পর্ব-৩

অলি আউলিয়াগণের জীবন থেকে শিক্ষা

হযরত সালমান ফারসী রাঃ

ইমামুল আযম হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাঃ

সুলতানুল আরিফীন হযরত আবু ইয়াযিদ বোস্তামী রাঃ

কুতুবে যামান শায়খ আবুল হাসান খারকানী রাঃ

হযরত আবু ইয়াকুব ইউসুফ হামদানী রাঃ

হযরত মাওলানা খাজায়ে খাযেগান আবদুল খালেক গজদেওয়ানী রাঃ

হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ

হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী রাঃ

হযরত মাওলানা  শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ

হযরত সালমান ফারসী রাঃ

বিশ্ব মানবতার একমাত্র পথ প্রদর্শক, সাইয়্যেদুল মুরসালীন খাতামুন্নইবয়ীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহম্মদ মুজতবা সাঃ এর বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসী রাঃ অন্যতম। সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক বয়স লাভ করেছিলেন। এ মহান সাহাবীর সাড়ে তিনশত বছরের সুদীর্ঘ জীবনী বর্ণাঢ্য সব ঘটনা প্রবাহে ভরপুর। অজস্র ঘটনার সিঁড়ি পেরিয়ে তিনি মহানবী সাঃ এর সান্নিধ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এ জন্য তিনি অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিলেন। হযরত সালমান ফারসী রাঃ এই জন্য একবিন্দুও থেমে থাকেননি। সত্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা মুহাম্মদের শেষ আয়াতটি হযরত সালমান রাঃ ও তাঁর জাতি অর্থাৎ পারস্যবাসী সম্পর্কেই অবতীর্ণ করেছেন বলে তাফসীরে ইবনে কাসিরসহ বিখ্যাত তাফসীর গুলোতে এবং রাসূল পাক সাঃ এর হাদিসের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল পাক সাঃ অগণিত সাহাবাগণের ভরা মজলিশে একবার পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা মুহাম্মদের সর্বশেষ আয়াত তেলাওয়াত করলেন, অ-ইন তাতা-ওয়াল্লাও ইয়্যস্তাবদিল কাওমান গায়রাকুম ছুম্মা লা ইয়াকুনু আমছালাকুম। অর্থাৎ- সে জাতি জ্ঞানে-গুণে, চরিত্রে-ধর্মপরায়ণতায় ও ঈমানের পরিপক্কতায় তোমাদের চাইতে অনেক উন্নত হবে।
উপস্থিত সাহাবীগণ এক বাক্যে বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাঃ ! আমরা আপনার আনীত দ্বীন ইসলামকে অমান্য করলে আমাদের পরিবর্তে বর্তমান বিশ্বে এমন কোন জাতি আছে যারা ইসলামকে যথাযথভাবে মান্য করার ব্যাপারে আমাদের চেয়েও ভাল হবে? যাঁদের বর্ণনা মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মজিদে স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন? রাসূল পাক সাঃ তাদের প্রশ্নের জবাবে ও প্রমাণের জন্য বললেন যে, তোমাদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসী ইনি এবং তাঁর বংশধর। তারা এমনি লৌহমানব যে, ঈমান যদি আসমানের সুরাইয়া তারকা পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে সালমান ও তাঁর জাতি তা পাবে। (সহিহ তিরমিজি, মিশকাত- ৫৮০ পৃঃ)
নবী করিম সাঃ হযরত সালমান ফারসী রাঃ কে এত বেশি ভালবাসতেন যে, তিনি বললেন, সালমান আমার নিজের ঘরের লোক ও আমার পরিবারের (আহলে বাইতের) একজন। তাঁর জন্য মহান আল্লাহর তৈরি জান্নাত অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে। আল্লাহর নবী বলেন যে, মহান আল্লাহর তৈরী সুখময় জান্নাত তিন ব্যক্তির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। প্রথম হযরত আলী ইবনে আবি তালিব, দ্বিতীয় হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির এবং তৃতীয় হযরত সালমান ফারসী রাঃ। (সহিহ তিরমিজি, মিশকাত- ৫৭৮ পৃঃ)
হযরত সালমান ফারসী রাঃ নবী করিম সাঃ এর যুগেই আহলুল কেতাবাইন নামে আখ্যায়িত ছিলেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর যুগেই আহলুল কেতাবাইন নামে আখ্যায়িত ছিলেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাঃ এর আবির্ভাবের পূর্বে তিনি আসমানী কিতাব ইঞ্জিলের উপর ঈমান এনে হযরত ঈসা আঃ এর ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন। পরে বিশ্বনবী সাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করে কুরআন ও তাঁর আনীত দ্বীন ইসলামের উপরও ঈমান এনেছিলেন। এজন্য তিনি আহলুল কেতাবাইন অর্থাৎ দুই কিতাবের অনুসারী মহান আল্লাহর নিকট দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী ও বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত। (মিশকাত- ৫৭৮ পৃঃ)
হযরত সালমান ফারসী রাঃ যখন মদিনার রাজপথ ধরে চলতেন তখন এই স্বর্গীয় মহামানবকে প্রাণভরে একনজর দেখার জন্য রাস্তার দুই পাশে মুসলমানদের এক বিরাট সমুদ্র সমবেত হয়ে যেত। অনেকে তাঁর হাতে হাত মিলায়ে মুসুফাহা করতেন এবং অনেকে তাঁকে গলায় জড়ায়ে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কোলাকুলি করতেন। অনেকেই আবার জিজ্ঞাসা করতেন, ও সালমান ! তুমি স্বর্গীয় পুরুষ, তোমার বংশ পরিচয় আমাদেরকে দিয়ে যাও। আর তোমার পিতার নামটিও আমাদের শুনায়ে আত্মা জুড়াও। উত্তরে হযরত সালমান ফারসী রাঃ এতটুকু বলতেন যে, তোমরা আমার বংশ আর পিতার নাম শুনলে বিদ্রুপ করবে। আমি তো পারস্যের ইস্পাহান জেলার হরমুজ গ্রামের লোক আর বড় ধনিক, বণিক, অগ্নিপূজক, জমিদার ঘরের একক আদরের দুলাল। কিন্তু এখন আমার প্রকৃত পিতা একমাত্র ইসলাম। আমি দ্বীন ইসলামের পুত্র। আল্লাহর নবী সাঃ আমাকে তাঁর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকৃতি দান করেছেন। আমি এখন বিশ্ব রাসূল সাঃ এর বংশধর।
বিশ্বনবী সাঃ এর আবির্ভাবের সু-সংবাদ : হযরত সালমান ফারসী রাঃ প্রায় ১৮-২০ জন ধর্ম যাজকের কাছে যুগ যুগ ধরে ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করার পর অবশেষে আমুরিয়ার সবচেয়ে বড় ধর্ম যাজক হুমরান নামক ধর্ম যাজকের কাছে আশ্রয় নেন। ধর্ম যাজক হুমরানের কাছে দীর্ঘ ১০ বছর থাকার পর তাঁর তিরোধানের পূর্বে সবুজ রং এর একখানি কিতাব পড়ে বললেন যে, এই পাপে-তাপে জর্জরিত বিশ্বকে উদ্ধার করার জন্য শেষ পয়গম্বর আবির্ভাবের সময় উপস্থিত হয়েছে। তিনি মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করবেন এবং দু’টি উপত্যকার মধ্যে খোরমার উদ্যান বিশিষ্ট স্থানে ইয়াসরাব (মদিনা) শহবে বসবাস করবেন। তিনি কারও নিকট হতে দান গ্রহণ করবেন না। তবে বিশুদ্ধ মালের মধ্য হতে অত্যন্ত ভক্তি ভরে কেউ তাঁকে উপঢৌকনস্বরূপ দান করলে তা সাদরে গ্রহণ করবেন। তাঁর কাঁধের উপর ডিম্বাকারে মোহরে নবুয়ত দেখা যাবে।
তিনি হবেন উন্নত চরিত্রের অধিকারী, অপূর্ব সাহস, অতি সুদক্ষ ন্যায়পরায়ন নিষ্ঠাবান, কর্মঠ, সত্যবাদী সম্ভান্ত বংশোদ্ভূত পবিত্রাত্মা, সুবিবেক সম্পন্ন, প্রখর মেধাবী, অতি দানশীল, পরোপকারী ও গাম্ভীর্যপূর্ণ চিত্তাকর্ষক, প্রভাব বিস্তারকারী, হিতাকাক্সক্ষী, মানব দরদী কোন অপরূপ সুন্দর চেহারা হতেও তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারক অপরূপ সুন্দর হবে। পরকালে জান্নাতের চাবি একমাত্র তাঁর হাতে থাকবে। সর্ব প্রথম তিনি নিজের উম্মতদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। পবিত্র হাওজে কাসারের মালিক তিনিই হবেন। কিয়ামতে বিচারালয়ে তাঁর শাফায়াত ছাড়া কাও শাফায়তা কবুল করা হবে না। জিন ইনসান এর মধ্যে তিনিই সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশেষ নবী। বেগবতী বাতাসের চেয়েও তিনি বেশী দানশীল হবেন। তাঁর দোয়া সর্বদাই মাকবুল এবং কবুল করা হবে। মানব জতির সবচাইতে বড় দরদী একমাত্র তিনিই। তাঁর আনীত পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে বেশি পড়া হবে, তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ আদর্শরূপে সারা বিশ্ব গ্রহণ করবে। তিনিই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী হবেন। বিশ্ব যতই উন্নত হবে তাঁর কথাগুলো বাস্তব ও সত্য বলে অধিক প্রমাণিত হতে থাকবে।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে : হুমরান ধর্ম যাজকের নিকট বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর অপূর্ব গুণ-গরীমার কথা শুনে হযরত সালমান ফারসী রাঃ শেষ পয়গাম্বরের সাথে সাক্ষাতের জন্য তাঁর মহব্বতে পাগল হয়ে গেলেন। তাঁকে না দেখলেও তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারক তাঁর চোখের সামনে ভাসতে লাগল। এ সময় তিনি একাদিক্রমে ১৮ বছর বিভিন্নমুখী ব্যবসা করে যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ করলেন এবং দিন রজনী দরবারে এলাহীতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সাথে সাক্ষাত লাভের জন্য মুনাজাত করতে লাগলেন। এমনি একদিন আরব দেশের বানু কেলাব গোত্রের কয়েকজন ব্যবসায়ী বিরাট পণ্য সম্ভার নিয়ে আমুরিয়া এসে উপস্থিত হলে তাদের ক্রয়-বিক্রয় শেষ হলে একজন ব্যবসায়ী হিসাবে হযরত সালমান ফারসী রাঃ তাদের সহযাত্রী হয়ে আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সাথে সাক্ষাতের জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে গেলেন। তখনও কিন্তু তাঁর বিপদের দিনগুলো শেষ হয়নি। পথিমধ্যে দুরাত্মা বণিক দল তাঁর সমস্ত টাকা পয়সা লুট করে উসামা আশাহুলী নামের এক বিখ্যাত দাস ব্যবসায়ীর নিকট তাঁকে কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রয় করে দিলেন। হায় সর্বনাশ ! একজন স্বাধীন মানুষ হয়ে গেলেন দাস। এই দুঃখে তিনি এতবেশী দুঃখিত হলেন যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। উসামা আশাহুলীর নিকট দীর্ঘ ১২ বছর থাকাকালে তিনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর আবির্ভাবের সংবাদ পেলেন। এ সময় তিনি দিন-রজনী অকাতরে দরবারে এলাহীতে অশ্র“সিক্ত নয়নে বুক ভাসায়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সাথে সাক্ষাতের জন্য অবিরাম রোদন করতে লাগলেন।
বিধাতার অপার মহিমায় উসামা আশাহুলীর এক নিকটাত্মীয় জরুরী কাজে এসে তার বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি মদিনা প্রত্যাবর্তন কালে একজন লোকের একান্ত প্রয়োজন বোধে হযরত সালমান ফারসী রাঃ কে দাসরূপে ক্রয় করে মদিনায় নিয়ে যান। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত দাসত্ব করতে থাকেন এবং রাতের ঘন অন্ধকারে দরবারে এলাহীতে গোপনে বিশ্বনবীর সাক্ষাতের জন্য কান্নাকাটি করতে থাকেন। এমনি একদিন এক ব্যক্তি এসে সু সংবাদ দিলেন যে মক্কা থেকে কিছু লোক এসেছে তাঁদের মধ্যে একজন শেষ পয়গম্বর বলে দাবি করছে। এই সংবাদ শুনে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং মনে মনে বললেন মানব দরদী দয়াল নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর পদচুম্বন এবং তাঁর সংস্পর্শে কিছুক্ষণ অবস্থান করতে পারলে আমার জীবন ধন্য হবে। তখন তাঁর বয়স প্রায় দুইশত সাতানব্বই বছর। এতদিনে সেই অদম্য আশা পূর্ণ হবার সোনালী আভা দেখা দিল। তবুও নানা কারণে আরো ১০ বছর কেটে গেল। যখন তাঁর বয়স প্রায় তিনশত বছর তখন কালবিলম্ব না করে তিনি সন্ধ্যার পর মদিনার কতকগুলো উত্তম আজুয়া ও নাজুয়া খেজুর সঙ্গে নিয়ে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর দর্শন লাভের জন্য কোবা পল্লীতে গমন করলেন। মহানবী সাঃ ফুটফুটে চাঁদনী রাতের নির্মল হাওয়াযুক্ত একটি চত্বরে বসে ১০-১৫ জন শিষ্যকে শিক্ষাদানে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি তখন অত্যন্ত আদবের সাথে খোর্মাফলগুলো তাঁর সামনে পেশ করে হাদিয়া কবুলের জন্য অনুরোধ জানালাম। তখন রাসূল সাঃ বললেন, তোমাদের এক ভাই তোমাদের জন্য কিছু তোহফা নিয়ে এসেছে, তোমরা আল্লাহর নামে খাও। এইভাবে দ্বিতীয় রজনী কেটে গেল।
হযরত সালমান ফারসী রাঃ এর স্মরণীয় দিন হল তিনি সারা দিন মনিবের সমস্ত কাজ দ্রুত সমাধান করে পূর্ণিমার রাতে প্রিয় নবী র পবিত্র চেহারা মোবারক দেখার জন্য হাজির হলেন। হযরত নবী করিম সাঃ যেন শিষ্য মণ্ডলীকে সামনে বসায়ে তারকাবেষ্টিত পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উদিত হয়েছিলেন। তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারক এতই উজ্জ্বল ছিল যে, পূর্ণিমার চাঁদের উজ্জ্বল আলো হতেও বেশি পরিমাণ উজ্জ্বল। তিনি প্রিয় নবীর দর্শন লাভে ধন্য হলেন। তখন হযরত আবু বকর রাঃ তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেয়ে তাঁকে নতুন জামা দান করলেন। হযরত আলী রাঃ তাঁকে বুকে জড়ায়ে প্রগাঢ় আলিঙ্গন করলেন। সেই পবিত্র রজনীতে তিনি আকাশ পাতালকে সাক্ষী রেখে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর হাতে হাত দিয়ে বায়াত গ্রহণ করলেন। আর মনের আনন্দে কালেমা তাইয়্যেবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পাঠ করতে লাগলেন। এইভাবে তিনি আসা যাওয়া করতে লাগলেন। একদিন তিনি নবী করিম সাঃ এর নিকট মনের আশা আকাংখার কথা প্রকাশ করলেন যে, তিনি ইসলামের জন্য কিছু করতে চান। কিন্তু তিনি তো দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ। তখন বিশ্ব মানবতার মুক্তির পথ প্রদর্শক হযরত মুহাম্মদ সাঃ তাঁর বিধর্মী মালিককে তাঁর তিনশত বছর বয়সের গোলামকে বিক্রির জন্য অনুরোধ করলেন। নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি একটি শর্ত দিলেন যে, যদি কেউ তাকে চারশত খেজুর বৃক্ষ রোপন করে দেয় এবং প্রত্যেক বৃক্ষ প্রচুর পরিমাণে ফলশালী হয় এবং ৪০ তোলা স্বর্ণ দান করে তাহলে হযরত সালমান রাঃ কে মুক্তি দেয়া যেতে পারে।
মহানবী সাঃ এর মহানুভবতা : বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা, তাজেদারে মদিনা রাহমাতাল্লীল আলামিন সাইয়্যেদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ সাঃ সালমান ফারসী রাঃ কে দাসত্বের শৃংখল হতে মুক্তির জন্য যে মহান উদার নীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বের ইতিহাসে তা উজ্জ্বল হয়ে আছে। মানব দরদী আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এই কঠিন শর্তটি স্বীকার করে সাহাবীদেরকে চারশত খোর্মা বৃক্ষ সংগ্রহ করতে আদেশ দিলেন। প্রিয় নবীর আদেশ পেয়ে সাহাবায়ে কেরামগণ অতিদ্রুত আদেশ পালন করলেন। আল্লাহর নবী হযরত সালমান ফারসী রাঃ এর জন্য ও দ্বীন ইসলামের খেদমতের জন্য নিজেই সমস্ত বৃক্ষ রোপন করলেন। কেবল একটি বৃক্ষ হযরত উমর রাঃ রোপন করেছিলেন। কুদরেত এলাহী সকল বৃক্ষ অল্পদিনের মধ্যে ফলমণ্ডিত হয়ে মদিনার সমস্ত বাগানের মধ্যে শোভা বর্ধিত হল। অতঃপর হযরত নবী করিম সাঃ বিভিন্ন যুদ্ধে লব্ধ ধনরাশি হতে একখণ্ড স্বর্ণ তাঁকে দান করলেন। হযরত সালমান বললেন, আমি স্বর্ণখণ্ড ওজনে ৪০ তোলা অপেক্ষা কম হবে বলে মনে মনে চিন্তা করতেছিলাম এবং প্রিয় নবীর পবিত্র বদন মণ্ডলের দিকে বার বার দেখতেছিলাম। আল্লাহর নবী তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, সালমান তুমি কি চিন্তা কর? মৃদু হেসে বললেন যে, এটা তোমার মনিবের নিকট নিয়ে যাও, আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ওজনে কম হবে না। তখন তিনি স্বর্ণখণ্ডটি বিধর্মী মালিককে প্রদান করলে তিনি ওজন করতে গিয়ে পুরোপুরি ৪০ তোলাই পেলেন। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজা, মিশকাত)। বিধর্মী মনিবের সঙ্গে প্রিয় নবীজির সমস্ত ওয়াদা পূর্ণ হল এবং নিরূপায় হয়ে হযরত সালমান ফারসী রাঃ কে মুক্তি দান করলেন।
এই মহান ব্যক্তিত্ব হযরত সালমান ফারসী রাঃ ওফাত গ্রহণের পূর্ব দিন পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে ইসলামের খেদমত করেন। দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের পর হতে তিনি কখনও প্রিয় নবীর সংস্পর্শ ত্যাগ করেননি এবং নবীজির সাথে সমস্ত যুদ্ধে সমানভাবে তিনি শরীক হয়েছিলেন। নবীজির তিরোধানের পর তিনি অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত অবস্থায় দিন কাটাতে লাগলেন। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাঃ এর খেলাফত কালে হযরত সালমান ফারসী রাঃ পারস্যের গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং পূর্ণমাত্রায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেছিলেন। হযরত সালমান ফারসী রাঃ ইসলাম গ্রহণ করার পর হতে আল্লাহর নবীর যুগে সারা বিশ্বে ইসলামের পতাকাকে চির উড্ডীন রাখার জন্য তিনি ৮০ বার বল বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন। আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর ওফাত গ্রহণের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাঃ ও হযরত ওমর রাঃ এর যুগে সংঘটিত সকল যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সর্বমোট ১২৭টি যুদ্ধে অংশ নেন।
ঐতিহাসিকগণ বলেন, হযরত সালমান ফারসী রাঃ ৩৫০ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি নিজ হাতে যা উপার্জন করতেন তা দিয়েই পানাহার করতেন। তিনি অত্যধিক দানশীল ছিলেন। তিনি সমস্ত রাত পবিত্র কুরআন মজিদ তেলাওয়াত ও তাহাজ্জুতের নামাজে অতিবাহিত করতেন। বহু হাদিস দ্বারা তাঁর প্রশংসা পাওয়া যায়। তিনি ৩৫ হিজরিতে মাদায়েনে ওফাত লাভ করেন।
জান্নাত তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করছে : আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ বলেছেন, সালমান আমার নিজের ঘরের লোক আমার পরিবারের একজন। তাঁর জন্য আল্লাহর তৈরি জান্নাত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি আরো বলেছেন, আল্লাহর তৈরি সুখময় জান্নাত তিন ব্যক্তির জন্য অধীর আগ্রহে সময় অতিবাহিত করছে। তাঁরা হলেন, হযরত আলী, হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির এবং হযরত সালমান ফারসী রাঃ। (তিরমিজি, মিশকাত)

ইমামুল আযম হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাঃ

আহলে বাইতগণের নবী পরিবারের বারজন ইমামের মধ্যে ইমাম জাফর সাদেক রাঃ ছিলেন একজন। তাঁর পূর্ণ নাম ইমাম আবু মুহাম্মদ জাফর সাদেক ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবিতালেব। তিনি নবী করিম সাঃ আধ্যাত্মিক সম্পদের প্রকৃত ওয়ারিস। কাজেই তাঁর সম্বন্ধে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, তিনি মারেফাত, তরিকত ও হাকিকত তত্ত্বের সত্যিকারের একজন বিশদ ব্যাখ্যাকারী এবং সুন্নতে নববীর তলোয়ার ও ও শরীয়তে মুহাম্মদীর একনিষ্ঠ সাধক। আহলে বাইতের ইমামগণের মধ্যে তিনি সর্বশেষ ইমাম। সর্বশেষ ইমাম ছিলেন বলে তিনি আহলে বাইতগণের মারেফাত ও তরিকত সম্পর্কে বহু কিছু রেওয়ায়েত করেছেন। আর সর্ব কালের এলেম ও মারেফাতের সুক্ষè তত্ত্বজ্ঞানে তাঁহার কামালিয়ত ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন সমস্ত মাশায়েখ তরিকতের ইমাম। সকলেরই নির্ভর ছিল তাঁর উপর। সকল শ্রেণীর লোকেরই তিনি ছিলেন অগ্রনায়ক ও দিশারী এবং যাবতীয় সুক্ষ্ণে তত্ত্বের আবরণ উন্মোচনকারী, কুরআনে পাকের গূঢ়তত্ত্ব বিশ্লেষণকারী।
হযরত জাফর সাদেক বলেছেন, ……… …. যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে চিনতে পেরেছে, সে আল্লাহ তায়ালা ব্যতিত অপরাপর যাবতীয় পদার্থ হতে পরান্মুখ হয়েছে। ফলকথা, আল্লাহ তায়ালার মারেফতে নিমজ্জিত ব্যক্তি একমাত্র তাঁরই ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে অন্যান্য সমস্ত বস্তু হতে মুখ ফিরায়ে নেয়, আর পার্থিব যাবতীয় উপাদান ও উপকরণকে বর্জন করে। কেননা আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে তাঁকে ছাড়া অন্যান্য যাবতীয় পদার্থকে ভুলতে হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ পাকের মারেফাত (পরিচয় জ্ঞান) লাভ করেছে, সে সৃষ্ট জগতের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে এক আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তার অন্তরে সৃষ্ট পদার্থের প্রতি এতটুকু মর্যাদাও থাকে না- অন্ততঃ আড়চোখে একবার তাকায়ে দেখে। আর তার অস্তিত্ব তার অন্তরে এতটুকু চিন্তাও জাগায় না যে, মুহূর্তের জন্য তার স্মরণকে অন্তরে স্থান দেয়।
তিনি বলেছেন, ইবাদত তওবা ব্যতিত শুদ্ধ হয় না। কেননা আল্লাহ তায়ালা তওবাকে ইবাদতের উপর অগ্রবর্তী করেছেন, যেমন তিনি একটি আয়াতে উল্লেখ করেছেন, “তওবাকারীগণই প্রকৃত ইবাদতকারী।” কেননা, তরিকতের স্তরসমূহের মধ্যে সর্ব্রথম স্তর তওবার এবং সর্বশেষ স্তর ইবাদতের। আল্লাহ তায়ালা গুনাহগারদের উল্লেক করে তাদের তওবার নির্দেশ প্রদান করেছেন ………….. অর্থাৎ- “অতঃপর তিনি স্বীয় বান্দার প্রতি ওহি প্রেরণ করলেন।”
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে বাগদাদে খলিফা মনসুর হযরত জাফর সাদেকের বিরাট ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর প্রতি জনসাধারণের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তি-ভালবাসা দেখে নিজের রাজত্ব সম্বন্ধে ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়লেন, তাই তিনি এক রাত্রে স্বীয় উজিরকে ডেকে বললেন, “যাও, জাফর সাদেককে ডেকে আন, ইম তাকে হত্যা করব।” উজির বিনয় সহকারে বললেন, “বেচারা নিরীহ লোক, নির্জনে বসে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছে। সংসারের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, সমস্ত কিছুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এমন ব্রক্তির প্রতি আপনার রাগান্বিত হওয়ার এবং তাকে হত্যা করার কারণ কি? আমি তো তাঁর দ্বারা আপনার কোন ক্ষতির আশঙ্কা দেখছি না। তাঁকে হত্যা করে আপনার কি লাভ হবে?” উজিরের এই কথায় বাদশাহর মনোভাবের কিছুমাত্র পরিবর্তন হলো না, বরং তিনি উজিরের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বললেন, আমি তোমার এইসব নীতিকথা শুনতে চাই না। তাঁকে আমার দরবারে হাজির করতে হবে।” উজির পুনঃ পুনঃ আরজ করেও বাদশাহের মনোভাবের কোন পরিবর্তন করতে পারল না, অগত্যা হযরত জাফর সাদেক রাঃ কে ডেকে আনার জন্য ডেকে আনার জন্য গমন করল। এদিকে খলিফা গোলামদিগকে বললেন, “জাফর সাদেককে দরবারে হাজির করা মাত্রই আমি আমার মাথার মুকুট নামায়ে ফেলব। আর তোমরা আমার এই সংকেত পাওয়া মাত্রই তাকে হত্যা করিবে।” কিন্তু আল্লাহ পাকের লীলা বুঝা মুশকিল। হযরত জাফর সাদেক রাঃ যখন দরবারে এসে উপস্থিত হলেন, তখন মনসুর তাকে হত্যা করবেন তো দূরের কথা তাঁকে দেখামাত্র সন্ত্রস্তভাবে সিংহাসন ছেড়ে তাঁর এস্তেকবালের জন্য দ্রুত এসে তাঁর সামনে নতজানু হয়ে পড়লেন এবং পরমুহূর্তে তাঁকে অতি সস্মানের সাথে নিজের সিংহাসনে বসালেন। গোলামেরা তো এই দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইল। এদিকে মনসুর হযরত সাদেক রাঃ কে বললেন, “আমার কাছে আপনার কোন প্রয়োজন থাকলে বলুন, এই মুহূর্তেই আমি তা পূরণ করব।” হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাঃ বললেন, “আপনার নিকট আমার কোন জিনিসের প্রয়োজন নেই। শুধু আপনার কাছে আমার একটিই অনুরোধ আপনি আমাকে আর কখনো ডাকায়ে আমার ইবাদতে বিঘ্ন ঘটাবেন না।” একথা শুনে খলিফা মুনসুর তাঁকে তৎক্ষণাৎ খুব সম্মানের সাথে বিদায় দিলেন।
হযরত জাফর সাদেক রাঃ কে বিদায় করার পরমুহূর্তেই মনসুরের সর্ব শরীরে কম্পন আরম্ভ হল। তিনি কাঁপতে কাঁপতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। এই জ্ঞানহীন অবস্থারমধ্যেই তাঁর তিন দিন কেটে গেল। কেহ কেহ বলেছেন, এই বেহুশী অবস্থা এতক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল যে, তাঁর তিনি ওয়াক্তের নামাজ কাযা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরে আসার পর উজির যখন খলিফাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার এমন অবস্থা হল কেন?” খলিফা বললেন, “জাফর সাদেক রাঃ আমার দরবারে প্রবেশ করলে আমি দেখতে পেলাম তাঁর সঙ্গে একটি বিরাটকায় অজগর আমার দিকে এমন বিকটভাবে হা করে আছে যে, তার একটি চোয়াল চত্বরের নিম্নে আর অপরটি ঊর্ধ্বে। অজগরটি সেই অবস্থায় আমাকে বলল, মনসুর সাবধান ! যদি তুমি জাফর সাদেকের একটি কেশও স্পর্শ কর অথবা কোন রকম কষ্ট দাও, তবে তোমাকে এখনই এই তত্বরসহ গিলে ফেলব।” অজগরের ভয়ে আমি এমন জ্ঞানহারা হয়ে পড়েছিলাম, আমি কি বলেছি বুঝতে পারিনি। তবে এতটুকু স্মরণ আছে যে, আমি জাফর সাদেকের খেদমতে ওযর-আপত্তি পেশ করে বিনয় ও নম্রতার সাথে তাঁকে সসম্মানে বিদায় করেছি এবং পরক্ষণেই সম্পূর্ণরূপে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছি।
অন্য একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, একদা হযরত দাউদ তায়ী রাঃ হযরত জাফর সাদেক রাঃ এর দ্বারে এর আরজ করলেন, “হে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সন্তান ! আমার অন্তকরণ কালো এবং অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, আমাকে কিছু নছিহত করুন।” তিনি বললেন, “হে আবু সোলায়মান (হযরত দাউদ তায়ী’র কুনিয়াত) ! আপনি নিজেই যুগের সংসার বিবাগী শ্রেষ্ঠতম অলি, আমার নসিহতের আপনার কোন প্রয়োজন নেই।” ইমাম দাউদ তায়ী বললেন, “হে পয়গম্বরের সন্তান ! যুগের সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরামের চেয়ে আপনার মর্যাদা অনেক উচ্চে। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সকলের চেয়ে অধিক বুযুর্গী দান করেছেন। আপনি নবী করিম সাঃ এর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী, অন্যান্য সকলকে নসিহত করা আপনার উপর ওয়াজেব।” হযরত জাফর সাদেক রাঃ বললেন, “হে আবু সোলায়মান ! আপনাকে আমি কি উপদেশ দিব, আমার নিজের পরিণামের ভয়ে আমি নিজেই অস্থির। আমার মাননীয় নানাজী যদি আমাকে কেয়ামতের দিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, “তুমি  আমার আনুগত্য ও আদশে পালনের হক আদায় করলে না কেন? বস্তুতঃ এই আনুগত্যের হক ও পরলোকের মর্যাদা আর বুযুর্গী হাসাব-নাসাবের দ্বারা সম্পন্ন হয় না, বরং আল্লাহ তায়ালার দরবারে মান-মর্যাদা ও সফলতা লাভ করার একমাত্র ভিত্তি হল নেক আমল। নেক আমল ছাড়া সেখানে অন্য আর কোন কিছুরই মূল্য নেই।” নানাজী আমাকে এরূপ বলিলে আমি কি উত্তর দিব। আমি যে সেই ভয়েই অস্থির। নানাজী আমাদের আহলে বাইতগণকে লক্ষ্য করে বলেছেন, “সাবধান ! এমন যেন না হয় যে, কেয়ামতের দিন লোকেরা আমার নিকট তাহাদের আমল নিয়ে হাজির হয় আর তোমরা কোন আমল ব্যতিত শুধু হাসাব-নাসাবের দাবি নিয়ে আমার কাছে উপস্থিত হও, তাহা হলে আমার আর মুখ লুকাবার স্থান থাকবে না।” এই কথা শুনামাত্র হযরত দাউদ তায়ী রাঃ ক্রন্দন করতে করতে অস্থির হয়ে পড়লেন এবং বিলাপ করতে লাগলেন, “হায় খোদা ! পয়গম্বরের রক্তের মিশ্রনে যাঁর দেহ গঠিত, যাঁর নানাজী সৃষ্টির উৎস এবং সেরা- মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ, আর যাঁর মাতৃকুল শিরোমণি বেশেতের নারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়া হযরত ফাতেমা রাঃ, তিনিই যখন নিজের আমলের উপর কোনই নির্ভর না করে পারলৌকিক পরিণামের জন্য এতই ভীত, এত চিন্তিত, তখন দাউদ কোন ছার ….. যে নিজের আমলের জন্য গর্বিত হবে।”
একদিন হযরত জাফর সাদেক রাঃ নিজের গোলামদের সঙ্গে বসে আলাপ প্রসঙ্গে তাহাদের লক্ষ্য করে বললেন, “আসুন, আমরা সকলে মিলে পরস্পর এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হই যে, কেয়ামতের দিন আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি হিসাবে নিকাশে সকলের আগে মুক্তি লাভ করবে, সেই আমাদের অবশিষ্ট সকলের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে সুপারিশ করবে।” তারা সমস্বরে বলল, “হে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সন্তান ! আমাদের সুপারিশে আপনার কি লাভ? আপনার নানাজীই তো সমস্ত মানুষের জন্য সুপারিশ করবেন।” তিনি বললেন, “আমি আমার এই ক্রটিপূর্ণ যৎসামান্য ও নগণ্য আমল নিয়ে আমার নানাজীর সেই নূরানী চেহারার দিকে তাকাতে লজ্জাবোধ করি এবং যথেষ্ট ভয়ও রয়েছে। এজন্য আপনাদের কাছে সুপারিশের আবেদন জানায়েছি। নিজের আমলকে নির্ভরযোগ্য মনে না করে নিজের আয়েব ও দোষ-ক্রটির প্রতি লক্ষ্য রাখলেই এমন উচ্চস্তরে উন্নীত হওয়া যায়। এটা তরিকতপন্থীগণের মহৎ গুণ। সমস্ত আম্বিয়া, রাসূল, আউলিয়া এবং বিশিষ্ট নেককার বান্দাগণই এই মহৎ গুণের অধিকারী ছিলেন। যেমন রাসূলপাক সাঃ বলেছেন, আল্লাহ পাক যখন নিজের কোন বান্দার মঙ্গল ও উন্নতি বিধানের ইচ্ছা করেন, তখন তাঁর দোষ-ক্রটিসমূহ তার চোখের সম্মুখে তুলে ধরেন, আর যে ব্যক্তি নিজেকে অক্ষম মনে করির আল্লাহ পাকের মহাশক্তিশালী হস্তে নিজকে সমর্পন করে তাঁর সম্মুখে সম্তক অবনত করে, আল্লহ তায়ালা তার যাবতীয় কাজ সুসম্পন্ন করে দেন।
একসময় হযরত জাফর সাদেক রাঃ নির্জনতা অবলম্বনপূর্বক লোকালয়ে গমনাগমন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিলেন। এই সময় একদিন হযরত সুফয়ান ছওরী রাঃ তাঁর খেদমতে এসে বললেন, “হে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ফরযন্দ! আপনি নির্জনতা অবলম্বন করেছেন কেন? আল্লাহর বান্দগণ আপনার ফয়েজ ও বরকত হতে বঞ্চিত হচ্ছে।” হযরত জাফর সাদেক রাঃ উত্তর করলেন, “এ সময়ের জন্য আমি এটা সঙ্গত মনে করেছি।” এই বলে তিনি দুইটি বয়েত আবৃত্তি করলেন, যার সারমর্ম আনুগত্য ও ওফাদারী বোধসম্পন্ন লোকের নজীর দুনিয়াতে বিরল। মানুষ কেবল নিজের পার্থিব উদ্দেশ্য ও কামনা সিদ্ধির মোহে মোহিত হয়ে রহিয়াছে। এক অন্যের সাথে বাহ্যিক মহব্বতের ভাব প্রকাশ করে বটে, কিন্তু তাদের অন্তর সমূহ বিচ্ছুতে পরিপূর্ণ রয়েছে।” একদিন হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাঃ মূল্যবান জাঁকালো পোশাক পরিধান করেছিলেন। জনৈক ব্যক্তি তা দেখে বলল, “আপনি নবীর বংশধর। নবীর সন্তানের পক্ষে এমন জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক ব্যবহার করা শোভনীয় দেখায় না।” একথা শুনে তিনি লোকটির হাত টেনে এনে তাঁর আস্তিনের ভিতর ঢুকায়ে নিচের পরিধেয় পোশাকের উপর ঘষে দিলেন। লোকটি অনুভব করল, ভিতরের পোষাকটি খুব মোটা এবং খসখসে। এমনকি, তার ঘষায় তার হাত জ্বালা করতে লাগল। অতঃপর হযরত জাফর সাদেক রাঃ বললেন, “আমার কাছে দুই পরস্ত জামা-কাপড় আছে। এক পরস্ত খুব মোটা ও খসখসে, তা পরিধান করে আমি আল্লাহ পাকের দরবারে দাঁড়াইয়া নামাজ পড়ি। আর এক পরস্ত জামা-কাপড় পরি লোক সমাজে চলাফেরা করার জন্য- যা কিছুটা জাঁকজমকপূর্ণ বৈ কি!”
একদিন হযরত জাফর সাদেক রাঃ হযরত ইমাম আবু হানিফা রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রকৃত জ্ঞানবান লোক কে?” তিনি বললেন, “প্রকৃত জজ্ঞানবান সেই ব্যক্তি, যে ভাল-মন্দ এবং নেকী-বদীর মধ্যে পার্থক্য বজায় রেখে চলে।” হযরত জাফর সাদেক রাঃ বললেন, “এ তো চতুষ্পদ জন্তুরাও করতে পারে। কারণ কে তাকে মারে এবং কে তাকে চুম্ চুম্ করে আদর করে সে তা ভাল করে উপলব্ধি করতে পারে।” হযরত আবু হানিফা রাঃ বললেন, “আচ্ছা, আপনার মতে সত্যিকার জ্ঞানী ব্যক্তি কে?” তিনি বললেন, “আমার মতে সেই ব্যক্তিই প্রকৃত জ্ঞানী যে ব্যক্তি দুইটি ভাল ও দুইটি মন্দের মধ্যে তুলনা করে এবং দুইটি ভাল কার্য বা বস্তুর ম্েযধ অপেক্ষাকৃত উত্তমকে অবলম্বন করে, আর দুইটি মন্দের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম মন্দটিকে বেছে নেয়। অতঃপর তাহাও বর্জন করে।”
একদা কতিপয় লোক তাঁকে বলল, “আপনার মধ্যে সর্বপ্রকার মহৎ গুণই বিদ্যমান রয়েছে। সংসার বিরাগ, দানশীলতা, আভ্যন্তরীণ স্বচ্ছলতা ইত্যাদি। তদুপরি আপনি হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর খানদানের নয়নমণিও বটে, কিন্তু আপনার মধ্যে অহংকার বেশি।” তিনি বললেন, “আমি অহংকারী নই, কিন্তু আমার সৃষ্টিকর্তা এমন অহমিকাপূর্ণ যে, আমি যখন গর্ব ও অহংকার বর্জন করলাম, তখন তাঁর অহমিকা আমার দিকে এসে আমার অন্তরের শূন্যস্থান পূর্ণ করে দিল। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনায় অহংকার করা অবশ্য উচিত নয়, তবে নিজের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে গৌরব করা যায়েজ।”
কথিত আছে, একদা কোন এক ব্যক্তির হাজার টাকা ভর্তি একটি থলি হারায়ে যায়। সে হযরত জাফর সাদেক রাঃ কে চিনতে না পেরে সন্দেহক্রমে তাঁকে ধরে বলল, “তুমি আমার টাকার থলি চুরি করেছ, তুমি চোর।” হযরত জাফর সাদেক রাঃ বললেন, “তোমার থলিতে কত টাকা ছিল?” সে বলল, “হাজার স্বর্ণ মুদ্রা।” তিনি লোকটিকে সঙ্গে করে বাড়ি আসেন এবং তাকে এক হাজার মুদ্রা দিয়ে বিদায় করেন। পরে যখন উক্ত লোকটি তার হারান মুদ্রার থলি পেয়ে হযরত জাফর সাদেক রাঃ কে মুদ্রা ফেরত দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে এসে বলল, “আমি ভুলক্রমে আপনাকে আমার টাকার জন্য দায়ী করেছিলাম, আমাকে ক্ষমা করুন এবং আপনার এই এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা গ্রহণ করুন।” তখন হযরত জাফর সাদেক রাঃ বললেন, দান করে ফেরত নেয়ার দস্তুর আমার নেই। আমি তোমাকে যা দান করেছি তা ফেরত গ্রহণ করব না।” লোকটি তারপর দরবার হতে অন্যত্র গিয়ে একজন লোককে জিজ্ঞাসা করল, “ইনি কে?” সে বলল, “তিনি হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাঃ।” হযরত জাফর সাদেকের সাথে এরূপ রূঢ় ব্যবহার করেছে জানতে পেরে লোকটি লজ্জায় ও মনের দুঃখে সেখানে আর না দাঁড়ায়ে নিজ গন্তব্যে চলে গেল।
একদিন হযরত জাফর সাদেক রাঃ একাকী কোন পথ দিয়ে নিজ মানে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ জিকির করতে করতে যাচ্ছিলেন। একজন দগ্ধচিত্ত দরবেশও তাঁর পাছে পাছে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলতে বলতে পথ অতিক্রম করছিল। ইতিমধ্যে হযরত জাফর সাদেক রাঃ মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করলেন, “ইয়া আল্লাহ ! আমার জামা নেই, ইয়া আল্লাহ ! আমার যুব্বা নেই।” তাঁর প্রার্থনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎকৃষ্ট ধরনের জামা-কাপড় গায়েব হতে এসে তাঁর সামনে উপস্থিত হল। হযরত জাফর সাদেক রাঃ তা পরিধান করলেন। তা দেখে পশ্চাতের সেই দরবেশ তাঁর সামনে এস বললেন, “হে খাজা ! ‘আল্লাহ আল্লাহ’ জিকির করাতে আমিও আপনার সঙ্গে শরিক ছিলাম। এখন আপনি আপনার পুরাতন কাপড়গুলো আমাকে দান করুন।” হযরত জাফর সাদেক রাঃ তাঁর কথায় সন্তুষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ গায়ের পরিধেয় পুরাতন জামা-কাপড়গুলো তাঁকে দিলেন।
একব্যক্তি হযরত জাফর সাদেক রাঃ এর কাছে এসে বলল, আমাকে আল্লাহ পাকের দীদার লাভ করায়ে দিন। আমি যেন তাঁকে আমার বাহ্য চক্ষু দ্বারা প্রকাশ্যে দেখতে পাই।” হযরত জাফর সাদেক রাঃ বললেন, “তুমি কি শুননি যে, হযরত মুসা আঃ আল্লাহ পাকের দীদার লাভের প্রার্থনা জানায়ে বলেছিলেন, ………… “হে খোদা ! আমাকে আপনার দর্শদ দান করুন।” আল্লাহ পাক তৎক্ষণাৎ তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, …… “তুমি, (দুনিয়াতে এই চর্ম চক্ষু দ্বারা) আমাকে কখনোই দেখতে পাবে না।” লোকটি বলল, “শুনেছি, কিন্তু এ তো সেই মুসা আঃ এর যুগ নয়Ñ এ তো হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর যুগ। এই যুগে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর অনুরক্ত আউলিয়ায়ে কেরামের মধ্যে কেহ বলতেন, ….. ‘আমার কলব আমার রবের দর্শন লাভ করেছে।’ কেহ কেহ চিৎকার করে বলতেন, ….. এমন রবের ইবাদত আমি কখনও করিনি যাঁকে আমি দেখতে পাইনি। অর্থাৎ তাঁর উম্মতের মধ্যে অনেক অলি আউলিয়াই আল্লাহ পাককে দর্শন করেছেন বলে দাবি করেছেন। তবে আমার পক্ষে কেন অসম্ভব হবে? লোকটির কথা শেষ হতেই হযরত জাফর সাদেক রাঃ নিজের খাদেমদের বললেন, “লোকটিকে হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দাও।” তৎক্ষণাৎ তাঁর আদেশ পালন করা হল। নদীর পানিতে ঘূর্ণিপাক তাকে একবার ডুবায়ে দিল, আবার ভাসায়ে তুলল, এ অবস্থা চলতেছিল। আর সেই লোকটি চিৎকার করে বলতে লাগল, হে নবীর ফরযন্দ! আমাকে রক্ষা করুন, আমাকে রক্ষা করুন। হযরত জাফর সাদেক রাঃ পানিকে আদেশ করলেন, হে পানি এই লোকটিকে পুনঃ পুনঃ তোমার ভিতরে ডুবাতে থাক।” পানি হুকুম মত কাজ করতে লাগল। আর সে প্রত্যেকবার ভেসে একই চিৎকার করতে লাগল, হে নবীর সন্তান ! আমাকে রক্ষা করুন, আমাকে রক্ষা করুন। চিৎকার করতে করতে লোকটি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অবশেষে যখন দজলা নদীর অতলান্তে চলে গেল তখন সমস্ত মখলুকের আশা তার মন হতে চলে গেল। ঠিক এই সময় যখন সে পানির ঘূর্ণিপাকের সাথে হঠাৎ উপরে ভেসে উঠল, তখন বলল, “ইয়া আল্লাহ ! আমাকে রক্ষা করুন।” এবার হযরত জাফর সাদেক রাঃ খাদেম কে নির্দেশ দিলেন তাকে উঠায়ে আনার জন্য। খাদেম তাকে নদী হতে তুলে কিছুক্ষণ বিশ্রামের মাধ্যমে ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে এক স্থানে বসায়ে দিল। অনেকক্ষণ বিশ্রামের পর তার পূর্ব জ্ঞান ও স্বস্তি ফিরে আসলে হযরত জাফর সাদেক রাঃ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, এবার বলত, আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পেয়েছ কি?” সে বলল, “যতক্ষণ মাখলুকের সাহায্যের আশা মনে স্থান দিয়েছিলাম, ততক্ষণ পর্দার আড়ালে ছিলাম, তাঁকে দেখতে পাইনি। কিন্তু যখন সকল মানুষের আশা মত হতে মুছে খাঁটি মনে আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় গ্রহণ করলাম এবং আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লাম, তখন দেখলাম, আমার অন্তরের একটি খিড়কির দুয়ার খুলে গেছে, তা দিয়ে আমি আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পেলাম, অর্থাৎ তাঁর রহমতের নূর আমার উপর অজস্র ধারায় প্রবাহিত হতে লাগল। তখন আমি বলে উঠলাম, ……. “বিপন্ন ব্যক্তি বিপদে পড়ে যখন তাঁকে ডাকে, তখন সেই ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য এবং সেই বিপদ মোচন করে দেওয়ার জন্য তিনি ছাড়া আর কে আছেন? আর কেউ নেই।” হযরত জাফর সাদেক রাঃ বললেন, “যতক্ষণ তুমি আমার উপর নির্ভর করেছিলে এবং আমার সাহায্য চেয়েছিলে ততক্ষণ তুমি ভুল পথে ছিলে এবং ছিলে মিথ্যাবাদী। তোমার অন্তকরণের যে খিড়কিটি উন্মুক্ত হয়েছে- এখন হতে সেটি খুব যতœ সহকারে উন্মুক্ত রাখার চেষ্টা করো।
অমিয়বাণী :
হযরত জাফর সাদেক রাঃ বলেছেন,
যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ তায়ালা কোন বস্তুর উপর অবস্থিত কিংবা তাঁর অস্তিত্ব কোন বস্তু হতে উৎপন্ন, সে নিঃসন্দেহে কাফের হয়ে যায়।
মানুষের অন্তরে যে গুনাহের কাজ আরম্ভ করার পূর্বে ভয়ের উদ্রেক হয়া এবং নফসকে দমন করতে না পেরে সংকুচিত মনে তা করে ফেলে, পরিশেষে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে তওবা করে, সেই গুনাহের কাজই মানুষকে আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী করে দেয়। পক্ষান্তরে যে ইবাদত প্রথমে ইবাদতকারীর মধ্যে আমিত্ববোধ জাগ্রত করে এবং ইবাদত সমাপ্ত করে তদ্দরুন মনে অহমিকার উদ্ভব হয়- এ জাতীয় ইবাদতই মানুষকে মাবুদ হতে ক্রমশঃ দূরে সরায়ে দেয়। বস্তুতঃ সে এই ইবাদতের জন্য অহংকারী ও গুনাহগার। আর গুনাহের কাজ করে অনুতাপকারী ও ক্ষমা প্রার্থনাকারী আল্লাহ তায়ালার ফরমার্বাদার বলে গণ্য হয়।
লোকেরা হযরত জাফর সাদেক রাঃ কে জিজ্ঞাসা করল, “সবরকারী নিঃসম্বল দরবেশের ফজিলত বেশি, না শোকরগুজার ধনী লোকের ফজিলত বেশি?” উত্তরে তিনি বললেন, দরিদ্র ও সবরকারী দরবেশের ফজিলতই অধিক। কেননা, ধনী লোকের দৃষ্টি টাকা-পয়সার উপরেই নিবদ্ধ থাকে, আর নিঃসম্বল সবরকারী দরবেশের দৃষ্টি শুধু এক আল্লাহর প্রতিই আকৃষ্ট থাকে।”
বস্তুতঃ দুনিয়ার সমস্ত পদার্থের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহ পাকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। এর ফলে আল্লাহ তায়ালা এইরূপ স্মরণকারীর জন্য তার পরিত্যক্ত সমস্ত পদার্থের বিনিময় হয়ে যান।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ………… অর্থাৎ- নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা (নিজ বান্দগণের মধ্য হতে) যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমতের সাথে বিশিষ্ট (খাছ) করে থাকেন। অতএব, দেখ বান্দাকে দান করার ব্যাপারটি আল্লাহ তায়ালা একমাত্র নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন, মধ্যস্থলে কোন উছিলা বা উপকরণকে স্থান দেননি।
তিনিই মুমিন ব্যক্তি যিনি নফসে আম্মারাকে দমন করার জন্য সতর্ক প্রহরীরূপে দাঁড়ায়ে থাকেন। আর আরেফ তিনি যিনি সর্বদা আল্লাহ তায়ালার দরবারে দণ্ডায়মান থাকেন।
যে ব্যক্তি নিজের নফসে আম্মারার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়, সে ব্যক্তিই স্বীয় সত্তার পক্ষে বিশেষ কারামতের অধিকারী। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নফসে আম্মারার সাথে যুদ্ধ করে, আল্লাহ তায়ালাকে সেই পায়।
‘এলহাম’ অর্থ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে গায়েবী নির্দেশ প্রাপ্ত হওয়া। আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দগণের গুণাবলীর মধ্যে এ অন্যতম গুণ। ‘এলহাম’ কিছু নয় বলে প্রমাণিত করতে যাওয়া বে-দ্বীনী আলামত।
অন্ধকার রাতে একটি কালো পাথরের উপর একটি কালো বর্ণের পিপীলিকার গতিবিধি যতটুকু গুপ্ত এবং অদৃশ্য, আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব মানুষের নিকট তার চেয়ে অধিক প্রচ্ছন্ন।
মানুষের জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান হওয়া তার জন্য একটি সৌভাগ্য।
পাঁচ ব্যক্তির সংসর্গ হতে সর্বদা দূরে থেক- ক. মিথ্যুক। তাকে সঙ্গী হিসেবে রাখলে তুমি সর্বদাই তার দ্বারা প্রতারিত হবে। খ. আহমক। তার সঙ্গে থাকলে সে তোমার হিত সাধন করতে চাইবে, কিন্তু তাতে তোমার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কেননা সে যা করবে তাতে সে বুঝবে না যে, এতে তোমার ক্ষতি হবে না উপকার হবে। গ. কৃপণ। কেননা সে সর্বদা নিজের লাভের জন্য তোমার ক্ষতিই করতে থাকবে। তোমার সুসময়ে তোমাকে শোষণ করবে আর দুঃসময়ে তোমার সঙ্গ ত্যাগ করবে। ঘ. কাপুরুষ। তার সাহায্যের মুখপেক্ষী হওয়ার সময় তোমাকে সে নিঃসহায় অবস্থায় ফেলে ভয়ে পলায়ন করবে। ঙ. ফাসেক। কেননা, সে একটি মাত্র দেরহামের বিনিময়ে তোমাকে বিক্রয় করে ফেলবে। বরং লোভে পড়ে তার চেয়েও ন্যূনতম স্বার্থের বিনিময়ে তোমার মাথায় বিপদ চাপায়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
আল্লাহ পাক দুনিয়াতেই মানুষকে বেহেশত ও দোযখ অনুভব করার শক্তি দান করেছেন। সুস্থতাই বেহেশত আর অসুস্থতাই দোযখ। নিজের কাজ আল্লাহর হাতে সপর্দ করে দিলে বেহেশতের সুখ পাওয়া যায়, আার নিজের কাজ নাফসে আম্মারার হাতে সোপর্দ করলে দোযখের আযাবের মত আযাব ও অশান্তি ভোগ করতে হয়।

