলো, তখন আমরা তাঁদের প্রতি পাঠিয়েছিলাম ঝরো হাওয়া আর এমন এক বাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি।” (আহযাব, আয়াত ৯)
কুরাইশরা চলে যাবার পড়ে রাসূল সা. ঘোষণা দিলেন- “কুরাইশরা আর কখনো মদিনা আক্রমণ করতে পারবে না। ”
এগুলো ছিল বড় বড় যুদ্ধ, এ ছাড়াও আরো অনেক ছোট খাটো অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
২৩. হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং এর সুফল
ষষ্ঠ হিজরি সন। রাসুলুল্লাহ সা. স্বপ্নে হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার নির্দেশ পান। জেনে রাখা ভালো, নবীদের স্বপ্নও অহী। সে অনুযায়ী তিনি সে বছর যিলকদ মাসের শেষ দিকে চৌদ্দশত সাহাবী নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সাথে করে নেন কুরবানীর উট। হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের বাধা দেয়া মক্কার সনাতন ধর্মেও নিষেধ ছিল। কিন্তু কুরাইশরা রাসূল সা. এর কাফেলাকে মক্কার নিকটবর্তী হুদাইবিয়া নামক স্থানে এসে বাধা দেয়। তিনি উসমান রা.কে মক্কায় পাঠান তাঁদের নেতাদের একথা বলার জন্যে যে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আসিনি। আমরা হজ্জ, উমরা, কুরবানী ও যিয়ারত শেষে চলে যাব। আমরা কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা তাঁর কথা শুনেনি। তারা তাঁকে আটকে রাখে। উসমানকে অর্থাৎ রাসূলের দূতকে আতক করার সংবাদ শুনে সাহাবীগণ উসমানকে উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞা করেন। তারা এ উদ্দেশ্যে রাসূল সা. এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ শপথে সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ সাহাবীদের প্রসঙ্গে বলেন, “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।” (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত ১৮)
অবশ্য পরে কুরাইশরা উসমান রা. কে ছেড়ে দেয়। তিনি ফিরে আসেন। তারা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসে। রাসূল সা. তাঁদের আরোপিত শর্তানুযায়ী সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সন্ধির অধিকাংশ শর্তই ছিল বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্যে অপমানজনক। কিন্তু তাতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার একটি ধারা ছিল। সাহাবীগণ মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া সত্যেও রাসূল সা. এই ধারাটিকে লুফে নিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে এ বছর উমরা না করে পরের বছর উমরা করার একটি শর্ত ছিল। সে অনুযায়ী রাসূল সা. কাফেলা নিয়ে ফিরে চললেন মদিনার দিকে। পথিমধ্যেই নাযিল হল সূরা আল ফাতাহ। এ সুরার প্রথম আয়াতেই বলা হয়েছে, ‘হে নবী, আমরা তোমাকে এক সুস্পষ্ট বিজয় দিলাম।’
সত্যিই এ ছিল এক সুস্পষ্ট বিজয়। রাসূল সা. সাহাবীগণকে নিয়ে নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণ করতে থাকলেন। দুই বছরের মধ্যেই কুরাইশরা বন্ধুহীন হয়ে পড়ল। খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং আমর ইবনুল আস সহ কুরাইশদের অনেক বড় বড় সেনাপতি এরই মধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন।
২৪. মক্কা বিজয়
হুদাইবিয়ার সন্ধিতে যে অন্যায় শর্তাবলী দিয়ে চুক্তি সম্পাদিত করেছিল, সেগুলো তাঁদের জন্যেই বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে চুক্তি তারা নিজেরাই ভংগ করে। অপরদিকে রাসূল সা. নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াতী কাজ করতে থাকেন। ইসলামী জনবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আরবের অধিকাংশ গোত্রই পর্যায়ক্রমে কুরাইশদের সাথে মিত্রতা ত্যাগ করে। যাই হোক, চুক্তি ভংগের কারণে রাসূল সা. মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। অষ্টম হিজরি সনের ১০ রমযান। রাসূল সা. দশ হাজার অনুসারী সাথে নিয়ে রওয়ানা করলেন মক্কা অভিমুখে। ২০ রমযান মুহাম্মদ সা. বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন মক্কায়। আজ আর তাঁকে বাধা দেয়ার কোন শক্তি কারো ছিল না। সম্পূর্ণ বিনা বাধায় আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে তিনি এবং তাঁর সাথীরা মক্কার হারাম শরীফে প্রবেশ করেন।
ভেঙ্গে ফেলেন আল্লাহর ঘরে রাখা ৩৬০ টি মূর্তি। তাঁকে চরম কষ্ট দিয়ে থাকলেও তিনি ক্ষমা করে দেন মক্কার লোকদের। তিনি তাঁদের বলেন- ‘আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত। মক্কার আশেপাশের গোত্রগুলোতে রক্ষিত মূর্তিগুলোও নির্মূল করা হল। মক্কা ভূমি থেকে উৎপাটিত করা হল শিরকের শিকড়। ঘোষণা করা হলো আল্লাহর একত্ব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহর রাসূল সা. কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান করেন। এখান থেকে গিয়ে অভিযান চালিয়েই জয় করেন, হাওয়াযীন ও বনু সাকিফ। হোনায়েন প্রান্তরে যুদ্ধ হয় এদের সাথে। তারা চরমভাবে পরাজিত হয়। এ সময় তিনি তায়েফও অধিকার করেন। মক্কা বিজয় উপলক্ষে রাসূল সা. উনিশ দিন মক্কায় অবস্থান করেন। হোনায়েন ও তায়েফ যুদ্ধের পর ফিরে আসে মদিনায়।
