পর্ব-২

অলি আউলিয়াগণের জীবন থেকে শিক্ষা

.

 

হযরত বড়পীর সৈয়্যেদ মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী রাঃ

হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ.

হযরত মাওলানা শাহ্ আবদুল আজিজ দেহলভী রাঃ

হযরত আহমদ শহীদ বেরলভী রাঃ

 

হযরত বড়পীর সৈয়্যেদ মহিউদ্দীন আবদুল কাদির জিলানী রাঃ

মাহবুবে সোবহানী গাউসে সামদানী হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল কাদির জিলানী রাঃ ৪৭০ হিজরির পবিত্র রমজান মাসে ইরান দেশের অন্তর্গত জিলান নগরে শুভ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মাকালে তাঁর মাতার বয়সি ছল ৬০ বছর। এত অধিক বয়সে কোন মহিলাই গর্ভধারণের আশা করতে পারে না। কিন্তু এমন নিরাশার সময়েও আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন একটি সুসন্তানের গর্ভধারিণী করলেন, যিনি মানসিক বলে ও জ্ঞান শক্তিতে দুনিয়ার সমস্ত শিশুর চেয়ে অধিক বলিয়ান ও শক্তিশালী হয়েছিলেন। মাতার বার্ধক্য জনিত দুর্বলতার কোন প্রভাবই সেই শিশুর মেধা ও মস্তিষ্কের উপর প্রতিফলিত হয়নি।
হযরত গাউসুল আযমের দেহাবয়ব কৃশ হলেও তাঁর মেধাশক্তি, ধীশক্তি, জ্ঞান শক্তি এবং অনুভূতি শক্তি এত প্রবল ও প্রখর ছিল যে, তৎকালে এলম ও জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাপক চর্চা থাকা সত্ত্বে এবং সেকালে বহু প্রধান প্রধান খ্যাতনামা মেধাবী ও প্রতিভাবান আলেম থাকা সত্ত্বেও তাঁর তুলনা এবং দৃষ্টান্ত অন্য কারও মধ্যে পাওয়া যায় না। বৃদ্ধ পিতামাতার মাধ্যমে এই পৃথিবীতে আসা সত্ত্বেও তাঁর শারিরীক গঠন এবং অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে যে, জন্মই তাঁর জীবনের সর্বপ্রথম কারামত।
বংশ পরিচয় : হযরত গাউসে আযম রাঃ সৈয়্যেদ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার বংশগত সম্পর্ক ছিল হযরত ইমাম হাসান রাঃ এর সাথে, আর মাতার বংশগত সম্পর্ক ছিল হযরত ইমাম হুসাইন রাঃ এর সাথে। এই কারণেই তাঁকে আলহাসানী ওয়াল হুসাইনী বলা হয়ে থাকে। হযরত গাউসে আযমের পিতার নাম হযরত সাইয়্যেদ আবু সালেহ মুসা রাঃ। আর তাঁর মাতার নাম হযরত সাইয়্যেদা উম্মুল খায়ের ফাতেমা রাঃ, তাঁর পিতৃকুলের বংশ তালিকা এইরূপ- হযরত সাইয়্যেদ মহিউদ্দিন আবু মুহাম্মদ আবদুল কাদের জিলানী ইবনে সাইয়্যেদ আবু সালেহ মুসা ইবনে সাইয়্যেদ আবু আবদুল্লাহ ইবনে সাইয়্যেদ ইয়াহইয়া যাহেদ ইবনে সাইয়্যেদ মুহাম্মদ ইবনে সাইয়্যেদ দাউদ ইবনে মুসা সানী ইবনে সাইয়্যেদ মুসা জওন ইবনে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ মাহায ইবনে সাইয়্যেদ হাসান মুসান্না ইবনে সাইয়্যেদুনা ওয়া মাউলানা আমিরুর মুমেনীন হযরত ইমাম হাসান ইবনে ইমামুল আলাম আমিরুল মুমেনীন সাইয়্যেদুনা হযরত আলী রাঃ।
তাঁর মাতৃকুলের বংশ তালকা এইরূপ- উম্মুল খায়ের ফাতেমা বিনতে আবদুল্লাহ মায়ী ইবনে আবু জালাল ইবনে সাইয়্যেদ মুহাম্মদ ইবনে সাইয়্যেদ আবু তাহের ইবনে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ ইবনে সাইয়্যেদ আবু কামাল ইবনে সাইয়্যেদ মূসা ইবনে সাইয়্যেদ আবু আলাউদ্দিন ইবনে সাইয়্যেদ মুহাম্মদ ইবনে সাইয়্যেদ ইমাম আলী রেজা ইবনে সাইয়্যেদ মুসা কাযেম ইবনে সাইয়্যেদুনা ইমাম জাফর সাদেক ইবনে সাইয়্যেদুনা ইমাম বাকের ইবনে সাইয়্যেদুনা ইমাম যাইনুল আবেদীন ইবনে সাইয়্যেদুনা আমিরুল মুমেনীন সাইয়্যেদুনা আলী রাঃ।
শৈশবে রোজা : ঐতিহাসিকগণ সকলেই এবিষয়ে একমত যে, হযরত গাউসে পাক রাঃ পবিত্র রমজান মাসে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃদুগ্ধ পান করার বয়সেও তিনি অতুলনীয় রূহানী শক্তির অধিকারী ছিলেন। এর ফলে জন্মাবধি কখনও তিনি পবিত্র রমজান মাসে দিনের বেলায় মাতৃদুগ্ধ পান করেননি।
হযরত গাউসে আযমের জননী কর্তৃক বর্ণিত আছে- একবার ঊনত্রিশে শাবান রমাজানের চাঁদ দেখা না যাওয়ার কারণে পরের দিনে রোজা রাখতে হবে কি না এ সম্বন্ধে কেহ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। শহরের জনৈক বুযুর্গ লোকের পরামর্শক্রমে সকাল বেলা কতিপয় জ্ঞানবান লোক আমার গৃহদ্বারে আগমন করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার মহান শিশু আজ সকালে দুগ্ধ পান করছেন কিনা? আর আপনার কাছে রমজানের চাঁদ সম্বন্ধে কোন খবর আছে কি না? আমি বললাম, চাঁদের কোন খবর তো আমরা পাইনি। কিন্তু আজ সকাল হতে আমার পুত্র আবদুল কাদির মোটেও স্তন্য পান করছে না দেখে আমার মনে হচ্ছে, আজ রমজান মাসের পহেলা তারিখ। আমার কাছে এই কথা অবগত হয়ে সেদিন সকলেই রোজা রেখেছিল।
একই রমজানেই ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে আবার মতভেদ দেখা দেয়, অবশেষে শহরের কয়েকজন লোক আমার কাছে আসলে আমি বললাম, আজও সকাল হতে আমার আবদুল কাদির স্তন্য পান করছে না। এতে আমার মনে হয়, আজও ঈদের চাঁদ উদিয় হয়নি। কেননা, রমজান শরীফের সম্মানের জন্যই এই শিশু দুগ্ধ পান বন্ধ রেখেছে। আমি প্রথম তারিখ হতে তাঁকে এইরূপ দেখে আসছি। তা শুনে কেহই আর রোজা ভাঙল না।
এই বর্ণনা শ্রবণ করে বাহ্য জ্ঞানধারী যুক্তিবাদীরা হয়ত ধারণা করবে যে, প্রত্যেক বুযুর্গ ও প্রিয় লোক সম্বন্ধে তাঁর ভক্তের দল এরূপ মনগড়া কাহিনী বর্ণনা করতে পারে। কিন্তু এই ঘটনাটি হযরত গাউসুল আযম সম্ভন্ধে কোন অসম্ভব এবং সাধারণ জ্ঞান বিরোধী নয়। স্নায়ু ও ইন্দ্রিয়গুলোর অনুভূতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞ দর্শন বিশারদগণ সাক্ষ্য দিতে পারে যে, যে মানুষকে আল্লাহ তায়ালা অসাধারণ স্নায়ুশক্তি মানসিক শক্তি ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি দান করে পয়দা করে থাকে।
গায়েবী বাণী : অতি শৈশব কাল হতে গাউসুল আযম রাঃ খুব গভীর ও সংযত স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে কখনও তিনি খেলাধুলায় লিপ্ত হননি। শৈশব কাল হতেই তিনি চিন্তাশীল ছিলেন। তাঁর সকল কাজ সর্মে, হাবভাবে ও কথায় অস্বাভাবিতা প্রকাশ পেত। ছোটবেলায় খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের স্পৃহা তাঁর অন্তরে যে মোটেও উদয় হত না এমন নয়, কিন্তু কখনও তিনি তাকে প্রশ্রয় দিতে পারতেন না। কেননা, এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাঁর পবিত্র জীবনকে গড়ে তুলেছিল। ছেলেমি প্রেরণা কখনও তাঁর অন্তরে উদয় হলে গায়েবী বাণী তাঁকে সতর্ক করে দিত। গাউসে পাকের সন্তান হযরত সাইয়্যেদ আবদুর রাজ্জাক বর্ণনা করেছেন যে, স্বয়ং গাউসে পাক বলেছেন, শৈশবকালে কখনও সমবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করার ইচ্ছা আমার মনে উদয় হলে তৎক্ষণাৎ আমি গায়েবী বাণী শুনতাম, – হে মুবারক শিশু ! আমার দিকে এস। এইরূপ গায়েবী আওয়াজ শুনে আমি ভয় পেতাম এবং দৌড়ায়ে মায়ের কোলে আশ্রয় নিতাম।
শৈশবে কুরআন শরীফ হেফজ : হযরত গাউসে আযম রাঃ নিতান্ত শৈশবেই কুরআন শরীফ হেফয করেছিলেন। শৈশবে বিদ্যা শিক্ষার জন্য তাঁকে জিলানের এক মক্তবে প্রেরণ করা হলে ওস্তাদজী তাঁকে বিসমিল্লাহ পড়তে বলেন। তিনি বিসমিল্লাহ হতে আরম্ভ করে কুরআন শরীফের পনের পারা মুখস্ত শুনায়ে দেন। ওস্তাদ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বললেন, আমার জননীর এই পনের পারা হেফজ আছে, তিনি তা সব সময় তেলাওয়াত করেন, তাঁর তেলাওয়াত বারবার শুনে শুনে পনের পারা আমার হেফজ হয়ে গেছে।
ফলকথা, অতি শৈশবেই তিনি সম্পূর্ণ কুরআন মজিদ হেফজ করে ফেলেন। অতঃপর দ্বীনি এলমের বিভিন্ন কিতাব পাঠে মনোযোগ দেন। হযরত গাউসে পাক মক্তবে গমনকালে ফেরেশাতগণ হযরত গাউসে পাককে ঘিরে তাঁর সঙ্গে যেতেন এবং বলতেন, আল্লাহর অলিকে পথ দাও।
কুরআন শরীফ হেফজ করার পর তিনি পিতা-মাতার কাছে বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করতে থাকেন, দিবারাত্র ইবাদত বন্দেগী এবং এলম হাসিল করাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। কিন্তু তাঁর ইবাদত ও সাধনা ক্ষেত্রে অল্পদিনের মধ্যেই বিরাট বিঘ্ন এসে উপস্থিত হল। তাঁর দশ কিংবা বার বছর বয়সে তাঁর পিতা ইহলোক ত্যাগ করেন। এখন গৃহকর্মের অনেক কাজের দায়িত্ব তাঁর উপর এসে চাপল।
একদিন তিনি আরাফার দিনে নিজের গাভীটিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে গায়েবী আওয়াজ শুনলেন, ….. অর্থ- হে আবদুল কাদির ! তোমাকে এই কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি এবং এ কাজের জন্য তোমাকে আদেশও করা হয়নি।
শিক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ : হযরত গাউসে পাক আঠার বছর বয়স পর্যন্ত স্বীয় গৃহে থেকে এলম হাসিল করতে থাকেন। কিন্তু তাতে তাঁর জ্ঞান পিপাসা আরও বেড়ে চলল, তদুপরি আরাফার দিনের সেই সতর্কবাণী তাঁর অন্তরে এমন প্রভাব ফেলল যে, তিনি স্বীয় গৃহের ছাদের উপর গিয়ে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটি কাফেলা বাগদাদের দিকে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তাঁর মনেও বাগদাদ যাওযার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে পড়ল। তিনি ছাদ হতে দ্রুত নেমে এসে মায়ের কাছে বললেন, এলম হাসিল করার জন্য আমাকে বাগদাদে যাওয়ার অনুমতি দিন। সেখানে হয়ত শ্রেষ্ঠ আওলিয়ায়ে কেরামের সোহবত লাভ করে বাতেনী এলমও হাসিল করতে পারব।
তাঁর মাতা নিতান্ত বৃদ্ধা এবং দুর্বল ছিলেন। একমাত্র পুত্র আবদুল কাদির ছাড়া তাঁর দেখাশুনা করার আর কেহ ছিল না। তথাপি তিনি এলম হাসিল করার জন্য পুত্রকে বিদেশে যেতে অনুমতি দিলেন। তাঁর কাছে স্বামী প্রদত্ত আশিটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। তা হতে চল্লিশটি মুদ্রা তিনি পুত্রের পিনহানের বগলের নিচে সেলাই করে দিলেন, যেন কেহ তার সন্ধান না পায়।
অতঃপর তিনি প্রাণাধিক পুত্রকে আল্লাহ তায়ালার উপর সোপর্দ করে বললেন, বাবা ! কিয়ামত দিবসের পূর্বে হয়ত আর আমাদের পরস্পর সাক্ষাৎ হবে না। অতএব, বাবা ! আমার এই উপদেশটি স্মরণ রেখ, যে কোন অবস্থায় পতিত হও না কেন, কখনও মিথ্যা কথা বলো না। অর্থাৎ সত্যবাদিতা মুক্তিদান করে আর মিথ্যা ধ্বংস করে। আরও বলছি যে, কোন সময় তুমি কোন বিপদের সম্মুখীন হলে দোয়া পাঠ করিও।
তিনি মায়ের কদমবুসি করে গৃহ হতে বের হয়ে পড়লেন এবং পূর্বকথিত সেই কাফেলার সাথে মিলিত হলেন। পূর্ব হতেই হযরত গাুসে আযমের গুণ গরিমার কথা দেশময় ছড়ায়ে পড়েছিল, কাজেই কাফেলার লোকেরা তাঁকে চিনতে পারল। অতএব, তিনি কাফেলার সাথে শান্তিতে ও সসম্মানে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন খণ্ডিবার নয়।