সুলতানুল আরিফীন হযরত আবু ইয়াযিদ বোস্তামী রাঃ

হযরত আবু ইয়াজিদ তাইফুর ইবনে ঈসা বস্তামী ছিলেন, সুলতানুল আরেফীন, সেরাজুস সালেকীন, তত্ত্বজ্ঞানীদের অবলম্বর খলিফাতুল্লাহ, দ্বীনী এলমের অকূল সমুদ্র। আবু ইয়াজিদ হতে পরে তিনি বায়েজিদ নামে প্রসিদ্ধ হন। বস্তামের অধিবাসী বলে তাঁকে বস্তামী বলা হয়।
তিনি তাসাউফ শাস্ত্রের গূঢ়তত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর চেয়ে অধিক জ্ঞানী আর কেহ অতীত হননি। তিনি দুনিয়ার কুতুব ও আওতাদগণের কেন্দ্রস্থল ছিলেন। তাঁর ইবাদত ও রেয়াজত ছিল অতুলনীয়। তাঁর বহু কারামত বই পুস্তকে ও লোকমুখে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। মারেফাতের গূঢ় রহস্য এবং  গোপন তথ্য সমূহের মধ্যে তাঁর দৃষ্টি ছিল প্রখর ও দীপ্তিমান। তিনি সর্বদা আল্লাহ তায়ালার সান্নধ্য এবং ভীতি বিহ্বল মকামে অবস্থান করতেন। মহব্বতের অগ্নিতে দগ্ধিভূত ছিলেন। তিনি সর্বদা হেতকে রিয়াজত ও ইবাদতে এবং মনকে আল্লাহ তায়ালার মহিমা (তাজাল্লীর) অবলোকনে মশগুল রাখতেন। এলমে হাদীসের বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ। এলমে মারেফাত এবং এলমে হাকিকতের জ্ঞানেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। এক কথায় এলমে তরিকতের ক্ষেত্রে তৎকালে নিতিই ছিলেন সর্বেসর্বা।
হযরত জুনাইদ বোগদাদী রাঃ তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, হযরত বায়েজিদের মরতবা আমাদের মধ্যে ঠিক ফেরেশতা জাতির মধ্যে হযরত জিবরাঈল আঃ এর মত। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ হযরত জুনাইদ বোগদাদী রাঃ আরও বলেছেন, তাওহীদের ময়দানে সমস্ত তরিকতপন্থীরা যত দৌড়-ধাপ এবং চেষ্টা চরিতই করুক না কেন হযরত বায়েজিদের প্রাথমিক ও প্রারম্ভস্থান পর্যন্ত পৌঁছেই ক্ষান্ত হয়ে যায়। সেখানেই তারা হয়রান ও আত্মহারা হয়ে গমনে ক্ষান্ত দিয়ে বসে থাকেন। এ থেকে একথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কেহ যদি দুইশত বছর যাবত মারেফাতের বাগানে ভ্রমণ করে, তবে হয়ত সে একটি মাত্র ফুল প্রস্ফুটিত দেখবে, যখন হযরত বায়েজিদের জন্য ততটুকু সময়ে হাজার হাজার ফুল ফুটবে। শায়খ আবু সাঈদ আবুল খায়ের বলেন, আমি আঠার হাজহার আলমে বায়েজিদে পরিপূর্ণ দেখছি, তথাপি তার মধ্যে বায়েজিদকে খুঁজে পাচ্ছি না। অর্থাৎ বায়েজিদ রাঃ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছেন।
হযরত বায়েজিদ রাঃ এর দাদা অগ্নিপূজক ছিলেন। তাঁর পিতা ঈসা রাঃ ইসলাম গ্রহণ পূর্বক বস্তামের বুযুর্গানে দ্বীনের শ্রেণীভুক্ত হয়েছিলেন। হযরত বায়েজিদ রাঃ তাঁর মাতৃগর্ভে থাকা কালেই তাঁর কারামত প্রকাশ পাইতে থাকে। তাঁর মাতা বর্ণনা করেছেন, যে খাদ্য হারাম বা হালাল হওয়া সন্দেহজনক হত, তদ্রুপ কোন খাদ্যের গ্রাস মুখে দেওয়া মাত্র বায়েজিদ আমার উদরের মধ্যে অস্থিরভাবে নড়াচড়া আরম্ভ করত। তা মুখ থেকে ফেলে না দেওয়া পর্যন্ত তার নড়াচড়া বন্ধ হত না। একথার সাক্ষ্য স্বরূপ তাঁর পরবর্তীকালের একটি এরকম- একদিন লোকে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, তরিকতের মধ্যে কোন বস্তু উত্তম? তিনি বললেন, তরিকতের পথে উচ্চ শিখরে উন্নীত হওয়ার সর্বোত্তম বস্তু হল মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সম্পদ। আরজ করা হল- তা যদি কারও ভাগ্যে না ঘটে? তিনি বললেন, তবে দিব্য শক্তিশালী চক্ষু। তারা বলল, যদি তাও কারো ভাগ্যে না হয়? তিনি বললেন, তবে সত্যবাণী শ্রবণকারী কর্ণ। তারা বলল, যদি তাও না হয়? তিনি বললেন, সে ব্যক্তির পক্ষে দীর্ঘ জীবনের চেয়ে অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করা উত্তম।
তাঁর মাতা তাঁকে দ্বীনি এলেম শিক্ষা করতে মক্তবে পাঠালে তিনি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে থাকেন। এক দিন তিনি কুরআন শরীফে সূরা লোকমানে যখন এই আয়াত পাঠ করলেন……………… (আয়াত -১৪) অর্থাৎ- আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার শোকরগুযারী কর এবং নিজের পিতামাতার শোকর আদায় কর। তখন তিনি ওস্তাদ সাহেবকে এই আয়াতটির অর্থ জিজ্ঞাসা করলেন। ওস্তাদ সাহেব আয়াতটির অর্থ তাঁকে বুঝায়ে দিলে তা তাঁর হৃদয়ে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তিনি ওস্তাদ সাহেবের অনুমতি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। মা তাঁকে অসময়ে বাড়ি আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, আম্মা ! আজ কুরআন শরীফে একটি আয়াত পাঠ করলাম, আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আমার শোকরগুযারি কর এবং তোমর পিতামাতারও শোকর গুযারি কর। কিন্তু এক সঙ্গে দুই কূল রক্ষা করা কঠিন কাজ। আমার একার পক্ষে তো উভয় কাজ সম্ভব নয়। হয়ত আপনি আমাকে আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে চেয়ে নেন, যেন আমি এক মনে এক ধ্যানে শুধু আপনারই খেদমত করতে পারি, অথবা আমাকে খোদার নিকট সোপর্দ করে দিন, আমি তাঁরই দরবারে পড়ে থাকি এবং একাগ্র মনে কেবল তাঁরই ইবাদতে মশগুল থাকি। তাঁর মাতা বললেন, বাবা ! আমি তোমাকে খোদার জন্য সোপর্দ করে দিলাম। আমার নিজের হক আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। তুমি খোদারই হয় যাও এবং একাগ্র মনে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে থাক।
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বোস্তাম শহর ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে ১৩৩ জন অলিয়ে কামেলের খেদমতে থেকে জাহেরি বাতেনি এলম হাসিল করেন। অতঃপর শ্যাম দেশের অরণ্যে অনাহারে ও অনিদ্রায় থেকে কঠোর পরিশ্রম সহকারে রিয়াজত ও ইবাদত করেন। তাঁর ওস্তাদ ও শায়খদের মধ্যে হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাঃ ছিলেন অন্যতম। তিনি একদিন হযরত বায়েজিদ রাঃ কে বললেন, উপরের তাক থেকে ঐ কিতাবটি নিয়ে এস। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, কোন তাক থেকে? হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাঃ বললেন, কি আশ্চর্য ! তুমি এত দিন ধরে আমার এখানে রয়েছ, তুমি এখানে তাক দেখনি? তিনি বললেন, না হুজুর ! তাকে আমার কি প্রয়োজন যে, আমি আপনার সামনে মাথা উঁচু করে উপরের দিকে তাকাব? হযরত জাফস সাদেক রাঃ বললেন, বৎস ! ব্যাপার যদি তাই হয়ে থাকে তবে তোমার আর এখানে কাজ নেই, তোমার কাজ পূর্ণ হয়েছে, তুমি এখন বোস্তামে চলে যাও।
হযরত বায়েজিদ রাঃ একবার লোকমুখে শুনতে পেলেন যে, অমুক স্থানে একজন কামেল বুযুর্গ লোক অবস্থান করছেন। তিনি তাঁর সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে গমন করে নিকটবর্তী হলে দেখতে পেলেন যে, উক্ত বুযুর্গ লোক কেবলার দিকে থুথু ফেলছে। হযরত বায়েজিদ রাঃ মুহূর্তকাল সেখান বিলম্ব না করে ফিরে আসলেন এবং মনে মনে বলতে লাগলেন, এই ব্যক্তি সঙ্গে তরিকতের কোন সম্পর্ক নেই। তরিকতের পথে পা রেখে থাকলে কখনও শরিয়তের বরখেলাপ কার্য করত না। শ্র“ত রয়েছে, হযরত বায়েজিদ রাঃ এর বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত চল্লিশ কদমের ব্যবধান ছিল। তিনি মসজিদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার্থে পথে কখনও থুথু ফেলেননি।
হজ্বের উদ্দেশ্যে তিনি বার বছরে কাবা শরীফে পৌঁছেছিলেন। কয়েক কদম চলার পরই জায়নামাজ বিছায়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন এবং বলতেন, এটা দুনিয়ার বাদশাহের ‘দহলিজ’ নয় যে, একবারে সেখানে যেয়ে পৌঁছতে পারি। তিনি কাবা শরীফে পৌঁছে সেখানকার কাজ সমাধা করে দেশে ফিরে আসলেন। সেবারে মদিনা শরীফ গেলেন না। বললেন, অন্য কাজে এসে উদ্দেশ্যবিহীনভাে সরওয়ারে দো-আলমের জিয়ারত করা আমি শক্ত বে-আদবী বলে মনে করি। আমি বাড়ি থেকে পৃথকভাবে তাঁর জেয়ারতের নিয়ত করে বের হব। পরবর্তী বছর কেবল হুজুর সাঃ এর জেয়ারতের উদ্দেশ্যে শহরের বাইরে পৌঁছলে সংবাদ পেয়ে বহু লোক তাঁর সহযাত্রী হওয়ার জন্য তাঁর পিছনে এসে সমবেত হল। হঠাৎ তিনি পিছনের দিকে তাকায়ে দেখতে পেলেন, বহু লোক তাঁর পিছনে চলছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কারা? লোকেরা বলল, তারা সকলে আপনার সঙ্গে মদিনা শরীফ যাচ্ছে। তা শুনে তিনি হাত উঠায়ে আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ ! আমি মিনতি সহকারে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনি আপনার ও আমার মাঝখান থেকে মানুষের পর্দা উঠায়ে দিন। অতঃপর তিনি তাঁর প্রতি লোকের অন্তর থেকে মহব্বত ও ভক্তি দূরীকরণের উদ্দেশ্যে এবং লোকের শোরগোলে তাঁর পথের অসুবিধা দূর করার জন্য এক উপায় অবলম্বন করলেন। তিনি ফজরের নামাজ শেষ করে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে এই আয়াতটি পড়লেন, ………………………… অর্থ- আমি খোদা, আমি ভিন্ন অন্য কোন উপাস্য নেই। অতএব, তোমরা সকলে আমার ইবাদত কর। লোকেরা তাঁর কথা শুনে বলল, এই লোকটি পাগল হয়ে গেছে। এই বলে তারা সকলে তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেল। প্রকৃতপক্ষে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ আয়াতটি পাঠ করে আল্লাহ তায়ার বাণী উদ্ধৃত করেছেন মাত্র।
হযরত জুন্নুন মিছরী রাঃ হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ এর কাছে নিজের এক মুরিদকে পাঠালেন এবং বলে দিলেন যে, তাঁকে বলিও, হে বায়েজিদ সারারাত্র অরণ্যে নিদ্রায় বিভোর থেকে আরাম উপভোগ করছ, এদিকে কাফেলা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। লোকটি হযরত জুন্নুন মিছরী রাঃ এর এই পয়গাম হযরত বায়েজিদ রাঃ এর হাতে পৌঁছালে তিনি উত্তরে বললেন, জুন্নুন মিছরী রাঃ কে গিয়ে বল, কামেল সেই ব্যক্তি যিনি সারারাত্র শুয়ে আরামে ঘুমান, কিন্তু ভোরে উঠে কাফেলার আগেই গন্তব্যে উপস্থিত হন। হযরত জুন্নুন মিছরী রাঃ একথা শুনে খুব রোদন করলেন এবং বললেন, তা তাঁর জন্য মোবারক হোক।
একবার তিনি হজ্বে যাওয়ার সময় তাঁর ও তাঁর মুরিদদের সমস্ত মাল-পত্র একটি উট বোঝাই করে যাচ্ছিলেন। তা দেখে এক পথিক বলল, এই নিরীহ উটটির উপর বড় ভারি বোঝা চাপান হেয়েছে, এ অত্যন্ত জুলুম করা হচ্ছে। হযরত বায়েজিদ রাঃ তা শুনে বললেন, এসমস্ত বোঝা উটটি বহন করছে না। একটু ভাল করে লক্ষ্য করে দেখ। বোঝাগুলো উটের পিঠে আছে না অন্য কোথাও? সে মাথা নিচু করে ভালকরে দৃষ্টি করে দৃষ্টি করে দেখল যে, বোঝা উটের পিঠ থেকে প্রায় এক হাত উঁচুতে রয়েছে। তা দেখে সে বলে উঠল, ‘সুবহানাল্লাহ’ এ তো বড় আশ্চর্যজনক ব্যাপার। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, আমি যদি নিজের অবস্থা তোমাদের কাছে গোপন রাখি তবে তোমরা নিন্দাবাদ করতে থাক। আর যদি প্রকাশ করি তোমার তা বরদাশত করতে পার না। আমি ভেবে স্থির করতে পারছি না, তোমাদের সঙ্গে এমতাবস্থায় কি করা উচিত?
অতঃপর মদিনা শরীফের কাজ শেষ হলে ভাবলেন, এখন এখন একবার মায়ের খেদমতে যাওয়া উচিত। সুতরাং বোস্তাম অভিমুখে যাত্রা করলেন। এই সংবাদ অবগত হয়ে বোস্তাম শহরের অধিবাসীরা দলে দলে তাঁর অভ্যর্থনার জন্য শহর থেকে বহু দূরে অগ্রসর হল। তিনি এই বিরাট জনতার সমাগম দেখে ভাবলেন আমি তাদের মনস্তুষ্টির জন্য তাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করলে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য থেকে বহু দূরে সরে পড়ব। কাজেই এমন কোন উপায় বের করা দরকার যাতে আমার প্রতি তাদের ধারণা পাল্টে যায়। তখন ছিল রমজান মাস। তারা যখন হযরত বায়েজিদ রাঃ এর নিকটবর্তী হল, তিনি রোজা রাখা সত্ত্বেও, নিকটবর্তী এক রুটির দোকান থেকে রুটি নিয়ে খাইতে আরম্ভ করলেন। অভ্যর্থনাকারীরা তা দেখে তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে চলে গেল। অতঃপর তিনি নিজের মুরিদদের বললেন, তোমরা দেখলে তো আমি শরিয়তের একটি মাসয়ালা অনুযায়ী আমল করলাম। (অর্থাৎ- মুসাফিরের সফরের অবস্থায় রমজানের রোজা রাখা ওয়াজিব নয়। রোজা না রেখে পরে কাযা করতে পারে, অবশ্য পারলে রোজা রাখাই ভাল। এক্ষেত্রে হযরত বায়েজিদ রাঃ নিজেকে লোক চোখে হেয় করার জন্য সফরের অবস্থায় রমজানের রোজা ভঙ্গ করলেন। তা শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ বটে। সুতরাং এই রোজা ভাঙ্গার জন্য তিনি গোনাহগার হবেন না।) রমজানের রোজা পালন না করার জন্য লোকেরা তাঁকে ‘মরদুদ’ ভেবে চলে গেল। যাহোক তিনি খুব ভোরে গৃহদ্বারে পৌঁছলেন। কান পেতে শুনতে পেলেন, ঘরের ভেতরে তাঁর মা অজু করতে করতে এই দোয়া করছে, এলাহী ! আমার সেই মুসাফির পুত্রকে নিরাপদে রেখ, তাঁর প্রতি বুযুর্গানে দ্বীনের অন্তর সন্তুষ্ট রেখ। আর তাঁকে উত্তম হাল দান কর। হযরত বায়েজিদ রাঃ এ সমস্ত দোয়া শুনে খুব রোদন করলেন। তারপর দ্বারে করাঘাত করলে তাঁর মা ভিতর থেকে শব্দ করলেন, কে? হযরত বায়েজিদ বললেন, আপনার মুসাফির পুত্র। তা শুনে তাঁর মা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ায়ে এসে দরজা খুলে দিলেন এবং বললেন, তাইফুর ! এত বিলম্ব কেন করলে? তোমার বিচ্ছেদ যাতনায় কাঁদতে কাঁদতে আমার দুই চোখ দৃষ্টি শক্তি হারায়ে ফেলেছে। তোমার বিচ্ছেদ ব্যথায় আমার পিঠ কুঁজো হয়ে পড়েছে। হযরত বায়েজিদ বললেন, যে কাজটিকে আমি সকলের পশ্চাতে মনে করতাম, তাই সকলের আগে প্রকাশ পেল। তা হচ্ছে আমার প্রতি মায়ের সন্তোষ।

হযরত বায়েজিদ রাঃ বলতেন, ইবাদত, রিয়াজত এবং সফরে কষ্ঠ করে যে বস্তুর অন্বেষণ করতেছিলাম, তা শুধু আমি এতে হাসিল করেছি যে, একরাতে আমার মাতা আমার কাছে পানি পান করতে চাইলেন। আমি দেখলাম কলসীতে পানি নেই। তৎক্ষণাৎ আমি কলসী নিয়ে নদী থেকে পানি আনতে গেলাম। পানি এনে দেখলাম মা ঘুমায়ে পড়েছে। এদিকে কন্কন্ েশীত। আমি পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এই দারুণ শীতেই তাঁর মাথার কাছে দাঁড়য়ে থাকলাম। শীতের প্রকোপে আমার হাত গ্লাসের সাথে জড়ায়ে গিয়েছিল। পানিও বরফের মত হয়ে গিয়েছিল। আমার মা জাগ্রত হয়ে পানি পান করলেন এবং আমাকে খুব দোয়া করলেন। বললেন, তুমি পানির গ্লাসটি নামায়ে রাখলে না কেন? আমি আরজ করলাম আম্মা ! আমার আশঙ্কা হল, আমি যদি গ্লাসটি নামায়ে রেখে অন্যত্র চলে যাই, তবে হয়ত আপনি জেগে পানি চাইবেন এবং আমি অনুপস্থিত থাকার কারণে আপনাকে পানি দিতে পারব না। এই ভয়ে আমি পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়ায়ে ছিলাম।
তিনি মক্কা শরীফ থেকে ফেরার পথে যখন হামাদানে পৌঁছলেন, সেখান থেকে কিছু কুসুম ফুলের বীজ ক্রয় করে চাদরের এক কোণে বেধে নেন। বাড়ি এসে চাদরের কোণের গিরা খুললে তার মধ্য থেকে কয়েকটি পিপড়া বের হয়ে পড়ল। তা দেখে তিনি বললেন, বড় আফসোসের বিষয়, আমি এই পিপড়াগুলোকে স্থান ও দলচ্যুত করে ফেললাম, তাদের বড় কষ্ট হবে। তৎক্ষণাৎ তিনি পিপড়াগুলোকে পূর্ববৎ বেঁধে হামাদানে রেখে আসলেন। বস্তুতঃ কেহ আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনে হযরত বায়েজিদের মত এত চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি এবং আল্লাহর সৃষ্ট জীবের প্রতি এমন চরম স্তরে অনুগ্রহ ও দয়া প্রদর্শন করতে সক্ষম হননি।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, আমার নফসের মলিনতা দূর করে তার সংশোধন কাজ আমি বার বছর ধরে লৌহকাররূপে কাজ করেছি। নফসকে রিয়াজত ও সাধনার অগ্নিকুণ্ডে ফেলে ‘মুজাহাদা’ অর্থাৎ, কঠোর পরিশ্রমের আগুনে উত্তপ্ত করে মালামত ও তিরস্কারের হাতুড়ি দিয়ে পিটাতে থাকি। এই উপায়ে শেষ পর্যন্ত আমি নফসের যাবতীয় মলিনতা দূর করে তাকে আয়নার মত পরিষ্কার ও স্বচ্ছ করতে সক্ষম হই। প্রথমে নফসকে আয়নার মত গঠন করতেই আমার পাঁচ বছর কেটে যায়, এই সময় আমি নানাবিধ ইবাদত বন্দেগীর রেত দ্বারা তাকে মার্জিত করে নেই। পরে এক বছর ধরে তাতে গভীর দৃষ্টিপাত করে দেখলাম, আমার কোমরে নিজের ইবাদত ও আমলের প্রতি ভরসাজনিত অহংকার ও আত্মতৃপ্তির পৈতা জড়ান রয়েছে। অতঃপর আরো পাঁচ বছর ধরে ইবাদত, চেষ্টা ও সাধনার দ্বারা সেই পৈতা ছিড়ে ফেলতে সক্ষম হই। তখন যেন নতুনভাবে মুসলমান হলাম। অতঃপর দুনিয়ার মানুষদের প্রতি দৃষ্টি করে দেখলাম, সকলেই মৃত। এবার আমি চার তাকবিরের সাথে তাদের জানাজা পড়ে নিজ কর্তব্য পালনে মনোনিবেশ করলাম এবং অবশেষে বিনা বাধায় আল্লাহ পাকের সাথে মিলিত হলাম।
একবার তিনি কাবা শরীফে হজ্বের উদ্দেশ্যে গৃহ থেকে বের হয়ে কয়েক মঞ্জিল গিয়ে গৃহে ফিরে আসলেন। লোকেরা তাঁকে বলল, আপনি তো কখনও সংকল্প পরিবর্তন করেননি? আজ আপনার কি হল? হজ্ব যাত্রা করে অর্ধেক পথ থেকে ফিরে আসলেন? তিনি বললেন, আমি পথ চলতে চলতে কিছুদূর পর দেখলাম এক কৃষ্ণকায় যুবক মুক্ত তরবারী হাতে আমার পথ রোধ করে দাঁড়ায়ে রয়েছে। সে আমাকে বলল, নিজের মঙ্গল চাও তো বাড়ির দিকে ফিরে যাও। অন্যথায় আমি এই তরবারী দিয়ে এখনই তোমাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলব এবং সে বলল, ……………………… অর্থাৎ- তুমি আল্লাহ তায়ালাকে বোস্তামে রেখে খানায়ে কাবায় হজ্বের এরাদা করছ। একথা শুনে আমি বাড়িতে ফিরে এসেছি।
একবার হজ্বে যাত্রার পথে এক ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হল। লোকটি তাঁকে জিজ্ঞেসা করল, কোথায় যাচ্ছেন? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, হজ্বে যাচ্ছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাছে কি আছে? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, দুইশত দেরহাম। তিনি বললেন, তা আমাকে দিয়ে দিন। আমি একজন বহু পরিজনবিশিষ্ট লোক। আপনার মুদ্রাগুলো আমাকে দিয়ে আমার চারপাশে সাত বার প্রদক্ষিণ করুন। তাতেই আপনার হজ্ব সমাধা হয়ে যাবে। হযরত বায়েজিদ রাঃ তাই করলেন। অতঃপর লোকটি দেরহামগুলো নিয়ে চলে গেল।
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ যখন মারেফাত ও খোদাতত্ত্বজ্ঞানে উচ্চতর শিখরে আরোহণ করলেন এবং তাঁর উক্তিসমূহের তাৎপর্য ব্যর্থ দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের বোধগম্য হচ্ছিল না, তখন সাতবার তারা তাঁকে বোস্তাম শহর থেকে বের করে দিয়েছিল। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে শহর থেকে কেন বের করছ? তারা জবাব দিল, তুমি একজন খারাপ লোক। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, সেই শহরটি খুবই উত্তম, যেখানকার নিকৃষ্টতম লোক বায়েজিদ।
একদিন হযরত বায়েজিদ রাঃ একটি লাল রং এর সুন্দর পাকা ফল হাতে নিয়ে খুব আগ্রহের সাথে তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, কেমন লতীফ (সুন্দর ও মনোরম) ফল? তৎক্ষণাৎ গায়েব থেকে আওয়াজ আসল, হে বায়েজিদ! ফলের সঙ্গে তুমি আমার নাম (লতীফ) যোগ করতেছ, তোমার লজ্জা হয় না? এই অপরাধে ৪০ দিন পর্যন্ত তাঁর অন্তর থেকে আল্লাহ তায়ালার নাম ভুলায়ে দেয়া হল। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, তা দেখে তৎক্ষণাৎ আমি শপথ করলাম যে, জীবনে আর কখনও বোস্তাম শহরের কোন ফল খাব না।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, একদিন আমি বসে বসে ভাবতেছিলা, আমি বর্তমান জামানার শ্রেষ্ঠ পীর এবং এই জামানার কুতুব। পরক্ষণে একটু চিন্তা করে আমি বুঝতে পারলাম যে, এরূপ কল্পনা মনে স্থান দিয়ে আমি বড়ই ভুল করেছি। তৎক্ষণাৎ আমি সেখান থেকে উঠে খোরাসান অভিমুখে যাত্রা করলাম। পথিমধ্যে এক মঞ্জিলে উপস্থিত হয়ে আমি কসম করলাম যে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ পাক কোন একজন কামেল লোককে এখানে পাঠায়ে আমার প্রকৃত অবস্থা আমাকে জানায়ে দেন, সে পর্যন্ত আমি আর সম্মুখের দিকে অগ্রসর হব না। এভাবে সেখানে আমি তিন দিন তিন রাহ্র কাটায়ে দিলাম। চতুর্থ দিন সকালে দেখলাম, উটের পিঠে কানা ও অপরিচিত একজন লোক আমার দিকে আসছে, নিকটে আসলে লোকটির প্রতি ভাল করে দৃষ্টি করলাম। মনে হল লোকটি আমার প্রিয়। মহব্বতের বহু আলামত তাঁর মধ্যে দেখা গেল। তাঁর উট আমার সামনে আসার পূর্বেই চলন্ত অবস্থায় আমি থামার জন্য ইশারা করলাম, তৎক্ষণাৎ উটটির পা মাটিতে আটকায়ে গেল। তখন আগন্তুক লোকটি তীক্ষè দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়ে বললেন, আমায় উত্তেজিত করে তুমি এই কামনা কর যে, আমি আমার বন্ধ চক্ষু খুলে খোলা চক্ষুটি বন্ধ করি এবং সমগ্র বস্তাম ও তার অধিবাসীবৃন্দকে বায়েজিদ সহ ডুবায়ে দেই? একথা শুনে আমার জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাওয়ার উপক্রম হল। আমি অতি কষ্টে নিজেকে সামলায়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথা থেকে তসরিফ এনেছেন? তিনি উত্তর করলেন, তুমি যখন আল্লাহর নামে কসম করেছ যে, এস্থান থেকে নড়বে না, তখন আমি এখান থেকে তিন হাজার ক্রোশ দূরে ছিলাম। তৎক্ষণাৎ আমি তথা থেকে এদিকে যাত্রা করি এবং তিন দিন পর এখানে পৌঁছেছি। অতঃপর তিনি বললেন, সাবধান বায়েজিদ ! অন্তরের হেফাযত কর এবং তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখ। এই বলে তিনি আমার দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরালেন এবং অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
হযরত বায়েজিদ রাঃ ৪০ বছর যাবত এক মসজিদে অবস্থান করেন। মসজিদে ইবাদতের জন্য তাঁর পৃথক কাপড়, ঘরে সাধারণ ব্যবহারের জন্য পৃথক এবং অজু-গোসলের জন্য পৃথক কাপড় ছিল। এই চল্লিশ বছর তিনি কখনও মসজিদ এবং মুসাফিরখানার দেয়াল ব্যতিত অন্য কোন দেয়ালের গায়ে পিঠ লাগায়ে বিশ্রাম করেননিÑ বিছানায় শুয়ে শয়ন করা তো দূরের কথা। অবশ্য কখনও কখনও মসজিদের দেয়ালে অল্প সময়ের জন্য পিঠ লাগায়ে বিশ্রাম করতেন।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলতেন, মুনষ যে খাদ্য খেয়ে থাকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত আমি সে খাদ্য আহার করিনি। আমার খাদ্র আলমে গায়েব থেকে নির্দিষ্ট ছিল। তিনি আরো বলেছেন, আমি চল্লিশ বছর পর্যন্ত নিজ অন্তঃকরণকে কড়া পাহারায় রেখেছি। অতঃপর আমি অন্তরের প্রতি দৃষ্টি করে আমার দাসত্ব এবং আল্লাহ পাকের প্রভুত্ব উভয় বস্তুকে খোদার তরফ থেকে দেখতে পেলাম। তিনি আরো বলেছেন, আমি ত্রিশ বছর আল্লাহ তায়ালাকে অন্বেষণ করে বেড়িয়েছি। সবশেষে দৃষ্টি করে দেখলামÑ আল্লাহ তায়ালাই অন্বেষণকারী আর আমি অন্বিত (বাঞ্ছিত)। তিনি এও বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে ও জিকির-ফিকিরে আমার উপর পূর্ণ ত্রিশ বছর অতীত হয়ে গেল, তথাপি আজও আমার অবস্থা এই যে, যখনই আমি আল্লাহ তায়ালার পবিত্র নাম মুখে আনতে চেষ্টা করি, তখনই আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য করে নিজের মুখ ও জিহ্বাকে তিনবার পানি দিয়ে ধৌত করি।

আবু মুসা রাঃ হযরত বাযেজিদ রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, এই তরিকতের পথে আপনি সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ কি দেখেছেন? তনি বললেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে নফসকে খোদার দরবারে নিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সে খুব ক্রন্দন করত এবং যেতে চাইত না। অতঃপর যখন আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে তাওফীক আসল, তখন সেই নফসই এমন হয়ে গেল যে, সে নিজেই আমাকে আল্লাহ তায়ালার দরবারের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল এবং আমার প্রতি হাস্য করতে লাগল। অবশেষে তিনি এমন উন্নত স্তরে পৌঁছলেন যে, যা কিছু তাঁর মনে উদয় হত তৎক্ষণাৎ তা প্রকাশও পেত। আর যখন তিনি মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করতেন, তখন তাঁর প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে প্রস্রাবের পরিবর্তে রক্ত বের হত।
হযরত আবু তোরাব বখশী রাঃ এর এক মুরিদ তরিকতের পথে একটু উগ্র স্বভাব এবং ওয়াজদ ও হালের প্রভাবে প্রভাবান্বিত থাকতেন। আবু তোরাব রাঃ সর্বদা তাঁকে পরামর্শ দিতেন যে, এই উগ্র স্বভাব দমনের জন্য কিছুকাল হযরত বায়েজিদ রাঃ এর সংসর্গে তোমার থাকা উচিত সে একদিন উত্তর করল, যে ব্যক্তি প্রত্যহ বাযেজিদের খোদাকে শতবার দর্শন করে থাকে বায়েজিরেদ সংসর্গে তার কি ফল হবে? তা শুনে হযরত আবু তোরাব রাঃ বললেন, তুমি তোমার অবস্থা ও ক্ষমতার অনুরূপই আল্লাহ পাকের দর্শন লাভ করে থান। যদি হযরত বায়েজিদ রাঃ এর সংসর্গে থেকে তছার তাওয়াজ্জুহর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার দর্শনর লাভ করতে পার, তবে সেই দর্শন হবে অন্য ধরনের। আর একথাও স্মরণ রেখ যে, দর্শনে দর্শনেও বড় পার্থক্য হয়ে থাকে। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ পাক শুধু হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাঃ এর জন্য স্বতন্ত্রভাবে একবার তাজাল্লী প্রকাশ করবেন এবং সমগ্র মানবকুলের জন্য একবার। এই কথাটি মুরিদের মনে ক্রিয়া করল। সে বলল, তবে উঠুন আমরার দুজনেই তাঁর খেদমতে যাই। অতঃপর তাঁরা উভয়ে বোস্তামে গেলেন। তখন হযরত বায়েজিদ রাঃ ঘরে ছিলেন না। তিনি পানি আনতে গিয়েছিলেন। তাঁরা উভয়ে তাঁর খোঁজে বের হলেন। কিছুদূর অগ্রসর হতেই দেখলেন, হযরত বায়েজিদ রাঃ এক হাতে একটি পানির কলসী এবং অপর হাতে একটি ছেঁড়া ও পুরাতন চামড়ার চাদর নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। আবু তোরাব রাঃ এর উক্ত মুরিদের উপর হযরত বায়েজিদ রাঃ এর দৃষ্টি পতিত হতেই তাঁর কম্পন আরম্ভ হল। এমনকি কাঁপতে কাঁপতে সে ধরাশয়ী হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর প্রাণবায়ু বের হয়ে গেল। হযরত আবু তোরাব রাঃ এই দেখে বললেন, হযরত ! এক দৃষ্টিতেই বেচারার কর্ম শেষ করে দিলেন ? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, হে আবু তোরাব! এই যুবকটির মূল স্বভাবের মধ্যে একটি অতি সুক্ষè প্রশ্ন উকি-ঝুঁকি মারছিল, যার তথ্য তার অন্তরে এযাবৎ প্রকাশিত হয়নি। বায়েজিদের দর্শন লাভের সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ সেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বেচারা সেই আকস্মিক সমাধানের আঘাত সইতে না পেরে নিজের প্রাণকে আল্লাহ পাকের হাতে সমর্পণ করে দিয়েছে। মিসরের রমণীদেরও ঠিক এইরূপ ঘটনাই ঘটেছিল। তারা হযরত ইউসুফ আঃ এর রূপের ছটা বরদাশত করতে না পেরে একেবারে নিজেদের হাতই কেটে ফেলল। কেননা, ইতিপূর্বে তারা হযরত ইউসুফের এই অনুপম রূপ লাবণ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল।
হযরত ইয়াহইয়া মা’আয় রাযী রাঃ একবার হযরত বায়েজিদ রাঃ কে পত্রে লিখলেন, আমি আর আপনি উভয়ই যদি বেহেশতি হই, তবে বেহেশতের ‘তুবা’ বৃক্ষের ছায়ায় বসে আপনার সঙ্গে কিছু গোপন কথা বলব। সেই চিঠির খামের ভিতরে এক টুকরা রুটিও দিলেন এবং বাহককে বলে দিলেন, তুমি হযরত বায়েজিদ রাঃ কে এই রুটির টুকরাটিও খাইতে বল। এটা যমযম কূপের পানি দ্বারা ছেনে তৈরী করা হয়েছে। হযরত বায়েজিদ রাঃ চিঠির জবাবে লিখলেন, যেখানে আল্লাহ তায়ালার স্মরণ বিদ্যমান, সেখানে তুব কৃক্ষ এবং বেহেশত উভয়ই বিদ্যমান রয়েছে। আর সেই গোপন রহস্যেরও জবাব লিখলেন যে, আমি আপনার প্রেরিত এই রুটি খাব না। কেননা আপনি বলেছেন যে, এটার আটা যমযমের পানি দিয়ে ছানা হয়েছে। কিন্তু এটা বলেননি যে, যে বীজ থেকে এই রুটি প্রস্তুত হয়েছে তা কি প্রকারে কোথা থেকে পাওয়া গেছে। এই উত্তর পেয়ে হযরত বায়েজিদ রাঃ কে দেখার জন্য হযরত ইয়াহইয়া মা’আযের মনে খুব আগ্রহ হল। তাঁর দর্শন লাভের উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করলেন। এশার নামাজের পর তাঁর বাড়ি পৌঁছে ভাবলেন, রাতে তাঁকে কষ্ট দেয়া সমীচীন হবে না। সুতরাং ভোর পর্যন্ত বাইরে থাকেলন। ভোর হলে শুনতে পেলেন যে, হযরত বায়েজিদ রাঃ কবরস্তানে খোদার ইবাদতে মশগুল আছেন। সুতরাং তিনিও কবরস্তানের দিকে গমন করলেন। সেখানে হযরত বায়েজিদ রাঃ কে দেখলেন দুই পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর ভর করে দণ্ডায়মান আছেন। এও জানতে পারলেন যে, সন্ধ্যা থেকেই এইরূপে দাঁড়ায়ে ইবাদত করছেন। হযরত ইয়াহইয়া মা’আয রাঃ তা দেখে খুব বিস্মিত হলেন এবং নীরবে দাঁড়ায়ে দেখতে লাগলেন।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলিয়াছেন, একরাতে আমি একখানি তালিযুক্ত চাদর গায়ে দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে শায়িত ছিলাম। এই অবস্থায় হঠাৎ আমার গোসলের আবশ্যক হয়ে গেল। সেই রাত্রে শীতও খুব বেশি ছিল। আমি গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করতে ইচ্ছা করলাম কিন্তু নফস গড়িমসি করতেছিল। সে পরামর্শ দিতেছিল, একটু সবর কর। সূর্য উদিত, তখন গোসল করলে শীতে কষ্ট পাবে না, বেশ আরাম লাগবে। আমি যখন নফসের অনিচ্ছা ও গড়িমসি দেখতে পেলাম যে, নফসের পরামর্শমত চললে নামাজ কাযা হয়ে যাবে। অতএব তালিযুক্ত ছেঁড়া চাদরটিকে অমনি বরফ সহ ভাঁজ করে রেখে গোসল করলাম। অতঃপর সেই ভাঁজ করা চাদরখানি গায়ে জড়ায়ে বসে রইলাম। এমন কি, সম্পূর্ণ চাদরখানির উপর বরফ জমে গেল, ন্তিু আমি তাকে নিজের শরীর থেকে পৃথক করলাম না। অতঃপর যখন সূর্য উদিত হল তখন সূর্যের উত্তাপে বরফ গলে গেল এবং চাদর ক্রমশঃ শুকায়ে গেল। সেইদিন থেকে সমস্ত শীত ঋতু এই কাজটি আমার নিত্যকর্মরূপে স্থির করলাম।
একদিন হযরত বায়েজিদ রাঃ মুরিদগণসহ একটি সঙ্কীর্ণ গলি পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন, বিপরীত দিক থেকে একটি কুকুর আসছে। তিনি সঙ্গীদেরসহ পশ্চাৎ দিকে ফিরে এসে কুকুরের জন্য পথ ছেড়ে দিলেন। এই ব্যাপার দেখে তাঁর এক মুরিদের মনে প্রশ্ন জাগল যে, আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে তো সৃষ্টির সেরা করেছেন, মানুষের এই মযৃাদা এবং আমরা একদল খাঁটি মুরিদ তাঁর সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও শায়খুল আরেফীন এটা কি কাজ করলেন ! তিনি যেন কুকুরটিকে আমাদের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন। এটা এক অভাবনীয় কাজ। এমন কি সাধারণ জ্ঞানের বিরোধী আর কুরআন-হাদিসেরও বিরোধী। হযরত বায়েজিদ রাঃ উক্ত মুরিদের মনের সন্দেহ বুঝতে পেরে বললেন, বৎস ! এই কুকুরটি স্বীয় অবস্থার ভাষায় আমাকে বুঝােেয় দিল যে, বলুন তো আদি সৃষ্টি কালে আমার দ্বারা এমন কোন ত্র“টি সাধিত হয়েছিল ,ে আল্লাহ পাক আমাকে কুকুররূপে সৃষ্টি করলেন? আর আপনর দ্বারা কোন বুযুর্গী ও মর্যাদা চিহ্ন প্রকাশিত হয়েছিল যে, আপনাকে সুলতানুল আরেফীনের জামা পরালেন? আমি চিন্তা করে এই প্রশ্নের কোনই উপযুক্ত উত্তর খুঁজে না পেয়ে পেরেশান হয়ে পড়লাম। অবশেষে আমার মনে উদয় হল, প্রকৃতপক্ষে কুকুরেরও তখন কোন ত্র“টি ছিল না এবং আমারও কোন যোগ্যতা বা মর্যাদা ছিল না। এটা শুধু আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ ও দয়া। অন্যথায় সে এবং আমি আদি সৃষ্টিকালে উভয়েই তো সমান। এই চিন্তা করে আমি তাকে পথ ছেড়ে দিলাম।
বস্তাম শহরের বুযুর্গানে দ্বীনের মধ্য থেকে এক সংসারত্যাগী যাহেদ জনসমাজের খুব প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তিনি হযরত বায়েজিদ রাঃ এর দরবার থেকে কখনও অনুপস্থিত থাকতেন না। একদিন তিনি হযরত বায়েজিদ রাঃ কে বললেন, হযরত ! আমি ত্রিশ বছর যাবত দিনের বেলায় রোজা রাখছি এবং রাতে ইবাদত করছি। কিন্তু আপনি আমাকে যে এলম শিক্ষা দিয়েছেন, আজ পর্যন্ত আমি সেই এলমের কোন ফলাফল নিজের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। অথচ আমি এই এলমে সত্য বলেই বিশ্বাস করি এবং ভালবাসি। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, তুমি যদি তিনশত বছর ধরেও দিনে রোজা রাখ এবং রাতে ইবাদত কর, তবুও তুমি এইরূপ থাকবে, যেমন তুমি রয়েছ। সে বলল, কেন? তিনি বললেন, এই যে, তুমি তোমার নফসের কতগুলো পর্দার অন্তরালে পড়ে আছ। দরবেশ বললেন, এই পর্দা দূর করার কোন উপায় আছে কি? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, হ্যাঁ আমার কাছে এর উপায় আছে, কিন্তু আমি তোমাকে সেই উপায় বলে দিলে তুমি পালন করবে না। সে বলল, হ্যাঁ, আমি অবশ্যই পালন করব। কেননা বহু বছর ধরে আমি এর উপায় অন্বেষণ করছি। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, আচ্ছা, তবে যাও, এখনই দাড়ি, গোঁফ ও মাথা মুড়ায়ে ফেল, পরিধানের এই কাপড় খুলে কোমরে কম্বল জড়াও এবং যেই মহল্লার লোকে তোমাকে বেশি চিনে সেই মহল্লায় প্রকাশ্য সড়কের উপর গিয়ে বস। আর আখরোট দ্বারা একটি থলে পূর্ণ করে নিয়ে ছেলেপেলেদের ডেকে নিজের কাছে একত্রিত কর এবং ঘোষণা কর, যে ব্যক্তি আমাকে একটি ধাক্কা মারবে আমি তাকে একটি আখরোট দিব, দুইটি ধাক্কা মারলে দুইটি আখরোট দিব। অতঃপর সমগ্র শহরে ঘুরতে থাক, যেন ছেলেরা তোমাকে ধাক্কা মারতে থাকে। এইরূপে যেখানে দেখবে তোমার অসম্মান ও অপমান অধিক হচ্ছে সেখানেই অবস্থান কর। এটাই তোমার পর্দা দূরীকরণের শ্রেষ্ঠ উপায়। দরবেশ লোকটি একথা শুনে বলে উঠল, …………… আল্লাহ তায়ালা পবিত্র, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, এই পবিত্র কোন কাফের ব্যক্তি উচ্চারণ করলে সে ঈমানদার হয়ে যেত কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই কলেমাটি উচ্চারণ করে তুমি মুশরিক হয়ে গেলে। সে বলল, কেমন করে আমি মুশরিক হয়ে গেলাম? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, এই কালেমা উচ্চারণ করে তুমি নিজের বুযুর্গী প্রকাশ করেছ, আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা করনি। লোকটি বলল, আপনি আমাকে যে উপায় বলে দিলেন তা পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, আমি তোমাকে যে উপায় বলে দিয়েছি, তাই তোমার একমাত্র ঔষধ। একথা তো আমি তোমাকে প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম যে, তুমি আমার নির্দেশিত পন্থায় চলবে না।
একরাতে হযরত বায়েজিদ রাঃ এর মন কোন ইবাদত বন্দেগীতে বসছিল না এবং তিনি ইবাদতে স্বাদ পাচ্ছিলেন না। তিনি খাদেমকে ডেকে বললেন, খুঁজে দেখ ত ঘরে কি বস্তু আছে? সে তালাশ করে দেখতে পেল এক গুচ্ছ আঙ্গুর ফল মজুদ আছে। হযরত বায়েজিদ রাঃ কে তা জানালে তিনি বললেন, কাউকে দান করে দাও, আমার ঘর ফলের দোকান নয়। আঙ্গুরগুলো দান করা মাত্র তাঁর অন্তরে আল্লাহ তায়ালার নূরের ঝর্ণা নেমে এল। তাঁর অন্তর ইবাদতের স্বাদে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
হযরত বায়েজিদ রাঃ এর বাড়ির পাশে এক অগ্নিপূজক বাস করত। একবার সে কয়েকদিনের জন্য কোথাও সফরে গিয়েছিল। তার আর্থিক অবস্থাও তত স্বচ্ছল ছিল না। তার একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিল। শিশুটি রাতে অন্ধকার ঘরে খুব চিৎকার করে ক্রন্দন করত। কেননা অগ্নিপূজকের স্ত্রী অভাবের দরুন রাতে ঘরে প্রদীপ জ্বালায়ে রাখার ব্যবস্থা করতে পারত না। তা দেখে হযরত বায়েজিদ রাঃ প্রতিরাতে তাঁর নিজের ঘরের প্রদীপ নিয়ে অগ্নিপূজকের ঘরে রেখে আসতেন। আলো পেয়ে শিশুটি ক্রন্দন বন্ধ করত এবং সারারাত আরামে কাটাত। অগ্নিপূজক লোকটি সফর থেকে গৃহে ফিরে আসলে তার স্ত্রী হযরত বায়েজিদের ব্যবহার সম্পর্কে তাকে জানালে অগ্নিপূজক ভলল, হযরত বায়েজিদের ন্যায় মহামানবের আলো যখন আমার গৃহে এসেছে, তখন অন্ধকার পথে চলতে থাকা আমার জন্য বড়ই পরিতাপের কারণ হবে। তৎক্ষণাৎ সে হযরত বায়েজিদ রাঃ এর খেদমতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করল।
লোকে কোন এক অগ্নিপূজককে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বললে সে বলল, মুসলমানী যদি এই হয় যা, হযরত বায়েজিদ রাঃ পালন করছেন, তবে এমন মুসলমানী বিধান পালন করার শক্তি আমার নেই, আর যদি মুসলমানী তাই হয়, যা তোমরা সকলে পালন করছ, তবে এমন মুসলমানীর উপর আমার আস্থা নেই।
একদিন হযরত বায়েজিদ রাঃ মুরিদসহ মসজিদে অবস্থান করছিলেন, হঠাৎ তিনি মুরিদগণকে বললেন, উঠ, আমরা সকলে আল্লাহ তায়ালার অলিগণের মধ্য থেকে একজন অলিকে অভ্যর্থনা করতে যাই। দরজায় পৌঁছেই দেখতে পেলেন, হযরত ইবরাহীম হেরাবী রাঃ একটি গাধায় চড়ে এদিকে আসছেন। হযরত বায়েজিদ রাঃ তাঁকে বললেন, আমার প্রতি এলহাম হয়েছে যে, উঠ এবং তাঁর এস্তেকবাল কর। তাঁকে আমার দরবারে নিজের জন্য সুপারিশকারী সাব্যস্ত কর। হযরত ইবরাহীম হেরাবী রাঃ তা শুনে বললেন, যদি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী করলের সুপারিশ একত্রে আমাকে দেয়া হয়, তথাপি সকলের সুপারিশ মিলিত হয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সুপারিশের তুলনায় একমুষ্টি পরিমাণ হবে। হযরত বায়েজিদ রাঃ তা শুনে বিস্মিত হলেন। বাক্যালাপ করতে করতে খাওয়ার সময় হয়ে গেল। দস্তরখানা বিছান হল এবং তাতে উত্তম উত্তম খাদ্য রাখা হল। হযরত ইবরাহীম হেরাবী রাঃ মনে মনে বললেন, শায়খ এমন উত্তম খাদ্য আহার করে থাকেন। এমন জাঁকজমকের খাদ্য তো তাঁর পক্ষে গ্রহণ করা উচিত নয়। হযরত বায়েজিদ রাঃ তাঁর মনের কল্পনা বুঝতে পারলেন, কিন্তু চুপ রইলেন। খাওয়ার কাজ সমাপ্ত হলে হযরত বাযেজিদ রাঃ হযরত ইবরাহীম হেরাবী রাঃ এর এক হাত ধরে ঘরের এক কোণের দিকে দেয়ালের গায়ে হাত মারলেন তৎক্ষণাৎ একটি দরজা খুলে অপার সমুদ্র প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তিনি ইবরাহীম হেরাবী রাঃ কে বললেন, আসুন আমরা উভয়ে এই দরিয়ার উপর দিয়ে হেঁটে যাই। তা শুনে হযরত ইবরাহীম হেরাবী রাঃ আতঙ্কিত হয়ে বললেন, এই স্তর আমার নয়। হযরত বায়েজিদ রাঃ অতঃপর বললেন, আপনি জঙ্গলের যে যব দিযে রুটি পাকায়ে থলির মধ্যে রেখেছেন, তাতে চতুষ্পদ জন্তুরা খেয়ে মলত্যাগ করেছিল। আপনি সেই রুটি আহার করেছেন। যাঁচাই করে দেখেননি যে, তা যব ছিল কি না। আর আজ এই উত্তম খাদ্য দস্তরখানের উপর সাজান দেখে বলছেন, সুস্বাদু ও উত্তম খাদ্য খাওয়া তাকওয়া নয়। হযরত ইবরাহীম হেরাবী রাঃ একথা শুনে অনুসন্ধান করে দেখলেন, হযরত বায়েজিদ রাঃ সত্যই বলেছেন। তিনি তওবা করলেন এবং এই জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে মাগফেরাত প্রার্থনা করলেন।
একবার একদল লোক এসে হযরত বায়েজিদ রাঃ এর খেদমতে দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টির অভিযোগ করে ক্রন্দন করতে করতে বলল, আপনি দোয়া করুন, যেন আল্লাহ তায়ালা অতি সত্বর বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তা শুনে তিনি মস্তক অবনত করলেন এবং একটু পরেই মস্তক উত্তোলন করে বললেন, যাও পানি নিষ্কাশনের নালীগুলো সংস্কার কর, বৃষ্টি আসছে। তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই বৃষ্টি বর্ষিতে আরম্ভ করল এবং পূর্ণ একদিন ও একরাত্রি  ধরে বর্ষিতে রইল।

