হযরত সুরেশ্বরী (রাঃ)
হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী সুরেশ্বরী রহ.
।
হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী সুরেশ্বরী রহ.
মহান আল্লাহ তায়ালা আত্মার জগতেই তাঁহার প্রিয়তম বান্দাগণকে মনোনীত করিয়াছেন এবং সেই সকল আত্মাকে পবিত্র আত্মার অধিকারী পিতার ঔরসে ও মাতার গর্ভের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়া থাকেন। তাই অধিকাংশ নবী-রাসূল, অলি-আউলিয়া পবিত্র আত্মার অধিকারী বুযুর্গ পিতার ঔরসে এবং বুযুর্গ মাতার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যাইতে পারে: হযরত শীশ আ., হযরত ইসমাঈল আ., হযরত দাউদ আ., বড়পীর গাউসুল আজম হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ., হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ., হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানী রহ., হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী রহ. প্রমুখ।
আল্লাহ তায়ালা তাঁহার প্রিয় বন্ধু মাদারজাত অলি শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী রহ.কে বুযুর্গ পিতা সূফীকুল সম্রাট সাফী হাজ্জ্বিউল হারামাইন আশ-শরীফাইন শাহ্ সূফী সাফী সৈয়্যেদ মুহাম্মদ মেহের উল্লাহ রহ.-এর ঔরসে এবং বুযুর্গ মাতা হযরত হাফেজা সৈয়্যেদা নূরজাহান খাতুনে জান্নাত রহ. গর্ভে ১২৬৩ বঙ্গাব্দের ২ অগ্রহায়ণ সোমবার সুবহে সাদিকের সময় শুভ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক দীক্ষা গুরু ও শিক্ষা গুরু। তাঁহার অমর কীর্তি সমূহ অদ্যাবধি বিশ্ববাসীর নিকট বিস্ময় হইয়া আছে। হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ.-এর বুযুর্গ পিতামহের বরকতময় নাম হযরত শাহ্ সৈয়্যেদ আখুন নিয়ামাতুল্লাহ্ রহ.।
তাঁহাদের পূর্ব্ব পুরুষ ইসলাম ধর্ম্ম প্রচারের লক্ষ্যে পবিত্র মদিনা মনোয়ারা হইতে এই দেশে আসিয়াছিলেন। হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রহ.-এর ঊর্ধ্বতন বংশধর আধ্যাত্মিক মহা-পুরুষ হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ মানিক শাহী রহ. এবং পঞ্চম পুরুষ আলহাজ্জ্ব হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ মুহাম্মদ দীদার উল্লাহ শরীফ মদিনা মনোয়ারা হইতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত হইয়া বাংলাদেশে আগমন করেন। তাঁহারা স্থায়ী ভাবে প্রথমতঃ পদ্মার তীরবর্র্ত্তী ইছাপাশা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেখানে নবাবদের প্রদত্ত সকল ভ‚-সম্পতি নিঃস্ব গরীবদের মধ্যে বিলাইয়া দেওয়ার পর নূতন ভাবে বাসস্থান নির্ম্মাণের জন্য পরবর্ত্তীতে পার্শ্ববর্তী সুরেশ্বর গ্রামে স্থানান্তরিত হন। তাঁহারা বংশানুক্রমিক উচ্চ কামালিয়ত সম্পন্ন মহান আল্লাহর অলি ও আশেকে রাসূল সা.ছিলেন। জ্ঞানে-গুণে ও পাণ্ডিত্যে সকলের নিকট তাঁহারা শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তাঁহার পরবর্ত্তী বংশধরগণের মধ্যেও একই ভাবধারা প্রবাহিত রহিয়াছে। তাঁহারা প্রত্যেকেই ছিলেন সূফী মনোভাবাপন্ন আধ্যাত্মিক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সদৃশ।
হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ.-এর পিতা কেবলা সমাজে ‘সূফী সাহেব’ নামে সু-পরিচিত ছিলেন। এখনও মানুষের মাঝে তাঁহার সেই পরিচিতি বিদ্যমান রহিয়াছে। তিনি জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও কর্ম্ম গুণে সর্ব্বত্র জনপ্রিয় ছিলেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের নিকট তিনি শ্রদ্ধাভাজন মহান অলি আল্লাহ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি এতই সূফী মনোভাবাপন্ন ছিলেন যে, কখনও নিজের গাভী ছুটিয়া গিয়া অন্যের জমির ঘাস বা ফসল খাইলে সাত দিন তিনি ঐ গাভীর দুধ পান করিতেন না। পরিবারের কাহাকেও তাহা পান করিতে দিতেন না। ঐ সাত দিনের দুধ সেই জমির মালিকের বাড়ীতে পাঠাইয়া দিতেন। তিনি কখনও জমির সীমানা বা আইলের নিকটবর্ত্তী ৪/৫ হাত পরিমাণ জমির ফসল ঘরে আনিতেন না।
এমন জগৎ বিখ্যাত সূফীকুল সম্রাট মহান পিতার ঔরসে এবং মহীয়সী মাতা হযরত হাফেজা সৈয়্যেদা নূরজাহান খাতুনে জান্নাত রহ.-এর পবিত্র গর্ভে হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার মাতা ছিলেন অসংখ্য গুণে গুণান্বিতা মহীয়সী নারী। তিনি কোরআনে হাফেজা ছিলেন এবং বাংলা, আরবী, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় তাঁহার অগাধ জ্ঞান ছিল। ফলশ্রুতিতে হযরত সুরেশ্বরী রহ. এমন গরীয়সী জননীর মায়া-মমতা ও সাহচর্য্যে থাকিয়া মাত্র ৮/৯ বৎসর বয়সে যে বিদ্যার্জন করিলেন, তাহা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও অসামান্য মেধার পরিচায়ক। যাহা সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না। উল্লেখ্য, এই সময় পরম করুণাময়ের আহ্বাণে তাঁহার মাতা ইহলোক ত্যাগ করেন। মাতৃ বিয়োগের কারণে তিনি অত্যন্ত মর্ম্মাহত হইয়া পড়েন। ফলে পড়া-লেখায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে।
এমন প্রতিভার যথার্থ বিকাশের লক্ষ্যে তাঁহার পিতা হযরত সূফী সাহেব রহ. তাঁহাকে নয় বৎসর বয়সে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্ত্তি করিয়া দেন। সেখানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সহিত তিনি পড়ালেখা চালাইয়া যান। সর্ব্ব ক্ষেত্রে তিনি প্রভূত মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় অত্যন্ত প্রশংসার সহিত সর্ব্ব পরীক্ষায় কৃতকার্য্য হইয়া প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভের পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক পর্য্যায়ে তাঁহাকে মোদাররেস (শিক্ষক) হিসাবে নিয়োগ দান করেন।
পরবর্ত্তীতে তিনি কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ‘হেড মৌলভী’র পদ অলঙ্কৃত করেন। ইহাই ছিল তখনকার সময়ে কোন ভারতীয় মুসলমানের জন্য সর্বোচ্চ পদ। ঊর্ধ্বতন পদ ছিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। যাহা ছিল ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত। মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ‘হেড মৌলভী’ (শাইখুল হাদিস) সর্বোচ্চ পদে হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রহ. দীর্র্ঘ বিশ বৎসর (১৮৯২- ১৯১২ খৃঃ) অধিষ্ঠিত ছিলেন। তবে তিনি মাদ্রাসার এই পদে শুধু মাত্র ‘আহমদ’ নামে সু-পরিচিত ছিলেন।
কিশোর বয়স হইতে ইলমে শরীয়তের পাশাপাশি ইলমে তরিকত, হাকিকত ও মারেফতের জ্ঞান অর্জন করিতে রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.-এর নিকট হযরত সুরেশ্বরী রহ. বায়াত গ্রহণ করেন। তাঁহার নিকট হইতেই তিনি কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, মাসুমিয়া ও ওয়াইসিয়া এই সাত তরিকার ফয়েজ-নিসবত, খেলাফত ও পীরের মর্য্যাদা লাভ করেন। ফলে, তিনি এক দিকে যেমন বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন ছিলেন, অন্যদিকে মোর্শেদে মোকাম্মেল হইয়া সুপরিচিতি লাভ করেন।
از بهاران کی شود سرسبز سنگ
خاک شو تا گل نمایی رنگ رنگ
উচ্চারণ : “দর বাহাঁরা না শওদ্ সর সবয্ সংগ্
খাক্ শো তা গুল বর দিদ রনগ্ রনগ্”
- হযরত শেখ সাদী রহ.