ডাকাত দলের মুখোমুখি : তাঁরা হামদানের নিকটবর্তী হলে একদল ডাকাত এসে কাফেলার লোকজনকে লুটতরাজ আরম্ভ করল। ডাকাতেরা কাফেলার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিল। হযরত গাউসে আযম রাঃ এক পাশে দাঁড়ায়ে সবকিছু দেখতে লাগলৈন। দস্যুরা তাঁকে সাদাসিধা দেখে নিতান্ত নিঃস্ব মনে করল, কাজেই কেহ তাঁর প্রতি লক্ষ্য করল না। অবশেষে উগ্রমূর্তি একজন ডাকাত এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কাছে কি কোন টাকা-পয়সা আছে? তিনি বললেন, আমার কাছে চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা আছে। দস্যুরা তাকে উপহাস মনে করে তাঁকে নিজেদের সর্দারের কাছে নিয়ে গিয়ে তাকে তাঁর কথা জানাল। সর্দার তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি পূর্ববত সেই একই উত্তর প্রদান করলেন এবং এও বললেন যে, স্বর্ণগুলো তাঁর মাতা তাঁর পিরহানের বগলের নিচে সেলাই করে দিয়েছেন। এতে দস্যু সর্দার অত্যন্ত আশ্চার্যান্বিত হয়ে মুদ্রাগুলো জামার বগলের নিচ থেকে বের করা হলে সর্দারের বিস্ময়ের অবধি রইল না। সে হযরত গাউসে আযমকে এই স্বীকৃতির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বিদায় কালে আম্মা আমাকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করেছেন। তা শুনে দস্যু সর্দারের মনে এক অপূর্ব ভাবান্তরের উদয় হল। সে ভাবল, এই বালক নিজের মাতার আদেশ পালন করতে গিয়ে নিজের লুকায়িত ধন ডাকাতের হাতে তুলে দিল। আর আমি বিশ্বপালক আল্লাহ পাকের আদেশ অহরহ লঙ্ঘন করে চলেছি, আমার চেয়ে অধিক পাপিষ্ঠ আর কে আছে। হায় আমার পাপাচারের শাস্তি কতই না গুরুতর হবে। অনুশোচনায় সে অস্থির ও উন্মত্ত হয়ে উঠল এবং নিতান্ত বালকের মত চিৎকার করে কেঁদে উঠল। অবশেষে হযরত গাউসে পাকের হাতে তওবা করল। তার অনুসরণকারী দস্যুরা বলল, সর্দার ং এতদিন আমরা পাপ কার্যে তোমার অনুসরণ করে আসছি। আজ নেক কাজেও আরা তোমারই অনুসরণ করছি, এই বলে একে একে সকল দস্যুই হযরত গাউসে পাকের হাতে তওবা করল এবং উক্ত কাফেলার লোকদের ডেকে লুণ্ঠিত ধন স্ব স্ব মালিককে ফেরত দিল। অতঃপর আর কখনও দস্যুবৃত্তি করবে না ও ভবিষ্যৎ জীবনে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করে চলবে বলে হযরত গাউসে আযমের কাছে অঙ্গীকার করে।
এটাই ছিল হযরত গাউসে আযমের হাতে প্রথম তওবা। এই ঘটনা হতেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি জন্মগতভাবেই আল্লাহ তায়ালার প্রিয় অলি ছিলেন। কেননা, সত্যবাদিতা আল্লাহ তায়ালার প্রিয়পাত্র হওয়ার নিদর্শন। হুজুর সাঃ এর একটি হাদিসে একথা উল্লেখ রয়েছে। একাদ রাসূলে মাকবুল সাঃ অজু করতেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম রাঃ তাঁর ব্যবহৃদ পানি নিজেদের দেহে সানন্দে মাখতে লাগলেন, তা দেখে হুজুর পাক সাঃ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এরূপ করছো কেন? তাঁরা উত্তর করলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত লাভের আশায় আমরা এরূপ করছি। হুজুর সাঃ বললেন, যারা আল্লাহ, রাসূলের মহব্বত পেতে চায়, তাদের উচিত সত্য কথা বলা, আমানতদারীকে স্বীয় অভ্যাসে পরিণত করে নেয়া এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহার করা।
মহিউদ্দিন উপাধি : হযরত গাউসুল আযম বাগদাদ অভিমুখে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে একজন অতিশয় দুর্বল বৃদ্ধকে মুমূর্ষু অবস্থায় পতিত দেখতে পান। বৃদ্ধ কাতর স্বরে হযরত গাউসুল আযমকে ডেকে বলেেলন, হে পথিক আমি দুর্বল, অচল ও রুগ্ন, মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছি। আমাকে ধরে তুলে উদ্ধার করুন। হযরত গাউসে পাক রাঃ তাকে উঠায়ে বসালেন। তাঁর পরশ লাভ করেই লোকটি খুব সবল এবং নিরোগ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং অপূর্ব লাবণ্য লাভ করলেন। তা দেখে হযরত গাউসুল আযম রাঃ অতিশয় বিস্ময় বিমুগ্ধ হয়ে পড়লেন। তাঁর বিস্ময়ভাব দেখে সেই জ্যোতিস্মান পুরুষ তাঁকে বললেন, আমি সনাতন ইসলাম ধর্ম। বেদআৎ ও কুসংস্কারের প্রভাবে দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলাম। আপনার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমাকে পুনর্জীবিত ও সবল করে তুললেন। অতঃপর আপনি মহিউদ্দিন (ধর্মের জীবিতকারী) নামে আখ্যায়িত হবেন। শোনা যায়, অতঃপর তিনি জামে মসজিদে উপস্থিত হলে লোকে তাঁকে মহিউদ্দিন নামে সম্বোধন করতে আরম্ভ করে এবং তদবধি তিনি লোকসমাজে মহিউদ্দিন নামে পরিচিত হন।
ছাত্রাবস্থায় বাগদাদে : বাগদাদে পৌঁছেই তিনি তৎকালীন ইসলামী দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মাদ্রাসায়ে নিজামিয়াতে ভর্তি হন এবং তফসীর, হাদিস, ফেকাহ, দর্শন ও সাহিত্য শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। আব্বাসীয় খলিফাগণের অজস্র দানে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় এই মাদ্রাসাটি ছিল তৎকালে দ্বীনী এলমের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। ইসলামী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম এই মাদ্রাসায় একত্রিত হয়েছিলেন। এই শ্রেষ্ঠ ও বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরামের নিকট থেকে হযরত গাউসুল আযম রাঃ প্রত্যেক বিষয়ে প্রকৃত শিক্ষা লাভ করতে লাগলেন। স্বীয় তীক্ষ্ণ ও খোদা প্রদত্ত মেধাশক্তি গুণে অতি অল্প সময়ে তিনি দ্বীনি এলমের প্রত্যেক শাখায় অগাধ জ্ঞান অর্জন করলেন।
শিক্ষকগণের মধ্যে হযরত কাজী আবু সাঈদ মুবারক রাঃ হযরত গাউসুর আযমকে সমধিক স্নেহ করতেন এবং বলতেন, হে আবদুল কাদির ! দুনিয়ার খাস ও আম লোকেরা অতি সত্বর তোমার দিকে রুজু করবে এবং তোমার এলম ও আমল দ্বারা সমগ্র দুনিয়ার লোক উপকৃত হবে এবং ফয়েজ হাসিল করবে।
হযরত গাউসুল আযম তেরটি এলমে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। বিশেষ করে হাদিস শাস্ত্রের উচ্চতম উপাধি প্রদানকালে ওস্তাদ সাহেবান তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, যদিও আমরা তোমাকে হাদিসের সনদ প্রদান করছি। তা দেশাচার অনুযায়ী একটি প্রথা পালন করছি মাত্র। বাস্তবিকপক্ষে হাদিসের গূঢ়তত্ত্ব উদঘাটনে আমরাই তোমার দ্বারা উপকৃত হয়েছি। আরবি ভাষায় তাঁর এমন দক্ষতা লাভ হয়েছিল যে, তিনি অনায়াসে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষায় অতি সুন্দর কবিতা রচনা করতে পারতেন।
একমাত্র কিতাবী এলম হাসিল করাই তাঁর বাগদাদ গমনের উদ্দেশ্য ছিল না। শ্রেষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানী আউলিয়ায়ে কেরামের সোহবত লাভ করাও তাঁর অন্যতম মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল। কাজেই মাদ্রাসায় কিতাবী এলম হাসিল করার সাথে সাথে তিনি বাগদাদের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত আউলিয়ায়ে কেরামের সোহবতেও থাকতেন্ এই কারণে তাঁর জাহেরী এলমের সাথে রূহানী শক্তিরও উত্তরোত্তর উন্নতি হতেছিল। ফলতঃ জাহেরী এলমের সাথে রূহানী শক্তির সংযোগে তাঁর পবিত্র হৃদয় বেহেশতি নূরের আলোতে দিন দিন উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হতেছিল।
দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম : বাগদাদ যাত্রার কালে তাঁর মাতা যে চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা খরচরে জন্য দিয়েছিলেন তাই ছিল তাঁর একমাত্র সম্বল। বাড়ি হতে আর কোন সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা তাঁর ছিল না। সুতরাং শিক্ষার্থী অবস্থায় বাগদাদে তাঁকে কি কঠোর দারিদ্রের ও অভাবের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা বর্ণনা তীত। তিনি অভাবগ্রস্ত ছিলেন বলে অপর অভাবী ছাত্রকে নিঃসম্বল দেখলে তাঁর মন গলে যেত, কাজেই তাদের অভাব মোচনে নিজের অর্থ ব্যয় করে অল্পকালের মধ্যে তিনিও নিঃসম্বল হয়ে পড়লেন।
হযরত গাউসুল আযম নিজের অভাব অনটনের কথা কাহারও কাছে প্রকাশ করতেন না। অভাবের সময় কারও সাহায্য প্রার্থনা করাও তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। শিক্ষার্থী অবস্থায় বাগদাদে তাঁকে বহুদিন অর্ধাহারে ও অনাহারে কাটাতে হয়েছে। এরূপ সময়ে তিনি মাদ্রাসায় উস্তাদগণের কাছে সবক পড়ে শহর হতে জঙ্গলের দিকে, নদীর কূলের দিকে কিংবা মরুভূমির কোন অজ্ঞাত স্থানে চলে যেতেন। ক্ষুধার জ্বালা অসহ্য হয়ে উঠলে গাছের পাতা ফলমূল বা মাকশবজী খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতেন। উপর্যুপরি অনাহারে থেকে কোন কোন সময় তিনি অবসন্ন হয়ে পড়তেন। তথাপি তিনি বিদ্যা শিক্ষায়, রিয়াজতে ও ইবাদতে অটল থাকতেন। জ্ঞান পিপাসা এবং ইবাদতের আগ্রহ তাঁকে এমন তন্ময় করে রেখেছিল যে, কোন বিপদাপদই তাঁকে বিচলিত করতে পারত না।
গায়েবী সাহায্য : একবার তিনি উপর্যুপরি কয়েকদিন অনাহারে থেকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়লেন, কিন্তু কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুল করে রইলেন। এমন সময় তিনি হঠাৎ একটি গায়েবী আওয়াজ শুনলেন, কারও নিকট হতে ধার নিয়ে নিজের অভাব মোচন কর এবং ইবাদতে, এলম হাসিল করায় মনোনিবেশ কর। তিনি বললেন, কর্জ করলে আমি তা কেমন করে পরিশোধ করব? আবার গায়েবী আওয়াজ আসল, তুমি কর্জ নেও আমি তা পরিশোধ করব। তা শুনে তিনি এক রুটিওয়ারার দোকানে গিয়ে ধারে রুটি গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। কয়েকদিন পর তিনি গায়েবী ইঙ্গিতে কতকগুলো স্বর্ণমুদ্রা পেলেন এবং তা দ্বারা কর্জ পরিশোধ করে ফেললেন। এই ঘটনার পর হতে আল্লাহ তায়ালার প্রতি তাঁর তাওয়াক্কুল আরও দৃঢ় হল।
বাগদাদে দুর্ভিক্ষ : হযরত গাউসুল আযমের পাঠ্যাবস্থায় বাগদাদে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। অনাহারে বহুলোক প্রাণ ত্যাগ করতে লাগল। হযরত গাউসল আযম ক্ষুধার কষ্ট পূর্ব হতেই ভোগ করতে ছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় তা আরও প্রকট হয়ে পড়ল। জঙ্গলে গিয়ে যখন দেখতে পেলেন যে, আরও বহু লোক অনাহারক্লিষ্ট ঘাস পাতা সংগ্রহের জন্য গিয়েছে, তখন তিনি নীরবে সেখান থেকে ফিরে আসতেন। উপর্যুপরি অনাহারে থেকে একদা তিনি হযরত গাউসে পাক অবসন্ন হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় দজলা নদীর তীরে গমনপূর্বক দেখতে পেলেন তাঁর পূর্বেই বহুলোক সেখানে সমবেত হয়েছে। তা দেখে তিনি আবার বাগদাদে ফিরে আসলেন। খাদ্যের অন্বেষণে অন্য কোথাও যেতে তাঁর ইচ্ছে হল না। তিনি সোজাসুজি জামে মসজিদের দিকে চলে গেলেন, সেখানে গিযে তিনি দেখতে পেলেন, মসজিদের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গণে একব্যক্তি আহারে রত রয়েছে। লোকটি হডযরত গাউসে আযমকে তার সঙ্গে আহারে শরিক হওয়ার জন্য আহ্বাণ করল। তিনি অপর ক্ষুধাতুর ব্যক্তির আহারের অংশ গ্রহণ করা সমীচীন মনে করলেন না। তাকে ধন্যবাদ জানায়ে তার দাওয়াত কবুল করতে অসম্মতি জানালেন, কিন্তু লোকটির পুনঃ পুনঃ অনুরোধ এড়াতে না পেরে তিনি অবশেষে তার সাথে আহারে শরিক হলেন।
আহারে বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে লোকটি বুঝতে পারল যে, তিনিই হযরত আবদুল কাদির জিলানী রাঃ। তখন সে খুব সম্মানের সাথে আরজ করল, আমার বাগদাদ যাত্রাকালে আপনাকে দেওয়ার জন্য আপনার মাতা আমার কাছে আটটি দীনার দিয়েছিলেন। এখানে এসে কয়েকদিন যাবৎ আমি আপনাকে তালাশ করে আপনার কোন সন্ধান পাইনি। এই কয়দিনে আমার নিজের কাছে যা কিছু ছিল সব নিঃশেষ হয়ে গেছে। নিঃসম্বল অবস্থায় বিগত তিন দিন অনাহারে কাটায়েছি তথাপি আপনার অর্থ এক কপর্দকও ব্যয় করিনি। আজ ক্ষুধার কষ্ট অসহনীয় হয়ে পড়ায় জীবন ধারণোপযোগী কিছু রুটি আপনার অর্থে ক্রয় করেছি। সুতরাং বাহ্যত আপনি আমার মেহমান হলেও প্রকৃত পক্ষে আমিই আপনার মেহমান। এই নিন আপনার অবশিষ্ট অর্থ। তিনি তা গ্রহণ করলেন এবং পথ খরচ বাবত কিছু অর্থ তাকে দিলেন।
রিয়াজতের পথে : হযরত সাইয়্যেদ আবদুল কাদির জিলানী রাঃ তৎকালীন দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাগার নিজামিয়া মাদ্রাসা হতে সর্বোচ্চ সনদ লাভ করে রূহানী জ্ঞান লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। অজানাকে জানার জন্য তাঁর মন এত পাগল হয়ে উঠল যে, তিনি শহারের বাইরে প্রাচীন বিরান বাড়ি ঘরে গিয়ে চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন এবং কঠোর পরিশ্রম সহকারে ইবাদত করতেন। তাঁর খাওয়া পরা ও চলা-ফেরা নিতান্ত সাধারণ ছিল। তিনি খালি পায়ে চলতেন। মোটের উপর দুনিয়ার কোন প্রকারের ভোগ লালসাই তাঁকে কোন সময় স্পর্শ করতে পারেনি।
কুরআন শরীফ তেলাওয়াত, নামাজ এবং জিকির ছিল তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। তিনি প্রতি রাতে নফল নামাজে কুরআন শরীফ খতম করতেন। তাঁর এই ভাব বিভোরের সময় তিনি কারও সাথে মেলামেশা, সাক্ষাৎ কিংবা আলাপ আলোচনা করতেন না। কঠোর সাধনার দ্বারাই তিনি নিজের পার্থিব লোভ লালসাকে দমন করে রাখতেন। আল্লাহ তায়ালার ধ্যান কোন কোন সময় তাঁকে এমন বিহ্বল করে তুলত যে, তিনি নির্জন স্থানে বসে চিৎকার আরম্ভ করে দিতেন, কোন কোন সময় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন। লোকে তাঁকে মৃত মনে করে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করত, তখন তিনি সকলকে অবাক করে উঠে বসতেন।
দিনের পর দিন তিনি কঠোর হতে কঠোরতর পরিশ্রম সহকারে ইবাদত ও রিয়াজতে মনোনিবেশ করতে লাগলেন। বছরের পর বছল অতিবাহিত হতে লাগল, কিন্তু তাঁর শ্রম এবং সাধনার নিবৃতি নেই। তিনি লোকালয় ত্যাগ করে অবশেষে ইরাকের মরুভূমিতে, শহরের পোড়ো বাড়িতে এবং গভীর জঙ্গলে সাধনায় ও ধ্যানে মগ্ন থাকতে লাগলেন। লোকালয়ের সাথে তাঁর এসময়ে কোন সম্পর্ক ছিল না। এসমস্ত নির্জন স্থানে বহু জিন দীক্ষা গ্রহনের জন্য তাঁর কাছে আসত। সে সমস্ত জিনেরাই সেখানে তাঁর খেদমত করত, এইরূপে দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি লোকালয়ের বাইরে অতিবাহিত করেন।
এ সময়কার অবস্থা সম্বন্ধে তিনি স্বয়ং বলেন, ইরাকের মরু-প্রান্তরে ও বনে জঙ্গলে আমি দসুদীর্ঘ পঁচিশ বছর একাকী অহিবাহিত করেছি। দিবারাত্রির মধ্যে একমাত্র আল্লাহ পাকের জিকির ছাড়া আমার অন্য কোন কাজ ছিল না। বছরের পর বছর আমি এশার নামাজের অজু দ্বারা ফজরের নামাজ আদায় করেছি। অসংখ্য ও অগণিত রাত্র আমার উপর দিয়ে এই রূপে অনিদ্রায় কেটেছে যে, নিমিষের জন্যও আমি চক্ষু মুদিত করিনি। নিদ্রার প্রবল আক্রমণ হলে আমি এক পায়ের উপর দাঁড়ায়ে নফল নামাজে পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করতাম। এইরূপে বহু বছর পর্যন্ত আমি রাতে নফল নামাজে দাঁড়ায়ে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করেছি। একরাতে নিদ্রার আক্রমণ আমাকে বিরক্ত ও অতিষ্ঠ করে তুলল। আমার নফস বলল, একটু আরাম করে নেও, তৎপর নতুন উদ্যমে পুনরায় ইবাদতে লিপ্ত হও। কিন্তু নফসের প্ররোচনায় আমি কর্ণপাত করলাম না। আমি যথারীতি জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকলাম।
হযরত গাউসুল আযম রাঃ স্বয়ং বললেন, ক্রমশঃ আমি কঠোর রিয়াযত ও শ্রমবহুল ইবাদতের অভ্যাস করি। প্রথমে এক বছর কাল মাদায়েন শহরের জন বসতিহীন পুরাতন ভগ্নপ্রায় দালান কোঠায় নির্জনে বাস করেছি। এই মাদায়েন শহরটি বর্তমান বাগদাদ হতে পনের মাইল দূরে অবস্থিত অতি প্রাচীন সমৃদ্ধ নগর। পারস্যের জগত বিখ্যাত প্রবল প্রতাপ রাজাদের এটাই ছিল রাজধানী। এই মনোহর নগরটি তাঁদের নির্মিত বহু সুন্দর ও জাকজমকপূর্ণ অট্টালিকায় সজ্জিত ছিল। এই নগর হতে বহু মূল্যবান মাল মসলা সংগ্রহ করেই খলিফা আল মানসুর বর্তমান বাগদাদ শহরের পত্তন ও শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেন। এই সময় বন জঙ্গল হতে জায়েজ ও মোবাহ ফলমূল সংগ্রহ করে আহার করতাম। দিবা-রাত্রির মধ্যে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত এবং ধ্যানই ছিল আমার একমাত্র কাজ। রাতে নিদ্রার আক্রমণ হতে মুক্ত থাকার জন্য কোন সময় তীব্র ও কনকনে শীতের মধ্যে সারা রাত আমি মুক্ত আসমানের নিচে ছাদের উপর নামাজে কাটায়ে দিতাম। অবশ্য তীব্র শীতের মধ্যে তা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল।
হযরত গাউসে পাক স্বয়ং বলেন, আমি কারখের জনহীন ময়দানে কয়েক বছর অতিবাহিত করেছি। সেখানে শুধু গাছের খেজুর খেয়ে আমি জীবন ধারণ করতাম। আমার পোষাক ছিল মাত্র একটি পশমি জুব্বা। আমি খালি পায়ে কণ্টকময় প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম, তাতে আমার পায়ের তালু ছালুনির মত শত ছিদ্র যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তা ছিল আমার পূর্ণ যৌবনের যুগ। এই যুগেই বহুলোক নাফসানী খায়েশের প্রভাবে বিপথগামী হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি আমার যাবতীয় খায়েশের উপর বিজয়ী ছিলাম। সুস্বাদু খাধ্য আহার, সুপেয় পানি পান, সুন্দর পোশাক পরিধান এবং উত্তম গৃহে বসবাস এসমস্তের কোন কিছুরই খায়েশ কোন সময় আমার অন্তরে স্থান পায়নি। আর পার্থিব ভোগ বিলাস, মান সম্মান এবং প্রভুত্বের মোহেও আমার মনকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি। আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আগ্রহ ও উৎসাহ শুধু একটি দিকে নিবদ্ধ ছিল। আমার সত্তার প্রত্যেকটি বাসনা শুধু একই দিকে আকৃষ্ট ছিল। আমার চিন্তাধারা ও কল্পনা একমাত্র মহান সত্তা ব্যতীত অন্য কোন দিকেই যেত না। সেই সত্তা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা। এইরূপে আমার সমগ্র দেহ মন যাতে তাঁর মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকে, মহান স্রষ্টা আল্লাহ পাক এবং তাঁর জিকিরের নেশা ও আনন্দে যেন আমি বিভোর হয়ে থাকি- এটাই ছিল আমার একমাত্র বাসনা। পরবর্তী জীবনে আমার সেই বাসনা পূর্ণ হয়েছিল। তোহফায়ে কাদেরিয়া ও আখবারুল আখয়ার।
হযরত গাউসুল আযম রাঃ তাঁর এই সময়ের অবস্থাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ দান করেছেন-
সাধনা ও রিয়াজতের প্রথমাবস্থায় শয়তান নানারূপ প্রলোছন দ্বারা আমাকে বিভ্রান্ত করার নানা প্রকার চেষ্টা চালাতে লাগল। আমি অতিশয় দৃঢ়তার সাথে তাকে পরাস্ত করে দিয়েছি। সে আমার সামনে অসংখ্য প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত জাল বিস্তার করে। এক বছরের কঠিন রিয়াজতে আমি তার সমস্ত জাল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম। আর এক বছরের মুজাহাদার দ্বারা পার্থিব যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ওনির্মল হয়ে গেলাম।
অতঃপর আমার অন্তরে কামনা ও বাসনার নানাবিধ অবস্থার উদ্ভব হজতে লাগল। তৃতীয় বছরের কঠোর রিয়াজতের ফলে সে সমস্ত কামনা-বাসনাকেও আমি অন্তর হতে উৎখাত করে ফেললাম। অবশেষে মানব সুলভ কুপ্রবৃত্তি জানি রোগসমূহ আমার মধ্যে প্রকাশ পেতে লাগল। তা ভোগ বিলাসের লালসা। চতুর্থ বছরের মুজাহাদার ফলে এই ব্যাধিগুলো হতেও মুক্তি লাভ করলাম। পরিশেষে শয়তান আমার বশ্যতা স্বীকার করল। এই পর্যায়ে উন্নীত হয়ে আমার যাবতীয় কার্যকলাপ একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে হতে লাগল।
অতঃপর আসল তাওয়াক্কুলের পালা। এই সোপানে এসে আমি অসংখ্য বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হলাম। কিন্তু দৃঢ় কৃচ্ছ্র সাধনার দ্বারা এসমস্ত বাধা-বিঘ্ন আমি অতিক্রম করলাম। অতঃপর আমি শোকরের পর্যায়ে উপনীত হলাম। এখানেও আমি বহু বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হলাম। আল্লাহ পাকের অপার করুণা বলে দৃঢ়তার সাথে আমি তাও অতিক্রম করলাম। অতঃপর আমি জোহদ অর্থাৎ, সংসার বৈরাগ্যের স্তরে পৌঁছলাম। এই পর্যায়েও আমি বহু বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হলাম।
অনন্তর ক্রমশঃ মহান আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য লাভের পথের বাধাবিঘ্নসমূহও দূর করে তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। এই পর্যায়েও আমি বহু বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে তাঁর মিলন লাভ করলাম। অতঃপর ফকিরীর দ্বারে উপনীত হয়ে দেখলাম, এখানে এখন আর কোন বাধা-বিঘ্ন নেই। অনায়াসে এই দ্বারে প্রবেশ করা যায়। প্রবেশ করে দেখলাম, স্থানটি অতি চমৎকার, অতি মনোরম, এখানেই সকল শান্তি বিরাজমান। চলার পথে অন্যান্য স্থানে আমি শান্তিময় যা কিছু পরিত্যাগ করে এসেছিলাম সব কিছুই এখানে বিদ্যমান। এখানে আমি লাভ করলাম শ্রেওষ্ঠতম মর্যাদা, যাবতীয় বাসনার বিলুপ্তি এবং পূর্ণ স্বাধীনতা। দূর হয়ে গেল আমার মানব সুলভ যাবতীয় স্বভাব। আমি যেন এব নতুন বস্তু লাভ করলাম।
হযরত শায়খ আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে আবুল ফাতাহ নাহরাভী রাঃ বলেন, আমি চল্লিশ বছর হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর খেদমতে অবস্তান করি। তিন রাতের প্রথমভাগ নামাজে অতিবাহিত করতেন, দ্বিতীয় অংশ আল্লাহ পাকের জিকির ফিকিরে কাটাতেন, তৃতীয় ভাগে এক পায়ে দাঁড়ায়ে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করতেন। অতঃপর এক দীর্ঘ সেজদায় পতিত হয়ে সেজদার স্থানে ললাট ঘর্ঘণ করতেন এবং অতিশয় কাকুতি মিনতি সহকারে আল্লাহ পাকের সদবারে মুনাজাত করতেন। সকাল বেলা তাঁর পবিত্র মুখ-মণ্ডলখানি এক অপূর্ব নূরানী আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠত, তার প্রতি দৃষ্টি পড়লে দর্শকের চক্ষু ঝলসে যেত।
তরিকতের সিলসিলা : হযরত গাউসুল আযম রাঃ সর্বপ্রথম তৎকালীন শ্রেষ্ঠ অলি হযরত শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী রাঃ এর হাতে বায়াত হন। হযরত গাউসুল আযম রাঃ তখন শরিয়াতে সর্বপ্রকার এলমে অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয় ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, সসীমকে নিয়ে শান্ত থাকা যায় না। ওদিকে অসীমের পথ অতি সূক্ষ এবং বিপদসঙ্কুল। অতএব, কেবল জাহেরী এলমের অগাধ জ্ঞান থাকলেই এপথে নিরাপদে চলা যায় না। চিকিৎসা শাস্ত্রে যেমন কেবল পুঁথিগত বিদ্যা যথেষ্ট হয় বরং কোন সুনিপুণ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে জ্ঞানকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার নিয়ম কানুন শিক্ষা করতে হয়। তরিকতপন্থীকেও তদ্রুপ অগাধ ধর্মীয় জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও অভিজ্ঞ পীরের তত্ত্বাবধানে ও সংসর্গে থেকে সাধনার পথ চিনে নিতেহয়। অন্যথায় চলার পথে বিপদের আশঙ্কা থাকে। বিশেষতঃ একাকী পথ চললে পথভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও আছে, তাই এত বড় অদ্বিতীয় আলেম হয়েও তিনি পীরের আবশ্যকতা অনুভব করলেন। অবশেষে তৎকালে জগৎবরেণ্য অলি হযরত শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী রাঃ এর মুরিদ হলেন। তিনি ছিলেন হযরত শায়খ আবুল হাসান আলি রাঃ এর খলিফা। এইরূপে ক্রমাগত হযরত আবুল ফারাহ তারতুষী রাঃ, হযরত আবুল ফাযল রাঃ, হযরত আবুল কাসেম রা, হযরত আবু বকর শিবলী রা, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রা, হযরত সাররী শাকতী রাঃ, হযরত মারূফ কারখী রাঃ, হযরতত খাজা হাসান বসরী রাঃ এবং হযরত সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাজা রাঃ এর খেলাফতের মাধ্যমে তাঁর রূহানী তালিমের সম্পর্ক হযরত সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুন্নাবিয়্যীন মুহাম্মদ সাঃ এর সাথে যুক্ত হয়। হযরত আবু সাঈদ মাখযুমী রাঃ গাউসুল আজমের অতুলনীয় প্রতিবার সন্ধান পেয়ে অতিশয় আগ্রহ এবং মনোযোগের সাথে তাঁকে তালিম দিতে লাগলেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি রূহানী এলমের শীর্ষস্থানীয় হয়ে উঠলেন।

