হযরত নূরী শাহ রাঃ
বিশেষ তত্ত্বাবধানে হযরত নূরশাহ রাঃ
।
হযরত নূরশাহ রাঃ
শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত নূরশাহ রাঃ এর জন্মক্ষণ ছিল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমতে পূর্ণ। বাংলা ১৩০০ সাল, নূতন শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়। ১৮ই আশ্বিন শুক্রবার শুক্ল পক্ষের চতুর্থী তিথিতে, অনুরাধা নক্ষত্রে, বরুণক্ষণে, শারদীয় পূর্ণিমার জ্যোস্নায় জগৎ আলোকিত। আমোদিত প্রকৃতির উচ্ছল উদ্বেলিত অশান্ত রূপ। বনফুলের মিষ্টি সুবাস মৃদু মন্দ শীতের হাওয়ায় মিশিয়া মনোহর সৌরভে চতুর্দিক গুঞ্জরিত। বিগত রাত্র বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি রাজ্যের গুঞ্জনও ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। এ রজনী তাহাদের মহা আনন্দের রজনী। মনের উচ্ছ¡সিত আনন্দ কোন বাঁধা না মানিয়া স্ববেগে নিঃসরিত হইল। পক্ষীকুল মধুর রবে চতুর্দিক মুখরিত করিল। সকলেই যেন অদ্য কোন বিশেষ আয়োজনে ব্যস্ত। সমস্ত রাত্র ব্যাপী বিশ্ব প্রকৃতি সর্ব্বস্ব উজাড় করিয়া এক মহান অতিথির অভ্যর্থনার জন্য নিজকে অপরূপ সাজে সাজাইল, কিন্তু এই আয়োজনও যেন অতিশয় নগণ্য।
তখন সুবহে সাদিকের অন্তিম লগ্নে পূর্ব্বাকাশে আলোর আভা ফুটিয়া উঠিতেছে। মুয়াজ্জ্বিনের সুমধুর কন্ঠে ধ্বনিত হইতেছে আজানের ধ্বনি। রাতের শেষ লগ্নে বৃহৎ বৃত্তাকার চন্দ্র হেলিয়া ঢলিয়া আনন্দ নৃত্যের তালে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমাকাশে গমনরত। শেষ মুহূর্ত্তেও তাহার আনন্দোচ্ছল হাসিমাখা মুখ আর ম্লান হইল না। সুবহে সাদিকের অন্তিম লগ্নে পূর্ব্বাকাশে রক্তিম আলোর আভা ফুটিয়া উঠিতেছে। এমনি পবিত্র পরিবেশ তাঁহাকে সানন্দে বরণ করিতে প্রতীক্ষায় ছিল। সকালের উজ্জ্বল সূর্যের আলো ম্লান করিয়া সুরেশ্বর দরবার শরীফের নিভৃত পূত পবিত্র গৃহে পুণ্যময়ী মাতা সৈয়্যেদা মেহেরজান বিবির কোল আলোকিত করিয়া বাংলা ১৩০০ সনের ১৮ই আশ্বিন রোজ শুক্রবার শুক্ল পক্ষের চতুর্থ তিথীতে পূর্ব্বাহ্ন ১১টার সময় এই ধরণীতে আগমন করিবেন এক নূরানী শিশু। পবিত্র শিশু যেন আল্লাহর পূতঃপবিত্র নূরের আকর, যাহার নূরের রশ্মিতে এই ধরণী আলোকময়। নূরালোকে আলোকিত স্বর্গীয় এই শিশু আল্লাহর অলি শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ এর আলোয় আলোকিত।
হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রাঃ এর ঔরসজাত ও প্রথমা স্ত্রী হযরত সৈয়্যেদা মেহেরজান বিবি রাঃ এর গর্ভজাত দুই পুত্র, চার কন্যা। তাঁহাদের মধ্যে চতুর্থ সন্তান হযরত মাওলানা শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ ওরফে হযরত মাওলানা শাহ সূফী সৈয়্যেদ আবদুল হাই রাঃ। তিনি ছিলেন হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রাঃ এর পুত্র সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ তাঁহাকে আদর করিয়া শাহ সাহেব’ বলিয়া ডাকিতেন। এই পৃথিবীতে তাঁহার আগমন ছিল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অপূর্ব্ব নেয়ামতে পরিপূর্ণ। মহান মাবুদের ইচ্ছা এবং অপর মহিমায় মহিমান্বিত হইয়া নূরের বাদশাহ’রূপে এই পৃথিবীতে প্রকাশিত হইলেন জগদ্বিখ্যাত অলিয়ে কামেল বাদশাহে দো-জাঁহা ইমামে তরীকত কুতুবে রব্বানী গাউসে সামদানী হযরত বাবা নূরশাহ্ রাঃ।
আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবাণীতে তিন কন্যার পর প্রতিশ্রুত প্রথম পুত্রের চন্দ্র মুখ দর্শন করিয়া পিতা-মাতা উভয়েই আনন্দাশ্রু বিসর্জ্জন পূর্ব্বক পরম করুণাময়ের দরবারে শোকর গুজারী করিলেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পাইয়া স্বহোদর জ্যেষ্ঠা ভগ্নিগণ পরস্পর আনন্দে বিহবল হইলেন। কে কাহার আগে কোলে নিবেন ইহার প্রতিযোগিতা চলিতে লাগিল। বাড়ী ভর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই আনন্দে উৎফুল্ল হইলেন। পরস্পরে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক প্রতিশ্রুত মহান অলি ইমামুত তরীকত বাদশাহে দোজাঁহা হযরত নূরশাহ রাঃকে নিজেদের মধ্যে পাইয়া তাঁহার অলৌকিক গুণগান আলোচনায় ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত নূরশাহ রাঃ হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর নয়নের মণিকোঠায় স্থান করিয়া নিলেন।
এই নূরময় শিশুর নূরানী চেহারা দর্শনে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ অতিশয় মুগ্ধ হন। হযরত নূরশাহ রাঃ এর নামকরণের সময় হযরত সুরেশ্বরী রাঃ তাঁহার মোর্শেদের তরফ হইতে তাঁহার নাম ‘আবদুল হাই’ এবং লকব হযরত ‘নূরশাহ’ বলিয়া দেন। তিনি সকলকে আরও পরামর্শ দেন, তাঁহারা যেন হযরত নূরশাহ রাঃ এর নাম ধরিয়া না ডাকেন। তাঁহার কুনিয়াত বা উপনাম ‘শাহ সাহেব’ দান করেন। এই নামে তিনি তাঁহাকে সস্নেহে ডাকিতেন। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ যেহেতু তাঁহার নাম না ধরিয়া ‘শাহ সাহেব’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন, সেই কারণে আত্মীয়-পরিজন সকলেই তাঁহাকে সমীহ করিয়া ‘শাহ সাহেব’বলিয়া ডাকিতেন। ইহা হযরত নূরশাহ রাঃ এর প্রতি হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর বিশেষ দৃষ্টি, যত্ম ও শ্রদ্ধার ইঙ্গিত বহন করিতেছিল।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর পীর মোর্শেদ কেবলা রাসূলনোমা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ ইন্তেকালের পূর্ব্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রিয় মুরিদ ও খলিফা হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর যোগ্য উত্তরসূরী এক মহা-পুরুষ জগৎ আলোকিত করিয়া আবির্ভূত হইবেন। যাঁহার দ্বারা শেষ জামানার অসংখ্য মানুষ আল্লাহ পাকের সন্ধান লাভ করিয়া পরিত্রাণ লাভ করিবে। তিনি সে সময়ে তাঁহার নাম অতি মহব্বতের সহিত ‘আবদুল হাই’এবং লকব ‘নূরশাহ’রাখিয়া যান। রাসূলনোমা হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ বহু আগেই যে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন তাহা আজ বাস্তব রূপ লাভ করিল। তিনি ২০শে অগ্রহায়ণ ১২৯৩ বাংলা সন মোতাবেক ৫ই ডিসেম্বর ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বেসালে হক্ক লাভ করেন।
‘আবদুল হাই’শব্দের অর্থ চিরঞ্জীবের বান্দা আর ‘নূরশাহ’শব্দের অর্থ নূরের বাদশাহ। যেই নূরের তাৎপর্য্য সাধারণের বোধগম্যের ঊর্ধ্বে। আল্লাহর অলিগণই এ সম্পর্কে ভাল জানেন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি শৈলী বড় অপূর্ব্ব ও বৈচিত্র্যময়। তাঁহার রহমতের করুণায় পাথরে ফোটে ফুল, মরু বুকে বহে ঝরনার প্রস্রবন। মহান রাব্বুল আলামীনের বিস্ময়কর ব্যতিক্রমী সৃষ্টি রাজ্যের পাশাপাশি রহিয়াছে চিরন্তনী সৃষ্টি ধারা। তাঁহার অপার মহিমায় আঠার হাজার মাখলুক সুনির্দিষ্ট নিয়মে আবর্ত্তিত। গোলাপ বাগানে ফুটে সুদৃশ্য নন্দন গোলাপ। উহার মনমোহনী সুবাসে চিত্তহরণ করে। এমনি ভাবে মানুষের মাঝে আছেন আদর্শ মহা-মানব। নিজেদের কর্ম্ম গুণে মানুষের মাঝে মর্য্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন অধিকার করেন। গোলাপ সম সৌন্দর্য্যে পরিণত হয় ভালবাসার প্রতীকে; শ্রেষ্ঠত্বের আসনে একচ্ছত্র অধিপতি হইয়া দুনিয়ার মাঝে খ্যাতি ও দ্যূতি যাহার মাথার মুকুট। নিজ গুণ বৈশিষ্ট্যে হইয়া যান সবার আদরণীয়, পূজনীয় ও পবিত্রতার বিমূর্ত্ত প্রতীক।
চির বিজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্ত্তার সৃষ্টি কৌশল এমনই রহস্যময় যে, নিজের মহিমা ও মাহাত্ম্য গুণে তিনি কাহাকেও দান করেন সমুন্নত ও অতি গৌরবময় নেয়ামত। দান করেন সুউচ্চ বংশ মর্যাদা। যেমন তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর বংশধরদের দান করিয়াছেন সর্ব্বোত্তম মর্য্যাদা।