অর্থ : বসন্তকালীন মৌসুমে পাথর কখনই
সজীবতা লাভ করে না, (কবি
নিজেকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন)
মাটির মত হইয়া যাও, যেইখানে
নানান রঙের ফুল শোভা পায়।
হযরত শেখ সাদী আলোচ্য কাব্যাংশে বুঝাইয়াছেন যে, নরম মাটিতে যেমন ফুল ফুটে তেমনি মানুষ বিনয়ী হইলে তাহার মর্য্যাদা বৃদ্ধি পায়। হযরত সুরেশ্বরী রহ. জ্যোতির্ম্ময় মোর্শেদ রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.-এর নিকট বায়াত গ্রহণ পূর্ব্বক সোহবতে থাকিয়া আত্ম-শুদ্ধির মাধ্যমে অসীম আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করিয়াছিলেন। তাই আজ তিনি বিশ্ব ব্যাপী সুপরিচিত।
অতঃপর হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. পীর-মোর্শেদ কেবলার নির্দেশে হেদায়েত ও তরিকতের কাজ পূর্ণ মাত্রায় করিতে থাকেন। তিনি ধর্ম্মীয় বিভিন্ন কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি উচ্ছেদ করেন। ওহাবী, খারেজী ও নজদীরা ধর্ম্মপ্রাণ মানুষের ঈমান-আকীদা বিনষ্ট করিতে পাঁয়তারা করিতেছিল। তাহারা ইসলামকে নিজস্ব ভাবধারায় অপতৎপরতায় কুক্ষিগত করিয়া ফেলিয়াছিল। মনগড়া মতবাদ ধর্ম্মভীরু ও অশিক্ষিত জন-সমাজের উপর চাপাইয়া ধর্ম্মীয় পরিবেশ সম্পূর্ণ কলুষিত করিয়াছিল। এমন প্রতিকূল পরিবেশে হযরত সুরেশ্বরী রহ. সমাজে প্রতিষ্ঠা করিলেন কোরআন-হাদিসের আলোকে প্রকৃত ইসলামের ভিত্তি। জুমার নামাজ পড়াকে ওহাবীরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিল, আর তিনি তাহাদের বিরুদ্ধে কোরআন-হাদিসের আলোকে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য ও মত প্রকাশ করিয়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জুমার নামাজ প্রতিষ্ঠিত করেন।
হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রহ. তরিকত প্রচারে দেশ-বিদেশ সফর শুরু করেন। নিজ পীর-মোর্শেদ কেবলার নির্দেশে ধীরে ধীরে সুরেশ্বর দরবার শরীফে রওজা শরীফ, দ্বায়রা শরীফ, মসজিদ, মাদ্রাসা, লঙ্গরখানা, মুসাফিরখানা নির্ম্মাণ করেন।
মোর্শেদ কেবলার নির্দেশে হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রহ. দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফ প্রতিষ্ঠা করিয়া ২০ মাঘ সপ্তাহ ব্যাপী ওরোছ শরীফ পালন করেন। এখন হইতে ১৩৭ বৎসর পূর্ব্বে অর্থাৎ ১৮৭২ খ্রীঃ হইতে তিনি দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে ১৬ মাঘ হইতে ২২ মাঘ সপ্তাহ ব্যাপী পবিত্র ওরোছ শরীফ উদযাপনের গোড়াপত্তন করেন। তখন হইতেই প্রতি বৎসর ২০ মাঘ ওরোছ শরীফ যথাযোগ্য মর্য্যাদায় অনুষ্ঠিত হইয়া আসিতেছে।
মোর্শেদ পাকের নির্দেশেই ১৬ মাঘ হইতে ১৮ মাঘ মঙ্গল ও বুধবার ব্যতীত যে কোন একদিন রওজা শরীফ গোসল দেওয়া হয়। এই ওরোছ শরীফে ১৯ মাঘ পবিত্র আশা মোবারক বাদ মাগরিব উপস্থিত ভক্ত-মুরিদ ও জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়। ২১ মাঘ হযরত গাউসুল আজম বড়পীর রহ.-এর নেওয়াজ ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
৫ পৌষ হইতে ২১ মাঘ ওরোছ শরীফের সময় পর্য্যন্ত সুরেশ্বর দরবার শরীফের সীমানায় কোন রকম জীব হত্যা করা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। অদ্যাবধি তাঁহার আওলাদগণ ৫ পৌষ হইতে ২২ মাঘ পর্য্যন্ত কোন জীব হত্যা করেন না। সুরেশ্বর দরবার শরীফের পবিত্র ওরোছ মোবারক সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্ম্মী আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সু-সম্পন্ন হয়। ৫ পৌষ হইতে ২১ মাঘ পর্য্যন্ত সুরেশ্বর দরবার এলাকায় কোন প্রাণী জবেহ করা নিষিদ্ধ থাকিবার কারণে ওরোছ শরীফে ও অন্যান্য ধর্ম্মীয় অনুষ্ঠানে তাবাররুক হিসাবে গরু-মহিষের মাংস গ্রহণ করা হয় না। ভক্ত আশেক জেয়ারতকারীগণ ভাল খাইবার আশায় কেহ দরবার শরীফে আসে না। ডাল-ভাত বা সামান্য তরকারি দিয়া দুই মুঠো খাইতে পারিলেই ভক্ত-আশেকগণ সন্তুষ্ট হন।
হযরত সুরেশ্বরী রহ. ওরোছ শরীফের প্রারম্ভিক সূচনা লগ্নে ৫ মাঘ ২টি ত্রিকোণ লম্বাকৃতির সাদা কাপড়ে লাল শালুর বর্ডারে লাল অর্ধচন্দ্র ও ৫ তারকা খচিত নিশান উত্তোলনের মাধ্যমে বিশ্বের সকল নবী-রাসূল আঃ ও অলি-আউলিয়াগণকে রূহানী ভাবে ওরোছ শরীফে দাওয়াত দান করিতেন। অদ্যাবধি সেই নিয়ম অব্যাহত রহিয়াছে। সপ্তাহ ব্যাপী ওরোছ শরীফে আগমনকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে ১৯ মাঘ পবিত্র আশা মোবারক জনসমক্ষে বাহির করা হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত একটি ও তাম্র নির্ম্মিত কারুকার্য্য খচিত সু-বৃহৎ পবিত্র চারটি মোট পাঁচটি আশা মোবারক হযরত সুরেশ্বরী রহ. গায়েবী ভাবে পাইয়াছিলেন। ভক্তকুল এই আশা মোবারক স্পর্শ করাকে সৌভাগ্যের কারণ মনে করেন। সপ্তাহ ব্যাপী ওরোছ শরীফের শেষ দিনে ২১ মাঘ হযরত গাউসুল আজম বড় পীর মুহিউদ্দীন আবদুল কাদির জিলানী রহ.-এর নামে নেওয়াজ তৈয়ারী করা হয়। দরবারে আগত ভক্তবৃন্দ উক্ত নেওয়াজ অত্যন্ত ভক্তি ও আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করেন। এই দিনে বিরাট ওয়াজ মাহ্ফিল ও আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
কোরআন ও হাদিসের অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রহ. ধর্ম্মীয় ও সমাজ সংস্কারের অংশ হিসাবে একে একে বাস্তবে রূপ দান করিয়াছিলেন জিকরে জলী, মাহফিলে সামা, সিজদায়ে তাহিয়্যা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তরিকত (বায়াত) গ্রহণ, মাজার শরীফে ইমারত-কোব্বা তৈরী করা, মাজার শরীফ জেয়ারত করা, মাজার শরীফে গিলাফ, ফুল, আগরবাতি, মোমবাতি ও গোলাপজল দেওয়া প্রভৃতি।