২৫. ইসলামের ছায়াতলে জনতার ঢল
মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণের জন্যে জনতার স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে মদিনার অভিমুখে। আরব উপদ্বীপের ছোট বড় সব গোত্র তাঁদের প্রতিনিধি দল পাঠাতে থাকে আল্লাহর রাসূলের কাছে তাঁদের ইসলামের ছায়াতলে আগমনের সংবাদ জানাবার জন্যে। মক্কা বিজয়ের পরবর্তী বছর বড় ছোট শতাধিক প্রতিনিধি দল মদিনায় এসে তাঁদের এবং তাঁদের গোত্রের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। ইসলামের ছায়াতলে এই জনস্রোতের আগমনের কথা মহান আল্লাহ কুরআন মজিদে উল্লেখ করেছেন, “যখন এসেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং তুমি দেখতে পাচ্ছো, লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করছে আল্লাহর দ্বীনে। তখন তোমার প্রভুর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর তাঁর কাছে। অবশ্যি তিনি পরম ক্ষমাশীল দয়াবান।” (সূরা আন নাসর)
২৬. তাবুক যুদ্ধ
রাসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক সবচেয়ে বড় অভিযান ছিলো তাবুক অভিযান। এ অভিযান ছিলো বর্তমান সিরিয়া ও জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত তৎকালীন বৃহৎশক্তি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। অভিযানের রয়েছে পূর্ব ঘটনা। তাহলো, হুদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসূল সা. মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে গোটা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠান। এছাড়া সর্দার ও শাসকদের কাছে পত্র মাধ্যমে দাওয়াত দিয়ে দূত পাঠান। সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি তাঁর একটি পনের সদস্যের দাওয়াতী প্রতিনিধিদলকে খ্রিষ্টানরা হত্যা করে। প্রাণে বেঁচে আসে শুধুমাত্র দলনেতা কাব বিন উমায়ের গিফারী। একই সময় রাসূল সা. বুসরার গভর্নরের কাছে দাওয়াত নিয়ে পাঠিয়েছিলেন হারিস বিন উমায়েরকে। কিন্তু রোম সম্রাটের অনুগত এই খৃষ্টান সর্দার আল্লাহর রাসূলের দূতকে হত্যা করে। রোম সাম্রাজ্যের এসব অন্যায় ও অপরাধমূলক আগ্রাসী থাবা থেকে আরব অঞ্চলকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে অষ্টম হিজরির জমাদিউল উলা মাসে রাসূল সা. হযরত যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়ার দিকে পাঠান। কিন্তু এই সেনাদলটি মাআন নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন, বুসরার গভর্নর শুরাহবিল এক লাখ সৈন্য নিয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার জন্যে এগিয়ে আসছে। সামনে অগ্রসর হয়ে মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখ সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তিন হাজার মুসলিম এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্যাপক হতাহত হয় শুরাহবিল বাহিনী। এ যুদ্ধে বারোজন মুসলিম সেনাও শহীদ হন। এই বারো জনের মধ্যে মুসলিম বাহিনীর তিন সেনাপতিও অন্তর্ভুক্ত। তারা হলেন- যায়িদ বিন হারিসা, জাফর বিন আবু তালিব এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা.। পরের বছর নবম হিজরিতে রোম সম্রাট কাইজার মুসলমানদের থেকে মুতা যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া এবং তাঁদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া সীমান্তে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। জানা যায়, তারা সীমান্তে দুই লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। আরব ভূখণ্ডের দিকে আর এক কদমও অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই রাসূল সা. তাঁদেরকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ অভিযান ছিল ব্যাপক দূরত্বের অভিযান। ছিলো গরমের মওসুম, অর্থনৈতিক সমস্যা, ফসল পাকার মওসুম, সোয়ারীর অভাব। তা সত্যেও রাসূল সা. বৃহৎ শক্তির হামবড়া ভাব স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। নবম হিজরির রযব মাসে তিনি ত্রিশ হাজার মুজাহিদকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন সিরিয়া সীমান্তের দিকে। এদিকে রোম সম্রাট ত্রিশ হাজার মুসলিম সৈন্যের আগমনের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। বিশ্বনবী সা. তাবুক নামক স্থানে পৌঁছে খবর পান, কাইজার সিরিয়া সীমান্ত থেকে তাঁর বাহিনী গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে সিরিয়া প্রবেশ না করে রাসূল সা. বিশ দিন তাবুকে অবস্থান করেন। আরব ভূখণ্ডে কাইজারের যেসব ছোট ছোট করদ রাজ্য ছিলো, তিনি সেগুলোর সর্দারদের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট বাহিনী পাঠান। এতে করে তারা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এভাবে আল্লাহ পাক স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসলামের প্রভাব সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সূরা আত তওবার ৩৮-৭২ নং আয়াত তাবুক যুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে এবং ৭৩ থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত আয়াতগুলো তাবুক থেকে ফিরে আসার পরে নাযিল হয়। এ আয়াতগুলোতে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে উৎসাহ প্রদান এবং তাবুক যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়েছে। সূরা তাওবার এ আয়াতগুলো পড়লে তাবুক যুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া যাবে।