হযরত মা ফাতেমাতুজ যাহরা রাঃ এর মাধ্যমে মহানবী সাঃ এর পবিত্র বংশ ধারা প্রবাহিত। হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রাঃ হইলেন সেই পবিত্র স্রোতধারায় প্রস্ফুটিত এক উজ্জ্বল রক্তকমল। তাঁহার মোহনীয় আকর্ষণে চতুর্দিক হইতে ছুটিয়া আসিয়াছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁহার সোহবতে পাইয়াছে অঢেল প্রশান্তি, পূরণ করিয়াছে বিতৃষ্ণ হৃদয়ের কামনা-বাসনা, জানিতে পারিয়াছে মহান সৃষ্টিকর্ত্তার পরিচয়, লাভ করিয়াছে জীবনের পরম পাওয়া মহান প্রভুর সান্নিধ্য।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর ওফাত গ্রহণের পর তাঁহার সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে দরবার শরীফের সার্ব্বিক দায়িত্ব পালন করিয়াছেন তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র মুফতিয়ে আজম হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ রাঃ ওরফে হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আবদুল হাই রাঃ।
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে হযরত নূরশাহ রাঃ অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর তিন পুত্র সন্তান হযরত নূরশাহ রাঃ ও হযরত কলিম শাহ রাঃ তাঁহার অন্তরের মণিকোঠায় ছিলেন। তাঁহারা দুইজনই দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে সকলের মধ্যমণি ছিলেন। তৃতীয় পুত্র আতুর ঘরেই ইন্তেকাল করেন।
মহান প্রেমময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আহবানে অল্প বয়সে হরষিত মনে হযরত কলিম শাহ হুজুর রাঃ বেসালে হক্ক প্রাপ্ত হন। ইহাতে সকলে হযরত নূরশাহ রাঃকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া, ভালবাসিয়া হযরত কলিম শাহ রাঃ এর তিরোধানের বিরহ ব্যথা ভুলিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। হযরত নূরশাহ রাঃ অতিশয় সরলতা ও বিচক্ষণতার সহিত সকলের সহিত মধুর সম্পর্ক গড়িয়া তোলেন।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর দ্বিতীয়া স্ত্রী সৈয়্যেদা গোলে আরজান বিবি রাঃ নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি আজীবন হযরত বাবা নূরশাহ রাঃকে নিজ সন্তানের মতই স্নেহ করিতেন। দয়াল বাবা নূরশাহ রাঃও তাঁহাকে আপন মায়ের মতই শ্রদ্ধা-ভক্তি, মহব্বত ও খেদমত করিতেন। পিতার বর্ত্তমানে ও অবর্ত্তমানে বিমাতাদের প্রতি তাঁহার কর্ত্তব্যের কোন ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল না। ইহা সর্ব্বত্র স্মরণকালের ঐতিহাসিক ঘটনা।
।
বিশেষ তত্ত্বাবধানে হযরত নূরশাহ রাঃ
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ অতি শৈশব হইতেই হযরত নূরশাহ রাঃ এর প্রতি বিশেষ নজর ও যত্ম নেন। সেই সময়ে অধিকাংশ মাতা-পিতা প্রচলিত সামাজিক রীতি-পদ্ধতিতেই ছেলে-মেয়ে প্রতিপালন করিতেন। তাহাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও ভরণ-পোষণের যথাযথ ব্যবস্থা করিতেন। হযরত সুরেশ্বরী রাঃ হযরত নূরশাহ রাঃকে বিশেষ যত্ম মহব্বত ও অত্যন্ত সুদৃষ্টির সহিত তাঁহাকে লালন-পালনের নির্দেশ দেন। হযরত নূরশাহ রাঃ এর প্রতি সার্ব্বিক দৃষ্টি রাখিতেন, যাহাতে তাঁহার মেধা বিকাশ ও জ্ঞান চর্চায় কোন রূপ ত্রুটি-বিচ্যূতি না হয়।
হযরত নূরশাহ রাঃ এর লালন-পালনের জন্য যাঁহারা তাঁহার সান্নিধ্যে আসিতেন এবং তাঁহার প্রতিপালনে সহযোগিতা করিতেন হযরত সুরেশ্বরী রাঃ তাঁহাদেরকে নির্দেশ দান করেন যে, তাঁহারা যেন হযরত নূরশাহ রাঃ এর সহিত বেয়াদবী না করে। সর্ব্বদা গভীর দৃষ্টিতে দেখিবে তিনি কী করিতে চান বা কী বলিতে চান ? তাঁহার চাওয়া-পাওয়াকে যেন কেহ কোন ভাবে অবজ্ঞা না করে। এই বিষয়ে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ সকলকে কড়া ভাষায় সতর্ক করিয়া দেন।
