শরিয়তের গুরুত্ব
শরিয়ত আরবি শব্দ। এর অর্থ পথ, রাস্তা।এটি জীবন পদ্ধতি, আইন-কানুন। বিধি- বিধান অর্থেও ব্যবহৃত হয়।ইসলামি পরিভাষায় ইসলামি কার্যনীতি ও জীবন পদ্ধতিকে শরিয়ত বলে।অন্যকথায় ইসলামি আইন-কানুন ও বিধি- বিধানকে একত্রে শরিয়ত বলে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ ও রাসুল সা. যে্সব আদেশ- নিশেধ ও পথ নির্দেশনা মানুষ্কে জীবন পরিচালনার জন্য প্রদান করেছেন তাকে শরিয়ত বলে।
শরিয়তের প্রথম উৎস : অাল-কুরআন
রিয়তের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান উৎস হলো অাল-কুরআন। ইসলামি শরিয়তের সকল বিধি-বিধানের মূল উৎসই হলো আল কুরআন। এর উপর ইসলামি শরিয়তের ভিত্তি ও কাঠামো প্রতিষ্ঠিত। আল- কুরআন শরিয়তের অকাট্য ও প্রামাণ্য দলিল। মানব জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের সমাধানসূচক মূলনীতি ও ইঙ্গিত আল-কুরানে বিদ্যমান।
শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস : সুন্নাহ
শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হলো সুন্নাহ। সুন্নাহ অর্থ রীতিনীতি। ইসলামি পরিভাষায় মহানবি (সা.)- এর বানী,কর্ম ও তার সমর্থিত রীতিনীতিকে সুন্নাহ বলে। সুন্নাহকে হাদিস নামেও অভিহিত করা হয়। সুন্নাহ হল আল-কুরানের ব্যাখ্যা স্বরূপ। মহান আল্লাহ আখিরাত সম্পর্কে আমাদের পুরোপুরি সাবধান ও সতর্ক করেছেন। সুতরাং মহানবি (স) তাঁর সুন্নাহের মাধ্যমে এসব বিধি-বিধান ও বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
” আর আমি আপনার প্রতি কুরআন নাজিল করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যা তাঁদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে। “
সুন্নাহ বা হাদিস শরিয়তের অন্যতম দলিল ও উৎস। আল কুরআনের পরই এর স্থান।
শরিয়তের তৃতীয় উৎসঃ আল– ইজমা
শরিয়তের তৃতীয় উৎস হলো ইজমা। ইজমা আরবি শব্দ। এর আভিধ্নিক অর্থ- একমত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। ব্যবহারিক অর্থে কোনো বিষয় বা কথায় ঐক্যমত্য পোষণ করেকে ইজমা বলে। ইসলামি ভাষায়, শরিয়তের কোনোবিষয়ে একই যুগের মুসলিম উম্মতদের পুণ্যবান মুজাহিদগণের ঐকমত্য পোষণ করাকে ইজমা বলা হয়। ইজমা কুরআন সুন্নাহ সমর্থিত হওয়া আবশ্যক। ইজমা আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ মর্যাদা ও নিয়ামত।
শরিয়তের চতুর্থ উৎসঃ আল–কিয়াস
শরিয়তের চতুর্থ উৎস হলো কিয়াস। কিয়াস শব্দের অর্থ হলো অনুমান করা, তুলনা করা, পরিমাপ করা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় কুরআন ও সুন্নাহর আইন বা নীতির সাদৃশ্যের ভিত্তিতে বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে পরবর্তীতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দেওয়াকে কিয়াস বলে। অন্য কথায়, কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমাতে যে সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না ইসলামি মূলনীতি অনুযায়ী বিচার- বুদ্ধি প্রয়োগ করেসে সমস্যার সমাধান করাকেই কিয়াস বলা হয়। কিয়াস ইসলামি শরিয়তের অন্যতম উৎস। ইজমার পরেই এর স্থান।
শরিয়তের আহকাম সংক্রান্ত পরিভাষা