২৭. বিদায় হজ্জ
হজ্জ ফরয হওয়ার পর রাসূল সা. একবারই হজ্জ করেন। আবার এ হজ্জেই তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। সে কারণে এ হজ্জকে বিদায় হজ্জ বলা হয়। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সা. এর বিদায়ী হজ্জ। দশম হিজরি সন। এ বছর বিশ্বনবী, বিশ্বনেতা মুহাম্মদ সা. হজ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পর্যন্তকার গোটা মুসলিম মিল্লাতকে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, রাসুলুল্লাহর হজ্জে যাবার খবর। সব গোত্র ও কবিলার সামর্থ্যবান মুসলিমরা হজ্জে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চতুর্দিকে বইয়ে চলছে আনন্দের বন্যা। দশ হিজরি সনের ২৬ জিলকদ তারিখে আল্লাহর রাসূল সা. হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। ৫ জিলহজ্জ তারিখে মক্কায় পৌঁছান। হজ্জ শেষে ১৪ যিলহজ তারিখে ফিরে রওয়ানা করেন মদিনা অভিমুখে। এ হজ্জ উপলক্ষ্যে আল্লাহর রাসূল সা. দুটি ভাষণ প্রদান করেন। একটি আরাফার ময়দানে অপরটি মিনায়। তাঁর এ ভাষণ ছিলো ইসলামের এক অনন্য মেনিফেস্টো। এক লাখ চব্বিশ হাজার, কোন কোন বর্ণনায় এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর সাথে হজ্জে শরীক হয়েছিলেন। তাঁর এ হজ্জই মুসলিম উম্মাহর জন্যে হজ্জের মডেল।
২৮. বিদায় হজ্জের ভাষণ
হজ্জ উপলক্ষে রাসূল সা. দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি ৯ যিলহজ্জ তারিখে আরাফার ময়দানে। অপরটি ১০ যিলহজ্জ তারিখে মিনায়। এ দুটি ভাষণে তিনি অনেকগুলো মৌলিক নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো—
১. আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ তাঁর দাস ও রাসূল।
২. আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনা করবে।
৩. তোমাদের প্রত্যেকের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র। পরস্পরের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন নিষিদ্ধ করা হলো।
৪. আমানাত তাঁর প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে দেবে।
৫. সুদ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হল।
৬। জাহেলী যুগের সমস্ত কুসংস্কার রহিত করা হল।
৭. খুনের প্রতিশোধ যুদ্ধ রহিত করা হল।
৮. ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অনিচ্ছাকৃত হত্যার দণ্ড একশো উট।
৯. তোমরা শয়তানের আনুগত্য করো না।
১০. তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের উপর স্বামীদের অধিকার হলো তারা স্বামী ছাড়া আর কারো সাথে যৌনাচার করবে না। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তারা তাঁর অর্থসম্পদ খরচ করবে না।
১১. স্বামীদের উপর স্ত্রীদের অধিকার হলো, তারা পবিত্র জীবন যাপন করলে স্বামী প্রচলিত উত্তম পন্থায় তাঁদের জীবন সামগ্রী প্রদান করবে।
১২. একজনের অপরাধের জন্যে আর একজনকে দণ্ড দেয়া যাবে না।
১৩. তোমাদের নেতা কোন নাক বোঁচা হাবশি হলেও সে যদি আল্লাহর কিতাবের আনুগত্য করে, তবে তাঁর আদেশ পালন করবে।
১৪. মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই।
১৫. সমস্ত মানুষের স্রষ্টা একজন। সবার পিতাও একজন। সুতরাং কোন মানুষের উপর অপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
১৬. তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান সে, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ও ন্যায়নীতিবান।
১৭. তোমাদের অধিনস্তদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হও। তাঁদের প্রতি অন্যায় করো না। তাঁদের আঘাত করো না। তোমরা যা খাবে, পরবে, তাদেরকেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
১৮. বিবাহিত ব্যাভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
১৯. উত্তরাধিকার কে কতটুকু পাবে, স্বয়ং আল্লাহ তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ারিশদের জন্যে আর অসিয়ত করা যাবে না।
২০. মনে রেখো, ঋণ অবশ্যি পরিশোধ করতে হবে।
২১. মনে রেখো, দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না।
২২. যারা এখানে উপস্থিত আছো, তারা এ ফরমানগুলো অনুপস্থিতদের কাছে, পরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দেবে।
২৯. গাদীরে খুম
দশম হিজরির ১৮ জিলহজ বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে ‘গাদীর’ নামক স্থানে সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নাজিল হওয়ার পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা. তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী রা. কে নিজের উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন । নবী করীম সা. শেষবারের মত যখন হজ করে আসেন এবং গাদীরে খোমের নিকটবর্তী রাস্তায় আসেন তখন আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর হাবীবের ওপরে ওহী নাজিল হল- যা সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াত নাজিল হওয়ার পরে নবী করীম সা. তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত বেলাল রা. কে বললেন: চারদিকে যারা চলে গেছে তাদেরকে ফিরিয়ে আন এবং পেছন দিক থেকে যারা আসছে তাদেরকে এখানে অবস্থান করতে বল কারণ, এখানে আমি ভাষণ দেব। আমার সঙ্গে যে এক লক্ষ বিশ হাজার হাজী হজ করেছে তাদের উদ্দেশে আমি কিছু বলব।
রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী হাজীগণ গাদীরে খোম নামক স্থানে সমবেত হলেন। সেখানে মঞ্চ তৈরি করা হল। সেখানে রাসূলেখোদা দীর্ঘ তিন ঘণ্টা বিশদভাবে তাঁর উম্মতের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন।
এই ভাষণ এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে তা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: “হে রাসূল,পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালক এর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন,তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”
নবী করীম সা. বিদায় ভাষণের শেষভাগে তাঁর উম্মতদের উদ্দেশ্য বললেন, আমি তোমাদের নিকট দু’টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি, একটি হল আল্লাহর কুরআন আর অপরটি হল আমার আহলে বাইত। আহলে বাইত বলতে নবী করীম সা. এর আওলাদ অর্থাৎ হযরত মাওলা আলী, হযরত ফাতেমা, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন এই চারজনকে বোঝায়। নবীজী বলেছেন, “আল্লাহর কুরআন ও আমার আহলে বাইত একে অপর থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না, যারা এই দু’টি জিনিসকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারবে তারা কেয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে আমার নিকট পৌঁছে যাবে।”
এ কারণেই গাদীরের যে ঐতিহাসিক ভাষণ তার শেষভাগে তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের মাওলা? উপস্থিত সকলেই বললেন, হ্যাঁ আপনিই আমাদের মাওলা অর্থাৎ আপনিই আমাদের অভিভাবক। এ সময় তিনি হযরত আলীর হাত নিজের হাতে ধরে উঁচু করে সবার উদ্দেশ্য বললেন, আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা অর্থাৎ আমি যাদের অভিভাবক, আলী তাদের অভিভাবক।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবীজী গাদীরে খোমে পরবর্তী তিন দিন হাজিদের নিয়ে অবস্থান করেছিলেন এবং সকলেই রাসূল সা. এর নির্দেশে হযরত আলী রা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।
৩০. আখেরি চাহার শোম্বা ও মুহাম্মদ সা. এর ইন্তেকাল
কোন নবী রাসূলই চিরজীবী হননি। সবারই মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি মানুষেরই মৃত্যু অবধারিত। মুহাম্মদ সা. সম্পর্কেও আল্লাহ বলেন – “হে মুহাম্মদ, তুমিও মরণশীল, তাঁরাও মরণশীল।” (আল কুরআন ৩৯ ; ৩০)
হজ্জ শেষে রাসূল সা. যিলহজ মাসের শেষার্ধেই মদিনায় ফিরে আসেন। এরপর মহররম মাস মোটামুটি ভালোভাবেই অতিবাহিত করেন। সফর মাস থেকে তাঁর অসুস্থতা দেখা দেয়।
সফর মাসের শেষ বুধবার আখেরি চাহার শোম্বা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে এ দিনটি অতি মর্যাদাপূর্ণ। ফারসি শব্দমালা ‘’আখেরি চাহার শোম্বা’ অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। রাসুলুল্লাহ সাঃ এদিনে শেষবারের মতো রোগমুক্তি লাভ করেন এবং গোসল করেছিলেন। এ দিনের পর তিনি আর গোসল করেননি। এ দিন মুসলমানরা ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে অত্যন্ত মহব্বত ও প্রেমের সঙ্গে নফল ইবাদত-বন্দেগি করেন ও রাসূল সাঃ এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে ঈমানি চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতেও এ দিনের গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ বিশ্বের অনেক দেশে আখেরি চাহার শোম্বা তাৎপর্যের সঙ্গে পালন করা হয়।
রাসূলুল্লাহ সাঃ ইন্তেকালের প্রায় ৬ মাস আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর রিসালতের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পন্ন হয়েছে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আভাস পেতে লাগলেন, ‘আপনার জন্য পরবর্তী সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয়।’ (সূরা আদ-দোহা, আয়াত-৪) এরপর থেকেই তিনি দুনিয়া হতে বিদায়ের প্রস্তুতি শুরু করেন এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ১০ম হিজরিতে লক্ষাধিক সাহাবি ও স্ত্রীদের নিয়ে পবিত্র হজ্ব করতে যান। যা ছিল ঐতিহাসিক বিদায় হজ্ব। বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি একটি আদর্শ মুসলিম সমাজের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরেন। শ্রোতাম-লীকে প্রাক-ইসলামী যুগের শ্রেণী-বৈষম্য, নারী ও দাসদের প্রতি অন্যায়-অত্যাচার, ধনী সুদখোর মহাজনদের হাতে সাধারণ লোকের শোষণ-নির্যাতন, প্রাচীন রীতি-নীতি প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপের হতে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরেন।