হযরত নূরশাহ রাঃ এর সুশিক্ষার জন্য হযরত সুরেশ্বরী রাঃ যথা সময়ে নিজ তত্ত্বাবধানে তাঁহাকে বাল্যশিক্ষা দান করেন। পরবর্ত্তীতে নোয়াখালী জেলার মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব হযরত নূরশাহ রাঃ এর পড়াশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পড়াশোনায় বিশেষ অগ্রগতি লাভ করায় পরবর্ত্তীতে শিক্ষার জন্য তাঁহাকে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্ত্তি করাইয়া দেন। তিনি নিজ তত্ত্বাবধানে তাঁহাকে সেখানে রাখেন।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর নেক নজরে হযরত নূরশাহ রাঃ টাইটেল ক্লাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হইয়া মুমতাজুল মুহাদ্দেসীন খেতাব লাভ করেন। পরবর্ত্তী পর্য্যায়ে তাঁহাকে ‘মুফতিয়ে আজম’ খেতাবে ভূষিত করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি হযরত নূরশাহ রাঃকে তরীকতের সবক প্রদান করেন। ফলে যুগপৎ তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা ও তরীকতের শিক্ষায় ধারণাতীত সাফল্য লাভ করেন। অতি দ্রুত তিনি উচ্চতম মোকামে উন্নীত হইয়া বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন।
অতি শৈশব হইতেই হযরত নূরশাহ রাঃ এর নূরের ছটা চতুর্দিকে অতি উজ্জ্বল আলোয় বিচ্ছুরিত হইতেছিল। তাঁহার আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, চাল-চলন সবই ছিল অতিশয় সুবিবেচনা প্রসূত এবং মনোমুগ্ধকর। আর স্মৃতিশক্তি ছিল অতিশয় প্রখর। অতি অল্প দিনের মধ্যেই পিতা-মাতার সাহচর্য্যে বাল্য শিক্ষা সমাপ্ত করিলেন। একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় উচ্চ মার্গে অধিষ্ঠিত হইলেন। পিতা কেবলার সান্নিধ্যে থাকিয়া এবং দরবার শরীফে আগত সমকালীন বুযুর্গ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সংস্পর্শ লাভ করিয়া তিনি সার্ব্বিক বিষয়ে অতিশয় ব্যুৎপত্তি অর্জন করিয়াছিলেন।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ পরবর্ত্তীতে তাঁহার উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসাতে ভর্ত্তি করিয়া দেন। সেখানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সহিত সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন পূর্ব্বক দেশে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। তিনি উর্দু, আরবী, ফার্সী, ইংরেজী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সকলের মাঝে তিনি ছিলেন জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানে উজ্জ্বল প্রদীপ স্বরূপ। তিনি প্রখ্যাত মোহাদ্দেসও ছিলেন এবং মুফতি-এ-আযম বলিয়া সর্ব্বত্র সুপরিচিত ছিলেন ও আছেন। তাঁহার অগাধ জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা সকলকে বিমোহিত করিত। তাঁহার আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রতিভা সেকালের সকলকে হার মানাইয়াছে।
হযরত নূরশাহ রাঃ এর আধ্যাত্মিকতার উচ্চতম স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাঁহার পিতা কেবলা হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর। নিজ সান্নিধ্যে সুন্দর পরিবেশে তিনি তাঁহাকে লালন-পালন করেন। আর সবচেয়ে বড় কথা মহান আলøাহর অলিগণের সুদৃষ্টি ছিল তাঁহার উপর। যাহার কারণে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল।
হযরত নূরশাহ রাঃ অতি শৈশবেই জগদ্বিখ্যাত পিতা কেবলা হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর হাতে বায়াত গ্রহণ করিয়াছিলেন। অতঃপর তিনি এলমে মারেফাতের অতল গভীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কঠোর রিয়াজত ও ইবাদতের মাধ্যমে রূহানিয়াতের সুউচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হন। তাঁহার সুউচ্চ মর্যাদার মূল্যায়ন স্বরূপ হযরত সুরেশ্বরী রাঃ তাঁহার প্রতি বিমুগ্ধ হইয়া তাঁহার অন্তরে নূরের বাতি প্রজ্বলিত করিয়া দেন।