একবার হযরত বায়েজিদ রাঃ বসা অবস্থায় হঠাৎ পা বিস্তার করে দিলেন, তা দেখে তাঁর এক মুরিদও পা ছড়ায়ে দিল। হযরত বায়েজিদ রাঃ নিজের পা গুটায়ে নিলেন। কিন্তু মুরিদও তার পা গুটাতে চাইলেও বহু চেষ্টা করেও গুটাতে পারল না। তার সেই পা ছড়ান অবস্থাতেই রইল এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এরূপই থাকল। মুরিদ মনে করেছিল যে, হযরত বায়েজিদের পা বিস্তার অন্যান্য লোকের পা বিস্তারের মত হবে।
একবার হযরত বায়েজিদ রাঃ পা ছড়ায়ে বসায় জনৈক জ্ঞানী নামধারী আহমক তাঁর মজলিশ থেকে চলে যাওয়ার জন্য উঠল। হঠাৎ তার মনের মধ্যে এক উদ্ভট কল্পনা আসল এবং যাওয়ার সময় সে হযরত বায়েজিদ রাঃ এর ছড়ান পায়ের উপর নিজের পা রাখল। মজলিশের লোকেরা চিৎকার করে উঠল, আহমক ! কি করছিল? সে বলল, আমি শুনেছি পায়ের মধ্যেও কারামত আছে, তা পরীক্ষা করছি।
কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই লোকের পায় কুষ্ঠ রোগ দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত সেই কুষ্ঠ রোগেই তার মৃত্যু হয়।  জানা যায়, তার সন্তানদের মধ্যেও পুরুষানুক্রমে এই কুষ্ঠরোগ কংক্রামিত হয়েছিল। কেহ কেহ জনৈক বুযুর্গের কাছে জিজ্ঞেস করল, একজনে অপরাধ করে, আর এর শাস্তি তার বংশধরেরা পুরুষানুক্রমে ভোগ করে, এর কারণ কি? উক্ত বুযুর্গ লোক উত্তরে বললেন, তীরন্দায যত অধিক শক্তিশালী হয়, তাঁর তীর ততই দূরে গিয়ে পৌঁছে।
শেখ আবু সাঈদ মাইখারানী রাঃ হযরত বায়েজিদ রাঃ কে পরীক্ষা করার জন্য তাঁর কাছে গেলেন। হযরত বায়েজিদ রাঃ তা বুঝতে পেরে তাঁকে বললেন, হে আবু সাঈদ ! তুমি আমার আবু সাঈদ রাঈ নামক মুরিদের কাছে গমন কর। আমি কারামত ও বেলায়েত তার হাতে সোপর্দ করে দিয়েছি। আবু সাঈদ মাইখারানী আবু সাঈদ রাঈর বাসস্থানে গিয়ে দেখলেন, তিনি মাঠে এক জায়াগায় নামাজ পড়ছেন এবং তাঁর বকরীগুলোকে নেকড়ে বাঘেরা পাহারা দিতেছে। আবু সাঈদ রাঃ ন ামাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে মাইখারানী রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি চান? তিনি উত্তর করলেন, গরম রুটি এবং তাজা আঙ্গুর। হযরত আবু সাঈদ রাঈ রাঃ নিজের হাতের লাঠিটি দ্বিখণ্ডিত করে এক খণ্ড মাইখারানীর সামনের মাটিতে পুতে দিলেন, অপর খণ্ডটি নিজের সামনে পুতিলেন। তৎক্ষণাৎ লাঠির উভয় অংশ সবুজ এবং সতেজ বৃক্ষের রূপ ধারণ করে মাইখারানীর সামনের খণ্ডে কাল এবং আবু সাঈদ রাঈ’র সামনের খণ্ডে সাদা আঙ্গুর ফল ধরল। মাইখারানী রাঃ জিজ্ঞাসা করলেন, আমার অংশে কাল এবং আপনার অংশে সাদা আঙ্গুর ফল ধরার কারণ কি? আবু সাঈদ রাঈ রাঃ বললেন, যেহেতু আমি খাঁটি নিয়তে বিশ্বাসের সাথে চেয়েছি। আর আপনি পরীক্ষার নিয়তে চেয়েছেন, সুতরাং এটা অবধারিত সত্য যে, প্রত্যেক বস্তুর বর্ণ তার অবস্থার অনুরূপ হয়ে থাকে। অতৎপর তিনি আবু সাঈদ মাইখারানীকে একখানা কম্বল দিয়ে বললেন, এটা খুব হেফাযতে রাখবেন, যেন হারায়ে না যায়। আবু সাঈদ মাইখারানী হজ্বে গমন করলে আরাফাতের ময়দানে কম্বলখানি তাঁর কাছ থেকে হারায়ে যায়। আবু সাঈদ মাইখারানী হজ্বে গমন করলে আরাফাতের ময়দানে কম্বলখানি তাঁর কাছ থেকে গায়েব হয়ে যায়। বোস্তামে প্রত্যাগমন করে ঠিক সেই কম্বলখানি আবু সাঈদ রাঈ রাঃ এর কাছে দেখতে পান।
একদিন কেহ হযরত বায়েজিদ রাঃ কে জিজ্ঞাসা করল, আপনার পীর কে? তিনি উত্তর করলেন, একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক। একদিনের ঘটনা, একবার আমি মহব্বত ও তাওহীদের প্রবল প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম যে, এক চুল পরিমাণ পার্থক্য এবং ব্যবধান ছিল না। নিজত্ব বোধ হারায়ে জঙ্গলের দিকে বের হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, এক বৃদ্ধা একটি আটার বোচকাসহ তথায় উপস্থিত হয়ে আমাকে বলল, আমার কাঁধ থেকে আটার বোচকাটি নামায়ে তুমি নিজে বহন করে নিয়ে চল। তখন আমার অবস্থা এমন ছিল যে, আমি নিজের শরীরের বোঝাই বহন করতে পারছিলাম না। নিজেকে সামলানই আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে অদূরে একটি বাঘ দেখতে পেয়ে তাকে ইশারা করতেই সে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। আমি বৃদ্ধার কাঁধ থেকে বোচকাটি নামায়ে বাঘের কোমরের উপর রাখলাম। অতঃপর আমি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি শহরে গিয়ে পৌঁছলে কি বলবে? অর্থাৎ কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে কি বলবে? সে বলল, আমি বলব, আমি একজন আত্মগরিমা প্রকাশকারী যালেমকে দেখেছি। আমি বললাম, হ্যাঁ। তুমি এ কি বলছ? বৃদ্ধা বলল, সত্যই বলতেছি, আপনিই বলুন, এই বাঘটি কি শরিয়তের বিধানের আওতামুক্ত? আমি বললাম, না। সে বলল, যাকে আল্লাহ পাক নিজের আদেশ পালনের কষ্ট প্রদান করেনি, আপনি তাকে কষ্ট দিতেছেন, আপনি যালেম নহেন তো কি? আর আপনার এই কার্যকে যুলুম না বলে আর কি বলা যাবে? এছাড়া আপনার ইচ্ছা- সমস্ত শহরবাসী লোক অবগত হোক যে, বাঘ আপনার অনুগত ও ফরমাঁবরদার এবং আপনি খুব কারামত ও বুযুর্গীওয়ালা। এটা আত্মশ্লাঘা বা রিয়াকারী নহে তো কি? আমি বললাম, তুমি সত্যই বলছ। অতঃপর আমি তওবা করলাম এবং উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তরে নেমে পড়লাম। বৃদ্ধার এই কথাগুলোই আমার বিরাট সংশোধন করে দিয়েছে। কাজেই বৃদ্ধা আমার পীর হল। এর পর আমি এমন হয়ে গেছি যে, যখনই আমার মধ্যে কোন কারামত কিংবা বুযুর্গীর লক্ষণ প্রকাশ পেত, তখনই আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে তার যথার্থতার প্রমাণ চাইতাম এবং তখনই এক হলদে নূর প্রকাশিত হত- তাতে সবুজ অক্ষরে লেখা থাকত- ……………………………  এই পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা কারামতের সত্যতা প্রমাণিত হতে আরম্ভ করল। অতঃপর লোকের কাছে প্রকাশ করে আমার কারামতের সাক্ষী দাঁড় করাবার কি প্রয়োজন থাকতে পারে?
আহমদ খায়রাবিয়্যাহ রাঃ বলেন, আমি এক রাতে আল্লাহ তায়ালাকে স্বপ্নে দেখলাম। তিনি বললেন, দুনিয়ার সকলে আমার কাছে বিভিন্ন প্রকারের বস্তু প্রার্থনা করে থাকে, কিন্তু বায়েজিদ আমার কাছে শুধু আমাকেই চাই।
একবার হযরত বায়েজিদ রাঃ কোন এক ইমামের পিছনে নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষ উক্ত ইমাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হযরত আপনি কোন ব্যবসা বাণিজ্যও করেন না, কৃষিকর্মও করেন না, কারও কাছে কিছু চানও না। আচ্ছা বলুন তো আপনার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা কোথা থেকে হয়? হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেন, একটু সবর করুন, আমি নামাজ পুনরায় পড়ে নেই। তৎপর আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। ইমাম বললেন, কেন নামাজ কি জন্য পুনরায় পড়বেন? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, যে ব্যক্তি রিজকদাতাকে চিনে না, তার পিছনে নামাজ দুরুস্ত হয়নি। কাজেই নামাজ পুনরায় পড়তে হবে।
একবার হযরত বায়েজিদ রাঃ এক ব্যক্তিকে নামাজ পড়তে দেখে বললেন, তুমি যদি মনে করে থাক যে, এই নামাজ তোমাকে আল্লাহ তায়ালা পর্যন্ত পৌঁছবে, তবে তোমার ভুল। এটা অসম্ভব কল্পনা। মিলনের আশা বৃথা, কিন্তু দেখ, সাবধান, নামাজ ত্যাগ কর না, কাফের হয়ে যাবে। আর নামাজের উপর বিন্দুমাত্র ভরসাও কর না, তাতে মুশরিক হয়ে যাবে।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, কোন কোন লোক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে এই ফায়দা লাভ করে যে, অভিশপ্ত হয়ে ফিরে যায়। আর কেহ কেহ আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে এই উপকার লাভ করে যে, আল্লাহ তায়ালার রহমত প্রাপ্ত হয়ে যায়। লোকে জিজ্ঞাসা করল, এটা কেমন করে হয়ে থাকে? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, কেহ কেহ আমার এমন অবস্থার সময়ে আসে যে, তখন আমি নিজের মধ্যে থাকি না। সে আমার এই অবস্থা দেখে আমার পশ্চাতে নিন্দা আরম্ভ করে লানতের মধ্যে গেরেফতার হয়ে যায়। কেহ কেহ এমন সময়ে আসে যে, তখন আমার উপর আল্লাহ তায়ালার ভাব প্রবল থাকে। আগন্তুক এই অবস্থায় আমাকে ক্ষমার যোগ্য মনে করে ক্ষমা করে। এর ফলে সে রহমত প্রাপ্ত হয়।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, আমি চাই যে, কিয়ামত খুব তাড়াতাড়ি আসুক যেন আমি দোযখের ধারে আমার বাসস্থান গ্রহণ করতে পারি। ফলে দোযখ আমাকে দেখে শীতল হয়ে যায় এবং আমি আল্লাহর সৃষ্ট মানবের শান্তির কারণ হতে পারি।
হযরত হাতেম আছাম্ম নিজের মুরিদগণকে বলতেন, তোমাদের মধ্যে যে, ব্যক্তি দোযখীদের জন্য সুপারিশকারী না হবে সে আমার মুরিদ নয়। লোকে এসে একথা হযরত বায়েজিদ রাঃ কে বললে তিনি বললেন, আমি বলি, সেই ব্যক্তিই আমার মুরিদ, যে ব্যক্তি দোযখের ধারে দাঁড়ায়ে দোযখীদের হাতে ধরে বেহেশতে পৌঁছায়ে দিবে এবং তার পরিবর্তে সে নিজে দোযখে যাবে। লোকে জিজ্ঞাসা করল, হযরত ! আল্লাহ তায়ালা যখন আপনাদের প্রতি এরূপ দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন, তখন আপনারা মানুষকে আল্লাহ তায়ালার দিকে টেনে কেন নিতেছেন না? হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, যাকে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমত থেকে বিতাড়িত করেছেন, বায়েজিদ বেচারার কি ক্ষমতা আছে যে, তাকে আল্লাহর প্রিয় বানায়ে দেয়?
একবার হযরত বায়েজিদ রাঃ এর সময়ে রোম শহরে মুসলিম সেনাগণ নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন হল। হঠাৎ হযরত বায়েজিদ রাঃ এর কানে গায়েব থেকে এক আওয়াজ আসল- হে বায়েজিদ ! মুসলিম সৈন্যদের সাহায্য কর, তৎক্ষণাৎ খোরাসানের দিক থেকে এক ভয়ঙ্কর দাবানল এসে শত্র“ সৈন্যদের ঘিরে ফেলল। এতে তাদের মনে এমন ভীতির সঞ্চার হল যে, তারা পশ্চাৎপদ হয়ে পলায়ন করল। ফলে মুসলিম সেনা বাহিনীর জয় হল।
হযরত বায়েজিদ রাঃ এর উপর কোন মুসিবত আসলে তিনি বলতেন, এলাহী ! রুটি তো আপনি পাঠিয়েছেন ব্যঞ্জনও এর সঙ্গে প্রেরণ করুন, যাতে আমি তা উত্তমরূপে আহার করতে পারি। অর্থাৎ সবর দান করুন যেন এই মুছিবত উত্তমরূপে বরদাশত করতে পারি।
একদিন আবু মুসা রাঃ হযরত বায়েজিদ রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার অদ্যকার ভোরবেলা কেমন কাটছে? তিনি উত্তর করলেন, আমার ভোরও নেই, সন্ধ্যাও নেই। তিনি আরও বললেন, আমার প্রতি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে এলহাম হল, হে বায়েজিদ ! কবুলকৃত ইবাদত ও পছন্দীয় বন্দেগীতে আমার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। তুমি যদি  আমাকে চাও, তবে এমন জিনিস আনয়ন কর যা আমার ভাণ্ডারে নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে পরওয়ারদেগার ! এমন কোন বস্তু আছে যা আপনার ভাণ্ডারে নেই? জবাব আসল- নিরীহতা, অক্ষমতা, দৈন্য এবং নিঃসহায়তা।
তিনি বলিয়াছেন, আমার নামাজ থেকে শরীরের সুস্থতা ছাড়া আর কিছু পাইনি এবং রোজা থেকে শুধু পেটকে ভুখা ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারিনি। যা কিছু পেয়েছি তাঁর অনুগ্রহ এবং দয়া থেকেই পেয়েছি। নিজের আমল ও ইবাদত দ্বারা কিছুই পাইনি। আবার তিনি বলিলেন, চেষ্টা ও তদবীর দ্বারা কিছুই লাভ করা যায় না। আমার এই কথাটি উভয় জগৎ হইতে শ্রেষ্ঠ কিন্তু সৌভাগ্যবান বান্দা সেই ব্যক্তি যিনি সর্বদা পূর্ণ উদ্যমের সাথে চেষ্টা ও পরিশ্রমে রত থাকেন। এর ফলে কোন না কোন এক সময়ে যথা পাতে পা পড়বেই এবং সফলকাম হবেই। তিনি আরও বলেছেন, যখন কেহ আমার এখানে এসে মুরিদ হবে, তখন আমার অবশ্য কর্তব্য হবে উচ্চতম মাকাম (স্তর) থেকে নিম্নতম মাকামে নেমে আসা এবং তার বুদ্ধি ও বোধশক্তি অনুযায়ী তার সাথে কথা বলা।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, আমি প্রথম বার হজ্বে গমন করে শুধু কাবা শরীফের ঘরটিকে দেখেছি, দ্বিতীয় বার গমন করে খানায়ে কাবার মালিককে দেখেছি, তৃতীয় বার হজ্বে গমন করে খানায়ে কাবার মালিককেও দেখিনি, খানায়ে কাবাকেও দেখিনি। অর্থাৎ আমি এমন আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম যে, শুধু আল্লাহ পাকের মহিমা ও মাহাত্ম্য ভিন্ন আর কিছুই আমার দৃষ্টি পথে আসেনি। যে দিকে দৃষ্টিপাত করেছি কেবল তাঁর মহিমাই আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
একদিন কতিপয় লোক হযরত বায়েজিদ রাঃ কে বলল, হযরত ! আপনার সাধনা ও রিয়াযতের যৎকিঞ্চিত আমাদের কাছে বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, আমি যদি আমার উচ্চতম মানের কোন রিয়াযতের কথা তোমাদের সামনে বর্ণনা করি, তবে আমি দেখছি, তা তোমাদের বোধগম্য হওয়া তো দূরের কথা, তা শ্রবণ করার ক্ষমতাই তোমাদের নেই। আচ্ছা, একটি নিম্নমানের সাধনা ও রিয়াযত তোমাদের কাছে বর্ণনা করছি। এক বারের ঘটনা, আমি নফসকে আল্লাহ পাকের ইবাদতের ফরমায়েশ করলে সে অবাধ্যতা প্রকাশ করল। আমি তাকে এক বছর পানি পান থেকে বঞ্চিত রেখেছি, এবং বলেছি, হে নফস ! আল্লাহ পাকের ইবাদতের জন্য সম্মত হয়ে যা, অন্যথায় তোকে আমি এইরূপে পিপাসায় জ্বালায়ে পুড়ায়ে মারব।
হযরত বায়েজিদ রাঃ খোদাতত্ত্বে নিমজ্জিত থাকা অবস্থা এইরূপ ছিল যে, তাঁর জনৈক মুরিদ বিশ বছরে কখনও তাঁর দরবার থেকে কোথাও যায়নি। তিনি তাঁকে প্রত্যেক বারই ডাকার সময় জিজ্ঞাসা করতেন, ভাই তোমার নাম কি? একদিন  সে তাঁকে বলল, হযরত আমার মনে হয়, আপনি আমার সাথে কৌতুক করছেন। কেননা, আমি সুদীর্ঘ বিশটি বছর ধরে আপনার খেদমত করছি, অথচ আপনি প্রত্যেকবারেই আমাকে ফরমাইশ করার সময় আমার নাম জিজ্ঞাসা করছেন। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, মিয়া ! আমি তোমার সঙ্গে কৌতুক করছি না। এর কারণ এই যে, যখন থেকে আমার মালিকের নাম আমার অন্তরে প্রবেশ করেছে, তখন থেকে তিনি দুনিয়ার সমুদয় নাম আমাকে ভুলায়ে দিয়েছেন। কাজেই আমি তোমাকে প্রত্যেক দিন তোমার নাম জিজ্ঞাসা করছি।

লোকেরা থাঁকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি মারেফাতে এমন উন্নত মান কেমন করে লাভ করলেন এবং এমন উচ্চ মাকামে কেমন করে পৌঁছলেন? তিনি উত্তর করলেন, আমি যখন সবেমাত্র বালক ছিলাম, এক রাতে আমি বোস্তাম শহরের বাইরে গেলাম। চাঁদের আলোতে পৃথিবী আলোকিত ছিল। মানুষ আরামে ঘুমাতেছিল। আমি এক দরবার দেখতে পেলাম, সেই দরবারের তুলনায় আার হাজার আলম এক রেণুর সমানও নয়। আমার হৃদয়ে তা উপলব্ধি করে এক প্রকার প্রদাহ ও জ্বালা উৎপন্ন হল এবং আমার উপর এক বিচিত্র অবস্থার আবির্ভাব হল। আমি বললাম, ইয়া আল্লাহ ! এত বড় দরবার এবং এত খালি। এমন অসাধারণ দরবার ! আর এত গুপ্ত ! তৎক্ষণাৎ গায়েব হতে আওয়াজ আসল, আমার দরবার খালি থাকার কারণ এই যে, কেহ এখানে আসে না। কারণ, আমি চাই না যে, অযোগ্য লোক এই দরবারের যোগ্য হোক। হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেন, আমার ইচ্ছা হল, আমি অন্যান্য লোকদের জন্য সুপারিশ করি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, সুপারিশের যোগ্যতা তো একমাত্র হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে। সুতরাং আদব রক্ষার্থে আমি নীরব থাকলাম। অতঃপর আবার গায়েব থেকে আওয়াজ আসল, এখন তুমি যে আদব রক্ষা করলে তার খাতিরে আমি তোমার নাম উচ্চ করে দিলাম। হে বায়েজিদ ! কিয়ামত পর্যন্ত লোকে তোমাকে ‘সুলতানুল আরেফীন’ বলে ডাকবে।
হযরত বায়েজিদ রাঃ এমন উচ্চ পর্যায়ের বুযুর্গ হওয়া সত্ত্বেও বলেছেন, আমার সারাটি জীবন এই আকাক্সক্ষার উপরই কেটেছে এবং বর্তমানেও কেটে যাচ্ছে যে, একবার এমন নামাজ পড়ি যা তাঁর দরবারের উপযুক্ত হয়। কিন্তু আমার সেই আকাক্সক্ষা আজও পূর্ণ হয়নি। আমি একবারও তেমন নামাজ পড়তে পারিনি। তিনি প্রায়ই এশার নামাজের পর চার রাকাত নামাজ পড়তেন। প্রত্যেক বারই সালাম ফিরায়ে বলতেন, এই নামাজ তো তাঁর দরবারের যোগ্য নামাজ হয়নি। এই বলে আবার নিয়ত বেঁধে নামাজ আদায় করতেন এবং শেষ করে পূর্বের মত বলতেন। এই রূপ করতে করতে রাত ভোর হয়ে যেত। তিনি বলতেন, এলাহী ! আপনার দরবারের উপযোগী একটু নামাজ পড়ার জন্য খুবই চেষ্টা করলাম, কিন্তু আফসোস ! আমার দ্বারা হয়ে উঠল না। বায়েজিদ যেইরূপ তাঁর নামাজও সেইরূপ হচ্ছে। এলাহী ! আপনার বহু বান্দা বেনামাজীও তো রয়েছে, বায়েজিদকে আপনি তাদের মধ্যে গণ্য করুন।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, চল্লিশ বছর যাবত ইবাদত ও রিয়াজত করতে করতে এক রাতে আমি দেখলাম, আমার চোখের সামনে থেকে পর্দা উঠায়ে দেয়া হয়েছে। তা দেখে অনেক কাকুতি মিনতি করলাম, দরবারে পৌঁছার জন্য রাস্তা দান করা হোক। আমাকে বলা হল, ভাঙ্গা বদনা এবং ছেঁড়া কম্বল সঙ্গে থাকার কারণে তুমি দরবারে প্রবেশ করতে পারছ না। আমি বদনা ও কম্বল ফেলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার কানে আওয়াজ আসল, হে বায়েজিদ ! তুমি সেই মারেফাতের দাবিদার ভণ্ড দরবেশদের বলে দাও যে, বায়েজিদ চল্লিশ বছরের সাধনা এবং পরিশ্রম সত্ত্বেও ভাঙ্গা বদনা এবং ছেঁড়া কম্বল সঙ্গে থাকার কারণে যে পর্যন্ত বদনা ও কম্বল বর্জন করেনি দরবারে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। তোমরা সাংসারিক সম্পর্কের পুটলি বেঁধে, নিজের কাছে রেখে আর আমার তরিকতের পন্থাকে নিজের নফসের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য ফাঁদ ও চারা স্বরূপ করে নিয়েছ। বল তো, তোমরা কেমন করে সেই দরবারে প্রবেশের আশা করতে পার? কখনই নয়, কখনই নয়, কোন অবস্থাতেই তোমরা সেই দরবারে প্রবেশ করতে পার না।
হযরত বায়েজিদ রাঃ এক রাতে এশার নামাজের পর থেকে ভোর পর্যন্ত দ্ইু পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর  করে নামাজ পড়তে থাকলে সর্বক্ষণ তাঁর দুই চক্ষু থেকে রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়ে মাটি পর্যন্ত রক্তাপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর এক মুরিদ তাঁর এই অবস্থা দেখে খুবই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। ভোরে সে হযরত বায়েজিদ রাঃ কে জিজ্ঞাসা করল, রাতে আপনার কি অবস্থা ছিল? একটু বর্ণনা করুন, যাতে আমরাও তা তেকে কিছু বরকত হাসিল করতে পারি। হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, আমি পা উঁচু করতেই আরশের উপর গিয়ে পৌঁছলাম, দেখলাম তা নেকড়ে বাঘের মত হাঁ করে রয়েছে এবং তার উদর খালি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আরশ ! …… (দয়ালু খোলা আরশের অধিপতি রয়েছেন) আয়াতটি তোমার সন্ধান দিচ্ছে। দেখাও তোমার মধ্যে কি আছে। আরশ থেখে আওয়াজ আসল, কথা এইরূপই বটে, কিন্তু আমি তোমার অন্তরে এই সন্ধান দিচ্ছি যে, ……. অর্থাৎ, আমি ভাঙ্গা ও দুর্বল হৃদয়সমূহের নিকটে রয়েছি। এই কারণেই আসমানীরা জমিনবাসীদের নিকট, জমিনবাসীরা আসমানবাসীদের নিকটে রয়েছি। এই কারণেই আসমানবাসীরা জমিনবাসীদের নিকট, জমিনবাসীরা আসমানবাসীদের নিকট, বৃদ্ধরা যুবকদের নিকট, যুবকেরা বৃদ্ধদের নিকট, যাহেদরা ফাসেকদের নিকট এবং ফাসেকরা যাহেদদের নিকট ভাঙ্গা হৃদয় তালাশ করে বেড়ায়। অতঃপর হযরত বায়েজিদ রাঃ বললেন, আমি যখন সান্নিধ্যের স্তর পর্যন্ত পৌঁছলাম তখন তখন আল্লাহ পাক বললেন, কি চাইবার আছে চাও। আমি আরজ করলাম, এলাহী ! আমি নিজের জন্য কিছুই চাই না। আমি তো কেবল আপনার সন্তুষ্টি চাই আর আপনি আমার জন্য যা কিছু চান, আমিও তাই চাই। আওয়াজ আসল, যে পর্যন্ত বায়েজিদের অস্তিত্ব রেণু পরিমাণও অবশিষ্ট থাকবে এই আকাক্সক্ষা নিষ্ফল। আচ্ছা, নিজেকে বিলীন করে দাও এবং চলে আস। আমি আরজ করলাম হে পরওয়ারদেগার ! কোন ফয়েজ ও বরকত হাসিল করা ব্যতিত আমি এখান থেকে যাব না। নির্দেশ হল প্রার্থনা কর। আমি নিবেদন করলাম। পরওয়ারদেগার ! সমগ্র মাখলুকের প্রতি রহম করুন। এরশাদ হল, গভীরভাবে দৃষ্টি করে দেখ। আমি গভীরভাবে দৃষ্টি করে দেখলাম, প্রত্যেক মাখলুকের সঙ্গে এক একজন সুপারিশকারী রয়েছেন এবং প্রত্যেক বান্দার প্রতি আল্লাহ পাক আমার চেয়েও বেশি মেহেরবান। আমি নীরব হয়ে গেলাম, অতঃপর আমি বললাম, ইবলিসের প্রতি রহম করুন। নির্দেশ আসল, চুপ থাক, বেআদবী কর না। কেননা সে অগ্নি থেকে প্রস্তুত, অগ্নির জন্য অগ্নিরই প্রয়োজন, তুমি নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে থাক যেন অগ্নি থেকে রক্ষা করতে পার। কেননা, তোমার সেই অগ্নি বরদাশত করার শক্তি নেই।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলিয়াছেন, আল্লাহ পাক দুই হাজার অবস্থায় আমাকে আপন দরবারে হাজির করেছেন এবং প্রত্যেক অবস্থায় আমার সামনে এক বিশাল রাজত্ব পেশ করেছেন। কিন্তু আমি তা গ্রহণ করিনি। অতঃপর আমাকে বলেছেন, হে বায়েজিদ ! কি চাইবার আছে চাও। আমি আরজ করলাম, হে পরওয়ার দেগার আমি এই চাই যে, আমি যেন কিছু না চাই।
এক ব্যক্তি হযরত বায়েজিদ রাঃ এর কাছে বলল, আমাকে এমন বস্তু শিখায়ে দেন যা আমার নাজাতের কারণ হয়। তিনি বললেন, এই দুটি কথা স্মরণ রাখ এবং এই পরিমাণ এলমই তোমার জন্য যথেষ্ট : ক. তুমি সর্বদা মনে রাখবে যে, আল্লাহ তায়ালা আমার সব কিছু অবগত আছেন। খ. তুমি যে কোন সময় যা কিছু কর, আল্লাহ তায়ালা তোমার যাবতীয় কর্মই দেখছেন। আর খুব ভালভাবে মনে রাখবে যে, আল্লাহ তায়ালা তোমার আমলের পরোয়া করেন না। তোমার আমলে তাঁর কোন প্রয়োজন নেই।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, আমি আল্লাহ পাকের দরবারে আরজ করলাম, এলাহী ! আমি কোন পথে আপনার দিকে আসব? তৎক্ষণাৎ আমি এক আওয়াজ শুনলাম, হে বায়েজিদ প্রথমে নিজের নফসকে তিন তালাক দাও, তারপর আমার নাম লও।
হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, যদি আটটি বেহেশতকে আমার কুটিরের দ্বারে রেখে দেয়া হয় তাহলে এবং জায়গীর স্বরূপ উভয় জগৎ আমাকে দান করা হয়, তবুও গতরাতে এশকের জ্বালায় আমি যে একটি স্নিগ্ধ শ্বাস ফেলেছি, শুধু তার বিনিময়ে আমি জায়গীর কবুল করব না। বরং তাঁর মহ্ববত ও এশকের উৎসাহে আমি যেই একটি শ্বাস গ্রহণ করেছি, তাকে আমি আঠার হাজার আলমের সাথে বিনিময় করতে প্রস্তুত নই। তিনি আরো বলেছেন, যদি পরলোকে বেহেশতের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় দিদার আমাকে না দেখান তবে আমি এত রোদন ও আহাজারী করব যে, সাত তবক দোযখের দোযখীরা আমার কান্নাকাটির চোটে নিজেদের আযাব পর্যন্ত ভুলে যাবে।
তিনি আরো বলিয়াছেন, চল্লিশ বছর ধরে আমি মানুষকে স্রষ্টার দিকে আহ্বান করেছি, কিন্তু কেহই আমার ডাকে সাড়া দেয়নি। অনন্যোপায় হয়ে আমি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরায়ে আল্লাহ তায়ালার দরবারে গমন করলাম। সেখানে পৌঁছায়ে দেখলাম, সকলে আমার আগে সেখানে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ আমি দেকতে পেলাম, তাঁর সৃষ্ট মানবের জন্য আমার চেয়ে তাঁর দয়া অনেক বেশি। অতএব, আমি বুঝতে পারলাম, আমি এত বছর ধরে মানুষের জন্য যা কামনা করছিলাম, তা সফল হয়নি, কিন্তু আল্লাহ পাকের এক মেহেরবানীর দৃষ্টিতেই তা হয়ে গেছে। কাজেই তো তিনি সকলকে আমার আগেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছায়ে দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেছেন, যে দিন আমি আমার অস্তিত্ব বর্জন করে বাইরে আসলাম, সর্প যেরূপ নিজের খোলস ত্যাগ করে বের হয়ে যায়- সেদিন থেকে আমার দৃষ্টিতে আশেক এবং মাশুক একই রকম বোধ হতে লাগল। কেননা, তাওহীদের জগতে সকলকে একইরূপ দেখা যায়।
তিনি আরও বলেছেন, আমি দীর্ঘকাল ধরে খানায়ে কাবার তাওয়াফ করছিলাম, কিন্তু যখন আমি আল্লাহ তায়ালা পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম, তখন দেখলাম কাবা ঘরই আমার চতুর্দিকে তাওয়াফ করছে।
তিনি আরো বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন উচ্চ স্তরে পৌঁছায়েছেন যে, সমগ্র সৃষ্ট জগতকে আমি আমার দুই অঙ্গুলির মাঝখানে দেখতে পেয়েছি।
তিনি বলেছেন, যদি কোন মোর্শেদ নিজের মুরিদদের ইবাদতের স্বাদ প্রদান করতেছেন বলে আনন্দিত হন তবে এই আনন্দই তার পক্ষে খোদার নৈকট্য লাভের পথে বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেছেন, আরেফগণের নিম্নতম স্তর এই যে, আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী যেন তাঁদের মধ্যে পাওয়া যায়।
তিনি আরো বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে সমস্ত মানবের পরিবর্তে আগুনে পোড়ান আর আমি তাঁর মহব্বতের দাবিদার বলে তাতে সবর করি, তবে আমি মহব্বতের হক কিছুই আদায় করলাম না। আর যদি আমার ও সমগ্র মানবকুলের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেন, তবে তা তাঁর রহমত ও দয়া গুণের তুলনায় কোনই বড় কাজ নেই।
তিনি বলেছেন, আমি দুনিয়ার সাথে শত্র“তা স্থাপন করে আল্লাহ তায়ালার নিকটে গমন করেছি এবং সমস্ত সৃষ্ট জগৎ ও তন্মধ্যস্থ সবকিছু বর্জন করে আল্লাহ তায়ালাকে অবলম্বন করেছি। তখন আমার হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালার মহব্বত এত অধিক পরিমাণে প্রাবল্য লাভ করেছে যে, আমি নিজেকেও দুশমন মনে করতে আরম্ভ করেছি। আর যখন আমি ঐ সমস্ত বস্তুকেও দূর করে দিলাম, যা আমার ও আল্লাহ পাকের মাঝখানে পর্দাস্বরূপ, তখন তাঁর অনন্ত ফয়েজ লাভ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম।
তিনি আরো বলেছেন, সত্যিকারের আরেফ ও সত্যনিষ্ঠ আমলকারী সেই ব্যক্তি যিনি রিয়াযত ও ইবাদতের তলোয়ারে যাবতীয় উদ্দেশ্য ও কামনার মুণ্ডপাত করে দেন এবং নফসের সর্ববিধ কামনা ও বাসনা আল্লাহ পাকের মহব্বতের সামনে বিলীন ও বিলোপ করে দেন। আর আল্লাহ তায়ালা যে সমস্ত বস্তুকে পছন্দ করেন, সে সমস্ত বস্তুকে ভালবাসেন এবং সে সমস্ত বস্তুরই আকাক্সক্ষা পোষণ করেন।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, হযরত ! আল্লাহ তায়ালা কি নিজের মর্জি অনুসারে বান্দাকে বেহেশতে দাখিল করেন? তিনি বললেন, একথা তো একবার চিন্তা করে দেখ যে, আল্লাহ তায়ালা যার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দান করেন, বেহেশত তাঁর কোন কাজে আসবে, বেহেশত নিয়ে তিনি কি করবেন?
তিনি আরো বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার এক যাররা পরিমাণ মারেফা আরেফের মনে এমন আনন্দ ও স্বাদ দান করে যে, সর্বোচ্চ বেহেশতের এক লক্ষ মহলও তার তুলনায় তাঁদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হয়। আর আল্লাহ তায়ালার মহব্বত মারেফাতের ময়াদানের অনেক বীর পুরুষকে দুর্বল এবং অনেক দুর্বলকে বীর পুরুষ করে দেয়।
অমিয়বাণী :
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ বলেছেন,
সংসার ত্যাগী হওয়া এবং নেক কাজে মনোনিবেশ করা আল্লাহ তায়ালার রহমতের বায়ু স্বরূপ, যা তোমাদের প্রতি প্রবাহিত হচ্ছে।
মুসলমান ভাইকে অপমান ও অপদস্থ করলে তোমার যত ক্ষতি হবে রাশি রাশি পাপ তোমার তত ক্ষতি করবে না।
দুনিয়া দুনিয়াদারদের জন্য ধোঁকার উপর ধোঁকা, আর আখেরাত আখেরাতওয়ালাদের জন্য আনন্দের উপর আনন্দ। আর আল্লাহ তায়ালার মারেফাত মারেফাতওয়ালাদের জন্য নূরের উপর নূর।
প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসকে আল্লাহর ধ্যানে নিয়োজিত রাখাই মারেফাতওয়ালাদের ইবাদত।
আরেফ লোক যখন নীরবতা অবলম্বন করে, তখন আল্লাহ তায়ালার সাথে কথাবার্তা বলার বাসনা তার অন্তরে উদিত হয়। আর যখন চক্ষু বন্ধ করেন, তখন তাঁর কাম্য হয় যে, তিনি চক্ষু খোলামাত্র যেন আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পান। আর যখন হাঁটুর উপর মাথা রেখে ধ্যানে নিমগ্ন হয়, তখন আল্লাহ তায়ালার সাথে তাঁর সেই বিরাট আশা ও আকাক্সক্ষা নিবদ্ধ হয়, তখন তার কারণে তাঁর ইচ্ছা হয়, হযরত ইসরাফীল আঃ এর সিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া পর্যন্ত যেন তার আর মাথা উঠানে না হয়।
আল্লাহ তায়ালাকে চিনতে পারার লক্ষণ হল, জনসমাজ থেকে দূরে সরে থাকা এবং নির্জনে বসে আল্লাহ পাকের মারেফাতের মধ্যে ডুবে থাকা।
কারও হৃদয়ে আল্লাহ পাকের এশকের আবির্ভাব হলে হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহ ব্যতীত আর যা কিছু রয়েছে সব কিছুকে মধ্যস্থ থেকে দূর করে দেয়। অন্য কিছুর নামমাত্রও হৃদয়ে অবিশষ্ট থাকে না। শেষ পর্যন্ত সে ব্যক্তি একাকী থেকে যায়- যেমন আল্লাহ তায়ালা একক।
এমন ব্যক্তি থেকে এলম শিক্ষা করা উচিত, যে ব্যক্তি এলম শিক্ষার উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌঁছেছে। যে ব্যক্তি গর্ব করার জন্য এলম শিখেছে এবং এলম শিক্ষা দ্বারা যে ব্যক্তি মর্যাদা ও জাঁকজমক কামনা করে, আর আশা করে যে, লোকের কাছে প্রিয় ও পছন্দনীয় হবে, এমন ব্যক্তি থেকে দূরে থেক। কেননা, সে ব্যক্তি প্রত্যহ আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আল্লাহ তায়ালার সত্যিকারের পরিচয় পাইলে আল্লাহ তায়ালার মহব্বতে মত্ত না হয়ে পারে না। মহব্বত ভিন্ন মারেফাতের কোন মূল্য হয় না।
কতই না উত্তম হত যদি মানুষ নিজ পরিচয়ের সীমা পর্যন্ত পৌঁছতে পারত। কেননা, তার নিজের পরিচয় লাভের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করতে পারত।
আল্লাহ তায়ালা যাদের লাভবাসেন, তিনটি স্বভাব তাদের দান করেন-
১. দরিয়ার দানশীলতার মত দানশীলতা, ২. সূর্যের দয়ার মত দয়া ও ৩. জমিনের নম্রতার মত নম্রতা।
হাজীগণ স্বশরীরে খোদার ঘরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করেন এবং হাশরের মাঠে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাৎ লাভের জন্য দরখাস্ত করে থাকেন, আর আল্লাহর মহব্বতে বিভোর বান্দাগণ অন্তরের সাথে আরশের চতুর্দিকে তাওয়াফ করে থাকেন এবং আল্লাহ তায়ালার দীদার প্রার্থনা করতে থাকেন।
আল্লাহ তায়ালা যাকে কবুল করেন একজন ফেরাউন স্বভারে লোক তার পশ্চাতে লাগায়ে দেন। সেই ফেরাউন তাকে দুঃখ-কষ্ট প্রদান করতে থাকে।
নেককারের সংসর্গে থাকা নির্জনে বসে নেককাজ করার চেয়ে উত্তম আর বদকার লোকের সংসর্গে থাকা বদকাজ করার চেয়ে উত্তম।
ইবাদতে ও রিয়াজতে সর্ববিধ চেষ্টা শেষ করে আল্লাহ তায়ালার মেহেরবাণীর উপর ভরসা করা উচিত, নিজের আমলের উপর ভরসা করা উচিত নয়।
দোযখের আগুন সেই ব্যক্তির জন্য আযাব, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে চিনে না। যারা খোদাকে চিনে তারাই দোযখের জন্য আযাব স্বরূপ হবে।
যে ব্যক্তি নফসের যাবতীয় কামনা বাসনা ত্যাগ করতে পেরেছে, সে আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য ও নৈকট্য যে ব্যক্তি লাভ করতে পেরেছে, সব কিছুই তার হয়ে যায়। কেননা আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিদ্যমান, আর সকল বস্তুই আল্লাহ তায়ালার।
যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার মারেফাত হাসিল করেছে, তিনি নিজেকে মূর্খ ও অজ্ঞ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কিছুই জানে না, সে বলে বেড়ায় আমি খোদা তত্ত্ব জ্ঞানী। আরেফ লোক উড্ডীয়মান পক্ষীর মত। আর যাহেদ (সংসার ত্যাগী) ভবঘুরে যুবকদের মত।
রেওয়ায়েতে দেখা যায়, হযরত ইবরাহীম আঃ, হযরত মূসা আঃ, হযরত ঈসা আঃ আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন, “ইয়া খোদা ! আমাদেরকে মোহাম্মদ সাঃ এর উম্মতশ্রেণীভুক্ত করুন।” এর কারণ এই ছিল যে, তাঁরা উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে এমন লোক দেখতে পেয়েছিলেন, যাদের পা মাটির নিচে এবং তাঁদের মস্তক সেই আলা ইল্লিয়্যিন অর্থাৎÑ সর্বোচ্চ আসমানের দিকে আর তাঁরা এত আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে আল্লাহ তায়ালার মহব্বতের মধ্যে নিমজ্জিত আছেন যে, নিজেদের অস্তিত্ব হারায়ে ফেলেছেন। তোমরা একথায় এরূপ ধারণা কর না যে, আমি এই কথা দ্বারা নবীদের উপর নিজেদের ফজিলত প্রমাণ করতে চাচ্ছি। কখনই নয় কখনই নয়।
সমুদয় সৃষ্টির জন্য যত নেয়ামত নির্ধারিত রয়েছে, তৎসমুদয় নেয়ামতই যদি একা তোমাকে প্রদান করা হয়, তথাপি তুমি তার প্রতি ঝুঁকে পড় না। আর যদি তরিকতের পথে সর্ব প্রকার দুর্ভাগ্য তোমার উপর এসে পড়ে তথাপি নিরাশ হয়ো না। কেননা, আল্লাহ তায়ালার কাজ …….. অর্থাৎ- তাঁর ইঙ্গিত হওয়া মাত্র অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়, তোমার সমস্ত দুর্ভাগ্য এক মুহূর্তে সৌভাগ্যে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া কিছুই অসম্ভব নয়।
যে ব্যক্তি নিজকে কিছু মনে করে, নিজের ইবাদতকে খাঁটি এবং নিজের অন্তরকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার বলে ধারণা পোষণ করে, আর নিজের নফসকে সমস্ত নফসের চেয়ে নিকৃষ্ট বলে মনে না করে, সেই ব্যক্তি কোন গণনার মধ্যেই নহে।
যে ব্যক্তি নিজের অন্তঃকরণকে অত্যধিক কামনা ও বাসনার চাপে মুর্দা করে ফেলেছে তার মৃত্যু হলে তাকে লানতের কাফনে জড়ায়ে লজ্জা ও অনুতাপের জমিনে দাফন করা উচিত, আর যে ব্যক্তি নফসকে তার কামনা বাসনা থেকে বিরত রেখে মেরে ফেলেছে, তার মৃত্যু হলে তাকে রহমতের কাফনে জড়ায়ে ছালামতির জমিনে দাফন করা উচিত।
জীবন এলমের মধ্যে, শান্তি মারেফাতের মধ্যে এবং স্বাদ জিকিরের মধ্যে রয়েছে।
নফসের পপ্রশস্ততা যত বৃদ্ধি পায় অন্তঃকরণ ততই সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে অন্তঃকরণ যত প্রশস্ত ও প্রফুল্ল হয় নফস তত সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ নফসের চাহিদা অনুযায়ী মানুষ যতই অসৎ কাজ করতে থাকে ততই অসৎ প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে সৎ প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে নফসের বিরুদ্ধাচরণে অন্তরের নির্দেশ অনুযায়ী যতই নেক কাজ করতে থাকবে, ততই অন্তঃকরণ অর্থাৎ সৎপ্রবৃত্তি সবল হতে থাকবে এবং নফস অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তি দুর্বল ও নিস্তেজ হতে থাকবে।
সংখ্যার আধিক্য দ্বারা জিকিরের বিচার হয় না, বরং সংসারের মোহ এবং আল্লাহ তায়ালার দিকে রুজু করে সামান্য জিকির করলেই তা আল্লাহ তায়ালার কাছে জিকির বলে গণ্য হয়।
নিজের নফসকে ভুলতে পারলেই আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সর্বদা তাঁকে স্মরণ রাখা যায়। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা হতে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করতে পারে, সে অমরত্ব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি নিজের অস্তিত্ব হতে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করে, সে নিজের অস্তিত্বকে লুপ্ত ও বিলীন করে দেয়।
আরেফ লোকের অন্তঃকরণ সেই চেরাগের মত যা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার আয়নায় তৈরী লণ্ঠনের মধ্যে রক্ষিত আছে। তার আলো সমগ্র ফেরেশতা জগতকে আলোকিত করে রেখেছে। যে অন্তঃকরণের এরূপ অবস্থা তার আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার আশঙ্কা কিসের।
তাঁর জনৈক মুরিদ সফরে যাওয়ার কালে তাঁর কাছে আরজ করল, আমাকে কিছু উপদেশ দান করুন। তিনি বললেন, আমি তোমাকে তিনটি উপদেশ দান করছি, তদনুযায়ী আমল করো। ১. কোন অসৎ স্বভাব লোকের সাথে ঘটনাক্রমে তোমার সাক্ষাৎ হলে তুমি সৎ স্বভাব শিক্ষা করবে, তাতে তোমার আনন্দ স্থায়ী থাকবে, নষ্ট হবে না। ২. কেহ তোমাকে কিছু দান করলে প্রথমে আল্লাহ তায়ালার শোকরগুজারী করবে, তৎপর সেই দাতা ব্যক্তির শোকর করবে যার অন্তঃকরণকে আল্লাহ তায়ালা তোমার প্রতি সদয় করে দিয়েছেন। ৩. তুমি কোন সময় কোন বিপদের সম্মুখীন হলে তখন নিজের অক্ষমতা স্বীকার করিও এবং আল্লাহ পাকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করিও। কেননা তাঁর সাহায্য না হলে তুমি উক্ত বিপদে সবর করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালার দরবারে এর কোন পরোয়া নেই।
তিনি বলেছেন, আমি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উপর এত সন্তুষ্ট যে, যদি তিনি কোন বান্দাকে চিরতরে সর্বোচ্চ বেহেশতে দাখেল করেন আর আমাকে চিরতরে দোযখের সর্ব নিম্ন স্তরে আবদ্ধ রাখেন তথাপি আমি তাঁর উপর খুব সন্তুষ্ট এবং খুশি থাকব।
লোকে তাঁকে বলল, বান্দা কামালিয়তের স্তরে কখন পৌঁছতে পারে? তিনি বললেন, বান্দা যখন নিজের দোষ-ত্র“টি চিনতে ও বুঝতে পারে এবং সমস্ত মানুষ থেকে নিজেকে উঠায়ে নেয়, তখন আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তিকে তার বাসনা অনুযায়ী এবং তাঁর নফস থেকে তার দূরুত্ব অনুযায়ী নিজের সান্নিধ্য দান করে থাকেন।
দরবেশ কে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি অন্তরের এক নিভৃত কোণে প্রবেশ করে একটি মণিকোঠার সন্ধান পেয়েছে এবং সেখানে হাতড়ায়ে একটি রত্ন প্রাপ্ত হয়েছে। এই রত্নই মহব্বত বা প্রেম, যিনি এই মহব্বত রূপ রত্ন লাভ করেছেন, তিনিই দরবেশ।
লোকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, মানুষ আল্লাহ তায়ালা পর্যন্ত কিরূপে পৌঁছতে পারে? তিনি বললেন, বাতেনী মৃত্যু অর্থাৎ জীবিত থেকেও সমস্ত কামনা বাসনার বিলোপ সাধন দ্বারাই সৌভাগ্য লাভ হয়।
জিজ্ঞাসা করা হল, হযরত আপনি এই উচ্চ মর্যাদা কেমন করে লাভ করিয়াছেন? তিনি বললেন, আমি দুনিয়ার যাবতীয় ভোগের সামগ্রী একত্রিত করে অল্পে তুষ্টির শিকলে বেধে ফেলেছি এবং খাঁটি তাওয়াক্কুলের উপর নির্ভর করে তৎসমুদয়কে নিরাশার দরিয়ায় নিক্ষেপ করেছি।
তাঁকে নামাজ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করতে বলা হলে তিনি বললেন, নামাজ অর্থ আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলন, কিন্তু আল্লাহ ভিন্ন অপরাপর সব কিছুর সম্পর্ক ছিন্ন করা ব্যতীত আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলিত হওয়া সম্ভব নয়।
আপনি অনাহারে থাকার প্রশংসা কেন করে থাকেন? জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ফেরাউন যদি অনাহারে থাকত তবে, “আমি তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ খোদা” বলত না। অহংকারী ব্যক্তি কোন দিন মারেফাতের ঘ্রাণ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারবে না।
অহংকারী কে? প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, সেই ব্যক্তি অহংকারী, যে ব্যক্তি আঠার হাজার আলমের মধ্যে কোন নফসকে নিজের নফসের চেয়ে অধিক নাপাক বলে মনে করে।
লোকটি বলল, আপনি খুব কারামতওয়ালা। কেননা আপনি পানির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন। তিনি বললেন, এটা কোন কারামত নয়, কেননা, তুচ্ছ একখণ্ড  লাকড়ীও পানির উপর দিয়ে ভেসে যেতে পারে। লোকে বলল, তবে এটা নিশ্চয়ই আপনার বড় কারামত যে, বাতাসের উপর দিয়ে উড়ে যেতে পারেন। তিনি বললেন, এটাও কোন কারামত নয়, কেননা তুচ্ছ মথ নামক পতঙ্গও উড়ে বেড়ায়। লোকে বলল, এগুলো কারামত না হলেও এটা অবশ্যই খুব বড় কারামত হবে যে, আপনি এক রাতের মধ্যে মক্কা-মোয়াজ্জমায় পৌঁছে যান। তিনি বললেন, এটা কিসের কারামত? একজন জাদুকরও এক রাতের মধ্যে হিন্দুস্তান থেকে দেমাওয়ান্দ পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছে থাকে।
আমি যখন নিজ জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহকে চিনলাম, তখন মনে করলাম এতটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট। আর যখন আমি তাঁকে তাঁর অনুগ্রহে চিনলাম, তখন বললাম, আমার আরও উন্নতি করা দরকার। এতটুকু আমার জন্য যথেষ্ট নয়।
আমি আমার অঙ্গ প্রতঙ্গ সমূহকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে মশগুল করতাম এবং কোন একটি অঙ্গকে কিঞ্চিত অলস ও গাফেল দেখতে পেলে তৎক্ষণাৎ অন্য অঙ্গকে তার স্থানে মশগুল করে দিতাম। এরূপে ক্রমে ক্রমে আমি বায়েজিদ হয়ে গেলাম।
আল্লাহ তায়ালা সমস্ত মানুষের অন্তরের গোপন অবস্থা সম্বন্ধে অবগত আছেন। যে দিকে দৃষ্টি করেন নিজের মহব্বত থেকে শূন্য দেখতে পান। কিন্তু বায়েজিদের অন্তরের দিকে দৃষ্টি করলে তাকে নিজের মহব্বতে পরিপূর্ণ দেখতে পান।
ইন্তেকাল : হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ প্রথম প্রথম আল্লাহ আল্লাহ শব্দ খুব বেশি পরিমাণে জিকির করতেন। শেষকালে যখন তাঁর মৃত্যু যন্ত্রণা উপস্থিত হল, তখনও তিনি সেই প্রাথমিক কালের ন্যায় প্রচুর পরিমাণে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতে লাগলেন। অতঃপর বলতে লাগলেন, পরওয়ার দেগার আমি কখনও গাফলত অমনোযোগিতা ভিন্ন আপনাকে স্মরণ করিনি। আর এখন আমি আমার প্রাণ পাখি উড্ডয়নের পথে, এখনও আমি আপনার ইবাদত থেকে গাফেল। জানি না, আমার অন্তঃকরণ আপনার দরবারে হাজির হওয়ার ভাগ্য কখন লাভ করতে পারবে? এই শব্দগুলো তাঁর মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল। এমনি সময় তাঁর প্রাণবায়ু আল্লাহ পাকের দরবারে উড়ে গেল। তখন হিজরি ১৩৩৪ সন এবং তাঁর বয়স ছিল ৭৪ বছর।