পবিত্র হজ্বব্রত পালন শেষে মদিনা শরীফ রওয়ানার পথে ১৮ জিলহজ্ব ইসলামের ইতিহাসের আরো একটি চিরস্মরণীয় ঘটনার অবতারণা হয়। শেষবারের মত আল্লাহর ঘর জিয়ারতের পর প্রিয় জন্মভূমি পবিত্র মক্কা ত্যাগ করে ক্লান্ত শরীর ও ব্যথাভরা হৃদয়ে মদিনা যাওয়ার সময় গাদীর-এ- খুম নামক স্থানে পৌঁছালে পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটি নাযিল হয়, হে রাসূল! যা (যে আদেশ) আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন, আর যদি তা না করেন, তবে (যেন) তার কোন বার্তাই পৌঁছাননি; এবং (আপনি ভয় করবেন না) আল্লাহ আপনাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন; এবং নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না । (সূরা মায়েদাহ, আয়াত- ৬৭)
আল্লাহর পক্ষ হতে এই আয়াতটি নাযিল হবার পর, রাসূলুল্লাহ সাঃ গাদীর-এ- খুম নামক স্থানে আল্লাহর সেই ঘোষণাটি তার উম্মতকে জানিয়ে দেয়ার জন্য সবাইকে একত্রিত হতে বললেন। জোহরের নামাজ শেষে উটের গদিগুলো দিয়ে বেদী বা মঞ্চ তৈরী করা হলো। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে বললেন, “নিশ্চয় আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি এ দু’টিকে আঁকড়ে ধর তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার একটি হলো আল্লাহর কিতাব-যা আসমান হতে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত রজ্জু এবং অন্যটি হল আমার আহলে বাইত (আমার পরিবার)। এ দু’টি কখনো পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হবে না এবং এ অবস্থায়ই হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হবে। তাই লক্ষ্য রেখ তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে।” (তিরমিযী শরীফ)
বিদায় হজ্ব পালন করে মদিনায় প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ সাঃ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই অতিবাহিত করেন। হযরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, একদা রাসুলুল্লাহ সাঃ জনৈক সাহাবির জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। ফেরার পথে তাঁর ভীষণ মাথাব্যথা শুরু হয়। ক্রমে রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর পীড়া বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাঃ বলেন, রাসূল সাঃ-এর জ্বর ও মাথাব্যথা এত বেশি ছিল যে, মাথায় একটি রুমাল বাঁধা ছিল। আর তাঁর শরীর এত বেশি উত্তাপ ছিল যে, তাঁর দেহে হাত রাখা সম্ভব হল না।
সফর মাসের শেষ বুধবার সকাল বেলায় রাসূলুল্লাহ সাঃ আয়েশা রাঃ-কে ডেকে বললেন, আয়েশা! আমার জ্বর কমে গেছে, আমাকে গোসল করিয়ে দাও। সে মতে রাসূল সাঃকে গোসল করানো হল। এটিই ছিল তাঁর শেষ গোসল। অতঃপর তিনি সুস্থবোধ করলেন। গোসল সেরে তিনি বিবি ফাতেমা ও নাতিদ্বয়কে ডেকে এনে সবাইকে নিয়ে সকালের নাস্তা করলেন। হযরত বেলাল রাঃ এবং সুফফাবাসী সাহাবিরা এ সংবাদ মদিনার ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিলেন। স্রোতের ন্যায় সাহাবিরা রাসূল সাঃকে দেখার জন্য ভিড় জমাতে লাগল। মদিনার অলিতে-গলিতে আনন্দের ঢেউ লেগে গেল। ঘরে ঘরে শুরু হল সদকা, দান-খয়রাত ও শুকরিয়া জ্ঞাপন। রাসূল সাঃ এর একটু আরামের বিনিময়ে সাহাবায়ে কেরামের জানমাল কোরবানি দেয়ার ঘটনাটি ছিল সকলের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়।
জনৈক আশেক এই অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, এই পৃথিবীতে যত খুশি, যত আনন্দ, যত সুখ, যত সম্ভোগ ও উপভোগের বিষয়বস্তু রয়েছে এর সব একত্র করলেও রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর উপশম বোধের আনন্দের হাজার ভাগের এক ভাগও হবে না। এটা একান্তই সত্য ও প্রতিষ্ঠিত যে, ‘প্রেমাস্পদই সত্তা কেবল প্রেমিক খোলস মাত্র তার, প্রেমাস্পদই জিন্দা-জাভিদ, প্রেমিক শুধু নাইকো সার।’ সাহাবায়ে কেরাম ফানাফির রাসূলের অতলান্ত সমুদ্রে সর্বদা অবগাহন করতেন বলেই, তাদের এমন আনন্দ-উৎফুল্ল হওয়া বিচিত্র ছিল না।
আখেরি চাহার শোম্বা এমন একটি দিন যে দিনের সকালে ছিল আনন্দ আর বিকালে ছিল বিষাদের ছায়া। রাসূল সাঃ ওই দিন সকালে সুস্থতা বোধ করে গোসল করেন আর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে জোহরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে আগমন করেন অতঃপর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। আখেরি চাহার শোম্বার পর নবী করিম সাঃ-এর পীড়া বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। পরদিন তিনি নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে নববীতে যেতে চাইলেন এবং প্রতিবারই চেতনা হারিয়ে ফেললেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, জীবনের আয়ুষ্কাল ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। তিনি সর্বমোট ১৩ দিন রোগ-যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন এবং ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ওফাত লাভ করেন।
৩১. ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা
মুহাম্মদ সা. এর মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে গেলো নবীর আগমনের সিলসিলা। পৃথিবীতে আর কোন নবী আসবেন না। তাই মহান আল্লাহ মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম বা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের উপযোগী করে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জ উপলক্ষ্যে আরাফার ভাষণের সময় মহান আল্লাহ অহী নাযিল করে এ সংক্রান্ত ডিক্রি জারি করেন। তিনি বলেন-
“আজ আমি তোমাদের জন্যে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম তোমাদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা), পরিপূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত (কুরআন) এবং তোমাদের জন্যে দ্বীন (ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা) মনোনীত করলাম ইসলামকে।” (আল কুরআন ৫ ; ৩) এ ছাড়াও মহান আল্লাহ কুরআন মজীদে আরো বলে দিয়েছেন-
১. “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দ্বীন হলো ইসলাম।” (আল কুরআন ৩ ; ১৯)
২. “যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করবে, তাঁর থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। আর আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (আল কুরআন ৩ ; ৮৫)
৩. “আল্লাহ কাউকেও সঠিক পথে চলার তৌফিক দিতে চাইলে ইসলামের জন্যে তাঁর হৃদয়কে উম্নুক্ত করে দেন। আর তিনি যাকে বিপথগামী করতে চান, তাঁর অন্তরকে করে দেন সংকীর্ণ। তখন তাঁর কাছে ইসলামে প্রবেশ করাটা সিঁড়ি বেয়ে আকাশে উঠার মতই কষ্টসাধ্য মনে হয়। যারা ঈমান আনে না, আল্লাহ এভাবেই তাঁদের লাঞ্ছিত করেন।” (আল কুরআন ৬ ; ১২৫)
৪. “আল্লাহ যার হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন ইসলামের জন্যে এবং যে রয়েছে তাঁর প্রভুর প্রদত্ত আলোর মধ্যে, সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য, যার অবস্থান এরকম নয়?” (আল কুরআন ৩৯ ; ২২)
৫. “ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় যালিম আর কে? যাকে ইসলামের দিকে ডাকা হলে সে মিথ্যা রচনা করে আল্লাহর দিকে আরোপ করে? ’’(আল কুরআন ৬১ ; ৭)
৬. “আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি আলোকবর্তিকা (মুহাম্মদ সাঃ) এবং একটি সুস্পষ্ট কিতাব (আল কুরআন)। এর মাধ্যমে আল্লাহ সে সব লোকদের সালামের (ইসলামের, শান্তির ও নিরাপত্তার) পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তোষ লাভের আকাঙ্ক্ষী। আর তিনি নিজ অনুমতিক্রমে তাঁদের বের করে আনেন অন্ধকাররাশি থেকে আলোতে এবং তাঁদের পরিচালিত করেন সরল সঠিক পথে।” (আল কুরআন ৫ ; ১৫-১৬)
৩২. রাসূল সা. এর আহলে বাইত
রাসূল পাক সাঃ এর পরিবারের মধ্যে ইমাম আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী মুরতাজা রাঃ, হযরত মা ফাতিমা যাহরা রাঃ, ইমাম হযরত হাসান রাঃ ও ইমাম হযরত হোসাইন রাঃ আহলে বাইতের সদস্য। রাসূল পাক সাঃ তাঁদেরকে আহলে বাইত হিসাবে ঘোষণা করেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই রাসূল পাক সাঃ এর বংশধারা এবং ইসলামের মূলধারা প্রবাহিত। তাঁদের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে রাসূল পাক সাঃ এর শাফায়াত এবং মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য। অন্যদিকে সূফীবাদ হলো আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা। সূফীবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করা। আল্লাহ পাক যাঁকে ভালবাসেন এবং যাঁর আত্মাকে পবিত্র করে দিয়েছেন তিনিই প্রকৃত সূফী। আর আত্মাকে পবিত্র করার মাধ্যম হলেন আল্লাহর প্রিয় হাবীব পাক সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতের অনুসরণ। তাই মাশায়েখে কেরামগণ সর্ব্বদা আল্লাহর রাসূল সাঃ ও তাঁহার আহলে বাইতের অনুসরণ করেন। আল্লাহর দিক হতে তাঁদেরকে বিশেষ ইস্তেকামত বা স্থিরতা দান করা হয়। তাই সূফী সাধক শামসুল উলামা হযরত মাওলানা শাহ সূফী উল্লাহ রাঃ বলেছেন :
“আগর কেসিকো তাসলিম ও রেযা কা সহীহ মাকাম দেখনা মাকাসুদ হো
তো ও ময়দানে কারবালা কে র্যারাত কা সায়ের করে।”
অর্থাৎ : যদি কাহারও তসলিম ও রেযার সঠিক অবস্থান দেখা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে যেন কারবালার ময়দানের ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র বস্তু সমূহ পর্য্যবেক্ষণ করে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন,
ইন্নমা ইউরীদুল্লাহু লিইউযহিবা আনকুমুর রিজসা আহলাল বায়তি ওয়া ইউতাহহিরাকুম তাতহীরা
অর্থ : “ হে নবীর আহলে বাইত! আল্লাহ কেবল চান আপনাদের হতে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূর করতে এবং সম্পূর্ণরূপে পূত পবিত্র রাখতে” (সূরা আহযাব, আয়াত : ৩৩)
এই জন্যই এমন ধরণের গুণের অধিকারী অলি আল্লাহ ও সুফিয়ায়ে কেরামগণ আল্লাহর রেযামন্দী ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন। অসংখ্য বিপদ-আপদের সম্মুখীন হয়েও তাঁরা আল্লাহর রেযামন্দীর জন্য ব্যাকুল ছিলেন এবং অহরহ আল্লাহর জন্যই সমর্পিত চিত্ত থাকতেন। কারণ, তাঁদের দর্শনই হল “যেখানেই থাক না কেন আল্লাহর সঙ্গে থাক।”
যারা নবী করিম সাঃ এর আহলে বাইতের অনুসারী না হয়ে তাঁদের কষ্ট প্রদান ও ধ্বংস কবার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, সেই এজেদি মুসলমানদের কর্ম্মধারা ও বংশধর আজও বিভিন্ন দেশে ছড়ায়ে ছিটায়ে আছে। তারা নানা বেশে ইসলামের নামে নিরীহ মুমিন মুসলমান ও সর্ব্ব সাধারণকে ধোঁকা দিয়া তাদেরকে নিজেদের দলভুক্ত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