শিক্ষকতা : সে সময়ে মুতাযেলা ও বেদাতী সম্প্রদায়ের সৃষ্ট নানাপ্রকারের কুসংস্কারে দেশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। দুনিয়াদার আলেমগণ ইসলামের সনাতন ন্যায় নীতিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামের বিকল ও বিকৃত করে রেখেছিল। এমন সময়ে হযরত গাউসুল আযম রাঃ জাহেরী ও বাতেনী এলমে পূর্ণতা লাভ করে মৃতপ্রায় ইসলামকে সজীব করে তোলার জন্য আল্লাহ পাকের ইঙ্গিতে পুনরায় বাগদাদে আভির্ভূত হলেন।
হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর পীর হযরত শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী রাঃ একজন জগতশ্রেষ্ঠ আলেম ও কামেল অলি ছিলেন। তিনি বাগদাদে এসে পৌঁছলে হযরত আবু সাঈদ রাঃ নিতান্ত আগ্রহ সহকারে তাঁর মাদ্রাসার শিক্ষকতা ও পরিচালনার ভার হযরত গাউসুল আযমের হাতে অর্পণ করলেন। হযরত গাউসুল আযমও ইসলামের খেদমতরে জন্য প্রথমে এই পথে চলাই সমীচীন মনে করলেন।
তিনি নিতান্ত দক্ষতা ও মনোযোগের সাথে মাদ্রাসা পরিচালনা করতে লাগলেন। পুরাতন শিক্ষা পদ্ধতির কিছুটা পবির্তন করে তিনি এক নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। অল্পদিনের মধ্যে তাঁর সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়ায়ে পড়ল। ফলে শুধু বাগদাদেরই নয়, বরং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ হতে তালেবে এলমগণ তাদের জ্ঞান পিপাসা মিটাটে তাঁর মাদ্রাসায় এসে সমবেত হতে লাগল। হযরত গাউসে পাক রাঃ তেরটি বিষয়ে শিক্ষ দান করতেন, সকাল বেলা তাফসীর, হাদিস, সাহিত্য, উসূল, ক্কাওয়ায়েদ, ধর্ম এবং শিষ্টাচার ও আচার ব্যবহার শিক্ষা দিতেন। জোহরের নামাজের পর তিনি কুরআন শরীফের তরজমা, তাওহীদ ও অন্যান্য বিষয়ের মাসয়ালা বর্ণনা করতেন। প্রথমে তিনি শাফেয়ী মাজহাব অবলম্বী ছিলেন। পরে হযরত ইমাম আহমদ আবনে হাম্বাল রাঃ এর মতের পোষকতা করেন। ছাত্র সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে পুরাতন মাদ্রাসা গৃহটি অপরিসর থাকায় স্থান সংকুলান হতেছিল না। মাদ্রাসার মাঠে নিকটবর্তী ঘরসমূহের ছাদে এমনকি সড়কের উপরও ছাত্ররা হরত গাউসুল আযমের শিক্ষা মজলিসে যোগদান করতে লাগল। এই অবস্থা দেখে হযরত গাউসুল আযম রাঃ মাদ্রসা গৃহটি সম্প্রসারণের জন্য জনসাধারণের সাহায্য চাইলেন। জনসাধারণ নিতান্ত আগ্রহের সাথে প্রচুর অর্থ দান করল, দিন মজুরগণ অনেকে বিনা মজুরিতে, কেহ কেহ অর্ধ মজুরিতে মাদ্রাসার কাজ করতে স্বীকৃত হল।
এই প্রসঙ্গে এক দরিদ্র রাজমিস্ত্রীর স্ত্রীর একটি ঘটনা  উল্লেখ করা যাচ্ছে, স্ত্রীলোকটি তার স্বামীকে নিয়ে হরত গাউসল আযমের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করল- এই ব্যক্তি আমার স্বামী। মোহরানা বাবদ আমি তার কাছে বিশটি স্বর্ণমুদ্রা পাওনা আছি। তার দাবি আমি এই শর্তে ত্যাগ করছি যে, তিনি মজুরি গ্রহণ না করে খুব মনোযোগের সাথে আপনার মাদ্রাসা নির্মাণের কাজ করবেন। এই চুক্তি গ্রহণের শর্তে আমি তাকে আমার প্রাপ্য মোহরানা মাফ করে দিলাম।
রাজমিস্ত্রী উক্ত শর্ত স্বীকার করলে তার স্ত্রী মোহরানার একটি প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ লিখে হযরত গাউসুল আযমের হাতে দিয়ে আরজ করলেন, আমার মোহরানার অর্থের পরিমাণ কাজ হয়ে গেলে এই রশিদটি আমার স্বামীকে দিবেন।
রাজমিস্ত্রী মাদ্রাসা নির্মাণের কাজ আরম্ভ করল। হযরত গাউসুল আযম রাঃ নিতান্ত দয়ালু ছিলেন। তিনি রাজমিস্ত্রীকে এক দিনের মজুরি দিয়ে দিতেন এবং পরবর্তী দিনের মজুরি দিতেন না। এইরূপে স্ত্রীলোকটির প্রাপ্য অর্থের অর্ধেক পরিমাণ কাজ হয়ে গেলে তিনি উক্ত রশিদটি রাজমিস্ত্রীকে দিয়ে দিলেন এবং বাকী অর্ধেক পরিমাণ কাজ হয়ে গেলে তিনি উক্ত রশিদটি রাজমিস্ত্রীকে দিয়ে দিলেন এবং বাকী অর্ধেক তাকে মাফ করে দিলেন। তৎপর হতে তাকে পূর্ণ মজুরি দিতে লাগলেন।
৫২৮ হিজরিতে এই বিরাট মাদ্রাসাগৃহটির কাজ সমাপ্ত হল। হযরত গাউসুল আযমের পবিত্র নামানুসারে অবশেষে মাদ্রাসাটি মাদ্রাসায়ে কাদেরিয়াহ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ল। এই মুবারক মাদ্রাসায় শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সহস্র সহস্র তালেবে এলম বিখ্যাত আলেম, ফাযেল ও কামেল হয়েছিলেন।
পোষাক পরিচ্ছদ : হযরত গাউসুল আযম রাঃ আড়ম্বরপূর্ণ উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। কিন্তু শরীয়ত বিরুদ্ধ পোশাক কখনও তিনি ব্যবহার করেননি। তৎকালীন আলেমগণ যেরূপ পোশাক পরিতেন, তিনিও সেরূপ পোশাকই পরিতেন, পার্থক্য শুধু এই টুকু ছিল যে, তিনি বাজারের সর্বোচ্চ মূল্যের কাপড় ব্যবহার করতেন।
বাগদাদের বিখ্যাত কাপড় বিক্রেতা শায়খ আবুল ফজল বলেন, একদা হযরত গাউসুল আযমের খাদেম আমার দোকানে এসে তাঁর জন্য প্রতি গজ এক দীনার মূল্যের কাপড় ক্রয় করতে চাইলে আমি মনে মনে ভাবলাম- ফকীর দরবেশগণ এমন দামী কাপড় ব্যবহার করলে রাজা বাদশাহগণ কিরূপ কাপড় পরিধান করবেন? যা হোক, খাদেমকে এক দীনার গজ মূল্যের কাপড় দিয়ে আমি হযরত শেখের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তিনি কাশফের দ্বারা আমার হাব-ভাব বুঝতে পেরে আমাকে বললেন, হে আবুল ফযল ! আল্লাহর শপথ ! আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং আমাকে যা আদেশ করেন আমি তাই পালন করে থাকি। তোমার দোকান হতে আমার জন্য যে কাপড় আনা হয়েছে সে সম্পর্কে আমি আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি, হে আবদুল কাদির ! তোমার প্রতি আমার যে হক য়েছে তার শপথ দিয়ে বলছি, তুমি এমন কাপড়ের একটি জামা পরিধান কর যার প্রতি গজের মূল্য এক দীনার। তিনি আরও বললেন, হে আবুল ফযল ! এটা পোষাক নয় বরং মৃত ব্যক্তির কাফন। দরবেশ সাধনার ক্ষেত্রে সহস্রবার মৃত্যুবরণ করলে তাকে একটি কাফন দান করা হয়।
হাদিয়া : হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর কাছে সর্বদা অসংখ্য হাদিয়া আসত। তিনি তা স্পর্শও করতেন না, অনেকে টাকা পয়সা এনে তাঁর বিছানার নিচে রেখে যেত। তিনি সম্পূর্ণই দান করে ফেলতে আদেশ করতেন। বাদশাহ বা আমীর ওমারাদের কখনও তিনি সম্মানের চক্ষে দেখতেন না। বাদশাহ কোন তাদিয়া নিয়ে তাঁর দরবারে আসলে তিনি তা স্পর্শ ও করতেন না, তৎক্ষণাৎ মুসাফির ও মুরিদানের জন্য খরিদকৃত রুটির মূল্য স্বরূপ রুটিওয়ালাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য আদেশ করতেন।
হযরত গাউসে পাকের জন্য চারটি রুটি তৈরী করা হত। খাওয়ার সময় হলে তিনি নিজের হাতে তা ছিঁড়ে টুকরা করতেন এবং উপস্থিত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। সামান্য যা কিছু অবশিষ্ট থাকত তাই তিনি আহার করতেন। যারা হাদিয়া তোহফা নিয়ে আসত, তিনি নিজ হতে তাদেরও কিছু হাদিয়া প্রদান করতে। হযরত রাসূলে মাকবুল সাঃ এরও এই সুন্নত ছিল। এসম্পর্কে হুজুর সাঃ বলেছেন, তোমাদের কেহ কোন হাদিয়া প্রদান করলে তোমরা তাকে তারে চয়ে উত্তম প্রতিদান দিতে চেষ্টা কর, তাতে পরস্পরের মধ্যে মহব্বত বৃদ্ধি পায়।
একদিন বাগদাদের খলিফা মানসুরের পুত্র ইউসুফ এক থলি স্বর্ণমুদ্রা উজিরের মারফতে হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর দরবারে প্রেরণ করলে তিি তা গ্রহণ করলেন না। কিন্তু উজিরের বার বার অনুরোধে অবশেষে তিনি থলিটি হাতে নিয়ে দুই হাতে মর্দন করতেই দেখা গেল, অল্প কয়েকটি মুদ্রা ব্যতীত সবগুলোই গলে তা হতে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। এই বিস্ময়ের সংবাদ পেয়ে খলিফা তৎক্ষণাৎ হযরত গাউসুল আযমের দরবারে উপস্থিত হলেন। খলিফাকে লক্ষ্য করে হযরত গাউসুল আযম বললেন,  নিঃসহায় ইয়াতিম বালকদের উপর অত্যাচার করে তাদের তাজা রক্তরূপ এই মুদ্রা সঞ্চয় করেছো। সেই রক্তই তা হতে ঝরে পড়বে। খলিফা এই আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হয়ে নিজগৃহে ফিরে গেলেন।
জনগণের শিক্ষক : হযরত গাউসুল আযম রাঃ জাহেরী ও বাতেনী এলমে পরিপূর্ণতা লাভের পর স্বীয় জন্মভূমি জিলানে প্রত্যাগমন করতে সংকল্প করলেন। কিন্তু বাগদাদবাসীগণ তাঁকে বিদায় দিতে চাইল না। আল্লাহ পাকেরও ইচ্ছা তা হহে, হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর জননী অনেক পূর্বেই ইন্তেকাল করেছিলেন।  অতঃপর স্বদেশের প্রতি তাঁর এমন কোন আকর্ষণও ছিল না। কাজেই বাগদাদে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁর জ্ঞান গরিমার কথা অল্পকাল মধ্যেই সারা বিশ্বে ছড়ায়ে পড়ল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে শিক্ষার্থীরা দলে দলে বাগদাদে তাঁর মাদ্রাসায় এসে বিদ্যা করতে লাগল। এমতাবস্থায় বাগদাদের বিরাট কর্মক্ষেত্র পরিত্যাগ করা তিনি সমীচীন মরে করলেন না।
রূহানী এবং ধর্মীয় শিক্ষা বিষয়ে জটিল প্রশ্নের মীমাংসার জন্য এবং সসিহত গ্রহণের উদ্দেশ্যেপ্রথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে দলে দলে লোক তাঁর মজলিশে আসত। তিনি তাদের শুধু সওয়ালের জবাব দান করতেন। তাতে তারা তৃপ্ত হত না, ফলে আরও নসিহত শুনার জন্য মন অধীর হয়ে থাকত।
হুজুরে পাক সাঃ এর দর্শন লাভ : হযরত গাউসুল আযম রাঃ  ইবাদত, রিয়াজ, ও শ্রমসাধনার কষ্ট সহন এবং প্রান্তরে ও জঙ্গলে ও ভ্রমণের সঙ্গহীন অবস্থায় এবং শিক্ষাদান কাজে এক দীর্ঘকাল অতীত হয়ে গেলে অকস্মাৎ ৫২১ হিজরির ১৬ই শাউয়াল মঙ্গলবার হুজুর আকরাম সাঃ কে স্বপ্নে দেখেন। হুজুর পাক সাঃ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, লোক সমাজে কথা বল না কেন? হযরত গাউসে পাক আরজ করলেন, দাদাজান আমি আরবের বাইরের বাসিন্দা, আরবের বিখ্যাত ভাষাবিদগণের সামনে কেমন করে মুখ খুলতে পারি? হুজুর সাঃ বললেন, আচ্ছা ! মুখ খোল। তিনি হাঁ করলেন, হুজুর সাঃ নিম্নের এই দোয়াটি সাতবার পড়ে তাঁর মুখের মধ্যে ফুঁ দিলেন, ‘আল্লাহর বান্দগণকে তোমার প্রভু আল্লাহ পাকের পথের দিকে হেকমত ও ভাল উপদেশের সাথে ডাক। সেইদিনই তিনি জোহরের নামাজের পর মসজিদের মিম্বরে বসে উপদেশমূলক কয়েকটি কথা বললেন। তা শুনে শ্রোতাবর্গের মধ্যে এক প্রকার ভাবাবেগ ও আত্মবিলুপ্তির অবস্থার উদ্ভব হয়ে গেল। এর পর হতে সমগ্র বাগদাদ শহরে তাঁর ওয়াজের ধুম পড়ে গেল।
হুজুর সাঃ এর আদেশ পেয়ে সেদিন হতে তিনি হুজুরের আদেশ পালনে ব্রতী হলেন। বাগদাদের খলিফাগণের বিলাস-ব্যাসন ও আরাম প্রিয়তা এবং প্রজা পালনে শিথিলতা জনসাধারনের সাথে তাঁদের যোগসম্পর্ক এক প্রকার ছিন্নই করে দিয়েছিল। ফলে সুধারণ মুসলমানগণ ধর্শের প্রতি উদাসীন হয়েপড়েছিল। এদিকে বেদআতীদের ও  মুতাযেলাদের ফেৎনা ফাসাদ, ওদিকে ধনী শ্রেণীর পরম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং গরিব শ্রেণীর অনাহারক্লিষ্ট জীবন হযরত গাউসুল আযমের কোমল প্রাণে দারুণভাবে আঘাত করল। তিনি আল্লাহ পাকের ভরসা করে তেজোদীপ্ত ও সংস্কারমূলক সংকল্প নিয়ে এসমস্ত বিভেদ ও কুসংস্কারের মূলে আঘাত হানতে লাগলেন। তাঁর স্পষ্টবাদিতার জন্য প্রথম প্রথম তাঁকে অসীম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ পাকের প্রতি তাঁর অটল নির্ভরতা এবং অতুলনীয় ধৈর্যগুণে তিনি সকল দুঃখ-কষ্ট এবং বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে যেতে লাগলেন। তিনি সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ষোঘণা করলেন। প্রতিটি মানুষের কাছে আল্লাহ পাকের সুমহান বাণী পৌঁছায়ে দিবার যে কঠোর দয়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল অদম্য উৎসাহ এবং অসীম সাহসিকতার সাথে তিনি তা সম্পন্ন করতে লাগলেন।
প্রথম প্রথম তাঁর ওয়াজের মজলিসে লোক সমাগম বেশি হত না। কিন্তু তাঁর তেজোদৃপ্ত কণ্ঠস্বর, মনোহর বর্ণনাভঙ্গী, অকাট্য যুক্তি, সুস্পষ্ট অভিমত এবং সারগর্ভ বক্তৃতার খ্যাতি অচিরেই সমস্ত দুনিয়ায় ছড়ায়ে পড়ল। ফলে ক্রমেই তাঁর মুবারক মজলিসে জনসমাবেশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। এমনকি, তাঁর ওয়াজ শ্রবণের জন্য দেশ বিদেশ হতে বছাধভাঙ্গা স্রোতের মত অসংখ্য মানুষের সমাগম হতে লাগল। প্রথমে তাঁর ওয়াজের মসলিস বসত মসজিদে, শ্রোতা মণ্ডলীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার ভিত্তিতে, পরে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে এবং রাজ পথের উপর মজলিস হতে লাগল। এতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় শহরের প্রধান ঈদগাহে তিনি ওয়াজ করতে লাগলেন। বিদেশী লোকের জন্য ঈদগাহের পার্শ্বে একটি বিরাট মুসাফিরখানাও নির্মিত হল।
তিনি সপ্তাহে তিন দিন ওয়াজ করতেন। শুক্রবার জুমআর পরে মসজিদের প্রাঙ্গনে, শনিবার রাতে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে এবং বুধবার ভোর বেলায় সর্বসাধারণের ঈদগাহের ময়দানে। খলিফা হতে আরম্ভ করে কুলি মজুর পর্যন্ত সকল শ্রেণীর মানুষ তঁর মজলিসে উপস্থিত থাকত। জ্ঞানী-গুণী, আলেম ফাযের, সূফী দরবেশ এমনকি ইহুদি, খৃষ্টান, কাফের মুশরিকগণও তাঁর মজলিসে অতি আগ্রহের সাথে যোগদান করত। ছোট ও ধনী দরিদ্রের আসন বসনে কোন পার্থক্য ছিল না, যে যেখানে পারত বসে যেত। মানুষ ছাড়া জ্বিন এবং ফেরেশাগণও তাঁর মজলিসে হাজির থাকত। কোন কোন রেওয়ায়েতে দেখা যায়, সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের রূহ তাঁর ওয়াজের মজলিসে অংশ গ্রহণ করে মজলিসকে গৌরবান্বিত করত। এমনকি তাঁর তালিম ও সমর্থনের জন্য স্বয়ং হুজুর পাক সাঃ এর রূহও তাঁর মজলিসে এসে তাকে অধিকতর মহিমাময় করে তুলত।
শ্রোতা আমীর ওমারাই হোক আর রাজা বাদশাই হোক, হযরত গাউসে পাক রাঃ কাউকে পরোয়া করে কথা বলতেন না। তাঁর সংগ্রাম ছিল সর্ব প্রকার কুসংস্কার, অনাচার, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কাজেই তিনি নির্ভীক ও স্পষ্ট ভাষায় সকলকে উপদেশ দান করতেন। তিনি ওয়াজের সময় সাধারণ শ্রোতামণ্ডলীকে ইয়া কাওম ! হে আমার সম্প্রদায় ! এবং নিজের খাস মুরিদগণকে ইয়া গোলাম ! হে বৎস ! বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর ওয়াজের প্রভাব এইরূপ ছিল যে, তাঁর জ্ঞানগর্ভ নসিহতপূর্ণ এবং প্রেমময় ওয়াজ শ্রবণ করে কেহ কেহ মূর্ছিত হয়ে পড়ত, কেহ বা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে নিশ্চল হয়ে যেত। কেহ বা ভাবাবেগে উন্মত্ত হয়ে পরিধানের বস্ত্র ছিঁড়তে ছিঁড়তে এবং বক্ষে কারাঘাত করতে করতে বিলাপ আরম্ভ করে দিত। কেহ বা মূর্ছিত হয়ে ভূমিতে লুটায়ে পড়ত এবং সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হয়ে যেত। সভাভঙ্গের এর এশকের তলোয়ারে নিহত এই ভাগ্যবানদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা হত।
হিজরি ৫২১ সাল হতে আরম্ভ করে হিজরি ৫৬১ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর তিনি এইরূপে ওয়াজ নসিহত এবং শিক্ষা-দীক্ষার কাজে মশগুল ছিলেন। তাঁর মজলিশে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ হত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, নিকটবর্তী দূরবর্তী সকলেই তাঁর কণ্ঠস্বর সমানভাবে শুনতে পেত, এটাও তাঁর একটি কারামত।
হযরত গাউসে পাকের ভক্ত হযরত আদী ইবনে মুসাফির রাঃ বাগদাদ হতে সহস্র মাইল দূরে অবস্থান করতেন। সব সময় তিনি নির্দিষ্ট সময়ে নিজের মুরিদানসহ নিকটস্থ এক পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে নিজের লাঠি দিয়ে একটি বৃত্ত আঁকতেন। অতঃপর সকলকে নিয়ে সেই বৃত্ত সীমার ভিতরে বসে হযরত গাউসে পাকের ওয়াজ স্পষ্টরূপে শুনতে পেতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে রাখতেন। হযরত গাউসে পাকের মজলিশে যাঁরা তাঁর ওয়াজ লিপিবদ্ধ করতেন তাঁদের লেখার সাথে হযরত আদী ইবনে মুসাফির রাঃ এর লেখা সম্পূর্ণরূপে মিলে যেত। বাগদাদে তাঁর ওয়াজের মজলিশে চারশত লেখক উপস্থিত থাকতেন। মজলিশ খতম হওয়ার পর এসমস্ত লিপি মিলায়ে সেখানে যদি কিছু গরমিল হত, হযরত গাউসে পাক স্বয়ং তা সংশোধন করে দিতেন।
ব্যক্তিত্বের প্রভাব : হাদিস, তফসীর ও ফেকাহ প্রভৃতি দ্বীনি এলমে বিভিন্ন দেশ হতে অগাধ জ্ঞান লাভ করে হযরত গাউসে পাকের পুত্র হযরত আবু আবদুল্লাহ আবদুল ওয়াহাব রাঃ গৃহে ফিরে আসলেন। যথারীতি নির্দিষ্ট সময়ে আযরত গাউসে পাকের ওয়াজ শুনবার জন্য মজলিশে অসংখ্য লোক জড় হয়ে গাউসে পাকের আগমনের প্রতীক্ষা করছে। এমন সময় হযরত গাউসে পাক পুত্র সহ মজলিশে উপস্থিত হলেন। হযরত আবদুল ওয়াহাব রাঃ পিতার অনুমতি নিয়ে মিম্বরে আরোহণ করলেন এবং সারগর্ভ পূর্ণ ওয়াজ করলেন। কিন্তু তাঁর ওয়াজ শ্রোতাবর্গের মানে কোনই ক্রিয়া করছে না দেখে তিনি মিম্বর হতে নেমে আসলেন। হযরত আবদুল ওয়াহাব রাঃ হতে বর্ণিত আছে যে, অতঃপর হযরত গাউসে পাক রাঃ মিম্বরে আরোহণ করে বলতে লাগলেন, গতকল্য আমি রোজা রেখেছিলাম। উম্মে ইয়াহইয়া একটি ডিম রান্না করে পাতিলসহ তাকের উপর রেখে দিয়েছিল। একটি বিড়াল এসে পাতিলটিকে নিচে লেফে ভেঙ্গে ফেললে ডিমটি মাটিতে পড়ে ধুলামাটি বিজড়িত হয়ে গেল। হযরত গাউসে পাক এই পর্যন্ত বলতেই মজলিশে হা হুতাশ ও কান্নার রোল পড়ে গেল।
সভাশেষে হযরত গাউসে পাক রাঃ তাঁর পুত্রকে নির্জনে বসায়ে বললেন, বৎস ! বলতে পার কি? তোমার এমন জ্ঞানগর্ভ ওয়াজ শ্রোতাদের মনে কোন ক্রিয়া করল না কেন? এবং আমার সাধারণ কয়েকটি কথা তাদের মনে এমন আলোড়ন সৃষ্টি করল কেন? তার কারণ এই যে, তুমি তোমার এলমের জন্য গর্বিত। রূহানী জগতে এখনও প্রবেশ করনি। আমি যখন কথা বলি, তখন আল্লাহ তায়ালার তাজাল্লী প্রকাশিত হয়। কেননা আমি নিজের অস্তিত্ব ভুলে হাকিকতের প্রতি দৃষ্টি রেখে কথা বলি।আর তুমি নিজের সত্তায় দণ্ডায়মান থেকে কথা বল।
হযরত গাউসে পারেক ডিমের ও বিড়ালের কাহিনীতে পরম সত্তা, কুপ্রবৃত্তি এবং শয়তানের প্রতি ইঙ্গিত ছিল। খোদা-প্রেমিকদের ভক্ত হৃদয় তা বুঝতে পেরে হা হুতাশ ও কান্নার রোল তুলেছিল।
কারামত : হযরত গাউসে পাক রাঃ এর জীবনে অসংখ্য কারামত প্রকাশিত হয়। এখানে কয়েকটি কারামতের ঘটনা বর্ণনা করা হল।
সওদাগরের ধন ও জীবন রক্ষা : শেখ আবুল মাযাফফার নামে এক সওদাগর সাতশাত স্বর্ণমুদ্রা মূল্যের মালমাত্তা নিজে তেজারতের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে চাইলেন। তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলি শেখ হাম্মাদ দাব্বাস রাঃ এর কাছে স্বীয় অভিপ্রায় জ্ঞাপন করলে তিনি তাকে এসময়ে বাণিজ্য যাত্রা করতে নিষেধ করে বললেন, তুমি এখন বাণিজ্য যাত্রায় বের হলে জানে মালে ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।
একথা শুনে নিতান্ত দুঃখিত মনে সওদাগর বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর সাক্ষাৎ পেল, তখন তিনি যুবক মাত্র। সওদাগর সমুদয় বৃত্তান্ত তাঁর কাছে খুলে বলল। হযরত গাউসুর আযম রাঃ তাকে বলরেন, তুমি বাণিজ্য যাত্রা কর, ইনশাআল্লাহ লাভবান হয়ে গৃহে ফিরবে। এর ব্যতিক্রম হলে তজ্জন্য আমি দায়ী।
হযরত গাউসুল আযমের পরামর্শানুযায়ী সওদাগর সিরিয়া গমনপূর্বক পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করে তিনশত দীনার লাভ করলেন। এখন এক সহস্র দীনার সঙ্গে নিয়ে গৃহাভিমুখে ফিরে চললেন। পথিমধ্যে তিনি একস্থানে মলত্যাগ করতে বসলেন। কার্য শেষে ভুলক্রমে দীনারের তোড়াটি সেখানে রেখেই উঠে আসলেন এবং কাফেলার বিশ্রামের স্থানে এসে ঘুমায়ে পড়লেন। ঘুমের ঘোরে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, একদল দস্যু তাঁদের কাফেলা আক্রমণ করে সমস্ত মালপত্র লুণ্ঠন করে নিয়েছে এবং সকলকে হত্যা করে ফেলেছে। একজন দস্যু তরবারির আঘাতে তাকেও হত্যা করে ফেলেছে। স্বপ্ন দেখে তিনি শিহরিয়া জেগে উঠলেন। তাঁর গলায় রক্ত চিহ্নও দেখতে পেলেন এবং দেখলেন যে, সত্য সত্যই তাঁর কাফেলার সকলেই লুণ্ঠিত এবং নিহত হয়েছে, তাঁর নিজের গলা কাটা যায়নি, আঁচড় লেগেছে মাত্র। হঠাৎ তাঁর দীনারের কথা মনে পড়তেই তিনি দৌড়ায়ে গিয়ে সেখানে দেখতে পেলেন তা সেখানে পড়ে আছে, তিনি তোড়াটি নিয়ে ফিরে আসলেন।
সওদাগর দীনারের তোড়াসহ আনন্দিত মনে দেশে ফিরে আসতেই প্রথমে হযরত শেখ হাম্মাদ দাব্বাস রাঃ এর সাথে দেখা হল। তিনি বললেন, তুমি প্রথমে হযরত আবদুল কাদির রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ কর। তিনি অবশ্যই আল্লাহ পাকের প্রিয় পাত্র। তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে তোমার জন্য সতর বার দোয়া করেছেন বলেই পাগ্রতাবস্থায় তোমার যে প্রাণহানি ঘটত, তাকে আল্লাহ পাক স্বপ্নে রূপান্তরিত করে দিয়েছে।
হযরত হাম্মাদ রাঃ এর পরামর্শ অনুসারে সওদাগর তৎক্ষণাৎ হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর দরবারে পৌঁছাতেই তিনি সওদাগরকে বললেন, হাম্মাদ রাঃ বলেছেন যে, আমি তোমার জন্য সতর বার দোয়া করেছি। আল্লাহর শপথ আমি তোমার জন্য সতর বার হতে আরম্ভ করে সত্তর বার পর্যন্ত দোয়া করেছি। এই জন্যই তুমি যেরূপ বর্ণনা করেছ সেরূপ ঘটেছিল।
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, উক্ত সওদাগরের জন্য যা কিছু নির্ধারিত ছিল, হযরত শেখ হাম্মাদ রাঃ তাই জানতে পারলেন। আর হযরত গাউসুল আযম রাঃ জানতেন, আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাগণের দোয়ায় তকদিরেরও পরিবর্তন করে থাকেন, “আল্লাহ তায়ালা যা ইচ্ছা বিলুপ্ত করে দেন এবং যা ইচ্ছা ঠিক রাখেন এবং তাঁর কাছে মূল গ্রন্থ রয়েছে।” (অর্থাৎ, লওহে মাহফুজ, যাতে সবকিছুই লিপিবদ্ধ রয়েছে।)
একশত আলেমের মনের মধ্যস্থিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান : হযরত ইমাম শারানী রাঃ বলেন, হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর কারামত এবং জ্ঞান গরীমার কথা দেশময় ছড়ায়ে পড়লে বাগদাদের একশত জন আলেম তাঁকে পরীক্ষা করার মানসে প্রত্যেকে এক একটি জটিল প্রশ্ন মনে নিয়ে তাঁর মজলিশে আগমন করল। হযরত গাউসুল আযম রাঃ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকলেন। তদাবস্থায় তাঁর বক্ষ হতে একটি নূরের ঝলক বের হয়ে অভ্যাগত আলেমদের বক্ষে প্রবেশ করল। তৎক্ষণাৎ তারা সকলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল এবং অজ্ঞানাবস্থায় অস্থিরতার সাথে নিজেদের পরিধানের কাপড় ছিঁড়তে লাগল। প্রত্যেকে নিজ নিজ পাগড়ী দূরে নিক্ষেপ করল এবং যে সমস্ত প্রশ্ন মনে করে আসেছিল সবই ভুলে গেল।
অতঃপর হযরত গাউসুল আযম রাঃ ধ্যান ভঙ্গ করে নিজের আসনে বসলেন এবং এক এক করে সমাগত আলেমদের প্রত্যেকের মনের প্রশ্ন সমূহের সঠিক উত্তর প্রদান করতে লাগলেন। আলেমগণ বিস্ময়ে অবাক হয়ে হযরত গাউসুল আযমের বুযুর্গী স্বীকার করল।
গায়েবী সালাম : হযরত ইমাম হারাভী রাঃ বলেন, ঘটনাক্রমে এক সময় হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর সাথে রাত যাপন করলাম। আমি তাঁর ইবাদতের নিয়ম এইরূপ দেখলাম, ইশার নামাজের পর রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ কিছু নফল নামাজ পড়ে তিনি জিকিরে মশগুল হলেন। এর পরবর্তী তৃতীয়াংশ নফল নামাজে মশগুল থাকলেন এবং শেষ তৃতীয়াংশ নিতান্ত বিনয়ের সাথে মুরাকাবায় অতিবাহিত করলেন। সুবহে সাদিক ঘনায়ে আসলে অত্যন্ত আকুতি-মিনতির সাথে আল্লাহ তায়ালার দরবারে মুনাজাত করতে লাগলেন। ফজরের নামাজের জন্য মসজিদের দিকে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মুনাজাতেই নিমগ্ন থাকলেন। এই সময়ে তাঁর প্রতি গায়েব হতে সালাম আসতে লাগল- “সালামু আলাইকুম, সালামু আলাইকুম।”

চিলের মৃত্যু ও পুনরায় জীবন দান : একদা একটি চিল হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করতে করতে উড়ে যাচ্ছিল। তার চিৎকারে মজলিশের লোকেরা বিরক্ত হয়ে উঠছিল। হযরত গাউসুল আযম রাঃ তখনই বাতাসের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, এই চিলটির মস্তক ছিঁড়ে ফেল। তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই চিলটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তা দেখে হযরত গাউসুল আযম রাঃ নিজের আসন হতে নেমে এসে চিলটিকে ধরলেন এবং তার শরীর হাত বুলায়ে উড়তে বললেন, তৎক্ষণাৎ চিলটি জীবিত হয়ে উড়ে গেল।