স্বীয় পীর-মোর্শেদ রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.-এর নিকট হইতে তাঁহার প্রিয়তম মুরিদ-খলিফা শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রহ. চিশতিয়া তরিকা সহ মোট সাত তরিকার ফয়েজ-নিসবত অর্জন করিয়াছিলেন। ফলে তিনি ছিলেন সুর প্রেমিক, পছন্দ করিতেন মাহফিলে সামা বা ভাব-সঙ্গীত। কেননা সুলতানুল হিন্দ গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ. এবং চিশতিয়া তরিকাপন্থী তাঁহার অধঃস্তন মহান আউলিয়াগণ সামা বা ভাব-সঙ্গীত শ্রবণ করিতেন।
হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ.-এর পর হযরত জালাল উদ্দীন রুমী রহ. সামার প্রতি আরও বেশী অনুরক্ত ছিলেন। তাঁহার মৌলভিয়া তরিকত পন্থীগণ নৃত্যের তালে তালে সামা বা ভাব-সঙ্গীত শ্রবণ করিয়া থাকেন। তাহাদের নৃত্য ও বাদ্য কালক্রমে চিশতীদের একাংশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। তাহারাও সামার সহিত নৃত্য করে। সামা সম্পর্কে কাহারো কাহারো আপত্তি থাকিলেও মূল বিষয় হইল সামা যে ব্যক্তিকে আলøাহমুখী করে, ঈমানে প্রতিষ্ঠিত করে, আল্লাহ-প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তাহার জন্য সামা শ্রবণ করা বৈধ। (দিওয়ানে মঈন উদ্দীন চিশতী)
আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর স্তুতি মূলক হাম্দ ও নাত, আল্লাহ ও রাসূলের আশেকগণের হৃদয় মহব্বতে আন্দোলিত করে। খোদ রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.ও নবী করীম সা.কে প্রেম নিবেদন করিয়া গজল-কাসিদা রচনা করিয়াছেন। যাহা সুর-ছন্দ ও শব্দ বিন্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। যাহা সুরেলা কণ্ঠে আবৃত্তি করিলে আশেকের অন্তর আন্দোলিত হইয়া উঠে। হযরত ওয়াইসী পীর রহ.-এর এমন গজল-কাসিদা রচনা মনের প্রেম ছন্দ-সুরে প্রকাশ এবং ঊর্ধ্বতন পীর-মোর্শেদগণের সামা প্রেমের অনুসরণেই তাঁহার কোন কোন মুরিদ-খলিফা মাহফিলে সামার আয়োজন করিতেন। তবে হযরত সুরেশ্বরী রহ. মাহ্ফিলে সামাকে জিকিরের সহায়ক হিসাবে ও রূহের খোরাক বলিয়া অধিক গুরুত্ব প্রদান করিয়াছিলেন। মাহফিলে সামায় বিভোর হইয়া ওয়াজদের হালে হালকা জিকিরের মাহফিলে কোন কোন আশেকান নৃত্যও করিয়া থাকেন। যেমনটি করিতেন হযরত জালাল উদ্দীন রুমী রহ.।
এই প্রসঙ্গে হযরত জালাল উদ্দীন রুমী রহ. লিখিয়াছেন,
رقص و جولان بر سر میدان کنند رقص اندر خون خود مردان کنند
چون رهند از دست خود دستی زنند چون جهند از نقص خود رقصی کنند
উচ্চারণ : “রাক্ছো জুলান বার সারে মেইদান কুনান্দ
রাক্ছে আন্দার খুনে খোদ মারদান কুনান্দ
চুন রাহেন্দ আয দাস্তে খোদ দাস্তি যানান্দ
চুন জাহান্দ আয নাকছে খোদ রাক্সি কুনান্দ”
অর্থ : পবিত্র মানুষ নৃত্য করেন আধ্যাত্মিক
যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজের রক্তের উপর।
নিজের হাত হইতে যখন তাহারা
মুক্ত হন তখন তালি বাজান
নিজের অসম্পূর্ণতাকে অতিক্রম
করে তাহারা নৃত্য করেন।
হযরত জালাল উদ্দীন রুমী রহ. আলোচ্য কবিতাংশে আধ্যাত্মিক জগতে সামা ও নৃত্যের মাহাত্ম্য তুলিয়া ধরিয়াছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁহার অনন্য লেখায় সুন্দর রূপে প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিয়াছে। পাঠক মাত্রই তাহা হৃদয় দিয়া উপলব্ধি করিতে পারিবেন।
শায়খুল ইসলাম হযরত ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর রহ.-এর সামা বিষয়ক একটি আলোচনার কথা মাহবুবে সোবহানী হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া রহ. ‘রাহাতুল কুলুব’ গ্রন্থে এই ভাবে লিখিয়াছেন, “হযরত শায়খ বদর উদ্দীন গজনবী রহ. ছয়জন দরবেশকে সঙ্গে লইয়া হুজুরের খেদমতে হাজির হইলেন এবং হযরত শায়খুল ইসলামের সন্নিকটে বসিয়া পড়িলেন। ‘সামা’ বা গান সম্বন্ধে আলোচনা শুরু হইল। যে যাহার জ্ঞান অনুপাতে সামা সম্বন্ধে বর্ণনা করিয়া যাইতেছিলেন। হযরত শায়খুল ইসলাম রহ. হযরত জামাল উদ্দীন রহ.কে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন, ‘সামা’ অন্তরে শান্তি দান করে এবং প্রেমিকদের গতিশীল করে ও প্রেম দরিয়ায় সাঁতার কাটা শিখায়। আরও বলিলেন, প্রেমিকদের রীতি হইল যখন তাহারা বন্ধুর নাম শুনে, তখন সম্মান প্রদর্শন করিবার জন্য দাঁড়াইয়া যায়। অতঃপর হযরত শায়খ বদর উদ্দীন গজনবী রহ. জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সামার মধ্যে যে কিছু লোক বেহুঁশ হইয়া যায় ইহার কারণ কি?’ হুজুর উত্তরে বলিলেন, বেহুঁশী (অচৈতন্যতা) তো “আলাস্তু বিরাব্বিকুম” (অর্থাৎ আমি তোমাদের প্রভু নহে) এর দিন হইতেই শুরু হইয়াছে।
সমস্ত রূহ যখন আলাস্তু বিরাব্বিকুম শুনিয়াছিল, তখনই কিছু রূহ প্রেমাকর্ষণে বেহুঁশ হইয়া গিয়াছিল। সেই বেহুঁশীভাবই পুনরায় প্রেমাকর্ষণে তাহার মাঝে ঝংকারিত হয়। অতঃপর শামস্ দবীর জমিনে চুম্বন করিয়া আরজ করিলেন, যেই দিন আলাস্তু বিরাব্বিকুম বলা হইয়াছিল, সেই দিন কি সমস্ত রূহ একত্র ছিল, না পৃথক? উত্তরে তিনি বলিলেন, সকলে একত্রে ছিল। শামস্ দবীর দ্বিতীয়বার আরজ করিলেন, তাহা হইলে এতো যুদ্ধ-বিগ্রহ, দলাদলি, রেশারেশি ও বিভিন্ন মতাবলম্বী লোক কেন? শায়খুল ইসলাম হযরত গঞ্জেশকর রহ. উত্তরে বলিলেন, ইমাম গাজ্জালী রহ. তাঁহার পুস্তকে লিখিয়াছেন, যখন আল্লাহ তায়ালা বলিলেন: ‘আলাস্তু বিরাব্বিকুম’ তখন সমস্ত রূহ চার শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া পড়িল।