এই ভ্রান্ত আকীদার আলেমরা আল্লাহ পাকের পেয়ারা হাবীব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ এর রওজা মোবারক জেয়ারত, তাঁর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ, মিলাদ শরীফ ও কিয়াম করাকে বেদাত ও বেশরা বলে থাকে। তারা সাধারণ মানুষকে আশুরা পালন করা ও তাজিয়া মিছিল করা হতে বিরত রাখায় চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাঁরা কোন ধরনের মুসলমান ও রাসূল পাক সাঃ এর আশেক তা অনেকেই বুঝতে পারে না। তাদের পিছনে অনেকেই অর্থ যোগান দেয়, তাদের অর্থনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েকটি টিভি চ্যানেল। যার কারণে তাদের প্রচার প্রচারণাও বেশি হয়। কিন্তু যারা প্রকৃত পক্ষে আহলে বাইতের অনুসারী তাদের প্রচার প্রচারণা তেমন হয় না। তাদের নেই কোন টিভি চ্যানেল। তাই এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া অতি জরুরী।
আমি এ প্রসঙ্গে নাহাজুল বালাগা’র উল্লেখ আছে, আমরা (আহলে বাইত) মাঝখানের বালিশের ন্যায়। যে পেছনে পড়ে রয়েছে তাকে তা পেতে হলে আগায়ে আসতে হবে এবং যে অতিক্রম করে গিয়েছে তাকে এর নিকটে ফিরে আসতে হবে।
সূফীবাদের অনুসারীগণ রাসূল পাক সাঃ এবং তাঁর আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়ার কারণে তারা শিয়া-সূন্নীর মতপার্থক্য করতেন না। বরং তাঁরা বলতেন যারা রাসূল পাক সাঃ এর আহলে বাইতকে ভালবাসে তারাই প্রকৃত ইসলামের অনুসারী। তাই আওলাদে রাসূল সাঃ হযরত সুরেশ্বরী রাঃ দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দরবার শরীফে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য্যরে সহিত নিয়মিত আশুরা উদযাপন করতেন। মহররম আসলেই তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ দেখলে মনে হত তিনি যেন শিয়া হয়ে গিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যে মাঝে মধ্যেই বলতেন, রাসূল সাঃ এর আহলে বাইতকে ভালবাসলেই যদি শিয়া হয়ে যায়, তবে আমি শ্রেষ্ঠ শিয়া।
এই ভাবে তিনি রাসূল সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতকে ভালবাসতেন ও অনুসরণ করতেন এবং ভক্ত-মুরিদগণকেও এই নির্দেশ দিতেন। তিনি বলতেন আহলে বাইতের পথ মোটেও সহজ নহে। হযরত ইমাম হাসান রাঃ ও ইমাম হোসাইন রাঃ এই পথেই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই এই পথে চলতে হলে নানা বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখিন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এই সম্পর্কে ইমাম হযরত আলী রাঃও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। নাহাজুল বালাগা’য় উল্লেখ করা হয়েছে, আহলে বাইতদের যারা ভালবাসে তাদেরকে দুঃখ দুর্দশা-লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-উৎপীড়ন-যন্ত্রণা পোহাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘হে রাসূল বলুন, তোমাদের কাছে রিসালাতের বিনিময়ে আমার নিকটাত্মীয়গণের প্রতি সৌহার্দ্য, ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই চাই না।” (সূরা শুরা, আয়াত : ২৩)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, আমি নবী সাঃ কে জিজ্ঞাসা করি যে, আপনার বংশধর কারা? যাঁদের ওপর মুসলমানদের ভালবাসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তখন তিনি বললেন, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন। তাছাড়া, এ আয়াত নাজিল হবার পর সাহাবাগণ নবী সাঃকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, কারা আপনার নিকটাত্মীয়, যাঁরা আপনার দুয়ারী জিন্দেগীর বিশাল ব্যাপক কর্মকা-ের বিনিময় স্বরূপ? উত্তরে হাবীবে খোদা সাঃ বলেন, আলীয়্যুন ওয়া ফাতেমা ওয়া আবনাহুমা, অর্থাৎ আলী, ফাতেমা ও তাঁদের সন্তানগণ।
সূফীবাদের অনুসারীগণ দুনিয়াদারীর মায়া ও লোভ লালসা ত্যাগ করে আল্লাহর ধ্যানে তাঁর জিকির ও তসবিহ পাঠের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করতে পছন্দ করে। তারা যখনই সময় পান তখন নবীর প্রতি দরূদ-সালাম পেশ করে থাকেন। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নির্দেশ দান করেছেন,
অবশ্যই আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাদের নিয়ে নবীর প্রতি দরূদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করতে থাক এবং উত্তম উপায়ে সালাম পেশ কর। (সূরা আহযাব, আয়াত : ৫৬)
এ আয়াত নাজিলের পর সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাঃ এর কাছে গিয়ে বললেন, হুজুর কিভাবে আপনাকে সালাম দিতে হয় জানি: কিন্তু কিভাবে আপনার প্রতি দরূদ পেশ করতে হয় এবং উত্তম উপায়ে সালাম পেশ করতে হয়, তা জানি না। তখন তিনি তাঁদেরকে দরূদ পেশ করা শেখালেন। যার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের ওপর রহমত বর্ষণ কর।
অন্য একটি হাদিসে রাসূলে করিম সাঃ বলেছেন, আমার ওপর অসম্পূর্ণ দরূদ পড়ো না। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল : হে নবী সাঃ অসম্পূর্ণ দরূদ কেমন?
তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ বলেই থেমে যাও। তোমাদের উচিত এরূপ বলা : আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলা আলে মুহাম্মদ।
সূফীবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভ করা। সোপান ছাড়া যেমন উপরে উঠা যায় না, তেমনিভাবে রাসূলপাক সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতের শাফায়াত ছাড়া আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই সূফীগণ রাসূলপাক সাঃ ও তাঁর আহলে বাইতকে আল্লাহকে পাওয়ার সোপান বলেই গণ্য করে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, সেদিনের কথা স্মরণ কর, যেদিন আমি সবাইকে তাদের নেতাদের সঙ্গে আহ্বান জানাবো, অতঃপর যাদের ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে, তখন তারা (সন্তুষ্ট মনে) তাদের আমলনামা পড়তে থাকবে এবং তাদের প্রতি তিলমাত্র জুলুম করা হবে না।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৭১)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এই আয়াত প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ কেয়ামতের দিন শ্রেষ্ঠ নেতা হযরত আলী রাঃ ও অন্ধকারে আলোকবর্তিতাস্বরূপ হযরত হাসান ও পুণ্যবানের প্রতীক হযরত হোসাইন রাঃকে ডাকবেন। আর তাঁদের বলা হবে যে, তোমরা তোমাদের বন্ধুজনসহ পুলসিরাত পার হয়ে যাও এবং নির্দ্বিধায় জান্নাতে প্রবেশ কর। অতঃপর মিথ্যাচারীদের নেতাকে ডাকা হবে। তন্মধ্যে ইয়াজিদও থাকবে। তাকে বলা হবে, তুমি তোমার বন্ধুদের হাত ধরে নির্দ্বিধায় জাহান্নামে প্রবেশ কর। (ইমামাতুল কুরআন, পৃঃ ৩৩৯)
এ প্রসঙ্গে নবী করীম সাঃ বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী জিনিস রেখে যাচ্ছি- আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত, এ দু’টি জিনিস একে অন্যের সাথে পৃথক হবে না; যতক্ষণ না তাঁরা আমার সাথে পুলসিরাতে মিলিত হয়।(মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, ৫ম খন্ড ও তিরমিজী শরীফ)
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, তোমাদের কাছে আমার আহলে বাইত-এর উদাহরণ নূহের নৌকার সমতুল্য। যারা এ নৌকায় আরোহণ করবে, তারাই মুক্তি পাবে এবং যারা আহলে বাইত হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তারা ডুবে যাবে, অর্থাৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। (তিরমিজী, মুসতাদরাকে হাকিম, ৩য় খন্ড)
এ প্রসঙ্গে হুজুর সাঃ আরো বলেছেন, যে কেউ আমার মত বাঁচতে ও মৃত্যুবরণ করতে চায় এবং মরণের পর বেহেশতে বসবাস করতে চায়, তাঁর উচিত আলীকে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে গ্রহণ করা এবং আমার পর আমার আহলে বাইতকে অনুসরণ করা। কারণ তাঁরা আমার আহলে বাইত এবং আমাকে যা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাঁদেরও তাই দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাঁদেরও সে জ্ঞান ও বুদ্ধি দান করা হয়েছে, যা আমাকে দান করা হয়েছে। আমার সে সকল অনুসারীদের জন্য দুঃখ, যারা আমার আহলে বাইত ও তাঁদের মর্যাদা অস্বীকার করবে, তারা আমার সাথে সম্পর্ক ও সম্বন্ধ অস্বীকার করে। আল্লাহ যেন তাদের আমার শাফায়েত হতে লাভবান না করেন।(মুসনাদে হাম্বল, ৫ম খন্ড)
এ প্রসঙ্গে নবীজী সাঃ আরো বলেছেন, তাঁদের (আহলে বাইত) আগে যেও না, তাতে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে অথবা তাঁদের থেকে পেছনে পড় না, তাতেও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তাঁদের শিক্ষা দিও না, কারণ তাঁরা তোমার চেয়ে বেশি জানেন।
এ প্রসঙ্গে নবীজী সাঃ আরো বলেছেন, মুহাম্মাদের সন্তান (আ’লে মুহাম্মাদ)-এর স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া এবং তাঁদের প্রতি ভালবাসা হচ্ছে পুলসিরাত পার হবার উপায় এবং তাঁদের আনুগত্য হচ্ছে আল্লাহর ক্রোধ হতে রক্ষা কবচ।
এ প্রসঙ্গে নবীজী সাঃ আরো বলেছেন, যদি কেউ রুকন বা মুকামের মাঝে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে এবং তাঁর সমস্ত জীবন প্রার্থনা (নামাজ), রোযা এবং উপাসনা করে কাটায়, কিন্তু মুহাম্মদের সন্তান [আ’লে মুহাম্মদ সাঃ]-এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তবে সে নিশ্চিত দোযখে যাবে।
হযরত রাসূলে মকবুল সাঃ আরো এরশাদ করেন যে, হযরত আলী আঃ-এর মহব্বত ও অনুসরণ ব্যতীত কেউই জান্নাতে যেতে পারবে না। পুল সিরাত অতিক্রম করতে হলে হযরত আলী আঃ-এর অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হবে। (ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাত, পৃঃ ১১৬)
এ প্রসঙ্গে হযরত আহমদ বর্ণনা করেছেন : ‘রাসূলে করিম সাঃ ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের হাত ধরে বলেছেন, আমাকে ও এই দু’জন এবং এদের পিতামাতাকে ভালোবাসবে সে কিয়ামতের দিনে আমার সঙ্গে বেহেশতে থাকবে।
আজও প্রকৃত অলি-আউলিয়া, পীর-মাশায়েখগণ ইমাম হাসান রাঃ, ইমাম হোসাইন রাঃ তথা আহলে বাইতের নিশান বক্ষে ধারণ করিয়া মানুষকে প্রকৃত ইসলামের প্রতি আহ্বান করিতেছেন। যাঁহাদের কোন লোভ-লালসা পরাভূত করিতে পারে না। যেমনটি পারে নাই ইমাম হাসান রাঃ, ইমাম হোসাইন রাঃ কে।