একটি তাজা মুরগির জীবন লাভ : হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর ভক্ত মহিলা তাঁর সন্তানকে সঙ্গে এনে গাউসুল আযম রাঃ কে বললেন, আমার এই ছেলেটি আপনাকে খুব মহব্বত করে। অতএব, আমি তাকে আপনার জন্য ত্যাগ করলাম। হযরত গাউসুল আযম রাঃ বালকটিকে নিজের তত্ত্বাবধানে তরিকতের পথে চালিত করতে লাগলেন। বালকটি কঠোর পরিশ্রম সহকারে ইবাদত বন্দেগী ও মুজাহাদা করতে লাগল। কিছুদিন পর মাতা এসে বালকটিকে ক্ষুধা ও অনিদ্রা জনিত শীর্ণ এবং রক্তশূন্য অবস্থায় শুষ্ক রুটি খেতে দেখে দুঃখিত হল।
অতঃপর মাতা গাউসে পাকের কামরায় প্রবেশ করে পাত্রে তাজা মুরগির হাড় দেখতে পেয়ে তাঁকে বলল, হুজুর ! আমার ছেলে শুধু রুটি আহার করছে, আর আপনি মুরগির গোশত খাচ্ছেন। এই কথা শুনে হযরত গাউসে পাক হাড়গুলোর উপর হাত রেখে বললেন, আল্লাহ পাকের আদেশে দাঁড়াও। তৎক্ষণাৎ মুরগিটি জীবিত হয়ে গেল। হযরত গাউসে পাক রাঃ তখন স্ত্রী লোকটিকে বললেন, তোমার পুত্র যখন এই অবস্থায় উন্নীত হবে তখন সে যা ইচ্ছা তাই খেতে পারবে।
জ্বিনদের উপর প্রভাব : বাগদাদের এক ব্যক্তির কন্যাকে জ্বিনে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সে ব্যক্তি এসে হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর শরণাপন্ন হল। তিনি লোকটিকে এতটি স্থানে বৃত্ত অঙ্কন করে তার ভিতরে বসে দোয়া পড়তে বললেন, হযরত গাউসে পাক রাঃ এর নির্দেশ অনুসারে লোকটি তাই করল। তৎক্ষণাৎ দলে দলে জ্বিন সেখানে এসে সমবেত হতে লাগল। এমন কি, তাদের বাদশাহও এসে পৌঁছল। বাদশাহ লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি চান? লোকটি নিজ কন্যার সমুদয় ঘটনা বাদশাহের কাছে নিবেদন করল। বাদশাহের আদেশে সেই দুষ্ট জ্বিন কন্যাকে নিয়ে হাজির হল। বাদশাহ কন্যাটিকে লোকটির হাতে দিয়ে জ্বিনটির শিরশ্ছেদ করল। লোকটি বাদশাহকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা হযরত গাউসুল আযম রাঃ কে এত মান্য করেন কেন? বাদশাহ বললেন, আমরা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই থাকি না কেন, তিনি আমাদেরকে নিজ গৃহ হতে দেখতে পান এবং আমাদের প্রতি দৃষ্টি করা মাত্র আমরা ভয়ে জড়সড় হয়ে এদিক সেদিক দৌড়ায়ে পালাই।
বৃষ্টিপাত বন্ধ : হযরত গাউসুল আযম রাঃ একদিন স্বীয় মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে ওয়াজ করছিলেন। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হল। তিনি আসমানের দিকে মুখ তুলে বললেন, ইয়া আল্লাহ ! আমি মানুষকে আপনার পথ দেখাবার জন্য সমবেত করে থাকি আর আপনি তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করে দিতেছেন। এই কথাটুকু শেষ হতে না হতেই মজলিশের স্থানে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে তার চতুর্দিকে সেই মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত থাকল।

কিতাব পরিবর্তন : শায়খ আবুল মানসুর এক দিন একটি দর্শন শাস্ত্রের কিতাব বগলের নিচে নিয়ে হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর দরবারে গেলেন। তিনি কিতাবটি না দেখেই বললেন, তা তোমার কুসঙ্গী। তা ত্যাগ কর। আমি বাহ্যতঃ তা ত্যাগ করতে স্বীকার করলাম, কিন্তু অন্তরে সেই ইচ্ছা ছিল না। তা উপলব্ধি করতে পেরে হযরত গাউসে পাক রাঃ বললেন, কিতাবটি আমার হাতে দাও তো দেখি, আমি কিতাবটি তাঁর হাতে দিলে তিনি তার কয়েকটি পাতা উল্টায়ে আবার আমাকে ফিরায় দিলেন এবং বললেন, তাতে কুরআন শরীফের ফজিলত বর্ণিত আছে এবং অতি পরিশ্রম সহকারে এই কিতাবটি সংকলিত হয়েছে।
তা শুনে হযরত আবুল মনসুর রাঃ মনে মনে বললেন, তা দর্শন শাস্ত্রের কিতাব। তাতে কুরআন শরীফের ফজিলত কোথা হতে আসবে? অতিশয় বিস্ময়ের সাথে আমি কিতাবটি খুলে দেখলাম, বাস্তবিকই তাতে কুরআন শরীফের ফজিলত বর্ণিত রয়েছে। আমি তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে হযরত গাউসে পাক রাঃ বললেন, হে মনসুর যা তোমার অন্তর স্বীকার করে না, তা কখনও মুখে মেনে নিও না। তওবা কর এবং মুখ ও অন্তর এক করে নাও।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত কুষ্ঠ রোগীর আরোগ্য লাভ : এক দিন আবু গালেব ফজলু্ল্লাহ ইবনে ইসমাইল বাগদাদী হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর দরবারে এসে আরজ করল, হুজুর পাক সাঃ এর সুন্নত অনুযায়ী আমার দাওয়াত কবুল করিয়া আমার গরিবখানায় পদার্পণ করে আমাদের সৌভাগ্যশালী করুন। হযরত গাউসুল আযম রাঃ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলেন। একটু পরেই মাথা উঠায়ে বললেন, আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় হয়ত তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। আমি তোমার দাওয়াত কবুল করলাম।
নির্দিষ্ট সময়ে একটি খচ্চরে আরোহণ করে হযরত গাউসুল আযম রাঃ ফজলুল্লাহর গৃহে গমন করলেন। সেখানে আরও বহু গণ্যমান্য ও বুযুর্গ লোক উপস্থিত ছিলেন। দস্তরখানে খাদ্যসামগ্রী হাজির করা হলে সকলে দেখতে পেল, দস্তরখানের এক পাশে ঢাকনী দিয়ে ঢাকা একটি বড় ভাণ্ড রাখা আছে। মজলিশে হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর উপস্থিতির কারণে পূর্ণ নিরবতা বিরাজমান। ঢাকনা বন্ধ ভাণ্ডটি দেখে হযরত গাউসুল আযম রাঃ গৃহস্বামীকে বললেন, ভাণ্ডটি আমার সামনে আন। তা খুলে মজলিশের সকলকে দেখাও। ভাণ্ডটি খোলা হলে সকলে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল যে, তাতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটি কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত বালক রয়েছে। হযরত গাউসুল আযম রাঃ বালকটিকে বললেন, আল্লাহ তায়ালার আদেশে উঠ। তোমার সুস্থ হওয়ার সময় এসেছে। তৎক্ষণাৎ বালকটি রোগমুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সুস্থ লোকের মত চলাফেরা করল। তা দেখে সকলে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। হযরত গাউসুল আযম রাঃ সকলকে বিস্ময় বিমুগ্ধ রেখে অভুক্ত অবস্থায় মজলিশ ত্যাগ করে চলে গেলেন।

তাঁর সম্বন্ধীয় কয়েকটি ঘটনা : একবার লোকে হযরত গাউসুল আযম রাঃ কে জিজ্ঞাসা করল, হযরত ! আপনি তা করে জানতে পারলেন যে, আপনি আল্লাহর অলি? তিনি উত্তর করলেন, আমি দশ বছর বয়সে বাড়ি হতে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে দেখতাম ফেরেশতারা আমার সঙ্গে সঙ্গে চলছে। মাদ্রাসায় পৌঁছলে তারা অন্যান্য তালেবে এলেমদের বলত, আল্লাহর অলির জন্য স্থান ছেড়ে দাও। একদিন আমি এমন একজন লোককে দেখলাম, যাঁকে আমি পূর্বে কখনও দেখিনি, সেই লোকটি আমার সঙ্গীয় এক ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করল, এই বালক কে? যাকে তোমরা এত সম্মান করছ? সেই ফেরেশতা উত্তরে বলল, ইনি আল্লাহর একজন অলি। কালে ইনি অতি শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হবেন। তরিকতের ক্ষেত্রে ইনি সেই ব্যক্তি যাকে অবাধে নেয়ামত সমূহ প্রদান করা হচ্ছে। কোন পর্দা ব্যতীত যাকে দরবারে স্থান প্রদান করা হচ্ছে। কোন দলিল প্রমাণ ছাড়াই যিনি সান্নিধ্য লাভ করছেন। চল্লিশ বছর বয়সে আমি জানতে পারলাম যে, সেই জিজ্ঞাসাকারী তৎকালের আবদাল ছিলেন।
একদিন তিনি নির্জনে বসে কিছু লিখতেছিলেন, হুজরার ছাদ হতে দুই তিনবার তাঁর পাগড়ী ও কাপড়ের উপর মাটি ঝরে পড়ল। তিনি ক্রমাগত তিনবারই মাটি ঝেড়ে ফেললেন। চতুর্থবার মাটি পড়লে তিনি উপরের দিকে চোখ তুলে দৃষ্টি করতেই দেখতে পেলেন, একটি ইঁদুর ছাদ কাটছে। তার প্রতি তাঁর দৃষ্টি পতিত হওয়া মাত্র ইঁদুরটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এই করুণ দৃশ্য দেখে তিনি লেখা ছেড়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। রাবী বলেন, আমি বললাম, হযরত ! আপনার ক্রন্দন করার কারণ কি? তিনি বললেন, এই অবস্থা দেখে আমার মনে আমার মনে আশঙ্কা হল, কোন মুসলমানের প্রতি আমার মনে কষ্ট আসলে পাছে তার অবস্থাও এই ইঁদুরের মত না হয়।
একবার তিনি মাদ্রাসায় বসে অজু করতেছিলেন। একটি পাখি উড়ন্ত অবস্থায় তাঁর কাপড়ে পেশাব করে দিল। তিনি চোখ তুলে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করতেই পাখিটি মাটিতে পড়ে গেল। তিনি কাপড় ধৌত করে খাদেমকে বললেন, এই কাপড়খানা বাজারে বিক্রয় করে ফেল এবং বিক্রয় মূল্যের টাকা গরিব মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করে দাও। তা হবে এই পাখিটিকে মারার কাফফারা।
একদা তিনি এক ফকিরকে চিন্তিত মনে নির্জন স্থানে একাকী বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে বসে কি চিন্তা করছ? সে বলল, আমি নদী পার হওয়ার জন্য খেয়াঘাটে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে পয়সা কড়ি না থাকায় পার হতে না পেরে ফিরে এসেছি। অথচ, নদী পার হওয়া আমার নিতান্ত প্রয়োজন। ফকিরের কথা শেষ হতে না হতেই এক ব্যক্তি ত্রিশটি দীনারের একটি তোড়া এনে তার সামনে হাদিয়া স্বরূপ পেশ করল। তিনি তৎক্ষণাৎ তা উক্ত ফকিরকে দান করে বললেন, লও, তা দিয়ে নদী পার হও।
হযরত বড়পীর সাহেবের সমসাময়িক এক অলিয়ে কামেল তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে করেছেন, হযরত আবদুল কাদির রাঃ সদাহাস্যমুখ এবং প্রফুল্ল চেহারা, খুব দানশীল, অসীম লজ্জাশীল, আল্লাহ তায়ালার মহব্বতে নিমজ্জিত, প্রত্যেক আগন্তুককে সহজে বশকারী, পূত চরিত্র, পবিত্র গুণাবলীতে গুণান্বিত, সদয় মেহেরবাণ, কোমল হৃদয়, সঙ্গী সহচরদের সম্মানকারী, ব্যথিত ও বিপন্নদের সাহায্যকারী ছিলেন। এমন মধুরভাষী, প্রাঞ্জল ও স্থানোচিত বক্তা এবং শব্দকোষের অধিকারী আর কোন মানুষকেই দেখিনি।
কোন একজন অলি হুজুরে আকরাম সাঃ কে স্বপ্নে দেখে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুুল্লাহ সাঃ ! আমার জন্য দোয়া করুন, যেন কুরআন এবং আপনার সুন্নতের উপর থেকে আমার জীবনের অবসান হয়।
হুজুর সাঃ পরমাইলেন, ইনশাআল্লাহ এইরূপই হবে। কেন হবে না? তোমাদের পীর এবং মোর্শেদ যখন আবদুল কাদির রাঃ  তখন তোমাদের অন্তিম অবস্থা ভাল হতে বাধ্য। উক্ত অলি বলেন, এইরূপে তিনবার আমি স্বপ্নযোগে হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ এর কাছে দরখাস্ত করেছিলাম, প্রত্যেকবারই তিনি আমাকে সেই একই জবাব দান করেছেন।
একবার কয়েকজন মাশায়েখ হযরত গাউসুল আযম রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, যারা আপনার হাতে বায়াত করার সুযোগ পায়নি, শুধু আপনার প্রতি নিজেকে আন্তরিক সম্বন্ধযুক্ত বলে মনে করে, এরূপ লোক কি আপনার আসহাবের মধ্যে গণ্য হবে? এরূপ লোক কি সেই ফজিলতের শরিক হবে যা আপনার মুরিদগণের আছে? গাউসুল আযম বললেন, যে ব্যক্তি শুধু নিজকে আমার প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করেছে এবং অন্তরে আমার সাথে মহব্বত রেখেছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে কবুল করে নিবেন। তার প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন, তাকে একবার তওফীক প্রদান করবেন, যদিও তার কার্য পদ্ধতি অপছন্দনীয় হোক। এরূপ ব্যক্তি আমার মুরিদানের মধ্যে গণ্য হবে। আল্লাহ পাক অনুগ্রহপূর্বক আমার সাথে ওয়াদা করেছেন যে, আমার বন্ধুবর্গ আমার মতাবলম্বী, আমার পথের পথিক, আমার মুরিদ এবং আমাকে মহব্বতকারীকে বেহেশত দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাকে একটি রেজিষ্ট্রারী খাতা দান করে বলেছেন যে, এই খাতায় কিয়ামত পর্যন্ত যাদের নাম তালিকাভুক্ত হবে, তোমার খাতিরে তাদের সকলকে আমি মাফ করে দিলাম।
হযরত গাউসুল আযম রাঃ বলেছেন, হযরত মনসুর হাল্লাজ রাঃ এর জামানায় তাঁকে সাহায্য করার মত কেহ ছিল না। সেকালে আমি বিদ্যমান থাকলে অবশ্যই আমি তাঁর সাহায্য করতাম এবং ব্যাপার এমন ভয়াবহ পরিণতি পর্যন্ত গড়াতে পারত না।
হযরত গাউসুল আযম রাঃ বলেছেন, কেহ দুই রাকাত নামাজের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর এগার বার সূরা এখলাস পাঠ করে এবং এগার বার দরুদ শরীফ পড়ে। এইরূপে উভয় রাকাত শেষ করে এগার বার দরুদ শরীফ পড়ে ইরাকের দিকে মুখ করে আমার নাম নিয়ে আল্লাহ পাকের দরবার নিজের কোন মকসুদ পূরণের জন্য দোয়া করবে, আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহপূর্বক তার সেই পূর্ণ করবেন।  আখবারুল আখয়ার।
ওফাত : হিজরি ৫৬১ সালের রবিউসসানী মাসের প্রথম দিকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অসুখ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকলে মানুষ তাঁর জীবনের প্রতি নিরাশ হয়ে পড়ল এবং তাঁর কাছে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করল। তিনি দুনিয়াবাসীর জন্য অন্তিম যে উপদেশ রেখে যান তা এই-
একমাত্র আল্লাহকে ভয় করা এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করা তোমার কর্তব্য। আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় কর না এবং কারও কাছে কোন আশা করও না। আল্লাহ ব্যতীত আর কারও প্রতি ভরসা কর না। একমাত্র তওহীদ ভিন্ন অন্য কোন বস্তুর প্রতি নির্ভর কর না। যে তওহীদ সম্বন্ধে সকলে একমত।
অতঃপর গাউসুল আযম রাঃ বললেন, আমি কোন কিছুই পরোয়া করি না। আমি মালাকুল মাউতকেও ভয় করি না। হযরত গাউসুল আযম রাঃ এর ইন্তেকালের সময় নিকটবর্তী জেনে বহু দূর দূরান্ত হতে তাঁর অসংখ্য আশেক বাগদাদে এসে পৌঁছতে লাগল। এমন কি ঊর্ধ্ব লোক হতেও বহু পবিত্র আত্মা এবং ফেরেশতারা এসে সালাম করতে লাগলেন। তিনি রোগ শয্যায় থেকে সকলের সালামের জবাব দিতেন। তিনি নিজ আওলাদগণকে শয্যাপার্শ্ব হতে সরে যেতে বললেন। তিনি আরও বললেন, আমি বাহ্যত তোমাদের মধ্যে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তোমাদের ও আমার মধ্যে আসমান জমিন ব্যবধান। তোমাদের ছাড়া এখানে বহু আল্লাহর বান্দা আগমন করেছেন, যাদের তোমরা দেখতে পাচ্ছ না। তাঁদের জন্য জায়গা ছেড়ে দাও, তাঁদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।
এগারই রবিউসসানী এশার নামাজের পর তিনি খুব দীর্ঘ মুনাজাত করলেন। অতঃপর বললেন, আমি আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা করছি, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও বে-পরোয়া, তাঁর মৃত্যু নেই, তিনি কাওকে ভয় করেন না। বান্দার প্রতি বল প্রয়োগে বান্দাকে মৃত্যুদানে তাঁর ক্ষমতা অপ্রতিহত। আমি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, আল্লাহ ব্যতীত কোনই মাবুদ নেই, মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ তাঁর প্রেরিত রাসূল। শেষোক্ত বাক্যটি তাঁর মুখ হতে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রাণবায়ু বের হয়ে জান্নাতের মুখে প্রস্থান করল।
দাফন : তাঁর শেষ দর্শন লাভের জন্য দূরবর্তী ও নিকটবর্তী অগণিত লোক পূর্ব হতেই বাগদাদ নগরে এসে সমবেত হয়েছিল। ফল এই দাঁড়াল যে, শহরের বাড়ি ঘরে, রাস্তা ঘাটে ও মাঠে এত জনসমাগম হল যে, লোক চলাচল একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ল। কাজেই দিনের বেলায় তাঁকে দাফন করা সম্ভব হল না। তাই রাত্রিকালে মাদ্রাসায়ে কাদেরিয়ার বারান্দায় তাঁকে দাফন করা হল।
তাঁর ২৭ জন পুত্র ও ২২ জন কন্যা ছিল। তন্মেধ্যে কেহ কেহ তাঁর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করে।