কুতুবে যামান শায়খ আবুল হাসান খারকানী রাঃ

জন্ম- ১৫৩  হিজরী, ওফাৎ- ২০৩ হিজরী। মাযার শরীফ- খেরকান।
হযরত আবুল হাসান আলী খেরকানী বিশ্বাসে ও ইয়াকীনে পর্বতের মত অচল অটল ছিলেন। তিনি সুলতানুল মাশায়েখ এবং আবদাল ও আওতাদগণের কুতুব ছিলেন। তরিকত ও হাকীকতপন্থীদের অগ্রনায়ক ছিলেন। তিনি পর্বত তুল্য গুরুগম্ভীর এবং তরিকত, মারেফত ও তওহীদে সাতিশয় কামেল ছিলেন। সর্বদা রিয়াজত এবং সাধ্যসাধনায় নিজের দেহকে নিয়োজিত এবং মনকে সর্বদা আল্লাহ তায়ালার ফেকেরে ধ্যানে মশগুল রাখতেন। তিনি অত্যন্ত বেপরোয়া ধরনের উচ্চসাহস ছিল অতি উচ্চ মর্যাদাশালী বুযুর্গ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল অতি উচ্চ পর্যায়ের। আল্লাহ তায়ালার দরবারে তাঁর আবদার এত নির্ভীক ছিল যে, তা বর্ণনাতীত।
প্রতি বছর হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ দাহিস্তানের জিয়ারতে যেতেন। সেখানে বহু শহীদানের মাজার ছিল। যখন তিনি খেরকান অতিক্রম করতেন, তখন তিনি সেখানে থেমে নিঃশ্বাস উপরের দিকে টানতেন যেন, কোন কিছুর ঘ্রাণ নিচ্ছেন। সঙ্গীয় মুরিদগণ তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, হযরত ! আমরা তো কোন কিছুর ঘ্রাণ পাচ্ছি না, আপনি কিসের ঘ্রাণ নিচ্ছেন? তিনি বললেন, এই চোরদের গ্রাম থেকে একজন লোকের ঘ্রাণ আমি পাচ্ছি। তিনি আমার চেয়ে তিন স্তর উচ্চে হবেন। পরিবার-পরিজনের বোঝাও বহন করবেন, কৃষি এবং বাগিচাও করবেন।
হযরত আবুল হাসান খেরকানী রাঃ প্রথম জীবনে ২০ বছর যাবৎ এই অভ্যাস করেছিলেন যে, খেরকানে এশার নামাজ জামাতের সাথে আদায়ের পর হযরত বায়েজিদ রাঃ এর মাজার শরীফ জেয়ারত করার জন্য বোস্তামে গমন করতেন। সেখানে পৌঁছায়ে মাজারের পাশে দাঁড়ায়ে দোয়া করতেন, এলাহী ! যে নেয়ামত ও খেলআৎ আপনি হযরত বায়েজিদ রাঃ কে দান করেছেন তার কিছু অংশ আমাকেও দান করুন। এরূপ দোয়া করে তিনি রাতেই খেরকানে ফিরে আসতেন এবং এশার নামাজের অজু দ্বারাই ফজরে নামাজ আদায় করতেন। তিনি হযরত বায়েজিদ রাঃ এর মাজার থেকে প্রত্যাবর্তন কালে মাজারের দিকে মুখ রেখে উল্টা পায়ে পিছনের দিকে হেঁটে খেরকানে পৌঁছাতেন। বার বছর এই নিয়ম পালন করার পর একদিন হযরত বায়েজিদ রাঃ এর মাজার থেকে আওয়াজ আসল, হে আবুল হাসান ! এখন তোমার একস্থানে বসে পড়ার সময় এসেছে। হযরত আবুল হাসান রাঃ বললেন, হে বায়েজিদ রাঃ ! হিম্মত দান করুন, আমি মূর্খ, শরীয়তের গূঢ়তত্ত্ব সম্বন্ধে তেমন বেশি জানি না। আবার মাজার থেকে আওয়াজ আসল, হে আবুল হাসান ! আমাকে যা কিছু দান করা হয়েছে তা তোমার বদৌলতে হয়েছে। হযরত আবুল হাসান রাঃ বললেন, আপনি ছিলেন আমার ঊনচল্লিশ বছর পূর্বে। আমার বদৌলতে আপনাকে দান করার অর্থ কি? আওয়াজ আসল, ব্যাপার এরূপই বটে। আমি খেরকান হয়ে কোথাও যাবার সময় সেখান থেকে এক নূর আসমানের েিদক উঠতে দেখতান।
আমি ত্রিশ বছর ধরে আল্লাহ তায়ালার কাছে একটি মাকসুদ চাইতাম, কিন্তু তা পূর্ণ হত না। অবশেষে একদিন আমার প্রতি এলহাম হল, হে বায়েজিদ ! এই নূরের মর্যাদাকে তোমার মকসূদ পূর্ণ করার জন্য আমার দরবারে সুপারিশকারী রূপে পেশ কর। আমি তাই করলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার মকসুদ পূর্ণ হয়ে গেল।
হযরত আবুল হাসান খেরকানী রাঃ এর একটি বাগান ছিল। একবার তিনি বেলচা দ্বারা বাগানে কোন বৃক্ষমূল খুড়লে তা থেকে রৌপ্য বের হল। তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবার খনন করলেন। এবার স্বর্ণ বের হল। সেদিকেও তিনি দৃষ্টিপাত না করে আবার খনন করলেন। এবারে বহু মূল্যবান হীরা জওরাতাদি বের হল। তখন তিনি বললেন, হে খোদা ! আবুল হাসান এসবে ভুলবে না। আমি দ্বীন ও দুনিয়া উভয় প্রাপ্ত হলেও আপনাকেও ভুলব না। আপনা থেকে মুখ ফিরাব না। কখনও এমন হত যে, ভূমি চাষ করার জন্য ক্ষেতে তিনি গরু দ্বারা হাল জুড়াতেন। নামাজের ওয়াক্ত হলে তিনি হাল খাড়া করে নামাজ পড়ে চলে যেতেন। গরু পূর্বের মত লাঙ্গল টেনে চলত। তিনি নামাজ শেষ করে ক্ষেতে আসলে দেখতেন ক্ষেত প্রস্তুত।
একদল লোক সফরে যাওয়ার সময় হযরত আবুল হাসান রাঃ এর কাছে এসে বলল, হযরত ! আমাদের রাস্তা ভয়সঙ্কুল আপনি আমারেদ এমন কিছু দোয়া শিখায়ে দিন যার বরকতে আমরা সমস্ত বিপদ আপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারি। তিনি বললেন, তোমরা কোন বিপদের সম্মুখীন হলে আবুল হাসানকে স্মরণ করিও। সেই দলের লোকেরা এই কথাটি পছন্দ করল না, তারা যাত্রা করল। ঘটনাক্রমে পথে ডাকাতের দল তাদের ঘিরে ফেলল এবং সকলের ধনমাল লুণ্ঠন করতে আরম্ভ করবে, এমন সময় হঠাৎ সে নিজের মাল এবং সওয়ারীসহ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কোন পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না। মোটকথা, সেই লোকটি বেঁচে গেল, আর অন্যান্য সকলেই লুণ্ঠিত হল। ডাকাতেরা চলে যাওয়ার পর যাত্রীদের লোকেরা  সেই লোকটিকে সম্পূর্ণ নিরাপদ দেখতে পেল। জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে যে, তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকলে? সে বলল, আমি শেখ আবুল হাসান রাঃ কে স্মরণ করেছিলাম। অতঃপর সে সমস্ত ঘটনা বিশদভাবে বলল। সেই যাত্রীদল হযরত খেকানী রাঃ এর কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করল, হযরত ! আল্লাহর ওয়াস্তে আদাদের বলুন এর রহস্য কি? আমরা সকলে আল্লাহ তায়ালাকে ডাকতেছিলাম কিন্তু রক্ষা পেলাম না। আর এই ব্যক্তি আপনাকে স্মরণ করল এবং রক্ষা পেল। তিনি বললেন, ভাই তোমরা তো আল্লাহ তায়ালাকে শুধু মুখে ডাক, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ডাক না, পক্ষান্তরে আবুল হাসান অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ডাকে। অতএব, তোমরা আবুল হাসানকে স্মরণ কর। তা হলে আবুল হাসান তোমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালাকে ডাকবে এবং তোমরা নিজেদের উদ্দেশ্যে সফলকাম হয়ে যাবে। কেননা, অন্তর থেকে না ডাকলে শুধু মুখে অভ্যাস অনুযায়ী সহস্রবারও যদি আল্লাহকে ডাক তবে কোনই ফল হবে না।
একবার তাঁর এক মুরিদ তাঁর কাছে এসে অনুমতি চাইল যে, আমি লেবান পাহাড়ে গিয়ে কুতবে আলমের জিয়ারত করতে ইচ্ছা করি। তিনি তাঁকে অনুমতি দান করলেন। লেবান পাহাড়ে গিয়ে সে দেখল, একদল লোক কেবলামুখী হয়ে বসে আছে। তাদের সামনে একটি লাশ জানাজার নামাজের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু জানাজার নামাজ পড়া হচ্ছে না। উক্ত মুরিদ জিজ্ঞাসা করল, আপনারা এই জানাজার নামাজ কেন পড়ছেন না? তাদের একজন উত্তর দিল, ভাই ! আমরা কুতবে আলমের জন্য অপেক্ষা করছি। কেননা, এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেই কুতবে আলম ইমামত করে থাকেন। মুরিদ তা শুনে খুব আনন্দিত হল এবং মনে মনে বলল, আমি তো কুতবে আলমের জিয়ারতে এসেছি, আর এখন স্বচক্ষে তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাব। একটু পরেই সকলে দাঁড়ায়ে গেল, মুরিদ ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল, হযরত আবুল হাসান রাঃই ইমামের স্থানে দাঁড়ায়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলতেছেন। তা দেখে মুরিদ ভয়ের আতিশয্যে মুর্ছিত হয়ে পড়ল। অতঃপর তার জ্ঞান ফিরে আসলে দেখতে পেল মুর্দারকে দাফনও করা হয়ে গেছে এবং হযরত আবুল হাসান রাঃও চলে গেছেন। মুরিদ বিশ্বাসই করতে পারল না যে তিনিই আবুল হাসান রাঃ ছিলেন। সে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করল, তিনি কে ছিলেন? তারা বলল, তুমি তো বড়ই নাদান। জান না, তিনি তো আবুল হাসান খেরকানী রাঃ ছিলেন। মুরিদ পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, তিনি কি আবার আসবেন? লোকে বলল, হ্যাঁ নামাজের সময় আবার আসবেন। তখন মুরিদ কেঁদে বলতে লাগল, আমি তাঁর মুরিদ। হায় ! তাঁর সামনে আমি বেয়াদবী মূলক কথা বলেছি। আপনারা আমার হয়ে তাঁর খেদমতে সুপারিশ করে দিন, তিনি যেন আমাকে খেরকানে নিয়ে যান। কেননা আমি দীর্ঘদিন যাবত সফরে আছি। নামাজের সময় তিনি তশরিফ আনলেন, মুরিদ হযরত শেখকে দেখা মাত্র তাঁকে সালাম করল এবং তাঁর আঁচল ধরে কাঁদতে লাগল, ভয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না।
তিনি বললেন, এই শর্তে তোমাকে খেরকানে ফিরে যাওযার অনুমতি দেয়া যেতে পারে যে, তুমি যা কিছু দেখলে তা তারও কাছে প্রকাশ করবে না। আমি আল্লাহ পাকের দরবারে আব্দার করেছি, তিনি যেন তা জগতে মানুষের কাছে আমাকে গোপন রাখেন। আর একমাত্র বায়েজিদ রাঃ ব্যতীত কোন মানুষ আমাকে দেখতে না পায়। কেননা, তিনি ইহজগতে জীবিত আছেন।
এক ব্যক্তি হাদিস শুনার জন্য ইরাকে গমন করতে তাঁর পরামর্শ চাইল। তিনি বললেন, ইরাক গিয়ে কি করবে? এখানেই কারও কাছে পড়ে নাও। সে বলল, হযরত ! এখানে তো তেমন কোন মুহাদ্দেস দেখতে পাচ্ছি না। ইরাকে বহু বিখ্যাত ও নামকরা মুহাদ্দেস আছেন। তিনি বললেন, ভাই ! আমিই তো একজন মূর্খ ও নিরক্ষর লোক। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সবকিছু দান করেছেন। কিন্তু এই সমস্ত এহসান প্রচার করে বেড়াই না, তবে হ্যাঁ নিজের এলম থেকে আমাকে যা কিছু দান করেছেন, তার এহসান অনে ক কিছু বর্ণনা  করেছেন। লোকটি বলল, হযরত ! আপনি হাদিস কার কাছে পড়েছেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকট থেকে। তার মনে এই কথার প্রতি বিশ্বাস হল না। রাত্রে ঘুমালে হুজুরে আকরাম সাঃ কে স্বপ্নে দেখল যে, তিনি বলছেন, আবুল হাসান ঠিক কথাই বলেছেন। পরবর্তী দিন লোকটি আবার তাঁর খেদমতে গমন করল এবং তাঁর কাছে হাদিস পড়তে আরম্ভ করল। কোন কোন সময় তিনি কোন কোন হাদিস সম্বন্ধে বলতেন, এটা হুজুর সাঃ এর হাদিস নয়। লোকটি জিজ্ঞাসা করত, হযরত ! আপনি তা কেমন করে জানতে পারলেন? তিনি বললেন, তুমি যতক্ষণ হাদিস পড়তে থাক ততক্ষণ পর্যন্ত আমার দৃষ্টি হুজুর সাঃ এর পবিত্র ভ্রু-যুগলের প্রতি নিবদ্ধ থাকে। যখন আমি দেখতে পাই যে, হুজুর সাঃ তাঁর পবিত্র ভ্রু-কুঞ্চিত করেছেন তখনই আমি বুঝতে পারি যে, তিনি এই হাদিসটির প্রতি অসন্তুষ্ট। এটা তাঁর হাদিস নয়।

একবার শেখ আবু সাঈদ রাঃ হযরত আবুল হাসান রাঃ এর বাড়িতে আসলেন। তখন তাঁর ঘরে দুইটি রুটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তিনি বিবি সাহেবাকে বললেন, এই রুটি দুইটি একখানা চাদর দিয়ে ঢেকে দিন। তারপর যত রুটির প্রয়োজন হয় এই চাদরের নিচ থেকে বের করে দিতে থাকুন। বিবি সাহেবা সেইরূপই করলেন। সমস্ত মেহমান তৃপ্তি সহকারে আহার করলেন। কেউ কেউ ঘটনাটি এইরূপ বর্ণনা করেছেন যে, দস্তরখানে বহু লোক বসেছিল, খাদেম অনবরত সেই চাদরের নিচ থেকে রুটি এনে মেহমানদের সামনে রাখতে লাগলেন। কিন্তু শেখ সাহেবের চাদর দ্বারা ঢাকা থাকার বরকতে চাকর যতবারই চাদরের নিচে হাত দিত ততবারই তার কাছে মনে হত যেন চাদরের নিচে বহু রুটি মজুত আছে। এইরূপে সমস্ত মেহমান তৃপ্তি সহকারে আহার করার পর চাকর হঠাৎ চাদর উল্টায়ে ফেললে দেখা গেল সেখানে একটি রুটিও নেই। তা দেখে হযরত আবুল হাসান রাঃ খাদেমকে বললেন, তুমি বড় ভুল করলে। তুমি চাদর না উঠালে এইরূপে কিয়ামত পর্যন্ত চাদরের নিচ থেকে লোক রুটি নিতে পারত।
হযরত আবু আলি সীনা রাঃ হযরত আবুল হাসান রাঃ এর খ্যাতি শুনে খেরকানে আগমন করলেন। তখন তিনি কাঠ সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে গিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, শেখ কোথায়? তাঁর বিবি সাহেবা ধমক দিয়ে বললেন, এই বে-দ্বীন মিথ্যুক কে? শেখ কোথায়, শেখ কোথায়, বলে জিজ্ঞাসাকারী কে এসেছে? সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন যে, সে লাকড়ী আনতে জঙ্গলে গেছে। হযরত আবু সীনা রাঃ মনে মনে ভাবলেন, স্বামীর সাথে বিবিরই যখন এরূপ অবস্থা না জানি লোকটি কেমন? অতঃপর আবু আলি সীনা রাঃ জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলেন যে, হযরত আবুল হাসান রাঃ বাঘের পিঠে লাড়কীর বোঝা চাপায়ে ফিরে আসছেন। শেখ আবু আলি সীনা রাঃ তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। মনস্থির হওয়ার পর বললেন, হযরত বলুন তো এদিকে আপনার অবস্থা এরূপ ওদিকে আপনার বিবি সাহেবার ব্যবহার আপনার সাথে এরূপ? সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁকে বর্ণনা করে শুনালেন। হযরত আবুল হাসান রাঃ বললেন, ভাই ! আমি যদি এমন নেকড়ে বাঘিনীর বোঝা বহন না করি তবে এই বাঘ আমার বোঝা বহন করবে কেন? অতঃপর তিনি বাড়িতে আসলেন এবং আবুল হাসান রাঃ এর সাথে বহুক্ষণ কথা বললেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, আমাকে মাফ করবেন, আমাকে এই দেওয়ালটি গাঁথতে হবে। এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন এবং দেওয়ালের উপর আরোহণ করলেন। ঘটনাক্রমে তাঁর কর্নিক হাত থেকে ছুটে নিচে পড়ে গেল। হযরত আবু আলি সীনা রাঃ তা তুলে তাঁর হাতে দেয়ার জন্য উঠলেন। কিন্তু তিনি উঠতে না উঠতেই কর্নিক জমিন থেকে লাফায়ে তাঁর হাতে গিয়ে পৌঁছল। তা দেখে হযরত আবু আলি সীনা রাঃ অবাক হয়ে রইলেন এবং তাঁর অত্যন্ত ভক্ত হয়ে গেলেন।
আযদুদ্দৌলা নামে শহরে একজন উজির ছিলেন, পেটের ব্যথায় তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। শহরের সমস্ত চিকিৎসক একত্রিত হয়েও ব্যথার কোন উপশম করতে পারছিলেন না। কেউ এসে হযরত আবুল হাসান রাঃ এর জুতা নিয়ে উজিরের পেটের উপর ঘষতেই ব্যথার উপশম হল। আল্লাহ পাক সেই জুতার বরকতে উজিরের রোগমুক্ত করে দিলেন।
একবার এক ব্যক্তি তাঁর খেদমতে আরজ করল, হযরত ! আপনার খেরকা আমাকে পরায়ে দিন। তিনি বললেন, আগে একটি প্রশ্নের উত্তর দাও, তা হলে খেরকা পরায়ে দিব। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, একজন পুরুষ যদি একজন স্ত্রীলোকের চাদর দেহের মধ্যে জড়ায়ে নেয় সে কি স্ত্রীলোক হয়ে যাবে? সে বলল, কখনই না। তিনি বললেন, এইরূপ যদি কোন স্ত্রীলোক কোন পুরুষের চাদর গায়ে জড়ায়ে নেয়, সেও পুরুষ হবে না। অতএব তুমি যখন তরিকরেত পুরুষ নও তখন আমার খেরকা পরিধান করলে তোমার কোনই ফায়দা হবে না। সেই না মরদই থেকে যাবে।
এক ব্যক্তি তাঁর দরবারে এসে বলল, হযরত ! আমাকে অনুমতি দিন, আমি মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করি। তিনি বললেন, তুমি যখন মানুষকে আহ্বান করবে, সাবধান ! নিজের দিকে আহ্বান করো না। সে বলল, হযরত ! কেউ কি মানুষকে নিজের দিকে আহ্বান করতে পারে? তিনি বললেন, নে পারে না? অন্য একজন লোকে মানুষকে আল্লাহ তায়ালার দিকে আহ্বান করছে তা যদি তোমার পছন্দ না হয় এবং তুমিও আহ্বান করতে আরম্ভ কর তখন বুঝে নাও যে, তুমি মানুষকে তোমার নিজের দিকে আহ্বান করছো, আল্লাহ তায়ালার দিকে নয়।
একবার সুলতান মাহমুদ তাঁর ব্যক্তিগত খাদেম আয়াযের সঙ্গে ওয়াদা করলেন, আমি আমার পোষাক তোমাকে পরাব এবং তোমার তরবারী নিজের বক্ষের উপর রেখে গোলামের মত তোমার সামনে দাঁড়ায়ে থাকব। সুলতান মাহমুদ অতঃপর যখন হযরত শেখ আবুল হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলেন তখন খেরকানে পৌঁছায়ে হযরত শেখের দরবারে একজন দূত পাঠায়ে বলে দিলেন যে, তুমি গেয়ে হযরত শেখের কাছে আরজ করো যে, সুলতান মাহমুদ গজনী থেকে আপনার জেয়ারতের উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেছেন। আপনি অনুগ্রহ পূর্বক একটু তকলীফ স্বীকার করে বাদশাহের তাঁবু পর্যন্ত তশরীফ নিতে মর্জি করলে সুলতান যারপরনাই কৃতজ্ঞ হবেন। কিন্তু হযরত আবুল হাসান রাঃ দূতের কথাতে সম্মত না হওয়ায় দূত ফিরে গিয়ে সুলতানকে জানালে তিনি নিজে ছদ্মবেশ ধারণ করলেন এবং আরও দশজন দাসীকে পুরুষের বেশে সাজায়ে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যাত্রা করলেন। হযরত আবুল হাসান রাঃ এর খানকায় পৌঁছিয়া তিনি হযরত শেখকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললেন, তিনি ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’ বললেন, কিন্তু সম্মানের জন্য দাঁড়ালেন না। মাহমুদ ভৃত্যের পোষাকে থাকা সত্ত্বেও হযরত শেখ তাঁরই দিকে লক্ষ্য করলেন। শাহী লেবাস পরিহিত আয়াযের দিকে একটুও দৃষ্টিপাত করলেন না। মাহমুদ বললেন, আপনি বাদশাহের তাজিম করলেন না? হযরত শেখ বললেন, এই সমস্তই তো ফাঁদ, মাহমুদ বললেন, হ্যাঁ নিঃসন্দেহে সবই ফাঁদ। কিন্তু এসমস্ত ফাঁদে পেরেফতার হওয়ার পাখি আপনি নন।
অতঃপর তিনি মাহমুরেদ হাত ধরে বললেন, সামনে আসুন, মাহমুদ সামনে গিয়ে বললেন, কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আগে এ সমস্ত বেগানা স্ত্রীলোকদের বাইরে পাঠায়ে দিন। মাহমুদ ইশারা করলে দাসীরা সকলে বাইরে চলে গেল। অতঃপর মাহমুদ বললেন, হযরত ! হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাঃ এর কোন কাহিনী বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, হযরত বায়েজিদ রাঃ বলেছেন, যে আমাকে দেখেছে সে বদবখতী থেকে নিশ্চিন্ত হয়েছে। সুলতান মাহমুদ বললেন, হযরত রাসূলে পাক সাঃ থেকেও কি হযরত বায়েজিদ রাঃ এর মরতবা অধিক ছিল? আবু জহল ও আবু লাহাব আরো কতিপয় খোদা দ্রোহী কাফের বদবখতই হুযুরে আকরাম সাঃকে দেখেছিল কিন্তু যেমন বদবখত ছিল তেমন বদবখতই থেকে গেল। হযরত আবুল হাসান রাঃ বললেন, মাহমুদ দেখ, আদবের প্রতি লক্ষ্য রেখ। নিজের আধিপত্যের মধ্যে নিজের হস্তক্ষেপ সীমাবদ্ধ রাখ। এই স্থান তোমার হস্তক্ষেপের অনেক ঊর্ধ্বে। হুজুর সাঃ কে তাঁর চারজন প্রধন সাহাবী ভিন্ন আর কেহ দেখতে পায়নি। দেখ একথার প্রমাণ এই যে, আল্লাহ পাক বলেছেন, …………………….
অর্থাৎ, হে মাহবুব ! আপনি তাদেরকে দেখছেন যে, তারা আপনার প্রতি দৃষ্টিপাত করছে, কিন্তু তারা আপনাকে দেখতে পায় না। মাহমুদের এই কথাটি পছন্দ হল। তিনি নীরব হয়ে গেলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে কিছু নসিহত করুন। তিনি বললেন, ক. আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ থেকে দূরে থেক। খ. জামাতের সাথে নামাজ আদায় কর। গ. গরিব-দুঃখীকে দান কর। ঘ. আল্লাহ তায়ালার বান্দদের প্রতি দয়া কর। মাহমুদ বললেন, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। তিনি বললেন, আমি নিজেই সর্বদা এই দোয়া করে থাকি। ………………………
অর্থ- হে খোদা ! সমস্ত মুমিন নর-নারীদের ক্ষমা করে দিন। মাহমুদ বললেন, খাস আমার জন্য কিছু দোয়া করুন। তিনি বললেন, হে মাহমুদ, তোমার পরিণাম মাহমুদ অর্থাৎ প্রশংসনীয় হোক। অতঃপর মাহমুদ আশরাফীর একটি থলি তাঁকে দান করলেন। তিনি যবের কিছু শুষ্ক রুটি মাহমুদের সামনে রেখে বললেন, খাও। মাহমুদ তাঁর এরশাদ অনুযায়ী এক টুকরা রুটি ছিড়ে মুখে দিয়ে অনেকক্ষণ চিবালেন। কিন্তু তা গলার নিচে নামল না। হযরত আবুল হাসান রাঃ বললেন, সম্ভবত তোমার গলায় ঠেকছে। মাহমুদ বললেন, হাঁ। তিনি বললেন, তুমি চাচ্ছো যে, এই আশরাফীগুলোও এইরূপেই আমার গলায় ঠেকুক। এই গুলো উঠায়ে নাও, আমি অনেক দিন আগে তালাক দিয়েছি। মাহমুদ বললেন, সামান্য কিছু কবুল করুন। তিনি বললেন, না আমি কিছুই গ্রহণ করব না। অতঃপর মাহমুদ বললেন, আচ্ছা ! আপনার কিছু তাবারুক আমাকে দান করুন। তিনি নিজের একটি পিরাহান মাহমুদকে দান করলেন। মাহমুদ বিদায় গ্রহণের সময় বললেন, আপনার খানকাহটি খুবই ভাল লাগে। তিনি বললেন, এত বড় রাজ্য থাকতে আবার ফকিরের এই কুটিরও কি চাও?
অতঃপর তিনি সুলতানের বিদায় গ্রহণকালে উঠে দাঁড়ালেন। মাহমুদ বললেন, হযরত ! আমি যখন আপনার খানকায় আসলাম তখন আপনি আমার দিকে লক্ষ্যই করলেন না। এখন এই তাজিমের অর্থ কি? এই অনুগ্রহ ও দয়ার কারণ কি? আর সেই বেপরোয়া ভাবেরই বা কারণ কি ছিল? তিনি বললেন, আগমনের সময় তুমি বাদশাহীতে মোহাবিষ্ট থেকে আমার পরীক্ষা করতে এসেছিলে। আর এখন যাওযার সময় বিনয় ও দরবেশীর সাথে যাইতেছ। দরবেশীর সূযর্র্ং তোমার উপর কিরণ দান করছে। এই কারণেই প্রথমে তোমার বাদশাহী ভাবের কারণে আমি তোমার তাজিমের জন্য দাঁড়াইনি। এখন তোমার দরবেশীর কারণে তোমার সম্মান করছি। অতঃপর সুলতান মাহমুদ চলে গেলেন।
কথিত আছে, সুলতান মাহমুদ যখন সোমনাথের মন্দির আক্রমণ করলেন, তখন তিনি শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হবে ভেবে ভীত হয়ে পড়লেন। কেননা, শত্র“পক্ষ বড়ই শক্তিশালী এবং নির্ভীক দেখা গেল। হঠাৎ সুলতান মাহমুদ কিছু ভেবে তাড়াতাড়ি ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন এবং এক নির্জন কোণে গিয়ে সেজদায় পড়ে মাটিতে মুখ ঘষতে লাগলেন। আর আবুল হাসান রাঃ এর দেয়া পিরহানটি হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন, এলাহী ! এই খেরকার মালিকের ইজ্জতের সদকা স্বরূপ আমাকে এই শত্র“দের উপর জয়ী করুন। এই যুদ্ধে যা কিছু গণিমতের মাল আমি পাব সব কিছুই আমি দরবেশদের দান করব। দোয়া শেষ হতে না হতেই হঠাৎ শত্র“ সৈন্যদের মধ্যে হট্টগোল এবং বিভেদ সৃষ্টি হল। সে রাতে সুলতান মাহমুদ স্বপ্নে দেখলেন যে, হযরত আবুল হাসান রাঃ তাঁকে বলছেন, হে মাহমুদ ! তুমি এই সামান্য কাজের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে আমার খেরকার উসিলা ধরেছ, তা ভাল করনি। ওরে গাফেল ! যদি তুমি আমার খেরকার উসিলা ধরে সমস্ত কাফেরদের মুসলমান হয়ে যাওয়ার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করতে তবে সকলেই মুসলমান হয়ে যেত।
হযরত আবুল হাসান রাঃ চল্লিশ বছর পর্যন্ত বালিশে মাথা রাখেননি। অনবরত এশার নামাজের অজু দিয়ে ফজরের নামাজ পড়তেন। হঠাৎ একদিন তিনি বললেন, আমি আরাম করব। বালিশ আন, মুরিদেরা একথা শুনে আনন্দিত হল এবং জিজ্ঞাসা করল, হযরত ! আজ কি? তিনি বললেন, আজ রাতে আবুল হাসান চাক্ষুষভাবে দর্শন করেছে যে, আল্লাহ তায়ালা কারও ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন। তিনি এতে সম্পূর্ণ বেপরোয়া। তিনি আরো বললেন, ত্রিশ বছর হয়ে গেল কখনও আল্লাহ তায়ালার চিন্তা ভিন্ন অন্য কোন চিন্তাই আমার মনে স্থান পায়নি।

একদিন একজন গুদড়ীপরা সূফী শূন্যমণ্ডল থেকে নেমে হযরত আবুল হাসান খেরকানী রাঃ এর সামনে দাঁড়ায়ে বলতে লাগল, আমি এই জামানার জুনাইদ, আমি এই জামানার শিবলী। তৎক্ষণাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং জমিনের উপর পদাঘাত করতে করতে বলতে লাগলেন, আমি এই যুগের খোদা। আমি এই যুগের মোস্তফা। প্রকাশ থাকে যে, এর অর্থ ঠিক তাই যা আমরা মুনসুর হাল্লাজ রাঃ এর ‘আনাল হক’ অর্থ আমিই খোদা বাক্যের বিস্তারিত বলে এসেছি যে, তা আল্লাহ পাকের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার অবস্থার কথা। আউলিয়ায়ে কেরাম থেকে সুন্নতের খেলাপ কোন কাজ প্রকাশ পেলেও তাঁদের তিরস্কার করা বা তাঁদের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা পোষণ করা উচিত নয়। যেমন হুজুর আকরাম সাঃ বলেছেন, আমি ইয়ামেনের দিক থেকে আল্লাহ পাকের নিঃশ্বাস পাচ্ছি।
একরাতে তিনি নামাজে মগ্ন ছিলেন। এক গায়েবী আওয়াজ আসল, “হে আবুল হাসান ! তুমি কি চাও যে, তোমার সম্বন্ধে আমি যা জানি তা মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেই, তাহলে মানুষ তোমাকে পাথর মেরে ধ্বংস করে দিবে।” তিনি বললেন, খোদাওয়ান্দ করিম ! আপনি কি চান যে, আপনার রহমত এবং দয়া গুণ সম্বন্ধে যা কিছু জানি তা আমি মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেই? তাহলে কোন মানুষই আর আপনার ইবাদত এবং আপনাকে সেজদা করবে না। হযরত আবুল হাসান রাঃ বললেন, অতঃপর আমি শুনতে পেলাম, তুমিও আমার সম্বন্ধে কিছু বলো না, আমিও তোমার সম্বন্ধে কিছু বলব না।” (তা ছিল ভালবাসা সূচক বাক্যালাপ)
একবার তিনি সেজদায় পতিত হয়ে বলতে লাগলেন, এলাহী ! আপনি মালাকুল মউতকে আমার কাছে প্রেরণ করবেন না, আমি আমার জান তার হাতে দিব না। কেননা, আমি জান তার কাছ থেকে গ্রহণ করিনি। তার হাতে প্রত্যার্পণও করব না। আমি জান আপনার হাত থেকে নিয়েছি, আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিব না।
অমিয়বাণী :
হযরত আবুল হাসান খেরকানী রাঃ বলেছেন,
আমি তিনটি বস্তুর সীমা জানতে পারলাম নাÑ ক. হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মর্যাদার সীমা, খ. নফসের ধোঁকাবাজীর সীমা, গ. মারেফাতের শেষ সীমা।
আমি অন্তরকে দুনিয়া ও আখেরাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছি এবং আল্লাহ তায়ালার দিকে ফিরায়ে দিয়েছি।
আমার মধ্যে এশকে এলাহীর যে ব্যথা বিদ্যমান আছে, তার এক ফোঁটাও যদি প্রকাশ পায়, তবে দুনিয়াতে নূহ আঃ এর তুফানের ন্যায় তুফাত উত্থিত হবে।
হে আমার মুরিদগণ ! আদম আঃ থেকে আজ পর্যন্ত এবং আজ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা সমস্ত পীরদের সাথে যত সদ্ব্যবহার করেছেন, একমাত্র তোমাদের পীরের সাথে তত সদ্ব্যবহার করেছেন। আর যত ভাল ব্যবহার সমস্ত পীরের মুরিদের সঙ্গে করেছেন, তত ভাল ব্যবহার একমাত্র তোমাদের জন্য করেছেন।
প্রত্যেক রাতে মাগরিবের নামাজ থেকে আরম্ভ করে আমি আরাম করি না, যে পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালাকে আমার সারা দিনের হিসাব নিকাশ চুকায়ে না দেই।
লোকে বলে থাকে আমি উমুক ইমাম। আমি বলি, তোমরা স্মরণ রেখ, আরশ থেকে তাহতাসসারা পর্যন্ত এবং পূর্ব থেকে পর্যন্ত সমস্ত মাখলুকের যাবতীয় অবস্থা পুংখানুপুঙ্খরূপে জানতে না পারা পর্যন্ত কেহ ইমাম হতে পারে না।
তিনি বলেছেন, আমি মাতৃগর্ভেই খোদার প্রেমানলে জ্বলে ছাই হয়ে গিয়েছি, জামিনের উপর এসে গলে গিয়েছি, বালেগ হওয়ার সময় বৃদ্ধ হয়েছি।
তিনি বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বন্ধুদের এমন স্তরে রাখেন যে, সেখানে কোন মাখলুক গিয়ে পৌঁছতে পারে না। আবুল হাসান এ বিষয়ে যা বলছে সত্যই বলছে। আমি যদি আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীর কিছু আলোচনা করি, তবে সাধারণ লোকেরা আমাকে পাগল বলবে। যা কিছু আমি খেয়েছি, পরেছি, দেখেছি এবং শুনেছি, আর যা কিছু তিনি পয়দা করেছেন কোন বস্তু হইতে আমার জন্য পর্দা রাখেননি।
আল্লাহ তায়ালা আমাকে বলেছেন, তোমাকে আমি কোন বদবখতকে দেখাব না। কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিকে দেখাব, যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসে, আমিও তাকে ভালবাসি। এখন আমি দেখছি, কাকে কাকে আনা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যে ব্যক্তিকে আনা হয়েছে, কাল কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তিকে আমার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাজির করা হবে। আমি বললাম, এলাহী আমাকে আপনার কাছে উঠায়ে নেন। আওয়াজ আসল, হে আবুল হাসান ! তোমার প্রতি আমার আদেশ, তোমাকে এইরূপে রাখছি, যেন আমার বন্ধুরা এসে তোমার দর্শন লাভ করে। তোমার স্তর পর্যন্ত এসে পৌঁছতে না পারলে তোমার নামই তাদের শুনাব এবং নাম শুনে তারা তোমাকে মহব্বত করবে। কেননা, আমি তোমাকে নিজের পবিত্রতা দ্বারা পয়দা করেছি। অতএব, যারা পাক তারাই তোমাকে ভালবাসবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাকে যে পর্যন্ত বন্ধুরূপে গ্রহণ না করেছেন, সে পর্যন্ত আমাকে মানুষের বন্ধু করেননি।
সমস্ত ইবাদত এবং কারামতের সওয়াব প্রকাশ্যে, কিন্তু আল্লাহ পাকের ওয়াস্তে আউলিয়ায়ে কেরামের জিকিরের সওয়াব ও বিনিময় প্রকাশ্য নয়।
পঞ্চাশ বছর ধরে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছি যে, আমার অন্তর এবং জবান সেই কথার কোন খবর রাখে না।
তিয়াত্তর বছর আমি আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে এমনভাবে জীবন যাপন করছি যে, একটি সেজদাও শরিয়তের খেলাপ করিনি এবং একটি নিঃশ্বাসও নফসের অনুকূলে ফেলিনি।
আল্লাহ তায়ালা হইতে আমি একটি আওয়াজ শুনলাম, হে আমার বান্দাগণ ! যদি চিন্তা সহকারে আমার কাছে আগমন কর, তবে আমি তোমাদের সন্তুষ্ট করব। আর যদি ফকিরি ও অভাবের সাথে আগমন কর, তবে আমি তোমাদের ধনী করে দিব। আর যখন নিজেদের অস্তিত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে হাত তুলে ফেল, তখন আমি পানি এবং বায়ুকে তোমাদের আদেশের অধীন করে দিব।
একবার আল্লাহ তায়ালা সমগ্র দুনিয়ার সমস্ত ধনভাণ্ডার আমাকে দেখাবার জন্য আমার সামনে হাজির করলে আমি বললাম, হে খোদওয়ান্দ ! আমি তা দ্বারা প্রতারিত হব না। তখন আল্লাহ পাকের দরবার থেকে সম্বোধন হল, হে আবুল হাসান ! দুনিয়া এবং আখেরাতের কোনটির কোন অংশ তোমার নেই, এতদুভয়ের বিনিময়ে তোমার জন্য আমিই রয়েছি।
আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে আমার চোখের সামনে গুনাহরূপে দেখায়েছেন।
আমি যখন দুনিয়াকে বর্জন করেছি, তখন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও আর কোন দিন দুনিয়ার দিকে যাইনি। আর যখন থেকে আমি মুখে আল্লাহ বলেছি, তখন থেকে আমি কোন সৃষ্ট পদার্থের প্রতি মনোনিবেশ করিনি।
আমি নিজের অস্তিত্ব থেকে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজেকে পানিতে নিক্ষেপ করলামÑ ডুবলাম না। আগুনে ফেললামÑ জ্বললাম না। চার মাস দশ দিন পানাহার ত্যাগ করে থাকলাম- মরলাম না। অবশেষে আমার মস্তক অক্ষমতার চৌকাঠের উপর রাখলাম, তখন এমন প্রশস্ততা পেলাম এবং এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছলাম তা বর্ণনাতীত।
আমি আবেদও নই, জাহেদও নই, আলেমও নই, সূফীও নই। হে খোদা ! আপনি একক, আমি আপনার সেই এককত্বের মধ্যে নিমজ্জিত একটি অপদার্থ।
সে ব্যক্তি কেমন করে আল্লাহর পথের পথিক হতে পারে যে আসমান, জমিন এবং পাহাড়ের মত ধীরস্থির ভাবে খেদমতে দণ্ডায়মান না থাকে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে নেককারীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য করতে প্রয়াস পায় সে নেককার নয়, কেননা, নেকী আল্লাহ পাকের গুণ।
যে পর্যন্ত আল্লাহ জাল্লা শানহু ছাড়া অন্যান্য বস্তুর প্রতি আমার লক্ষ্য ছিল, তৎপর্যন্ত আমার কোন আমলের মধ্যে এখলাছ হয়নি। যখন আমি সমস্ত সৃষ্ট পদর্শ থেকৈ গায়েব হয়ে গেলাম এবং সব কিছু আল্লাহ পাকের মধ্যেই দেখলাম, তখন আমার সকল কাজে এখলাছ প্রকাশ পেতে থাকে। অতঃপর আমি যখন তাঁর বেপরোয়া অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করলাম তখন সমুদয় সৃষ্টির আমলকে মশার একটি ডানার সমানও দেখতে পেলাম না। আবার যখন তাঁর রহমতের প্রতি দৃষ্টি করলাম, তখন সমুদয় সৃষ্টিকে তার মোকাবিলায় একটি সরিষা বীজের সম ওজন এবং সমপরিমাণ দেখলাম না। অতএব, এমন মহান দরবারে মশার ডানা এবং সরিষার বীজ দ্বারা কি হতে পারে?
এলাহী ! কতই না ভাল হত যদি বেহেশত এবং দোযখ না হত। তাহলে প্রকাশ পেত যে, আল্লাহ তায়ালার ইবাদতকারী কে? এখন তো লোকে বেহেশত পাওয়ার আশায় এবং দোযখের শাস্তির ভয়ে আপনার ইবাদত করছে।
তুমি যখন নিজের অস্তিত্ব অতিক্রম করে গেলে, তখন তুমি পুলসিরাত এবং দোযখের বাধা অপসারিত করে দিলে।
আমি আল্লাহ তায়অলার কাজ দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে রয়েছি। প্রাথমিক অবস্থায় এই দেহের চর্মের মধ্যে এত বাজার মিলায়ে রেখেছিলেন, অথচ তখন সে সম্বন্ধে আমার কোন খবরই ছিল না। পরে যখন আমাকে সে সম্বন্ধে অবহিত করলেন তখন আমি এমন পেরেশান হইলাম যে, বলতে লাগলাম, হে পেরেশান লোকদের পথ প্রদর্শক ! আমার পেরেশানী আরও বাড়ায়ে দিন।
আল্লাহ তায়ালার দিকে যাওয়ার রাস্তা অসংখ্য। আল্লাহ তায়ালার যত বান্দা আছে প্রত্যেকের জন্য আল্লাহ তায়ালার দিকে যাওয়ার একটি রাস্তা রয়েছে। আমি যে রাস্তায়ই গমন করেছি, তার উপর একটি সম্প্রদায়কে চলমান দেখেছি। আমি আরজ করলাম, এলাহী ! আমাকে এমন পথে নিয়ে যানÑ যে পথে আপনি ও আমি ছাড়া আর কেহ না থাকে। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সামনে চিন্তার পথ এনে রাখলেন, আমি তা অবলম্বন করলাম।
যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ময়দানে জাওয়ামর্দ সে মানুষের কাছে শিশু, আর যে ব্যক্তি মানুষের কাছে জাওয়ামর্দ সে আল্লাহ পাকের ময়দানে না-মরদ।
আমি একাকী থাকার মধ্যে নিরাপত্তা এবং নীরব থাকার মধ্যে শান্তি পেয়েছি।
আমার দিলের মধ্যে গায়েবী আওয়াজ আসল, হে আবুল হাসান ! আমার আদেশ পালনে দৃঢ়রূপে কায়েম থাক। কেননা, আমি চিরঞ্জীব, কখনও আমার মৃত্যু ঘটবে না। আমার আদেশ পালন করলে তোমাকে এমন জীবন দান করব যাতে কখনও মৃত্যু ঘটবে না। আর যে বস্তু থেকে তোমদের নিষেধ করেছি তা থেকে দূরে থাক। কেননা, আমার রাজত্ব ও বাদশাহী কখনও ধ্বংস হবে না। আমার নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দূরে থাকলে তোমাকে এমন রাজ্য দান করব যা কখনও ধ্বংস হবে না।
যে ব্যক্তি আমাকে চিনেছে ও ভালবেসেছে, সে আল্লাহ তায়ালাকে ভালবেসেছে এবং আল্লাহ তায়ালাও তাকে ভালবেসেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহওয়ালা লোকদের সোহবতে বসেছে, সে যেন আল্লাহ তায়ালার সোহবতে বসেছে।
প্রাতঃকালে আলেম লোক আরও অধিক এলম এবং যাহেদ লোক আরও বেশি যোহদ তলব করে থাকে। আর আবুল হাসান এই চিন্তায় ব্যস্ত থাকে যে, কেমন করে একজন মুসলমান ভাইয়ের অন্তরে খুশী ও আনন্দ পৌঁছাবে।
আমি আল্লাহ তায়ালা এবং মানুষের সঙ্গে এমন সন্ধি করেছি যে কখনও তাঁদের সঙ্গে লড়াই করব না।
আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে আওয়াজ আসল, হে আবুল হাসান ! আমি খোদায় ছাড়া আর সবকিছুই তোমাকে দান করব। আমি আরজ করলাম, হে খোদওয়ান্দ করীম ! এই দান দক্ষিণার কথা মধ্যস্থল থেকে উঠায়ে দিন। কেননা, এরূপ কথা বেগান লোকের সঙ্গে সমীচীন, কিন্তু বেগানার মত আপনার সঙ্গে থাকতে আমার তন্ত্রীতে আঘাত লাগে।
যারা আমার কথা শুনে থাকবে, শুনবে বা শুনতে থাকবে, তাদের সর্বনিম্নস্তরের দরজা এই হবে যে, কিয়ামতের দিন তাদের হিসাব-নিকাশ হবে না।
এলাহী ! আমি মানুষের মনে দুঃখ প্রদান করলে মানুষ আমা থেকে পাশ কাটায়ে চলত। আর আমি আপনাকে এত অসন্তুষ্ট করেছি তবুও আপনি আমার সাথেই রয়েছেন, কেননা এটা পবিত্রদের রাস্তা।
এলাহী ! আপনার কোন কোন বান্দা নামাজ এবং ইবাদত বন্দেগীকে ভালবাসে। আবার কেহ বা হজ্ব এবং জেহাদকে ভালবাসে, আবার কেহ কেহ এলম এবং সাজ্জাদা অর্থাৎ গদীকে পছন্দ করে। আপনি আমাকে এরূপ করে দিন যে, আমার জীবন এবং মহব্বত আপনি ছাড়া অন্য কিছুর জন্য না হয়।
এলাহী ! আপনার বন্ধুবর্গের মধ্যে এমনও কি কেউ আছেন যিনি আপনার নাম যেমন ভাবে নেয়া উচিত তেমন করে নেন। জানতে পারলে আমি আমার চক্ষুকে তাঁর পায়ের তলার নীচে রাখব।
এলাহী ! একদল লোক কিয়ামতের দিন শহীদ অবস্থায় উঠবেÑ যাঁরা আপনার রাস্তায় প্রাণ দান করেছেন। আমি কেয়ামতের দিন এমন শহীদ হয়ে উঠব যে, আপনার এশকের তলোয়ারে নিহত অবস্থায় উঠব এবং এমন ব্যথা বেদনা ধারণ করতে থাকব যে, যতদিন আপনার অস্তিত্ব অবশিষ্ট থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সেই ব্যথা বেদনাও বাকী থাকবে।
এক ব্যক্তি এরূপ আছে যে, সত্তর বছরে একবার নিজের কর্মফল সম্বন্ধে সংবাদ পায়। কেহ আছে পঞ্চাশ বছরে একবার, কেহ আছে চল্লিশ বছরে একবার, কেহবা ত্রিশ বছরে একবার, কেহবা দশ বছরে একবার, কেহ বা এক বছরে একবার, কেহবা মাসে একবার, আবার কেহ আছে, এক নামাজের সময় থেকে অন্য নামাজের সময়ের মধ্যে একবার, আবার কেহ আছে যে, তাঁর উপর হুকুম চালায়, আর এই জগত থেকে কোন খবরই তার হয় না।
কোন মানুষ খানায়ে কাবার তওয়অফ করে। আর কেহ বা বায়তুল মামুরের তওয়াফ করে, কেহবা আরশের চতুর্দিকে তওয়াফ করে, আর যারা জাওয়ামর্দ তারা আল্লাহ পাকের একত্বের তওয়াফ করে থাকে।
আউলিয়া কেরামের ভিতরে যা কিছু আছে, যদি তা থেকে এক রেণু পরিমাণও তাঁদের দুই ঠোঁটের মধ্য দিয়ে বের হয় তবে জমিন ও আসমানের সমুদয় সৃষ্টি ঘাবড়ায়ে যাবে।