আধ্যাত্মিক সাধনা, শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফাতের জ্ঞানে হযরত নূরশাহ রাঃ অতি উচ্চস্তরে উন্নীত হন। তিনি সুবিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং ‘মুফতিয়ে আজম’হিসাবে সর্ব্বত্র খ্যাতি লাভ করেন। অতি শৈশবেই তিনি জগদ্বিখ্যাত পিতা কেবলার হাতে বায়াত গ্রহণ করায় অতি অল্প বয়সেই এলমে মারেফাতের অতল গভীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কঠোর রেয়াজত ও ইবাদতের মাধ্যমে রূহানিয়াতের সুউচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হন।
।
শাদী মোবারক
হযরত বাবা নূরশাহ রাঃ এর বয়স বিশ বৎসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন স্থানের নামি-দামী অভিজাত পরিবার হইতে শাদী মোবারকের প্রস্তাব আসিতে লাগিল। কে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি তাঁহার কন্যাকে শাদী দিয়া হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর সুযোগ্য আত্মীয় হইয়া গৌরবান্বিত হইবেন।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ শাদী মোবারকের প্রস্তাব সমূহ সবিস্তারে অবগত হইয়া স্মিত হাস্যে উত্তর করিলেন, এখনও সময় হয় নাই। আল্লাহ তায়ালা ও নবী করীম সাঃ এর ইচ্ছায় ইনশাআল্লাহ তাঁহার শাদী মোবারক সম্পন্ন হইবে। অতঃপর যথা সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় বাইশ বৎসর বয়সে শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হইল।
হযরত নূরশাহ কেবলা কাবা রাঃ দুই শাদী মোবারক করেন। তাঁহার প্রথমা স্ত্রীর নাম সৈয়্যেদা আরফতেন নেছা। আর দ্বিতীয় স্ত্রী আলহাজ্জ্ব সৈয়্যেদা আশরাফুন্নেছা।
হযরত নূরশাহ রাঃ এর সর্ব্বমোট ৭ পুত্র ও ৩ কন্যার মধ্যে শৈশবেই ২ পুত্র ইন্তেকাল করেন। তিনি জাহেরান থাকা অবস্থায় মাতৃক্রোড়ে প্রথম পুত্র সৈয়্যেদ শাহ নূরে আনোয়ার এবং দ্বিতীয় পুত্র হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরে হেলাল সাহেব রাঃ এক পুত্র ও দুই কন্যা রাখিয়া অল্প বয়সে বাংলা ১০ শ্রাবণ ১৩৫৭ মোতাবেক ২৭ জুলাই ১৯৫০ ইং সালে ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয়া স্ত্রীর দ্বিতীয় পুত্র সৈয়্যেদ শাহ নূরে সোনা মিঞা মাতৃক্রোড়ে অনুমান দেড় বৎসর বয়সে বাংলা ১৩৪৮ সনের পৌষ মাসে ইন্তেকাল করেন।
দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফের গৌরবজ্জ্বল কার্য্যক্রম তৎসময়ে দ্রুত প্রচার এবং প্রসার লাভ করিতে থাকে। মহান অলি হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর সুখ্যাতি ও আধ্যাত্মিক রচনাবলীর অমিয়বাণী সকলকে আরও বেশি আকৃষ্ট করিতে থাকে। তাঁহার রচিত গ্রন্থ সমূহ মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আকৃষ্ট ও আন্দোলিত করিত। এই সমস্ত গ্রন্থ প্রকাশের সময়ে ‘হাসবে ফরমায়েস’(অর্থ-অনুমতি ক্রমে) ছিলেন গ্রন্থকারের জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত মাওলানা শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ ওরফে হযরত মাওলানা শাহ সূফী সৈয়্যেদ আবদুল হাই রাঃ। ইহাতে দেশ-বিদেশের গুণী-জ্ঞানী ব্যক্তিগণ অচিরেই হযরত নূরশাহ রাঃ সম্পর্কে বিস্তারিত পরিচয় লাভ করিতে লাগিলেন।
।
যোগ্য উত্তরসূরী