অমিয়বাণী :
হযরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রাঃ বলেছেন,
আল্লাহ পাকের রহমতের ভরসায় থেকে ইবাদত বন্দেগী না করায় তুমি তা থেকে দূরে সরে পড়েছ। তুমি ভালকে মন্দ এবং মন্দকে ভাল মনে করে ধোঁকায় পতিত হইও না। অন্যথায় তুমি শীঘ্রই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে এবং আযাবরূপী সাপ বিচ্ছুর দংশনে যাতনা ভোগ করবে।
আপন গৃহে অকমণ্য, দোকানে পরহেজগার, নির্জন কক্ষে বেঈমান, কাফের কিন্তু ওয়াজের মিম্বরে মহা দরবেশ ও সিদ্দিক, আজকাল এমন লোকের সংখ্যা অনেক বেশি।
মনে রেখ চিরকাল দুনিয়াতে থেকে আমোদ প্রমোদ করার জন্য তুমি সৃষ্ট হওনি। তোমার মধ্যে আল্লাহ পাকের অসন্তোষজনক যে সমস্ত কাজ বা স্বভাব আছে তা পরিত্যাগ পূর্বক নিজের অবস্থা পরিবর্তন সাধন কর। তুমি কেবল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কলেমা পাঠ করাকেই যথেষ্ট মনে কর না, এর সঙ্গে আমল যোগ না করলে শুধু কলেমা পাঠ তোমার কোনই লাভ হবে না।
তোমাদের ধনের কিয়দংশ দরিদ্রকে দান কর। সামর্থ থাকলে ভিক্ষুককে কিছু না দিয়ে ফিরায়ে দিও না। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে দান করার ক্ষমতা দিয়েছেন, তজ্জন্য তাঁর নামে দান করে তাঁর সেই দানের শোকর কর। ভিক্ষুক আল্লাহর তরফ হতে উপহার স্বরূপ তোমার কাছে প্রেরিত হয়ে থাকে। অতএব, দান করার সামর্থ সত্ত্বেও তাকে কিছু না দিয়ে প্রেরকের কাছে ফিরায়ে দেয়া নিতান্ত আফসূসের বিষয়।
কেহ তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, আমার এই অন্তরদৃষ্টিহীনতা আর কতদিন থাকবে? হযরত গাউসুল আযম বললেন, যে পর্যন্ত তুমি কোন কামেল পীরের শরণাপন্ন না হবে, তাঁর গৃহের চৌকাঠকে নিজের বালিশ না বানাবে এবং তাঁর নির্দেশ অনুসারে কঠোর সাধনায় লিপ্ত না হবে, সে পর্যন্ত তুমি অন্তরদৃষ্টি লাভ করতে পারবে না।
যে ব্যক্তি আহারের পর (হিসাব প্রদানের ভয়ে) রোদন করে, আর যে ব্যক্তি আহার করার পর উদাস মনে হাস্য কৌতূকে লিপ্ত হয়, তারা উভয়ে কি সমান? কখনই নয়। আহারের সময়েও নিজের মনকে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিবদ্ধ রাখ, তাহলে খাদ্যদ্রব্যের মন্দ প্রভাব বা ফল হতে রক্ষা পাবে। যে খাদ্যদ্রব্যের গুণ তোমার জানা নেই, তা কোন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের হাতে আহার করাই শ্রেয়।
নামাজে অলসতা করলে তোমাদের সাথে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
সেজদারত অবস্থায় বান্দা আল্লাহ তায়ালার সর্বাধিক নৈকট্য লাভ কর।
হে উম্মতে মুহাম্মদী ! আল্লাহ পাকের শোকর কর। কেননা, পূর্ববর্তী উম্মতগণের তুলনায় তোমাদের সামান্য কাজকে তিনি প্রচুর বলে গ্রহণ করেন। দুনিয়াতে তোমরা সকল উম্মতের পশ্চাতে এসেছ। কিন্তু কাল কিয়ামত দিবসে তোমরা সকলের অগ্রগণ্য হবে। তোমাদের মধ্যে যারা উৎকৃষ্ট হতে তাদের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কেহ হবে না। তোমরাই হবে সেদিন অন্যান্য উম্মতদের সর্দার।
যে পর্যন্ত তুমি নফস প্রবৃত্তি এবং স্বভাবের কয়েদি হয়ে থাকবে, যে পর্যন্ত রিয়াকারী ও মোনাফেকীর বশীভূত থাকবে, ইবাদতের দ্বারা মানুষকে তোমার দিকে আকর্ষণ করার চিন্তায় মগ্ন থাকবে, যে পর্যন্ত দুনিয়ার প্রতি আসক্ত থাকবে, যতদিন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর উপর নির্ভর রাখবে, ততদিন তোমার আধ্যাত্মিক সুস্থতা ও উন্নতি লাভ হবে না।
এলম আমলকে আহ্বান করে, আমল সেই ডাকে সাড়া দিলে এলম থাকে, অন্যথায় চলে যায়। অর্থাৎ, এলমের বরকত চলে যায়। কেবল পরিশ্রমটুকুই অবশিষ্ট থাকে এরূপ এলম আল্লাহ পাকের কাছে তোমার জন্য সুপারিশ করবে না। প্রয়োজনের সময় তা তোমার কাছে হতে সরে দাঁড়াবে, আমল এলমের সারবস্তু। সারবস্তু না থাকলে শুধু খোসা থেকে কি উপকার সাধন করবে? এই কারণেই এলম চলে যায়।
আমল তোমাকে আহ্বান করছে, কিন্তু তুমি তা শুনছো না। তার আহ্বান অন্তরের কান দ্বারা শ্রবণ কর এবং সেই ডাকে সাড়া দাও, তা হলে তুমি উপকৃত হবে। তোমার এলম অনুযায়ী তুমি আমল করলে এলমই তোমাকে এলম দানকারী আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য পর্যন্ত পৌঁছায়ে দিবে। তুমি জাহেরী এলম অনুযায়ী আমল করলে তোমার অন্তরে বাতেনী এলমের ঝরণা প্রবাহিত হবে এবং তোমার অন্তঃকরণকে বাতেনী এলমের দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিবে।
অধিক পরিমাণে দুনিয়া বর্জনের আশা কর না। কেননা, তাতে তুমি সংসারের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়বে, কুসংসর্গ বর্জন কর। সৎলোকের সংসর্গ লাভ কর। এমন কি, তোমার নিকটতম আত্মীয়-স্বজন মন্দ হলেও তাকে বর্জন কর, আর সৎ হলে অপরিচিত লোকের সাথেও বন্ধুত্ব কর। বন্ধুত্ব স্থাপিত হলেই সে তোমার আত্মীয় হয়ে যাবে।
অদৃষ্টে থাকুব বা না থাকুক কোন বস্তুরই অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইও না। কেননা, যা তোমার অদৃষ্টে আছে, বিনা অন্বেষণেই তুমি তা প্রাপ্ত হবে। তা অন্বেষণ করলে তোমার পরিশ্রম বৃথা যাবে। আর যা অদৃষ্টে নেই তা অন্বেষণ করলেও পাবে না। তাতে পরিশ্রম তো বিফল হবেই তদুপরি বঞ্চিত হওয়ার কষ্ট তোমার জন্য ভীষণ হয়ে দাঁড়াবে। হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন,যে বস্তু অদৃষ্টে নেই তা অন্বেষণ করা বান্দার জন্য আল্লাহ তায়ালার শাস্তিসমূহের অন্যতম।
স্রষ্টার বিরুদ্ধে সৃষ্টের কোন অভিযোগ করও না। কোন অভিযোগ থাকলে তাঁরই কাছে পেশ কর। তিনি সর্বশক্তিমান। অপর কেহই কিছু করতে পারবে না।
সংসাররূপ অতল সাগর হতে সতর্ক থাক। এই সাগরে নিমগ্ন হয় না এমন লোক অতি অল্প। আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা এই সাগর হতে রক্ষা করেন।
দুনিয়া অর্জন করতে গিয়ে রাত্রিকালে লাকড়ি সংগ্রহকারীর মত হইও না। অন্ধকার রাতে লাকড়ি আহরণ করতে গেলে হাতে লাকড়িও আসতে পারে বিষধর সাপও আসতে পারে। তোমার গতিবিধি লক্ষ্য করছি, ঘোর অন্ধকারময় অমাবশ্যা রাতে গভীর জঙ্গলে তুমি লাকড়ি সংগ্রহে ব্যস্ত আছ, যাতে নানাবিধ হিংস্র জন্তু ও বিষধর সাপ, বিচ্ছুতে পরিপূর্ণ। ফলকথা, খোদাভীতি এবং শরিয়তের আলোতে অবস্থান কর। তাহলে এই আলো তোমাকে শয়তানের ফাঁদ হতে রক্ষা করবে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে,কারও সামনে কোন নেক কাজের দ্বার খোলা হলে তাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে প্রচুর পরিমাণে নেকী হাসিল করা উচিত। কেননা, এই দরজা কখন বন্ধ করে দেয়া হবে তা সে জানে না। অতএব, হে লোকগণ আয়ু শেষ হওয়ার আগে তাকে পরম নেয়ামত বলে মনে কল। কেননা, যে কোন মুহূর্তে প্রদীপ নিভে যেতে পারে। ক্ষমতা থাকা পর্যন্ত তাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগাও। তওবার দরজা যে পর্যন্ত খোলা আছে, সে পর্যন্ত দোয়ায় রত থাক। তোমার ধর্মীয় বন্ধুগণ তোমাকে অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করলে তাতে তোমার পরম সৌভাগ্য বলে মনে কর।
হে লোকগণ ! তোমরা যা ভেঙ্গেছ তা মেরামত করে না। যা নাপাক করে ফেলেছ তা পাক করে নাও। যা বিকৃত করেছ, তা ঠিক করে নাও। যা ময়লা করেছ তা পরিষ্কার করে নাও। যা অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করেছ তা ফিরায়ে দাও। তোমার মহাপ্রভু আল্লাহ পাক হতে পলায়ন করে বেড়াইও না। পশ্চাৎপদ হয়ে থেক না। বরং তাঁর দিকে ফিরে আস।
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, দুনিয়া আখেরাতের চাষাবাদের ক্ষেত্র। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নেকীর বীজ বপন করবে, সে তার ফল স্বরূপ আখেরাতে এমন উন্নত অবস্থা প্রাপ্ত হবে যা দেখে অন্যান্য লোকের মনে হিংসা হবে। আর যে ব্যক্তি গুনাহের বীজ বপন করবে, সে আখেরাতে তার ফলস্বরূপ কেবল অনুতাপই লাভ করবে।
তুমি আপন প্রভুর নিকট হতে পলাতক গোলাম। তাঁর দিকে ফিরে যাও, তাঁর সামনে অবনত হও। অতিশয় বিনীতভাবে তাঁর আদেশ পালন কর। তাঁর নিষিদ্ধ কাজ হতে দূরে থাক। তাঁর অদৃষ্ট বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট থাক। তাঁর ইচ্ছার মধ্যে তোমার ইচ্ছাকে বিলুপ্ত করে দাও। তা পূর্ণরূপে সমাধা করতে পারলেই তুমি মহান আল্লাহ পাকের পূর্ণ দাসরূপে গণ্য হবে এবং তোমার সমুদয় কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করবেন। এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারলে তোমার অবস্থা এইরূপ হবে যে, তুমি সর্বাবস্থাতেই তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। যদি বিস্তীর্ণ দুনিয়াকে তোমার জন্য সংকীর্ণ করে দেন এবং প্রশস্ত ও উন্মুক্ত দরজাকে তোমার জন্য বন্ধ করে দেন। যদি তোমার জীবিকা নির্বাহের কোনই পথ না থাকে। তথাপি ভুলেও অপরের দরজায় যাবে না। অপরের খাদ্যও খাবে না।
তিনটি কারণে তোমাদের ধর্ম বিনষ্ট হচ্ছে- ক. অর্জিত এলম অনুযায়ী আমল না করা। খ. না জেনে আমল করা, গ. যারা এলম হাসিল করতে চায় তাদের পথে বাধার সৃষ্টি করা।
হে গাফেলগণ ! গাফলত (অমনোযোগিতা) ত্যাগ করে সচেতন হও। মনে রেখ, তোমার মন যদি আল্লাহ পাকের দিকে একপদ অগ্রসর হয়, তবে তাঁর মহব্বত তোমার দিকে দশ কদম অগ্রসর হয়ে থাকে। আশেক লোকদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য তাদের চেয়ে তিনিই অধিক আগ্রহান্বিত।
যারা দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়, আখেরাতের দ্বারা তাদের পরীক্ষা হয়। আর যারা দুনিয়া-আখেরাত উভয়ের প্রতি অনাসক্ত, মহান আল্লাহ পাকের দ্বারা তাদের পরীক্ষা হয়ে থাকে।
তোমরা এমন গাফেল হয়ে রয়েছ যে, তোমাদের দেখে মনে হয় তোমরা কখনও মরবে না, কিয়ামতের ময়দানে হাজির হবে না, মহাশক্তিমান আল্লাহ পাকের নিকট হিসাব নিকাশ দিতে হবে না। পুলসিরাতও অতিক্রম করতে হবে না। তোমাদের এরূপ অবস্থা  হওয়া সত্ত্বেও তোমরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে থাক।
প্রিয় বৎসগণ ! অতর্কিতে তোমরা জাগ্রত করার আগে তুমি নিজেই জাগ্রত হও, দ্বীনদার হও, দ্বীনদারের সংসর্গ অবলম্বন কর, আল্লাহ পাকের নির্দেশসমূহ যথাযথভাবে পালনকারীই সর্বাপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান। তাঁরাই প্রকৃত মানুষ। আর আল্লাহর নাফরমান লোকেরাই সর্বাপেক্ষা মূর্খ এবং বোকা। সৎলোকের প্রতি তাকীদ করতে গিয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ পরহেজগার দ্বীনদার, স্ত্রীলোককে বিবাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা, তা পরহেজগার হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায়।
হে প্রিয় বৎস ! দুনিয়া হাসিলের কল্পনায় মগ্ন হয়ে তুমি তোমার অন্তঃকরণ বরবাদ করছ। তোমার অদৃষ্টে যে পরিমাণ দুনিয়া নির্ধারিত পরিমাণ জীবিকা তুমি লাভ করবেই। আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান অসম্পূর্ণ হওয়ার কারণেই তুমি দুনিয়ার অন্বেষণে ব্যস্ত রয়েছ।
আল্লাহ তায়ালাকে একক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস কর, তাঁর সাথে কাউকে শরিক কর না। সর্বপ্রকার দোষত্রুটি হতে তাঁকে পবিত্র বলে বিশ্বাস কর। তাঁর প্রতি কোন প্রকার দোষারোপ করও না।
ইসলাম ধর্মের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস রাখ, এতে কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করো না। সবর অবলম্বন করো, বে-সবর হইও না, আল্লাহর পথে অবিচলিত থাক, উদ্বিগ্ন হইও না। মুনাজাত কবুল হওয়ার আশায় এন্তেজার করতে থাক, নিরাশ হইও না।
আল্লাহ তায়ালা হতে কখনও গাফেল হইও না। তওবা করতে কখনও বিলম্ব করও না। দিবারাত্র তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাক, তাহলে তোমার প্রতি আল্লাহ তায়ালার রহমত নাজিল হবে। তোমার বেহেশতে পরম সুখে বাস হবে, দোযখের আযাব হতে মুক্তি পাবে।
হযরত গাউসে পাক রাঃ বলেন, ‘আল্লাহ’ শব্দই ইসমে আযম কিন্তু এর সুফল তখনই পাওয়া যাবে, যখন জিকিরকারীর অন্তরে আল্লাহ ভিন্ন আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। ‘আল্লাহ’ শব্দ সকল দুঃসাধ্য কাজ সহজ করে দেয়। সর্বপ্রকার শোক-দুঃখ, দুশ্চিন্তা ও বিষন্নতা দূর করে দেয়। এমন কি তা বিষের ক্রিয়াও বিনষ্ট করে দেয়।
সর্বাগ্রে এলম হাসিল কর। তৎপর নির্জনতা অবলম্বন কর। কেননা, এলম হাসিল না করে যারা ইবাদতে মশগুল হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সফলতা লাভ করতে পারে না। যারা এলম হাসিল করে তদানুযায়ী আমল করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের এলম বৃদ্ধি করে থাকেন এবং বিনা ওস্তাদে, বিনা কিতাবে নিজের ভাণ্ড হতে তাদেরকে এলম দান করেন।
কারও সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে তাড়াতাড়ি কর না এবং শত্র“তা বা ঘৃণা পোষণ করতেও তাড়াহুড়া কর না। বরং উভয় ক্ষেত্রেই কুরআন ও হাদিসের কষ্টি পাথরে পরীক্ষা করে দেখ, যেন একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্যই তুমি কাউকে ভাল জানতে বা ঘৃণা করতে পার। শুধু নফসের দুরভিসন্ধির বশীভূত হয়ে যেন কারও প্রতি শত্রুতা বা ঘৃণা পোষণ না কর।
আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত পরিচয় জানে না বলেই মানুষ আল্লাহ ছাড়া অপরের কাছে কিছু প্রার্থনা করে। হালালরূজী অন্বেষণ  করাও মুমিনের নিদর্শন। মুমিন লোক কখনও অদৃষ্টের প্রতি নির্ভর করে বেকার বসে থাকে না। রুজি অন্বেষণ করে সফলতা লাভ করলে দুই সওয়াব এবং বিফল হলে শুধু অন্বেষণের জন্য এক সওয়াব লাভ করবে।
আল্লাহ ব্যতীত আর সবকিছুর আশা ভরসা ত্যাগ করে সদা আল্লাহর প্রেমে বিভোর থেকে শুধু তাঁর উপর ভরসা করে থাকাকে তাওয়াক্কুল বলে। ফলকথা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভর করে অন্যান্য সমস্ত পদার্থ হতে বে-পরোয়া ও অভাবশূন্য হয়ে যাওয়াই তাওয়াক্কুল। ফানার মাকামে উপনীত হলে মানুষ যেমন আল্লাহ ব্যতীত আর সবকিছুই ভুলে যায়, তদ্রুপ তাওয়াক্কুলের দরজায় পৌঁছলে মানুষ বাইরের জগতকে ততোধিক ভুলে যায়।
তাওয়াক্কুল ও এখলাসের হাকিকত একই। ইবাদত করে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কোন বিনিময় না চাওয়াই এখলাস।
শরিয়ত বিগর্হিত কাজ হতে দূরে থেকে শরিয়ত সম্মত নেক কাজের আমল করাই তওবা। তওবা তিন প্রকার- অনুতাপ, ভয় ও এনাবৎ। গুনাহের কাজ করার পর অনুতাপ ও অনুশোচনার সাথে তওবা করা অনুতাপ জাত তওবা। আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তওবা করাকে এনাবৎ বলে। তওবা করার পর আল্লাহহ পাক বান্দাকে নিজের রহমতের দ্বারা নিজের দিকে আকর্ষণপূর্বক নেককাজে রত করে দিলেই বুঝতে হবে তার কবুল হয়েছে।
দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হয়ে তার যাবতীয় সুখ-সম্পদ বর্জনপূর্বক দুনিয়া হতে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে আখেরাতের অনন্ত সুখ-শান্তি লাভের চেষ্টায় রত হওয়ার নাম যোহদ। দশটি কাজ হাসিল না করা পর্যন্ত কেহই পূর্ণ যোহদ হাসেল করতে পারে না। যথা- ক. স্বীয় রসনাকে সংযত করা, খ. গীবত হতে দূরে থাকা, গ. কাউকে তুচ্ছ মনে না করা বা কাউকে ঠাট্টা, বিদ্রুপ না করা, ঘ. যাকে বিবাহ করা জায়েজ এমন স্ত্রীলোকের প্রতি দৃষ্টি না করা। ঙ. সরলতা ও বিনয় অবলম্বন করা, চ. আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ও এহসান স্বীকার করতঃ শোকর করা, যেন মনে অহংকার না আসে, ছ. হীন প্রবৃত্তির লোভ-লালসা ত্যাগপূর্বক ধন দৌলত আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা, জ. নফসের আরাম ও সুযোগ সুবিধার অন্বেষণ না করা, ঝ. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও অন্যান্য ফরজ কাজগুলো খুব যত্ম ও সতর্কতার সাথে আদায় করা, ঞ. রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নত এবং শরিয়তের নির্দেশসমূহ পুংখানুপুঙ্খরূপে পালন করা এবং তাঁর স্বভাব নিজের মধ্যে ফুটায়ে তোলা।
সবরের তিনটি অবস্থা আছে- ক. সবরের সাথে শরিয়ত নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে বিরত থাকা, খ. শত কষ্ট হলেও শরিয়তের আদিষ্ট কাজগুলো যথাযথভাবে পালন করা। গ. আল্লাহ পাকের আদেশ অনুযায়ী নিজের প্রিয় বস্তুগুলো ত্যাগ করা এবং সবরের সাথে অসহনীয় বিপদ আপদের সম্মুখীন হওয়া।
সবর তিন শ্রেণীতে বিভক্ত- ক. আল্লাহর আদিষ্ট কাজ যথাযথভাবে পালন করা এবং তাঁর নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকা ‘সবর বিল্লাহ’। আনন্দিত মনে একথা প্রকাশ করে দেয়া যে, আমি আল্লাহ ছাড়া অপর কারও মুখাপেক্ষী নই, এটা ‘সবর মা আল্লাহ’। আর আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনে যে সওয়াবের প্রতিশ্র“তি এবং তাঁর নিষেধ অমান্য করাতে যে আযাবের ভয় প্রদর্শন রয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য রেখে সকল সময় শরিয়তের নির্দেশের উপর দৃঢ়পদ থাকা ‘সবর আলাল্লাহ’।
ভিতর এবং বাহির সমান রাখা এবং ভিতরকে বাহিরের চেয়ে মূল্যবান মনে  করাকে সিদক বলে। আল্লাহ পাকের অনুপম নূরের প্রতি লক্ষ্য রেখে কথা বলা এবং কাজ করাই কথা ও কাজে সিদকের প্রমাণ। আর আল্লাহ পাকের পছন্দনীয় অবস্থা হওয়াই ‘হালে সিদকের’ পরিচয়।
আল্লাহ পাকের হকসমূহ যথাযথভাবে পালন করা, কথায় ও কাজে তাঁর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করে চলা এবং ভিতরে বাহিরে তাঁর সন্তুষ্টির দিকে রুজু হওয়ার নাম ওয়াফা।
শাস্তির ভয়ে নয় বরং আল্লাহ পাকের কাছে লজ্জিত হয়ে যাবতীয় পাপ কাজ পরিত্যাগ করাকে হায়া বলে। খাঁটি বান্দ আল্লাহ তায়ালাকে সকল স্থানে উপস্থিত আছেন এবং সবকিছু দেখছেন মনে করে পাপকাজ করতে লজ্জাবোধ করে। কিন্তু পাপ কাজ বারংবার করতে করতে হৃদয় কালিমাময় হয়ে পড়লে লজ্জায় অনুভূতি সে হারায়ে ফেলে।
লোক দেখানোর মনোভাব সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে ইবাদত করাকে এখলাস বলে।
সৎ স্বভাব বা মহত্ব এই যে, তোমার মধ্যে অপরের অত্যাচার, অবিচারের কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাবে না। তোমার রসনাও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ করবে না।
তরিকতপন্থীর প্রতি দশটি উপদেশ- ক. কখনও আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে শপথ করো না, সাবধান ! তোমার মুখ হতে কখনও যেন ‘আল্লাহর কসম’ শব্দটি বের না হয়। যদি এই অভ্যাস করে নিতে পার আল্লাহতায়ালার নূরের একটি দ্বার তোমার হৃদয়ের প্রতি খুলে দেয়া হবে। খ. মিথ্যা হতে দূরে থাক। এমনকি, হাসি ঠাট্টা করেও বলো না। সত্য বলার এই অভ্যাস তোমার মধ্যে স্থায়ী হলে আল্লাহ পাক তোমার অন্তরদৃষ্টি এবং এলম দান করবেন। গ. প্রতিজ্ঞা রক্ষা কর, তাহলে তোমাকে ‘হায়া’ ও সাখাওয়াতের মর্যাদা প্রদান করা হবে। ঘ. কাও প্রতি লানৎ করবে না। তা সিদ্দিকগণের তরিক, তা হলে আল্লাহ পাক তোমার ইজ্জত বহাল রাখবেন এবং অপরের অনিষ্টকারিতা হতে তোমাকে নিরাপদে রাখবেন। ঙ. কারও জন্য বদদোয়া করও না, বরং ধৈর্যের সাথে তোমার প্রতি কৃত সকল অত্যাচার অবিচার সহ্য কর। তাহলে তুমি সকলের প্রিয়ভাজন হবে। চ. কোন মুসলমানকে নিশ্চিতরূপে কাফের, মুশরেক বা মুনাফেক বলো না, এটাই সুন্নত তরিকা। কে কাফের, কে মুশরেক বা মুনাফেক তা নিশ্চিতরূপে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। কাউকে এরূপ শব্দে অভিহিত না করলেই আল্লাহ পাকের এলমে অনধিকার চর্চা করা হতে রক্ষিত থাকবে এবং তাঁর রহমত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করবে। ছ. জাহেরি, বাতেনী সর্বপ্রকারের গুনাহ হতে দূরে থাক এবং নিজের অঙ্গ-প্রতঙ্গকেও তা হতে রক্ষা কর। তাহলে শীঘ্রই তোমার অন্তরে এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গে এর সুফল দেখতে পাবে। জ. আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারও উপর তোমার জীবিকা নির্বাহের ভার দিও না। তাহলেই নেক কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করার দায়িত্ব উত্তমরূপে পালন করতে পারবে। তাতেই রয়েছে তোমার চূড়ান্ত সম্মান এবং তাতেই বুঝা যাবে আল্লাহ তায়ালার প্রতি তোমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং পূর্ণ নির্ভর আছে কি না। ঝ. মানুষের কাছে সামান্য আশা রেখ না তাতে নিহিত রয়েছে সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাওয়াক্কুল। তা দ্বারাই যোহদ এবং পরহেজগারী হাসিল হবে। ঞ. বিনয় ও নম্রতায় অভ্যস্ত হও, সকল ইবাদত তাতেই শামিল হয়। তাতেই সর্বাধিক মর্যাদা এবং তাই পূর্ণ পরহেযগারী। আর এই স্বভাবের দ্বারাই নেককার লোকদের দলভুক্ত হওয়া যায়।
তকদীর অর্থাৎ, আল্লাহ পাকের নির্ধারণের প্রতিবাদ করলে বা অসম্মতি প্রকাশ করলে দ্বীন, তাওহীদ, তাওয়াক্কুল এবং ইখলাস নষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি তকদীরের বিরুদ্ধে অসম্মতি কাকে বলে জানেই না। বরং আল্লাহ পাকের বিধান অনুযায়ী বিপদাপদ এসে পড়লে সে আনন্দিত মনে বলে, হাঁ এইরূপ হওয়াই উচিত ছিল। মোটকথা মানুষের প্রবৃত্তি আল্লাহ পাকের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারী এবং কলহপ্রিয়। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি কামনা করে তাকে কঠোর রিয়াজতে মশগুল হতে হয়। যাতে প্রবৃত্তি দমিত হয়ে যায় এবং তার পক্ষ হতে সর্বপ্রকার অনিষ্টের আশংকা দূরীভূত হয়ে যায়। কেননা, প্রবৃত্তি বড়ই দুষ্ট এবং দুরন্ত ও কঠোর। পরিশ্রম ও রিয়াজতের দ্বারা তা প্রশান্ত হয়ে গেলে তাই আবার অশেষ মঙ্গলের উৎস হয়ে পড়ে। তখন নফস সর্বপ্রকার ইবাদত সম্পাদনে এবং পাপ কাজ বর্জনে মানুষকে আল্লাহ পাকের ইচ্ছানুরূপ চলতে সহযোগিতা করবে।
স্মরণ রেখ, যে ব্যক্তি অদৃষ্ট বিধানে সন্তুষ্ট এবংআল্লাহ তায়ালার কাজে ধৈর্য ধারণ করে, তার জন্য দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালার অশেষ সাহায্য এবং আখেরাতে অনন্ত নেয়ামত রয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন,
সবরকারীকে তাদের সবরের পুরস্কার বেহিসাব দেয়া হবে। যারা মহাবিপদে আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে সবর করে থাকে, তাঁদের দুঃখ-কষ্ট ও বিপদজনক অবস্থা গোপন থাকে না। বহু বছর ধরে তুমি যখন তাঁর অসীম দয়া ও দানসমূহ ভোগ করে আসছ, তবে এখন বিপদের সময় কিছুক্ষণের জন্য সবর কর না কেন? ক্ষণকালের জন্য সবর করে থাকাও বাহাদুরীর কাজ বটে। আল্লাহ পাক বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সবরকারীদের সাথে রয়েছেন। সুতরাং সবর অবলম্বন করে তাঁর সঙ্গী হয়ে থাক।
জেনে রাখ, পরহেযগারী, তাওয়াক্কুল, তাওহীদ ও ইবাদতে এখলাসের দ্বারাই অন্তঃকরণ ঠিক হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে এই গুণগুলোর অভাবে অন্তঃকরণ বিগড়ায়ে যায়। দেহের ভিতরে কৌটার মধ্যে বহু মূল্যবান মণিমুক্তার মত এবং ধনাগারে মধ্যে ধন-সম্পদের মত। জ্ঞানী লোকেদের দৃষ্টি মণিমুক্তা এবং ধন-সম্পদের দিকেই থাকে। পিঞ্জর, কৌটা বা ধনাগারের দিকে থাকে না।
হে আমার কওম! পূর্বকালের নেককার লোকগণ যেমন দুনেয়া ছেড়ে আল্লাহ তায়ালার হয়ে গিয়েছিলেন, তোমরাও ঠিক তেমন করে আল্লাহ তায়ালার হয়ে যাও। তাহলে আল্লাহ তায়ালা যেমন তাঁদের হয়েছিলেন তদ্রুপ তিনি তোমাদেরও হয়ে যাবেন। তোমরা যদি চাও যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের হয়ে যাক, তবে তাঁর ইবাদত করতে থাক, মুসিবতে সবর কর। তাঁর ইচ্ছার উপর সন্তুষ্ট থাক এবং তিনি তোমার ও অপরের প্রতি যাকিছু করেন তাতেও অসন্তুষ্ট হইও না।
হে বৎস ! তুমি প্রথমে নিজেকে উপদেশ দিও। তোমার আত্মসংশোধন সম্পূর্ণরূপে না হওয়া পর্যন্ত অপরকে উপদেশ দিতে যাইও না। সর্বদা নিজেকে নফসের সংশোধন চিন্তায় মগ্ন থাক।
আফসুস ! তুমি তো নিজেই ডুুবে যাচ্ছ। এমতাবস্থায় অপরকে রক্ষা করবে কিরূপে? চক্ষুস্মান ব্যক্তিই অপরকে পথ দেখাতে পারে। সন্তরণপটু ব্যক্তিই নিমজ্জমান ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে পারে। তদ্রুপ যিনি আল্লাহ তায়ালাকে চিনতে পেরেছেন, একমাত্র তিনিই মানুষকে কাফেরী, শিরক এবং গুনাহের কাজ হতে ফিরায়ে আল্লাহ তায়ালার দিকে আনয়ন করতে পারে। আর যে ব্যক্তি নিজেই আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে অজ্ঞ সে অপরকে তাঁর পথ দেখাবে কেমন করে? তুমি যে পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালাকে না চিন এবং তাঁর প্রতি আসক্ত না হয়ে পড়, যার ফলে তোমার যাবতীয় ইবাদত কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যই হতে থাকে, আর আল্লাহ ব্যতীত পার্থিব ধন-সম্পদ, সম্মান লিপ্সা ও প্রভুত্বের মোহ, বেহেশত ইত্যাদি কোন বস্তুই তোমার কাম্য না হয় এবং আল্লাহ ব্যতীত কোন রাজা বা রাজকর্মচারী, দোযখ ইত্যাদি কোন কিছুকেই ভয় না কর এবং একমাত্র আল্লাহর ভয়ই তোমার অন্তরে বিরাজ করে সে পর্যন্ত অপরকে উপদেশ দিতে যাওয়া তোমার জন্য জায়েজ নয়। মুখের অনর্গল ওয়াজে কোন ফল হয় না। বরং আল্লাহ প্রেমিকদের অন্তর হতে এখলাসের সাতে যে সমস্ত নসিহত বাণী বের হয় তাই অপরের মনে ক্রিয়া করে। এই ক্রিয়া লোক সমাবেশ অপেক্ষা নির্জনে অধিক হয়ে থাকে।
হে লোকগণ ! তকদীরের উপর আত্মসমর্পণ কর। অর্থাৎ আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তোমদের উপর যাই আসুক না কেন তাতে সন্তুষ্ট থাক। আর আবদুল কাদিরের কথা শুন। সে তকদীরের অনুকূল হবার জন্য তৎপর রয়েছে। তকদীরের প্রতি তাঁর আনুগত্যই তাঁকে কাদিরের (আল্লাহ পাকের) দিকে অগ্রসর করেছে।
হে বৎস ! পরহেযগারী অবলম্বন কর এবং শরিয়তের নির্ধারিত সীমার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখ। নফসের তাড়না, শয়তানের প্ররোচনা এবং কুসংসর্গ হতে আত্মরক্ষা কর। খাঁটি ঈমানদারগণ সর্বদা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। তাদের যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম সর্বদা বাঁধাই থাকে। মাথার পাগড়ী কখনও নামে না, তরবারি কখনও কোষবদ্ধ হয় না এবং ঘোড়া কখনও গদিশূন্য হয় না।
নিদ্রার প্রবল আক্রমণ যখন দরবেশদের অভিভূত করে ফেলে, তখন তাঁরা কেবল একটু শয়ন করে থাকে। আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় একান্ত কাতর হলেও তাঁরা জীবন রক্ষার পরিমাণ আহার গ্রহণ করেন। নিতান্ত আবশ্যক না হলে তাঁর কথা বলেন না, নীরব থাকাই তাঁদের স্বভাব। কেবল আল্লাহ তায়ালার আদেশ তাঁদেরকে জিহ্বা নাড়তে সচেতন করে। দরবেশদেরকে আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে সঞ্চালিত করেন যেভাবে কিয়ামতের দিন মানুষের অঙ্গগুলি সঞ্চালিত করবেন। বাকশীল প্রাণীগুলোকে আল্লাহ তায়ালা যেরূপ কথা বলার শক্তি দান করেছেন, তেমনিভাবেই কিয়ামতের দিন এসমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গের দ্বারাও কথা বলাবেন। নির্জীব নির্বোধ পদার্থকে তিনি সে দিন যেভাবে কথা বলাবেন, ঠিক তদ্রুপই তিনি দরবেশগণকে কথা বলার উপকরণাদি সংগ্রহ করে দেন। আল্লাহ তায়ালা যখন তাঁদের দ্বারা কোন কাজ করাতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তাঁদের সেকাজের শক্তিও দান করেন।
আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট জীবকে আযাবের ভয় প্রদর্শন করতে এবং রহমতের সুসংবাদ দিতে চাইলেন, তখন তিনি নবী ও রাসূলদের বাকশক্তি প্রদান করে তাদের কাছে পাঠালেন। অতঃপর মৃত্যু দিয়ে নবী ও রাসূলগণকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন। অতঃপর নবী-রাসূলগণের এলম অনুযায়ী আমলকারী আলেমগণকে তিনি তাঁদের স্থলাভিষিক্ত করলেন। নবীদের খলিফারূপ সেই আলেমদের মুখ হতেও আল্লাহ তায়ালা এমন সব কথা বের করেন যা সমস্ত মানবজাতির জন্য মঙ্গলজনক হয়ে থাকে। হাদিস শরীফে এসেছে, “আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী।”
হে বৎস ! নফস ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা বর্জনপূর্বক অলি আল্লাহর পদতলে পড়ে থাক। তাঁদের সম্মুখে একেবারে মাটি হয়ে যাও, তাহলেই মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সজীব করে তুলবেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ পাক জীবিত পদার্থ হতে মৃত পদার্থকে বের করে থাকেন। আর মৃত পদার্থ হতে জীবিত পদার্থকে বের করে থাকেন।”

 

হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ.