শরিয়ত হলো ইসলামি বিধি বিধানের সমন্বিত রূপ। পরিভাষায় শরিয়ত বলতে এমন সুদৃঢ় সোগা পথকে বুঝায় যার দ্বারা তার অবলম্বনকারীব্যক্তি হিদায়াত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মপন্থা লাভ করতে পারেন। আর আহকাম হলো বিধানাবলি। প্রতিটি বিষয়েরই নিজস্ব কিছু পরিভাষা থাকে। ইসলামি শরিয়তেরও এরূপ বেশ কিছু পরিভাষা বিদ্যমান। ইসলামি শরিয়তের আহকাম বা বিধানাবলি সংক্রান্ত পরিভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব, মুবাহ ইত্যাদি।
ইসলামে শরিয়ত এবং মারেফত প্রয়োজনীয়তা
শরিয়তের পরবর্তী স্তর তরিকত, হাকিকত ও মারেফত। শরিয়তের বিধিবিধান মেনে চললে একজন মুসলমান মানুষ হিসাবে ও একজন ভালো মানুষ হিসাবে সমাজে চিহ্নিত হতে পারে। সমাজ তার অনিষ্টকারিতার হাত থেকে মুক্ত হতে পারে তাই শরিয়তী বিধিবিধান মেনে চলার জন্য প্রতিটি মুসলমানের প্রতি বিশেষ তাগিদ। তরিকত, হকিকত ও মারেফাত এই তিনটি স্তর একত্রে আধ্যাত্মিক জগত হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত। তরিকত প্রথম স্তর। এ্ই স্তরে প্রবেশ না করলে পরবর্তী স্তরে অনুপ্রবেশের কোন সুযোগ আসে না। তরিকত স্তরে অনুপ্রবেশের ফলে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক জগতের মহিমাময় ক্ষেত্রে বিচরণের সুযোগ লাভ করে। সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে বুঝার সুযোগ শরিয়তী বিধিবিধানে নেই। তাই তরিকতী স্তরে পৌঁছে যখন কোন মুসলমান সৃষ্টি ও স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সম্পর্কে বুঝার ইঙ্গিত পায় তখন আধ্যাত্মিক জগতের পরবর্তী স্তর হাকিকত ও মারেফাতের স্তরে পৌছার বিশেষ তাগিদ বোধ তার মধ্যে সৃষ্টি হয়। তরিকতী স্তরে প্রবেশ না করলে বা না পৌঁছালে কোন মুসলমান আধ্যাত্মিকতার পরবর্তী স্তরে পৌছতে পারে না। এই তরিকতী স্তর-ই ব্যক্তি জীবনের আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের মুখ্য স্তর। তাই আধ্যাত্মিক জগতের এই মুখ্য স্তর হিসাবে আধ্যাত্মিক জগতে তরিকতের স্থান। তাই এই স্তর তরিকত বা তরিকাহ হিসাবে মুসলিম জাহানে সর্বজন স্বীকৃত।
শরিয়তী স্তরের জন্য শারিরীক ও আর্থিক সামর্থই মুখ্য। এই স্তরের জন্য মানসিক শক্তি সাধনা যে টুকু প্রয়োজন তাতে মানসিকভাবে তেমন কোন আত্মনিবিষ্ট না হলেও চলে যায়। ব্যক্তি একজন মোটামুটি একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে । কিন্তু তরিকত, হকিকত ও মারেফাত এককথায় আধ্যাত্মিক জগতের মহিমাময় ক্ষেত্রে বিচরণের জন্য ব্যক্তিকে স্বকীয় স্বার্থের মোহমুক্ত হয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রাবুবিয়াত অর্থাৎ প্রতিপালন শক্তির গুণে গুনান্বিত হওয়ার কঠোর সাধানায় আত্মনিবেদিত ও আত্মনিয়োজিত হতে হয়। তাই তরিকতের ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তিকে বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে চেনাজানার কঠোর সাধনায় নিয়োজিত হতে হয়। ফলে ব্যক্তি স্বকীয় স্বার্থের মোহমুক্ত হয়ে একজন স্বার্থত্যাগী ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাধনায় নিয়োজিত হয় । তাই তরিকত বা তরিকা ইসলামের আধ্যাত্মিক জগতের প্রথম সোপান হিসাবে ইসলামের সত্যিকার প্রতিষ্ঠা ও তার আদর্শ চিরস্থায়ীত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। আধ্যাত্মিক জগত ‘তরিকাহ’ হিসাবে পরিচিত ও সকলের নিকট সমাদৃত।