হযরত নূরশাহ রাঃ অতি শৈশবেই জগদ্বিখ্যাত পিতা কেবলার হাতে বায়াত গ্রহণ করিয়াছিলেন। অতঃপর তিনি এলমে মারেফাতের অতল গভীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কঠোর রিয়াজত ও ইবাদতের মাধ্যমে রূহানিয়াতের সুউচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হন। মহান মাবুদের ইচ্ছা এবং অপর মহিমায় মহিমান্বিত হইয়া যিনি ‘নূরের বাদশাহ’রূপে এই পৃথিবীতে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত হইলেন, তিনি জগদ্বিখ্যাত অলিয়ে কামেল বাদশাহে দো-জাঁহা ইমামে তরীকত কুতুবে রব্বানী গাউসে সামদানী হযরত বাবা নূরশাহ্ রাঃ।
হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রাঃ এর তিরোধানের আগের ওরোছ শরীফ অর্থাৎ বাংলা ১৩২৫ সনের ২০ শে মাঘ মোতাবেক ৩রা ফেরুয়ারী ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে পবিত্র ওরোছ শরীফ উপলক্ষে তিনি নয়নের মণি জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত মাওলানা শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ রাঃকে ফজরের নামাজের ইমাম নিযুক্ত করিয়া অগণিত ভক্ত ও মুরিদ সহ তাঁহার পিছনে নামাজ আদায় করেন।
অতঃপর হযরত নূরশাহ রাঃ এর দিকে ইশারা করিয়া বলিলেন, ‘অদ্য হইতে আপনাদের নিকট আমি এই নূরের বাতি প্রজ্জ্বলিত করিয়া গেলাম।” উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে আরও ঘোষণা করেন, ‘আজ হইতে আমি লক্ষ কোটি গুণ ক্ষমতা নিয়া নূরশাহ্ রাঃ এর মধ্যে ডুব দিলাম এবং তাঁহার সঙ্গে মিশিয়া একাকার হইয়া গেলাম। আমাকে চাইলে হযরত নূরশাহ্ রাঃ এর নিকট আসিলেই পাইবেন। তাঁহার ও আমার মাঝে কোন ব্যবধান থাকিল না। আমাদের উভয়কে এক মনে করিয়া মান্য করিতে হইবে।”হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এইরূপ অমূল্য বাণী প্রদানের পর নিজ অঙ্গুলী মোবারক হইতে আংটি খুলিয়া হযরত নূরশাহ রাঃ এর অঙ্গুলীতে পরাইয়া দেন। উল্লেখ্য, এই আংটিটি তিনি স্বীয় পীর-মোর্শেদ রাসূলনোমা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ হইতে খেলাফতের নিদর্শন স্বরূপ লাভ করিয়াছিলেন।
এই ঘোষণা দেওয়ার পর হইতে ইন্তেকাল পর্য্যন্ত প্রায় এক বৎসর অর্থাৎ ১৩২৬ সনের ২রা অগ্রহায়ণ পর্য্যন্ত হযরত সুরেশ্বরী রাঃ কাহাকেও মুরিদ করেন নাই। কেহ তাঁহার নিকট মুরিদ হইতে চাহিলেও তাহাকে হযরত নূরশাহ রাঃ এর নিকট মুরিদ হওয়ার নির্দেশ দিতেন।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এহেন গুরুত্ব পূর্ণ অসিয়তের মাধ্যমে হযরত নূরশাহ রাঃকে বেলায়েতের ভাণ্ডার-বণ্টনকারী, পরবর্ত্তী গদিনশীন, মোতাওয়াল্লী ও দরবার শরীফের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব অর্পণ করিয়া যান। তখন হইতে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর সকল আওলাদ, ভক্ত, মুরিদ-খলিফা হযরত নূরশাহ রাঃ এর আনুগত্য প্রকাশ করেন। তবে গুটিকয়েক বিপথগামী ও বিভ্রান্ত তাঁহার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নাই। বরং যুগ যুগ ধরিয়া তাহারা সরাসরি হযরত সুরেশ্বরী রাঃ হইতে বৃথা ফয়েজ-রহমত সন্ধানে মরিচিকার পিছনে ছুটিয়া চলিতেছে। যাহা একেবারেই নিষ্ফল এবং হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর অসিয়ত লঙ্ঘন করায় তাহারা মহা অপরাধী।
হযরত নূরশাহ রাঃ পিতার নির্দেশিত ও অনুসৃত পথে দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফের গুরু দায়িত্ব পালন ও সর্ব্বত্র অগণিত ভক্ত-মুরিদ করেন। বিভিন্ন স্থানে ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করিয়া বহস-তর্কে জয়যুক্ত হন। সুন্দর আচরণ, বাচন ভঙ্গী এবং জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার কারণে বাংলা ভারতের সর্ব্বত্র তাঁহার বিশেষ সুখ্যাতি ছড়াইয়া পড়ে। কুরআন ও হাদীসের উপর অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে যে কোন সময়ে সকল সমস্যার সমাধান করিতে পারিতেন। বড় বড় আলেমগণও শরীয়তের বিশেষ সমস্যার ফয়সালার জন্য অধিক সময় ব্যয় করিয়া সমাধানে পৌঁছাইতে না পারিলে সমাধানের জন্য পেরেশান হইয়া ছুটিয়া আসিতেন এবং হযরত নূরশাহ রাঃ এর খেদমতে হাজির হইয়া আরজ পেশ করিলে তিনি পবিত্র মুখে এক মুহূর্ত্তের মধ্যে সমাধান প্রদান করিতেন।