আল্লাহ তায়ালার এমন বান্দাও আছেন, যাঁরা রাতে অন্ধকার ঘরে জমিনের উপর লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েও আসমানের তারকারাশি ও চন্দ্রের গতি দেখতে পান। আর মানুষের ইবাদত এবং নাফরমানিও দেখতে পানÑ যারা ফেরেশতাদের জমিন থেকে আসমানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আর মানুষের রিজিকও দেখতে পান যা আসমান থেকে জমিনের দিকে আসে। আর ফেরেশতাদেরও দেখেন যাঁরা আসমান থেকে জমিনের দিকে আসেন এবং জমিন থেকে আসমানের দিকে যান। আর ঠিক সেই সময় জমিনের নিচ দিয়ে সূর্যের গতিও দেখতে পান।
যে ব্যক্তির মনে এই আশঙ্কা বিদ্যমান থাকে যে, হয়ত আমার দ্বারা কোন দোষত্র“টি হয়ে গেছে, ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। সে ব্যক্তি বন্ধু হওয়ার যোগ্য নয়।
আল্লাহওয়ালা লোকদের গোপন রহস্য আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ করবেন না। ইহজগতেও না পরলোকেও না। তাঁরা নিজেরাও প্রকাশ করবেন না।
যৎসামান্য তাজিম, অনেক এলম, ইবাদত ও যোহদ অপেক্ষা উত্তম।
ভূপৃষ্ঠে আল্লাহ তায়ালার এমন বান্দাও রয়েছেন যখন তাঁরা আল্লাহ তায়ালার জিকির করতে থাকেন, তার ভয়ে বাঘ গর্জন করা থেকে এবং মাছেরা চলাফেরা করা থেকে বিরত থাকে। আর আসমানের ফেরেশতার মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়। আসমান জমিন এবং ফেরেশতা তার নূরে আলোকিত হয়ে যায়। কোন কোন সময় এমনও হয় যে, জমিন কেঁপে উঠে। লোকে মনে করে ভূমিকম্প আরম্ভ হয়েছে। আবার কোন  সময় এমনও হয় যে, আরশ থেকে পাতাল পর্যন্ত কেঁপে উঠে।
তিন জায়গায় ফেরেশতারা আউলিয়াগণকে খুব ভয় করেন, ক. মালাকুল মউত তাঁদের জান কবজ করার সময়, খ. কেরামুন কাতেবীন তাঁদের আমলনামা লেখার সময়, গ. মুনকার নাকীর সওয়াল করার সময়।
যাঁকে আল্লাহ তায়ালা উন্নত করেন, তাঁকে এমন পবিত্রতা দান করেন যে, তাকে কোন প্রকারের আবিল্য এবং ঘোলাটে ভাবের অধিকার থাকে না এবং এমন ক্ষমতা দান করেন যে, যাকিছু তিনি বলেন তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ধ্বনি আসল, হে আমার বান্দা অন্তরের চেষ্টা দ্বারা যা কামনা কর তা তুমি পেতে পার না। কেননা, তার আদি-অন্ত নেই। অতএব, কেমন করে তুমি তা পেতে পার? আর এই পথটি এমন পথ যে, এই পথে খোদারই সাহায্যে খোদা পর্যন্ত পৌঁছা যায়, কোন বান্দা নিজের শক্তিতে এই পথে এক কদম চলবে, কি সাধ্য তার?
আমি যখন আমার ইবাদতের প্রতি লক্ষ্য করলাম, তখন আমার সত্তর বছরের আয়ুকে এক মুহূর্ত বোধ হল। আর যখন আমার নাফরমানির প্রতি লক্ষ্য করলাম, তখন আমার আয়ুষ্কালকে হযরত নূহ আঃ এর আয়ু থেকে দীর্ঘ দেখলাম। যে পর্যন্ত আমি ইয়াকীনের সাথে জানতে পারিনি যে, আমার রিজিক তাঁর হাতে, তখন পর্যন্ত আমি হাতকে কাজ থেকে বিরত রাখিনি। আর যে পর্যন্ত আমি মানুষের অক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য করিনি, সে পর্যন্ত আমি মানুষ থেকে মুখ ফিরাইনি।
এমনভাবে জীবন যাপন কর যে, কেরামুন কাতেবীনকে খালি হাতে ফিরায়ে দিতে পার। এরূফ করতে না পারলে এইভাবে অবশ্যই জীবন যাপন কর যে, রাতে আমলনামা তাদের হাত থেকে নেয়ে আস এবং যা ইচ্ছা মুছে ফেল। আর যা চাও লিখে দাও আর যদি তাও না পার তবে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের কাজ এই যে, এমন হয়ে যাও যে, ফেরেশতারা যখন আল্লাহ তায়ালার দরবারে ফিরে যাবেন, তখন যেন তারা তোমর সম্বন্ধে নিবেদন করেন, এই ব্যক্তি নেকীই করেছে বদী করেনি।
যে পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে মানুষের মধ্যে রাখেন সে পর্যন্ত তার চিন্তা মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। কিন্তু যখন তার অন্তরকে মানুষ থেকে ছিন্ন করে দেন, মানুষের মধ্যে তার চিন্তা আর থাকে না। তার চিন্তা তখন একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে থাকে। অর্থাৎ তার অন্তরে তখন আর কোন চিন্তাই বাকী থাকে না।
আল্লাহ তায়ালা মহাশক্তিমান। কাকেও এক স্থানে রেখেই সমুদয় স্থান তাকে দেখায়ে দিতে পারেন।
আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মুমিনকে ৪০ জন ফেরেশতার ভয়-ভীতি ও গাম্ভীর্য দান করেন এবং যত দরজা তাকে দান কর হয় তন্মধ্যে তা নিম্নস্তরের। ভয়-ভীতিকে সমগ্র মানব জাতি হইতে গোপন করা হয়। যাতে সকল মানুষ তার সাথে অবাধে মেলামেশা করতে পারে।
যদি তুমি মহান আলÍাহ পাককে আকলের দ্বারা চিনতে পার, তবে এই এলম তোমার সঙ্গে থাকবে। আর যদি ঈমানের দ্বারা চিনতে পার তবে শান্তি ও আরাম তোমার সঙ্গী হবে। আর যদি মারেফাতের দ্বারা চিনতে পার তবে এক ভীষণ ব্যথা তোমার সাথী হবে।
মানুষ যে পর্যন্বত কিছু জানে না সে পর্যন্তই জানি বলে গর্ব করে থাকে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে যে, কিছুই জানতে পারেনি তখন নিজের জ্ঞানের প্রতি লজ্জিত হয়। তখন তার মারেফাত পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
আল্লাহ তায়ালাকে কল্পনা দ্বারা জানা সমীচীন নয়, ধারণ া দ্বারা জানা সম্ভব নয়। সাবধান ! তুমি কখনও এরূপ বলতে আরম্ভ করও না যে, আল্লাহ কে আমি জানি। অথচ তুমি তাঁকে জান না, আল্লাহ তায়ালাকে এইরূপে জানা উচিতÑ যে, যতই তুমি আল্লাহ তায়ালা সম্ভন্ধে জ্ঞান লাভ করবে ততই বলতে থাকবে যে, কতই না ভাল হত, যদি আমি তাঁকে এর চেয়ে আরও উত্তমরূপে জানতে পারতাম।
এই মারেফাতের পথে একটি বাজার আছে, তার নাম আল্লাহওয়ালাগণের বাজার। সেই বাজারে বহু উত্তম উত্তম সূরত আছে, তরিকতপন্থীরা সেখানে এসে পৌঁছলে থামেন না। প্রকাশ থাকে যে, সেই সুন্দর ও উত্তম সূরত সমূহ কারামত, ইবাদত, যোহদ, রিয়াযত, দুনিয়া ও আখেরাত, আল্লাহর অনুগ্রহ ও বেহেশত ইত্যাদি। তরিকত পন্থীরা এর কোনটির প্রতিই মনোযোগ প্রদান করে গমনে ক্ষান্ত দিলে আল্লাহ তায়ালা পর্যন্ত পৌঁছা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। অতএব বান্দার জন্য তাই উত্তম যে, সমগ্র সৃষ্ট জগতকে পরিত্যাগপূর্বক আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে নির্জনে অবস্থান করে মস্তক সেজদায় স্থাপন করে। অনুগ্রহের সমুদ্র অতিক্রম করে এবং আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত যে সমস্ত পদার্থ পথে পাওয়া যায়, সবকিছুকে বর্জন করে গন্তব্য পথে অগ্রসর হতে থাকেÑ যে পর্যন্ত না আল্লাহ তায়ালার একত্বের মধ্যে গিয়ে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে যে, নিজের অস্তিত্ব মধ্যস্থলে বিদ্যমান না থাকে।
এলমের একটি বাহিরের দিক আছে তা আলেমদের আলোচনার বস্তু। আর একটি অভ্যন্তরের দিক আছে তা তরিকতপন্থী আল্লাহওয়ালা লোকদের আলোচনার বস্তু। আর একটি অভ্যন্তরেরও অভ্যন্তর আছে তা আল্লাহওয়ালাদের রহস্য। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেকানে যাওয়া সম্ভব নয়।
যে পর্যন্ত তুমি দুনিয়ার অন্বেষণকারী থাকবে দুনিয়া তোমার উপর বাদশাহ থাকবে। আর তুমি যখন দুনিয়া থেকে মুখ ফিরায়ে নিবে তখন তুমি তার উপর বাদশাহ হয়ে যাবে।
দুনিয়া এবং আখেরাতের সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক না থাকে এবং তাদের প্রতি যার কোন প্রকারের আগ্রহ ও উৎসাহ না থাকে সে ব্যক্তিই ফকির। কেননা, দুনিয়া ও আখেরাত খুবই হনি এবং নিকৃষ্ট পদার্থ। দিলের সাথে তাদের কোনই সম্পর্ক বা সংস্রব হতে পারে না।
আল্লাহ তায়ালা যেমন সময় আসার তোমার নিকট নামাজ তলব করেন না তদ্রƒপ তুমিও সময়ের আগে তার নিকট রিজিক তলব করও না।
আল্লাহ তায়ালা যে কওমের অন্ততঃ একজনকে উন্নত মর্যাদা দান করেন, তার গোটা কওমকে মাফ করে দেন।
তরিকতপন্থীরা অভ্যন্তরের পবিত্রতা দ্বারাই উন্নতি করে থাকেন। অধিক আমল করার দ্বারা নয়।
আল্লাহ তায়ালা যদি তাঁর সৌন্দর্য ও গুণাবলীর এক রেণু পরিমাণও তোমার উপর প্রকাশ করেন, তবে জগতে তুমি এমন কাউকে পাবে না যে, সেই গুণ বা সৌন্দর্যাবলী তুমি তার কাছ থেকে শ্রবণ কর বা তার কাছে ব্যক্ত কর।
হুজুরে আকরাম সাঃ এমন একটি সীমাহীন সমুদ্র ছিলেন। যদি সেই সমুদ্রের একটি ফোঁটা বের হয়ে আসত তবে দুনিয়া ও দুনিয়াবাসী ডুবে যেত।
যে ব্যক্তি কথা বলার সময় কিংবা চিন্ত করার সময় আল্লাহ তায়ালাকে নিজের সঙ্গে মনে করে না, উভয়স্থলে সে বড় বড় বিপদে পতিত হয়।
তরিকতের ইমাম হওয়ার যোগ্য সেই ব্যক্তি যিনি তরিকতের সমস্ত পথ অতিক্রম করেছেন।
ইবাদতের ব্যাপারে এতটুকু তো আবশ্যক যে, শরিয়তের কোন হক তোমার উপর বাকী না থাকে। আর ইলম তোমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, শরিয়তের আদেশ নিষেধগুলো তুমি ভালরূপে জেনে নাও, আর ইয়াকীন বা বিশ্বাস এতটুকু যথেষ্ট যে, তোমার জন্য রিজিক যতটুকু নির্ধারিত আছে তা তোমার কাছে এসে পৌঁছবেই। আর জোহদের এতটুকু যথেষ্ট যে, তুমি মনে করবে যা কিছু তুমি খাচ্ছ তাই তোমার রিজিক। এতটুকু বিবেচনা তোমার থাকলে তুমি কখনও বলবে না যে, তা থেকে খাব বা তা খাব।
তুমি যখন নেককার লোকের আলোচনা করতে থাক, তখন একটি সাদা মেঘ এসে তোমার উপর রহমত বর্ষণ করে। আর যখন আল্লাহ পাকের জিকির করতে থাক, তখন একটি সবুজ মেঘ এসে তোমার প্রতি এশক বর্ষণ করতে থাকে। আর নেককারের আলোচনা জগতের জন্য রহমত, আর খাস লোকের জন্য গাফলত।
মুমিন লোকের পশ্চাৎ নিন্দা সকলেই করে থাকে, তিন জন ব্যতীতÑ ক. আল্লাহ তায়ালা, খ. হযরত মুহাম্মদ সাঃ, গ. পবিত্রমনা মুমিন।
সফর পাঁচ প্রকারÑ ক. পায়ের দ্বারা, খ. দিলের দ্বারা, গ. ইচ্ছা শক্তির দ্বারা, ঘ. দর্শনের দ্বারা, ঙ. নফসকে ফানা করে।
আল্লাহওয়ালা লোকদের পানাহার আল্লাহ তায়ালার মহব্বত।
আল্লাহ তায়ালা নিজের অলিদের অন্তরে নূর দ্বারা অন্তর দৃষ্টি স্থাপন করেন। অতঃপর সেই অন্তদৃষ্টির উপর একের পর এক অন্তদৃষ্টি স্থাপন করতে থাকেন। এইরূপে উপর্যুপরি অন্তরদৃষ্টি স্থাপন করতে করতে তার সমুদয় অন্তদৃষ্টি কেবল আল্লাহ তায়ালারই হয়ে যায়।
পথ মাত্র দুইটি। একটি হেদায়েতের পথ, দ্বিতীয়টি গোমরাহীর পথ। যে পথ বান্দা হতে খোদার দিকে দিয়েছে তা গোমরাহীর পথ, আর যে পথ আল্লাহ তায়ালা হতে বান্দার দিকে গিয়েছে তা হেদায়েতের পথ। অতএব যদি কেই বলে যে, আমাকে আল্লাহ তায়ালা পৌঁছায়েছেন সম্ভবতঃ সে পৌঁছে থাকবে।
প্রতি একশত বছরে এমন একজন লোক মাদৃগর্ভ হতে আত্মপ্রকাশ করে থাকেন যিনি আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের উপযুক্ত হন।
যে অন্তকরণে খোদা ছাড়া আরও কোন বস্তু বিদ্যমান থাকে, সেই অন্তকরণ ইবাদতে পূর্ণ থাকলেও তা মৃত।
তিনটি বিষয় রক্ষা করা কঠিনÑ ক. মানুষের সংসর্গে থেকে মানুষ হতে আল্লাহ তায়ালার রহস্য গোপন রাখা, খ. মানুষের সংগে জবান রক্ষা করা, গ. আমলের পবিত্রতা রক্ষা করা।
নফস ব্যতীত আর কোন বস্তুই বান্দা ও আল্লাহ তায়ালার মধ্যস্থলে পর্দার সৃষ্টি করতে পারে না। সকল তরিকতপন্থী আল্লাহ পাকের সামনে নফসকে অভিযুক্ত করেছেন। আর সমস্ত পয়গম্বর আঃও এই নফসকে অভিযুক্ত করেছেন।
লোভী আলেম এবং বে-আলেম দরবেশ দ্বারা ধর্মের যতটুকু বিনাশ হয় শয়তান দ্বারা ততটুকু বিনাশ হয় না।
সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ আল্লাহ পাকের জিকির। তারপর দানশীলতা এবং পরহেজগারী ও নেককার লোকের সংসর্গ।
যদি তুমি রাজকর্মচারীদের কারও সাক্ষাৎ এড়াবার উদ্দেশ্যে হাজার ক্রোশ দূরে পলায়ন কর, তবে তুমি এই কাজটি বড় মঙ্গল ও হিতজনক কাজই করলে।
কেবলা পাঁচটি- ক. মুমিনের কেবলা খানায়ে কাবা, খ. অন্যান্য পয়গম্বর ও তাঁদের উম্মতদের কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাস, গ. ফেরেশতাগণের কেবলা আসমানে বাইতুল মামুর, ঘ. দোয়ার কেবলা আরশ, ঙ. আল্লাহওয়ালা অলিগণের কেবলা আল্লাহ জাল্লা শানহু, ……………… “যে দিকেই তোমরা মুখ ফিরাও না কেন সে দিকেই আল্লাহর চেহারা আছে।”
বুদ্ধিমান লোক আল্লাহ তায়ালাকে দিলের আলোকে দেখতে পায়। আর বন্ধু লোক ইয়াকীনের আলোকে, আর আল্লাহওয়ালা লোক চাক্ষুষ দর্শনের আলোকে। লোকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি আল্লাহ তায়ালাকে কোথায় দেখেছেন? তিনি বললেন, সেই জায়গায় যেখানে আমি নিজেকে দেখতে পাইনি।
যে ব্যক্তি নফসের একটি আকাক্সক্ষা পূর্ণ করে। আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় সহস্র রকমের গম চিন্তায় তাকে পতিত হতে হয়।
আল্লাহওয়ালা লোকগণ আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় এত আনন্দ পেয়ে থাকেন যে, তাঁরা তা ছেড়ে মানুষের সোহবতে আসতে রাজী হন না। আর মশহুর হয়ে পড়লে মানুষের কাছে নিজেদের অবস্থা গোপন রাখেন। আর যখন লোকে তাঁদের অবস্থা জেনে ফেলে, তখন তাঁদের জীবন নমকবিহীন খাদ্যের মত বিস্বাদ হয়ে যায়।
তরিকতপন্থীরা আমল হতে হাত উঠায়ে নেন না, যে পর্যন্ত আমল তাঁদের থেকে হাত উঠায়ে না নেয়।
আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত অদৃষ্টের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এমন সহস্র সহস্র নেক আমলের চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ যা আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হয়ে গিয়েছে।
আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের এক ফোঁটা যদি তোমার উপর টপকায়ে পড়ে, তবে ইহজগতে আর কোন বস্তুর প্রতি মোর আগ্রহ এবং বাসনা থাকবে না এবং কারও সাথে দেখাশুনা করা কিংবা কারও কথা শুনার প্রয়োজন তোমার থাকবে না।
দুনিয়াতে কারও সাথে তোমার ঝগড়া-বিবাদ হওয়ার চেয়ে অধিক কঠিন তোমার জন্য আর কোন বস্তুই নেই।
নামাজ রোজা ইত্যাদি ইবাদত শ্রেষ্ঠ কাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু অহংকার এবং হিংসা-বিদ্বেষ অন্তর থেকে বের করে ফেলা তার চেয়েও শ্রেষ্ঠতর কাজ।
মারেফাত তিন প্রকার- শরিয়তের সাথে মিশ্রিত মারেফাত, শরিয়ত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত মারেফাত, শরিয়তের সমমত মারেফাত। তরিকতপন্থীর কর্তব্য তিন প্রকারের মারেফাত সম্বন্ধেই অভিজ্ঞতা লাভ করা। তা হলে যে যেই স্তরের লোক তার সাথে সেই স্তর থেকে কথা বলতে পারবে।
অধিক রোদন কর এবং কম হাস। বেশি নীরব থাক, অল্প কথা বল, অধিক দান দক্ষিণা কর নিজে কম ভোগ কর। বেশি জাগ্রত থাক, কম ঘুমাও।
যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার কালামে অনন্দ ও স্বাদ আস্বাদন করা ব্যতীত এই দুনিয়া হতে বের হয়ে গেল, সে ব্যক্তি যাবতীয় নেকী এবং শান্তি থেকে বঞ্চিত রইল, কিছুই পেল না।
জীবন যাপন করা উচিত মানুুষের সাথে নম্র ও বন্ধু বাবাপন্ন হয়ে। হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সাথে আনুগত্য, অনুসরণ এবং আদব-কায়দার সাথে আর আল্লাহ তায়ালার সাথে পবিত্রতার সাথে কেননা তিনি পবিত্র এবং পবিত্র লোকদের ভালবাসেন।
চেষ্টা কর যাতে এই তিনিটি বিষয় মৃত্যুর পূর্বে নিজের মধ্যে দেখতে পাও- ক. আল্লাহ তায়ালার মহব্বতে তুমি স্বীয় অশ্র“কে রক্ত আকারে দেখবে, খ. তাঁর ভয়ে নিজের প্রসাব রক্তের মত দেখবে, গ. তাঁর আদেশ পালনে, রিয়াযতে এবং রাত্রি জাগরণে তুমি তোমার অঙ্গ-প্রতঙ্গসমূহকে বিগলিত করে দিবে।
আল্লাহ তায়ালাকে এমনভাবে স্মরণ কর যে, দ্বিতীয়বার আর স্মরণ করতে না হয়। অর্থাৎ, কখনও ভুল না যে, আবার তোমাকে তাঁর স্মরণ নতুন করে করতে হয়।
সর্বত্র সর্বকর্মে নিজেকে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে দেখতে পাওয়ার নাম ওফা অর্থাৎ, আদেশ পালন। আর খোদাকে নিজের সঙ্গে দেখতে পাওয়ার নাম ফানা অর্থাৎ নিজের অস্তিত্ব বিলোপ করা। আর যখন তুমি কেবল খোদাকেই দেখতে পাবে নিজেকে দেখতে পাবে না সেই অবস্থার নাম বাক্বা অর্থাৎ, স্থায়িত্ব।
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নিজের কার্যাবলী সম্বন্ধে অবহিত করেছেন। যদি তাঁর নিজের সত্তা সম্বন্ধেও অবহিত করতেন, তবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু কলেমা উচ্চারণকারী কেহ হত না। অর্থাৎ ভয় ও অস্থিরতার মধ্যে ডুবে যেত।
দরবেশ তিনিই যাঁর দিলে কোন চিন্তা ও আশঙ্কা নেই, কথা-বার্তাও নেই। শুনে কিন্তু শ্রবণশক্তি নেই, খায় কিন্তু খাওয়ার স্বাদ বিস্বাদ নেই। আর নড়াচড়া গম চিন্তা, অনন্দ আহ্লাদ খিচুই নেই।
বেহেশতগামীপথ খুব নিকটবর্তী কিন্তু যে পথ আল্লাহ তায়ালার দিকে তা খুব দূর-দারাজ।
তোমার কর্তব্য প্রতিদিন হাজার বার মরে যাওয়া এবং হাজার বার জীবিত হওয়া এরূপ করতে থাকলে হয়ত একদিন এমন জীবন লাভ করবে যে, আর কখনও মরবে না।
যে ব্যক্তি জমিনের উপর ভ্রমণ করে তার পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। আর যে ব্যক্তি আসমানে ভ্রমণ করে তার অন্তঃকরণে ফোস্কা পড়ে।
যে ব্যক্তি একাকী বসে আল্লাহ তায়ালার ধ্যানে মগ্ন হয়, তার সম্বন্ধে মনে কর যে, সে ব্যক্তি নিজের প্রভুকে অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে দুনিয়ার সমস্ত পদার্থ এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক ভালবাসে।
আল্লাহ তায়ালা নিজের মেহেরবাণী তাঁর বন্ধুদের জন্য রাখেন, আর নিজের সহমত তাঁর নাফরমান বান্দাদের জন্য রাখেন।
নিজের প্রভু আল্লাহ তায়ালার বন্ধু হও, কেননা, কোন মুসাফির যখন এমন এক শহরে গিয়ে পৌঁছে যেখানে তার কোন বন্ধু-বান্ধব আছে সেখানে তার দিল খুব সবল থাকে।
আল্লাহ তায়ালার মহব্বত সেই ব্যক্তির অন্তরে স্থান পায় না যার মনে আল্লাহর বান্দাগণের প্রতি স্নেহ এবং দয়া নেই।
যে ব্যক্তি দুনিয়াকে এবং নিজের আয়ুষ্কালকে আল্লাহ তায়ালার কাজে ব্যয় করতে পারে না তাকে বলে দাও, তুমি এরূপ দাবি করো না যে, আমি তাড়াতাড়ি পুলসেরাত পার হয়ে যাব।
এক ব্যক্তি খোরাসান থেকে মক্কা শরীফ যাওয়ার সঙ্কল্প তাঁকে জানালে তিনি বললেন, তুমি কেন মক্কা যাচ্ছ? সে বলল, আল্লাহ তায়ালার অন্বেষণে। তিনি বললেন, খোরাসানের খোদা কোথায় গেলেন যে, খোদার অন্বেষণে তোমাকে মক্কা যেতে হচ্ছে? হুজুরে আকরাম সাঃ তো বলেছেন, এলম তলব কর, যদি সেজন্য তোমাকে চীন দেশেও যেতে হয়। তিনি তো বলেননি যে, খোদার অন্বেষণে দেশ ছেড়ে বিদেশে যাও।
সমগ্র সৃষ্ট জগত অর্থাৎ তা মধ্যস্থিত যাবতীয় সৃষ্ট পদার্থ মুমিনের জন্য বাধা এবং ফাঁদ স্বরূপ। জানি না কে কখন কোন ফাঁদে আটকা পড়ে যায়।
কোন মুমিনকে কষ্ট দেয়া ব্যতীত যার একটি দিন ও রাত অতিবাহিত হয়েছে, সে যেন সেই দিন ও রাত হুজুরে আকরাম সাঃ এর সোহবতে কাটাল। আর যদি কেহ কোন মুমিনকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তায়ালা তার সেই দিন ও রাতের কোন ইবাদত কবুল করেন না।
ঈমানের পরবর্তী সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত যা আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে দান করেন- তা হল পবিত্র দিল এবং সত্যবাদী ও সৎ জবান। এর চেয়ে অধিক নেয়ামত ঈমানের পরে আর কিছুই হতে পারে না।
যে ব্যক্তি ইহজগতে আল্লাহ পাক, রাসূলুল্লাহ সাঃ এবং পীর সাহেবান থেকে লজ্জা ও শরম রক্ষা করে চলেন আল্লাহ তায়ালা পরজগতে তার সাথে শরম রক্ষা করবেন।
আল্লাহর দরবারে তিনটি সম্প্রদায়ের প্রবেশাধিকার রয়েছে- ক. যারা আলেম এবং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ, খ. যারা গুদড়ী ও গদীরও অধিকারী, গ. যারা উপার্জনশীল ও শিল্পকলা বিশারদ। এতদ্ব্যতীত অলস ও অকর্মন্য নফস মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
আল্লাহ তায়ালার সোহবত ও খেদমতের উপযুক্ত সেই ব্যক্তি যার চক্ষু অন্ধ, কান বধির এবং রসনা মূক।
মানুষ তিনটি বস্তু দ্বারা ইবাদত করতে পারে- নফস দ্বারা, অন্তর দ্বারা এবং জবান দ্বারা। সুতরাং এই তিনটি বস্তুর দ্বারাই সর্বদা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও জিকিরে মশগুল থাকা কর্তব্য। তা হলে মৃত্যুর পর কিয়ামতের দিন হিসাব-নিকাশ ছাড়াই বেহেশতে নিয়ে যাওয়া হবে।
যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার জন্য ব্যাকুল ও আগ্রহশীল তাকে দুনিয়া এবং তার মধ্যস্থিত সব কছিু দান করলেও সে সন্তুষ্ট হবে না।
বান্দা চারটি বস্তু নিয়ে আল্লাহ তায়ালার সম্মুখীন হয়ে থাকে- ক. দেহ, খ. মাল-দৌলত, গ. দিল, ঘ. জবান। অতএব, তুমি যদি দেহকে আল্লাহ তায়ালার খেদমতে নিযোজিত কর আর জবানকে আল্লাহ তায়ালার জিকিরে মশগুল রাখ, কিছুই লাভ হবে না, যে পর্যন্ত দিলকে তাঁর হাতে সোপর্দ না কর, আর মাল-দৌলত যা কিছু তোমার আছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় না কর। যদি তুমি এই চারটি বস্তুকে আল্লাহ তায়ালার পথে ব্যয় কর, তবে আল্লাহ তায়ালার কাছে চারটি বস্তু প্রার্থনা করতে পারÑ ক. মহব্বত, খ. ভয়, গ. তাঁর সঙ্গে জীবন যাপন করা এবং ঘ. তাঁর বন্ধুত্বের পথ।
আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে এক এক বস্তুর সাথে মশগুল করেছেন এবং তাঁর থেকে পৃথক করে রেখেছেন। অতএব, হে তরিকতপন্থীগণ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কোন বস্তুর সাথে নিজেকে মশগুল করো না। বরং আল্লাহ তায়ালার ভক্ত হয়ে আল্লাহ তায়ালার দিকে অগ্রসর হও, তা হলে তুমি আল্লাহ তায়ালা হতে বঞ্চিত থাকবে না এবং তিনি তোমাকে অন্য কোন বস্তুতে মশগুল রেখে তাঁর নিজ থেকে বঞ্চিত রাখবেন না।
অনেক লোক আছে জমিনের উপর চলাফেরা করে চটে, কিন্তু তার মুর্দা। আবার এমনও অনেক লোক আছে যারা জমিনের নিচে কবরের মধ্যে শায়িত, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাঁরা জীবিত।
যে দিকেই দৃষ্টিপাত কর- খোদাই খোদা বিদ্যমান।
মারেফাতের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ এই যে, মনে বলবে আল্লাহ। তাঁকে ছাড়া আর সব কিছুকে ভুলে যাবে। পরবর্তী পদক্ষেপ তাঁর মহব্বত, তৎপরবর্তী পদক্ষেপ তাঁর এশকের আগুনে পুড়ে তাঁর মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া।
আলেমরা আলেমকে, যাহেদরা যোহদকে এবং আবেদরা ইবাদতে অবলম্বন করে থাকেন, এই বস্তু সমূহকেই তাঁরা আল্লাহ তায়ালার সম্মুখীন হওযার উপলক্ষরূপে সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু সাবধান ! তুমি একমাত্র পবিত্রতা ছাড়া অন্য কিছুই অবলম্বন করো না। পবিত্রতাকেই তাঁর সামনে পেশ করো। কেননা, তিনি পবিত্র এবং অভাবমুক্ত।
মুরিদ পীরের তাজিম যত অধিক পরিমাণে করবে তত অধিক পরিমাণে সে আল্লাহ তায়ালার দীদার লাভ করতে পারে।
সকলেই মাছ ধরতে নদীতে গমন করে থাকে, আর এই তরিকতপন্থীরা শুকনার উপর মাছ ধরে থাকে।
এই দুনিয়ার হাজার হাজার উদ্দেশ্য পরিহার করা কর্তব্য, তাহলে সেই জগতের অর্থাৎ, পরলোকের একটি উদ্দেশ্যে পৌঁছতে পারবে। আর এই দুনিয়ার হাজার হাজার পেয়ালা বিষাক্ত শরবৎ পান করা উচিত তা হলে পরলোকের এক পেয়ালা মজাদার শরবত পান করতে পাইবে।
জিন্দেগানী, প্রত্যক্ষ দর্শন, পবিত্রতা, ফানা, স্থায়িত্ব এর সব কিছুই মৃত্যুর মধ্যে নিহিত আছে। কেননা, সত্য যখন প্রকাশিত হয়, তখন আল্লাহ তায়ালা ভিন্ন আর কিছুই দেখা যায় না।
সেই ব্যক্তির কথা শুনে হাসি পায় যে বলে, দলিল প্রমাণের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালাকে চিনতে পারা যায়। কেননা আল্লাহ তায়ালাকে আল্লাহ তায়ালার দ্বারাই চেনা যেতে পারে, কোন সৃষ্ট পদার্থ দ্বারা পারা যাবে না।
যে ব্যক্তি খোদার প্রেমে মত্ত হয়েছে, সে খোদাকে পেয়েছে। যে ব্যক্তি খোদাকে পেয়েছে সে নিজকে ভুলে গেছে এবং হারায়ে ফেলেছে।
একদল লোক কুরআন মজিদের তাফসীর করার কাঝে মশগুল কিন্ত তরিকতপন্থী জাওয়ামর্দেরা নিজেদের তাফসীর করার কাজে মশগুল রয়েছে।
প্রকৃত ও সত্যিকার আলেম তিনিই- যিনি নিজে নিজে আলেম এবং জ্ঞানী হয়েছেন অর্থাৎ- গায়েবী এলম পেয়েছেন। এলেম পড়ে যিনি আলেম হয়েছেন তিনি প্রকৃত আলেম নন।
খোদা প্রেমের শেষ সীমা এই যে, দুনিয়ার সমস্ত দরিয়ার পানি তার গলায় ঢাললেও তার পিপাসার নিবৃত্তি নেই, বরং তার অন্বেষণ আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আল্লাহ তায়ালা ভিন্ন আর সমস্ত পদার্থ থেকে মুখ ফিরায়ে নেয়। আর কোন কারামতে ভুলে না।
লোকে জিজ্ঞাসা করল, হযরত ! আপনি মৃত্যুকে ভয় করেন কি না? তিনি বললেন, মৃত ব্যক্তি আবার মৃতৃত্যু ভয় কোথায়? কেননা, আল্লাহ পাক মানুষকে যত মৃত্যুর ভয়, কিয়ামতের ভয়, দোযখ ইত্যাদির ভয় প্রদর্শন করেছেন, আমার দুঃখ-কষ্টের সামনে এই সমুদয়ের কোন অস্তিত্বই নেই। আর মানুষের সাথে যত শান্তি, আরাম, বেহেশত ইত্যাদির ওয়াদা করেছেন, আমার আশার তুলনায় এ সমস্ত কিছুই নয়।
লোকে জিজ্ঞাসা করল, নেককার হওয়ার দাবি করা অধিক মন্দ, না গুনাহের কাজ অধিক মন্দ? তিনি বললেন, দাবি করা প্রত্যক্ষ পাপ।
দুনিয়ার সমুদয় নেয়ামতকে একটি গ্রাস প্রস্তুত করে মেহমানের মুখে তুলে দিলেও তবুও মেহমানের হক আদায় হবে না। আর যদি একজন আল্লাহওয়ালা লোকের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মাশরেক থেকে মাগরেব পর্যন্তও সফর কর তবু তা তেমন কোন বড় কাজ হল না।
মুমিনের জন্য ভূপৃষ্ঠের সকল স্থানই মসজিদ। প্রত্যেকটি দিনই জুমআর দিন। প্রত্যেকটি মাসই রমজান মাস অর্থাৎ মুমিন লোক যেখানে এবং যে সময়েই থাকুক আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে অবস্থান করে।
একরাতে আমি আল্লাহ তায়ালাকে স্বপ্নে দেখলাম। আমি বললাম, এলাহী ! ষাট বছর হয়ে গেল আমি আপনার মহব্বতে এবং আপনার আশায় কাল কর্তন করছি এবং আপনার প্রেমের পরশে আয়ু ক্ষয় করছি। আল্লাহ পাক বললেন, তুমি মাত্র ষাট বছর কাল আমার মহব্বত অন্বেষণ করেছ। তাতে আশ্চর্যের কি আছে? তুমি যখন আমার জ্ঞানাধারের মধ্যে মূর্তিমান ছিলে, তখন হতেই তো আমি তোমাকে ভালবাসি।
হযরত আবুল হাসান রাঃ এর ইন্তেকালের সময় নিকটবর্তী হলে তিনি বললেন, কতই না ভাল হত ! যদি আমার এই রক্তপূর্ণ অন্তকরণকে ফেড়ে দুনিয়ার মানুষকে দেখান হত। তাহলে তারা জানতে পারত যে, আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে মূর্তিপূজা করা ঠিক হবে না। অতঃপর তিনি অসিয়ত করলেন, আমাকে ত্রিশ গজ মাটির নিচে দাফন করিও। কেননা, খেরকানের জমিন বোস্তামের জমিন অপেক্ষা অধিক উঁচু। আমার কবর হযরত বায়েজিদ রাঃ এর কবরের চেয়ে উঁচু থাকলে বড়ই বেআদবী হবে। লোকে তাই করল। তাঁর ইন্তেকাল হলে তাঁর নির্দেশ অনরুসারে তাঁকে ত্রিশ গজ মাটির নিচে দাফন করা হল। পরবর্তী দিন খুব জোরে একটি শব্দ হল। পরক্ষণে লোকে দেখতে পেল তাঁর সমাধির উপর একটি বৃহদাকার সাদা পাথর পড়ে আছে এবং কবরের উপর বাঘের পদচিহ্ন রয়েছে। লোকে বুঝতে পারল যে, পাথরটি সম্ভবত বাঘই এনেছে। আর কেহ কেহ বলেছে, বাঘকে দেখা গেছে, তাঁর মাজারের চতুষ্পার্শে ঘোরাফেরা করছে। আর একটি কথা প্রচলিত আছে হযরত শেখ আবুল হাসান রাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার মাজারের উপরিস্থিত পাথরের উপর হাত রেখে কোন উদ্দেশ্য সফল হওয়ার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করবে আল্লাহ তায়ালা তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করে দিবেন।
হযরত আবুল হাসান রাঃ এর ইন্তেকালের পর কেহ তাঁকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করল, আল্লাহ তায়ালা আপনার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? তিনি বললেন, আমার আমলনামা আমার হাতে এনে দিলেন। আমি আরজ করলাম, আপনি আমাকে আমলনামায় মশগুল করতে চান? আমি আমল করার আগেই আপনি আমাকে জানতেন যে, আমার দ্বারা কি কি আমল হবে? আমার আমলনামা কেরামুন কাতেবিনের হাতে দিন তারা পড়তে থাকুক আমাকে মুক্তি দিন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে থাকি।
মোহাম্মদ ইবনুল হুসাইন রাঃ বলেছেন, আমি পীড়িত ছিলাম, শেষ নিঃশ্বাসের খেয়াল করে খুব চিন্তিত এবং উদাসীন অবস্থায় আছি। এমন সময় হযরত আবুল হাসান রাঃ তশরিফ এন বললেন, কেন এমন ভীত? ভাল হয়ে যাবে। আমি বললাম, হযরত ! মৃত্যুর ভয়। তিনি বললেন, তৃত্যুকে কখনও ভয় করা উচিত নয়। আর শুনে রাখ আমি তোমার ত্রিশ বছর পূর্বে মরলেও তোমার মৃত্যুর সময় হাজির হয়ে যাব। তুমি মৃত্যুর ভয় মোটেও করও না। হযরত মোহাম্মদ ইবনুল হুসাইন বললেন, আমি সে যাত্রায় ভাল হয়ে গেলাম।
হযরত শেষ আবুল হাসান রাঃ এর ইন্তেকালের পর ত্রিশ বছর অতীত হয়ে গেল। মোহাম্মদ ইবনুল হুসাইন রাঃ এর অন্তিম অবস্থা উপস্থিত হল। তাঁর পুত্র দেখতে পেলেন সেই মৃত্যু যন্ত্রণার সময়ই তিনি হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায়ে গেলেন এবং বললেন, আসুন, আসুন, ………. তাঁর পুত্র জিজ্ঞাসা করলেন, হযরত ! আপনি কাকে দেখেছেন? তিনি বললেন, বৎস ! হযরত আবুল হাসান খেরকানী রাঃ বহুদিন পূর্বে কৃত তাঁর ওয়াদা অনুযায়ী তশরিফ এনেছেনÑ যেন আমি মৃত্যুকে ভয় না করি। আল্লাহওয়ালা লোকদের একদল আউলিয়ায়ে কেরামও তাঁর সঙ্গে আছেন। এই বলেই তিনি ইন্তেকাল করলেন, তাঁর ওফাতের তারিখ ১৫৭ হিজরি।

হযরত আবু ইয়াকুব ইউসুফ হামদানী রাঃ

হযরত আবু ইয়াকুব ইউসুফ হামদানী রাঃ ছিলেন হযরত আবদুল খালেক গজদেওয়ানী রাঃ এর পীর ও মোর্শেদ, জামানার ইমাম ও অতুলনীয় তত্ত্বজ্ঞানী আরেফ। তাঁর কুনিয়াত ছিল আবু ইয়াকুব। তিনি হামদানের অন্তর্গত বুযাঞ্জার নামক নগরে বাস করতেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আবু আইয়ুব ইবনে শুআইব। তিনি শেখ আবু আলী ফারমাদী রাঃ এর মুরিদ ছিলেন। বহুকাল শেখ আবদুল্লাহ জুঈ এবং শেখ হাসান সানসাঈর সোহবতেও ছিলেন। আবু ইসহাস শিরাজী হতেও ফয়েজ লাভ করেছিলেন। গাউসুল সাকালাইন হযরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদির জিলানী রাঃ হতেও তাসাউফ সম্বন্ধে অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মানাযিলুস সায়েরীন, মানাযিলুস সালেকীন ও যুবদাতুল হায়াত নামক তিনটি কিতাব তাঁর অমর রচনা।
শেখ ইউসুফ হামদানী রাঃ আঠার বছর বয়সে এলম হাসিল করার আগ্রহে জন্মভূমি ত্যাগ করে বিদেশ ভ্রমণ করেন। প্রথমে বাগদাদ শরীফ গিয়ে মাওলানা আবু ইসহাক শিরাজীর খেদমতে অবস্থান করেন এবং কুরআন শরীফ ও এলমে ফেকাহ তাঁর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেন। মাওলানা আবু ইসহাক শিরাজীর শাগরেদগণের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক প্রিয়। বাগদাদ শরীফে অবস্থান কালে তিনি হামেশা হযরত গাউসুল সাকালাইন রাঃ এর খেদমতে যাতায়াত করতেন।
বাগদাদের পরে তিনি বোখারা এবং ইসপাহানেও গমন করেন এবং কিছুকাল সেখানে অবস্থানপূর্বক এলম হাসিল করেন। অতঃপর তিনি ইরাক, খোরাসান, খাওয়ারযম এবং মা-ওয়ারাউন্নাহারেও ভ্রমণ করেন এবং খুব কঠিন রিয়াজত, পরিশ্রম ও মুজাদাহায় মশগুল থাকেন। এসমস্ত মঞ্জিল অতিক্রম করে অবশেষে তিনি খাজা আবু আলী ফারমাদী রাঃ এর মোবারক খেদমতে উপস্থিত হন। এখানেই তিনি পূর্ণ কামালিয়ত লাভ করেন। অতঃপর পীর মোর্শেদের নির্দেশক্রমে স্বীয় মহামূল্যবান ওয়াজসমূহ দ্বারা মানুষকে ফয়েজ দান করতে থাকেন। অতঃপর মারো দেশে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। এখানে কিছুকাল বাস করার পর আবার হেরাতে গিয়ে বাস করতে থাকেন। আর একবার তিনি মারো দেশে গিয়ে পুনরায় হেরাতে চলে আসেন। ফলকথা- এইরূপে তিনি বিভিন্ন দেশে, অঞ্চলে ও শহরে ঘুরাফিরা করে আল্লাহর বান্দাগণকে আল্লাহর রাস্তার দিকে আহ্বান করতঃ এলমে দ্বীন এবং এলমে বাতেন শিক্ষা দিতে থাকেন। সর্বশেষে মারো যাওয়ার সময় পথিমধ্যে ৫৩৫ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন এবং মারো শহরেই সমাহিত হন।