এই উপমহাদেশের মুসলমানগণ চার ইমামের পরেই হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে। তিনি ছিলেন হিন্দুস্তানের আলেমকুল শিরোমণি মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণের অগ্রদূত। খান্দানী মীরাস সূত্রে প্রাপ্ত এলম জাহেরী ও বাতেনীর অকূল সমুদ্র।
বংশ পরিচয় : হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রাঃ বংশগত পিতার দিক হতে হযরত ওমর ফারুক রাঃ এবং মাতার দিক হতে হযরত ইমাম মূসা কাযেম রাঃ এর সাথে সংযুক্ত। হযরত ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রাঃ এর পূর্ব পুরুষদের মধ্যে হযরত শায়খ মুফতী শামসুদ্দীনের নাম ইতিহাস প্রসিদ্ধ। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে দিল্লীর তিন মাইল পশ্চিমে ‘রোহতক’ নামক প্রাচীন শহরে বসতি স্থাপন করেন। তিনি একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর বংশধরগণের মধ্যে মাওলানা শাহ ওয়াজীহউদ্দীন রাঃ সম্রাট শাহ জাহানের আমলে রোহতক ছেড়ে দিল্লী চলে আসেন এবং ইমারতে মোহান্দিয়ার কাছে বসতি স্থাপন করেন। তিনি হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাঃ এর পিতামহ। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ আলেম এবং অলিআল্লাহ ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি সম্রাট শাহ জাহানের সৈন্য বাহিনীতে সাধারণ সৈন্য হিসাবে যোগদান করেন, কিন্তু বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতার ফলে অল্প দিনেই সেনাবিভাগে বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ পদে উন্নীত হন। তিনি খুব পরহেযগার এবং আবেদ ছিলেন।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ এর পিতা ছিলেন হযরত শাহ আবদুর রহিম রাঃ। তিনি একজন সুপরিচিত বুযুর্গ ছিলেন। তিনি হাদিস, তফসীর, ফেকাহ, সাহিত্য প্রভৃতি শাস্ত্রে একজন অদ্বিতীয় আলেম ছিলেন।
তাঁর মাতামহ শেখ রফীউদ্দিন মুহাম্মদ সাহেব ইন্তেকালের অব্যবহিত পূর্বে স্বীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পতি ওয়ারিশগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন। কিন্তু কনিষ্ঠা কন্যা শাহ ওয়ালী উল্লাহ সাহেবের দাদী এবং শেখ আবদুর রহিমের মাতাকে ঐসমস্ত সম্পত্তির কিছুই না দিয়ে কেবল কয়েকখানি তাসাউফের কিতাব এবং মাশায়েখগণের শাজারানামা দিলেন। তাঁর স্ত্রী তাতে বিস্মিত হয়ে বললেন, এই মেয়েটির বিবাহ কাজ এখনও বাকি, টাকা পয়সা ও বিষয় সম্পত্তির প্রয়োজন তার সকলের চেয়ে অধিক। কিন্তু তার কিছুই তাকে না দিয়ে কেবল কতকগুলো কাগজ দিলেন। শেখ রফীউদ্দীন সাহেব বললেন, ছোট মেয়েটি আমার সর্বাধিক স্নেহের, কাজেই আমার সম্পত্তির মধ্যে সমধিক মূল্যবান বস্তুগুলোই তাকে দিয়েছি।
বাদশাহ জাহাঁঙ্গীরের সৈন্য বিভাগের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী শাহ ওয়াজীহ উদ্দীনের সাথে এই কন্যার বিবাহ হয়। তাঁর ঔরসে এবং এই কনিষ্ঠা কন্যা গর্ভে সম্রাট শাহ জাহানের রাজত্ব কালে হিজরি ১০৫৪ সালে হযরত শেখ আবদুর রহিমের জন্ম। তিনি বুযুর্গী ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে সুউচ্চ অবস্থানে উন্নীত হন।
খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিম গৌরব সূর্যের অন্তিম লগ্নে সম্রাট আওরঙ্গজেবের বার্ধক্য, শারীরিক দুর্বলতা এবং মানসিক অবসাদের সুযোগে একদিকে মুসলিম শক্তি গৃহবিবাদে লিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ল। অন্যদিকে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা ও উত্তর ভারতের শিখগণ তাঁদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে লাগল। জাতির সেই চরম দুর্দিনে হিজরি ১১১৪ সালে দিল্লীর বিখ্যাত বুযুর্গ ফারূকী পরিবারে শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ জন্মগ্রহণ করেন। নবজাত শিশু ওয়ালী উল্লাহ নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম রাখা হয়েছিল আবুল ফাইয়্যায আহমদ কুতবুদ্দীন।
তাঁর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতা তাঁর জন্ম সম্বন্ধে কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর পিতা হযরত আবদুর রহীম বলেন, একদিন আমি হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাঃ এর মাজারে গিয়ে জেয়ারত করার পর মোরাকাবায় বসলে হযরত কুতুবুল আকতাবের রূহানী সুরত আমার সামনে এসে আমাকে বলল, হে আবদুর রহীম ! শীঘ্রই তুমি একটি পুত্র সন্তান লাভ করবে। তুমি একটি পুত্র সন্তান লাভ করবে। তুমি তার নাম রেখ কুতবুদ্দীন আহমদ। একথা শুনে আমার মনে সংশয় উপস্থিত হল যে, আমার স্ত্রী সন্তান প্রজনন ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। হয়ত একথা দ্বারা হযরত কুতুবুল আকতাব আমার কোন পৌত্রের জন্ম সম্বন্ধেই এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আমি এরূপ ভাবতেছিলাম এমন সময় তিনি আবার বললেন, তুমি যা বুঝেছ আমি তা বলিনি। সেই পুত্র সন্তান তোমার ঔরসেই হবে। এতটুকু বলেই তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। হযরত কুতুবুল আকতাবের এই ভবিষ্যদ্বাণীর কিছুদিন পর আমাকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে হয়েছিল। আমার এই স্ত্রীর গর্ভেই যথা সময়ে শাহ ওয়ালী উল্লাহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কুতুবুল আকতাব রাঃ নবজাত শিশুর যে নাম রাখতে বলেছিলেন, তা আমার স্মরণ না হওয়ায় আমরা তাঁকে ওয়ালী উল্লাহ নামে ডাকতে আরম্ভ করলাম। কিছুদিন পর তাঁর নির্দেশিত সেই নাম স্মরণ হওয়ায় তাঁর নাম রাখা হল, আবুল ফাইয়্যায কুতুবুদ্দীন আহমদ।
হযরত শাহ সাহেব মাতৃগর্ভে থাকাকালে একদিন এক ভিখারিণী এসে তাঁর মায়ের কাছে কিছু খাবার চাইল, তিনি তাঁকে অর্ধেকটি রুটি দান করলেন, ভিখারিণী রুটি নিয়ে চলে যাওয়ার সময় তিনি পিছন হতে ডেকে এনে বাকী অর্ধেক রুটিও দিয়ে দিলেন, ভিখারিণী আনন্দিত হয়ে রুটি নিয়ে চলে যাচ্ছিল, তিনি আবারও তাকে ডাকলেন এবং ঘরের সব রুটি তাকে দিয়ে দিলেন। এরূপ করার কারণ সম্বন্ধে তিনি জিজ্ঞাসিত হলে বললেন, আমার গর্ভের সন্তানটি ঘরের সব কটি রুটি ভিখারিণীকে দান করার জন্য আমাকে খুব তাকিদ করাতে শেষ পর্যন্ত আমি সবগুলো রুটি তাকে দান করেছি।
হযরত শাহ সাহেবের জন্মের পূর্বে একরাতে তাঁর মাতা ও পিতা তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে মুনাজাতে হাত উঠায়েছেন, এমন সময় হযরত শেখ আবদুর রহীম রাঃ দেখলেন, তাঁদের উভয়ের হাতের মাঝখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দু’খানি হাত উঠে তাঁদের সাথে মুনাজাতে শরীক হয়েছে। শেখ আবদুর রহীম মুনাজাত শেষে বিবিকে বললেন, আমাদের ভবিষ্যৎ নেকবখত সন্তানেরই এই দু’খানি হাত আমাদের সঙ্গে মুনাজাতে ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলতেছিল। হযরত শাহ সাহেব স্বয়ং বলেছেন, উক্ত ঘটনার কয়েকদিন পরেই আমার জন্ম হয়।
শিক্ষা : পাঁচ বছর বয়সে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ কুরআন শরীফ হেফজ করেন। তের বছর বয়সে হাদিস, তফসীর, দর্শন, ফেকাহ অর্থাৎ দ্বীনি এলমের সমস্ত শাখায় অগাধ জ্ঞান লাভ করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁকে বিবাহ করাবার জন্য তাঁর পিতা খুব উদগ্রীব হয়ে উঠেন, পাত্রীও স্থির হল। শেখ আবদুর রহীম শুভ কাজ তাড়াতাড়ি সমাধা করতে চাইলে পাত্রীর পিতা প্রস্তুতির জন্য কিছু সময় চাইলেন। শেখ আবদুর রহীম সাহেব বললেন, আপনারা বিলম্ব করবেন না। আমার তাড়াহুড়ার পিছনে বিশেষ রহস্য রয়েছে। পরে তা আপনারা জানতে পারবেন। সুতরাং নিতান্ত অনাড়ম্বরে সত্বর শুভকাজ সমাধা হয়ে গেল। বিবাহের অল্প কয়েকদিন পরেই পাত্রীর মাতা এবং এর কয়েকদিন পর তাঁর নানী ইন্তেকাল করেন। অল্প দিনের ব্যবধানে শ্বাশুড়ী ও নানী শ্বাশুড়ীর ইন্তেকালে হযরত শাহ সাহেব এবং স্ত্রী শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। এই বিয়োগ ব্যথা দূর না হতেই হযরত শাহ সাহেবের বিমাতা ইন্তেকাল করলেন, এর কিছু কাল পর নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে শেখ আবদুর রহীম রাঃও ইন্তেকাল করেন। এটাই ছিল পুত্রের বিবাহে তাড়াহুড়ো করার কারণ।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রাঃ সর্বশক্তি নিয়োজিত করে জাহেরি এলমের পাশাপাশি নিজ পিতাকেবলার নিকট হতে রূহানিয়্যাত ও বাতেনী এলমও অর্জন করেন। চৌদ্দ বছর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তিনি বাতেনী এলমে পূর্ণতা লাভ করে পিতার নিকট হতে খেলাফতের নিদর্শন স্বরূপ পাগড়ী লাভ করেন। এই কাজটি নিতান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সুধী সমাবেশের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল।
তাফসীর, হাদিস, দর্শন ও ফেকাহ শাস্ত্রে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ এর গভীর জ্ঞান ছিল। একথা সত্য যে, তিনি হিন্দুস্তানে হাদিস চর্চার প্রতিষ্ঠাতা। তাফসীরুল কুরআনেও তিনি ছিলেন একজন যুগ প্রবর্তক। হেকমতে এবং মানতিক ও ফালসাফা শাস্ত্রে সে সময়ে তাঁর তুলনা ছিল না। পিতার ইন্তেকালের পর তিনি সুদীর্ঘ বার বছর পিতৃ প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে রহীমিয়াতে শিক্ষকতা করেন। অল্প দিনের মধ্যে তাঁর অগাধ জ্ঞানের খ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়ায়ে পড়ে। ফলে বহু দূরবর্তী অঞ্চল হতে দ্বীনি এলমের পিপাসুগণ দলে দলে তাঁর মাদ্রাসায় এসে শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে।
শিক্ষকতা করার ফলে তাঁর এলম বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা সত্ত্বেও তাঁর জ্ঞান লাভের পিপাসা মিটল না। হাদিস ও তাফসীর বিষয়ে অধিকতর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে তিনি হেজাজ গমনের সুযোগ সন্ধানে থাকেন। ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ হেজাজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। সেই বছরই তিনি হজ্জ সমাধা করেন। অতঃপর মদিনায় রাসূলুল্লাহ সাঃ এর রওজা মোবারক জেয়ারত করেন। সেখানে তিনি এক বছর অবস্থান করে মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থানের শ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের নিকট বিভিন্নমুখী জ্ঞান অর্জন করেন।
হেজাজ সফরকালে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ শায়খ আবু তাহের মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কুর্দী মাদানী ও শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে শায়খ সুলায়মান মালেকীর কাছে এলমে হাদিস শিক্ষা করেন। তাঁদের নিকট হতে তিনি এ বিষয়ে পূর্ণতা লাভের সনদ বা সার্টিফিকেটও হাসিল করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি শায়খ তাজুদ্দীন হানাফী, মুফতিয়ে মাক্কা শায়খ সানাবী, শায়খ মুহাম্মদ আলা বাবলী, শায়খ ঈসা জাফরী, শায়খ হাসান আযীযী, শায়খ আহমদ আলী এবং শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে সালেম বসরী প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের নিকটও বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ শেখ আবু তাহের রাঃ এর নিকট হাদিস শিক্ষা করে সনদ লাভ করেন। তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক যোগ্যতা দেখে তাঁকে খেলাফতের খেরকাও পরায়ে দেন। শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ অতঃপর শেখ তাজুদ্দীন রাঃ এর খেদমতে গমন করেন। তখন সেখানে বুখারী শরীফের দাওরা চলতেছিল। তিনি তাতে শরীক হলেন। তাছাড়া হাদিসের বিশুদ্ধ ছয় কিতাবের যেস্থানে তাঁর কিছু কিছু সন্দেহ ছিল সে সকল বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে তাও তিনি দূর করে নিলেন।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ স্বীয় জীবদ্দশায় অতি অল্প দিনের মধ্যে বাদশাহ আলমগীর, বাহাদুর শাহ, জাহাঁঙ্গীর শাহ, ফররোখ শিয়ার, রাফীউদ্দৌলা, মুহাম্মদ শাহ দ্বিতীয় আলমগীর, শাহ আলম প্রমুখ বাদশাহগণকে দিল্লীর সিংহাসনে দেখেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একমাত্র বাদশাহ আলমগীর ব্যতীত আর কেউ সিংহাসনে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেননি।
বাদশাহ আলমগীর ব্যতীত অন্যান্য বাদশাহগণ ছিলেন অপরের হাতের পুতুল। স্বার্থান্বেষীদের ইশারায় সিংহাসনে বসতেন আবার তাদের ইশারায় সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য হতেন।
সম্রাট মুহাম্মদ শাহের আমলে তিনি শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ কে এলমে হাদিসের প্রসার কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। শাহ জাহানাবাদে দ্বীনি এলম শিক্ষা প্রদানের  উদ্দেশ্যে একটি বিরাট অট্টালিকা হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ এর নিকট হস্তান্তর করেন। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ তখন দিল্লীতে মাদ্রাসায়ে রহিমীয়ায় শিক্ষকতা করতেছিলেন। সম্রাট তাঁকে উক্ত মাদ্রাসার ব্যয়ভার বহন করার জন্য একখণ্ড জমিও দান করেছিলেন। শাহজাহানাবাদের এই আলীশান ইমারতে শাহ ওয়ালী  উল্লাহ এবং তাঁর মৃত্যুর পর আবদুল আজিজ রাঃ দ্বীনি এলম শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত ছিলেন। শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর পরেও দীর্ঘকাল পর্যন্ত মাদ্রাসাটিতে শিক্ষা প্রদান কাজ চলতে থাকে। অবশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস¯তূপে পরিণত হয়। দিল্লী শহরে ‘মহল্লা মাদ্রাসায়ে শাহ আবদুল আজিজ’ নামটি আজও তার ঐতিহ্য বহন করছে।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহর চিন্তাধারা : যৌবনের প্রারম্ভেই হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ পাক ভারতের মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সূত্রপাত দেখতে পেয়েছিলেন। সুতরাং তিনি তখন হতেই চিন্তা করতে লাগলেন, এই জাতিকে কেমন করে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করা যায়। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, শুধু শাসন ক্ষমতা কোন জাতিকে বাঁচায়ে রাখতে পারে না। যদি তাই হত, তবে শত শত বছর ধরে শাসন ক্ষমতা হাতে থাকার পরও মুসলমানদের এমন মর্মন্তুদ পরিণতি কখনও হতে পারত না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মুসলমানদের ঈমানী ও ইসলামী শক্তিকে জাগরিত ও সুসংহত করা ছাড়া এ জাতির অস্তিত্ব রক্ষার অন্য কোন উপায় নেই। এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ইসলামী ধর্ম দর্শন সম্বন্ধে কিতাব রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। সে সমস্ত কিতাবই পরবর্তী কালে ওহাবী আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লব, পাকিস্তান আন্দোলন প্রভৃতি জাতীয় জাগরণের ইন্ধন যোগায়েছিল।
ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণ : হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম ফারসী ভাষায় কুরআনুল করিমের তরজমা করেন। অতঃপর মুওয়াত্তা ইমাম মালেক রাঃ এর তরজমা করেন। তাঁর পুত্র শাহ আবদুল কাদির রাঃ লিখেছেন, আমার আব্বা শেখ আবদুর রহিমের সুযোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ফারসী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করেন। আমি তাঁরই অনুসরণে উর্দু ভাষায় কুরআনের তরজমা করেছি।
অমিয়বাণী :
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ বলেছেন,
বড়ই দুঃখের বিষয় এক শ্রেণীর লোক প্রত্যেক অবান্তর বিষয়কে ধর্মের অঙ্গ বলে মনে করে এবং এ সম্বন্ধে তারা মানুষের মনগড়া জাল হাদিস শুনায়ে থাকে। পদে পদে তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, তাদের মনে রাখা উচিত মানুষের জীবন সুন্দর ও সুখী করার উদ্দেশ্যেই ধর্মের সৃষ্টি। তারা বিবেক বিবর্জিত মাত্রা জ্ঞানহীন লোকের কথাকেই প্রামাণ্য মনে করে থাকে। তারা এক গোলক ধাঁ ধাঁ সৃষ্টি করে রাখে। প্রত্যেক ব্যাপারে ধর্মের দোহাই দেয়া তাদের খাম-খেয়ালী। তারা ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতাও হারায়ে ফেলেছে। তাদের কর্তব্য সত্য, সুন্দর ও সাধনার পথ অবলম্বন করে মানুষকে সেদিকে  আহ্বান করা। তাদের মনে রাখা উচিত, আল্লাহ এবং রাসূলের প্রদর্শিত পথই আসল পথ। তারা ভুলে গিয়েছে যে, তাদের অনুসৃত পথ হযরত রাসুলুল্লাহ সাঃ এবং তাঁর সাহাবীগণের পথ নয়।
হে বনী আদম ! অন্যায়, লোভ এবং পরশ্রীকাতরতার দরুন তোমাদের নৈতিক চরিত্রের চরম অধঃপতন ঘটেছে। নারীরা পুরুষদের সাথে অশোভন আচরণ করছে। আর পুরুষরাও নারীদের নায্য প্রাপ্য হতে বঞ্চিত রাখছে। সমাজের অনেকেই হারামকে আরামদায়ক এবং হালালকে অপছন্দীয় মনে করছে। আল্লাহর কসম ! কাউকে আল্লাহ তায়ালা তার সাধ্যাতীত কাজের জন্য বাধ্য করেন না। সামর্থ্য থাকলে তোমরা আবশ্যক মত চার বিবাহ পর্যন্ত করতে পার। তা সত্ত্বেও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া কারো জন্য অনুমতি নেই।
হে বনী আদম ! তোমরা কখনও বিলাসিতা এবং অপব্যয়ের পথে যেও না, মনে রেখ, তোমরা সকলেই নিজ নিজ কাজের জন্য দায়ী হবে। তোমরা কখনও আত্মসম্মান বিসর্জন দিও না। আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের প্রতি খুবই দয়ালু। তিনি তাদেরকে সহজ এবং সম্ভব কাজেরই আদেশ করে থাকেন। তোমরা অন্ততঃ নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন করার ব্যবস্থা করবে। কখনও পরের গলগ্রহ হয়ো না। প্রত্যেক মানুষের পক্ষে কোন না কোন পথে জীবিকা উপার্জন করা কর্তব্য। সময়ের সদ্ব্যবহার করবে, অবসর মত আল্লাহর জিকির এবং কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করবে।
হে বনী আদম ! তোমরা নামাজ, রোজা ও জামাতের কথা ভুলে গেছ। তোমাদের মধ্যে সকল স্বচ্ছল লোকেরই আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, জাকাতের অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য করবে। তা হলে নিজের আত্মীয় স্বজনের সাহায্যও করা হবে জাকাতও আদায় হবে।
তোমাদের মনে রাখা কর্তব্য মুসলমানদের সুরম্য অট্টালিকায় বাস করেও সওয়াব হাসিল করতে পারে। নেকী উপার্জনের জন্য কাউকেও কোন সময় সর্বস্ব ত্যাগ করে ফকির সাজতে হয় না।
মুসলমানদের আকায়েদ এবং আমলসমূহের মূল উৎস কুরআন শরীফ এবং হাদিসে রাসূল হলেও পরবর্তীকালে তার শাখা-প্রশাখা সম্বন্ধে ইমাম ও ফকীহগণের মতভেদ দেখা দেয়, মুসলমানদের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, একদিকে যেমন স্বাধীন চিন্তার শুভ পরিণতি রয়েছে তদ্রুপ অন্যদিকে মতের গোড়ামী এবং বাড়াবাড়ি রয়েছে, তা অবশ্যই চিন্তাশীল লোকদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ।
মানুষের বাহ্যিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর যেমন বাহ্যিক শক্তি রয়েছে, তদ্রুপ তাদের প্রত্যেকটির একটি অন্তর্নিহিত বা আভ্যন্তরীণ শক্তিও রয়েছে। শরীর চর্চা দ্বারা যেমন বাহ্যিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শক্তি বৃদ্ধি পায়, তদ্রুপ সংযম ও সাধনার ফলে মানুষের আত্মিক ক্ষমতার উৎকর্ষ সাধিত হয়।
তাসাউফকে শরিয়ত হতে আলাদা করে দেখার কোন আবশ্যকতা নেই। আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে আকীদা ঠিক রাখলে এবং নিয়মিত ও যথার্থরূপে নেক আমল করতে থাকলে রূহানী কুওয়্যাত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর মতে লতীফায়ে কালবের পরিবর্তে লতিফায়ে জাহেরের গুরুত্ব অধিক। সারকথা এই যে, আল্লাহ তায়ালার নেককার বান্দাগণের শারীরিক ও রূহানী শক্তি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কার্যকরী থাকে। মানুষের এই দ্বিবিধ ক্ষমতার যখন কার্যকাল শেষ হয় তখন তা এক প্রশান্ত অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে চলে যায়, মানব জীবনের পরিসমাপ্তি এইভাবেই ঘটে থাকে।
মানুষের আকৃতিতে যেমন পার্থক্য রয়েছে তদ্রুপ তাদের চিন্তাধারা এবং রূহানী শক্তির মধ্যেও ব্যবধান রয়েছে। নবী ও রাসূলগণ মানুষ হলেও তাঁদের রূহানী শক্তির দ্বারা যা উপলব্ধি করতে পারেন সাধারণ মানুষ তা পারে না, এই অসাধারণ রূহানী শক্তি তাঁদের প্রতি আল্লাহ তায়ালারই বিশেষ দান। এই বিশেষত্ব ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তাঁরা আমাদেরই মত মানুষ।
আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাগণকে সত্য পথের দিকে আহ্বান করর জন্য যুগে যুগে দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে বহু নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন, হযরত মুহাম্মদ সাঃ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর। তাঁর প্রচারিত দর্শ বিবেক সম্মত, যুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের পার্থিব ও পারলৌকিক মঙ্গল এবং শান্তি সাধনই নবুয়তের মূল উদ্দেশ্য, কেননা পার্থিব উন্নতির ক্ষেত্রে যেহেতু ধার্মিক অধার্মিকের কোন পার্থক্য নেই। অতএব, বুঝতে হবে যে, নবুয়তের কাজ শুধু পরলোকের মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করা। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের মঙ্গল সাধনই নবুয়তের উদ্দেশ্য।
আমরা কুরআন শরীফে দেখতে পাই, যখনই কোন জাতির নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে, তখনই তাদের প্রতি নবী ও রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। তাঁদের আগমনে অধঃপতিত জাতির নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির সাথে সাথে তাদের পার্থিব মঙ্গলও সাধিত হয়েছে।
ধর্মের দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নতিতে কোন পার্থক্য নেই। উভয়বিধ উন্নতিই জাতির উন্নতি। মুসলিম জাতির ইতিহাস এর সাক্ষী। কুরআন পাকে মুসলমানদেরক এরূপে মুনাজাত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছেÑ হে আমাদের পথ প্রদর্শক, আপনি আমাদের দুনিয়া এবং আখেরাতের মঙ্গল দান করুন। এতে বুঝা যায়, পার্থিব এবং পারলৌকিক উভয় উন্নতিই কাম্য। আল্লাহর নবীগণ আজীবন সাধনা করে দুনিয়াতে এই আদর্শই প্রচার করে গিয়েছেন।
ইন্তেকাল ও আওলাদবর্গ : হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ মাত্র কয়েক দিন রোগ ভোগের পর ২৯ শে মহররম, হিজরি ১১৭৬ সালে দিল্লী শহরে ইন্তেকাল করেন। সে সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৩ বছর। তখন দিল্লীর বাদশাহ ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর। দিল্লীর জেলখানার নিকট তুর্কমান ও দিল্লীদরওয়াজার মাঝখানে ‘মেহেনদীর’ নামে একখানা অতি প্রাচীন ইমারত রয়েছে। হযরত গাউসে পাকের নামে এই বালাখানাটি নির্মিত হয়েছে। এই ঐতিহাসিক ও মোবারক স্থানে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ কে দাফন করা হয়। এখানে তাঁর পুত্র শাহ আবদুল আজিজ রাঃ, শাহ রফীউদ্দীন রাঃ, শাহ আবদুল কাদির রাঃ এবং শাহ আবদুল গণি রাঃ এবং পরিবারের অন্যান্য সকলের মাজার শরীফ রয়েছে।
রচনাবলী : হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন শাখা সম্বন্ধে ৫০-৬০খানি কিতাব রচনা করেছেন। এই সকল কিতাব তাঁর সময়ে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যা আজো মুসলিম সমাজের পথের দিশারী স্বরূপ বিদ্যমান।

 

হযরত মাওলানা শাহ্ আবদুল আজিজ দেহলভী রাঃ

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর তারিখি নাম ‘গোলাম হালীম’। আবজাদ এর হিসাব অনুযায়ী এই নামের হরফগুলোর স্থানীয় মান যোগ করলে যোগফল ১১৫৯ হয়। এই হিসাবে তাঁর জন্ম তারিখ ১১৫৯ হিজরি সাল ধরে নেয়া যেতে পারে।
তিনি ছিলেন দ্বীনি এলমের অকূল সমুদ্র এবং তৎকালীন ভারতের অন্যতম ও খ্যাতনামা অলিয়ে কামেল। প্রতি দিন ভোরে হাজার হাজার পীড়াগ্রস্ত এবং বিপন্ন লোক তাঁর দরবারে দোয়াপ্রার্থী হয়ে আসত এবং তাঁর দোয়ার বরকতে তাদের মকসুদও পুরা হত।
পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ নিজ গৃহেই প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ করেন। দুই বছর পর্যন্ত তাঁর শিক্ষার জন্য মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আশেক এবং মাওলানা খাজা মুহাম্মদ আমীনকে শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। তিনি এই ওস্তাদদ্বয়ের নিকট  প্রথমে ফারসী ও আরবি ভাষা শিক্ষা করেন। অতঃপর আরবি ব্যাকরণ, ফিকহ, উসূল, মানতিক, কালাম, আকায়েদ, অঙ্ক ও ভূতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এইরূপে তের বছর বয়সে এ সমস্ত জরুরি বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে পিতার নিকট হাদিস ও তফসীর বিষয়ে উচ্চতর ও অধিকতর জ্ঞান লাভের জন্য পড়াশুনা আরম্ভ করেন। দুই বছর অধ্যয়ন করার পর তিনি উভয় বিষয়ে পিতার নিকট হতে ‘তকমীলের সনদ’ প্রাপ্ত হন।
হাদিস ও তফসীর বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান লাভের পর শাহ আবদুল আজিজ রাঃ পিতার আদর্শ অনুযায়ী শিক্ষা দান কাজে ব্রতী হন। পুরাতন দিল্লীতে সম্রাট মুহাম্মদ শাহ দ্বীনি এলম প্রচারের জন্য শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ কে যে আলীশাহ ইমারত দান করেছিলেন, শাহ আবদুল আজিজ রাঃ তাতে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। অল্প দিনের মধ্যে তাঁর শিক্ষাদানের যোগ্যতার খ্যাতি চারদিকে ছড়ায়ে পড়ে। বহু দূর দূরান্ত হতে এলমে দ্বীন শিক্ষার্থী তাঁর মাদ্রাসায় এসে জ্ঞান পিপাসা মিটাতে থাকে। তিনি মাদ্রাসায় নিয়মিতভাবে শিক্ষাদান ছাড়াও অবসর সময়ে বিভিন্ন দিকে সফর করে ইসলাম প্রচারেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই শিক্ষা কেন্দ্রে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ এর চার পুত্রই পর্যায়ক্রমে শিক্ষকতা করেছিলেন। তাঁদের সকলের ওফাতের পর শাহ মুহাম্মদ এসহাক এই মাদ্রাসায় শিক্ষাদান করতে থাকেন। তিনি হেজাজে হিজরত করলে শাহ মাখসুসুল্লাহ এবং শাহ মুহাম্মদ মুসা সেখানে শিক্ষাদান করতে থাকেন। তাঁদের ওফাতের পর ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শাহ আবদুস সালাম শিক্ষকতার পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় মাদ্রাসাটি ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়। অদ্যাবধি সে স্থানটি মাদ্রাসা মহল্লা নামে পরিচিত।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর ওয়াজে জাদুমন্ত্রের মত শক্তি ছিল। শ্রোতাগণ তাঁর ওয়াজে মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে যেত। ওয়াজ নসিহত ছাড়াও তিনি মানুষকে নিজ পিতা হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ এর তরিকা অনুযায়ী তাসাউফের শিক্ষা দান করতেন।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ নিজ পিতাকেবলার নিকট হতে হাদিসের সনদ হাসিল করেছিলেন। বলা বাহুল্য, দুনিয়াতে এই সিলসিলাই হাদিসের উচ্চতম সনদ। তাঁর মতে মুয়াত্তা ইমাম মালেক, সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম এলমে হাদিসের মধ্যে প্রথম স্তরে স্থান পাওয়ার যোগ্য কিতাব।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ অতি উচ্চ স্তরের অলি ছিলেন। মির্জা আখতার দেহলভী বলেন, আমার পীর ভাই মির্জা বাহাদুর আমাকে একদিন শাহ আবদুল আজিজের খেদমতে নিয়ে গেলেন। তখন শাহ সাহেব উপস্থিত অভাবগ্রস্ত লোকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনতেছিলেন, কাজেই তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য আমরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিক বেলা দশটায় তিনি অবসর লাভ করে মির্জা বাহাদুরকে লক্ষ্য করে বললেন, অন্যদিন তো তুমি এত বিলম্ব কর না, আজ কি উদ্দেশ্যে এতক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছ? মির্জা সাহেব বললেন, আজ একটি বিশেষ জরুরি কাজ নিয়ে এসেছি। আমি বহু ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আপনি দয়া করে আমাকে তা হতে অব্যাহতি পাওয়ার উপায় করে দিন। তিনি বললেন, আমি তো একজন ফকীর, আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুলই আমার সম্বল। আর তোমাকে তো আল্লাহ তায়ালা শাহজাদা করেছেন। তুমি নিজেই তো এর কোন উপায় খুঁজে নিতে পার।
এই জবাব শুনে মির্জা বাহাদুর সাহেব বললেন, আপনার সাথে আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব। জীবনে আর কোন দিন কোন কাজে আপনাকে কষ্ট দেইনি। আজ শুধু একটি কাজের জন্যই আপনার কাছে আসলাম। তাতেও আপনি আপত্তি করছেন। আজ আমার এই আবদার রক্ষা না করলে জীবনে আর কখনও আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসব না।
মির্জা বাহাদুর সাহেবের এই জবাব শুনে হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ তাঁর হাত ধরে তাঁকে ঘরের উপরের তলায় নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরই আবার তাঁরা উভয়ে নিচে নেমে আসলেন। অতঃপর মির্জা সাহেব আমাকে নিয়ে শাহ সাহেবের নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করে ঘরে ফিরে আসলেন। আমি মির্জা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, শাহ সাহেব কি আপনাকে কিছু দিয়েছেন? তিনি বললেন, শাহ সাহেব আমাকে তাঁর ইবাদতখানায় নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, বল, তুমি কি চাও? আমি বললাম, আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তা শুনে তিনি নিজের দুই হাতের তালু দিয়ে ঘরের মেঝের উপর সজোরে আঘাত করলেন। অমনি ঘরের চার দেয়াল হতে টাকার স্রোত বের হতে লাগল। তিনি বললেন, নাও, তোমার যত টাকার প্রয়োজন গুণে নাও। কিন্তু স্মরণ রেখ, অতঃপর আর তোমার ফকীরী থাকবে না। আমি বললাম, এরূপ টাকা আমিও গ্রহণ করতে চাই না। আমি শুধু আপনার মন পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর বাড়িতে সর্বদা কয়েকজন ছাত্র থাকত। একদিন এক ব্যক্তি এসে সকল ছাত্রকে দাওয়াত করল। একটি ছাত্র ব্যতীত আর সকলেই দাওয়াতে গেল, নিমন্ত্রণকারীর বহু অনুরোধ সত্ত্বেও সেই ছাত্রটি দাওয়াতে গেল না। এই ঘটনাটির বর্ণনাকারী বলেন, আমার এক বন্ধু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, হযরত শাহ সাহেব একবার মামুলীভাবে ছাত্রটিকে দাওয়াতে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন, কিন্তু সে দাওয়াতে না গিয়ে শাহ সাহেবের কাছেই বসে রইল। একটু পরে হযরত শাহ সাহেব দাওয়াতকারীর বাড়ির দিকে মুখ করে বললেন, বিরিয়াণীর ঘ্রাণ আসছে। এইরূপে নিঃশ্বাস নিয়ে প্রত্যেকবার একটি উপাদেয় খাদ্যের নাম নিলেন। অতঃপর ছাত্রটিকে বললেন, এমন উত্তম খাবার ছেড়ে তুমি আমার এখানে বসে রয়েছ কেন? ইতিমধ্যে নিমন্ত্রণকারীর বাড়ি হতে ছাত্রেরা ফিরে আসল। আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমর সেখানে কি কি খেয়েছ? উত্তরে তারা ঠিক সেই জিনিসগুলোর নামই বলল, যা একটু আগে হযরত শাহ সাহেব বলেছিলেন।
শাহ মুহাম্মদ এসহাক বলেন, হাদিস শরীফে এসেছে- কোন বান্দা এমন সব কাজ করে থাকে, যা তাকে নরকের পথে টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু তার তকদীর অগ্রসর হয়ে তার ও দোযখের মধ্যস্থলে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। তখন সে আবার এমন কাজ করতে আরম্ভ করে যাতে সে জান্নাতে প্রবেশের অধিকারী হয়ে যায়।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর আমলে দিল্লীতে শিয়াদের নেতা নজফ খানের উপদ্রবে হযরত শাহ রাঃ কে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। তারা দুইবার তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। মোটকথা, শিয়াদের অত্যাচারে সর্বদাই তাঁকে সন্ত্রস্ত ও নির্বাক হয়ে থাকতে হত।
রাফেজীদের উপদ্রব ছাড়াও আরও একটি সমস্যার তিনি সম্মুখীন হয়েছিলেন। ভণ্ড দরবেশরা সর্বসাধারণের উপর এবং সম্ভান্ত পরিবারসমূহের উপর সাংঘাতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। স্বয়ং বাদশাহ এবং শাহী খান্দানের লোকেরা তাদের ভক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে তাদের দুঃসাহস এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা কোন কোন সময় উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আলেমদের সামনে এসে বলত যে, ওহে মসজিদে অবস্থানকারী ভেড়ার দল। আমাকে রেনডী রাখার, মদ খাওয়ার এবং গাজা কেনার জন্য কিছু দাও। অত্যাচারের ভয়ে বাধ্য হয়ে হযরত শাহ আবদুল কাদিরও তাদেরকে কিছু দিয়ে বিদায় করতেন। কিন্তু হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ কখনও কোন ভণ্ডের হাতে কিছু দেননি। এই শ্রেণীর ভণ্ড ফকির তার কাছে কিছু চাইলে তিনি কৌশলে ফিরায়ে দিতেন।
একদিন কুতুব সাহেবের প্রতিবেশী এক ভণ্ড দিল্লী এসে স্থানীয় আলেমদের প্রত্যেকের নিকট গিয়ে নিজেকে কুতুব সাহেবের প্রেরিত বলে দাবি করে বলত, কুতুব সাহেব আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তুমি অমুকের কাছে গিয়ে তাকে একটি পয়সা দিয়ে তার মাথায় এক গাছি লাল ফিতা বেঁধে দিবে। আমি এখন তাঁর সেই নির্দেশ পালন করতে  এসেছি। অতএব, সে তা বলে প্রত্যেকের সামনে একটি ডবল পয়সা দিয়ে তার মাথায় একগাছি লাল ফিতে বেঁধে দিতে লাগল। তার বিনিময়ে প্রত্যেকেই তাকে কিছু না কিছু দান করত। এইভাবে ভণ্ডামী করতে করতে সে হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হল এবং নিজের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল। হযরত শাহ রাঃ তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে লোক মারফত বলে দিলেন এখন তাঁর অজু নেই। বিনা অজুতে তিনি কুতুব সাহেবের দেয়া হাদিয়া স্পর্শ করবেন না। জবাব শুনে একখানা ডবল পয়সা ও কিছু লাল ফিতা শাহ সাহেবের সামনে রেখে বকশিশ পাওয়ার আশায় দাঁড়ায়ে থাকল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বকশিশ পাওয়ার সম্ভাবনা না দেখে সে বলল, হুজুর ! আপনার দরবারের কিছু তাবাররুক চাই। শাহ সাহেব বললেন, কুতুব সাহেবের নির্দেশে আপনি আমাকে হাদিয়া দিয়েছেন আমিও তাঁর তরফ হতে নির্দেশ পেলে আপনাকে বকশিশ দিব। অগত্যা সে খালি হাতে ফিরে গেল। শাহ সাহেবের দরবারে তাঁর ভণ্ডামী চলল না।
আর একবার এক ভণ্ডদলের নেতা নাসিম খান অতি গর্বের সাথে হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর দরবারে এসে কোন প্রকার সম্মান প্রদর্শন, নম্রতা বা আদব কায়দার খেয়াল করল না, বরং গোঁয়ার গোবিন্দের মত নিজেদের রীতি অনুযায়ী শাহ সাহেবকে সালাম করল এবং নীরস ভাষায় শাহ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করল, শাহ সাহেব ! আর কতকাল শরিয়তের কারাগারে বন্দী হয়ে থাকবেন। এখন শরিয়তের নাগপাশ ছিন্ন করে মুক্ত হয়ে পড়–ন।
হযরত শাহ রাঃ প্রথমেই তার কথার জবাব না দিয়ে বিনয়ের সুরে বললেন, আসুন খান সাহেব বসুন।
শাহ সাহেব খান সাহেবকে নিজের পাশে বসায়ে এদিক ওদিকের নানা বিষয়ে আলাপ জুড়ে দিলেন। অবশেষে কথা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে বললেন, আচ্ছা খা সাহেব ! আপনি কি কুরআন শরীফ পড়েছেন ?
– হাঁ পড়েছি।
– আপনি কি ফারসী ভাষা শিখেছেন?
– হাঁ শিখেছি।
– আরবি ভাষাও জানেন কি?
– হাঁ, কিছু জানি। আমি আরবি মীর কুতবী পর্যন্ত পড়েছি।
– আপনি অশ্ব চালনাও শিক্ষা করেছেন কি?
– হাঁ করেছি।
– আপনি কি ভাল তীর আন্দাজীও জানেন?
– হাঁ, জানি বৈ কি।
– আচ্ছা ফকিরী গ্রহণের পূর্বে আপনি কি কাজ করতেন?
– এর পূর্বে আমি সামরিক বিভাগে গ্র“প কমাণ্ডারের চাকরী করতাম।
– আচ্ছা বলুন তো, কুরআন পাঠ, ফারসী ও আরবী ভাষা শিক্ষা, অশ্ব চালনা ও তীরন্দাজ আয়ত্ত করতে আপনার কতদিন সময় লেগেছিল? নাসিম খা এর উত্তর প্রদান করলে শাহ সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই ফকিরি জগতে কবে প্রবেশ করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরও খা সাহেব ঠিক ঠিকই প্রদান করলেন। অতঃপর শাহ সাহেব হঠাৎ রাগত স্বরে বলে উঠলেন, রে ভণ্ড ফকির ! সোজা হয়ে আদবের সাথে বস এবং মনোযোগের সাথে আমার কথা শোন। নয় মাস তুই মাতৃগর্ভে বন্দী ছিলি, সেখান থেকে নিজের ইচ্ছায় বের হয়ে আসতে পারিসনি। অতঃপর ভূমিষ্ঠ হয়ে আড়াই বছর মাতৃস্তনের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলি, সেই বন্ধনও তুই স্বেচ্ছায় এড়াতে পারিসনি। অতঃপর কয়েক বছর তুই তোর পরিবারের বয়স্কদের হাতের আঙ্গুল ধরে বা কোলে কাঁধে চড়ে কাটায়েছিস, সেই বন্ধন হতে নিজের ইচ্ছামত মুক্ত থেকে চলাফেরা করতে পারিসনি। তারপর তোকে কুরআন পাঠের এবং বিভিন্ন ভাষা ও বিদ্যা শিক্ষার কারাগারে বন্দী থাকতে হয়েছে, সেই বন্ধন হতেও মুক্ত হতে পারিসনি। তারপর অশ্ব চালনা, তীরন্দাজী ইত্যাদি যুদ্ধ-বিদ্যা শিক্ষার কারাগারে আবদ্ধ ছিলি, আবার কিছুকাল ইংরেজ সরকারের গোলামীর নাগপাশে আবদ্ধ ছিলি। এখন আবার ভণ্ড তপস্যার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছিস। সুতরাং এই পৃথিবীতে কেমন করে নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করতে পারিস? তুই ভণ্ডামীর নাগপাশে বন্দী আর আমি শরিয়তের বন্ধনে আবদ্ধ। মনে রাখিস, ভণ্ডামীর এই ফকীরী কাঁচা রৌপ্যের মত। তাকে না পুড়ায়ে কেউ তার মূল্য দিবে না। পক্ষান্তরে আমার শরিয়ত সরকারী সীল মোহরযুক্ত খাঁটি সোনা। প্রত্যেকে নিঃসঙ্কোচে এর মূল্য দিতে বাধ্য।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর এরূপ তথ্যপূর্ণ জবাব শুনে নাসিম খান অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে সেখান থেকে উঠে গেলেন। এইরূপেই তিনি বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্তের মাধ্যমে নানা বিরূপ ভাবধারা হতে ইসলামকে রক্ষা করেছিলেন।
ওফাত ঃ হিজরি ১২৩৯ সালের রমজান মাসে হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগ ক্রমশ বাড়তে বাড়তে তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং সেই বছর ঈদুল ফিতরের এক সপ্তাহ পর ৭ই শাওয়াল ফজরের নামাজের পর ইন্তেকাল করেন।
ওফাতের পূর্ব মুহূর্তে তিনি তাঁর মূল্যবান কুতুবখানা স্বীয় দৌহিত্র মাওলানা মোহাম্মদ এসহাক রাঃ কে দান করেন এবং মাদ্রাসার দায়িত্বও তাঁর হাতে অর্পণ করেন। ওফাতের পর খান্দানের অন্যান্য বুযুর্গানের মত তাঁকেও দিল্লীর প্রসিদ্ধ কবরস্থান মেহেন্দীয়ানে দাফন করা হয়।
রচনাবলী : ১. তফসীরী আজিজি, উর্দু ভাষায় কুরআনের আংশিক তফসীর। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় এর একখানা কলমী নুসখা বিদ্যমান রয়েছে। ২. তুহফায়ে ইসনা আশারিয়্যাহ, শিয়াদের বিরুদ্ধে ফারসী ভাষায় লিখিত। এটি ১৩০৯ হিজরিতে লক্ষ্মৌ হতে প্রকাশিত হয়। ৩. বুস্তানুল মুহাদ্দেসীন, ফারসী ভাষায় লিখিত মুহাদ্দেসীনগণের সংক্ষিপ্ত জীবনী। ৪. উজালায়ে নাফেআহ, এলমে হাদিস সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত কিতাব। ৫. আজীজুল একতেবাস, আহলে বাইত এবং চার খলিফার ফজিলত সম্বন্ধে প্রামাণ্য কিতাব। ৬. সিররুশ শাহাদাতাইন, কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা সম্বন্ধে আরবি ভাষায় লিখিত। ৭. ফাতওয়ায়ে আজিজিয়া, বহু জরুরী ফতোয়ার সংকলন।

 