হযরত নূরশাহ রাঃ বিষয়টি অবগত হওয়া মাত্র বলিয়া দিতেন সমস্যার উত্তর পবিত্র কুরআনের কোন সূরায় বা কোন আয়াতে আছে অথবা কোন হাদীস শরীফে ইহার সমাধান পাওয়া যাইবে। অনেক কঠিন সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান তিনি সঠিক ভাবে অতি অল্প সময়ে দিতে পারিতেন। সকলেই অবাক হইয়া যাইতেন কিভাবে এত দ্রুত জটিল মাসয়ালার সমাধান দেওয়া সম্ভব ? তাহারা ধারণা করিতেন ইহা সম্ভব শুধু তাঁহার প্রবল আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এবং তীক্ষ্ম স্মৃতি শক্তির প্রভাবে। ফলে যে কোন বহেস-তর্কে তিনি সহজেই জয়লাভ করিতেন।
পিতা কেবলার প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরিচালনার মাধ্যমে হযরত নূরশাহ রাঃ নিজ বুযুর্গ পিতার অমূল্য গ্রন্থ সমূহ পুনঃপুনঃ প্রকাশ ও প্রচার করেন। তিনি হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর ছাপার রীতি অনুসরণ করিয়া গ্রন্থ সমূহ প্রকাশ করেন। যে সকল গ্রন্থ হযরত সুরেশ্বরী রাঃ ডান দিক হইতে শুরু করিয়াছেন তিনিও সে সকল গ্রন্থ ডান দিক হইতে শুরু করিয়াছেন। পিতা কেবলার রচিত মহামূল্য গ্রন্থ সমূহ যথাযথ মর্যাদা ও আঙ্গিকে প্রকাশ ও প্রচারের জন্য তিনি নিজ সন্তান-সন্ততিগণকে আদেশ প্রদান করিয়াছেন।
।
ওফাত গ্রহণ ও বিশেষ অসিয়ত
হযরত নূরশাহ রাঃ ওফাত গ্রহণের আগের ওরোছ শরীফ অর্থাৎ ১৩৬০ সনে ২০ শে মাঘ পবিত্র ওরোছ শরীফের সময় ১৭ মাঘ হঠাৎ অসুস্থ্য হইয়া পড়েন এবং ২১ শে মাঘ পর্য্যন্ত নির্ব্বাক ও অসুস্থ্য অবস্থায় শায়িত থাকেন। অসংখ্য ভক্ত-মুরিদান তাঁহার অসুস্থ্যতায় অধীর হইয়া পড়েন। তাঁহার সুস্থ্যতা ও হায়াত শরীফের জন্য সকলেই কায়মনোবাক্যে আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করেন। অতঃপর ২২ শে মাঘ তিনি সুস্থ্যতা ফিরিয়া পাইলেন ও আস্তে আস্তে কথা-বার্ত্তা বলিবার মাধ্যমে সুস্থ্য হইয়া উঠিলেন।
এমতাবস্থায় দরবার শরীফের প্রবীণ মুরিদ খলিফগণ হযরত বাবা নূরশাহ রাঃকে পরবর্ত্তী গদিনশীন করিবার অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। তদুত্তরে তিনি সবুর এখতিয়ার করিবার জন্য সকলকে উপদেশ দান করেন। তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার আওলাদগণের মধ্যে যিনি আধ্যাত্মিক সাধনা ও পরিশ্রম করিয়া নিজ মোর্শেদ পাকের সন্তুষ্টি লাভ করিতে পারিবে, তিনিই এই সৌভাগ্যের অধিকারী হইবে।”
কালের প্রবাহে হযরত বাবা নূরশাহ রাঃ ১৩৬১ বাংলা সনের ভাদ্র মাসের প্রথম দিকে পুনরায় অসুস্থ্য হইয়া পড়েন। তাঁহার অসুস্থ্যতার সংবাদ পাইয়া বহু ভক্ত-মুরিদ খলিফা আসিয়া সাক্ষাৎ করিতে লাগিলেন। এই সময় তিনি উপস্থিত সকল ভক্ত-মুরিদকে তাঁহার নাবালেগ স্নেহের দুই পুত্র লাল মিঞা শাহ (হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরে বেলায়েত হোসাইন) ও চুন্নু মিঞা শাহ (সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন আহমদীনূরী) উভয়ের দিকে লক্ষ্য রাখিবার জন্য অসিয়ত করিয়া যান। দরবার শরীফের সকল ভক্ত-মুরিদ তাঁহার এই মহা-মূল্যবান শেষ অসিয়ত শিরোধার্য্য করিয়া মানিয়া নেন।
মাশুকের আহবানে ইহলোকের মায়া-মমতা ত্যাগ করিয়া হযরত নূরশাহ রাঃ দুই স্ত্রী, চার পুত্র, তিন কন্যা, নাতি-নাতনী ও অসংখ্য ভক্ত-অনুসারী রাখিয়া বাংলা ১৩৬১ সনের ৫ই ভাদ্র মোতাবেক ২২শে আগষ্ট ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দ রবিবার বিকাল ৩:১৫ মিঃ সুরেশ্বর দরবার শরীফে বেসালে হক্ক লাভ করেন। ওফাত কালে তাঁহার কনিষ্ঠ দুই পুত্র হযরত লাল মিঞা শাহ রাঃ ও হযরত চুন্নু মিঞা শাহ তাঁহার সান্নিধ্যে উপস্থিত ছিল এবং জ্যেষ্ঠ দুই পুত্র শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরে জালাল ও শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূরে তাজাম্মুল উপস্থিত ছিলেন না।