হযরত মাওলানা খাজায়ে খাযেগান আবদুল খালেক গজদেওয়ানী রাঃ

হযরত খাজা আবদুল খালেক গজদেওয়ানী রাঃ তাঁর যুগের সমস্ত মানুষের উদ্দিষ্টস্থল ছিলেন। তাঁর উপাধি ছিল ‘আরেফে রব্বানী’। তাঁর সম্পর্কে ছিল নকশেবন্দিয়া তরিকার সহিত। খাজা বাহাউদ্দিন নকশেবন্দিয়া রাঃ হতে ফয়েজ লাভ করেছিলেন এবং খাজা আবু ইউসুফ হামাদানী রাঃ এর চতুর্থ খলিফা ছিলেন।
তাঁর পিতা-মাতা রোম দেশের মাল্টা নগর হতে হিজরত করে বোখারার সাত ক্রোশ দূরবর্তী মা-ওয়ারাউন্নাহার নামক অঞ্চলে আজযাওয়ান নামক এক নগরে এসে বসবাস করতে থাকেন। এই নগরেই তিনি ভূমিষ্ঠ হন। হযরত খিজির আঃ এর সাথে তাঁর কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁদের পরস্পরের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। হযরত খিজির আঃ তাঁর মাতাকে তাঁর শুভ জন্মগ্রহণ এবং বেলায়েতের শুভ সংবাদ প্রদান করেছিলেন।
পাঁচ বছর বয়স কালে তাঁর মাতা তাঁকে বোখারার বিখ্যাত আলেম শেখ সদরুদ্দীন রাঃ এর কাছে পড়াশুনা করার জন্য প্রেরণ করেন। তাঁর পাঠ্যাবস্থার প্রথম দিকে একবার তিনি কুরআন শরীফ পাঠ করার সময়ে এই আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, …………. তখন তিনি ওস্তাদজীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই আয়াতটির আসল হাকিকত কি? ওস্তাদ সাহেব জবাব দিলেন, এলমে লাদুন্নি (খোদা প্রদত্ত জ্ঞান) দ্বারা তুমি ক্রমে তা বুঝতে পারবে এবং এই এলম আল্লাহ পাক তোমাকে দান করবেন। বস্তুতঃ ওস্তাদের এই ভবিষ্যদ্বানী তাঁর পরবর্তী জীবনে বর্ণে বর্ণে সত্য হয়েছিল।
তিনি ২২ বছর বয়সে উপনীত হলে হযরত খিজির আঃ তাঁকে হযরত খাজা ইউসুফ হামাদানী রাঃ এর খেদমতে নিয়ে যান এবং তাঁর মুরিদ করে দেন। তখন হতেই তিনি হযরত খাজা হামাদানী রাঃ এর খেদমতে অবস্থান করতে থাকেন। খাজা ইউসুফ হামাদানী রাঃ তখন মা-ওয়ারাউন্নাহারে অবস্থান করতেছিলেন। যতদিন তিনি মা-ওয়ারাউন্নাহারে ছিলেন ততদিন খাজা আবদুল খালেক তাঁরই খেদমতে থেকে ফয়েজ লাভ করতে থাকেন। অতঃপর তিনি খোরাসান চলে গেলে খাজা আবদুল খালেক রাঃ তাঁর সঙ্গে না গিয়ে এখানেই অবস্থান করতে থাকেন। মা-ওয়ারাউন্নাহারে থেকে তিনি মোর্শেদের নির্দেশ ও হেদায়েত অনুসারে রিয়াযত ও মুজাহাদায় নিমগ্ন থাকেন।
খাজা খিজির আঃ এর তালিম অনুযায়ী নীরব জিকিরের পন্থায় কাজ করতে এবং লোকালয় হতে গোপনে ও নির্জনে থেকেইবাদত করতে থাকেন। যদিও খাজা ইউসূফ হামদানী রাঃ এর তরিকা ছিল জিকরে জ্বলি, কিন্তু তিনি কখনও খাজা আবদুল খালেকের জিকরে খফির তরিকার কখনও আপত্তি করেননি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিকির করা, কদমের প্রতি দৃষ্টি রাখা, লোকালয়ে থেকে নির্জনতা অবলম্বন করা এবং গৃহে অবস্থানরত অবস্থায় মুসাফির হয়ে থাকা প্রভৃতি কতকগুলো কথা নকশেবন্দী সিলসিলার মধ্যে প্রসিদ্ধ রয়েছে। এর সম্বন্ধ হযরত খাজা আবদুল খালেকের প্রতি করা হয়।
তাঁর সম্বন্ধে একটি বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণিত আছে যে, একবার আশুরার দিনে তাঁর কাছে বহু লোক উপস্থিত ছিল। আল্লাহ পাকের মারেফাত সম্পর্কে কথাবার্তা হচ্ছিল। এমন সময়ে একজন সুদর্শন যুবক এসে উপস্থিত হল। আকৃতি-প্রকৃতিতে যুবকটিকে আবেদ এবং যাহেদ বলে বোধ হতেছিল। তিনি এসে নীরবে এক কোণে বসে পড়লেন। খাজা আবদুল খালেক রাঃ কয়েকবার আড় চোখে তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। কিছুক্ষণ পর উক্ত যুবক সেখান থেকে উঠে তাঁর সামনে এসে পড়লেন এবং তাঁকে প্রশ্ন করলেন, রাসূলে খোদা সাঃ বলেছেন, ……………..
অর্থাৎ, মুমিনের অন্তরদৃষ্টিকে ভয় কর। কেননা, সে আল্লাহ পাকের নূরের সাহায্যে দর্শন করে থাকে। এই রেওয়ায়েতটির মধ্যে কি রহস্য নিহিত আছে? হযরত খাজা আবদুল খালেক গজদেওয়ানী রাঃ বললেন, এর মধ্যে রহস্য এই যে, তুমি পৈতা ছিঁড়ে ফেল এবং ঈমান আন। সে বলল, ………. আমার শরীরে তো কোন পৈতা নেই। তিনি তৎক্ষণাৎ খাদেমের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, উঠ এবং এই ব্যক্তির পরিধানের খেরকাটি খুলে ফেল। আদেশ পাওয়া মাত্র খাদেম তাই করল। সকলে বিস্ময়ের সাথে দেখতে পেল যে, তার কাঁধের উপর পৈতা ঝুলান রয়েছে। উক্ত যুবক তৎক্ষণাৎ পৈতা ছিঁড়ে ফেলল এবং হযরত খাজা সাহেবের পবিত্র হস্তে ইসলাম গ্রহণ করল। তখন হযরত খাজা সাহেব মজলিশে উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে বললেন, আস, আমরাও প্রত্যেকে নিজ নিজ পৈতা ছিঁড়ে ফেলি এবং নওমুসলিমের সাথে খাঁটি মুমিন হয়ে যাই। এই ব্যক্তি তার বাহ্যিক পৈতা ছিন্ন করে ফেলেছে। চল, আমরাও তার অনুকরণে আমাদের আভ্যন্তরীণ পৈতা অর্থাৎ, আত্মঅহংকার ছিন্ন করে ফেলি। তাহলে আল্লাহ পাক এই যুবককে যেমন মাফ করে দিয়েছেন, তদ্রƒপ আমাদেরও মাফ করে দিবেন।
এই কথাগুলো স্মরণ করে সকলে অস্থির হয়ে পড়ল। মজলিশের প্রত্যেক দিকে এক কান্নার রোল পড়ে গেল। উপস্থিত সকলে উঠে এসে নিজ নিজ মস্তক হযরত খাজা সাহেবের কদমের উপর স্থাপন করল এবং সকলে মহাঅনুতাপের সাথে খাঁটি মনে নতুন করে তওবা করল।
একবার তিনি কোন এক ব্যক্তিকে এরূপ বলতে শুনলেন যে, যদি আল্লাহ তায়ালা আমাকে দোযখ এবং বেহেশতের মধ্য হতে কোন একটিকে নিজের জন্য বেছে নেয়ার জন্য স্বাধীনতা প্রদান করে, তবে আমি বেহেশতকে নিজের জন্য কখনও পছন্দ করব না, বরং দোযখকে পছন্দ করব। কেননা, জান্নাত আমার নফসের পছন্দনীয় ও কাম্য। আমি কখনও নফসের কোন পছন্দ এবং কামনা পূর্ণ করিনি। আজও পূর্ণ করব না। তা শুনে হযরত খাজা আবদুল খালেক রাঃ বললেন এরূপ বলো না। কেননা, আমরা তাঁর দাস, পছন্দ না-পছন্দের সাথে দাসের কি সম্পর্ক? আল্লাহ তায়ালার যা পছন্দ তা আমাদেরও পছন্দ। তিনি যেখানেই পাঠাবেন সেখানেই যাব।
লোকটি জিজ্ঞাসা করল, তরিকতপন্থীর উপর কখনও শয়তানের প্রভাব এবং ক্ষমতা হয় কি? তিনি বললেন, তরিকতপন্থী নফসকে বিলীন করতে না পারা পর্যন্ত তার উপর শয়তানের ক্ষমতা এবং প্রভাব থাকে। কেননা, যে ব্যক্তি নফসকে ‘ফানা’ করে দিতে পারে তার মধ্যে ক্রোধ এবং গোস্বা অবশিষ্ট থাকে না। গোস্বা এবং ক্রোধ  অবশিষ্ট থাকলে তার উপর শয়তানের ক্ষমতা চলে। গোস্বা দূর হয়ে গেলে তখন তার মধ্যে সূক্ষè মর্যাদাবোধ উৎপন্ন হয়। শয়তান তখন তা হতে পলায়ন করে। এই মর্যাদা কেবল সেই ব্যক্তি লাভ করতে পারে, যার মনোযোগ শুধু আল্লাহ তায়ালার রাস্তার দিকে থাকে। সে ব্যক্তি ডান হাতে আল্লাহ তায়ালার কুরআন এবং বাম হাতে নবী করিম সাঃ এর হাদিস এবং সুন্নতকে ধারণ করে এতদুভয়ের আলোকে পথ অতিক্রম করতে থাকে। তিনি তার পুত্র হযরত খাজা আওলিয়ায়ে কবিরকে অসিয়ত করেন, বৎস ! আমি তোমাকে এলম, আদব, তাকওয়া, সুন্নতের পায়রবী ও জামাতের পাবন্দীর অসিয়ত করছি। নামাজ সর্বদা জামাতের সাথে আদায় করবে। হাদিস ও তাফসীরের তালিম হাসিল করবে, মূর্খ ও অজ্ঞ সূফীদের থেকে দূরে থেক। নিজের অবস্থা গোপন রেখ। কোন মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিন হইও না। কখনও কাজী বা শহরের শাসনকর্তার পদ গ্রহণ করো না। নিজের নামে কোন দলিল লিখে কোন সম্পত্তি ক্রয় করো না। রাজা বাদশাহদের সঙ্গে মেলামেশা করো না। নিজের জন্য কোন খানকাহ তৈরী করো না। নিজেকে কখনও শেখ অর্থাৎ, পীর বলে পরিচয় দিও না। সামা শ্রবণও করো না, তাকে নিন্দাও করো না। কথা খুব কম বলিও, খুব কম খাইও। খুব অল্প সময় শয়ন করিও। সাধারণ লোকের সংসর্গ হতে দূরে সরে থেক। শ্মশ্র“হীন বালক বা স্ত্রীলোকদের সোহবত এড়ায়ে চলো। দুনিয়ার অন্বেষণে কখনও মশগুল হয়ো না।
তিনি আরো বলেছেন, বৎস ! খুব বেশি রোদন করিও এবং খুব কম হাস্য করিও। সশব্দে হাস্য করা হতে নিজেকে রক্ষা করিও। কোন সৃষ্টজীব বা মানুষকে নিজের চেয়ে অধম বলে মনে করিও না এবং নিজেকে কারও চেয়ে উত্তম বলে মনে করিও না। নিজের বাহ্যিক অবস্থাকে সাজায়ে গুজায়ে রেখ না। যথাসম্ভব আল্লাহর সৃষ্টজীবের খেদমত করার চেষ্টা করিও। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টজীবের খেদমতে নিজ মাল উৎসর্গ করে দিতে কুণ্ঠিত হইও না। আউলিয়ায়ে কেরামকে নিজের প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয় মনে করিও না। তাঁদের কার্যকলাপের প্রতি কখনও প্রশ্নোত্থাপন করো না। অপর লোকের অন্তরসমূহকে হাতের মধ্যে নিয়ে রেখ অর্থাৎ, সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টায় রত থেকও এবং নিজের অন্তঃকরণকে সর্বদা চিন্তিত রেখ। তোমার শরীর যেন সর্বদা দুর্বল ও কৃশ এবং চক্ষু ক্রন্দনশীল থাকে। সরল ও অকপট মনে আমল করতে থাক। খুব বিনয়ের সাথে দোয়া করিও। পুরাতন বস্ত্র পরিধান করিও, আর দরবেশগণের সংসর্গে ও সোহবতে থেক। তোমার ইবাদতের প্রকৃত উদ্দেশ্য আল্লাহ পাক, তোমার ঘর মসজিদ, তোমার অন্তকরণ জিকিরকারী, তোমার রসনা শোকরকারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। ফিকির তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং জিকরে এলাহী তোমার চিরসাথী হতে হবে। নিজের পূর্বপুরুষ বুযুর্গানেদ্বীনের তরিকার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। অর্থাৎ নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফিকির ও জিকির করা, পায়ের প্রতি দৃষ্টি রাখা, গৃহে অবস্থানরত অবস্থায় মুসাফিরের ন্যায় থাকা, লোকালয়ে থেকে নির্জনে বাস, গতকৃত কর্মের হিসাব-নিকাশ নেয়া এবং অন্তরের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখা। মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার, জামানার অবস্থায় সজাগ থাকা, দুশমন সম্বন্ধে অবহিত থাকা। এই সমস্ত তরিকা তোমার পূর্বপুরুষ বুযুর্গানের তরিকা, তা অনুসরণ করে চলো।
তাযকেরা গ্রন্থসমূহে তাঁর বহু কারামত ও অলৌকিক ক্রিয়া বর্ণিত আছে। তাঁর তিনজন প্রধান খলিফা হলেনÑ খাজা আহমদ সিদ্দীক, খাজা আরেফ বিয়ুগরী এবং নিজ সাহেবজাদা খাজা আউলিয়ায়ে কবীর। তাঁদের মধ্যে খাজা আরেফ রিয়ুগরী রাঃ খুব উচ্চ স্তরে পৌঁছেছিলেন। তিনি বোখারা হতে ছয় ক্রোশ দূরবর্তী রিয়ুগর নামক স্থানে বাস করতেন। তাঁর খলিফার নাম খাজা মাহমুদ ফসফুনবী। তাঁর খলিফা ছিলেন খাজা আলি রামিতানী রাঃ। রামিতান বোখারা হতে দুই ক্রোশ কিংবা আড়াই ক্রোশ দূরে অবস্থিত একটি নগরের নাম। হযরত শেখ আবদুল খালেক রাঃ এর সমস্ত খলিফা বোখারার আশেপাশেই অবস্থান করতেন। খাজা আলি রামিতানী রাঃ বস্ত্র বয়নের ব্যবসা করতেন। তাঁর ফেরকার উপাধি ছিল ‘আযীযান’। তাঁর মাজার মোবারক খাওয়ারাযম দেশে অবস্থিত। উপরোক্ত সমস্ত বুযুর্গানে দ্বীন ছিলেন নকশেবন্দিয়া তরিকার আলীশান সিলসিলার (শৃঙ্খলের) দীপ্তিমান বড়াসমূহ।

হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ

তরিকতের ইমাম বিশ্বের তৎকালীন আউলিয়ায়ে কেরামের লক্ষ্যস্থল, সমস্ত খাজাগণের খাজা সূফীয়ায়ে কেরামের অবলম্বন হযরত খাজা বাহাউদ্দীন মোহাম্মদ নকশবন্দ রাঃ তরিকত ও মারেফাতের সে সমস্ত আরেফগণের অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা সারা জীবন অভাব-অনটন ও অনাহার উপবাসের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং সাধারণ মানুষের অন্তরকে মারেফাতে এলাহীর নূর দ্বারা উজ্জ্বল ও আলোকিত করেছেন।
তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদুল বোখারী। তিনি ছিলেন হোসাইনী সিলসিলার সাইয়্যেদ। তাঁর বংশ পরিচয় নিম্নরূপ ঃ
খাজা বাহাউদ্দিন মোহাম্মদ নকশবন্দ ইবনে মীর সাইয়্যেদ জালালুদ্দীন, ইবনে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ, ইবনে মীর সাইয়্যেদ যাইনুল আবেদীন, ইবনে সাইয়্যেদ মীর কাসেম, ইবনে সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীন, ইবনে সাইয়্যেদ মাহমুদ, ইবনে সাইয়্যেদ ঈলাক, ইবনে মীর সাইয়্যেদ নকীব, ইবনে মীর সাইয়্যেদ খালুকী, ইবনে মীর সাইয়্যেদ মুহীউদ্দীন, ইবনে সাইয়্যেদ মাহমুদ, ইবনে সাইয়্যেদ আলী আকবর, ইবনে ইমাম হোসাইন আসকারী রাঃ।
হযরত খাজা নকশবন্দ রাঃ ৭১৮ সালের মহররম মাসে কাসরে আরেফান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এটা বোখার শহর হতে এক ক্রোশ দূরে অবস্থিত। হযরত খাজা বাহাউদ্দিন মোহাম্মদ নকশবন্দ নামে প্রসিদ্ধি লাভের কারণ সম্বন্ধে বর্ণিত আছে যে, রূহানী তালিমের জন্য হযরত আমীর কালাল রাঃ এর হাতে সোপর্দ করা হলে হযরত আমীর কালাল রাঃ বললেন, “নকশ বাহাউদ্দী রা বরকন্দ।” এই কারণে তাঁকে নকশবন্দ বলা হত। কেহ বলেন, যে সমস্ত তরিকতপন্থী রূহানী শিক্ষার জন্য তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করত, তাঁর তালীম ঐ সমস্ত লোকের অন্তরে এমনভাবে নকশা অঙ্কিত করত যে, তারা এর ফলে অতি সহজে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যেত। কেহ কেহ বলেন, তিনি নিজের মুরিদদের ‘আল্লাহ’ নামটির নকশা লিখে দিতেন ও বলে দিতেন যে, অনবরত ধ্যান করে এই নামটির নকশা অন্তরে অঙ্কিত করে নাও। যার ফলে তোমার অন্তর ‘কালবুল মুমিনিন আরশাল্লাহ’ ‘মুমিনের কলব আল্লাহ পাকের আরশ’ রূপ লাভ করতে পারে। হযরত বাহাউদ্দীন মোহাম্মদ রাঃ কে নকশবন্দ নামে অভিহিত করার এটিই কারণ।
তরিকত সম্বন্ধীয় তালীম তিনি হযরত আমীর কালাল রাঃ হতে লাভ করেছিলেন। আর হাকীকতের তালীম তিনি হযরত ওয়াইস করণী রাঃ এর সিলসিলা হতে লাভ করেন। এই সিলসিলার তালীম তিনি হযরত খাজা আবদুল খালেক আজযাওয়ানী রাঃ এর রূহানী শক্তি হতে লাভ করেছিলেন। তিনি শরীয়ত সম্বন্ধে সর্বসাধারণের অনুসরণীয় এবং আহলে সুন্নাতওয়াল জামায়াতের অগ্রনায়ক ছিলেন।
হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ এর জন্মের পূর্বেই হযরত খাজা সামাসী রাঃ তাঁর জন্মগ্রহণ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। জন্মগ্রহণ করামাত্র হযরত খাজা সামাসী রাঃ তাঁকে নিজের সন্তানরূপে গ্রহণ করেন। ইন্তেকালের পূর্বে নিজের যোগ্যতম মুরিদ সাইয়্যেদ আমীর কালাল রাঃ কে অসিয়ত করলেন যে, আমার সন্তান বাহাউদ্দীনের প্রতি সদয় ও সস্নেহদৃষ্টি রাখতে এবং তাকে রূহানী তালীম প্রদান করতে কখনও ত্র“টি করবেন না। তিনি স্বীয় পীর মোর্শেদের এই আদেশ শিরোধার্য করে নেন।
বয়োপ্রাপ্ত হলে হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ সামারকন্দে গমন করেন এবং সেখানকার আউলিয়ায়ে কেরাম হতে ফয়েজ হাসিল করে সেখান হতে বোখারা গমন করেন এবং সেখানে বিবাহ করে কাসরে আরেফান নামক স্থানে বসবাস আরম্ভ করেন। ইতিমধ্যে হযরত মীর সাইয়্যেদ কালাল রাঃ বোখারায় গমন করেন। তখন হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ তাঁর নিকট বায়াত গ্রহণ করেন এবং তাঁর নিকট হতে রূহানী তালীম হাসিল করতে থাকেন।
রূহানী তালীম সম্পন্ন করার পর মরি সাইয়্যেদ কালাল রাঃ নকশবন্দ রাঃ কে বললেন, আমি আমর পীর বাবা সামাসী রাঃ এর নির্দেশ অনুযায়ী তোমার রূহানী তালীমের কাজ করে দিলাম ; কিন্তু তোমার যোগ্যতা অনেক ঊর্ধ্বে। অতএব আমি তোমাকে অনুমতি দিতেছিÑ যার নিকট হতে ফয়েজ হাসিল করতে চাও করতে পার। পীর সাহেবের অনুমতি পেয়ে তিনি হযরত শেখ ফাতাহ এবং খলিল আ-কার খেদমত করেন। শেখ ফাতাহ রাঃ বলতেন, বাহাউদ্দীন নকশবন্দের সীনার ভিতরে আল্লাহ তায়ালার অন্বেষণের যে আগুন জ্বলছে বোখারার জমিনে তার দৃষ্টান্ত অতি বিরল। খলিল আ-কার খেদমতে তিনি বার বছর অতিবাহিত করেন। তাঁরই সঙ্গে তিনি দুইবার হেজাজে গমন করেন। কিছুকাল পর খলিল আ-কা রাঃ মা-ওয়ারা উন্নাহার নামক রাজ্যের শাসনকর্তার পদ লাভ করেন এবং তিনি সুলতান খলিল আ-কা নামে খ্যাত হন। হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ বলেন, বাদশাহীর জামানায়ও আমি তাঁর মধ্যে যে সমস্ত বিষয় দেখতে পেয়েছি তাতে তাঁর প্রতি আমার মন আরও অধিক ঝুঁকে পড়ে। তাঁর বাদশাহীর কালে ছয় বছর আমি তাঁর সোহবতে ছিলাম। এই সময়েও তিনি আমাকে তরিকতের নানাবিধ আদব-কায়দা শিক্ষা দিতেন। তাঁর নিকট হতে যে শিক্ষা আমি লাভ করেছি তা আমার জীবনে খুব কাজে লেগেছে। হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ আরও বলেন, তাঁর রাজত্ব যখন পতনোন্মুখ হয়, তখন তাঁর শাসন ক্ষমতা ও আধিপত্য বিগড়ায়ে যায়। তার এই পতন দেখে আমার অন্তর হতে দুনিয়ার মূল্য ও মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়। তখন দুনিয়ার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমি মা-ওয়ারা উন্নাহার ত্যাগ করে বোখারায় ফিরে আসি এবং ‘যিওয়ারতুন’ নামক স্থানে অবস্থান করতে থাকি।
হযরত বাহাউদ্দীন রাঃ বলেন, আমার প্রথম জীবনে একবার এক আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। আমাকে দেখে তিনি বললেন, তোমাকে চিনা চিনা মনে হয়। আমি আরজ করলাম, আমি এই আশা পোষণ করছি যে, আমি যেন আল্লাহ পাকের বন্ধুগণের নেক নজরের বরকতে আল্লাহ তায়ালাকে চিনতে পারি। তিনি আমার জীবিকা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি উত্তর করলাম, কিছু পেলে আহার করি, অন্যথায় সবর ও শোকর করি। তিনি মৃদু হেসে বললেন, এ তো খুব সহজ কাজ। প্রকৃত কাজ তো এই যে, নফসকে তওবার মোকামে আনয়ন করা, যেন রুটি বা রিজিক না পেলে অবাধ্যতাচরণ না করে। আমি তাঁর কাছে কিছু উপদেশ চাইলাম। তিনি বললেন, জঙ্গলের দিকে চলে যাও এবং দুনিয়াদারগণ হতে তোমার নফসের যাবতীয় কামনা-বাসনা ছিন্ন করে ফেল। তৎপর তিন দিন পর্যন্ত এই দেশের জমিনের উপর চলাফেরা কর। চতুর্থ দিবসে তুমি পাহাড়ের পাদদেশে একটি ঘোটকীর খালি পিঠের উপর একজন আরোহীকে দেখতে পাবে। তাঁকে আদবের সাথে সালাম করে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তুমি তাঁর দিকে তিন পা অগ্রসর হতেই তিনি উচ্চৈঃস্বরে তোমাকে বলবেন, আমার কাছে একটি রুটি আছে, নিয়ে যাও। তুমি সেদিকে আদৌ কর্ণপাত করবে না।
হযরত বাহাউদ্দীন রাঃ বলেন, এই বুযুর্য ব্যক্তি আমাকে যা যা করতে বলেছিলেন আমি ঠিক তাই করলাম এবং যা যা ঘটবে বলে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ঠিক তাই ঘটেছিল। সেই আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ ব্যক্তি বললেন, মানুষের মন রক্ষার প্রতি এবং দুর্বল ও দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের প্রতি কেহই লক্ষ্য করে না। তোমার কর্তব্য হবে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং মানুষের সাথে বিনয় ও নম্র ব্যবহার করা। আমি খুব দৃঢ়তার সাথে এই নসিহতগুলো মেনে চললাম। অতঃপর তিনি আরো বললেন, ইতর প্রাণীরাও আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট জীব। তাদের প্রতিও দয়া করা উচিত। কোন প্রাণী আহত হলে তার যখমের চিকিৎসা করা উচিত।
আমি খুব দৃঢ়তার সাথে তাঁর এই আদেশটিও পালন করতে লাগলাম। আমার চলার পথে যেখানেই আমার সামনে কোন প্রাণী এসেছে তা আমাকে অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত আমি নিজের স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়ায়ে থাকতাম। সাত বছর পর্যন্ত এভাবে আমি তাঁর আদেশ মেনে চলেছি।
হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ বলেন, একদা আমি একটি গিরগিটিকে দেখলাম, সূর্যের দিকে তাকায়ে আল্লাহ পাকের সৌন্দর্য অবলোকনে বিভোর হয়ে পড়েছে। তা দেখে আমার মধ্যে এক অপূর্ব হালের উদয় হল। আমি মনে মনে ভাবলাম, এই গিরগিটির সাহায্যে সেই মহান আল্লাহর দরবারে কিছু সুপারিশ করার জন্য তার কাছে বাসনা জ্ঞাপন করব। এই ভেবে আমি আদবের সাথে দাঁড়ায়ে দোয়ার জন্য হাত উঠালাম। সঙ্গে সঙ্গে গিরগিটি আত্মহারা অবস্থা ত্যাগ করে চিৎ হয়ে নিজের পৃষ্ঠদেশ জমিনের উপর স্থাপন করল এবং আসমানের দিকে মুখ করল। যেন সে আমার জন্য দোয়া করছে। আমি বহুক্ষণ পর্যন্ত ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলতে থাকলাম।
হযরত বাহাউদ্দীন রাঃ বলেন, আমি আত্মহারা অবস্থায় আবেগে নানাদিকে ঘুরে বেড়াতাম। ফলে আমার পায়ে ফোসকা ফুটে গিয়েছিল। একটি চর্ম-নির্মিত পুরাতন জুব্বা পরিধান করতাম। শীত কাল আসার ফলে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে লাগল। এই অবস্থায়ই আমি একদা রাতে সাইয়্যেদ মীর কালাল রাঃ এর খেদমতে পৌঁছলাম। তখন সেখানে আরো অনেক দরবেশ উপস্থিত ছিলেন। হযরত পীর সাহেব আমাকে দেখে বললেন, এই লোকটি কে? কেহ কেহ বলল, ইনি উমুক। হযরত পীর সাহেব বললেন, তাকে এখান হতে বের করে দাও। আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসলে আমার নফস বড়ই অবাধ্যতাচরণ শুরু করল। কিন্তু আমি দৃঢ়তার সাথে সবর করলাম এবং মনে মনে ভাবলাম, যেহেতু আমার এই অপমান আল্লাহ তায়ালার তরফ হতে হচ্ছে, কাজেই তা ছাড়া গত্যন্তর নেই।  সুতরাং মনে মনে স্থির করলাম, যত দুর্ব্যবহার করা হোক না কেন, এই দরবার হতে মুখ ফিরাব না। এসময় ভীষণ বরফ পড়তেছিল। বাতাস দারুণ ঠাণ্ডা ছিল। আমি সারা রাত এই দারুণ শীত ও বরফের মধ্যে বাইরে পড়ে থাকলাম। প্রাতঃকালে মীর সাইয়্যেদ কালাল রাঃ স্বয়ং এসে আমাকে ঘরে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে ভাগ্যবান সন্তান ! সৌভাগ্যের পোষাক তোমার সঙ্গেই শোভা পায়। অতঃপর স্বহস্তে আমার পায়ের কাঁটাগুলো খুলে দিলেন, ক্ষতস্থানগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলেন এবং অতিশয় স্নেহ ও মহব্বতের সাথে আমার সাথে বাক্যালাপ করলেন।
হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ বলেন, একদিন আমি মীর সাইয়্যেদ কালাল রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বোখারা হতে নাসাফের দিকে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে একজন খেরকাধারী অশ্বারোহী আমার সামনে এসে কিছু কথাবার্তা বললেন, আমি সেদিকে মনোযোগ দিলাম না। আমি হযরত মীর কালাল রাঃ এর খেদমতে পৌঁছলে তিনি আমাকে বললেন, তোমার সামনে খেজের আঃ এসেছিলেন, তুমি তাঁর প্রতি মনোযোগ দিলে না! আমি বললাম, আমি আপনার খেদমতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আসছিলাম, অতএব এদিক ভিন্ন অন্য দিকে আমার মনোযোগ ছিল না।
হযরত নকশবন্দ রাঃ বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় এক রাতে আমি যিওয়ারতুনের মসজিদের একটি স্তম্ভের পার্শ্বে কেবলামুখী হয়ে মোরাকাবায় রত ছিলাম। ক্রমশঃ আত্মবিলুপ্তির লক্ষণ আমার মধ্যে প্রকাশ পেতে লাগল। ক্রমে ক্রমে এই অবস্থা এত প্রবল হয়ে উঠল যে, আমি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেলাম। তখন আমার কানে আওয়াজ আসল, তুমি নিজের উদ্দিষ্ট বস্তু পেয়ে গিয়েছ। একটু পরেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলাম।
হযরত বাহাউদ্দীন রাঃ বলেন, মঞ্জিল ও মকামসমূহ অতিক্রম করার সময় একবার হযরত হোসাইন মনসুর হাল্লাজের অবস্থা আমার মধ্যে প্রকাশ পেল। তাঁর সেই ‘আনাল হক’ আওয়াজটি আমার মুখ দিয়েও বের হওয়ার উপক্রম হল। বোখারা শহরে একটি ফাঁসীকাষ্ঠ ছিল। আমি দুইবার সেই ফাঁসীকাষ্ঠের নিকট গিয়ে বলেছিলাম, আমার মস্তক এই ফাঁসীকাষ্ঠেরই উপযোগী। কিন্তু আল্লাহ পাকের অশেষ দয়ার ফলে আমি সেই মকাম অতিক্রম করলাম।
হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ উচ্চৈঃস্বরে জিকির করতেন না, বরং তিনি নীরবে জিকির করতেন। যখন হযরত মীর সাইয়্যেদ কালাল রাঃ এর মুরিদগণ উচ্চৈঃস্বরে জিকির আরম্ভ করতেন, তখন তিনি সেই মজলিশ হতে উঠে চলে যেতেন। যদিও তা তাঁর অন্যান্য পীর ভাইদের নিকট অপছন্দীয় বোধ হত। কিন্তু তিনি তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতেন না। হযরত বাহাউদ্দীন রাঃ মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিবারণের প্রতি সর্বদা লক্ষ্য রাখতেন। একই সঙ্গে হযরত মীর সাইয়্যেদ কালাল রাঃ এর খেদমত এবং তাঁর আদেশ পালনে তিনি বিন্দুমাত্র ত্র“টি করতেন না। হযরত মীর সাইয়্যেদ সাহেবের মনোযোগও হযরত নকশবন্দ রাঃ এর প্রতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

অমিয়বাণী :
হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ বলেছেন,
ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নতে মুয়াক্কাদা পালন করাই আমাদের পন্থা। এই পন্থা আমাদের আল্লাহ পাকের দরজা দিয়ে তাঁর সকাশে প্রবিষ্ট করে দিয়েছে।
যারা আমাদের তরিকাভুক্ত আমাদের পায়রবী করা তাদের কর্তব্য, অন্যথায় আমাদের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।
নিজের সত্তা লোপ করে দাও এবং এমনভাবে আমল কর যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়।
দরবেশের জন্য পীরের খেদমত করা নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
কেহ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে তিনি প্রথমে তাঁর খেদমত করতেন। অতঃপর তার বাহন জন্তুটির খেদমত করতেন, তৎপর বলতেন, আগন্তুকের দয়া আমার ঘাড়ের উপর রয়েছে। তিনি কোন সময় তাঁর কোন মুরিদের বাড়ি গেলে গৃহস্বামীর ছেলেমেয়েদের, চাকর নওকর তথা গোটা পরিবারের অবস্থা জিজ্ঞাসা করতেন। এমনকি, গৃহপালিত পশুগুলোর অবস্থাও জিজ্ঞাসা করতেন।
যিনি বন্ধুর মিলন লাভ করেছেন তিনি আদব রক্ষার ফলেই তা লাভ করেছেন। আর যারা বঞ্চিত হয়েছেন তারা আদব রক্ষা না করার কারণেই বঞ্চিত হয়েছেন।
জায়েজ কার্য হলেও তা যদি নফসের কাম্য হয়, তবে তাতে নফসের বিরোধীতা করা কর্তব্য। নফসের বিরোধীতা করার তওফীক যার হয়, সামান্য আমলও প্রচুর বলে বিবেচিত হয়।
আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য সকল বস্তু হতে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবে। আর যে বস্তুর প্রতি নফসের আকর্ষণ লক্ষ্য করবে তা হতে দূরে থাকবে। তবুও যদি তরিকতপন্থীর সামনে স্বীয় অস্তিত্বের কোন লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হয়, তবে তাকেও বিলোপ করে দিবে। কেননা, যে পর্যন্ত অস্তিত্বের লক্ষণরূপ সকল হাল, সেফাত, গতিবিধি, দেহের ও অন্তরের কোন প্রকার সম্পর্ক বা চিন্তা হতে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ জাল্লাশানুহুর প্রতি মশগুল না হয়ে পড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার মধ্যে সত্যিকারের বান্দার আখলাক ফুটে উঠবে না এবং এখলাসের সৌভাগ্যও লাভ করতে পারবে না।
বোখারার কোন একজন আলেম হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, কিসের দ্বারা নামাজের মধ্যে ‘হুজুরে কালব’ লাভ করা যেতে পারে? তিনি বললেন, হালাল রুজীর দ্বারা যা সুনিশ্চিতভাবে হালাল জেনেও খেতে হয়।
তিনি বলেন, অলিত্ব একটি নেয়ামত। অলির জন্য নিজের অলিত্ব সম্বন্ধে অবগত থাকা অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা, অবগতি না থাকলে সে এই মহান নেয়ামতের শোকর আদায় করতে পারবে না। অলিগণ আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে সর্বপ্রকার বিপদাপদ হতে সুরক্ষিত থাকেন। অলির দ্বার অস্বাভাবিক কাজ সম্পন্ন হওয়া এবং কারামত প্রকাশ পাওয়া অলিত্ব প্রমাণের জন্য নির্ভরযোগ্য বিষয় নয়। ফলকথা- কথা ও কাজের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা। এই পথের পথিকগণ শুধু আল্লাহ পাকের আদেশ ও নিষেধসমূহ পালনের দ্বারাই আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে খাস বেলায়েত লাভ করে থাকেন। এই সম্প্রদায় তিন শ্রেণীতে বিভক্ত- ১. মুকাল্লেদ, ২. কামেল ও ৩.  কামেলে মুকাম্মেল। মুকাল্লেদগণ শুনে শুনে আমল করে থাকেন। আর কামেল ব্যক্তি নিজের সত্তার সীমা অতিক্রম করেন না এবং করতে পারেনও না।
তিনি বলেন, এরাদা, তাসলীম ও এখতেয়ারহীনতা অতি বড় গুণ। এই গুণ সমূহ নিজের মধ্যে উৎপন্ন করা বিরাট কাজ। এরাদা বা ইচ্ছাকে ত্যাগ করার নামই ‘এরাদা’। মুরিদের কর্তব্য নিজের এখতিয়ারকে সম্পূর্ণরূপে লোপ করে দিয়ে মোর্শেদের মরযীর উপর নিজের ইচ্ছাকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেয়া। তাকেই তাসলীম বা আত্মসমর্পণ বলে।
মোর্শেদ বিচক্ষণ বা অভিজ্ঞ চিকিৎসাকের তুল্য। তিনি আবশ্যক অনুযায়ী মুরিদের বাতেনী রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। চিকিৎসার ব্যাপারে মুরিদের পক্ষে নিজের এখতিয়ার বা ইচ্ছার দখল দেয়া হলাহল তুল্য।
জিকিরের তালীম ও তালকীন কামেল ও মুকাম্মেল পীরের দ্বারা হওয়া উচিত। তা হলে জিকিরে ক্রিয়া দেখা যাবে এবং ফল প্রকাশ পাবে। জিকিরের উদ্দেশ্য হল ‘জিকির’ কলেমায়ে তাওহীদের হাকীকত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। জিকির মুখে খুব অধিক পরিমাণে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। কলেমার হাকীকত এই যে, তা বার বার উচ্চারণ করার ফলে অন্তর হতে অন্যান্য নাম সম্পূর্ণরূপে লোপ পাবে।
খালেকের প্রতি সর্বদা এমনভাবে নজর নিবন্ধ করে রাখবে যে, কোন মাখলুক দৃষ্টিগোচরই হবে না। মুশাহাদা- গায়েবী হালাত বা আনওয়ার অন্তরে নাজিল হওয়াকে মুশাহাদা বলে। এসমস্ত হালাত ও আনওয়ার যেহেতু অতি বাহমান জমানার মত অস্থায়ী, এই কারণে তোমরা তা অনুভব বা উপলব্ধি করতে পার না। অবশ্য সঙ্কীর্ণতা ও প্রশস্ততার অবস্থায় কোন হালাত নাজিল হলে তা উপলব্ধি করা যায়। কেননা সঙ্কীর্ণতার অবস্থায় আমরা আল্লাহ পাকের ‘জালালী’ সেফাত প্রত্যক্ষ করে থাকি, আর প্রশস্ততার অবস্থায় আমরা আল্লাহ পাকের সেফাতী ‘জামালী’ অবলোকন করে থাকি। মুহাসাফার অর্থ এই যে, তোমার প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব নিয়ে দেখবে যে, তোমার এই মুহূর্তটি অন্তরকে আল্লাহ পাকের দরবারে হাজির রেখে অতিবাহিত হল, না অনুপস্থিত রেখে বা তাঁর দরবার হতে গাফেল থেকে অতিবাহিত হল। যদি দেখতে পাও যে, এই মুহূর্তটি আল্লাহ পাক হতে গাফেল থেকে অতিবাহিত হয়েছে, তবে তোমার এই মুহূর্তটি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছে। তোমাকে এর সংশোধন বা ক্ষতিপূরণ করতে হবে। অর্থাৎ প্রথম হতে আমল করতে হবে। আমল করার সময় এমন খেয়াল বা কল্পনাকে মনে স্থান দেয়া যাবে না যে, আমি কিছু আমল করেছি, বরং নিজেকে সর্বদা নগণ্য এবং ত্র“টিপূর্ণ মনে করতে হবে।
তিনি বলেন, ইবাদতের অর্থাৎ, বন্দেগীর মধ্যে অস্তিত্বের অন্বেষণ। আর অবুদিয়াতের অর্থাৎ দাসত্বের মধ্যে অস্তিত্বকে বিলোপ করে দেয়া। যে পর্যন্ত নিজত্ব বোধ অবশিষ্ট থাকবে সে পর্যন্ত কোন আমলেই ফল পাওয়া যাবে না।
যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিয়েছে, তার পক্ষে অপরের কাছে কিছু কামনা করা শিরকেরই শামিল। এই শিরক সাধারণ স্তরের লোকের জন্য দণ্ডভোগের যোগ্য নয়। কিন্তু খাস লোকদের জন্য জঘন্য অপরাধমূলক।
আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তির কর্তব্য নিজেকে নির্ভরশীল বলে কল্পনা না করা, বরং নিজের তাওয়াক্কুলকে উপার্জনের আড়ালে লুকায়ে রাখা কর্তব্য।
আমরা তরিকতের পথে নিজেদের জন্য হীনতা ও অপমানকে পছন্দ করেছি কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নিজ গুণে আমাদের সম্মান দান করেছেন।
অভ্যাস কোন কোন সময় মহব্বতে পরিণত হয়। তরিকতপন্থীর জন্য সময় সময় নফল ইবাদত ত্যাগ করা জায়েজ আছে। তাতে অভ্যাসের সাথে মহব্বত হয় না।
বাইরে রংবিহীন এবং ভিতরে বিরোধিতাবিহীন হওয়া দরবেশী।
পূর্বে আমরা নিজেদের অন্বেষণীয় এবং অপরকে অন্বেষণকারী বলতাম, কিন্তু এখন আমরা এই তরিকা বর্জন করেছি। প্রকৃত মোর্শেদ আল্লাহ তায়ালাই বটে, যে ব্যক্তি তাঁর পথের অন্বেষণকারী হয়, তাকে তিনিই আমাদের কাছে প্রেরণ করে থাকেন। তখন যা কিছু তার প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত থাকে তা সে প্রাপ্ত হয়।
‘মাজায’ হাকীকতের জন্য পুল বা সেতু স্বরূপ। এ কথার সারমর্ম এই, সমস্ত ইবাদত চাই তা জাহেরী হোক আর বাতেনীই হোক, কথায় হোক বা কাজেই হোক সমস্তই মাজায। যে পর্যন্ত তরিকতপন্থী এ সমস্ত অতিক্রম না করতে পারবে, সে পর্যন্ত হাকীকতে পৌঁছতে পারবে না।
কেউ জিজ্ঞাসা করল, কোন ফকিরের ‘হাল’ ছিনায়ে নেয়া হলে তার কি করা উচিত ? তিনি বললেন, যদি তার মধ্যে হাল বিন্দু পরিমাণও অবশিষ্ট থাকে, তবে তার বুঝতে হবে যে, তার কাছে কান্নাকাটি ও কাকুতি মিনতি চাওয়া হচ্ছে। আর যদি কিছুমাত্রও অবশিষ্ট না থাকে, তবে বুঝতে হবে যে, তার কাছে সবর এবং ‘রেযা’ অর্থাৎ আল্লাহ পাকের বিধানের প্রতি সন্তোষ চাওয়া হচ্ছে।
মহব্বতের জন্য অজিফা এই যে, হাবীব মাহবুবের অন্বেষণে সর্বদা লেগে থাকবে। মাহবুব যত অধিক প্রিয় হবে। তার অন্বেষণের পথে অতোধিক বিপদ-আপদ থাকবে।
এই পথের অন্বেষণে পূর্ণতা এই যে, অন্বেষণকারী সর্বদা অস্থির ও অশান্ত থাকে।
তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালাকে অন্বেষণকারীর রূহানীয়াতের পাখী যখন কোন উপযুক্ত মোর্শেদের তালীম ও তরবিয়াত প্রাপ্ত হয়ে মনুষ্যত্ব রূপ ডিমের খোলস ত্যাগ করে বের হয়ে আসে, তখন সে কোথা দিয়ে কোথায় উড়ে যায় এর খবর আল্লাহ পাক ভিন্ন আর কেউ জানে না।
তিনি বলেন, খোসা দিয়ে শাঁসের হেফাযত হয়ে থাকে। খোসার মধ্যে কোন প্রকার দোষ জন্মিলে তার ক্রিয়া বা প্রভাব শাঁসের মধ্যেও গিয়ে পড়ে। শরিয়ত খোসা আর তরিকত শাঁস। শরিয়তের বিধান পালনে কোন প্রকার ক্রটি ঘটলে তার ক্রিয়া বা প্রভাব অবশ্যই তরিকতের উপরও পড়বে।
হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ ৭৯১ হিজরি ৩রা রবিউল আউয়াল কাসরে আরেফান নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন। নকশেবন্দিয় তরিকা তাঁর হতেই উদ্ভূত।

হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী রাঃ

হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দীর নাম মুসলিম ইতিহাসে সুপ্রসিদ্ধ। তিনি ‘মুজাদ্দিদে আলফেসানী’ অর্থাৎ দ্বিতীয় শতাব্দীর মৃতপ্রায় ইসলামের পুনর্জীবন দানকারী নামে সুপরিচিত। দ্বিতীয় শতাব্দীতে হিন্দুস্থানে ইসলাম ধর্ম বাদশাহগণের হাতের ক্রীড়ানক হয়ে পড়েছিল। কুসংস্কারের বেড়াজালে সমগ্র দেশ আচ্ছন্ন হয়েছিল। ঠিক এই সময় আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপায় সিরহিন্দের আকাশে এই পূর্ণ চন্দ্রের আবির্ভাব ঘটে। এই মহান ব্যক্তিই ইসলামী দুনিয়াকে বাদশাহ আকবরের নবাবি®কৃত ‘দ্বীনে এলাহী’ নামক অলীক ধর্মের রাহুর করাল গ্রাস হতে মুক্ত করেন। ফলে, বেদাত ও শিরকের অন্ধকার হিন্দুস্থান হতে বিদূরিত হয়। এই পূর্ণ চন্দ্র ও যুগ প্রবর্তক ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেসানী হযরত সাইয়্যেদ আহমদ সেরহিন্দ রাঃ এই উপমহাদেশের সমস্ত বেদাত ও কুসংস্কারের মূল উৎপাটন করে ইসলামী পতাকাকে এত সমুন্নত করে গিয়েছেন অর্থাৎ তিনি এদেশবাসীকে যে মহান শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে দিয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব আল্লাহর রহমতে দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত জারি থাকবে।
তাঁর আসল নাম আহমদ। আবুল বারাকাত তাঁর কুনিয়াত, বদরুদ্দীন অর্থাৎ ধর্মের পূর্ণচন্দ্র তাঁর উপাধি, মুজাদ্দিদ তাঁর যুগোচিত পদবী। তাঁর পিতার নাম শেখ আবদুল আহাদ রাঃ। সেরহিন্দ নামক স্থানে তিনি ভূষিষ্ঠ হন। হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাঃ এর পিতা একজন শ্রেষ্ঠ আলেম ও কামেল লোক ছিলেন। তাঁর আম্মা ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ আবেদাহ। তিনি ফরজ ইবাদত ছাড়াও নফল ইবাদতের পাবন্দ ছিলেন। তৎকালে একজন নেককার ও পরহেযগার মহিলা হিসাবে তাঁর খুব খ্যাতি ছিল। তিনি বলেছেন, শেখ আহমদ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আমি একটু অজ্ঞানের মত হয়ে পড়েছিলাম। সে অবস্থায় আমি দেখতে পেলাম হযরত নবী করিম সাঃ এর উম্মতের সকল কামেল অলি আমার ঘরে তশরীফ এনেছেন। তাঁদের মধ্য হতে আমার কানে এই আওয়াজটি এসে পৌঁছল যে, আল্লাহ তায়ালা শেখ আহমদকে সর্বপ্রকার কামালিয়ত দান করেছেন। যে ব্যক্তি তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবে আল্লাহ পাক তাকে নাজাত দান করবেন।
৯৭১ হিজরির ৪ শাউয়াল মোতাবেক ১৫১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন শুক্রবার ইমামে রব্বানী হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে সেরহিন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি খতনাকৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হন। তিনি শৈশব হতে খুবই ধৈর্যশীল ছিলেন। সাধারণ শিশুদের মত কখনো চেচামেচি করেননি। কাজের ব্যস্ততার দরুন তাঁর আম্মা তাঁকে সময়মত স্তন দান করতে না পারলেও তিনি কখনও অস্থির হয়ে কাঁদতেন না ; বরং সবর করতেন। শৈশব কালেও কোন সময় কেহ তাঁর সতর (গুপ্তাঙ্গ) দেখতে পায়নি।
শৈশব কালে তিনি একবার কঠিন রোগ ভোগার কারণে খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁর পিতা শেখ আবদুল আহাদ রাঃ পুত্রের জন্য খুব ঘাবড়ায়ে যান। সেই সময়ে হঠাৎ একদিন কুতুবুল আকতাব হযরত শাহ কামাল রাঃ সেরহিন্দে শুভাগমন করেন। সংবাদ পেয়ে শেখ আবদুল আহাদ স্বীয় পীড়িত শিশুকে নিয়ে তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলেন এবং পুত্রের রোগমুক্তির জন্য দোয়া করতে আকুল আবেদন জানালেন। হযরত কুতুবুল আকতাব শিশুর প্রতি দৃষ্টি করা মাত্র উঠে দাঁড়ালেন এর্ব বললেন, এই শিশুটি এই যুগে উম্মতে মুহাম্মদী সাঃ এর মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি। তাঁর তাজীমের জন্যই আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। এই বলে তিনি নিজের জিহ্বা শিশুর মুখে ঢুকায়ে দিয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখলেন। অতঃপর বললেন, আমি কাদেরিয়া তরিকার সমুদয় বরকত এই শিশুকে দান করলাম। দেখতে দেখতে হযরত মুজাদ্দিদ সুস্থ ও সবল হয়ে উঠলেন।
হযরত শাহ কামাল রাঃ সিলসিলাক্রমে হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর খেরকা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। শেখ আহমদ সেরহিন্দ রাঃ সাত বছর বয়সে পদার্পণ করলে হযরত শাহ কামাল রাঃ পরলোক গমন করেন। ইন্তেকালের সময় তিনি স্বীয় পৌত্র শাহ সেকান্দরকে অসিয়ত করেন যে, হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর এই খেরকাটি মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ কে পৌঁছায়ে দিও। যথাসময়ে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব হযরত বড়পীর সাহেবের খেরকা লাভ করেন।
হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের পিতা হযরত মখদুম শেখ আবদুল আহাদ রাঃ হযরত শেখ আবদুল কুদ্দুস গাঙ্গুহীর মুরিদ ও প্রধান খলিফা ছিলেন। হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব ভাইয়ের মধ্যে ছোট এবং তিন ভাইয়ের বড় ছিলেন। অষ্টবিংশতম পুরুষের মাধ্যমে তাঁর বংশ-সম্পর্ক হযরত ওমর ফারুক রাঃ এর সাথে মিলিত হয়। হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ নকশেবন্দিয়া তরিকার হযরত খাজা বাকিবিল্লাহ দেহলভী রাঃ, কাদেরিয়া তরিকায় হযরত শাহ সেকান্দার কীথালী রাঃ এর এবং চিশতিয়া সাহরাওয়ার্দীয়া তরিকায় নিজের বুযুর্গ পিতা হযরত শেখ আবদুল আহাদ ফারূকী রাঃ এর মুরিদ ছিলেন।
হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ এর মেধাশক্তি ছিল অসাধারণ। তিনি সাত বছর বয়সে পূর্ণ কুরআন মজিদ হেফজ সমাপ্ত করেন এবং ১৭ বছর বয়সে সর্ববিধ শাখায় এলম পূর্ণরূপে হাসিল করে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। তাঁর ওস্তাদগণের মধ্যে মাওলানা কামাল কাশমীরী এবং মাওলানা ইয়াকুব কাশমীরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেরহিন্দে জাহেরী এলম শিক্ষা লাভ করেও তিনি তাঁর জ্ঞান পিপাসা মিটল না। সুতরাং আরো অধিক জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে তিনি তৎকালীন হিন্দুস্তানের রাজধানী আকবরাবাদে গমন করেন। তিনি ঘুরে ঘুরে সেখানকার আউলিয়ায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানকার উলামায়ে কেরামগণ এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকের অতুলনীয় মেধাশক্তি, অগাধ জ্ঞান এবং বিচক্ষণতা দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যান। পরিশেষে তাঁর নিকট হতেই সকলে এলম হাসিল করতে আরম্ভ করেন। আকবরের নবরতেœর আবুল ফযল এবং ফয়জীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁকে এলমের সাগর এবং যুগের যোগ্যতম ও শ্রেষ্ঠতম আলেম বলে স্বীকার করেন।
থানেশ্বর এলাকার শাসনকর্তা শেখ সুলতান একজন নেককার এবং অতিশয় ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। একরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ তাঁকে বলছেন, “হে সুলতান ! তোমার কন্যাকে শেখ আহমদ সেরহিন্দ এর সাথে বিবাহ দাও।” এই স্বপ্ন দেখে তিনি খুবই অস্থির হয়ে পড়েন। কারণ তিনি শেখ আহমদ সেরহিন্দ কে চিনতেন না। এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হুজুর সাঃ শেখ আহমদ সেরহিন্দ কে তাঁর সামনে উপস্থিত করলেন। তিনি শেখ সেরহিন্দ রাঃ এর চেহারা পরিষ্কাররূপে দেখতে পেলেন।কিন্তু বুঝতে পারলেন না তাঁর বাড়ি কোথায়? কোথায়ই বা তাঁকে পাওয়া যাবে?
ঘটনাক্রমে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এই সময়ে থানেশ্বর আগমন করেন। অতএব, শেখ সুলতান তাঁকে দেখেই চিনতে পারলেন যে, সেই স্বপ্নে দৃষ্ট চেহারা। কিন্তু মুজাদ্দিদ সাহেবের কোন পরিচয় তিনি জানতে না পেরে সুলতানের মনে নানা প্রকার চিন্তা-ভাবনার উদয় হতে লাগল। অনন্তর পরবর্তী রাতেই তিনি আবার হুজুর সাঃ এর নির্দেশ পেলেন, হাঁ, তাঁর সঙ্গেই তোমার মেয়ের বিয়ে দাও। সুতরাং পরবর্তী দিনই সুলতান হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের নিকট গমন করে স্বপ্ন বৃত্তান্ত ও স্বীয় আরজুর কথা প্রকাশ করলেন। তদুত্তরে তিনি বললেন, এ সম্বন্ধে আমি কিছুই বলতে পারি না। আমার পিতা আছেন, তাঁর নিকট বলুন। অতএব, শেখ সুলতান হযরত শেখ মখদুম আবদুল আহাদ রাঃ এর সমীপে গিয়ে স্বপ্ন বৃত্তান্ত এবং হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের উত্তর অবহিত করলেন। মখদুম হযরত আহাদ রাঃ হুজুর সাঃ এর নির্দেশ জ্ঞাত হয়ে প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করলেন এবং যথা সময়ে শুভ বিবাহ সম্পন্ন হল।
বিবাহের কিছুদিন পর হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে মরণাপন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর অন্তিম অবস্থা মনে করে তাঁর পতœী অজু করে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন, অতঃপর নিতান্ত কাকুতি মিনতির সাথে স্বামীর আরোগ্যের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করতে লাগলেন। মোনাজাতের মধ্যে তিনি একটু তন্দ্রাভূত হয়ে পড়লে একটি গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেলেন, তুমি অধীর হয়ো না। তোমার স্বামীর মৃত্যুর সময় এখনও হয়নি। শীঘ্রই সে আরোগ্য লাভ করবে। সে দুনিয়াতে বহু মহৎ কাজ করার জন্য এসেছে। তার কিছুই এখনও করা হয়নি।
আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীতে তিনি শীঘ্র সুস্থ হয়ে উঠলেন। অনন্তর নিজ পিতা কেবলার খেদমতে থেকে রূহানী তালীমে উন্নতি সাধন করতে লাগলেন। এমন সময়ে পিতা কেবলার অন্তিম সময় ঘটায়ে আসল। তিনি স্বীয় পীর হযরত আবদুল কুদ্দুস গোঙ্গুহী রাঃ হতে প্রাপ্ত চিশতিয়া সিলসিলার খেলাফতের খেরকা ও অন্যান্য সকল মোবারক বস্তুগুলো হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ কে দান করে চিশতিয়া তরিকার খেলাফত দান করলেন।
হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ প্রথমে নিজের পিতার নিকট হতে চিশতিয়া তরিকার বাতেনী তালীম হাসিল করে খেলাফত লাভ করেন। অতঃপর কুতুবুল আকতাব হযরত শাহ কামাল রাঃ এর সাহেবজাদা হযরত শাহ সেকান্দর কীথালী রাঃ এর নিকট কাদেরিয়া সিলসিলার মুরিদ হয়ে সর্বোচ্চস্তরে উপনীত হন এবং কাদেরীয়া তরিকার খেলাফত ও হযরত গাউসুল আযম কর্তৃক প্রদত্ত খেরকা লাভ করেন। অতঃপর হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ নকশবন্দী রাঃ এর মুরিদ হয়ে নকশেবন্দিয়া সিলসিলার বাতেনী এলম হাসিল করে খেলাফত লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এই নকশেবন্দিয়া তরিকার কিঞ্চিত সংস্কার সাধনপূর্বক মুজাদ্দেদীয়া তরিকার প্রবর্তন করেন। এই জন্যই হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশেবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদীয়া এই চার তরিকা অনুযায়ী মানুষকে মুরিদ করতেন।
নকশেবন্দিয়া তরিকার কোনও একজন কামেল বুযুর্গ একদিন স্বপ্নে দেখলেন, হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রাঃ তাঁকে বলছেন, অচিরেই হিন্দুস্তানে হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর একজন যোগ্যতম প্রতিনিধি নিযুক্ত হবেন। আমি আশা করি, সেই মহাপুরুষ যেন আমার তরিকাভুক্ত হন।
নকশেবন্দিয়া তরিকার অন্যতম বুযুর্গ হযরত খাজা আমকাংগী রাঃ তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি এই তরিকা প্রচারের উদ্দেশ্যে হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রাঃ কে হিন্দুস্তানে প্রেরণ করেন। হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রাঃ হিন্দুস্তানে আগমনের পর সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ সেখানে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর সোহবতে থেকে জিকিরের হালকায় বসতেন।
হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রাঃ বিশেষ স্নেহ ও মনোযোগের সাথে হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দ রাঃ কে রূহানী তালীম প্রদান করতে লাগলেন। আল্লাহ পাকের খাস মেহেরবাণীর ফলে এবং হযরত খাজা সাহেবের বিশেষ তাওয়াজ্জুহ প্রদানের বদৌলতে হযরত শেখ আহমদ সেবহিন্দ রাঃ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আধ্যাত্মিক জগতের বিশেষ স্তরসমূহ অতিক্রম করে উচ্চ শিখরে পৌঁছে গেলেন। তাঁর মধ্যে এই অসাধারণ যোগ্যতা দেখে এবং এমন ভাগ্যবান বুযুর্গ ব্যক্তির রূহানী ওস্তাদ বলে নিজেকে খুব গৌরবান্বিত মনে করতে লাগলেন এবং এজন্য আল্লাহ পাকের দরবারে অশেষ শোকরগুজারী করতে লাগলেন। হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রাঃ মাঝে মাঝে গর্ব ভরে বলতেন, শেখ আহমদ সেরহিন্দ এর হাতে নকশেবন্দিয়া তরিকার খেলাফতরূপ আমানত সোপর্দ করতে পেরে আমি দায়িত্বমুক্ত হয়েছি।
তিনি আরো বলেছেন, ইমামে রব্বানী শেখ আহমদ সেরহিন্দ এমন একটি দীপ্তিমান সূর্য যার তীব্র আলোকের সামনে আমার মত হাজার হাজার তারকা স্তিমিত হয়ে যায়।
হযত ইমামে রব্বানী প্রথম বার আড়াই মাস দিল্লীতে অবস্থান করে হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রাঃ এর নিকট হতে রূহানী তালীম ও প্রচুর ফয়েজ হাসিল করেন। অতঃপর মোর্শেদের অনুমতিক্রমে নিজ আস্তানায় ফিরে আসেন। কিছুদিন পর তিনি পুনরায় তাঁর খেদমতে আসলে তাঁকে খেলাফতের খেরকা প্রদান করেন এবং খানকায় অবস্থানকারী মুরিদানের মধ্যে খাস খাস লোকদের তালীম দেয়ার কাজে তাঁকে নিযুক্ত করলেন। তুতীয় বার হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দ রাঃ স্বীয় মোর্শেদের খেদমতে আসলে তিনি কয়েক কদম অগ্রসর হয়ে তাঁর এস্তেকবাল করলেন এবং আধ্যাত্মিক জগতের বহু শুভ সংবাদ তাঁকে প্রদান করলেন। অতঃপর তাঁকে কিছুদিন খুব সম্মান ও তাজিমের সাথে নিজের খানকায় রাখলেন।
চতুর্থবার যখন হযরত শেখ সেরহিন্দ রাঃ স্বীয় পীর-মোর্শেদের নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করেন তখন হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রাঃ তাঁকে বললেন, হিন্দুস্তানে আগমনের পূর্বে আমি এস্তেখারা করে দেখতে পেলাম যে, একটি মনোহর ও সুমধুর কণ্ঠবিশিষ্ট তোতা পাখি আমার হাতের উপর এসে বসল। আমি তার মুখ চুম্বন করে তার মুখে আমার মুখের লালা দিতে লাগলাম এবং তোাত পাখিটি তার চঞ্চু হতে আমার মুখে চিনি দিতে লাগল। আমি আমার এই এস্তেখারার ফল আমার মোর্শেদ হযরত শেখ খাজা আমকাংগী রাঃ এর কাছে বর্ণনা করলাম। তিনি বললেন, হিন্দুস্তানে তোমার তালীম ও তারবিয়াতের ফলে এমন একজন লোক আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করবেন যাঁর মাধ্যমে সারা বিশ্ব আলোকিত হবে এবং তুমিও তা হতে অংশ লাভ করবে। তখন হযরত খাজা সাহেব তোমারই প্রতি আমাকে ইঙ্গিত করেছিলেন।

অতঃপর হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দ রাঃ স্বীয় পীর ও মোর্শেদ হতে বিদায় গ্রহণপূর্বক নিজের আস্তানার দিকে যাত্রা করলেন। এবার হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ তাঁর সঙ্গে শহরের উপকণ্ঠ পর্যন্ত গমন করে তাঁকে বিদায় দিয়ে আসলেন।
ইতিমধ্যে দেশের চতুর্দিকে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর খ্যাতি ছড়ায়ে পড়ল। তিনি আস্তানায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক হতে লোক এসে তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করতে লাগল এবং তার নিকট হতে আম, খাস সকল শ্রেণীর লোকই রূহানী ফয়েজ এবং বাতেনী তালীম হাসিল করতে লাগল।
একদিন ফজরের নামাজের সময় হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দ রাঃ নিজের হুজরায় নির্জনে বসেছিলেন, এমন সময়ে হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ বহু আম্বিয়ায়ে কেরাম, বহু আউলিয়া ও ফেরেশতাসহ সেখানে আসলেন। হুজুর সাঃ এর হাতে একটি অপরূপ সুন্দর পোষাক ছিল, এমন সুন্দর পোষাক দুনিয়ায় কেউ কোন দিন দেখেনি। তা সম্পূর্ণ নূরের তৈরি ছিল। হুজুর সাঃ সেই পোশাকটি হযরত শেখ আহমদকে নিজ হাতে পরায়ে দিয়ে বললেন, মুজাদ্দিদের সনদ স্বরূপ তা আমি তোমাকে পরায়ে দিলাম। আমি তোমাকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দীর জন্য আমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করলাম, আমার উম্মতের উভয় জাহানের মঙ্গলামঙ্গল আজ হতে তোমার হাতে ন্যস্ত করলাম। এটি ছিল হিজরী ১০১০ সালের ১০ রবিউল আউয়াল শুক্রবারের ঘটনা।
একদিন তিনি নামাজের পর মুনাজাতে মশগুল ছিলেন। এমন সময় তাঁর সারা দেহ হতে এক অপরূপ আলো নিঃসৃত হয়ে প্রদীপের মত জ্বলতে লাগল। তিনি তা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ গায়েবী আওয়াজ আসল, রাসূলুল্লাহ সাঃ এর দেহাবয়ব গঠনের জন্য যে খামীর প্রস্তুত করা হয়েছিল, তারই উদ্ব্ত্তৃাংশ দিয়ে তোমার দেহ গঠিত হয়েছে। কাজেই এই আলোকরশ্মি বিকীর্ণ হচ্ছে।
সাইয়্যেদ মোহাম্মদ সালেহ বলেন, হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব একদিন কোন কাজে দূরবর্তী স্থানে পাঠাবার সময় আমাকে বলে দিলেন, পথ চলাকালে সর্বদা ‘লিয়ীলাফি ক্কুরাইশিন’ সূরা পাঠ করবে। আর কোন বিপদের সম্মুখীন হলে আমাকে স্মরণ করবে। অতঃপর আমি রওয়ানা হয়ে কিছুদূর যেতেই পথ হারায়ে এক গভীর জঙ্গলে পৌঁছলাম। সেখানে একটি বাঘ এসে আমাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। আমি তৎক্ষণাৎ হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবকে স্মরণ করতেই তিনি স্বশরীরে সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বাঘটিকে তাড়ায়ে দিলেন।
হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ এর বুযুর্গীর খ্যাতি শুনে একব্যক্তি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য সেরহিন্দ আসল। কিন্তু রাত অধিক হওয়ায় সে রাতে নিজ বাড়িতে না গিয়ে পার্শ্ববর্তী এক বাড়িতে রাত যাপন করল। এই প্রতিবেশী লোকটি হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের বুযুর্গীর জন্য তাঁর প্রতি হিংসা পোষণ করত। কাজেই আলাপ আলোচনা প্রসঙ্গে লোকটি আগন্তুক মেহমানের নিকট হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব সম্পর্কে বহু অশোভন উক্তি করল। মেহমান গৃহস্বামীর এই অশোভন উক্তিতে মন খারাপ করল। ঘটনাক্রমে রাতের শেষ ভাগে উক্ত গৃহ স্বামীর কোন এক শত্র“ তার ঘরে ঢুকে নিদ্রিতাবস্থায় তাকে হত্যা করে চলে গেল। পরদিন ভোরে উক্ত আগন্তুক লোকটি হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের দরবারে পৌঁছলে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব তাঁকে দেখা মাত্র বললেন, তোমার অতিথিসৎকারক লোকটি নিজ কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেছে।
একদিন হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ কয়েকজন মুরিদসহ এক মজলিসে বসে আছেন, এমন সময় হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, তোমাদের মধ্যে আমার একজন মুরিদের গর্দানে আমি কুফরীর রশি ঝুলান দেখতে পাচ্ছি। তবে সে শেষ পর্যন্ত আবার সৎপথে ফিরে আসবে। তা শুনে উপস্থিত শ্রোতাবর্গ অজানা আশংকায় কেঁপে উঠল। সবাই ভাবতে লাগল, না জানি এই হতভাগা কে? তাঁদের এরূপ উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব বলেন, সেই ব্যক্তি হল, শেখ তাহের। একথা শুনে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কেননা, শেখ তাহের তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুযুর্গ লোক। দেশময় তাঁর সুখ্যাতি। আর তাঁরই ঘাড়ে কুফরীর রশি।
এর কিছুদিন পরেই শেখ তাহের এক হিন্দু নারীর প্রেমে পড়ে প্রেমিকার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তিনি ইসলামী পোষাক পরিত্যাগ করে হিন্দুয়ানী পোষাক পরিধান এবং গলায় পৈতা ধারণ করলেন। হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ এই সংবাদ জানতে পেরে খুবই দুঃখিত এবং মর্মাহত হলেন। কেননা, তিনি শেখ তাহেরকে খুবই ভালবাসতেন। কয়েকদিন অতীত হওয়ার পর হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের দুই সাহেবজাদা এক সঙ্গে মিলিতভাবে পিতার নিকট এসে আবদার করলেন, আব্বাজান ! শেখ তাহের সাহেব আমাদের ওস্তাদ। জানি না কোন দুর্ভাগ্যের কারণে তিনি এমন দুরবস্থায় পতিত হয়েছেন। অদৃষ্টে যা ছিল তাঁর উপর তা তো ঘটে গেছে। এখন আপনি তাঁর প্রতি একটু নেকদৃষ্টি দান করুন, তিনি যেন, নিজের পূর্ব মর্যাদা ফিরে পেতে পারেন। সাহেবজাদাদের আকুল আবদারে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব শেখ তাহেরের জন্য হাত উঠায়ে দোয়া করতে লাগলেন, ইয়া আল্লাহ ! হযরত গাউসুল আযম বলেছেন, কেউ যদি নিতান্ত অক্ষম হয়ে কোন উদ্দেশ্য  সিদ্ধির জন্য হযরত গাউসে পাকের উসিলা ধরে আপনার দরবারে দোয়া করে, তবে আপনি তার মনস্কাম সফল করে দেন। অতএব, আমি আপনার দরবারে কাতর আবদার জানাচ্ছি যে, হযরত গাউসুল আযমের এবং আপনার সমস্ত প্রিয় বান্দাগণের উসিলায় আপনি শেখ তাহেরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে তাকে পুনরায় ইসলাম ধর্মে ফিরে আসার তওফীক দান করুন। এদিকে তিনি দোয়া করতেছিলেন, অপর দিকে সেই মুহূর্তে শেখ তাহেরের অন্তর হতে হিন্দু নারী প্রেম দূর হয়ে তদস্থলে তার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গেল। সুতরাং অবিলম্বে তিনি হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের পদপ্রান্তে লুটায়ে পড়লেন এবং তাঁর হাতে তওবা করে পুনরায় মুসলমান হয়ে গেলেন।
সম্রাট আকবর তখন দিল্লীর ময়ূর সিংহাসনে সমাসীন। রাজ্যের অমুসলমানদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে তিনি তাদেরকে সরকারী দপ্তরে বড় বড় পদ দিয়ে রেখেছিলেন। এমন কি শাহী অন্দর মহলেও তিনি অমুসলিম নারীদের ঢুকায়েছিলেন এবং নিজের অমুসলিম সম্রাজ্ঞী ও পুত্রবধুদের আত্মীয়-স্বজনকে বড় বড় জায়গীর দান করেন। রাজ্যের ওলামায়ে কেরাম তাঁর এসমস্ত কাজ সম্বন্ধে শরিয়ত সম্মত আপত্তি উত্খাপন করলে তিনি তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও রোষের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। তিনি স্বীয় রাজ্যের মধ্যে ইসলামী শিক্ষার বিকৃতি সাধন করতে লাগলেন এবং শেষ পর্যন্ত হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দোহাই দিয়ে ‘দ্বীনে এলাহী’ নামে এক মনগড়া ধর্মের প্রচলন করলেন। তদুপরি নিজের প্রতাপ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সর্বসাধারণ প্রজাবৃন্দের প্রতি অবশ্য পালনীয়রূপে নির্দেশ দিলেন যে, তার দরবারে প্রবেশ করেই তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য সেজদা করতে হবে। অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে প্রজা সাধারণের দ্বারা তা পালন করাতে হবে। শরিয়তের বরখেলাপ বলে যদি তা কেউ পালন করতে অমান্য করত তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করা হত। হিন্দুরা তাকে সেজদা করতে আপত্তি করত না। সুতরাং তারা সম্রাটের অধিক প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল এবং রাজ দরবারে খুব মর্যাদা ও বড় বড় পদ লাভ করতে লাগল। সম্রাট নিজেও হিন্দুয়ানী প্রথা ও রীতি নীতিসমূহ মেনে চলতেন। হিন্দুদের একাদশীর দিনটিকে বাদশাহ এরূপ গুরুত্ব দিয়ে রেখেছিলেন যে, সেদিন মুসলমানদের ঘরেও রান্না-বান্না নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে রমজান মাসেও দিনের বেলা শহরের হোটেল-রেষ্টুরেন্টে প্রকাশ্যভাবে রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়া চলত। কিন্তু মুসলমানগণ নিজেদের অক্ষমতার দরুন এর কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না। হিন্দুদের ইচ্ছা ও মরযী মোতাবেক মসজিদসমূহে নিঃসঙ্কোচে ও বিনা দ্বিধায় মন্দিরে পরিণত করা হল। স্বার্থান্বেষী সুধী ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা নিজেদের স্বার্থ লাভের জন্য সম্রাটের এ সমস্ত খামখেয়ালী কাজের কোন প্রতিবাদ না করে বরং আরও সমর্থন দিতে লাগল। দরবারের আলেমগণ বড় বড় খেতাব ও মূল্যবান খেলআতের বিনিময়ে সম্রাটের হাতের ক্রীড়ানকে পরিণত হলেন। বাইরের আলেমগণ বিভিন্ন মতবাদে ও দলে বিভক্ত হয়ে দুর্বলতা বশতঃ বাদশাহের এ সমস্ত ইসলাম বিরোধী কাজের প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না।
ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে ও দুর্দশার মুহূর্তে আল্লাহ পাক অনুগ্রহপূর্বক নিজের প্রিয় ইসলাম ধর্ম রক্ষা কল্পে হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দ মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ কে পাঠালেন। তিনি সেরহিন্দ শরীফ হতে আকবরাবাদে গমন করে সম্রাটের সভাসদবর্গ ও আমীর ওমারাহগণকে ডেকে বললেন, সম্রাট আকবর আল্লাহ পাকের সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাঃ এর প্রকাশ বিরোধিতা আরম্ভ করে দিয়েছেন। তোমরা আমার পক্ষ হতে তাকে বলে দাও, তার সিংহাসন তার রাজক্ষমতা ও তার অর্থবল ও সৈন্যবল কিছুই চিরস্থায়ী নয়। একদিন এ সমস্তই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অতএব তিনি যেন অতি সত্ত্বর এ সমস্ত খোদাদ্রোহী কাজ পরিত্যাগ করে তওবা করে আল্লাহ ও রাসূল সাঃ এর অনুগত হয়ে যায়। অন্যথায় তিনি যেন আল্লাহ তায়ালার গজবের অপেক্ষা করতে থাকেন।
অমাত্যবর্গ তখনই সম্রাটের কাছে সেই পয়গাম পৌঁছাল। রাজ্যের সেরা আমীর ও নেতৃস্থানীয় লোক খান খানান, খানে আযম, মির্জা আযীয এবং মুর্তজা খান হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের মুরিদ ছিলেন। বাদশাহ আকবরেরও খুব বিশ্বস্ত ও প্রিয় ছিলেন। তাদের মারফতেও মুজাদ্দিদ রাঃ বাদশাহকে বুঝাবার ব্যর্থ প্রয়াস করলেন। কিন্তু তিনি কারো কোন হেদায়েত এবং উপদেশের প্রতি কর্ণপাত করলেন না ; বরং নিজের প্রবর্তিত ধর্মের সফলতা লাভের নেশায় মেতে থাকলেন।
ইতিমধ্যে সম্রাট একটি দুঃস্বপ্ন দেখে রাজ্যের জ্যোতিষীগণকে ডেকে তার তাবীর জিজ্ঞাসা করলেন। তারা সকলে ঐক্যমতে এর ব্যাখ্যা করলেন যে, জাহাঁপনা ! এটা আপনার আসন্ন পতনের ইঙ্গিত করছে। এই ব্যাখ্যা তাঁর মনে কতটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। অতএব তিনি নিজের অসৎ সঙ্কল্প কিঞ্চিত শিথিল করে এক ফরমান জারি করলেন যে, দ্বীনে এলাহী ও দ্বীনে মুহাম্মদীর মধ্যে যে কোন একটি অবলম্বন করা সম্বন্ধে সর্বসাধারণের স্বাধীনতা থাকবে। এ ব্যাপারে কারও প্রতি কোন জবরদস্তী করা হবে না।
অতঃপর সম্রাট স্বীয় প্রবর্তিত দ্বীনে এলাহী ধর্মের জনপ্রিয়তা ও সফলতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে একটি উৎসবের আয়োজন করে একটি তারিখ ঘোষণা করলেন। উক্ত উৎসব উপলক্ষে তিনি ময়দানের একদিকে দ্বীনে এলাহীর নামে জাকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ একটি সাজলেন এবং তাতে খুব উৎকৃষ্ট ধরনের সাজসরঞ্জাম ও খাদ্যদ্রব্য মজুদ করলেন। অপর দিকে দ্বীনে মুহাম্মদীর তাঁবু নামে একটি পুরাতন ও ছেঁড়া-ফাটা তাঁবু প্রস্তুত করালেন। তাতে খাদ্যদ্রব্য ও সাজ সরঞ্জাম দেয়া হল নিতান্ত মামুলী ধরনের। তার ধারণা ছিলÑ আমর রাজত্ব ও প্রভাব প্রতিত্তির মোকাবেলা করার জন্য সেই পুরাতন ও গুদাম পচা ধর্মের অনুসারীগণ আমার প্রভাব প্রতিপত্তির সামনে মস্তক অবনত করতে বাধ্য হবে। সে কি একথা জানত যে, ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদ আলফেসানী হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দ দ্বীন ইসলামের তথা দ্বীনে মুহাম্মদীর পতাকাকে সুউচ্চে তুলে ধরার জন্য দুনিয়াতে তশরিফ এনেছেন। আকবর নিজের দ্বীনে এলাহীর তাঁবুতে স্বার্থন্বেষী চাটুকারদের জন্য নানাবিধ উৎকৃষ্ট ও উপাদেয় খাদ্যের আয়োজন করে রাখলেন। সেখানে তাঁর বহু তোষামোদকারী এসে জমায়েত হল।
আকবরের ধারণা ছিল তার রাজক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য কেউই দ্বীনে মুহাম্মদীর তাঁবুতে এসে প্রকাশ্যে দেখা দেয়ার সাহস করবে না। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে ভরা মজলিশে মজলিশের সমক্ষে দুষ্টমতি আকবর হযরত রাসূসুল্লাহ সাঃ এর ধর্মকে অপদস্ত এবং হীন প্রতিপন্ন করবে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ কেমন করে তা সহ্য করবেন। তিনি নিজের কয়েকজন দরিদ্র ও নিঃস্ব মুরিদকে সঙ্গে নিয়ে সেই দ্বীনে মুহাম্মদীর তাঁবুতে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁবুতে প্রবেশ করেই তিনি চারিদিকে একটি বৃত্ত একে দিলেন। অতঃপর একমুঠো মাটি হাতে নিয়ে দ্বীনে এলাহীর তাঁবুর দিকে নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল ঘূর্ণিঝড় আরম্ভ হল এবং সম্রাটের তাঁবুকে ওলট-পালট করে তছনছ করে ফেলল। লোকজন একে অন্যের গায়ে পড়ে হতাহত হতে লাগল। সমস্ত সাজ সরঞ্জাম ও খাদ্য সামগ্রী ধুলিবালির মত উড়ে গেল। একটি কাঠখণ্ড এসে আকবরের মাথায় পড়ল। ফলে আকবর অজ্ঞান হয়ে ভূমিতে লুটায়ে পড়ল এবং এর সপ্তম দিবসে তিনি মৃত্যু বরণ করলেন। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে দ্বীনে মুহাম্মদীর তাঁবুর কোন ক্ষতিই হল না। এমন প্রলয় কাণ্ডের কিছুই এই তাঁবুর কেউ টের পেল না।
সম্রাট আকবর দুনিয়া হতে চলে গেলেন বটে ; কিন্তু তাঁর প্রবর্তিত সমস্ত কুপ্রথা, কুসংস্কার শিরক ইত্যাদি মুছে গেল না। তাঁর পুত্র জাহাঁঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণ করে ঐ সমস্ত কুপ্রথা ও গর্হিত কাজ বহাল রাখতে চেষ্টা করল। এমন কি বাদশাহকে তাজিমী সেজদার প্রথাও বাতিল করলেন না। জাহাঁঙ্গীর তাঁর স্ত্রী নূর জাহানের রূপের পাগল ছিলেন। তিনি রাজদণ্ড নূর জাহানের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে শরাব পানে ব্যস্ত থাকতেন। জাহাঁঙ্গীর অনেক সময় আত্মহারা অবস্থায় বলতেন, আমি রাজত্ব নূর জাহানকে দান করেছি। তাতে আমার কোন প্রয়োজন নেই। এক সের শরাব ও আধা সের কাবাবই আমার জন্য যথেষ্ট।
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর মৃত প্রায় সুন্নতকে সজীব করার জন্য চেষ্টা করতেছিলেন এবং সত্য প্রচারের কাজ খুব ব্যাপক ভাবে আরম্ভ করে দিলেন। স্বার্থান্বেষী ও মতলববাজ লোকেরা ত৭ার এ সমস্ত সংস্কার মূলক কাজ দেখে অন্তর্দাহে জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল এবং তাঁর বিরদ্ধে ক্ষেপায়ে তুলতে লাগল। বাদশাহ জাহাঁঙ্গীরের কানেও তাঁর বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা কথা লাগাল। শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত নূর জাহান এবং নৃত্যগীত সমর্থক বেদাতীরা হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ এর বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠল। ওদিকে হযরতের এক কৃত্রিম মুরিদ মকতুবাতের মধ্যে শিরক ও কুফরী শব্দ সংযোগ করে তার ২০টি নকল প্রস্তুত করে হিন্দুস্তান ও আফগানিস্তানের প্রসিদ্ধ ওলামা ও মাশেয়েখে কেরামের নিকট নকল পাঠায়ে তাদের ফতুয়া চাইল। তা ছিল একটি বিরাট ষড়যন্ত্র। হিন্দুস্তানের শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত আলেম, ফাযেল অলিয়ে কামেল হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবীও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত হয়ে পড়লেন। তিনি হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের বিরুদ্ধে কয়েকটি রেসালা এবং প্রবন্ধও লিখে ফেললেন।
এইরূপে হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাঃ এর বিরুদ্ধে একটি ফ্রন্ট গঠিত হল। তাদের প্ররোচনায় জাহাঁঙ্গীর তাঁকে দরবারে ডেকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব তাঁর প্রশ্নের এমন সুন্দর উত্তর দিলেন যে, বাদশাহ তাতে সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন।
ইতিমধ্যে একটি অবস্থার উদ্ভব হল। সম্রাজ্ঞী নূর জাহান স্বীয় রাজকার্যে আন্তরিকতা, জনকল্যাণমূলক কাজ এবং দান খয়রাতের ফলে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন শিয়া, জাহাঁঙ্গীরের উজির আসফজাহও ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। কাজেই আসফজাহ নূর জাহানের সাহায্যে জাহাঁঙ্গীরের দিয়ে যা ইচ্ছা তা করায়ে নিতে পারতেন। ফলে, তার দ্বারা দেশে নানাবিধ ইসলাম বিরোধী কাজ প্রসার লাভ করল। আসফজাহের ইঙ্গিতে প্রজা সাধারণের প্রতি নানা প্রকার অত্যাচারও চলতে লাগল। সারাদেশে বিভিন্ন প্রকারের ফেতনা-ফাসাদ আরম্ভ হল। নিপীড়িত জনসাধারণ অগত্যা হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের শরণাপন্ন হল। তিনি বললেন, নিজেরা এজন্য দুঃসহ কষ্ট সহ্য না করা পর্যন্ত এই বালা হতে মুক্তি লাভ করা হবে না।
এর কিছুদিন পর হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব তাঁর খলিফা শেখ বদরুদ্দিন কে হেদায়েতী কাজ করার জন্য সম্রাটের সেনানিবাসে পাঠালেন। তাঁর নিঃস্বার্থ হেদায়েতে সৈন্য বাহিনীর অনেকেই হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের মুরিদ হলেন।
উজির আসফজাহ ছিলেন হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের বিরুদ্ধ নেতা। তিনি যখন দেখলেন যে, বাদশাহকে প্ররোচিত করে মুজাদ্দিদ সাহেবকে রাজ দরবারে ডাকায়েও কোন ফল হল না। বরং মুজাদ্দিদ সাহেবের উত্তরে বাদশাহ নিশ্চিন্ত হয়েছেন, সুতরাং আসফজাহ এখন মুজাদ্দিদ সাহেবের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের চেষ্টা করতে লাগল। তিনি রাজ দরবারে উত্থাপন করলেন যে, শেখ আহমদ সেরহিন্দর প্ররোচনায় লক্ষ লক্ষ সৈন্য জাহাপনার বিরোধী হয়ে পড়েছে। সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার জন্য শুধু শেখ সেরহিন্দীর আদেশের অপেক্ষা করছ্।ে এদিকে পারিপাশ্বিক জায়গীরসমূহের বাদশাহগণও শেখ সাহেবের অনুগত হয়ে পড়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সহসা তাদেরকে কঠোর হাতে দমন না করলে সিংহাসন রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অতএব, শেখ বদীউদ্দীনকে সেনা নিবাসে প্রবেশ করতে নিষেধ করে দেয়া হোক এবং শেখ আহমদকে রাজ আদেশ মেনে চলতে নির্দেশ দেয়া হোক। তাতে তিনি অসম্মত হলে তাঁকে জেল খানায় আবদ্ধ করে রাখা হোক।

আসফজাহের কু-মন্ত্রণায় বাদশাহ জাহাঁঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের প্রতি রেগে গেলেন এবং প্রাথমিক ব্যবস্থারূপে শেখ আহমদ ও বদী উদ্দীনের সঙ্গে কেউ কোন প্রকার সংশ্রব রাখতে পারবে না। এর অন্যথা করলে চাকরী হতে বরখাস্ত করে দেয়া হবে। অতঃপর শেখ আহমদের কার্যকলাপের প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হল। আর হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবকে লোক সমাজে অপ্রিয় করার জন্য নানাবিধ অপপ্রচার করা হতে লাগল। ফলকথা নূর জাহানের পরামর্শে ও আসফজাহের প্ররোচনায় বাদশাহ জাহাঁঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর প্রভাব ও প্রতিপত্তি খর্ব করার এবং জনপ্রিয়তা হ্রাস করার জন্য নানাবিধ উপায়ে চেষ্টা করতে লাগল। বাদশাহ কৌশলে মুজাদ্দিদ সাহেবের মিশন বন্ধ করার মনস্থ করছিলেন। কিন্তু আসফজাহ পরামর্শ দিলেন যে, কৌশলের পথ অবলম্বন না করে কঠোর হাতে দমন করে দেয়া উচিত, বিলম্বে বিপদের আশংকা সুনিশ্চিত।
আসফজাহের কুমন্ত্রণায় বাদশাহ অবস্থার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করলেন এবং হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবকে নিজের মহা শত্র“রূপে সাব্যস্ত করলেন। এই সুযোগে মন্ত্রী আসফজাহ প্রস্তাব করলেন, হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানীকে এবং তাঁর সমস্ত মুরিদকে হত্যা করে ফেলতে হবে। হত্যার উপযোগী অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য প্রথমে তাঁদেরকে দরবারে ডেকে সম্মান প্রদর্শনের সেজদা করতে আদেশ করা হোক। যদি তাঁরা তা না করে তবে রাজদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করে হত্যা করার জন্য জল্লাদকে আদেশ দেয়া হোক। সম্রাট উজিরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন।
এর পর একদিন হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ মুরিদদের বললেন, মনে হয় আল্লাহ পাকের দরবারে আমার আরো উচ্চ মর্যাদা লাভের সময় এসেছে। হয়ত শীঘ্রই আমাকে মহা বিপদে পড়তে হবে। সেই বিপদই আমার উন্নতি বহন করে আনবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী করার কয়েকদিন পর বাদশাহ জাহাঁঙ্গীরের একখানা পত্র পেলেন, আমরা আপনার সাক্ষাৎ লাভের আরজ করছি, অতএব, দয়া করে আপনি আপনার মুরিদদের নিয়ে সুযোগমত আমার দরবারে তশরিফ আনবেন।
সম্রাটের দাওয়াত পেয়ে তিনি পাঁচজন বিশিষ্ট খলিফাসহ জাহাঁঙ্গীরের দরবারে গমন করলেন, শিয়া সম্প্রদায়ের স্বরূপ সম্বন্ধে সমালোচনা করে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব একটি কিতাব লিখেছিলেন। এই কারণে আসফজাহ তাঁর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন, আসফজাহ সম্রাটের সম্রাটের সাথে তাঁদের সাক্ষাতের জন্য এমন একটি সময় নির্ধারিত করলেন, যে সময় সাধারণতঃ সম্রাটের মেজাজ উগ্র থাকে।
নির্দিষ্ট সময়ে হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ সঙ্গীগণকে নিয়ে রাজ দরবারে উপস্থিত হলেন। কিন্তু সম্রাটকে সম্মান প্রদর্শনের সেজদা তো দূরের কথা সালামও করলেন না। তা দেখে আসফজাহ বললেন, জাহাপনা ! এই ব্যক্তি নিজেকে আম্বিয়ায়ে কেরাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করে। বাদশাহ তার উস্কানীমূলক কথার প্রতি কর্ণপাত করলেন না। তখন আসফজাহ তার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উত্থাপন করে বাদশাহকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করলেন।
সম্রাট হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ কে বললেন, দরবারের রীতি অনুসারে আপনি আমাকে সেজদা করুন। তা শুনে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব নিতান্ত অবজ্ঞার স্বরে বললেন, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কোন সৃষ্ট বস্তুই সেজদার যোগ্য নয়। তাঁর এই দৃঢ় মনোভাব দেখে বাদশাহ বললেন, আপনার জন্য সেজদা মাফ করা হল। আপনি শুধু সম্মান প্রদর্শনের জন্য একটু মাথা নত করুন। সম্রাট হিসাবে আমার আদেশ প্রত্যাহার করা নিতান্ত লজ্জার কারণ। আপনি অন্ততঃ এটুকু কষ্ট করে দরবারের মর্যাদা রক্ষা করুন। হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব বললেন, তাও অসম্ভব, এই মস্তক কখনও একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে নত হয়নি। ইনশাআল্লাহ কোন সময় হবেও না। অতঃপর বাদশাহ দরবারের লোকদের আদেশ করলেন, তোমরা বলপূর্বক এই ব্যক্তির মাথা নোয়ায়ে দাও। সকলে এসে খুব চেষ্টা করল কিন্তু তাঁর মাথা বিন্দু পরিমাণ নত হল না। এর পর বাদশাহের নির্দেশক্রমে ক্ষণকালের মধ্যে একটি তোরণ নিচু করে নির্মাণ করা হল। উদ্দেশ্য এই যে, তা অতিক্রম করতে তাঁর মস্তক আপনা আপনিই নত হবে, কিন্তু হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব সামনের দিকে পা বাড়ায়ে মাথা পিছনের দিকে ঝুঁকায়ে তা পার হয়ে গেলেন, সামনের দিকে মাথা নত করতে হল না।
হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের এই ব্যবহারে সম্রাট খুব বিরক্ত হলেন এবং তাঁর ব্যবহারকে অহংকার বলে আখ্যায়িত করে এই অপরাধে তাঁর খলিফাগণকে গোয়ালিয়র কেল্লায় বন্দী করে রাখলেন। বাইরের সকলকে তাঁর সাথে সর্বপ্রকার যোগাযোগ করতে নিষেধ করে দেয়া হল।  এদিকে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয়া হল। কিন্তু এতসব নির্যাতনেও মুজাদ্দিদ সাহেব বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বা সম্রাট কিংবা অন্য কাউকেও বদদোয়া করলেন না। তিনি নিজেই ধৈর্য ধারণ করলেন এবং মুরিদগণকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং তাঁদের এই আশ্বাস দিলেন যে, এই অত্যাচার আমাদের জন্য অলিত্বের উচ্চশিখরে আরোহণের কারণ হবে।
শাহাজাদা খুররম হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি দূত মারফতে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের নিকট জেলখানায় এক পরামর্শ বাণী প্রেরণ করলেন যে, ফেকার কিতাবে লিখিত আছে যে, তাজিমের জন্য ঘাড় ও মাথা ঝুঁকায়ে সম্মান প্রদর্শন করা জায়েজ আছে। অতএব আপনি শরীরের উপরের অংশ একটু সামনের দিকে নোয়ায়ে বাদশাহকে সম্মান প্রদর্শন করুন। তাহলে আপনি বন্দি দশা হতে অব্যাহতি পেতে পারেন। জবাবে তিনি বললেন, প্রাণ রক্ষার জন্য তাজিমি সেজদা কিতাবে দুরস্ত আছে বটে, কিন্তু যে কোন অবস্থায় আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও সামনে মাথা নত করতে রাজি নন।
হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এবং তাঁর খলিফাগণ ছাড়াও আরও কয়েক সহস্র মুসলিম ও অমুসলিম কয়েদী গোয়ালিয়র দুর্গে নিজেদের অদৃষ্টের লিপি ভোগ করতে ছিল, তিনি তাদের মধ্যে নিয়মিতভাবে আধ্যাত্মিকতার বাণী প্রচার করতে লাগলেন। অল্পকাল মধ্যে তাঁর হেদায়েত ও নসিহতে আধ্যাত্মিক শক্তির বলে তারা সকলেই রূহানিয়্যাতের উচ্চস্তরে গিয়ে পৌঁছিল এবং কারাগারে তাদের জন্য এক মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি হল। জেলখানা এখন ইবাদতখানায় পরিণত হল।
বৈরাম খানের পুত্র আবদুর রহিম খানে খানান, খানে আযম মির্জা সাইয়্যেদ হুসাইন কুলিবেগ, ইসলাম খান, মোহাবাত খান, কাসেম খান, সেকান্দর লুধী, হায়াত খান প্রমুখ ব্যক্তিগণ মোগল সাম্রাজ্যের প্রধান প্রধান স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। অপর দিকে তাঁরা হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর একান্ত ভক্তও ছিলেন। আসফজাহের প্ররোচনায় বাদশাহ জাহাঁঙ্গীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য রাজ্যের এ সমস্ত প্রভাবশালী স্তম্ভসমূহকে দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত করে রাজধানী হতে সরায়ে দিলেন। যাতে তারা মুজাদ্দিদ সাহেবের সঙ্গে কোন রূপ যোগাযোগ রাখতে না পারেন। কিন্তু তারা নিজ নিজ এলাকায় থেকেই হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের প্রতি বাদশাহের দুর্ব্যবহার ও অত্যাচারের কথা জানতে পেরে সকলেই খুব মর্মাহত ও ব্যথিত হলেন। ফলে তাঁরা মিলিতভাবে সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর তারা কাবুলের শাসনকর্তা মোহাবাত খানকে নিজেদের নেতারূপে স্থির করে অতি গোপনে নিজ নিজ অধীনস্থ সেনাবাহিনীকে কাবুলে প্রেরণ করলেন। এই সংবাদ জানতে পেরে সম্রাট খুব অধীর হয়ে পড়লেন এবং মোহাবাত খানের পরিচালনায় বিগ্রোহ দমনের জন্য একটি বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে কাবুলের দিকে রওয়ানা হলেন। ঝিলাম নদীর তীরে উভয় সেনা দলের মোকাবিলা হল। মোহাবাত খানের রণ-পটুতা, বীরত্ব ও দক্ষতার সম্মুখে শাহী ফৌজ টিকতে পারল না। স্বয়ং জাহাঁঙ্গীর এবং তাঁর কুচক্রী উজির আসফজাহও মোহাবাত খানের হাতে বন্দি হলেন।
স্বয়ং জাহাঁঙ্গীর এবং আসফহার বন্দী হওয়ার কথা জানতে পেরে নূর জাহান নিজেই সম্রাটের সাহায্যার্থে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে কাবুল রওয়ানা হলেন করলেন, ফলে তিনিও বন্দি হলেন।
নূর জাহান কাবুল যাত্রা করলে রাজ্যের আমীর ওমারাগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইমামে রাব্বানীর নিকট জেলখানায় উপস্থিত হয়ে আবেদন করলেন, দিল্লীর সিংহাসন ধর্মদ্রোহীদের কবলমুক্ত হয়েছে। জুলুম অত্যাচারের উৎস বন্ধ হয়েছে। হযরত অনুগ্রহপূর্বক এসে সিংহাসন অলঙ্কৃত করুন। এতদসঙ্গে তাঁদের গোপন পরিকল্পনার কথা আদ্যোপান্ত হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের নিকট বর্ণনা করলেন। হযরত ইমামে রাব্বানী তাদের এই প্রস্তাবের উত্তরে গোপন পরিকল্পনার সাথে সংশি�ষ্ট আমীর ওমরাগণের নামে একটি চিঠি লিখলেন,
“রাজত্বের লোভ আমার নেই। আমি তোমাদের এই ফেতনা-ফাসাদ পছন্দ করি না। আমি যে এই কয়েকখানায় কষ্ট বরণ করেছি তা অন্য একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করেছি। রাজ সিংহাসন লাভ করার জন্য নয়। আমার সেই মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে গেলে তোমাদের সাহায্য ব্যতীত আপনা আপনিই আমার মুক্তির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমাদের এই ফেতনা-ফাসাদ আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল করার পথে বাধাই সৃষ্টি করবে। সুতরাং অতি সত্বর তোমরা যুদ্ধ বিগ্রহ এবং ফেতনা-ফাসাদ বন্ধ কর এবং আমার আরজু ও মহৎ কাজের সফলতার জন্য অবিলম্বে সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার পূর্বক তাঁকে পূর্বের মত বাদশাহ রূপে সিংহাসনে সমাসীন করে তাঁর আদেশ পালন করতে থাক। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমিও অচিরেই বন্দিদশা হতে মুক্তি লাভ করব। আমীর ওমারাগণ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানীর নির্দেশ শিরোধার্য করে দিল্লী ফিরে আসলেন এবং তাঁর নির্দেশ কাবুলে মোহাবাত খানের নিকট পাঠায়ে দিলেন।
বাদশাহ জাহাঁঙ্গীর, আসফজাহ ও নূর জাহানকে বন্দী অবস্থায় মোহাবাত খান হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানীর প্রতি দুর্ব্যবহার ও অত্যাচারের সমুচিত প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিজের সামনে উপস্থিত করেছেন, ঠিক এমন সময় হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের লিখিত পত্রটি তাঁর হাতে এসে পৌঁছল। তিনি তা পাঠ করে বাদশাহ জাহাঁঙ্গীরকে বললেন, আমি হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের নির্দেশে আপনাদের মুক্তি দান করছি।
সম্রাট জাহাঁঙ্গীর দিল্লীতে পৌঁছেই হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের মুক্তির ফরমান জারী করলেন। কিন্তু নূর জাহান ও আসফজাহের চক্রান্তের ফলে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবকে আরো এক বছর জেলখানায় কাটাতে হল। এই সময়ে একরাতে জাহাঁঙ্গীর কন্যা স্বপ্নে দেখলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ তাঁকে বললেন, ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদ আলফেসানীকে এখনও মুক্তি দেয়া হচ্ছে না কেন? শাহজাদী পিতার কাছে এই স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করলে বাদশাহ জাহাঁঙ্গীর লজ্জিত হলেন এবং নিজেই অনিচ্ছকৃত বিলম্বের জন্য ক্ষমা চেয়ে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবকে জেলখানা হতে বের হয়ে আসতে বলে পাঠালেন। হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব উত্তরে বাদশাহকে লিখলেন, আমার এই শর্তগুলো আপনি মেনে নিলে আমি জেলখানা হতে বের হয়ে আসতে রাজি আছিÑ
* বাদশাহের তাজিমী সেজদার প্রথা রহিত করে দিতে হবে।
* ধ্বংসকৃত এবং মন্দিরে পরিণত মসজিদগুলো পুনর্নির্মাণ করতে হবে এবং রাজ দরবারের সামনে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে হবে।
* সম্রাট আকবর গরু জবেহ করা বন্ধ করে হিন্দুদের মনন্তুষ্টি করেছিলেন, আপনার আমলেও তা বহাল আছে। আপনি নিজ হাতে গরু জবেহ করবেন এবং মুসলমানদের গরু জবেহ করার স্বাধীনতা দান করতে হবে।
* শরিয়তসম্মত কাজী নিয়োগ করে ইসলামী বিধান অনুযায়ী সকল মোকদ্দমার বিচার, মীমাংসা করতে হবে।
* অমুসলিম প্রজাগণ হতে জিজিয়া আদায় করতে হবে।
* রাজ্য হতে ইসলাম বিরোধী যাবতীয় কুসংস্কার উৎখাত করতে হবে।
* সকল বন্দীকে মুক্ত করে দিতে হবে।
সম্রাট সব শর্ত মেনে নিলেন এবং মহা সমারোহ ও  সম্মানের সাথে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ কে জেলখানা হতে বের করে আনলেন।
এর কিছুদিন পরই কতিপয় উগ্র মস্তিষ্ক ও সুযোগ সন্ধানী, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী দুষ্ট লোকের প্ররোচনায় শাহজাদা খুররম (শাহজাহান) পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরম্ভ করে দিল। জাহাঁঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের খেদমতে দোয়া প্রার্থী হয়ে বললেন, শাহজাদা খুররম সিংহাসনের লোভে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত দিল্লীর সিংহাসন আপনারই থাকবে। কেউ তা কেড়ে নিতে পারবে না।
বাস্তবিকই শাহজাদা খুররম যুদ্ধে সফলকাম হতে পারলেন না। তিনি হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের দরবারে এসে আবেদন করলেন, রাজ্যের সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরাম আমার সফলতার জন্য দোয়া করছেন, আমি তো পূর্ব হতেই আপনার ভক্ত, অথচ আপনি আমার পক্ষ সমর্থন করছেন না। হযরত মুজাদ্দিদ সাহেব বললেন, আমি তোমার পিতাকে ওয়াদা করেছি যে, আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত রাজত্ব তাঁরই থাকবে, তুমি অধীর হয়ো না, তোমার পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসন তোমারই অধিকারে আসবে, এই বলে তিনি নিজের পাগড়ী শাহজাদাকে দান করলেন, বস্তুতঃ জাহাঁঙ্গীরের মৃত্যুর পর শাহজাহানের হাতেই সিংহাসন এসেছিল।

হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ সমাজ সংস্কারের প্রথম পর্যায়ে রূহানী কামালিয়তের সাহায্যে দরবেশ ও ফকিরদের একটি দল গঠন করলেন, যাঁরা কার্যকরী আদর্শরূপে ইসলামী বিধান ও আখলাক আদত মানুষের সামনে পেশ করতে পারেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি সুধী ও সভ্য সমাজের মেধা ও বিবেক বিবেচনার মধ্যে এক বিপ�ব সৃষ্টি করেছিলেন এবং ইসলামের বিশুদ্ধ আকীদাসমূহ সম্বন্ধে তাঁদেরকে অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
তৃতীয় পর্যায়ে খাঁটি সুন্নী মাজহাবের অনুসারী আমীর ওমারাগণ, যাঁরা বিভিন্ন স্তরে রাজকীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তাঁদের নিজেদের দায়িত্বসমূহ সম্বন্ধে করেছিলেন।
চতুর্থ পর্যায়ে হিন্দুস্তানের সর্বাপেক্ষা অধিক ক্ষমতার অধিকারী বাদশাহের সংস্কার। এই শক্তির সংস্কারের জন্য তাঁকে বিভিন্ন প্রকারের বিপদ ও কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
প্রথম তিন পর্যায়ে হযরত ইমামে রাব্বানী অতি উত্তম সফলতা লাভ করে ছিলেন। আর চতুর্থ পর্যায়ে সফলতা লাভের জন্য তাঁকে কারাবরণপূর্বক অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল।
সম্রাট জাহাঁঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর একান্ত অনুরক্ত হয়ে পড়েন। কোন দিকে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তিনি সেরহিন্দে বাদশাহের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর দোয়া নিতেন। তিনি মাঝে মধ্যে বলিতেন, পারলৌকিক মুক্তির আশা করার মত তেমন কোন আমল আমার নেই। তবে একটি সনদ আমার রয়েছে, তা এই যে, হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ কোন ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে বলেছেন, জাহাঁঙ্গীর আমি বেহেশতে যাওয়ার উপযোগী সাব্যস্ত হলে তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করব না।
হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ বলেছেন, যেব্যক্তি প্রত্যেক দিন সকালে ও বিকালে তওবা না করে সে জালেম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন, হারামের একটি পয়সা তার মালিককে ফিরায়ে দেয়া একশত পয়সা সদকা করার চেয়ে উত্তম। কোন কোন বুযুর্গ লোক এও বলেছেন যে, কারও একরতি পরিমাণ মাল অন্যায়ভাবে বা হারাম উপায়ে নিয়ে থাকলে অতঃপর তা মালিককে ফিরায়ে দেয়া ছয় শত কবুল হজ্জের চেয়ে উত্তম।
একদিন এক ব্যক্তি হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর নিকট আরজ করল, আমি হযরত গাউসুল আযম বড়পীর হুজুর রাঃ কে দেখতে আরজু পেশ করি। তিনি তৎক্ষণাৎ ধ্র“ব তারার দিকে অঙ্গুলী দিয়ে ইশারা করলেন, অমনি হযরত গাউসুল আযম রাঃ সেখান থেকে কাল পোশাক পরিহিত এবং অশ্বারোহী অবস্থায় মুজাদ্দিদ সাহেবের সামনে এসে হাজির হলেন। হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ তাঁকে দেখিয়ে বললেন, ইনি বড়পীর হুজুর। হযরত গাউসুল আযম উপস্থিত সকলকে বললেন, ইনি মুজাদ্দিদ আলফেসানী, এই বলেই তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
একবার বর্ষাকালে রমজান মাস আসল। কয়েকদিন পূর্ব হতে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রথম তারাবিহ তিনি মসজিদে গিয়ে মুসল্লীদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। কিন্তু নামাজীর সংখ্যা অধিক হওয়ায় মসজিদের মধ্যে সকলের নামাজ পড়তে খুব কষ্ট হয়। নামাজ শেষ করে হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ সকলকে নিয়ে দোয়া কররলেন, ইয়া আল্লাহ ! রমজানের রাতে বৃষ্টি হলে তারাবিহ নামাজ পড়তে আমাদের বিশেষ কষ্ট হবে, আপনি দয়া করে রমজানের শেষ রাত পর্যন্ত রাতে আর বৃষ্টি দিবেন না। তাঁর দোয়া কবুল হল। প্রথম রাতের পর শেষ রাত পর্যন্ত রাতে আর বৃষ্টি হল না। তাঁর সকলে মসজিদে ও বারান্দায় খুব প্রশস্ততার সাথে তারাবির নামাজ পড়লেন। ঈদের পর হতে আবার বৃষ্টি আরম্ভ হল।
একবার মুরিদান সহ সফরে অবস্থানকালে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ একটি ভগ্নপ্রায় মসজিদে অবস্থান করছিলেন। সঙ্গীরা বলল, হুজুর এই মসজিদটি যে কোন সময় ধ্বসে পড়তে পারে। তিনি বললেন, আমরা যতদিন এখানে থাকব ততদিন তা ধ্বসে পড়বে না। তিনি মসজিদের দেয়ালের কাছে বসে মোরাকাবা করতেন এবং নামাজ পড়তেন। বাস্তবিক তাঁরা সেখানে থাকা পর্যন্ত মসজিদটি ঠিক ভাবে দাঁড়ায়ে রইল। কিন্তু যেদিন তিনি সঙ্গীসহ মসজিদ হতে বের হলেন সেই দিনই মসজিদটি হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ল।
একবার তিনি মুরিদানসহ লাহোরে গমন করেন। সেখানে তিনি নামাজ পড়ার জন্য বাসস্থান হতে সর্বদা মসজিদে যেতেন। একদিন এশার নামাজ পড়ে সঙ্গীসহ ফিরার পথে একটি পুরাতন দালান দেখে সঙ্গীদের সাবধান করে বললেন, খবরদার ! এই দালানের পাশ দিয়ে কেউ হেঁট না। অর্ধেক রাতের পর সংবাদ পাওয়া গেল দালানটি ধ্বসে পড়েছে। তার অধিবাসীদের কেউ কেউ আহত হয়েছে।
একদিন তিনি সফর কালে সঙ্গীদের বললেন, আজ জমিনে কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটবে। তোমরা এই দোয়াটি শিখে নাও, দুর্ঘটনার সময়ে তা পাঠ করো। ইনশাআল্লাহ তোমরা নিরাপদ থাকবে। এর কিছুক্ষণ পরেই শহরে আগুন লাগল এবং দেখতে না দেখতে আগুন বহুদূর পর্যন্ত ছড়ায়ে পড়ল, অনেকেই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। কিন্তু উক্ত দোয়া পাঠকারীদের কারও কোন ক্ষতি হল না।
একবার এক নিঃসন্তান ব্যক্তি এসে একটি সন্তান হওয়ার জন্য হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর কাছে দোয়া চাইল। তিনি বললেন, তোমার এই স্ত্রী বন্ধ্যা। সন্তানের আশা করলে অন্য বিবাহ করতে হবে। লোকটি দ্বিতীয় বিবাহ করে একটি পুত্র সন্তান লাভ করল।
কোন এক দরবেশ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর খেদমতে এসে বলল, আমি হজ্জে যাওয়ার এরাদা করেছি। আমার মকসূদ পূর্ণ হওয়ার জন্য দোয়া করুন। তিনি কিছুক্ষণ চক্ষু বন্ধ করে ক্ষণকাল পরেই বললেন, তোমাকে তো আরাফাতের ময়দানে দেখতে পেলাম না। অতঃপর দরবেশ সাহেব প্রতি বছর হজ্জে যাওয়ার চেষ্টা করতেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর হজ্জ করা হয়নি।
খাজা জামালুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর নিকট ফয়েজ হাসিলের জন্য আসলেন। তিনি তাকে বললেন, তুমি একটি রমণীর প্রতি আসক্ত হয়ে আছ। এই আসক্তি দূর না করা পর্যন্ত তুমি আমার নিকট হতে কোন ফয়েজের আশা করতে পার না। খাজা সাহেব তাঁর আসক্তির কথা স্বীকার করলেন এবং তওবা করে হযরত মুজাদ্দিদ সাহেবের মুরিদ হলেন এবং অশেষ ফয়েজ হাসিল করলেন।
একদিন হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এক মুরিদকে বললেন, তোমাকে হযরত ইব্রাহিম আঃ এর পক্ষ হতে বেলায়েত দান করা হয়েছে। মুরিদ তা বিশ্বাস করল না। পরবর্তী রাতে স্বপ্ন যোগে হযরত ইব্রাহিম আঃ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর উক্তির সত্যতা প্রতিপাদন করলেন। পরদিন উক্ত মুরিদ হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ এর খেদমতে উপস্থিত হলে তিনি মুরিদের বর্ণনার পূর্বেই রাতের ঘটনা বিস্তারিত তাকে শুনালেন। এতে মুরিদ লজ্জিত হয়ে তাঁর পায়ে লুটায়ে পড়ে নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
মোহাম্মদ আমীন নামের এক দুরারোগ্য রোগী আরোগ্য লাভে নিরাশ হয়ে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ এর নিকট একটি চিঠি লিখল। চিঠির জবাবে হযরত মুজাদ্দিদ রাঃ নিজের গায়ের জামাটি তার জন্য পাঠায়ে দিলেন। জামাটি পরার সঙ্গে সঙ্গে তার রোগ সম্পূর্ণরূপে ভাল হয়ে গেল।
ওফাত ঃ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ তেষট্টি বছর বয়সে পৌঁছলে ঈদুল আযহার দিন নামাজের পর সকলকে বললেন, আমার বয়স হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর বয়সের সমান হয়েছে। আমার অন্তিম সময় নিকটবর্তী। তোমাদের প্রতি আমার অসিয়ত- তোমরা হুজুরে আকরাম সাঃ এর সুন্নত এবং ওলামায়ে হকের ও বুযুর্গানে দ্বীনের অনুসরণ করো। শরিয়ত বিরোধী আলেমের কাছেও যেও না। জিকির-মোরাকাবা কখনও ত্যাগ করো না, অধিক মাত্রায় আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থেকো। আমার এই কথাগুলো মেনে চললে পারলৌকিক মুক্তি এবং বাতেনী এলমের কিছু অংশ লাভ করতে পারবে। আমার সন্তানগণকে সম্মান করো, তাঁদের নিকট দোয়া এবং তাওয়াজ্জুহ চেও।
আর একদিন তিনি বললেন, দুই মাস পরে যে শীত আসছে, তাতে আমি তোমাদের মধ্যে থাকব না। হিজরী ১০৩৩ সালের জিলহজ্জ মাসে তাঁর শ্বাস কষ্ট আরম্ভ হল। পরবর্তী দুই মাসে তাঁর রোগের অবস্থা ক্রমশঃ অবনতি হতে লাগল। ১০৩৪ হিজরির ২২ সফর তিনি মুরিদবর্গ ও পুত্রগণকে বললেন, একজন মানুষের পক্ষে যা কিছু পাওয়া সম্ভব আমি তার সব কিছু পেয়েছি। তাঁর এই উক্তি শুনে সকলে তাঁর অন্তিম কাল নিকটবর্তী বুঝতে পারল।
এর পাঁচদিন পর তিনি সকলকে ডাকায়ে পুনরায় পূর্ব অসিয়ত করলেন। আরও বললেন, সুন্নত তরিকা অনুযায়ী আমার দাফন করো। আমাকে গোসল দেয়ার সময় আমার খলিফাগণ ও পুত্রগণ ছাড়া আর কেউ যেন সেখানে উপস্থিত না থাকে। সাবধান ! আমার সতর যেন কেউ না দেখতে পায়। এসময়ে ক্রমশঃ তাঁর রোগের যন্ত্রণা বৃদ্ধি পেতে লাগল। এই দুর্বলতার সময়েও তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করলেন এবং বললেন, তা আমার শেষ নামাজ। তার পর ফজরের নামাজও জামাতের সাথে আদায় করলেন। এই সময়ে তিনি পাঞ্জাবী ভাষায় একটি বয়েত আবৃত্তি করলেন, যার অর্থÑ আজ আমি সেই বন্ধুর সন্ধান লাভ করেছি যার জন্য আমি সারা জাহান কোরবান করে দিতে পারি।
ফজরের নামাজ জামাতের সাথে পড়ে তিনি মোরাকাবায় বসলেন। মোরাকাবা শেষ করে এশরাকের নামাজও পড়লেন। অতঃপর ডেকে বললেন, আমার পেশাবের হাজত হয়েছে, একটি পাত্র আন। সঙ্গে সঙ্গেই একটি ভাণ্ড আনা হল কিন্তু তাতে বালি দেয়া ছিল না। কাপড়ে ছিটা লাগতে বলে বালি দিতে বললেন। তাতে বালি ভরে দেয়া হল। তিনি বললেন, এখন আর সময় কোথায় যে, পেশাবের পর অজু করতে পারব। তিনি আর প্রস্রাব করলেন না। বললেন, আমাকে বিছানায় শুয়ায়ে দাও। সাথে সাথে তাঁকে কেবলামুখী করে শুয়ায়ে দেয়া হল। শুয়ে তিনি ডান হাত চেহারার নিচে রেখে জিকির করতে লাগলেন। আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতে করতে তাঁর রূহ আল্লাহ পাকের দরবারে চলে গেল। সেদিনটি ছিল হিজরি ১০৩৪ সালের ২৮ শে মতান্তরে ২৯ শে সফর।
তাঁর লাশকে গোসল দেয়ার জন্য খাটিয়ার উপর রাখা হলে দেখা গেল, তাঁর হাত দুটি নামাজের কায়দায় নাভির নিচে বাঁধা আছে। অথচ ইন্তেকালের পর সাহেবজাদা হাত লম্বা করে দিয়েছিলেন। খাটিয়া রাখার সময় তাঁর হাসিমুখ ছিল। গোসলদাতা উভয় হাত কোশাদা করে প্রথম বাম করটে শোয়ায়ে ডান দিক ধৌত করেন। পরে ডান হাত করটে শোয়ায়ে বাম দিক ধৌত করেন। গোসল শেষে দেখা গেল উভয় হাত পূর্বাবস্থায় বাম হাতের উপর ডান হাত কনিষ্ঠা অঙ্গুলী ও বৃদ্ধাঙ্গুলীর দ্বারা হলকা অবস্থায় ছিল। অতঃপর সুন্নত অনুযায়ী কাফন দেয়া হল। সাহেবজাদা খাজা মোহাম্মদ সাঈদ সাহেব জানাজার নামাজ পড়ালেন। তাঁকে তাঁর মরহুম পুত্র হযরত সাদেক রাঃ এর মাজারের পশ্চিম পার্শ্বে সমাহিত করা হয়।

অমিয়বাণী :
হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী রাঃ বলেছেন,
পাপ কাজ করে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়াও তওবার একটি শাখা বিশেষ।
যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় তওবা এবং এস্তেগফার না করে সে জালিম।
মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে কারও মনে কষ্ট দিও না। কেননা তা কুফরীর পরবর্তী সর্বশ্রেষ্ঠ পাপ।
নিজেদের প্রয়োজনের উপর অপরের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার প্রদান করাই সত্যিকারের বদান্যতা।
আখেরাতের কাজ আজই সমাধা কর এবং দুনিয়ার কাজ আগামী কালের জন্য রেখে দাও।
সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে মানব জাতিই সর্বাপেক্ষা অধিক অভাবী।
কাফেরের সঙ্গে ভালবাসা ও সখ্যতা স্থাপন করলে প্রকারান্তরে মুসলমানকে হীন মনে করা ও অপমান করা হয়।
মানুষের সঙ্গে অধিক মেলামেশা করা তাদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নিকৃষ্ট শ্রেণীর আলেম তিনিই যিনি মানুষের কাছে সম্মানের প্রত্যাশা করে।
যে ব্যক্তি অন্তরের রোগে আক্রান্ত রয়েছে, কোন প্রকার ইবাদতই তাঁর জন্য কোন উপকারে আসে না ; বরং ক্ষতি করে।
নিরর্থক ও নিষ্ফল কার্যাবলী হতে বিরত থাকাই ‘গোশানাশীনী’ বা নির্জনতা অবলম্বন করা। আর দুনিয়া তরক করার অর্থ এই যে, দুনিয়ার প্রতি তোমার কোন মোহ বা আকর্ষণ না থাকা। দুনিয়ার কোন বস্তু পেয়ে খুশী হবে না। কিংবা দুনিয়ার কোন বস্তু তোমার হস্তচ্যুত হলেও তার জন্য দুঃখ করবে না।
আকীদা দুরস্ত না হওয়া পর্যন্ত শরিয়তের আহকাম সম্বন্ধীয় এলম কোন কাজে আসবে না। আবার এই দুটি বস্তু একসঙ্গে না হলে কালবের পরিুছন্নতা লাভ করাও সম্ভব নয়।
নফসের জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ হল শরিয়তের পাবন্দী করা।
দুনিয়ার যে সমস্ত স্বার্থ কাফেরদের সাথে জড়িত রয়েছে তা ত্যাগ করাই ইসলামের পূর্ণতা।
প্রতিবেশীর প্রতি অনুগ্রহ করাই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম অনুগ্রহ।
আল্লাহ তায়ালার শত্র“র সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করলে তা আল্লাহ ও রাসূলের সাথে শত্র“তার প্রতি টেনে নিয়ে যায়।
অহংকারী ব্যক্তির সাথে অহংকারমূলক ব্যবহার করা সদকা খয়রাতের সমান।
পয়গম্বরের বাণীর মোকাবিলায় জ্ঞানী বিজ্ঞানীদের বাণী পরিত্যাগ কর। পয়গম্বরের বাণীর সামনে তার কোন মূল্য নেই।
আল্লাহওয়ালা লোকগণ জমিনের জন্য নিরাপত্তা এবং যুগের জন্য গণীমত স্বরূপ।
জাহেরি জন্মের আয়ু অল্প কয়েকদিন আর আভ্যন্তরীণ জন্মের আয়ু অনন্ত।
সাধারণ শ্রেণীর লোকদের কাছে একটি মৃত দেহকে জীবিত করা খুব বড় কাজ, আর খাস লোকদের কাছে কালব এবং রূহকে সজীব করা অনন্ত জীবনের উপায়।
কুফুরী ও কাফেরদের অপমানের মধ্যেই মুসলমানদের ইজ্জত নিহিত রয়েছে।

হযরত মাওলানা  শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ

হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ ১৭৯০ ইংরেজি মোতাবেক ১২০৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগ গজনীর বাদশা ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র যুবরাজ হযরত বখতিয়ার কুতুবে আলম রাঃ এর নবম পুরুষ হযরত নিজামপুরী রাঃ। হযরত কুতুবে আলম রাঃ অতি অল্প বয়সে পিতা-মাতাকে হারান। মৃত্যুকালে পিতা সব সম্পত্তি তাঁর মামার কাছে তুলে দেন। শর্ত ছিল পুত্র কুতুবে আলম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাকে তা বুঝিয়ে দেবেন। তিনি পরিণত বয়সে মামার কাছে তা ফেরত চাইলে তিনি দিতে অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, সে দেশ থেকে জোরপূর্বক বের করে দেন। বাধ্য হয়ে ভগ্ন অন্তরে হযরত বখতিয়ার কুতুবে আলম পুত্র ফিরোজ শাহ, কন্যা মায়মুনা এবং স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনসহ দিল্লী রাজ দরবারে হিজরত করেন।
সম্রাট তাঁকে বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ের অধিপতি করেন। অসাধারণ জ্ঞান ও প্রতিভায় গৌড়ে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান বেড়ে গেল। এতে করে হিংসুক প্রকৃতির কিছু মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগে যায়। অন্যদিকে পিতা কুতুবুল আলম ইন্তেকাল করেন। এরকম বহুবিধ কারণে হযরত ফিরোজ শাহ গৌড় ছেড়ে বোন মায়মুনা ও আত্মীয় পরিজনসহ বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার ছান্দিয়া গ্রামে বাস করতে থাকেন। তিনি শুযায়াত খান নামক একজন আত্মীয়ের সাথে হযরত মায়মুনা রাঃ কে বিয়ে দেন। তাঁর গর্ভে একপুত্র মিয়া মল্লিক জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র মিয়া ইবরাহিম। তাঁর পুত্র শেখ বন্ধু। এমনি করে  বংশধারা নেমে আসেÑ শেখ আমানুল্লাহ, তাঁর পুত্র শেখ নাছের মুহাম্মদ, তাঁরপুত্র শেখ মুহাম্মদ ফানাহ। হযরত শেখ মোহাম্মদ পানা রাঃ এর ঔরসে হযরত শাহ সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ জন্ম গ্রহণ করেন।
হযরত মুহম্মদ পানা রাঃ এর পিতা চান্দিয়া গ্রামের বসতি ছেড়ে চট্টগ্রাম জেলার নিজামপুর পরগণার অন্তর্গত মালিয়াশ গ্রামে বসত করতে শুরু করেন। এখানেই হযরত শাহ সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ ভূমিষ্ঠ হন।
মহান আল্লাহর অলিগণের জন্ম থেকেই তাঁদের উঠা-বসা, চাল-চলনে অনেক কিছু প্রকাশ পায়। একই ভাবে হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর মাঝে বাল্যকাল থেকেই উঠা-বসা, চাল-চলনে উন্নত চরিত্রের ভাব প্রকাশ পেতে থাকে। সাথে সাথে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি, তাকওয়া, পরহেজগারী লালন করেই তিনি বড় হতে থাকেন। পিতার মত তিনিও একজন স্বনামধন্য আলেম ও বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর লেখাপড়ার হাতেখড়ি পিতা কেবলার কাছেই হয়েছিল। স্থানীয় ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি বিখ্যাত কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা হতে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর এ মাদ্রাসায় শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তখন কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মৌলভী ছিলেন হযরত ওয়াজি উল্লাহ রহঃ। অবশেষে তিনি ‘ফখরুল মুহাদ্দেসীন’ খেতাব লাভ করেন। তখন তিনি কলিকাতা মুন্সি গোলাম রহমান মসজিদ সংলগ্ন একটি ঘরে অবস্থান নেন।
হযরত নিজামপুরী রাঃ শৈশব থেকেই ছিলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। তাই প্রাথমিক শিক্ষা জীবন চলা কালেই তিনি প্রথম হযরত শেখ জায়েদ রহমান পারগণসের নামক এক বিখ্যাত দরবেশের হাতে মুরিদ হয়েছিলেন। তারও বেশ পরে পবিত্র হজ্ব উপলক্ষে মদিনা মুনাওয়ারা অবস্থানকালে স্বপ্নে হযরত নবী পাক সাঃ এর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে কলিকাতা নগরীতে আমীরুল মুমেনীন হযরত শাহ সূফী সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরলভী রাঃ এর হাতে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতায় বায়াত হন। তিনি তাঁর থেকে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশেবন্দিয়া, মুজাদ্দেদিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া ও ওয়াইসীয়া তরিকায় খেলাফত লাভ করেন। হযরত শাহ সূফী সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরলভী রাঃ ছিলেন প্রখ্যাত আলেম হযরত শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী রাঃ এর সুযোগ্য মুরিদ ও খলিফা।
হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এক মুহূর্ত সময়ও আল্লাহ তায়ালার জিকির ছাড়া অবসর থাকা পছন্দ করতেন না। পীড়িত ব্যক্তিকে দেখাশুনা ও পরিচর্যা করা, মৃত ব্যক্তির জানাজায় অংশ নেয়া নিজের অন্যতম কর্তব্য কর্ম মনে করতেন। সব সময় মসজিদে নামাজ পড়তেন এবং এক ওয়াক্ত নামাজ শেষে অন্য ওয়াক্তের নামাজের জন্য অপেক্ষা করতেন। দিনের বেলায় কোন সময় বিশ্রাম গ্রহণ করলে ঘন ঘন জিজ্ঞাসা করতেন আজান হয়েছে কি না। শুক্রবার দিন সকাল হতে জুমার নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। জুমার নামাজের পূর্বে কিছুই আহার গ্রহণ করতেন না। তাঁর পরিধেয় বস্ত্র ছিল একখানা সাদা কাপড়, মাথায় একটু সাদা পাগড়ী আর গায়ে একখানা চাদর। তিনি ছোট-বড় ইতর-ভদ্র সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলতেন।
হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ হযরত সূফী দায়েম রাঃ এর অলৌকিকতার সংবাদ শুনে সেখানে শুভাগমন করতেন, কখনো কখনো অবস্থানও করতেন। তাছাড়া ঢাকা কলিকাতা-চট্টগ্রামের মাঝামাঝি হওয়ায় ঢাকায় বিরতির সময় তিনি মাঝে মধ্যেই আজিমপুর দ্বায়রা শরীফে অবস্থান করতেন। তখন হযরত সূফী দায়েম রহঃ এর সুযোগ্য সন্তান ও খলিফা হযরত সূফী সাইয়্যেদ লকিয়ত উল্লাহ সেখানকার গদিনশীন ছিলেন। হযরত নিজামপুরী রাঃ এর এখানে আসা-যাওয়া থেকে বর্তমান আজিমপুর দ্বায়রা শরীফ সহ অনেক গ্রন্থকার  তাঁকে হযরত সূফী সাইয়্যেদ দায়েম রাঃ এর মুরিদ বলে মন্তব্য করে থাকেন। এটি যেমনই বিভ্রান্তিকর, তেমনি ধৃষ্টতাপূর্ণ।
একই সাথে হযরত নিজামপুরী রাঃ তাঁর পীর-মোর্শেদ হযরত সাইয়্যেদ আহমেদ শহীদ রাঃ এর আজাদী আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ছিলেন তাঁর অন্যতম দক্ষিণ হস্ত। তাঁদের মুজাহিদ বাহিনী পাজ্ঞাবের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন পাঞ্জাবে শিখরা ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমানদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করছিল। ফলে, পাঞ্জাবের পাঞ্জাতারে এক অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ বেধে যায়। এ যুদ্ধে হযরত শাহ সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর পীর ভাই হযরত ওয়াইসী রাঃ এর পিতা হযরত ওয়ারেস আলী রাঃ শাহাদত বরণ করেন। তারপর হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাঃ তাঁর বাহিনী নিয়ে কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তখন  ঐতিহাসিক বালাকোট এলাকায় শিখদের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি পাকিস্তানের বর্তমান রাজধানী ইসলামাবাদ ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফারবাদের মধ্যবর্তী। এ যুদ্ধে হযরত বেরলভীর রাঃ এর সৈন্য সংখ্যা ছিল আটশ’ জনের মতো। প্রতিপক্ষ শিখদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার।
এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মে শুক্রবার। এই যুদ্ধে আমিরুল মুমেনীন হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাঃ ও মাওলানা ইসমাইল শহীদ রাঃ সহ প্রায় তিনশত মুজাহিদ শাহাদত বরণ করেন। হযরত বেরলভী রাঃ এর শাহাদত বরণ করার পর মুহূর্তে হযরত শাহ সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ মুজাহিদ বাহিনীর হাল ধরেন। তিনিও আহত হলেন। হযরত নিজামপুরী রাঃ যখন যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, তখন যুদ্ধের ময়দানে মহান আল্লাহর অলৌকিক শক্তি বার বার প্রদর্শিত হতে থাকে। তিনি টানা যুদ্ধ করে আহত ও দুর্বল  হয়ে পড়েন। এ শোচনীয় অবস্থায় তিনি জীবিত কাফেলাকে সসম্মানে রক্ষা করতে সক্ষম হন। তারপর তিনি কলিকাতায় ফিরে আসেন। মুন্সি গোলাম রহমান মসজিদে তিনি রাত-দিন মহান আল্লাহ তায়ালার ধ্যানে মগ্ন  থাকেন। তখন ব্রিটিশরা কলিকাতায় তাঁকে বার বার গ্রেফতারের চেষ্টা চালায়। মহান আল্লাহ পাকের মহিমায় ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রচেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়।
হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ কলিকাতায় অবস্থানকালে কলিকাতা মাদ্রাসা আলিয়ার কাম্পাউন্ডের পশ্চিম পার্শ্বে কলিন ষ্ট্রীট বা রাস্তায় জমিদার মুন্সি গোলাম রহমান মসজিদের পার্শ্বস্থ কক্ষে থাকতেন। আর অন্য দিকে শাহ ওয়ালী উল্লাহ লেনে বিবি সালেটের মসজিদে থাকতেন হযরত ওয়াইসী কেবলা রাঃ। ফলে, মাদ্রাসা আলিয়ার ছাত্র শিক্ষকদের উপর তাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বিদ্যমান ছিল।
কলিকাতায় দীর্ঘদিন অবস্থানের পর তাঁরই প্রিয় পালকপুত্র আবদুল্লাহকে নিয়ে নিজামপুর পরগণার মালিয়াশ গ্রামে চলে আসেন।  তিনি জীবদ্দশায় এখানে নিজের খানকা শরীফের পাশে একটি সুন্দর মসজিদও নির্মাণ করে গেছেন। এটি বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার অন্তর্গত। তিনি সেখানে রাত-দিন আল্লাহ পাকের ধ্যানে অতিবাহিত করতে থাকেন। হযরত শাহ সূফী নিজামপুরী রাঃ এর আগমনে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। তিনি যে একজন মহান অলি ও গাজীয়ে বালাকোট, তা-ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এখানেই পরবর্তী জীবন কাটিয়ে এ মহান অলি ২৪ রবিউল আউয়াল ১২৭৫ হিজরী, ১ নভেম্বর ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে, ১৩ কার্তিক ১২৬৬ বাংলায় ইন্তেকাল করেন। কয়েক বছর পর তাঁরই প্রিয় পোষ্য পুত্র আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। তাঁকেও সেখানে সমাহিত করা হয়। তিনি ছিলেন তাঁর জনৈক আত্মীয়ের পুত্র। হযরত শাহ সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ ছিলেন চিরকুমার। হযরত নিজামপুরী রাঃ এর ইন্তেকালের আগে তাঁরই রূহানী ইঙ্গিতে মালিয়াশ গ্রামের কয়েক কিলোমিটার উত্তরে মোবারক ঘোনার বাসিন্দা হযরত মাওলানা আকরাম আলী রাঃ তাঁর জানাজার নামাজে ইমামতি করেন। তিনি তাঁরই অন্যতম মুরিদ, মতান্তরে খলিফাও।
হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর খলিফাগণের কোন সুস্পষ্ট তালিকা পাওয়া যায় না। হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী রাঃ ছাড়াও অন্যান্য যে সকল খলিফার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের অন্যতম হলেন, হযরত খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান রাঃ, হযরত মাওলানা আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী রাঃ, হযরত মাওলানা গোলাম কাদের রাঃ, ফুরফুরা, ভারত, হযরত মাওলানা আনওয়ার উল্লাহ রাঃ, ইসলামাবাদ, হযরত হাফেজ ক্বারী মুহাম্মদ ইবরাহীম রাঃ প্রমুখ।

হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর কারামত

১. পশ্চিম বাংলার মধ্যে যখন মহামারী লেগেছিল, তখন তাঁর আস্তানার আশে পাশে ঐ সময় মহামারী হয়নি। সূফী সাহেব তখন কলিকাতা শাহরে মুন্সী গোলাম রহমানের মসজিদের নিকটবর্তী লঙ্গরখানায় অবস্থান করছিলেন। তখন এমন কোন পল্লী ছিল না যেখানে কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়নি। কিন্তু সূফী সাহেবের পল্লীতে কাউকে রোগে আক্রমণ না করায় পল্লীর লোকেরা এসে তাঁর কাছে দোয়াপ্রার্থী হন। সূফী সাহেব তাঁদের বললেন, আমি তোমাদের জন্য মঙ্গল কামনা করতে পারি যদি তোমরা ভবিষ্যতে পাপ কাজ না করার প্রতিজ্ঞা কর। তখন তারা এক বাক্যে বলে উঠল যে, আমরা ভবিষ্যতে পাপ কাজ করব না বলে আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম। তারপর সূফী সাহেব এলাকাবাসীর মঙ্গল ও শান্তির জন্য এবং কলেরা, মহামারী ইত্যাদি থেকে সেসব এলাকাবাসীদের মুক্ত ও মাহফুজ রাখার জন্য রাব্বুল আলামিনের দরবারে দোয়া করলেন। রাব্বুল আলামিন কলিকাতা শহর হতে কলেরা, মহামারী দূর করে নিলেন এবং শহরের অবস্থা পুনরায় পূর্বের মত ফিরে আসে ও লোকেরা সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
২. একদা তাঁর বাসস্থান ইসলামাবাদের (চট্টগ্রামের) নিজামপুর পরগনার মধ্যে এক চোর ঢুকেছিল। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে সে এমন বিপদে পড়ল যে, সে ভিতরে প্রবেশের কোন রাস্তা পেলনা এবং আসার কোন উপায় দেখল না। যখন সূফী সাহেব তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠলেন অবস্থা জেনে তাকে কিছু তৌবা করায়ে বিদায় করেন।
৩. চট্টগ্রামের কাতালগঞ্জ নিবাসী মৌলানা হামিদুল্লাহ খাঁ সাহেব ইসলামাবাদ নিবাসী মৌলানা মুহির আলী হতে বর্ণনা করেছেনÑ আমি একজন কামেল মোর্শেদের তালাশ করতে ছিলাম যিনি শরিয়তের এবং তরিকতের অগাধ জ্ঞান রাখেন। অনেক চেষ্টার পর যাঁকে এ গুণে গুণান্বিত পেলাম মুরিদ হওয়ার মানসে তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি প্রথমে মুরিদ করতে অস্বীকার করলেন। যখন নিরাশ হয়ে খেদমত হতে চলে আসবার চেষ্টা করলাম তিনি বললেন, আমার উপর তোমার প্রাগাঢ় ভক্তি জন্মেছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আজ চলে যাও। আজ রাতে পাক পবিত্র পোশাক এবং পবিত্র বিছানায় এশার নামাজ পড়ে নিচের দরূদ শরীফ পড়ে শুয়ে যেও। যা কিছু দেখবে আগামী কাল বলবে।
দরূদ শরীফটি এইÑ “আল্লাহুম্মা সাল্লেআলা সাইয়্যেদিনা মুহম্মাদিনল, নাবিইল উম্মিয়ে ওয়ালিহি ওয়া সাল্লিম।” আমি রাতে তাঁর নির্দেশ মোতাবেক এই দরূদ শরীফটি পড়ে শুয়ে গেলাম। স্বপ্নে দেখলাম একটি সুন্দর বাগান, সে বাগানে একখানা অতি মনোরম ঘর। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ঘরের দরজায় দাঁড়ানো লোকটি কে? এটি কেমন বাগান এবং এ ঘরখানা কার? সে ঘরে যারা বাস করে তারা বলল, এ ঘরখানা বেহেস্ত। এক দিক ইঙ্গিত করে বলল ঐ দিকে ঘরের দরজা। দরজায় গিয়ে দেখলাম সেখানে হযরত শাহ সূফী নুর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পায়ের নিচে দোযখ অবস্থিত। হযরত সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এক মুরিদের হাত ধরে দোযখ থেকে বেহেশতে ঢুকায়ে দিলেন।
হামিদুল্লাহ খাঁ বললেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হুজুর ! একি ব্যাপার? আপনি দেখি দোযখ থেকেই বেহেশতে আনছেন, এর কারণ কি? তিনি বললেন, আমি অনেক কান্নাকাটি করে আল্লাহর দরবার হতে কতেক দোযখীকে বেহেশতে নিবার অনুমতি পেয়েছি। তাই ঐ সমস্ত লোককে আমি বের করে বেহেশতে পৌঁছাচ্ছি। তাঁর এ কথায় আমি স্বজোরে সোবহানাল্লাহ বলে চিৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্বপ্ন ছুটে গেল  এবং হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর উপর আমার বিশ্বাস ও ভক্তি বেড়ে গেল। ভোর হওয়ার সাথে সাথেই ফজরের নামাজ পড়ে তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলাম। সূফী সাহেব কেবলা ফজর নামাজ পড়ে মোরাকাবায় বা আল্লাহর ধ্যানে বসবার পর মোরাকাবা যখন শেষ হল তখন পার্শ্বে তাকায়ে আমাকে দেখলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এসেছো? আমি বললাম, হাঁ, এসেছি। আমাকে তিনি বায়াত করলেন। আমি স্বপ্নের বিষয়বস্তু বিস্তারিত বলার পর তিনি বললেন, আমি তো এখানেই। আসল কথা হল মানুষ যখন কামেল পীরের হাতে হাত দিয়ে তরিকতের সবক নিয়ে কিছু রিয়াজত করে তখন গুনাহের কারণে কলবের উপরে গুনার পর্দা পড়ে যায়। তা তরিকতের অজিফা ও রেয়াজতের কারণে গুনাহের পর্দা কেটে পরিষ্কার হয়ে যায় অর্থাৎ গুনাহ মাফ হবার পর কলব পরিষ্কার হবার পর আলমে মাখলুকাতের মধ্যে বহু কিছু দেকতে পায়। তুমি সে দরজার কথা বলছো সে দরজা আমার কোথায় হবে? বোধ হয় সে অন্য কেহ?
হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ যখন কলিকাতায় অবস্থান করছিলেন তখন ইংরেজ আমল। তাঁর পূর্বের কার্যদক্ষতা দেখে ইংরেজদের মনে ভয়ের উদ্রেক হয়। তারা মনে করল, সূফী সাহেবের মত মহাযোদ্ধাকে দমন করতে না পারলে আমাদের শাসন ব্যবস্থা ক্ষতি হতে পারে। তাই ইংরেজরা তাঁকে হত্যা করার জন্য কয়েকজন দস্যুকে নিয়োজিত করল।
এক রাতের একটি ঘটনা, দস্যুগণ তাঁকে হত্যা করার জন্য তাঁর ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু তারা তাকে দেখা মাত্র ভয়ে কম্পমান হয়ে যায় এবং তাদের হাতের তলোয়ার পড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তারা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাঁর কারামত দেখে সকলে মুসলমান হয়ে যায়। এ ঘটনার কিছু দিন পর ইংরেজ সরকার যখন জানতে পারে যে, দস্যুরা মুসলমান হয়ে গেছে, তখন তারা আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল।
৪. হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ কলিকাতা ত্যাগ করে চট্টগ্রামের অন্তর্গত মালিয়াশ নামক গ্রামে আগমন করার পর তাঁর কারামত ও বুযুর্গীর কথা চতুর্দিকে লোকমুখে ছড়ায়ে পড়ে। সে সময়ে একদিন তিনি উক্ত স্থান হতে দশ মাইল পূর্বদিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু সময়টা ছিল ভাদ্র মাস, তাই অতি বৃষ্টির কারণে সেখানে যেতে পারেননি। তাই নিজের এক শিষ্যকে সেস্থানে পাঠালেন। তিনি যখন পূর্বদিকে পথ চলতে চলতে এক পাহাড়ের মধ্যে উপস্থিত হন তখন হঠাৎ এক ব্যাঘ্র এসে তাঁকে আক্রমণ করে। তখন তিনি নিরূপায় হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ ! আমি তোমার প্রিয় বন্ধু হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর আদেশে এখানে এসেছি, তাঁর উসিলায় আমাকে এ হিংস্র জন্তুর আক্রমণ হতে রক্ষা কর। আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করতে না করতেই বাঘটি পলায়ন করল।
৫. চব্বিশ পরগনার বসিরহাট নিবাসী ফুরফুরা শরীফের অন্যতম খলিফা আল্লামা হযরত মাওলানা রুহুল আমীন সাহেব বর্ণনা করেন যে, এক রাতে হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ কলিকাতা শহরে মুন্সী গোলাম রহমানের মসজিদে এশার নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় ইংরেজ সেনাবাহিনী এসে মসজিদের চতুর্দিক ঘেরাও করে ফেলে। শেষ রাতে যখন তাঁকে খোঁজ করা হয় তখন মসজিদের কোথাও তাঁকে না পেয়ে তারা অধিক ভয় পেয়ে গেল। প্রকাশ থাকে যে, মসজিদ ঘেরাও থাকা অবস্থায় হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ অলৌকিক ক্ষমতা বলে আসাম প্রদেশে চলে যান। আসামের অনেক লোকজন সে সময়ে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেন।
৬. হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর এলাকার এক লোক ব্যবসার উদ্দেশ্যে একদিন কিছু মাল নিয়ে নৌকা বোঝাই করে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে অন্যদেশে যাচ্ছিল। নৌকাটি যখন সাগরের মাঝখানে পৌঁছেছে এমন সময় হঠাৎ দক্ষিণ দিক হতে তুফান আরম্ভ হয়। এক একটি তরঙ্গ ৫০/৬০ হাত উঁচু হয়ে আসতেছিল। তখন সে ধারণা করল, তার বাঁচবার আর উপায় নেই। সে তখন হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ কে স্মরণ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল, হে আল্লাহ ! তুমি আমাকে এ কঠিন বিপদ থেকে বাঁচাও, যাতে আমি দেশে ফিরে তোমার বন্ধু হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর মাজার জেয়ারত করতে পারি। আল্লাহ পাক তার দোয়ার সাথে সাথে তুফান বন্ধ করে দিলেন। সে ব্যক্তি শান্তিতে দেশে ফিরে হযরত নুর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর মাজার শরীফ জেয়ারত করেন।
৭. হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ যে একজন কামেল অলি ছিলেন তার পরিচয় বালাকোটের ময়দানে রাজা রনজিৎ সিংহের সাথে সংঘটিত ঘুদ্ধে পাওয়া যায়। তিনি নিজ অলৌকিক ক্ষমতা গুণে বিসমিল্লাহ পড়ে তোপের গোলা নিজ হাতে ধরতেন এবং সেটা পুনরায় শত্র“র দিকে ফিরায়ে দিতেন। তাঁর শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হাতের উপর তোপের গোলার দাগ ছিল।
৮. চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার এক ব্যক্তি এক লোটা দুধ নিয়ে হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর দরবারে আসতেছিলেন। সে যখন পাহাড়ের মাঝখানে পৌঁছল, তখন একটি বাঘ তাকে আক্রমণ করল। সে উপায়ান্তর না দেখে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল, হে আল্লাহ ! আমি তোমার অলির দরবারে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছি, তুমি আমাকে এই হিংস্র জন্তুর হাত হতে রক্ষা কর। সে হঠাৎ দেখতে পেল একটি লোটা এসে বাঘের মুখে আটকা পড়ল। সে আর আক্রমণ করতে পারল না। পাহাড়ের মধ্যে যখন বাঘ তাকে আক্রমণ করছিল, তখন হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ আসরের নামাজ পড়ার জন্য অজু করছিলেন। হঠাৎ তিনি লোটাটিকে ‘দূর হও’ বলে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। তার কারণ কেউ জানতে পারল না।
এদিকে বাঘটি পাহাড়ের মধ্যে লোটাটি মুখ হতে ফেলে দিয়ে জঙ্গলে পালায়ে গেলে লোকটি লোটাটি হাতে নিয়ে গভীর রাতে নিরাপদে দরবার শরীফে এসে পৌঁছে হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ কে বলল, আমি আপনার জন্য কিছু দুধ নিয়ে আসতেছিলাম। হঠাৎ একটি বাঘ আমাকে আক্রমণ করলে আমি আপনাকে স্মরণ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলে হঠাৎ আক্রমণকারী বাঘের মুখে কোথা হতে একটি লোটা এসে তার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সে আর আমাকে আক্রমণ করতে পারেনি। এ ঘটনা বর্ণনা করার সময় সেখানে আরো অনেক ভক্ত-মুরিদান উপস্থিত ছিলেন। তারা লোটাটি তার হাতে দেখে বুঝতে পারে যে, আসরের নামাজের জন্য অজু করার সময় তিনি লোটাটি রাগান্বিত হয়ে পুকুরে ছুড়ে ফেলেছিলেন। তারা দেখতে পায় যে, লোটাটিতে বাঘের দাঁতের কামড়ের দাগ রয়েছে।
৯. হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর মালিয়াশ গ্রামে অবস্থান কালে সে গ্রামের উত্তর পার্শ্বের এক বাড়ির এক পিতার দু’সন্তান ছিল। মৃত্যুর সময় তার সম্পত্তিকে তাদের মধ্যে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। বড় ভাই সম্পত্তি নিয়ে সব সময় ছোট ভাইয়ের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করত। তাই একদিন ছোট ভাই হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর কাছে এই বিপদের কথা বর্ণনা করল। তিনি তাদের দু’জনকে ডেকে বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। কিন্তু তারপরও বড় ভাই তার উপর জুলুম-অত্যাচার অব্যাহত রাখে।
হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ কলিকাতা যাওয়ার মনস্থ করেন। সে সময় ছোট ভাই এসে বলে, হুজুর আপনি থাকা অবস্থায় আপনি মীমাংসা করে দেওয়ার পরও সে মানছে না, আমাকে বরং আরো বেশি বেশি জুলুম করছে। আর আপনি চলে গেলে আমার অবস্থা কি হবে?
তখন হযরত নিজামপুরী রাঃ তাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, যে ব্যক্তি তোমার উপর অত্যাচার করবে তাকে শুকরে খাবে।
কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার বড় ভাই ছোট ভাইয়ের উপর জুলুম অত্যাচার শুরু করল। সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া করছে এমন সময় তার বাড়ির পশ্চিম দিকে খালের ধারে ছোট একটা জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ জঙ্গল হতে একটা শুকর এসে বড় ভাইকে আক্রমণ করে তার গর্দানের উপর নোখ দিয়ে কেটে রক্ত খেয়ে সেই শুকর আবার জঙ্গলে চলে যায়। আশপাশের লোকজন এই অবস্থা দেখে ছুটে এল। তারা ঐ জঙ্গলটি ঘিরে ফেলে সেই শুকরটি মারার জন্য অনেক খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু শুকরটি পেল না।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বড় ভাই মৃত্যুবরণ করল। তখন আর কারো বুঝতে বাকি থাকল না যে, হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর নির্দেশ না মানার কারণেই তার এই দুরবস্থা হয়েছে।
১০. একদিন হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ আসরের নামাজের জন্য অজু ও মিসওয়াক করছিলেন। এমন সময় একজন লোক দুটি পুটলি ও দুটি কাপড়ের গাঁইট নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হল। লোকটি তাঁর হাতে সেই পুটলি ও গাঁইট দিয়ে আসরের পূর্ব হতে মাগরিবের শেষ পর্যন্ত নিদ্রা গেলেন। আর হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ তার আমানত পাহারা দেয়ার জন্য দু’ওয়াক্ত নামাজ কাযা করলেন। তারপর সে ব্যক্তি নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে তার পুটলি নিয়ে চলে গেলেন। চলে যাওয়ার পর হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ কে তাঁর প্রধান শিষ্য আনোয়ার উল্লাহ জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই ব্যক্তি কে? অপারগ হয়ে তিনি বললেন, তিনি হলেন এ জামানার কুতুব। তিন বছর পর্যন্ত এ পুটলি অর্পণ করার জন্য বিশ্বস্ত কাউকে পাননি। আজ আমার কাছে অর্পণ করে কিছু সময়ের জন্য নিদ্রা গেলেন।
সূফীয়া নূরীয়া মাদ্রাসা ঃ হযরত আবু বকর সিদ্দিকী রাঃ এর অন্যতম খলিফা হলেন চট্টগ্রামের মীরেরসরাইয়ের হযরত মাওলানা আবদুল গণি রাঃ। তিনি হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর স্মরণে চট্টগ্রামের মিরেরসরায়ে সূফীয়া নূরীয়া মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসাটি হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাঃ এর মাজার শরীফের কয়েকশ’ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত।