হাদিস শরীফের নির্দেশনা

ইলমে শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফাতের বিষয়ে হাদিস শরীফে বহু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেমন- হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে –

الشَّريةٌ شَجرَةٌ وَ الطَّرِيقَةُ اَغصَانُهَا وَ المَعرِفَةُ اَورَقُهَا وَ الحَقِيقَةُ ثَمَرُهَا –

অর্থাৎ, শরীয়ত একটি বৃক্ষস্বরূপ, তরীকত তার শাখা প্রশাখা, মারেফাত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল । (সিসরুল আসরার)

হাদীস শরীফে আরও এরশাদ হয়েছে –

اَلشَّرِيعَةُ اَقوَالِى وَ الطَّرِقَةُ اَفعَالِى وَالحَقِيقَةُ اَحوَالِى وَالمَعرِيفَةُ اَسرَارِى-

অর্থাৎ, শরীয়ত হলো আমার কথাসমূহ (আদেশ-নিষেধ), তরীকত হলো আমার কাজসমূহ (আমল), হাকীকত হলো আমার গুপ্ত রহস্য। (ফেরদাউস)

তরীকত যথাযথভাবে পালন করতে হলে দ্বীনী এলেম অর্জন করতে হবে যা ফরজ। এই এলেম দু’প্রকার- ১) ইলমে ফিকাহ, ২) ইলমে তাছাউফ।

ইলমে ফিকাহ: ইলমে ফিকাহ দ্বারা এবাদাতে জাহেরা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। ইলমে তাছাউফ-এর দ্বারা এবাদাতে বাতেন বা অভ্যন্তরীন অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়ে ইখলাছ অর্জিত হয়। এ মর্মে হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে –

عن الحسن رضى الله عنه قال العلم علمان فعلم فى القلب فذاك العلم النافع و علم على للسان فذالك حجة الله غز و جل على ابن ادم-

(আনিল হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ক্বালা আল এলমু এলমানে ইলমু ফিল ক্বালবে ফাজাকাল ইলমুন নাফেউ ওয়া ইলমুল আলাল লেছানি ফাজাকা হুজ্জাতুল্লাহে আলা এবনে আদামা)। অর্থাৎ, এলেম দু’প্রকার (১) ক্বালবী এলেম। এটা হলো উপকারী এলেম। (২) লিসানী বা জবানী এলেম। এটা হলো আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আদম সন্তানদের প্রতি দলীলস্বরূপ। (মিশকাত শরীফ)

আর এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মালিকী মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম, ইমামুল আইম্মা রঈসুল মুহাদ্দিসীন ফখরুল ফুকাহা শায়খুল উলামা হযরত ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন –

مَن تَفَقَّهَ وَ لَم يَتَصَوَّفَ فَقَد تَفَسَّقَ وَ مَن تَصَوَّفَ وَ لَم يَتَفَقَّهَ فَقَد تَزَندَقَ وَ مَن جَمَعَ بَينَهُمَا فَقَد تَحضقَّقَ-

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এলেম ফিকাহ (জবানী এলেম) অর্জন করলো, কিন্তু এলেম তাছাউফ (ক্বালবী) এলেম অর্জন করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাছাউফের দাবি করে, কিন্তু শরীয়ত স্বীকার করেনা, সে ব্যক্তি যিন্দীক (কাফের); আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার এলেম অর্জন করলো সে ব্যক্তি মুহাক্কিক তথা মু’মিনে কামেল। (মিরকাত, কিতাবুল ইলম)