এক. যাহারা অন্তর ও মুখে বলিয়াছিলেন, ‘বালা (হ্যাঁ)’ এবং সেজদাবনত হইলেন। এই সকল রূহ আম্বিয়া, আউলিয়া ও শহীদানদের মর্য্যাদা লাভ করে।
দুই. যাহারা অন্তর দিয়া বলিল এবং সেজদা করিল, কিন্তু মুখে বলিল না। এই রূহ গুলি কাফের (আল্লাহকে অস্বীকারকারী) এবং অন্যান্য বেদ্বীনের ঘরে জন্ম নেয়, কিন্তু পরবর্ত্তীতে তাহারা মুসলমান হয়।
তিন. যাহারা মুখে ‘বালা (হ্যাঁ)’ বলিয়াছে এবং সেজদা করিয়াছে কিন্তু অন্তর দিয়া বলে নাই। এই সকল রূহ মুসলমানদের ঘরে মুসলমান হইয়াই জন্ম নেয়, কিন্তু পরে পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী হয়। সর্বশেষে কাফের হইয়া দোজখ ভোগ করিবে।
চার. যেই রূহ গুলি ‘বালা (হ্যাঁ)’ না মুখে বলিয়াছে, না অন্তরে। এমনকি তাহারা সেজদাও করে নাই। তাহারা কাফের ও নাস্তিক হইয়া জন্ম নেয় এবং কাফের ও নাস্তিক হইয়াই মৃত্যু বরণ করিবে।
অতঃপর শায়খুল ইসলাম হযরত ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর রহ. পুনরায় সামা প্রসঙ্গে বলিলেন, যেই সকল প্রেমিক সামা শ্রবণ করিয়া বেহুঁশ হয়, তাহারা ঐ দিনও বেহুঁশ হইয়া গিয়াছিল। সেই বেহুঁশী হইতেই এই বেহুঁশীর জন্ম। সেই বেহুঁশী এই বেহুঁশীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়া আছে। যখন সে বন্ধুর নাম শ্রবণ করে তখন গতি, বিহবলতা, অচৈতন্যতা ও শান্তি এই চার জিনিস তাহার প্রেম সাগরে তরঙ্গ হইয়া তাহার প্রেমবীণায় ঝংকারিত হইয়া বাজিতে থাকে।
তাই হযরত সুরেশ্বরী রহ. এই সামার সুরকে ভালবাসিতেন। সুরের মূর্ছনায় তিনি পরম সত্তার মধ্যে বিলীন হইয়া যাইতেন। সুরের প্রতি তাঁহার এই ভালবাসার কারণে সকলেই তাঁহাকে ‘সুরের ঈশ্বর’ বা ‘সুরেশ্বর’ নামে অভিহিত করিতেন। কালক্রমে তিনি ‘সুরেশ্বরী’ নামে পরিচিতি ও সুখ্যাতি লাভ করেন।
শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রহ. কোরআনের বিধানের আলোকে চান্দ্র মাসের সঠিক হিসাবের উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। চাঁদের উপর নির্ভরশীল ইবাদত সমূহ যথাযথ সময়ে পালনের নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন। এখন হইতে শতাধিক বৎসর পূর্ব্বেই তিনি মত প্রদান করেন যে, বাংলাদেশের আকাশে প্রথম দিনের নূতন চাঁদ কখনও দেখা যায় না। তাই তিনি কোরআন, হাদিস ও আধ্যাত্মিকতার আলোকে ও সূক্ষ হিসাবের মাধ্যমে চান্দ্র মাসের সহিত সম্পর্কিত ইবাদত-বন্দেগী যথা নির্দিষ্ট সময়ে পালন করিতেন। সেই সঙ্গে ভক্ত-অনুসারীগণের পালন করিবার উপদেশ দান করিতেন। যাহা আমাদের দেশের হিসাবের সঙ্গে না মিলিলেও বর্ত্তমান সময়ের আলোকে প্রমাণ করিয়া দেখা যায় যে, তাহা সৌদি আরব কিংবা মধ্য প্রাচ্যের হিসাবের সহিত মিলিয়া যায়।
মাজার শরীফের হেফাজত ও জেয়ারতের উপর হযরত সুরেশ্বরী রহ. অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য অজ্ঞাত মাজার শরীফের অবস্থান চিহ্নিত করেন। সেই সকল মাজার শরীফ ও রওজা মোবারক তৈয়ারী করিয়া যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও করিয়াছিলেন।
বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরে হযরত শাহ্ সূফী আমানত খান রহ.-এর মাজার শরীফের উপর হেলিয়া পড়া বরই গাছ কাটিয়া দিয়া তিনি মাজার শরীফ নির্ম্মাণ ও জেয়ারতকারীগণের সুবিধা করিয়া দেন। উল্লেখ্য, এই বরই গাছের পাতা ছিঁড়িলে বা ডাল কাটিলে রক্ত ঝরিত। যে কেহ ছিঁড়িলে তাহার মুখ দিয়া রক্ত পড়িত এমনকি মৃত্যু বরণ করিত।
তিনি ধর্ম্মীয় দর্শনের আলোকে এবং কোরআন শরীফের সারগর্ভ তত্ত্ পূর্ণ অনেক কিতাব রচনা করিয়াছেন। তাঁহার অগণিত রচনার মধ্যে নিম্নলিখিত কিতাব বিশেষ ভাবে উলেøখ যোগ্য:
১. সিররহক জামেনূর ২. নূরেহক গঞ্জেনূর
৩. লতায়েফে শাফিয়া ৪. মাতলাউল উলূম
৫. ছফিনায়ে ছফর ৬. কৌলুল কেরাম
৭. সরহে সদর ৮. আইনাইন
৯. মদিনা কলকি অবতারের ছফিনা।
এই সকল কিতাব প্রকাশ করিতে হযরত সুরেশ্বরী রহ. দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে প্রেস স্থাপন করেন। এই প্রেসে তাঁহার পুত্র ও পরবর্ত্তী গদিনশীন হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ্ রহ. সার্ব্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনার মাধ্যমে পূর্ণোদ্যমে পুস্তক প্রকাশ ও প্রচার কার্য্য পরিচালনা করিতেন। ইলমে মারেফাতের তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ এই সকল কিতাব বাংলা-ভারতের সর্ব্বত্র বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল।
নবী করিম সা.-এর সুন্নতের প্রতি গুরুত্বারোপ করিয়াই পিতা কেবলা হযরত সূফী-সাফী হাজ্জ্বীউল হারামাইন আশ-শরীফাইন মুহাম্মদ মেহের উল্লাহ রহ. পুত্র হযরত সুরেশ্বরী রহ.কে পরিণত বয়সে নবী করিম সা.-এর সুন্নত অবলম্বনে পঁচিশ বৎসর বয়সে শুভ বিবাহ করাইয়া ছিলেন। তাঁহার প্রথমা স্ত্রীর নাম মোবারক হযরত সৈয়্যেদা মেহেরজান বিবি রহ.। দ্বিতীয়া স্ত্রী গোলে আরজান রহ.। তৃতীয় স্ত্রী হযরত রাহাতন নেছা রহ.।
হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রহ.-এর তিন পত্নী, দুই পুত্র ও পাঁচ কন্যা ছিলেন। তাঁহাদের কনিষ্ঠ পুত্র হযরত কলিম শাহ্ রহ. শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। অবশ্য শৈশবেই তিনি কামালিয়ত অর্জন করিয়াছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ্ ওরফে হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আবদুল হাই রহ.। কন্যাগণ হইলেন: হযরত সৈয়্যেদা আয়ফরেন্নেছা রহ., হযরত সৈয়্যেদা জোবেদা খাতুন রহ., হযরত সৈয়্যেদা আবেদা খাতুন রহ., প্রথম স্ত্রীর সর্ব্ব কনিষ্ঠা কন্যা হযরত সৈয়্যেদা হামিদা খাতুন রহ., তৃতীয় স্ত্রী হযরত সৈয়্যেদা রাহাতন নেছা বিবির গর্ভজাত একমাত্র কন্যা হযরত সৈয়্যেদা আরেফা খাতুন রহ.। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় স্ত্রী নিঃসন্তান ছিলেন।