বিশাল জন রাশির উপস্থিতিতে তাঁহার নামাজে জানাজা দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে দুই বার অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ৫ই ভাদ্র রোজ রবিবার বাদ মাগরিব এবং দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ৬ই ভাদ্র রোজ সোমবার সকাল ১০ ঘটিকায়। এই উভয় জানাজাতে হযরত লাল মিঞা শাহ ও হযরত চুন্নু মিঞা শাহ উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার দাফন কার্য্য ৬ই ভাদ্র রোজ সোমবার বেলা ১১ টায় অনুষ্ঠিত হয়। দাফন কার্যের শেষ পর্য্যায়ে জ্যেষ্ঠ দুই পুত্র আগমন করেন। তখন তাঁহারা নিজেদের অনুপস্থিতির জন্য অনুশোচনা ও ক্রন্দন করিতে থাকেন।
হযরত নূরশাহ রাঃ এর পবিত্র রওজা মোবারক দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে অবস্থিত। তাঁহার কনিষ্ঠ দুই পুত্র হযরত লাল মিঞা শাহ রাঃ ও হযরত চুন্নু মিঞা শাহ মাঃজিঃআঃ এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও তত্ত্বাবধানে এই সুদৃশ্য মাজার শরীফ ও সুপরিসর বারান্দা নির্মিত হয়। প্রতি বৎসর ১৮ই আশ্বিন হযরত নূরশাহ রাঃ এর শুভ জন্মদিন উপলক্ষে খোশরোজ শরীফ এবং ৫ই ভাদ্র বেসালে হক্ক দিবসে পবিত্র সালিয়ানা ফাতেহা শরীফ যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হইয়া আসিতেছে।
হযরত সুরেশ্বরী রাঃকে পাইতে হইলে হযরত নূরশাহ রাঃ এর সন্তুষ্টির মাধ্যমে পাইতে হইবে। অন্যথায় সকল প্রচেষ্টাই বিফল হইবে। এই কথা অমান্য করিয়া অন্য কিছু চিন্তা-ভাবনা করিলে বিপথগামী হইতে হইবে। তাই অদ্যাবধি আগত সকল ভক্ত-মুরিদ প্রথমে হযরত বাবা নূরশাহ রাঃ এর মাজার শরীফ জেয়ারত করিয়া পরে হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর পবিত্র মাজার শরীফ এবং রাসূলনোমা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ এর মাজার শরীফ জেয়ারত করিয়া থাকেন।
বর্ত্তমানেও কোন আওলাদ বা তথাকথিত তরীকতের দাবীদার কেহ হযরত নূরশাহ রাঃকে বাদ দিয়া সরাসরি হযরত সুরেশ্বরী রাঃ হইতে ফয়েজ-রহমত প্রাপ্তির দাবী করিলে তাহা নিছক মিথ্যা, প্রতারণা ও ভণ্ডামী বলিয়া গণ্য হইবে। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, নবী করীম সাঃ এবং আহলে বাইতের আমলেও এমন বিপথগামী ছিল। তাহাদের জানা উচিত, তরীকতের শাজারা মোবারকে কোন ঊর্ধ্বতন পীর-মোর্শেদকে অস্বীকার করিয়া বেলায়েতের ফয়েজ-রহমত লাভ করা সম্ভব নহে। তাই বর্ত্তমানে যে বা যাহারা হযরত নূরশাহ রাঃকে অবজ্ঞা করিয়া হযরত সুরেশ্বরী রাঃ এর ফয়েজ-রহমত আশা করে তাহাদের প্রচেষ্টা নিষ্ফল হইবে। কেননা ইহা তরীকতের ধারার পরিপন্থী। একই ভাবে নিরীহ ধর্ম্মপ্রাণ মানুষকে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করা আরও মহা অপরাধ। তাই তাহাদের উচিত, তাহারা যেন অচিরেই হযরত নূরশাহ রাঃ এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া সত্য পথের পথিক হয়।
গদিনশীন : হযরত নূরশাহ রাঃ ৪ঠা ভাদ্র দুই শিশু পুত্র হযরত লাল মিঞা শাহ রাঃ ও হযরত চুন্নু মিঞা শাহকে কাছে ডাকিয়া আনেন এবং উপস্থিত ভক্ত-মুরিদানকে বলিলেন, তোমরা এই দুইজনকে দেখিয়া রাখিবে, সম্মান করিবে। এমনকি ইন্তেকালের বেশ আগেই তিনি দ্বিতীয়া স্ত্রীর নিকট নিজের হাতের ব্যবহৃত আংটি মোবারক অর্পণ করিয়া হযরত চুন্নু মিঞা শাহকে দেওয়ার জন্য অসিয়ত করিয়া যান। এই আংটিটি হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ হযরত সুরেশ্বরী রাঃকে খেলাফতের নমুনা স্বরূপ দান করিয়াছিলেন। যাহা পর্য্যায়ক্রমে হযরত নূরশাহ রাঃ ও পরবর্ত্তীতে হযরত চুন্নু মিঞা শাহ মাঃজিঃআঃ এর হাতে শোভা পাইতেছে।