অর্থাৎ, এলমে ফিকাহ ও এলমে তাছাউফ উভয় প্রকার এলেম অর্জন করে দ্বীনের ওপর সঠিকভাবে চলার চেষ্টা করা প্রত্যেকের জন্য ফরজ। বর্তমান মুসলমানের কাছে আসল সত্য জিনিস বা শিক্ষা না থাকাতে মানুষ প্রকৃত মু’মিন হতে পারছে না। কেবল মাত্র ক্বলব নামের অমূল্য রত্নটা হস্তগত করতে জীবনের সব সময়ই চলে যায়, তবে মানুষ খাঁটি ঈমানদার হবে কবে। এ জন্য আমরা চিন্তা ফিকির করি না। তরীকতের এমন সরল সহজ পথ অবলম্বন করা দরকার যাতে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে উক্ত নেয়ামত পেতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত নেয়ামত বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কোনো কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া। এখন প্রশ্ন হলো তাজকিয়ায়ে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয়, আর তা লাভ করার মাধ্যম বাইয়া’ত হয়, তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কী করে? কেননা উছুল-ই রয়েছে যে আমলের দ্বারা ফরজ পূর্ণ হয় এবং সেই ফরজকে পূর্ণ করার জন্য সে আমল করাও ফরজ। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন: যেমন এ প্রসঙ্গে “দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে, যে আমল ব্যতিরেকে ফরজ পূর্ণ হয় না বা আদায় হয় না, সে ফরজ আদায় করার জন্য সে আমলটাও ফরজ। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নামাজ আদায় করা ফরজ। আর এ নামাজ আদায় হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে পবিত্রতা অর্জন করা, অর্থাৎ, ওজু। যখন কেউ নামাজ আদায় করবে, তখনই তার জন্য ওযু করা ফরজ হয়ে যাবে। যেহেতু ওজু ছাড়া নামাজ হবে না, ঠিক তদ্রুপ-ই এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ। আর বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ। আর হাদীস শরীফের ভাষায় এ ধরণের ফরজকে অতিরিক্ত ফরজ বলে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই উক্ত হাদিসে বর্ণিত অতিরিক্ত ফরজের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাজহাব মানা, বাইয়া’ত হওয়া ইত্যাদি।

মুসলিম শরীফের ছহীহ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে কেয়ামতের দিন শহীদ, দানশীল ও দ্বীন প্রচারকারী আলেম, এ তিন প্রকার লোক থেকে কিছু লোককে সর্বপ্রথম জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যেহেতু তারা এখলাছের সাথে জিহাদ, তাবলীগ, দান ছদকা ইত্যাদি করেনি। যে সব আলেম বলে থাকে কোরআন শরীফে বর্ণিত উছিলা হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ ইত্যাদি, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন: তাহলে নামাজ আদায় করে জিহাদ করে ইলিয়াছি তাবলীগ করেও বান্দা জাহান্নামে যাবে কেন? কেনো উক্ত আমলসমূহ তার জন্য নাজাতের উছিলা হলো না? নিশ্চয়ই আপনারা বলবেন, তাদের এখলাছ ছিল না। কেন এখলাছ ছিল না? তারা কামেলে-মোকাম্মেল পীরের কাছে বাইয়া’ত হয়ে এলমে তাছাউফ আমলের মাধ্যমে তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করে এখলাছ অর্জন করেনি। তাহলে বোঝা গেল, পীর-মাশায়খগণ হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম উছিলা, তথা উছিলাসমূহের উছিলা। কারণ তাঁদের কাছে বাইয়া’ত হওয়ার উছিলাতেই এছলাহ লাভ হয়, এখলাছ অর্জিত হয়। যার ফলে নামাজ, রোজা, জিহাদ, দান খয়রাত ইত্যাদি কবুল হয় বা নাজাতের উছিলা হয়।

বাইয়াত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে হাদিছ শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত আওফ বিন মালেক আশ’আরী (রা:) বলেন, আমরা ৯ জন কিংবা ৮ অথবা ৭ জন নবী করীম (দ:)-এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। হযরত নবী করীম (দ:) বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রাসূলের হাতে বাইয়া’ত হবে না? আমরা নিজ নিজ হাত প্রসারিত করে দিলাম এবং বললাম, হে আল্লাহ’র রাছুল (দ:) কোন বিষয়ের বাইয়া’ত হবো? নবী পাক (দ:) বললেন, এ বিষয়ের ওপর যে তোমরা আল্লাহ পাকের এবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করবে এবং যাবতীয় হুকুম-আহকাম শুনবে ও মান্য করবে। (মুসলিম, আবু দাউদ ও নাছাই শরীফ)

অন্য হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে –

وَ مَن مَاتَ وَ لَيسَ فىِ عُنُقِهِ بَيعَةُ مَاتَ مِيتَةَ جَاهِلِيَّةُ-

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যু বরণ করলো যে, তার গর্দানে বাইয়া’তের (আনুগত্যের) বেড়ি থাকলো না, সে জাহেলীয়াতের মৃত্যুতে মৃত্যু বরণ করলো। (মুসলীম শরীফ: কিতাবুল ইমারা, হাদীছ নং-৪৮৯৯)।