এই মহান কীর্তিমান সিদ্ধ মহা-পুরুষ লক্ষ লক্ষ ভক্ত, মুরিদান, আশেকান, খলিফা ও আওলাদবর্গকে শোক সাগরে ভাসাইয়া ১৮ নভেম্বর ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দ মোতাবেক ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ২ অগ্রহায়ণ বুধবার বাদ মাগরিব ৫:১৫টায় বেছালে হক্ক লাভ করেন।
হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. ইতিপূর্ব্বে তাঁহার পীর-মোর্শেদের নির্দেশে দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে স্বীয় মোর্শেদ কেবলার মাজার শরীফ নির্ম্মাণ করেন। তাঁহার অন্তিম অসিয়ত অনুযায়ী ইন্তেকালের পর নিজ মোর্শেদ কেবলার মাজার শরীফের পদপ্রান্তে হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ.কে যথাযোগ্য মর্য্যাদায় দাফন করা হয়।
তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র ও পরবর্ত্তী গদিনশীন হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ্ রহ. পিতা কেবলার মাজার শরীফ নির্ম্মাণ করেন। একই দালানের অভ্যন্তরে পীর-মুরিদ অতি মনোরম পূত-পবিত্র স্বর্গীয় পরিবেশে পূর্ণ মর্য্যাদায় শায়িত আছেন। সুদৃশ্য উচ্চ গম্বুজ ও চার মিনার বিশিষ্ট মাজার শরীফে যেন হরহামেশা চলিতেছে আশেক-মাশুকের মধ্যে গোপন প্রেমালাপ। প্রতিদিন সকাল-বিকাল তাঁহাদের মাজার শরীফ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া গোলাপপানি ছিটাইয়া দেয় ভক্তবৃন্দ। জ্বালানো হয় সু-গন্ধি আগর বাতি। কাঁচা ফুল দিয়া ভক্ত-আশেকান শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাইয়া থাকে। পদ্মার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশ আর মাজার শরীফের পবিত্রতা আশেকের আত্মাকে প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করিয়া তোলে।
দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফ হইতে রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ. তাঁহার রূহানী সন্তান হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ.কে সঙ্গে লইয়া যেন গোটা দরবারের উপস্থিত আওলাদ, ভক্ত-মুরিদানদের মধ্যে ফয়েজে নিসবতে জামেয়ার অবারিত অফুরন্ত ধারা বিলাইয়া যাইতেছেন। এমনটিই উপস্থিত আশেকগণের আত্মিক উপলব্ধি। যাহারা ইতিমধ্যে পবিত্র রওজা শরীফ জেয়ারত করিয়াছেন তাহারাই এমন আত্মিক উপলব্ধি ব্যক্ত করিয়া আসিতেছেন।
এই মহান অলির মাজার শরীফ অতীব পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিদ্যমান। প্রতিদিন জেয়ারতকারীগণ ভক্তি-মহব্বত লইয়া জেয়ারত করিয়া থাকেন। ২০ মাঘ সপ্তাহ ব্যাপী বাৎসরিক ওরোছ শরীফ অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। এতদ ব্যতীত ২ অগ্রহায়ণ এই মহান অলির শুভ জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে খোশরোজ শরীফ এবং একই তারিখে তাঁহার ইন্তেকাল দিবস উপলক্ষে ফাতেহা শরীফ উদযাপিত হইয়া থাকে। এতদ ব্যতীত ইসলামী ধর্ম্মীয় দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান সমূহ উদযাপিত হইয়া আসিতেছে। এই সকল অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে লক্ষাধিক ভক্ত-মুরিদানের বিশাল সমাগম ঘটিয়া থাকে। ইহাতে ভক্ত-আশেকানগণ বিশেষ ফয়েজ-বরকত হাসিল করিয়া থাকেন।
হযরত সুরেশ্বরী রহ.-এর তিরোধানের আগের ওরোছ শরীফ অর্থাৎ ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ২০ মাঘ পবিত্র ওরোছ শরীফের সময়ে তাঁহার নয়নমণি জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ নূরশাহ্ রহ.-কে ফজরের নামাজের ইমাম নিযুক্ত করিয়া অগণিত ভক্ত ও মুরিদগণকে লইয়া তাঁহার পিছনে নামাজ আদায় করেন। এই সময় তিনি ভক্ত-মুরিদ, আশেকান, আত্মীয়-স্বজন ও উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মহা-মূল্যবান অসিয়ত করেন। অসিয়তে তিনি বলেন, “আমার কলিজার টুকরা হযরত নূরশাহ্ কে আজ হইতে আমার স্থলাভিষিক্ত ও গদিনশীন করিয়া গেলাম। আপনাদের মধ্যে আমি এই নূরের বাতি প্রজ্বলিত করিয়া গেলাম।”
সমবেত ভক্ত-মুরিদদের নিকট আরও ঘোষণা করেন, “আজ হইতে আমি লক্ষ-কোটি গুণ ক্ষমতা লইয়া নূরশাহ্ রহ.-এর সহিত মিশিয়া একাকার হইয়া গেলাম। আমাকে পাইতে চাহিলে হযরত বাবা নূরশাহ্ এর নিকট আসিলেই পাইবে। তাঁহার ও আমার মধ্যে কোন ব্যবধান থাকিল না। আমাদের উভয়কে এক মনে করিয়া ভক্তি মহব্বত ও মান্য করিতে হইবে।”
পিতার উপযুক্ত সন্তান হিসাবে হযরত নূরশাহ্ রহ. এই গুরু দায়িত্ব ভার সুচারু রূপে পালন করেন। তিনি দেশ-বিদেশে সর্ব্বত্র অগণিত ভক্ত-মুরিদ করেন। বাতিলদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করিয়া বিভিন্ন ধর্ম্মীয় বিতর্কে বহেসে জয়যুক্ত হন। বাংলা-ভারতের সর্ব্বত্র তিনি বিপুল সু-খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁহার এই সময়কে সুরেশ্বর দরবার শরীফের স্বর্ণ যুগ বলা হয়।
হযরত নূরশাহ্ রহ. ১৩৬০ বঙ্গাব্দের পবিত্র ওরোছ শরীফ ১৭ হইতে ২১ মাঘ পর্য্যন্ত অসুস্থ বোধ করিলেন। অতঃপর তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্মরণে পাঁচ দিন তন্ময় ভাবে নির্বাক অবস্থায় সময় অতিবাহিত করেন। এই সময়ে ওরোছ শরীফ উপলক্ষে আগত লক্ষ লক্ষ ভক্ত-মুরিদ অত্যন্ত অস্থির হইয়া আবেগ আপ্লুত চিত্তে হযরত সুরেশ্বরী কেবলা কাবা রহ.-এর রওজা শরীফে উপস্থিত হন। সেখানে তাহারা হযরত নূরশাহ্ রহ.-এর হায়াত দারাজ ও সুস্থতার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে ফরিয়াদ করিতে থাকেন।
হযরত নূরশাহ্ রহ. ২২ মাঘ সুস্থ হইয়া উঠেন। ভক্তকুল হযরত নূরশাহ্ রহ.-কে সুস্থ দেখিয়া আনন্দে উদ্বেলিত হইয়া উঠেন। উৎসুক হৃদয়ে পরবর্ত্তী গদিনশীন নির্ধারণ করিবার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ জানান। তদুত্তরে তিনি বলিলেন, “আমার জীবিত সন্তানদের মধ্যে যে স্বীয় প্রচেষ্টায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন করিতে সক্ষম হইবে সেই পরবর্ত্তী গদিনশীন বলিয়া বিবেচিত ও গ্রহণীয় হইবে এবং ফয়েজ ও রহমত লাভ করিবে। আল্লাহ পাক তাঁহার শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্ম্ম তৎপরতার মাধ্যমে সূর্য্য কিরণের ন্যায় পৃথিবীর সর্ব্বত্র সু-পরিচিত করিবেন।”
হযরত নূরশাহ্ রহ. দুই শাদী মোবারক করেন। তাঁহাদের সাত পুত্র তিন কন্যা সন্তান। তিনি দুই স্ত্রী, চার পুত্র ও তিন কন্যা রাখিয়া মাশুকের আহবানে ইহলোকের মায়া-মমতা ত্যাগ করিয়া ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ৫ ভাদ্র বিকাল ৩:১৫ মিনিটে সুরেশ্বর দরবার শরীফে বেছালে হক্ক প্রাপ্ত হন। তাঁহার মাজার শরীফ দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে সুন্দর আঙ্গিকে তৈরী করা হইয়াছে। সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পূত পবিত্র পরিবেশ বিদ্যমান। নিয়মিত ভক্ত-আশেকানগণ মাজার শরীফ জেয়ারত করিতে আসেন। বর্ত্তমানে তাঁহার পুত্রদের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্রকে আল্লাহ তায়ালা জীবিত রাখিয়াছেন। হযরত বাবা নূরশাহ্ রহ. পুত্রগণের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্রকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসিতেন। ওফাতের চারদিন পূর্ব্বে তাঁহার পবিত্র হাতের আঙ্গুলিতে ব্যবহৃত আংটি মোবারক কনিষ্ঠ পুত্রকে দান করিয়া গিয়াছেন। দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফের বর্ত্তমান গদিনশীন ও মোন্তাজেমে দরবারের গুরু দায়িত্ব ভার আল্লাহ পাক কনিষ্ঠ পুত্রকে দান করিয়াছেন। আল্লাহ পাকের রহমতে হযরত সুরেশ্বরী রহ. ও হযরত নূরশাহ রহ.-এর নির্দেশিত পথ ও সিলসিলায় যথা বিহিত দরবার শরীফের সকল কার্যক্রম সফলতার সহিত পরিচালনা করিয়া আসিতেছি। আল্লাহ পাক সকলের সহায় হউন।
।
মোর্শেদ কেবলার দরবারে
হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ.কে তাঁহার পিতা কেবলা মাত্র নয় বৎসর বয়সে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্ত্তি করিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসেন। হযরত সুরেশ্বরী রহ. মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে অবস্থান করিয়া একাগ্রচিত্তে পড়াশোনায় মগ্ন ছিলেন। মাদ্রাসা ও ছাত্রাবাস ছিল অতি নিকটে। এই দুইটির মাঝখান দিয়া পূর্ব্ব-পশ্চিমে একটি লম্বা রাস্তা চলিয়া গিয়াছে। এই রাস্তার দক্ষিণে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা এবং উত্তরে মাদ্রাসা ছাত্রাবাস ও অধ্যক্ষের বাস ভবন। রাস্তার এপার-ওপারের মধ্যেই হযরত সুরেশ্বরী রহ.-এর যাতায়াত সীমাবদ্ধ ছিল। এই ভাবেই তাঁহার দিন গুলি একে একে স্বাচ্ছন্দ্যে অতিবাহিত হইতেছিল।
মাদ্রাসার ঠিক সামনের রাস্তাটি পূর্ব্ব-পশ্চিমে আগাইয়া দুই অংশে বিভক্ত হইয়া পূর্ব্ব-উত্তরে তালতলার দিকে একটি অংশ চলিয়া গিয়াছে। অন্যটি দক্ষিণে গিয়া একটি অংশ পূর্ব্ব দিকে গিয়াছে। এই রাস্তার নাম ‘শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ লেন’। ১ নং শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ লেনেই বিবি সালেটের মসজিদ। ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর সু-বিখ্যাত অলিয়ে কামেল রাসূলনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ. বিবি সালেটের মসজিদ সংলগ্ন একটি হুজরা শরীফে প্রায়শঃ অবস্থান করিতেন। ইহা কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অতি নিকটেই ছিল। ফলে মাদ্রাসার ছাত্র এবং মোদাররেসগণ বিবি সালেট মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়িতে যাইতেন।
আল্লাহ পাকের রহমতে তাঁহাদের সহিত এক শুভ ক্ষণে হযরত সুরেশ্বরী রহ. সেখানে নামাজ আদায় করিতে যান। সেখানে হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা রহ.-এর সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। হযরত ওয়াইসী পীর রহ.-এর সু-মিষ্ট কন্ঠ এবং মধুর ব্যবহারে তিনি অভিভূত হন। তিনি অতি দরদের সহিত সুরেশ্বরী রহ.কে নিকটে বসিতে বলিলেন। বেশ আগ্রহ সহ তাঁহার নাম-পরিচয়, বর্ত্তমান অবস্থান, কোথায় কি করিতেছেন বিভিন্ন বিষয়ে স্ব-স্নেহে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। হযরত সুরেশ্বরী রহ. অত্যন্ত আদবের সহিত বিনয়ী কন্ঠে সকল প্রশ্নের উত্তর দিলেন। এই ঘটনার দিন হইতে তিনি হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা রহ.-এর প্রতি বিশেষ আত্মিক আকর্ষণ অনুভব করিতে থাকেন এবং একটি অব্যক্ত আবেদন তাঁহাকে অশান্ত করিয়া তোলে।
ما را از زلف تو موی با سند است
فضولی می کنم بوی با سند است
উচ্চারণ : “মরা আয্ যুলফে তু মুয়ে ব-সনদ আস্ত
ফযুলে মি কুনাম বুয়ে ব-সনদ আস্ত”
শেখ সাদী রহ.