হযরত আহমদ শহীদ বেরলভী রাঃ

হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরলভী রাঃ ১২০১ হিজরির ৬ই সফর সোমবার রায়বেরেলী নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাইয়্যেদ এরফান সাহেব একজন সরকারী কর্মচারী ও উচ্চ পর্যায়ের বুযুর্গ ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি নিজ কর্মস্থল লক্ষ্মৌ শহরে বাস করতেন। বৃদ্ধ বয়সে সরকারী চাকরী পরিত্যাগ করে সপরিবারে রায়বেরেলীতে এসে বসবাস করতে থাকেন।
হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ মাতৃগর্ভে থাকাকালে একদিন তাঁর মাতা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর রক্ত দিয়ে একখণ্ড কাগজে কিছু লেখা হল এবং পরক্ষণেই উক্ত কাগজ খণ্ড সারা পৃথিবীতে উড়ে বেড়াতে লাগল। তিনি জাগ্রত হয়ে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে চিন্তা করে পেরেশান হয়ে পড়লেন।
অতঃপর তাঁর জামাতা সাইয়্যেদ আবদুস সোবহানের কাছে এই স্বপ্নের তাবীর জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আপনার গর্ভস্থ সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়ে কালক্রমে সারা পৃথিবীতে প্রসিদ্ধি লাভ করবে এবং উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে। তাঁর গর্ভকাল যতই পূর্ণ হতেই লাগল, ততই তাঁর গর্ভকষ্ট লাঘব হতে লাগল। মনে হতে লাগল, যেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় এখনও বহু দূরে।
হযরত আহমদ রাঃ চার বছর বয়সে মক্তবে ভর্তি হন। লেখাপড়া এবং মারেফাতের শিক্ষায় তাঁর খানদানের বিশেষ খ্যাতি ছিল। এই জন্য তাঁর অভিভাবকগণ তাঁকে উভয় বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ জন্মিল না। তাঁকে লেখাপড়ার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তাঁর ওস্তাদগণের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হল। তিন বছর পর্যন্ত মক্তবে যাতায়াত করে তিনি কুরআন শরীফের মাত্র কয়েকটি সূরা হেফজ করতে সক্ষম হন। আর লেখার বেলায়ও তিনি কেবল বর্ণমালাগুলো কোন প্রকার লিখতে শিখলেন। লেখাপড়ায় তাঁর কোনই উন্নতি না দেখে তাঁর বড় দুই ভাই সাইয়্যেদ ইব্রাহিম ও সাইয়্যেদ এসহাক সাহেব নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে তাঁকে লেখাপড়া শিখাতে যথেষ্ট চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কোন চেষ্টাই ফলপ্রসূ হতে না দেখে তাঁর পিতা পুত্রদেরকে বললেন, তাঁর ব্যাপারে আর বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই। তাঁকে নিজের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাঁর কল্যাণকর অবস্থায়ই রাখবেন। তাঁর প্রতি কড়াকড়ি করাতে কোন ফল হবে বলে মনে করি না।
বাল্যকালে হযরত সাইয়্যেদ আহমদ রাঃ জাহেরী এলম শিক্ষার প্রতি অমনোযোগী থাকলেও পরবর্তীকালে তিনি যথেষ্ট জাহেরী এলম অর্জন করতে সক্ষম হন। পড়াশুনায় তাঁর এমন অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে যে, তিনি পড়ার জন্য কিতাব খুললেই কিতাবের অক্ষরগুলো তাঁর সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যেত। তিনি কিতাবের সাদা পাতা দেখতে পেতেন। একে চক্ষু রোগ মনে করে চোখের ডাক্তার দেখানো হল। কিন্তু কোন ফল পাওয়া গেল না। অবশেষে এই সংবাদ হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, পরীক্ষা করে দেখা হোক যে, কিতাবের অক্ষরের মত অন্যান্য ক্ষুদ্র বস্তু দেখতে পায় কি না। যদি অবস্থা এরূপ হয় যে, অন্যান্য বস্তু সে দেখতে পায় তবে তা চক্ষু রোগ নয়। বরং বুঝতে হবে যে, জাহেরী এলম শিক্ষায় তাঁর সময় ক্ষেপন করা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা নয়। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এলমে লাদুনী দান করবেন।
বস্তুতঃ তাই হয়েছিল। তিনি শাহ এসহাক সাহেবের কাছে যা কিছু শিখেছিলেন, তাই ছিল জাহেরী এলমের সম্বল। অথচ পরে দেখা গিয়েছে যে, কোন বিষয়েই তাঁর জ্ঞান কম ছিল না। মেশকাত শরীফ কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি বুঝতে পারতেন। আরবি ও ফারসী ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন।
মূলতঃ যে মহান উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য আল্লাহ পাক তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন, বাল্যকাল হতেই তাঁর স্বভাবে সেই বিষয়ের প্রতি আগ্রহ দেখা যেতে লাগল। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে উঁচু করে ধরার জন্যই তাঁর জন্ম হয়েছিল। কাজেই বাল্যকাল হতেই তাঁর মধ্যে সেই প্রতিভার বিকাশ পেতে থাকে। সমবয়সী বালকদের সাথে মাঠে খেলাধুলা করতে গিয়ে তিনি যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কোন খেলাই পছন্দ করতেন না। তিনি সঙ্গী-সাথীদেরকে দুই দলে বিভক্ত করে দু’টি পরস্পর প্রতিদ্বন্দী সেনাবাহিনীরূপে খাড়া করে দিতেন। তার মধ্যে একটি দলের নেতৃত্ব তিনি গ্রহণ করে তার নাম দিতেন ‘মুজাহেদীনে ইসলাম’। আর অন্যটির নাম দিতেন ‘কাফের বাহিনী’। অতঃপর উভয় দল মুখোমুখি দাঁড়ায়ে একদল অন্য দলকে আক্রমণ করত। এরূপে তাদের মধ্যে একটি কৃত্রিম যুদ্ধ বেধে যেত। শেষ পর্যন্ত মুজাহেদীনে ইসলামের জয় হত এবং তাঁরা বিজয়োল্লাসে তকবীর ধ্বনি আরম্ভ করে দিতেন।
হযরত সাইয়্যেদ রাঃ বলেছেন, বাল্যকাল হতেই আমার মনে এই ভাবের উদয় হয়েছিল যে, একদিন আমি কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করব। কোন কোন সময় কথা প্রসঙ্গে আমার সেই মনোভাব আমি ব্যক্ত করে ফেলতাম। আমার আত্মীয়-স্বজনগণ আমার মুখে এরূপ ইসলামী জোশপূর্ণ কথা-বার্তা শুনে আনন্দ অনুভব করতেন এবং বলতেন, হয়ত সত্যও হতে পারে। কিন্তু আমার আম্মা আমার এই সকল উক্তিকে আমার প্রকৃত মনোভাবের অভিব্যক্তি বলে অন্তরের সাথে বিশ্বাস করতেন। একদিন তিনি আমাদের পরিবারের সকৈেলর সামনে ‘দীওয়ানে হাফেজ’ নামক কিতাবটি খুলে তা হতে ‘ফাল’ বের করলেন। এই সময় অবলীলাক্রমে নিম্নে লিখিত অর্থবোধক বয়েতটি বের হয়ে পড়ল, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা অনুগ্রহপূর্বক যে তলোয়ারটিকে ধারাল করেছেন কোন সৈন্য সামন্তের সাহায্য ব্যতীত সেই তলোয়ার একাই সমগ্র দুনিয়া জয় করে ফেলতে পারে।
এই ফাল বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত এক বৃদ্ধা বলে উঠলেন, বাবা কোন সৈন্য সামন্তের সাহায্য গ্রহণের প্রয়োজন তোমার হবে না। সৈন্য ব্যতীতই তুমি যুদ্ধ করবে।
জেহাদী মনোভাব শৈশব হতেই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান থাকায় তিনি বাল্যকাল হতেই শরীর চর্চায় মনোনিবেশ করেন। এতদ্ভিন্ন তিনি শৈশব হতেই কুচ-কাওয়াজ, তরবারি চালনা, বন্দুক চালনা এবং তীরন্দাজী ইত্যাদি যুদ্ধ বিষয়ক শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। বাল্যকালেই তিনি দৈহিক শক্তিতে অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেন। তাঁর পরবর্তী জীবনের কতগুলি ঘটনা হতে একথার সত্যতা পরিস্ফুট হয়ে উঠে।
হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাঃ জন্মগত আল্লাহর অলি ছিলেন। বাল্যকাল হতেই নবী করিম সাঃ এর সুন্নত এবং শরিয়তের আহকাম পালনে তাঁর দৃঢ়তা স্বভাবগত বলে মনে হত। পক্ষান্তরে যাবতীয় বেদাত ও শরিয়ত বিরোধী কাজের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা তাঁর প্রকৃতিগত স্বভাবে পরিণত হয়েছিল।
তিনি কিছু বোধশক্তিসম্পন্ন ও বয়োপ্রাপ্ত হলে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে দুর্বল, এতিম, মিসকীন ও নিরাশ্রয়া বিধবাগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সেবাকার্যে তাঁকে এরূপ লিপ্ত দেখে অন্যান্য সাইয়্যেদগণ বিস্মিত হতেন। কেউ কেউ তাঁকে তিরস্কার করে এই কাজ হতে বিরত থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন। কিন্তু তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেননি। কেননা, তিনি দুস্থ জনগণের সেবা করাকে নিজের জন্য ফরজ করে নিয়েছিলেন। মহল্লাবাসীরা প্রায় সকলেই তাঁর পূর্ব পুরুষগণের মুরিদ ও ভক্ত ছিলেন বলে সেবা শুশ্রুষা গ্রহণ করতে রাজি হত না। তারা বলত, আমরা আপনার পূর্বপুরুষগণের খাদেম। আপনার খেদমত করা আমাদের কর্তব্য। আপনার সেবা আমরা কেমন করে গ্রহণ করতে পারি?
মাখযানে আহমদিয়াহ কিতাবের রচয়িতা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আলী লিখেছেন, আমার চাচাজী হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাঃ আঠার বছর বয়সে সাতজন সঙ্গী নিয়ে লক্ষ্মৌ যাত্রা করেন। সেই কাফেলায় আমি ছিলাম। সহগামীদের সকলের উদ্দেশ্য ছিল সেখানে গিয়ে নিজ নিজ জীবিকা নির্বাহের কোন উপায় উদ্ভাবন করা। কেবল হযরত সাইয়্যেদ আহমদ রাঃ এর উদ্দেশ্য ছিল স্বতন্ত্র। আটজন যাত্রী বিশিষ্ট এই ক্ষুদ্র কাফেলার বাহনের ঘোড়া ছিল মাত্র একটি, সকলে পালাক্রমে এই একটি অশ্বে আরোহণ করতেন। হযরত সাইয়্যেদ রাঃ এর পালা আসলে তিনি নিজে ঘোড়ায় না চড়ে তা সঙ্গীদের মধ্যে দুর্বলতম ব্যক্তিকে দান করতেন। রায় বেরেলী হতে লক্ষ্মৌ পর্যন্ত ঊনপঞ্চাশ মাইল পথ সম্পূর্ণই তিনি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করলেন।
লক্ষ্মৌ পৌঁছে জীবিকা নির্বাহের কোন ব্যবস্থা হওয়ার পূর্বেই সাইয়্যেদ রাঃ এর সঙ্গীগণের খরচের টাকা নিঃশ্বেষ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে সাইয়্যেদ খানদানের অনুরাগী এক আমীর ব্যক্তি তাদের দুই বেলা আহারের ভার গ্রহণ করলেন। কিন্তু কিছুদিন পর উক্ত আমীর ব্যক্তি মাঝে মধ্যে শুধু হযরত সাইয়্যেদ রাঃ এর খাদ্যদ্রব্য পাঠাতে লাগলেন। অবশ্য হযরত সাইয়্যেদ রাঃ নিজে ক্ষুধা না লাগার ভান করে উক্ত খাদ্যদ্রব্য সঙ্গীদের খাওয়ায়ে দিয়ে নিজে অনাহারে থাকতেন। এর কিছুদিন পর লক্ষ্মৌর নওয়াব সাহেব তাঁর বন্ধুবান্ধব ও বহু সৈন্য সামন্ত নেয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে বনের দিকে যাত্রা করলেন। সাইয়্যেদ সাহেবও নিজের সঙ্গীগণসহ নওয়াব সাহেবেরই সঙ্গী হলেন। অতঃপর হযরত সাইয়্যেদ রাঃও নিজের সঙ্গীদের নিয়ে নওয়াব সাহেবের সহযাত্রী হলেন। বনের ভিতরে বহুদূর অগ্রসর হওয়ার পর শিকারী দল এক মঞ্জিলে অবতরণ করে দেখলেন যে, সাইয়্যেদ সাহেব তাদের মধ্যে নেই। সকলে পেরেশান হয়ে চতুর্দিকে তাঁর সন্ধান করতে লাগলেন। তিন দিন পর্যন্ত বহু খোঁজা-খুঁজি করে তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। সুতরাং সকলে নিশ্চিতরূপে মনে করল যে, তাঁকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। পরের দিন বনের ভিতর হতে আগত এক পথিককে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, আমি অমুক জায়গায় অমুক সময়ে একজন সুদর্শন যুবককে এক সিপাহীর পিছনে পিছনে একটি গুড়ের কলস মাথায় করে যেতে দেখেছি। যুবকের চেহারা দেখে আমি তাকে মজুর শ্রেণীর লোক বলে মনে করতে পারিনি। জিজ্ঞাসা করলে সৈনিকটি আমাকে বলল, আামার গুড়ের কলসটি বহন করার জন্য আমি বহু তালাশ করেও একজন সবল মজুর না পেয়ে অগত্যা একজন ক্ষীণ ও দুর্বল মজুরকে ঠিক করে গুড়ের কলসটি তার মাথায় দিয়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিছুদূর অগ্রসর হবার পর মজুরটি হাপাতে লাগল। কলস মাথায় করে সে আর মোটেও হাঁটতে পারছিল না। এমন সময় হঠাৎ এই যুবকটি সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে মজুরটির দুরবস্থা দেখে আমাকে বলল, তোমার মনে কি খোদার ভয় নেই? আমি তাকে বললাম, আমি গুড়ের কলসটি বহন করার জন্য একজন মজুর খুঁজতেছিলাম, এই লোকটিকে ছাড়া আর কোন মজুর পাওয়া গেল না, সেও অনাহারী। অগত্যা কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাকে ঠিক করে নিয়েছি। অতঃপর যুবকটি মজুরটির প্রতি দৃষ্টি করতেই সে কেঁদে ফেলল এবং বলল, আমি বিগত দুই দিনের উপবাসী। আহার সংগ্রহের জন্য কোন ব্যবস্থা হয়নি দেখে কিছু খাবার কেনার উদ্দেশ্যে এই গুড়ের বোঁঝা বহন করতে রাজি হয়েছি। এখন আমি একেবারে অচল হয়ে পড়েছি। লোকটির এই কথা শুনে যুবকটি বলল, তুমি তাকে পূর্ণ মজুরি দিয়ে বিদায় করে দাও। তোমার মোট আমি বহন করে তোমার গন্তব্যে পৌঁছায়ে দিব। আমি মজুরটিকে তার পূর্ণ পারিশ্রমিক দান করলে সে চলে গেল। তখন হতেই এই যুবক আমার মোট বহন করে আমার সাথে চলেছে।
আগন্তুক পথিকের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে এবং মোট বহনকারী যুবকের চেহারা সুরত ও পোষাক পরিচ্ছদের বর্ণনা জিজ্ঞাসা করে সাইয়্যেদ রাঃ এর সঙ্গীরা বুঝতে পারলেন যে, ঐ যুবক হযরত সাইয়্যেদ রাঃ ছাড়া আর কেউ নন।
হযরত সাইয়্যেদ আহমদ রাঃ সিপাহীর গুড়ের কলস তার বাড়িতে পৌঁছায়ে দিয়ে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন এবং দিল্লী পৌঁছায়ে হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর দরবারে উপস্থিত হন। হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর সাথে ইতিপূর্বে তাঁর পরিচয় ছিল না। হযরত শাহ সাহেব নিজের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী সাইয়্যেদ রাঃ কে দেখামাত্র তাঁর সাথে মুছাফাহা ও মুআনাকা করলেন। অতঃপর তাঁকে সামনে বসায়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা হতে এসেছো? সাইয়্যেদ রাঃ বললেন, রায় বেরেলী হতে। হযরত আবদুল আজিজ রাঃ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোন খান্দানের লোক? উত্তরে তিনি বললেন, সাইয়্যেদ খান্দানের। পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা সাইয়্যেদ আবু সাঈদ ও সাইয়্যেদ আবু সাঈদ নোমানকে চিন? সাইয়্যেদ রাঃ বললেন, জি হাঁ, চিনি। সাইয়্যেদ আবু সাঈদ আমার নানা এবং সাইয়্যেদ নোমান আমার চাচা হন।
সাইয়্যেদ আহমদ রাঃ এর এই জবাব শুনে শাহ সাহেব তাঁকে পুনরায় আলিঙ্গণ করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কি উদ্দেশ্যে এতদূর এসেছো। সাইয়্যেদ রাঃ বললেন, আপনার সোহবতে থেকে আল্লাহ পাকের মারেফাত লাভের উদ্দেশ্যেই এসেছি। শাহ সাহেব বললেন, আল্লাহ পাকের মারেফাত তোমার পূর্ব পুরুষগণের সম্পদ। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে তুমিও তা লাভ করবে। এই বলে হযরত শাহ সাহেব নিজের একজন খাদেমের সাথে সাইয়্যেদ সাহেবকে আকবরাবাদী মসজিদে শাহ আবদুল কাদির সাহেবের উদ্দেশ্যে খাদেমের নিকট বলে দিলেন যে, তাঁকে মারেফাতের সবক দিন, পরে আমি তাঁর পরিচয় আপনাকে বলব। সাইয়্যেদ সাহেব শাহ আবদুল কাদির সাহেবের কাছে এক বছর মারেফাত শিক্ষা করে ১২২২ হিজরি সালে শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর কাছে বায়াত হলেন এবং অল্পকালের মধ্যেই উচ্চস্তরের কামেল হয়ে গেলেন।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ রাঃ এর খেদমতে অবস্থানকালে সাইয়্যেদ রাঃ হযরত আবদুল আজিজ রাঃ কে জিজ্ঞাসাবাদ করে মারেফাত সম্বন্ধে বহু জটিল মাসয়ালার সমাধান করে নিতেন। একদিন তিনি শাহ সাহেব রাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, বেলায়েতে আম্বিয়া ও বেলায়েতে আউলিয়ার মধ্যে পার্থক্য কি?” শাহ সাহেব বললেন, আল্লাহ পাক যাকে বেলায়েতে আউলিয়া দান করেন, তিনি দিবারাত ইবাদত, রেয়াজত তথা নামাজ, রোজা ও জিকির-ফিকিরে মশগুল থাকে। জনসমাজ হতে দূরে থেকে নির্জনে বসে আল্লাহ পাকের ইবাদত করতে ভালবাসেন। গুনাহগার ও বদলোকদের উপদেশ দানে ও তাদের সংশোধন কাজে কোন প্রকার তৎপরতা দেখান না। সূফিয়ায়ে কেরামের ভাষায় তাকে ‘কোরব বিন্নাওয়াফেল’ বলা হয়। পক্ষান্তরে যাকে বেলায়েতে আম্বিয়া দান করা হয়, তাঁর অন্তর আল্লাহ তায়ালার মহব্বতে পূর্ণ হয়ে যায়। অন্য কারও বা অন্য কোন পদার্থের মহব্বতের জন্য তাঁর অন্তরে বিন্দু পরিমাণ স্থানও অবশিষ্ট থাকে না। তিনি আল্লাহর বান্দাগণকে সৎপথে আনার জন্য সর্বদা নির্ভীক চিত্তে ‘তওহীদে এলাহী’ ও ‘সুন্নাতে নববীর’ প্রচার করে বেড়ান। এই ব্যাপারে তিনি কোন নিন্দুকের নিন্দাকে বা কোন ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনাকে পরোয়া করেন না। প্রয়োজন হলে বিরোধী দলের সাথে জিহাদ করতেও কুণ্ঠিত হন না। আউলিয়া ও নেককার বান্দাগণের সোহবত হাসিল করে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন করে থাকেন, সূফীয়ায়ে কেরামের ভাষায় একে ‘কোরব্ বিলফারায়েয’ বলা হয়।
মোর্শেদের সোহবতে থেকে এইভাবে কঠোর সাধনা ও রিয়াজতে দ্বারা অল্পকাল মধ্যেই সাইয়্যেদ রাঃ মারেফাত জগতে অতি উচ্চ স্তরের কামালিয়তের অধিকারী হন। স্বয়ং হযরত শাহ সাহেব সাইয়্যেদ সাহেবের কামালিয়তের সম্বন্ধে বলেন, এই উচ্চ প্রকৃতির সাইয়্যেদ বাতেনী এলমে এমন মেধাশক্তির অধিকারী হয়েছেন যে, সামান্য ইশারায় বহু উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক বিষয়সমূহ অতি সহজে হৃদয়াঙ্গম করে অনেক উচ্চ স্তর অতিক্রম করে গিয়েছেন।
একবার রমজানের ২১শে রাতে সাইয়্যেদ সাহেব হযরত শাহ সাহেবের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যেই ‘শবে কদর’ লুকায়িত রয়েছে। এই দশ দিনের প্রত্যেক দিন রাত জাগরণ করলে শবে কদর তোমার হাত ছাড়া হবে না।
যদিও রাত জাগরণ করতে সাইয়্যেদ সাহেব পূর্ব হতেই অভ্যস্ত ছিলেন, তথাপি মোর্শেদের নিকট শবে কদরের গুরুত্বের কথা শুনে তখন হতে সারা রাত জেগে বিশেষভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদত করতে লাগলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে রমজানের ২৭ শে রাতে এশার নামাজের পর অস্বাভাবিকভাবে তাঁর উপর নিদ্রার আক্রমণ হল এবং তিনি ঘুমায়ে পড়লেন। গভীর নিদ্রার সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি তাঁকে জাগায়ে দিলেন। তিনি চোখ খুলেই নিজের ডানে হযরত রাসূল পাক সাঃ কে এবং রামে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাঃ কে দেখতে পেলেন। হুজুর সাঃ তাঁকে বললেন, বৎস ! এটাই শবে কদর। উঠ, গোসল করে আল্লাহর ইবাদতে এবং দোয়া কালামে মশগুল হও। এতটুকু বলেই তাঁরা গায়েব হয়ে গেলেন। অতঃপর সাইয়্যেদ সাহেব গোসল করে ইবাদতে মশগুল হলেন। তিনি স্বয়ং বলেছেন, সেই রাতে আমার প্রতি রহমত অবিরত ধারায় বর্ষিত হয়েছে। তখন আমি সমস্ত বৃক্ষলতা পাহাড় পর্বত ইত্যাদিকে আল্লাহ পাকের দরবারে সেজদায় পতিত দেখেছি।
সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী রাঃ শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাঃ এর সুযোগ্য পুত্রগণের নিকট জাহেরী ও বাতেনী এলম শিক্ষা করে এমন প্রেরণা লাভ করেছিলেন যে, পরবর্তীকালে তিনি হিন্দুস্তানের মুসলিম সমাজের মুক্তি ও অগ্রগতির জন্য যে কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। উত্তর ভারতে মুসলমানদের প্রতি শিখদের অমানুষিক অত্যাচারে তাদের যে চরম দুর্দশা উপস্থিত হয়েছিল তা দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি শিখ শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের সংকল্প করলেন। এই জেহাদে তাঁর ডান হাত ছিলেন হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ সাহেবের পৌত্র শাহ ইসমাইল রাঃ। তাঁরা দিল্লী ও পাক ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভ্রমণ করে উত্তর ভারতের মুসলমানদের প্রতি শিখদের অমানুষিক অত্যাচারের করুণ কাহিনী বর্ণনা করেন। ফলে এ সমস্ত কেন্দ্র হতে প্রায় সাত হাজার লোক শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। এই দলের মধ্যে শিক্ষিত ও নিয়মিত সৈন্যের সংখ্যা ছিল নিতান্ত নগণ্য। ১৭২৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁরা মধ্য ভারত হতে উত্তর পশ্চিম সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। মুজাহিদগণ প্রথমে কোটলা ভাহওয়ালপুর, শেখপুরা এবং বোলান হয়ে কাবুল প্রবেশ করেন। পরে তাঁরা খাইবার গিরি অতিক্রম করে সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশ করেন।
জেহাদ আরম্ভ করার পূর্বে হযরত সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী রাঃ লাহোরের তদানীন্তন শিখ সরকারকে পত্র লিখলেন, মুসলমানদের নায্য দাবি দাওয়া পূরণ না হলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করবেন। লাহোর হতে উক্ত পত্রের উত্তরে জেনারেল বুধসিংহের নেতৃত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করা হল। ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর নওশেরা জেলার আকোড়ো নামক স্থানে উভয় দলের মধ্যে প্রথম বার সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে বুধসিংহ পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করে। দ্বিতীয় সংঘর্ষ হয় হাজারা জেলায়। এই যুদ্ধেও মুজাহেদীনে ইসলাম জয় লাভ করেন এবং বহু অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদ প্রভৃতি তাঁদের হস্তগত হয়।  এই সময় হযরত সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী রাঃ কে আমিরুল মোমেনীন নির্বাচিত করা হয় এবং তাঁর নামে জুমা মসজিদে খোৎবা পাঠ করা হয়।
এই সময় মৌলভী মাহবুব সাহেব নামে এক মুজাহিদ কিছু সংখ্যক সৈন্য সহ সাইয়্যেদ সাহেবের সৈন্য বাহিনীতে যোগদান করেন। কিন্তু তাঁর সাথে স্থানীয় আফগানদের মতানৈক্য ঘটায় তিনি সসৈন্যে ফিরে চলে যান। এই ঘটনার পর হতে মুজাহেদীনে ইসলামের মধ্যে অসন্তোষ ও অন্তর্বিরোধ আরম্ভ হয়। বিশ্বাসঘাতরা মুসলিম বাহিনীর অবস্থান ও পরিকল্পনা সম্বন্ধে গোপন তথ্যসমূহ শিখদের কাছে প্রকাশ করে দেয়। ফলে উভয় দলের মধ্যে ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে বালাকোটের ময়দানে চরম ও শেষ জেহাদ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে শিখদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন জেনারেল রাজা শেরসিংহ। অন্তর্বিরোধ ও বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এই যুদ্ধে মুসলমানগণ দারুনভাবে পরাজয় বরণ করেন। সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরলভী রাঃ, শাহ ইসমাঈল এবং আরও বহু মুজাহেদীনে ইসলাম শাহাদতের সৌভাগ্য লাভ করেন।
এই জেহাদে পূর্ববাংলা হতে যে সকল মুজাহেদীন অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে নোয়াখালী জেলার হাজীপুর নিবাসী মাওলানা সাআদুল্লাহ, তাঁর ভাই আলীমুল্লাহ ও চট্টগ্রামের সূফী নূর মুহাম্মদ রাঃ এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হযরত শাহ আবদুল কাদের সাহেবের ভক্ত আবু বকর খান বলেন, একদিন হযরত সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী রাঃ আকবরাবাদের জামে মসজিদে ওয়াজ করতে দাঁড়ায়ে হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাঃ এর উচ্চ মর্যাদা সম্বন্ধে আবেগপূর্ণ ভাষায় বর্ণনা করলেন। মজলিসে কয়েকজন রাফেযী ছিল, তারা তা শুনে বিদ্রুপত্মক অট্টহাস্য করতে করতে মসজিদ হতে চলে যেতেছিল। এমন সময় হযরত সাইয়্যেদ রাঃ ‘ইল্লাল্লাহ’ শব্দটি উত্তেজনাপূর্ণ রবে উচ্চারণ করলেন। ফলে তৎক্ষণাৎ উক্ত রাফেজীগণ নিজ নিজ স্থানে সংজ্ঞীহীন হয়ে পড়ে গেল এবং মসজিদ এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠল যে, মসজিদে অবস্থান করা শ্রোতাদের জন্য কষ্টকর হয়ে গেল। সকলে ছটফট করতে লাগল। আবু বকর খাঁ বলেন, আমি তখন সাইয়্যেদ সাহেবের খেদমতে আরজ করলাম, হুজুর ! মজলিশের লোকদের কষ্ট হচ্ছে, এখন তাদের কষ্ট মোচনের ব্যবস্থা করুন। তিনি বললেন, বেশ তাই হোক। অমনি মজলিশে শান্তি নেমে আসল। অতঃপর সকলে এশার নামাজ আদায় করলেন। নামাজের পর উক্ত রাফেজীগণ সাইয়্যেদ সাহেবের নিকট তওবা করে সুন্নী মতবাদ গ্রহণ করলেন।
হযরত সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী রাঃ সৈনিক জীবনের এক সময়ে ইয়াগেস্তানের শাসনকর্তার নিকট দূত প্রেরণ করেন। দূত একাকীই ইয়ার মোহাম্মদ খাঁর নিকট গমন করে হযরত সাইয়্যেদ রাঃ এর প্রস্তাব পৌঁছান। ইয়ার মোহাম্মদ উত্তর করল, সাইয়্যেদ সাহেব বৃথা আমার সঙ্গে কেন যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছে। এর ফল তাঁর পক্ষে শুভ হবে না। আমি তাঁর সৈনিকদের একটি একটি করে হত্যা করব। এই বলে সে দূতকে কোড়া লাগায়ে বিদায় মুহূর্তে দূতকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, সাইয়্যেদ তোমাকে আমার কাছে আবার প্রেরণ করলে আবারও আসবে? সে বলল, আসব বৈ কি। দূত সাইয়্যেদ সাহেবের নিকট ফিরে পুরো ঘটনা বর্ণনা করল। সাইয়্যেদ সাহেব বললেন, আচ্ছা, তুমিই আবার গিয়ে তাকে বলে আস যে, সে আমার কি ক্ষতি করবে, বরং সে নিজেই প্রস্রাব পান করে মরবে। ফলকথা, যুদ্ধ বাধল এবং ইয়ার মোহাম্মদ খান পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করল। পথিমধ্যে সে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে খাদেমের কাছে পানি চাইল। খাদেম বলল, পানি নেই। তখন তৃষ্ণাকাতর হয়ে বলল, প্রস্রাব নিয়ে আস, অবশেষে তা পান করেই সে প্রাণ ত্যাগ করল।