ইসলাম শরিয়তের সাথে সাথে আরও একটি ধারা মুসলমানদের মধ্যে চলে আসছে অনেক পূর্ব থেকেই। কারবালার ময়দানে রাসূল সা. এর বংশ শেষ হয়েছে ইয়াজিদী মুসলমানদের হাতে। এই কারবালার পর ভারত উপমহা দেশে পির, ফকির, ওলি আউলিয়াগনরাই ইসলাম প্রচার করেছেন। এই কথাটি যারা মেনে নিতে চাইবে না তারা সত্য থেকে অনেক দুরে। অথচ আল্লাহ কোরআনের সূরা তওবার ১১৯ নং আয়াতে বলেছেন “তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হয়ে যাও”।
ইয়াজিদী মুসলমান এই জন্যই বলছি যে; সে দলের মানুষগুলি টুপি, পাগরী, জুব্বা পরা, দাড়ি ওয়ালা এমনকি ৫-ওয়াক্ত নামাজি মুসলমান ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় ইয়াজিদের হুকুম ছিল হুসাইনে কল্লা তাড়াতারি কেটে আনো আসরের নামায যেন কাজা না হয়ে যায়। হায়রে কপাল নবীর বংশ বেহেস্তের সরদার হুসাইনের কল্লা কেটে রেখে দুরূদে ইব্রাহিমের মধ্যে নবী বংশকেই সালাম দেওয়া হয় জান্নাতের আশায়। এ কেমন মুসলমান? কোন জান্নাতের আশাতেই বা তাদের ইবাদত। ঠাই কি পাবে তারা নবী বংশের বেহেস্তের সরদারদের বেহেস্তে? বুঝা যা্য় কঠিন নামাযি এবং মুসলমানই ছিল তারা। রাসূল সা. ইসলামের ধারা সিলসিলা অনুযায়ী বায়াত হতে হয় তা বুখারী হাদিস শরীফ পাওয়া যায়। হাদিসটিতে উল্লেখ আছে ৪৯৯- “মুহাম্মদ ইবনুল মুছান্না (র.) .. জারীর ইবন আব্দুলাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা. এর নিকট সালাত আদায়, যাকাত প্রদান এবং প্রত্যেক মুসলমানকে নসিয়ত করার বায়আত গ্রহণ করেছি।”
ইসলাম পালনের জন্য বায়াতটা যে কতটুকু জরুরী মুসলমানদের এটা প্রকৃত জ্ঞানীরাই বুঝতে পারবেন। কারণ বায়’আত ব্যতীত নামাজ কায়েম হয় না সেই সাথে যাকাত প্রদান সঠিক হয় না। আর নসিয়ত করার প্রশ্নই তো উঠে না।
এই প্রসঙ্গে ইমাম মালেক রাহ. বলেছেন “যে ব্যক্তি ইলমে শরিয়তের জ্ঞান হাসিল করেছে এবং ইলমে মারেফতের জ্ঞান হাসিল করেনি সে ফাসিক। আর যে ব্যক্তি মারেফতের জ্ঞান হাসিল করেছে, কিন্তু ইলমে শরিয়তের জ্ঞান হাসিল করেনি, সি জিন্দিক অর্থাৎ কাফের।” এই হাদিসগুলি বর্তমানে শরিয়তের বিজ্ঞ আলেম সাহেবদের কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছে। কিন্তু একজন হাক্কানী আলেমের যে এই উভয় জ্ঞানেই জ্ঞানী হতে হবে সেটা তারা মনেই করেন না। উক্ত হাদিসটি এবং ইমাম মালেক রাহ. বানী অনুযায়ী তাদের পরিনতি যে কোন দিকে নিয়ে যায় তাদের সেটার দিকেও দৃষ্টি নাই।
বায়াত হতে হলে পীরের কাছে যেতে হয়। কোন সিলসিলার অনুসারী ব্যতীত পীর পাওয়া যায় না। আর শরিয়তের আলেম সাহেবগনের কাছে পীর বলতেই যে সবই বেদাত মুশরিক। মারেফত প্রসঙ্গে বিজ্ঞ আলেমগণ কোরআন এবং হাদিসের নির্দেশনা গুলি উপেক্ষা করে এই সব বন্ধ করতে চায় বলেই মারেফত পন্থি আলেমগণ হুজুরদের বিপক্ষে গিয়ে কোরআন হাদিস বাদ দিয়ে তাদের মন গড়া শিক্ষায় ধর্মভীরু মানুষগুলিকে বিপথগামী করে ফেলে। তা না করে যদি মানুষকে সচেতন করা যেতো যে শরিয়ত যেমন রাসূল সা. এর শিক্ষা ঠিক তেমনি মারেফত শিক্ষাটাও রাসূল সা. এর শিক্ষা। শরিয়তের শিক্ষা এবং মারেফতের শিক্ষা একে অপরের সাংঘর্সিক শিক্ষা হতে পারে না। কোরআন বিরোধীও হতে পারে না।
তাই কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী প্রতিটি মুসলমানের জন্য শরিয়তের এবং মারেফতের জ্ঞান হাসিল করা জরুরী ।