অর্থ : আপনার যুলফের একটি চুলই তো
আমার জন্য যথেষ্ট। ইহাও তো অনেক
বাড়তি কথা, শুধুমাত্র আপনার সু-গন্ধই
তো আমার জন্য অনেক।
।
বায়াত গ্রহণ
“পীর ধর যথা পার কহিয়াছে সাঁই
পীরের উছিলা বিনা হবে না ভালাই
ওহে লোক যাহাদের তকলিদি ঈমান
ডরাও খোদাকে হও সঙ্গী সাদেকান”
কামেল পীরের নিকট বায়াত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে হযরত ওয়াইসী রহ.-এর অনন্য মুরিদ-খলিফা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. স্ব-রচিত আধ্যাত্মিক গ্রন্থ ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ -এ পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের কাব্যিক বঙ্গানুবাদ করিয়াছেন। এইখানে তিনি বায়াত গ্রহণের গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। নিম্নে তাঁহার নিজের বায়াত গ্রহণের ঘটনা তুলিয়া ধরা হইল:
কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন কালে শামসুল উলামা আল্লামা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. আত্মিক ভাবে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন যে, কামেল পীর-মোর্শেদের মাধ্যম ব্যতীত আল্লাহ ও রাসূলের পরম সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব নহে। এই আত্মিক উপলব্ধি হইতেই তিনি কামেল পীরের সন্ধানে ব্যাকুল হইয়া উঠেন।
কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার সামান্য পূর্ব্ব দিকে শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ লেনে বিবি সালেটের মসজিদ অবস্থিত। সেখানে হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা রহ. অবস্থান করিতেন। তিনি সেখানে ইলমে তাসাউফ সম্পর্কে শিক্ষা দান করিতেন। মাদ্রাসার অন্যান্য ছাত্র ও শিক্ষকগণের সহিত হযরত সুরেশ্বরী রহ. পাঞ্জেগানার নামাজ আদায়ের জন্য বিবি সালেটের মসজিদে যাইতেন। সেখানে তাঁহার সহিত রাসূলনোমা পীর হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.-এর সাক্ষাৎ হয়।
শায়খে তরিকত হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.-এর সহিত প্রথম সাক্ষাতেই হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি নিজের মধ্যে অভূতপূর্ব্ব আত্মিক পরিবর্ত্তন অনুভব করিলেন। তাঁহার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করিলেন। তিনি মোর্শেদ কেবলার এই অলৌকিক আত্মিক আকর্ষণকে বিশেষ তাৎপর্য্যরে সহিত মূল্যায়ন করিলেন।
হযরত ওয়াইসী পাক রহ.কে বারবার দেখিতে তাঁহার প্রাণ ছটফট করিতে লাগিল। তখন পড়ালেখা কিছুতেই ভাল লাগে না। তাঁহার অন্তর ওয়াইসী প্রেমে উত্তাল হইয়া ঢেউ খেলিতে থাকে। তিনি নিজেকে আর স্থির রাখিতে পারিলেন না। হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা রহ.-এর তীব্র আকর্ষণে তাঁহার অন্তর ব্যাকুল হইয়া উঠে। তাই তিনি পুনরায় বিবি সালেটের মসজিদে হযরত ওয়াইসী পীর রহ.-এর দরবার শরীফে উপস্থিত হইলেন।
তিনি ভক্তি ও বিনয় সহ অনতি দূরে দাঁড়াইয়া থাকেন। অন্তর ফাটিয়া অশ্রুতে বুক ভাসিতে থাকে। উপস্থিত সকলেই তাঁহার করুণ অবস্থা দেখিয়া হতবাক হইয়া গেলেন। তাঁহারা ভাবিলেন, এত ছোট বালক কি চাহে? হযরত ওয়াইসী পাক রহ. বালকের পূত-পবিত্র মনের বাসনা ঠিকই অনুধাবন করিয়াছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ তাঁহার দিকে অন্তর্র্দৃষ্টি দিয়া তাঁহার লাওহে মাহফুজের পাতা পাঠ করিয়া স্নেহার্দ্র কণ্ঠে নিকটে বসিতে নির্দেশ দান করিলেন। আধ্যাত্মিক রাজ্যের কুতুবুল এরশাদের রূহানিয়াতের তাজাল্লীর প্রভাবে হযরত সুরেশ্বরী রহ. প্রভাবিত হইয়া উঠেন। তিনি হযরত ওয়াইসী পীর রহ.-এর নির্দেশে ক্রন্দনরত অবস্থায় মজলিশে বসিয়া যান। অতঃপর তিনি তাঁহাকে তরিকত দান করেন। এই দিন হইতে হযরত পীর কেবলা তাঁহাকে ‘আজিজম’ (হে আমার প্রিয়তম) বলিয়া ডাকিতেন। আবার কখনও স্নেহ উচ্ছ্বাসে ‘জানশরীফ শাহ্’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ইহা ছিল কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্ত্তি হইবার প্রায় এক বৎসর পরের ঘটনা। সেই সময় তাঁহার বয়স ছিল মাত্র দশ বৎসর।
চঞ্চল নদী যেমন অশান্ত গতিতে ছুটিয়া বিশাল সাগরের মধ্যে নিজেকে বিলাইয়া দেয়, তেমনি হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. নিজের গন্তব্যে পৌঁছিয়া স্থির হইয়া যান। অশান্ত মন এখন স্থির ও প্রেমানুরাগে পূর্ণতা লাভ করে। পরশের স্পর্শে তিনি যেন নিজেই স্বর্ণ হইয়া মূল পরশে পরিণত হইলেন।
হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. নিজের বায়াত গ্রহণের ঘটনা স্ব-রচিত নূরেহক গঞ্জেনূর কিতাবে পয়ার ছন্দে রূপকাকারে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন: আমি যখন মোর্শেদ কেবলার সান্নিধ্যে কলিকাতার মানিকতলা যাই, সেখানে অনেকেই মেহেদীর রং কপালে লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছে; কিন্তু কাহারও কপালে লাগে নাই। আমার কপালে সে দাগ এমন ভাবে লাগিয়া গিয়াছে তাহা দিন-রাত্র কাঁদিয়া উঠাইতে পারি নাই। এইখানে মেহেদীর রং বলিতে মোর্শেদ পাকের ফয়েজ-বরকত, ভাব-মহব্বত, এশ্কের কথা বুঝানো হইয়াছে। তিনি নূরেহক গঞ্জেনূর কিতাবে লিখিয়াছেন:
“ভাবুকেরে সেই মেন্দী লাগাইবা কালে
পড়েছিল এক বিন্দু লাগানু কপালে।
কপালে লাগাইতে মেন্দী মাথা ধরে তায়
সে দরদে কাঁদি আমি করে হায় হায়।
সকল ভাবুক চাহে সে মেন্দী লাগাই
আমি বলি বাঁচে নহে কেমনে ছাড়াই।
ছাড়াইতে চাহি বটে লেগে বসে দাগ
আচম্বিতে সে দরদে ফুটিল দেমাগ।
দেমাগ হইল খালি রহে মাত্র খোল
সেই খোলে রোদনেতে বাজাই তবল।
শুনিয়া তবল মম কেহ পেরেশান
রোদন দেখে কত হাসিয়া হয়রান।
আমিও হাসিনু কত কান্দনে আমার
আমার কান্দনে লোক কান্দে জারে জার।”
হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী রহ.-এর নিকট হইতে হযরত সুরেশ্বরী রহ. যে আধ্যাত্মিক শিক্ষ-দীক্ষা এবং কামালিয়ত লাভ করিবেন, তাহা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও রাসূল পাক সা.-এর তরফ হইতে বহু পূর্ব্বেই নির্ধারিত ছিল। এই কারণেই হযরত সুরেশ্বরী রহ. নিজ পিতা কেবলার ইশারা এবং এজাজতে তাঁহার নিকট বায়াত গ্রহণ করেন।
।
সাধনা ও সন্তুষ্টি
“অভক্তিতে মিথ্যা হয় সত্য গুরুজন
ঘাসে পাবে মুক্তি রুমের কথন
পীর যদি ঘাস হবে ভক্তি কর তায়
ঘাসে ভক্তি পাবে মুক্তি যাবে না বৃথায় ।”
হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা রহ.-এর সুযোগ্য মুরিদ-খলিফা শামসুল উলামা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. স্ব-রচিত ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ গ্রন্থে প্রকৃত পীর-মোর্শেদ কেবলার প্রতি অবিচল প্রেম-ভালবাসা ও ভক্তির গুরুত্ব এই ভাবে তুলিয়া ধরিয়াছেন।
তিনি কেবল উপদেশ বাণীই প্রচার করেন নাই, বরং বাস্তব জীবনে মোর্শেদ প্রেমের অপূর্ব্ব উজ্জ্বল নিদর্শনও রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি কিশোর বয়সে বায়াত গ্রহণের পর হইতেই মোর্শেদ কেবলার কদম মোবারকে অতি আদাব ও ভক্তি সহ খেদমতে ব্রত থাকিতেন। মাদ্রাসায় পড়াশোনার অবসরে এবং ছুটির দিন গুলিতে পীর-মোর্শেদ হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা রহ.-এর সেবায় সততঃ হাজির হইতেন। আন্তরিক ভাবে অতি প্রেম ও ভক্তি সহকারে তাঁহার সেবা-অর্চনা করিয়া ফয়েজ-নিসবত অর্জন করিতেন।
নিজ মোর্শেদ কেবলার সেবাকে প্রধান কর্ত্তব্য জানিয়া হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রহ. দেহ-মন, সহায়-সম্পত্তি, জীবন-মরণ, ইহকাল-পরকাল সকল কিছুই তাঁহার পবিত্র কদম মোবারকে অর্পণ করেন। সংসার ও পৃথিবীর বাহ্যিক চাক-চিক্যের প্রতি উদাসীন ও অমনোযোগী হইয়া উঠেন। মোর্শেদ কেবলার সান্নিধ্য, রূহানী তাজল্লী ও ফয়েজের প্রতি তিনি প্রচণ্ড আকৃষ্ট হইয়া পড়েন। শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে মোর্শেদ কেবলার সন্তুষ্টিই হইয়া উঠে হযরত সুরেশ্বরী রহ.-এর একমাত্র ব্রত। মোর্শেদ পাকই ছিলেন তাঁহার উপাসনা ও ইবাদতের মাধ্যম।
স্বরচিত গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন অধ্যায়ে প্রাসঙ্গিকভাবে হযরত সুরেশ্বরী রহ.-এর স্বীয় পীর-মোর্শেদ হযরত ওয়াইসী পীর কেবলা রহ.-এর প্রতি অগাধ ভক্তি-মহব্বতের বহিঃ প্রকাশ ঘটিয়াছে। তিনি সর্ব্বাবস্থায় হযরত ওয়াইসী পীর রহ.-এর প্রতি আত্ম সমর্পিত রূপে থাকিতেন।
হযরত সুরেশ্বরী রহ. নিজ পীর মোর্শেদের খান্কা শরীফে অনুষ্ঠিত মাহফিলে প্রতিনিয়ত যোগদান করিয়া আত্মিক ভাবে উন্নতি লাভ করিতেন। মাদ্রাসা হইতে মোর্শেদ পাকের খানকা শরীফ খুবই নিকটে থাকায় মাত্র ৪/৫ মিনিট হাঁটিয়াই সেখানে পৌঁছানো যাইত। এমনি করিয়া নিজ পীর-মোর্শেদ হযরত ওয়াইসী পীর রহ.-এর প্রতি তাঁহার এশ্ক ও মহব্বত ক্রমেই বাড়িতে থাকে। মোর্শেদ প্রেমে তিনি এতই বিভোর ছিলেন যে, কখনও কখনও নিজের সম্বন্ধেও কোন খেয়াল থাকিত না। এ সময় তাঁহার চলা-ফেরা ও জীবন ধারা একেবারেই পরিবর্ত্তন হইয়া যায়।
হযরত সুরেশ্বরী রহ.-এর সততা, সারল্য, শিষ্টাচারিতা, গভীর প্রেম ও ভক্তির কারণে পীর-মোর্শেদ কেবলা তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহসুলভ দৃষ্টিতে দেখিতেন। মোর্শেদ কেবলা তাঁহার প্রতি অতিশয় দয়ার্দ্র ও সন্তুষ্ট ছিলেন।
মোর্শেদ প্রেম ও সাধনার মাধ্যমে ইলমে মারেফাতের জ্ঞান রাজ্যে তিনি যতই অগ্রসর হইতেছিলেন, ততোই তিনি আরও গভীরে প্রবেশ করিতে অধিক আগ্রহী হইয়া উঠিয়াছিলেন। ফলে তিনি নিজ মোর্শেদ কেবলার দরবারে প্রতি দিনের মাহফিলে যোগদান করিয়া কল্পনাতীত ভাবে মোর্শেদ কেবলার ফয়েজ-নিসবত লাভ করিতেছিলেন। প্রায়শঃ তিনি মাহফিল শেষে মোর্শেদ কেবলার খেদমত ও সাধনায় বিনিদ্র রজনী কাটাইয়া দিতেন। এই ভাবে তিনি মোর্শেদ কেবলার সন্তুষ্টি অর্জন ও করুণা লাভ করিয়া মারেফাতের সু-উচ্চ স্তর সমূহ অতিক্রম করেন। তিনি ‘গাউসিয়াত’ ও ‘কোতবিয়াতে এরশাদ’ এর মর্য্যাদা লাভ করেন।
তাই শামসুল উলামা আল্লামা হযরত আহমদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী রহ. ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ গ্রন্থে বর্ণনা করিয়াছেন:
“যদ্যপি হউক জানশরীফ নিশ্চিত
পাক বলে জানে কহা নহে হরষিত ।
হাকিকতে আহম্মদী আলী যে মোকাম
সাধিতে পারিলে সিদ্ধ হবে মনস্কাম ।”
-নূরেহক্ক গঞ্জেনূর।
অর্থাৎ: হযরত জানশরীফ একটি পূতঃ-পবিত্র নাম যাহা তাঁহার পারিবারিক সূত্রে রাখা হইয়াছিল। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে হযরত জানশরীফ আরশে মোয়াল্লায় ‘আহমদ আলী’ নামে সংরক্ষিত, সেই আজলী নাম তাঁহার পীর মোর্শেদ কেবলা প্রকাশ করিয়া দেন। তাই হযরত সুরেশ্বরী রহ.-এর বর্ণনায় বুঝা যাইতেছে যে, হযরত জানশরীফ কিংবা হযরত আহমদ আলী নামক যে মোকাম রহিয়াছে তাহা কেহ সাধন করিতে পারিলে সকল মনোবাঞ্ছাই তাহার পূর্ণ হইবে।
।
সবার উপরে পীর-মোর্শেদ
হযরত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রহ. পীর-মোর্শেদ কেবলার প্রতি ভালবাসা, ভক্তি ও বিশ্বাসের এমন চূড়ান্ত অবস্থানে উপনীত হইয়াছিলেন যে, সবকিছুর উপরে তিনি নিজ পীর-মোর্শেদ কেবলাকে প্রাধান্য দিতে পারিয়াছিলেন। শরিয়তের দৃষ্টিকোণে যাহা অসামঞ্জস্য মনে হইলেও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তাহা সর্বোচ্চ স্তরের অবস্থান সুনিশ্চিত করে। নিজ পীর-মোর্শেদ কেবলার মাধ্যমে সবকিছু পাওয়ার সাধনায় তিনি অতিশয় সাফল্যের সহিত উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন যাহার প্রমাণ তিনি ‘নূরেহক গঞ্জেনূর’ কিতাবে গুরুত্বের সহিত লিপিবদ্ধ করিয়াছেন-
“বিসমিল্লার শির পুঁজি এই ফতে নাম
ফতে বিনা ফতে নাহি হবে মনস্কাম ।”
আমরা কোন কাজ আরম্ভ করিতে সর্ব্ব প্রথম বিসমিল্লাহ বলিয়া থাকি, কিন্তু হযরত সুরেশ্বরী রহ. হযরত ওয়াইসী পাকের নাম স্মরণ করিয়া কাজের সূচনা করিতে নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, এই পবিত্র নাম লইয়া কোন আশেক কাজ শুরু করিলে তাহাতে বিজয় নিশ্চিত। তাঁহার এই অমূল্য উক্তি মারেফাতের জ্ঞানধারী ব্যক্তিগণ যথার্থ উপলব্ধি করিতে পারিবেন বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস। এইখানে ইহার অধিক বর্ণনা করা সমীচীন হইবে না।